ছাতিম ফুলের গন্ধ (পর্ব- ০৬)

বিতস্তা ঘোষাল
উপন্যাস, ধারাবাহিক
Bengali
ছাতিম ফুলের গন্ধ (পর্ব- ০৬)

রিকের কথা

রিক বসে বসে বিয়ার খাচ্ছিল। কদিন ধরেই এই পানীয়টা তাকে টানছে। কারণটা এই নয় যে সে নিয়মিত কোনো ড্রিঙ্ক না নিলে খারাপ থাকে। আসলে মেডিক্যাল এক জার্নাল থেকে সদ্য সে জেনেছে সপ্তাহে তিনদিন বিয়ার খেলে কিডনি পরিস্কার হয়।তাই সিগারেট বা মদের নেশার তুলনায় এই পানীয়টাকেই রিক বেছে নিয়েছে।

অফিসের গেস্ট হাউসের বিছানাতে বসেই পান করতে করতে রিক ফোন করল দিয়াকে। দিয়ার ফোন বেজে বেজে কেটে গেল।

এবার তার মায়ের জন্য প্রান কেঁদে উঠল। কৃষ্ণাদেবীর ফোনও বেজে গেল। কোথায় গেল সব! শালা জীবনটাই ভাজা ভাজা হয়ে গেল। বৌটাও জুটেছে তেমন। সবেতেই বিরক্তি। চুটিয়ে লুকিয়ে প্রেম করব, সব কটা মোবাইলে লক করা, তাও ঠিক ধরে ফেলবে। কোনো চিৎকার না করে ঘরে কাঁদতে বসবে আর তারপরই প্রভু কৃপা হি কেবলম বলে গান জুড়বে। কী আমার প্রভু এলেন!

রিক নিজের মনেই সেই লোকটাকে গাল দিল যে হিয়াকে এত ক্ষমা করার, সহ্য করার ক্ষমতা দিয়েছে।

কেন রে ভাই তোর ক্ষমা আমি নিতে যাব! তুই কে? দিনরাত খালি শাসন আর শাসন। এটা করা অনৈতিক, ওটা করলে বদনাম হবে… নুন ভাত খেয়ে থাকব, কিন্তু কেউ যেন আঙুল তুলে কথা না বলার সাহস পায়। কী সাধু এলেন আমার জীবনে!

দেখ তো দুদিন নুন ভাত খেয়ে , কেমন পারিস! সোনার চামচ মুখে দিয়ে তো জন্মেছিলি, তুই কী করে জানবি খিদে কাকে বলে? বেশ করব আমি আমার টাকা যেভাবে খুশি খরচ করব, জমাবো কেন? খালি জমাও জমাও করে কানের সামনে ঘেনর ঘেনর। তোর জন্য কেন জমাতে যাব! তোর কি টাকার অভাব?

এসব ভাবতে ভাবতে আবার ফোন করল দিয়াকে।

খানিক রিং হবার পর দিয়া , ইয়েস স্পিকিং , বলা মাত্র রিকের মনটা হুহু করে কেঁদে উঠল।

বাবান সোনা, কী করছ? সোনা সোনা সোনা আমার বাবান সোনা. . . রিক বলে যাচ্ছিল ।

দিয়া ফোনটা স্পিকারে দিয়ে চিৎকার করে কৃষ্ণাদেবীকে ডাকল। ওই দেখ গো আম্মা তোমার ছেলে নেশা করে পাগল হয়ে গেছে

বাবান আমি নেশা করিনি। পাগলও নই। তোমার আর আম্মার জন্য মনটা খারাপ লাগছিল।তাই ফোন করলাম।

সারাবছর দূরে থাকলে একটু আধটু মন খারাপ হয় বাবা। তুমি তো আফটার অল আমার বাবা তো নাকি!

