ইমন কল্যাণ
পরিচ্ছেদ ৬ অনেক রাতে ফিরেছিল কল্যাণ ওরফে শহীদুল।গাড়িটা শেডে রাখার পর দু’বার হালকা করে মা…..
মাঝরাতে ঘুমটা ভেঙে গেল। আজকাল প্রায় রোজরাতেই তার এমনটা হচ্ছে। মাথার মধ্যে কত কিছু কিলবিল করে এই সময়টায়। মনে হয় তার সব অসমাপ্ত কাজ এখনি শেষ করতে হবে। নইলে ভোরের আলো ফোটার আগেই সেগুলো আবার রাতের গভীরে হারিয়ে যাবে। বিশেষ করে ফেব্রুয়ারি আর মার্চের মাঝামাঝি সময়টায়। ফাগুন এখন সেভাবে শহরে দেখা যায় না। কিন্তু রাস্তার দু’ধারে সারি সারি কৃষ্ণচূড়া আর রাধাচূড়া, রাস্তা জুড়ে লাল-হলুদের আলপনা মনে করিয়ে দেয় শিউলির প্রস্তুতি শুরু হয়ে গেছে।
হিয়া ফাগুনের আমেজ নেয় মনে। কারন এই সময়ের মধ্যেই তাকে গেঁথে ফেলতে হবে শব্দের মালা। হাজার হাজার শব্দ সুঁচে সুতো পরিয়ে যত্ন করে শক্তভাবে গাঁথতে হবে। সেই শব্দের মধ্যে থাকবে প্রেম, ভালবাসা, দুঃখ, নাগরিক জীবন। রাখতে হবে একটা মনের সঙ্গে অন্য আরেকটা মনের দ্বন্দ্ব। ভাঙাচোরা আয়নার মতো মুখে প্রতিফলিত হতে হবে লাল-নীল-হলুদ নানা অভিব্যক্তি। সব রঙ সঠিকভাবে মিশলেই তৃপ্তি। অবশ্য লেখকের অতৃপ্তি কখনোই যায় না।
এই যেমন গত সাতদিন ধরে কিছুতেই চরিত্রগুলো সঠিক আকার নিচ্ছে না। একটুখানি উঁকি দিয়েই মিলিয়ে যাচ্ছে। হিয়া প্রাণপণ চেষ্টা করছে সেগুলোকে ধরতে। অথচ …।
বিছানা ছেড়ে উঠে বসল হিয়া। মেয়ে দিয়া পাশে নিশ্চিন্তে ঘুমচ্ছে। জানলার কাচ ভেদ করে সাদা ভাতের মত জ্যোৎস্না দিয়ার মুখের ওপর। একটা কেমন যেন মন ভাল করা স্বর্গীয় দৃশ্য। আসলে স্বর্গ-নরক বলে তো কিছু নেই। যা আছে সব তোমার এই জগতের মধ্যেই। তোমার অনুভবের মধ্যে দিয়ে তাকে খুঁজে নিতে হবে। বাবার বলা কথাটা মনে পড়ে গেল হিয়ার। সন্তানের মুখের হাসির থেকে বড় শান্তি-সুখ বা আনন্দের মতো কোনো জিনিস পৃথিবীতে নেই। ওটাই স্বর্গ ওটাই নরক। নিজের মনেই বিড়বিড় করল হিয়া। তারপর আলতো করে দিয়ার কপালে একটা চুমু খেল। দিয়া ঘুমের মধ্যেও বুঝতে পারে যে মা তাকে হামি খাচ্ছে। সে চোখটা অল্প করে খুলে একটু হেসে দু’হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরল মাকে। তারপর আবার ঘুমিয়ে গেল। একটু অপেক্ষা করে আরেকটা চুমু খেয়ে হাতদুটো সরিয়ে দিয়ে বিছানা থেকে নিঃশব্দে উঠে এল হিয়া।
এসে বসল ড্রয়িং কাম ডাইনিং রুমে। জানলার গা ঘেঁষে রাখা চেয়ারে বসে টেবিলে রাখা বোতল থেকে জল খেল। আর তখনি মোবাইলের কথাটা মনে পড়ে গেল। চেয়ারের পাশে রাখা ছোট্ট টেবিল থেকে তুলে নিল অফিসের ব্যাগ। তারপর সেখান থেকে বের করে আনলো মোবাইলটা। এই ছোট্ট মোবাইলটা তার নয়। বেশ পুরোনো আমলের কোম্পানির সেট। এটা আজই সন্ধ্যে আটটা নাগাদ পেয়েছে সে। তবে পেয়েছে বলার থেকে ভাল, সে মোবাইল স্টোর থেকে নিয়ে এসেছে। দু’দিন ধরে তার নিজের সেটটা বারবার হ্যাঙ করে যাচ্ছিল। সেটাই দেখাতে গেছিল স্টোরে। তখন স্টোর থেকে জানালো দু’দিনের জন্য রেখে যেতে হবে তার মোবাইলটা। আর তার বদলে তাকে ব্যবহারের জন্য এই সেটটা দিল।
