ছাতিম ফুলের গন্ধ (পর্ব-২)

বিতস্তা ঘোষাল
উপন্যাস, ধারাবাহিক
ছাতিম ফুলের গন্ধ (পর্ব-২)

হিম- কুহু ( পর্ব ১)

হিমঃ  রাত কেন এত অস্থির? পার্টিতে তর্ক হল গম্ভীর। কিন্তু সে ভাষা শহরের না বস্তির? ঘুম নেই, ঘুম নেই…

কুহুঃ  আমার খুব ঘুম পাচ্ছে।

হিমঃ এই পৃথিবী বড় বিচিত্র। চড়াইয়ের পাশে উৎরাই ,দুঃখের পাশেই সুখ, ঘুমের পাশেই পেঁচা !

কুহুঃ পেঁচা?

হিমঃ ও কিছু নয়। তোমার কথা বল।

কুহুঃ  হু। জানো আজ আষাঢ়ষ্য প্রথম দিবস। দু -এক ফোঁটা বৃষ্টি। তারপর মেঘ গেল ভাসতে ভাসতে মনের মানুষের কাছে। সে ছিল এক কাব্যগাথা। যদি তার সাথে দেখা হয় একটু তাকে বলে দিও প্লিজ্ এখনো শহরের নিভৃত কোণে এক কন্যা আছে বসে। সেখানে বৃষ্টি পড়ে না বারোমাস । তবু মন খারাপ হয়। কী যেন অপূর্ণতা। কত কথা বলার ছিল। কত কী শোনার ছিল। এই রাতে ভীষণ ইচ্ছে করছে এলোমেলো পথ হাঁটতে।

হিমঃ তোমার কি মন খারাপ?

কুহুঃ  না, তা নয়। কিন্তু একঘেয়ে লাগে সব। ভাল লাগে না, কিছুই ভাল লাগে না। সারাদিন শুধু প্রতীক্ষা। কেউ আসে না। অথচ মনের মধ্য ঢং ঢং ঢং বেজেই চলেছে । কে যেন বলছে উড়িয়ে কেতন অভ্রভেদি রথে সে আসছে, মাঠ ঘাট প্রান্তর ভেঙে দীর্ঘ রাস্তা পার হয়ে সে আসছে…

হিমঃ কে আসছে অনুভব করতে পারছ?

কুহুঃ অনুভব? কে জানে! শুধু বলতে ইচ্ছে হচ্ছে মহাকবি তুমি রাজা- রানীর গল্প লিখলে। আজ আর এক বার কলম ধরো। রবিঠাকুর শরৎচন্দ্র এ কাজে রাজি নয়। তাই তুমিই আবার লেখ। আমাকে নায়িকা বানাও, মেঘকে পাঠাও সেই সুদূর দেশে যেখানে আমার জন্য আমার সে অপেক্ষায়। তারপর না হয় সারারাত ধরে বর্ষা নামুক এই শহরের খোলা চুল বেয়ে….

হিম- তোমার ঠিকানা কী  রাজকন্যা ? এ ফুটপাথ থেকে ও ফুটপাথ পার করেছে যে শহরের রাখাল , তাকে আদেশ দেব মেঘ বাহনে বসিয়ে এক্ষুণি বর্ষা কুমারকে তোমার সামনে হাজির করতে ।

কুহু– প্লিজ্ তাকে পাঠাও।

হিম– সে সামনে এসে দাঁড়ালে কী বলবে ?

কুহু- বলব এত দিন শুধু তোমার জন্যই এই পৃথিবীর গ্লানি  মেখেছি। এবার আমায় নাও।

হিম— দাঁড়াও , একটু অপেক্ষা করো, আদেশ করে দেখি কী বলে! কিন্তু  বলার পর যদি প্রলয় নেমে আসে?

কুহু–  প্রলয়?

 হিম-  যদি ভেসে যায় এতদিনের পৃথিবী তৃণ সম !