আবেগে ভেসে গেল রিক। বাবান, এই সেদিন তোমাকে নার্সিংহোম থেকে নিয়ে এলাম। সাদা ধবধবে, এতটুকু। ডাক্তার যেই বলল, মেয়ে হয়েছে , কী যে আনন্দ হল কী বলব! মনে হল স্বর্গ সুখ পেয়ে গেলাম।

অবজেকসন বাবা। জন্ম মুহূর্তে তুমি ছিলে না। আমি হবার অনেক পরে এসেছ। আর ছোটবেলায় তুমি আমাকে মোটেই ভালবাসতে না।

কে বলেছে তোমাকে এসব? নি়শ্চয় মা। সাধে বলি জীবনটা এই শা. .

বাবা. . খুব জোরে চিৎকার করে উঠল দিয়া। মুখ সামলে কথা বলো, ভুলে যাচ্ছ উনি আমার মা, নিজের  স্ত্রীকেই যে সম্মান দিতে জানে না, সে আবার মানুষ নাকী! বলে ফোন কেটে দিল দিয়া।

মেয়েটাকে পর্যন্ত আমার থেকে কেড়ে নিচ্চে , এত বড় আস্পর্ধা ! মায়ের হয়ে চামচাগিরি! কে তোকে এত দামি দামি পোশাক, মোবাইল, ল্যাপটপ দিচ্ছে শুনি! এই বাপ না থাকলে পারতিস এত ফুটানি করতে! এত দেওয়ার পরেও খালি মা মা। কেন রে, বাপটা বুঝি কেউ নয়!  তোর মা মরলে আমার শান্তি!

বলার পরই মেজাজ বিগড়ে গেল রিকের। সত্যি কি হিয়া মরলে আমি শান্তি পাব? ও ছাড়া কে দাঁড়ায় সবকিছুতে আমার পাশে! কে মেনে নেয় এমন করে আমার সব অন্যায় !

এবার মনটা হিয়ার জন্য উথলে উঠল রিকের। বোতলের বাকি লিকুইডটা একসঙ্গে মুখে চালান করে দিয়ে হিয়াকে ফোন করল।

সুইচ অফ। নির্ঘাৎ বাড়ি নেই। কারোর সঙ্গে ঘুরছে অথবা কোনো অনুষ্ঠানে ভাষন দিচ্ছে। এত জ্ঞান যে কোথা থেকে পেল! পড়াশোনা ছাড়া বাপ-মা কিছুই কি শেখায় নি? কোথায় স্বামীর খেয়াল রাখবি, বেরবার সময় পায়ে জুতো পরিয়ে প্রনাম করবি, রাতে সেবা করবি সেসবের কোনো বালাই নেই,খালি বড় বড় বুলি।

কিন্তু আমি যে ওকে ভালবাসি সেটা ও কেন কিছুতেই বুঝতে পারে না? কেন বোঝে না কোথাও তার সঙ্গে গেলে সব লোক তাকেই গুরুত্ব দেয়, আমাকে পাত্তা না দিয়ে, আমার খুব রাগ হয়। ইচ্ছে করে মেরে হাড়গোড় গুঁড়িয়ে দিই।

পরমুহূর্তেই মনে পড়ল সে চেষ্টাও করেছে সে। বেশ করেছি বাড়ি থেকে বের করে দিয়ে।সুন্দর ছেলে দেখলেই হাসি! দেখ কেমন লাগে! রাতদুপুরে দিয়েছি ঘাড় ধাক্কা।

কিন্তু কাজটা ভাল করিনি হিয়া। বিশ্বাস করো আমার খুব কষ্ট হয়েছিল সে রাতে। অপেক্ষা করছিলাম তুমি কখন ফিরবে! সত্যি বলছি, ভেবেছিলাম তুমি এলেই জড়িয়ে ধরে ক্ষমা চাইব। কিন্তু সব গোলমাল করে দিল শা… ওই অটোওয়ালাটা। বলে কিনা রাতদুপুরে বাড়ির বৌকে বের করে দিয়ে নিশ্চিন্তে বসে আছেন? যদি কিছু হয়ে যেত তার দায় কে নিত? ফারদার এমনি করলে একদম দেব কেলিয়ে। নো পুলিস নো আইন।

একটা সামান্য  অশিক্ষিত অটোওয়ালা তোমার জন্য আমাকে বাড়ি এসে অপমান করে গেল। আর তুমি চুপ করে ঘরে ঢুকে গেলে। যদি ফেরারই ছিল তো একাই ফিরতে পারতে, লোক এনে কথা শোনাবার কী ছিল?