হিয়া সেটটা নিলো বটে, কিন্তু নিজের সিম এতে ভরেনি এখনো। তার আরেকটা মোবাইল আছে। আপাতত তাতেই কাজ চালাচ্ছে। সে এখন ভাল করে এদিক ওদিক দেখল সেটটা। ব্যাক সাইডের কভারে নীল সমুদ্রের উপর ভাসমান নৌকার ছবি। অর্থাৎ এই মোবাইলটির মালিক সমুদ্র ভালবাসে। কিংবা ভেসে যেতে পছন্দ করে। তাই নৌকার ছবি। জীবন আসলে একটা ভাসমান নৌকার মতোই। ভেসে ভেসে যতদূর যাওয়া যায় ততটাই বেঁচে থাকা।
কিন্তু এই মোবাইলের মালিক ছেলে না মেয়ে? সেটা কিন্তু বোঝা যাচ্ছে না এখনো, ভাবতে ভাবতে মোবাইল অন করল হিয়া। ওয়েলকাম জানিয়ে মোবাইল অন হল। স্ক্রীনে লেখা এল কুহু।
এই কুহুটা কে? মালিকের নাম কী? কেন এটা স্টোরে? আর স্টোরেই যদি দিল তবে তো সব ডেটা সব ইনফরমেশন ডিলিট করে তবে তাকে দেওয়া উচিত ছিল। কিন্তু তাহলে কুহু কেন লেখা? কৌতূহলী হয়ে উঠল হিয়া। সে প্রথমেই হানা দিল মেসেজ বক্সে। সাধারণত চ্যাট থেকেই জানতে পারা যায় মোবাইলের মালিকের একটা সাধারণ পরিচিতি। মানে তার রুচিবোধ, জীবনবোধ বা ভাবনার ও প্রতিদিনের সামগ্রিক একটা গতিবিধি। সেইজন্যই কোনো অঘটন বা খুন বা সন্ত্রাসের ঘটনা ঘটলে পুলিস, গোয়েন্দা সকলেই সবার প্রথম ব্যক্তিগত মোবাইল বাজেয়াপ্ত করে। এসব কথা ভাবতে ভাবতে ইনবক্স খুলল হিয়া।
এ কী! এখানে তো সব মেসেজ রয়েছে। কোনো কিছুই ডিলিট করা হয় নি। তার আগেই তার হাতে এসে পড়েছে মোবাইলটা। না, এটার সব কিছু না মুছে দিয়ে নিজের সিম ঢোকানো ঠিক হবে না, ভেবে ক্ষণিক উত্তেজনা নিয়েই মোবাইলটা অফ করে টেবিলেই রেখে দিল হিয়া।
না, বড় গল্প লেখার মত কোনো কিছুই মাথায় আসছে না। কী নিয়ে লেখা যায়! গত বছর যেগুলো নিয়ে লিখেছে সেই কনসেপ্ট রিপিট করা যাবে না। সম্পাদকরা ভীষন চালাক। মুখে কিছু বলবেন না, কিন্তু নীরবে সব জায়গায় রটে যাবে নবাগত এই লেখকের মধ্যে কোনো ইনভেনসন নেই।একই বিষয় নিয়ে নাড়াঘাঁটা। ব্যস অমনি লেখার দফা রফা।
কী যে করি! চরিত্রগুলো কেন যে এভাবে অধরা থেকে যাচ্ছে? তাহলে কি সত্যি আমি মহামূর্খ! মেঘ তাহলে ঠিকই বলেছিল। এটা ভেবেই মেঘ মুখখানা চোখের সামনে ভেসে উঠল হিয়ার। মেঘ মিতুলের ছোটো মেয়ে, মানে হিয়ার বোনঝি। ভাল নাম মেঘ মল্লার।
সেটা ছিল একটা কালিপুজোর রাত। বেলেঘাটা সিআইটি রোডে এক অল্প পরিচিত ব্যক্তির বাড়িতে কালিপুজো দেখে ফিরছে তারা। তখন রাত প্রায় দুটো। কী একটা কথা প্রসঙ্গে মিতুল বলল, সামনে ছানা পট্টি, এখন ছানা কিনে নিলে ভালো হত।
এত রাতে ছানার দোকান খোলা পাবি?