 কুহু-  তাতে তো তোমার চাপ নেই। চাপ তো সেই কন্যার ।

 হিম-  ঠিক আছে বলছি ওকে…

এতটা এক নিঃশ্বাসে পড়ে ফেলল হিয়া। এখানে কুহুকে মনে হচ্ছে কোনো মেয়ে। আর হিম ছেলে। হিমের পুরো নাম কী? সে কি কুহুর প্রেমিক? নাকি নিছক বন্ধু? হিম পার্টির কথা লিখছে। কিসের পার্টিতে গেছিল সে? কী করে এই হিম? চাকরি না অন্য কোনো কিছু?  তার কেন ঘুম আসে না? আর কুহু! সে ঠিক কী করে? কেমন দেখতে এরা? কত বয়স হতে পারে এদের?

না এইটুকু লেখায় সে সব কিছুই ধরা পড়ছে না। দেখা যাক পরবর্তী অংশগুলো থেকে কোনো কিছু উদ্ধার হয় কিনা!

হিয়া বোতল থেকে গ্লাসে ঢেলে আবার একটু জল খেল। চা তেষ্টা পাচ্ছে তার। খেলে মন্দ হয় না, ভেবে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল। রান্নাঘরে আলো জ্বেলে গ্যাস ধরালো। কী ভেবে আবার নিভিয়ে দিয়ে মাইক্রো ওভেনে জল বসিয়ে কাপ নিয়ে তাতে ছাকনি দিয়ে তার ওপর গ্রীন টি দিল।

গ্রীন টি নাকি শরীরে অক্সিজেন বাড়ায়, ভেবে নিজের মনেই হাসল। তার বন্ধুরা ও বাড়ির লোকেরা বলে, তুই দারুনভাবে চা অ্যাডিক্টেড। লোকে যেমন মদ সিগারেট বা অন্য কোনো কিছুর নেশায় আচ্ছন্ন হয়ে যায় তেমনি তুই চায়ে।

ভাল তো! জানিস চায়ে একদিকে যেমন ক্যালোরী থাকে, অন্যদিকে চা রক্ত সঞ্চালনা বাড়িয়ে ব্রেন ভাল রাখে বুঝলি। আর সবচেয়ে মজার জিনিস, চা খাওয়া মানে প্রচুর জল খাওয়া। এবার ভেবে দেখ, আমার চা পানে কোনো ক্ষতি হচ্ছে না। উল্টে উপকারই হচ্ছে। হিয়া যুক্তি দেখায়।

আসলে হিয়া সত্যি চা ছাড়া বেশিক্ষণ থাকতে পারে না। বিশেষ করে রিকের সঙ্গে বিয়ের পর এই নেশা আরো বেড়ে গেছে। রিক যতক্ষণ বাড়িতে থাকে পাঁচ-দশমিনিট অন্তর চা খায়। তার ফলে আগে যেটা সারাদিনে বড়জোর চার পাঁচ কাপ ছিল সেটাই এখন গড়ে সারাদিনে হিয়ার তিরিশ পঁয়ত্রিশ কাপে দাঁড়িয়েছে।

কাপে জল ঢেলে চা ছেঁকে নিয়ে চেয়ারে ফিরে এল হিয়া। কাপে চুমুক দিয়ে ভাল লাগার একটা পরশ নিয়ে আবার নজর দিল ইনবক্সের দিকে।

কুহু:  আচ্ছা তুমি কি আমাকে পাগল ভাবো? ভাবলেও ক্ষতি নেই। আমি পাগলই

হিমঃ  উফ্ ভাগ্যিস একটা পাগলের সাথে দেখা হল । চারদিকে এত সুস্থ লোকের ভিড়। পাগলরা বেশ আছে পাগলের মত।

কুহু : তাহলে তো ঠিক আছে। তবে তুমি কিন্তু আমার মত পাগল হয়ো না।

হিমঃ ইদানিং একটা পাগলকে দেখা যাচ্ছে রাস্তায় রাস্তায় কিছু খুঁজতে !

কুহু:  তাই? পাগলটার ছবি পাঠিও তো!