হিয়া তুমি কি কোনোদিন বুঝবে না আমি তোমায় কতটা ভালবাসি! শুধু তোমায় পাব বলে, যাতে তুমি অন্য মেয়েদের সঙ্গে আমার সম্পর্ক দেখে জেলাস হও ,তারজন্য এত মেয়েদের সঙ্গে নিজেকে জড়াই।তোমাকে বোঝাতে চেষ্টা করি, তুমি ফিরে না তাকালেও আমার নারীর অভাব না। কিন্তু হিয়া, তুমি কেন প্রতিবাদ করো না, কেন ঝগড়া করে আমার বিরুদ্ধে লোক জড়ো করো না!

ও; তোমার তো রুচিতে বাঁধে, তুমি তো নিজেকে সফিসটিকেটেড ভাবো, বইয়ের হকারি ছেড়ে এখন আবার লেখক হয়েছ, বুদ্ধিজীবি তাই না! এসব নিয়ে পাঁচ কান হলে তোমার সম্মান যাবে মনে করো। বেশ তুমি থাকো ব্যস্ত মহুলকে নিয়ে, নিজেকে নিয়ে। তুমি ভাব, আমি টের পাইনি মহুলের সঙ্গে তোমার কথা বার্তা! জানো আমি মহুলকে ফোন করে খিস্তি দিয়েছি। কিন্তু লোকটা বড় সজ্জন। বলে কিনা , আপনি নিশ্চিন্তে থাকুন দাদা। হিয়ার সঙ্গে আমার এরকম কোনো কিছু নেই। হিয়া বড় ভাল মেয়ে।ওকে দেখলে আমার নিজের মায়ের কথা মনে পড়ে।

মা! ও মা তুমি তো কোনো কথাই বললে না। তোমার জন্যই হিয়ার সঙ্গে আমার সম্পর্কটা এত এলোমেলো হয়ে গেল। অফিস থেকে ফেরা মাত্র তুমি হিয়ার নামে নানা কথা বলে বলে আমার মনটা বিষিয়ে দিলে। তার কোনো গুন তোমার চোখে পড়ল না মা। আমাদের সব অশান্তিতে তুমি মাথা গলিয়ে আমাকে আরো তাতিয়ে দিয়েছ ওর বিরুদ্ধে। আমাদের আড্ডার ভাল মুহূর্তে তুমি ঝগড়ার কথা তুলে এনে আমাকে উত্তেজিত করেছ, অথচ দেখ মা , ও কিন্তু তোমার প্রতি কোনো কর্তব্যের অবহেলা করে না। আর আমি তোমাকে সব সময় সাপোর্ট করতে করতে কখন যে ওর থেকে একেবারে দূরে সরে গেলাম বুঝতেই পারলাম না।

আমি খুব বোকা। হিয়া ঠিক বলে। ব্রেনলেস। কোনো সম্পর্ক আমি ধরে রাখতে পারি না। সবাই বোঝে আমি আসলে খুব বোকা। তারা আমাকে তাদের মত ব্যবহার করে নিয়ে সরে যায়। হিয়া তুমিও তো পারতে আমাকে তোমার মত ব্যবহার করতে। করলে না। পুরো নিস্পৃহ আর উদাসীন হয়ে গেলে। তোমার ঐ শান্ত দৃষ্টি আমি সহ্য করতে পারি না। তুমি কি বোঝ না কেন আমি বাড়ি থাকি না! হ্যাঁ ,তুমি ঠিক বোঝ। আমি পালিয়ে বেড়াই তোমার দৃষ্টির থেকে আড়াল খুঁজে নিতে। তোমাকে সামনে দেখলেই অসহ্য লাগে। কেন তুমি এত দয়া করো আমায়! খুব যন্ত্রনা হয় হিয়া। সত্যি বলছি তোমাকে। আমাকে আঁকড়ে ধরো। এভাবে ছেড়ে দিও না।

এভাবে চলতে চলতে আমি পুরো ক্ষয়ে যাচ্ছি। বাঁচার ইচ্ছা ক্রমশ কমে আসছে। ভোগের তৃষ্ণা বাড়ছে। আমি ডুবে যাচ্ছি ভয়ঙ্কর আত্মঘাতী চোরাস্রোতে।

তুমি শুনতে পাচ্ছ হিয়া!