হ্যাঁ , সারারাত খোলা থাকে।
সত্যি হিয়া জানত না। তাই বিশ্বাস করে নিল।
একটু পরে ছোটো বোন আবিষ্টা বলল, ছোটো মাসি যেতে বলেছিল, চল এখন ঘুরে যাই।
এত রাতে?
আজ তো পুজো। জেগে আছে, চল।
দূর! এত রাতে গিয়ে কেউ বিরক্ত করে কাউকে! পরে যাস।
মেঘ তখন প্রায় ঘুমিয়ে পড়েছিল। হঠাৎ জেগে উঠল। গম্ভীর স্বরে বলল, বম্মা তুমি তুবড়ি বানাতে জান?
তুবড়ি জ্বালানো দেখেছে হিয়া, নিজেও দু-এক বার ধরিয়েছে। দেখতে দারুণ লাগে। কিন্তু নিজে বানানো! না বাবা! মার মুখে শোনা বড়মামা একবার তুবড়ি বানাতে গিয়ে মশলা হাতের মধ্যে বাস্ট করে যাচ্ছে-তাই অবস্থা হয়েছিল।
এমনিতেও হিয়া খুব একটা এসব বিষয়ে ক্রিয়েটিভ নয়, রান্না-বান্না, মশলা বাটা বা সংসারের খুঁটিনাটি নিয়ে কখনোই মাথা ঘামাতে ভালবাসে না। সেটা খানিকটা ভাল না লাগা আর খানিকটা না পারার জন্য। বিয়ের সম্বন্ধ দেখতে এসে শশুরমশাই জিজ্ঞেস করেছিলেন, রান্না জানো মা?
বাড়ির লোক কিছু বলার আগেই হিয়া বলেছিল, হ্যাঁ। পারি তো!
কী কী পারো মা?
চা আর ম্যাগি বানাতে পারি।
হাসিমুখে তিনি বলেছিলেন, ব্যস ব্যস ওতেই হবে। তবে যদি কখনো ইচ্ছে করে শুক্তো বানানোটা শিখে নিও। তারপর কাছে টেনে নিয়ে বলেছিলেন, তোমার এই বুড়ো বাপ শুক্ত খেতে খুউব ভাল বাসে। যে একবার শুক্তো রাঁধতে শিখে যায়, তার কাছে বাকি কোনো রান্নাই শক্ত নয়।
হিয়া বাড়ির বউ হয়ে আসার ছয় মাস পর ভাত ডাল আলুভাজা বাদে যে রান্নাটা মন দিয়ে শিখেছিল সেটা শুক্তোই।
তখন থেকে এখন অবধি জীবন পথে চলতে গিয়ে একটা গূঢ় সত্য সে উপলব্ধি করতে পেরেছে, জীবনের চলার রাস্তাটাকে শুক্তোর মতই সঠিক পরিমানে নানান মসলা সবজি আনাজ দিয়ে বানাতে হবে। এর কোনোটা বাদ গেলেই পথটা এবড়ো খেবড়ো হয়ে পড়বে। সামঞ্জস্য বজায় রাখাটাই জীবন। মাঝে মাঝে যখন সব মিলিয়ে দিশেহারা লাগে, তখন হিয়া রান্না ঘরে গিয়ে সবকিছু দিয়ে শুক্তো রাঁধতে রাঁধতে ভাবে ভাগ্যিস এই রান্নাটা শিখেছিল, তাই জীবনটা বিস্বাদ হয়ে গেল না।
সে যাই হোক, এখন হিয়া মেঘের কথায় অবাক হয়ে বলল, না তো!
মেঘ ততধিক গম্ভীর হয়ে বলল, ভগবান যখন তোমাকে বানিয়েছিলেন তখন খালি তুবড়ির খোলটা বানিয়ে ছেড়ে দিয়েছিলেন, মশলা ভরতে একদম ভুলে গেছিলো।
খানিকক্ষণ হিয়া বুঝতে পারল না মেঘ কী বলতে চাইল। না বুঝে সেই মুহূর্তে একটু রাগ হয়েছিল, আসলে যা হয়, খোঁড়াকে খোঁড়া বললে, কালাকে কালা বললে, ইত্যাদিতে যেমন রাগ হয় এটাও তেমনি, বোকাকে কি বোকা বলতে আছে! আমার বুঝি কষ্ট হয় না!