এত অবধি পড়ে হিয়া হাই তুলল। না এবার একটু ঘুমিয়ে নিতে হবে। ঘড়ি বলছে সাড়ে তিনটে। অন্তত ঘন্টা তিনেক না ঘুমোলে অফিসে গিয়ে ঘুম পেয়ে যাবে। মোবাইল অফ করে টেবিলে রেখে দিয়ে নিজের বিছানায় ফিরে এল হিয়া।

 শোওয়া মাত্র দিয়া ডান হাত দিয়ে তাকে নিজের দিকে ঘুরিয়ে নিল। অল্প আলোতেও হিয়া দেখল দিয়া হাসছে। ছোটবেলায় বাচ্চারা দেয়ালা করে, এই শব্দটার মানে স্কুলেই সে শিখেছিল। স্বপ্নে শিশুর হাসি কান্না। কিন্তু এত বয়সে কী হিয়ার দেয়ালা হতে পারে! অথচ সে লক্ষ্য করেছে হিয়া পাশে শুলেই দিয়া যেন কিভাবে বুঝে যায়,গভীর ঘুমের মধ্যে থাকলেও। আর তার মুখে এরকম একটা নিশ্চিন্ত হাসি ফুটে ওঠে।

আচ্ছা দিয়ার মানসিক গঠন কি এখনো বাড়েনি? অবশ্য দিয়ার মধ্যে একটা ইনসিকিউরিটি ফিলিং কাজ করে, এটা সে বোঝে। এ নিয়ে সাইকিয়াটিস্টের সঙ্গেও তার কথা হয়েছে। তিনি দিয়ার সঙ্গে একান্তে আলোচনা করে জানিয়েছিলেন, এতে ভয়ের কিছু নেই। ক্লাস ওয়ানে পড়ার সময় তার এক বন্ধুর মা মারা গেছিলেন। সেই বন্ধুটির দুঃখ কান্না সবকিছু তাকে গভীর ভাবে প্রভাবিত করেছিল তখনি। তাই তার অবচেতন মন সারাদিন-রাত মাকে খুঁজে চলে।একটু এদিক ওদিক হলেই তার মনে হয় মা বুঝি চিরদিনের মত হারিয়ে যাচ্ছে তার জীবন থেকে। আর তাই যেভাবে যে অবস্থাতেই থাক না কেন দিয়ার সমস্ত ইন্দ্রিয় মা পাশে এলেই, পাছে মা হারিয়ে যায় এই বোধ থেকে আঁকড়ে ধরে।

হিয়া মেয়ের কপালে আলতো করে চুমু খেয়ে তাকে নিজের হাতের ওপর বুকের কাছে টেনে নিল। কিছুক্ষণের মধ্যেই পাড়ি দিল ঘুমের দেশে।

হিয়ার সংসার

আ্যলামটা বেজে উঠল।ওয়েক আপ।ওয়েক আপ।সাড়ে ছ’টা। হিয়া আধা ঘুমে আধা জাগরণে দিয়াকে ডাকল। এই সোনা ওঠ…

উঠছি। দিয়া আবার পাশ ফিরে শুল।

কী হল ওঠ, সাতটায় পড়া তো!

যেতে ইচ্ছে করছে না মা, ঘুম পাচ্ছে

তা বললে হবে? ওঠ।

চোখ কচলাতে কচলাতে দিয়া, ভাল লাগে না আর ,কবে যে বড় হব! বলে বাথরুমে ঢুকল।

বড় হলেও কি রেহাই আছে? এখন শুধু পড়া …,তখন কত কী যে করতে হবে!

একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে হিয়া বিছানা থেকে উঠে ব্রাশ করে রান্নাঘরে গেল। ফ্রিজ থেকে দুধ বের করে ঈষৎ উষ্ণ গরম করে দিয়াকে ডাকল সে।

খাব না। রোজ বলি। তাও দেবে।

চেঁচিও না। এতক্ষণ খালি পেটে থাকলে গ্যাসটিক আলসার হবেই হবে, এমনিতেই তোমার হাজার সমস্যা …

   বলে যাও। ছোটবেলায় ট্যাবলেট গুঁড়ো করে খাওয়াতে…. আরো কত কী! তোমার জন্যই তো চেঁচাতে হয় মা, বলতে বলতে ব্যাগ নিয়ে দিয়া দরজার সামনে।

জল খেলি?