একা একাই চিৎকার আর প্রলাপ বকতে বকতে ঘুমিয়ে পড়ল রিক চোখের পাতায় দিয়া হিয়ার স্বপ্ন দেখবে বলে।

হিয়ার পুতুল বাড়ি পুতুল সংসার

সব কাজ মিটিয়ে বাইরের ঘরে গিয়ে বসল হিয়া। বাড়ি ফেরার পর থেকে এখন পর্যন্ত মোবাইলটা নিজের মত পড়ে ছিল চলন্ত টিভির সামনে। একটা সিনেমা চলছে। রিমোট দিয়ে টিভি অফ করে এতক্ষণে মোবাইলটা হাতে নিল। আর তখনি মহুলের টেক্সট চোখে পড়ল।

কী করছ? কোথায় আছ?

হিয়া একবার ভাবল উত্তর দেবে না। তারপর কী ভেবে উত্তর দিল, সব কাজ শেষ করে বাইরের ঘরে বসলাম।

মহুল বলল, তোমার ঘরটা দেখতে ইচ্ছে করে। তোমার বাড়ি আমার থেকে অনেক দূরে। আচ্ছা এটা কি ফ্ল্যাট?

হ্যাঁ। এটা বারোশো স্কোয়ার ফিটের একটা মধ্যবিত্ত ফ্ল্যাট। বাইরের এই ঘরটায় একটা ছোটো খাট, তার পাশে  বেতের ছোটো সোফা পাতা। এই সোফাটা হস্তশিল্প মেলা থেকে কেনা। একটা মজার গল্প আছে।এটা যখন কিনি তখন সন্ধে। লাইট আছে ঠিকই। তবুও আলো-আধাঁরি। এক নজরে দেখে পছন্দ হল। নিয়ে নিলাম। সারা রাস্তা ভাবতে ভাবতে এলাম কি ভাবে কোন দিকে এটা রাখবো। আসলে এই বেতের জিনিসের উপর আমার অদ্ভুত ভাল লাগা আছে। বাবা খুব বড় বড় বেতের চেয়ার ভালবাসতেন।সেই থেকেই হয়ত এই ভাল লাগা। সোফার সাথে মানাবে এমন একটা ফুলদানিও কিনে নিলাম।

আগে স্বপ্ন দেখতাম।একটা বড় ড্রইং রুম।তাতে পুরোটাই বেতের আসবাবপত্র দিয়ে সাজানো।এ ফ্ল্যাটের বাইরের ঘরটা বড়। কিন্তু শখগুলো মেটানো হয়নি।কর্তার ইচ্ছায় কর্ম।অবশ্য সেটা আর নতুন কী!এ সংসারে অনেক কিছুই নিজের পছন্দের সাথে মেলে না।

বাড়ি এসে দেখি নিচের দিকটা পুরো ফাটা।বকা খেলাম।তারপর সকালে এক কাঠের মিস্ত্রী ডেকে সেটাকে মেরামত করালাম।এহেন সোফার উল্টোদিকে টিভি স্ট্যান্ড।এর পাশে তিনটে টেডিবিয়ার।সাইজগুলো দেখার মত।অনেক সময় দেখলে একটা বড় মানুষ বসে আছে বলে মনে হয়।এগুলোর একটা আমার।

হাসছ? আমি টেডি খুব ভালবাসি। ছোটোবেলায় তো একা কিছু পেতাম না। যা ছিল সবার। আমার একার টেডি প্রথম হয় বিয়ের পর। ওর নাম দিয়েছিলাম ইউশিকা। সব সময় আমার সঙ্গে থাকত সে। তারপর একদিন জ্যান্ত পুতুল এসে গেল। ইউশিকা হল আলমারি বন্দী। পুতুলের ঘর সামলাতে সামলাতে আমি নিজেই এখন দম দেওয়া পুতুল। আর নিয়ন্ত্রণ কর্তা ওই যে যিনি মহাকাশে মহাশূন্যে বসে সুতো নাড়াচ্ছেন।