খানিকবাদে যখন পুরো বিষয়টা নিজে বুঝে হেসে ফেলল মেঘের বুদ্ধি আর সেন্স অফ হিউমার দেখে ।
বাবাও হিয়াকে ব্লান্ট বলতেন। বলতেন, সব কটা মানুষের মধ্যে তুই হচ্ছিস পৃথিবীর সেরা ব্লান্ট।খালি একটাই জিনিস জানিস, সেটা হল বাবা।কী যে হবে তোর! সত্যি বাবা শেষ দিনও ছোট বোনের হাত ধরে বলেছিল, দিদিকে দেখিস, ও ভীষণ বোকা, কোনো জটিলতা, কুটিলতা সে বোঝে না।
তা হিয়ার এই ছোটো বোন বছর দশ বয়স থেকেই তাকে যথেচ্ছ শাসন ও কড়া নজরদারিতেই রেখেছে । আর এখন তো আরো ভালো, স্বয়ং বাবা তার হাতে হিয়াকে, মানে বিশ্বের সেরা বোকা ভালমানুষ দিদিকে দেখার ভার দিয়ে গেছেন।
দিয়াও তাকে প্রায়শই বলে থাকে, মা তোমাকে আমি একা রেখে কোথাও গিয়ে শান্তি পাব না। এত বোকা তুমি যে পৃথিবীতে কী করে লড়াই করে, বুদ্ধি করে চলতে হয়, সেটাও জান না। দিনরাত খালি রামকৃষ্ণ শরণম করে যাও, আর দাদুকে ডেকে যাও। আরে বাবা নিজের বুদ্ধিটা তো কাজে লাগাও। সবাই তোমায় কষ্ট দেয়, তুমি বোকার মত কাঁদো বসে বসে আর খানিক বাদেই ভুলে গিয়ে আবার তাদের ক্ষমা করে দাও ।
এহেন হিয়া শাশুড়ি মার কাছেও বোকা আর ব্রেনলেস বলে বকা খায়, আজো শোবার একটু আগেইই খেল। কী না দিয়া আর মেঘ মিউজিক এলবাম বানিয়েছে, সে বলার মধ্যে বলেছে , মেঘতো আজ আসেই নি, কী করে একসাথে বানালি?
ব্যস ঠাকুমা নাতনী-গর্বে গর্বিত হয়ে বলে দিলেন, সাধে কি বলি মাথায় কিছু নেই। একদম ঢ্যাড়স একটা।
সত্যি, আমি যে কী! নিজের মনেই হাসে হিয়া নিজের বোকামি আর মূর্খতায়।
কিন্তু এখন কী নিয়ে লেখা যায়? অনিরুদ্ধ এপ্রিলের মধ্যে লেখা জমা দিতে বলেছেন। চরিত্রগুলো কেন যে এভাবে লুকিয়ে পড়ছে ভাবতে ভাবতে আনমনে হিয়া পাশে পড়ে থাকে মোবাইলটা আবার হাতে তুলে নিল। কী ভেবে অন করল। তারপর ইনবক্সে গিয়ে দুটি বিশেষ নম্বর থেকে আগত টেক্সটগুলো পড়তে শুরু করে দিল। এবং কল্পনার এলোমেলো পথ ধরে তাদের ছুঁয়ে ফেলতে চেষ্টা করল।
চলবে…
পরিচ্ছেদ ৬ অনেক রাতে ফিরেছিল কল্যাণ ওরফে শহীদুল।গাড়িটা শেডে রাখার পর দু’বার হালকা করে মা…..
পরিচ্ছেদ ৫ আকাশে এখন আর মেঘ নেই। হাওয়া হচ্ছে।কদিন পরেই বর্ষা নামবে।একদিন হাসপাতাল থেকে ফিরতে…..
পরিচ্ছেদ ৪ ভোর হয়ে আসছে।রাতে ভালো ঘুম হয়নি।ঘুমের ঘোরে মনে হচ্ছিল দম বন্ধ হয়ে আসছে।এরকম…..
পরিচ্ছেদ ৩ শীত শেষ হয়ে আসছে।রাঙ্গালীবাজনা ঢোকার মুখের রাস্তাগুলো পলাশ ফুলে ভরে গেছে।অথচ ঠান্ডাই।…..