পুতুল নাচ দেখেছ? মহুলের প্রশ্নে হিয়া বলল, খুব ছোটোবেলায় আমাদের স্কুলে একবার হরবোলা এসছিল। সেবারই পুতুল নাচও হয়েছিল। সুতুলি দিয়ে বানানো বড় বড় দুটো পুতুল। ভাল মনে নেই।তবে হরবোলাকে মনে আছে। এই তুমি কখনো হরবোলাদের দেখেছ?

একবার ভূপালে থাকাকালীন। বাবা কি একটা কাজে ক’দিনের জন্য ইটারসি গেছিলেন।তখন আমার ছুটি। আমি আর মা’ও গেলাম। সন্ধ্যেবেলা গেস্ট হাউসে তিনজনে বসে আছি। লোডশেডিং। মোমবাতি জ্বলছে। হঠাৎ বাঘের গর্জন। তার পরেই কুকুরের চিৎকার। শুনেছিলাম ওদিকটায় বন থেকে পালিয়ে চিতাবাঘ আসে মাঝে মাঝে। মা বেশ ভয় পেয়ে গেলেন। আমি বাঘ দেখব ভেবে দরজার বাইরে বেরলাম। বাবা তারস্বরে কেয়ার টেকারকে, একটু বিরতি নিয়ে, না। তার নামটা এখন আর মনে পড়ছে না, ডাকতে লাগলো। খানিকবাদে সে একটা আদিবাসী লোককে সাথে নিয়ে এল। সে নাকি হরবোলা। এতক্ষণ বাঘ কুকুর সবার স্বরই তার। মা তাকে বেশ বকলেও বাবা আবার সেগুলো শুনতে চাইলেন। সে প্র্নাম ঠুকে, বিশ্বাস করবে না- না শুনলে- বাঘ, হাতি, কুকুর, নানান পাখির ডাক হুবহু শোনালো। এটাই তার পেশা।

হিয়ার মনে পড়ল, বাবা বলত, আদিম মানুষের যখন কোনো ভাষা ছিল না তখন তারা বনের পশু পাখির ভাষা নকল করত কিংবা সেই ভাষাতেই কথা বলত। এমনও হতে পারে এটাই ছিল তাদের আত্মরক্ষার পদ্ধতি। আমাদের যাবতীয় ভাষা সুর তাল লয় সবই গড়ে উঠেছে প্রকৃতি, বৃষ্টি ,নদী , গাছপালা, পশু, পাখির ছন্দে।

কথাগুলো মনে পড়ায় হিয়া বলল, বেশ ভাল হতো যদি পাখি হতাম। ওদের ও প্রেম ভালবাসা সুখ দুঃখ রাগ অভিমান সব আছে নিশ্চয়। পরের জন্মে আমি পাখি হতে চাই। মানুষ জন্ম আর ভাল লাগে না।

এই কথার উত্তর দিল মহুল। চুরাশি কোটি যোনি পেরিয়ে এই মানব জন্ম। আমাদের চারপাশে কত আনন্দ, পৃথিবী প্রকৃতি রূপ রঙ আলো দিয়ে ভরিয়ে দিয়েছে। মানুষ না হলে কিভাবে বুঝতে?

যাই বল, এ জন্ম আর চাই না। তার থেকে নদী হওয়াও ভাল। এত অশান্তি, হিংসা, খুন খারাপি, রক্ত  …মাগো!

হিয়ার আর কথা বলতে ইচ্ছে করছিল না। সে লিখল, কী লিখতে বসে কী লিখছি! আসলে কী কিছু লিখতে চাইছি নাকি লেখার কিছু আছে! শুধু কতগুলো শব্দ জড়ো করে তারাদের সাথে এক পঙতিতে সেগুলোকে মুক্তি দিতে চাইছি। তারপর চুপ করে বসে পাতা খসার শব্দ শুনব। তুমিও শুনো প্লিজ। এখন আমি গেলাম বেশ।

এখন চারদিক জুড়ে নীরবতা। শুতে যাবার আগে নিজের মনেই হিয়া বলল,  দেখ তুমি নেই। এই নেই টাই আসলে তুমি বা তোমার মাঝে লুকিয়ে থাকা আরেকটা আকাশ। সে আকাশে কত রহস্য। চুরি করে সে রহস্য সমাধান করা যায় না। এখনো কোনো গোয়েন্দা পারেনি তার অগাধ সম্পদ ভান্ডারের হদিশ খুঁজে দিতে। বৃথা চেষ্টা। আসলে অরুপ যে রতন লুকিয়ে আছে, মন খ্যাপা তো এখন নির্জনে তারই সন্ধানে।

লাইট নিভিয়ে শুয়ে পড়ল হিয়া। আবার একটা দীর্ঘ রাত। আধো ঘুমে আধো জাগরনে সকালের জন্য অধীর প্রতীক্ষা। তার মনে এখন মহুল, দিয়া, কৃষ্ণাদেবী কেউ কোথাও নেই। শুধু রিক।

 কী করছে রিক? খেয়েছে কি? ইদানিং বাইরে গেলেই অ্যালকোহল খাচ্ছে। যদিও বলে এতে নাকি কিডনি পরিস্কার হয়, কিন্তু তার একটুতেই নেশা হয়ে যায়। তখন যে কী করে কী বলে তার কোনো মাথামুন্ডু খুঁজে পাওয়া যায় না।

সারাদিন ফোন করাও হয় নি। করেই বা কী করতাম! নয় রিং হয়ে কেটে যেত, নয় ধরেই বলত, ব্যস্ত আছি। পরে ফোন করছি। সেই ফোন আসতে আসতে আবার একটা দিন চলে যায়। আবার আমাকেই ফোন করতে হয়। কতবার ভেবেছি, আর কোনোদিন জানতে চাইব না কোথায় তুমি? কী করছ? খেয়েছ? ইত্যাদি … তবু মন মানে না। রিক তুমি বোঝো না প্রতিটা দিন রাত কিভাবে আমি অপেক্ষা করি তোমার জন্য। কত রাত ঘুম আসে না।তুমি পাশে শুয়ে জড়িয়ে ধরে আদর করবে বলে। কিন্তু তুমি কড়া ওষুধ খেয়ে ঘুমিয়ে যাও। মায়ের পাশে। সেই কবে থেকে আমি একা। মাকে রাতেও সঙ্গ দিতে দিতে তুমি ভুলেই গেলে আমারও কিছু চাহিদা ছিল, কিছু বলার ছিল। যাক, তুমি তাড়াতাড়ি ফিরো, আমার কাছে না ফিরলেও মেয়ের আর মায়ের জন্য ফের। আমি অপেক্ষায় রইলাম।

নিজের মনেই এসব ভাবতে ভাবতে সেই নিদারুণ অপেক্ষা আর চঞ্চলতার মধ্যে অবচেতনে মনের ক্যানভাসে    হিয়া হিম কুহুর বাকি গল্পটা লিখতে শুরু করল।

 

চলবে…

বিতস্তা ঘোষাল। কবি, গল্পকার ও অনুবাদক। জন্ম ৫ই জানুয়ারি, ভারতের কলকাতায়। ইতিহাসে এম এ, কলেজে সাময়িক অধ্যাপনা। অনুবাদ সাহিত্যের একমাত্র পত্রিকা ‘অনুবাদ পত্রিকা’র সম্পাদক। ‘বাংলা আকাডেমি’, ‘একান্তর কথা সাহিত্যিক', 'চলন্তিকা' পুরস্কারপ্রাপ্ত। বিতস্তার প্রকাশিত বই ২২টি। তাঁর কবিতা হিন্দি, ওড়িয়া, অসমিয়া ও ইংরেজিতে...

এই বিভাগের অন্যান্য লেখাসমূহ