হ্যাঁ।

সাবধানে যাস।

সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে দিয়া একবার মুখ ঘুরিয়ে মায়ের দিকে তাকাল, আর একটু ঘুমিয়ে নাও,আসছি। দিয়া চলে গেল।

হিয়া বাইরের ঘরের জানলাটায় বসল। ঠান্ডা হাওয়া দিচ্ছে। রাতে কি বৃষ্টি হয়েছে? ভাবতে ভাবতেই কলিং বেল বাজল। পেপার। তুলে নিয়ে চোখ বোলাল। দুর! একই খবর। রাশিফল দেখল। স্বাস্থের অবনতি। অফিসে পদোন্নতি। প্রেমে আঘাত।

হিয়া হাসল । কোনটাই মেলে না।

চা করল। শাশুড়ি মা এখনো ওঠেননি। ঘুমোক। কড়া ডোজের ওষুধ খেয়ে ঘুমোন। চা ঢাকা দিয়ে ডাইনিং টেবিলে বসে পাশে রাখা ম্যাগাজিনটায়  চোখ বোলাল। নাহ। সে রকম কিছু নেই। কতগুলো আধা উলঙ্গ মেয়ের  ছবি। এর নাম ফ্যাশন!

রান্নাঘরে ঢুকলো। সাড়ে আটটায় দিয়া ফিরবে।তার আগেই রান্না শেষ করতে হবে।

###

বৌমা, রিক উঠে গেছে। কী খেতে দেবে দাও ওকে। শাশুড়িমা রান্নাঘরের সামনে দাঁড়িয়ে কথাগুলো বলে ভিতরে চলে গেলেন।

দিচ্ছি, বলে হিয়া তাড়াতাড়ি দুধ গরম করে কর্ণফ্লেক্স মেশাল। রিক প্রাণায়াম করছে। ইশারায় রেখে যেতে বলল ।

চা খাবে?

রিক মাথা নাড়ল।

ভাত নামিয়ে চা বসাল। শাশুড়ি বললেন, পাউরুটি দিবি?

দিচ্ছি।

ঘড়ি বলছে পৌনে’নটা। মেয়েটা এখনো এল না! এসেই স্নান না করে ভাল করে না খেয়েই স্কুল চলে যাবে। ফোন করব? ভাবতে ভাবতেই কলিং বেল বাজল।এল।ওর বেলের আওয়াজ শুনলেই বোঝা যায়।

টান,খুলে যাবে। হিয়া চা ছাঁকতে ছাঁকতে বলল।

ঝড়ের মত ঘরে ঢুকেই, মা খেতে দাও, খুব ক্ষিধে পেয়েছে, বলেই দিয়া হাত ধুয়ে টেবিলে বসে পড়ল।

মা,পাউরুটি রাখলাম। ভাতটা একটু বেড়ে দাও। ওমলেটটা করি। থালা ধুতে ধুতে হিয়া ভাবল দশভূজা হলে বেশ ভাল হত।

রিক চেঁচাচ্ছে। হিয়া, জলের বোতলটা দাও,ওষুধ মুখে।

কিছুই কি পার না? নিষ্কর্মার ঢেঁকি। বসে বসে মেদ বাড়াচ্ছো। উঠে নিতে পারছ না? ডিম চাটুতে ফেলে হিয়া গজগজ করতে করতে বোতল দিয়ে এল।

মা, ড্রেস ইস্ত্রি করেছিলে?  দিয়া খেতে খেতেই বলছিল , কী টিফিন দিয়েছ?

রুটি তরকারি ।

আজও ?

কাল দিইনি তো!

ওই হল আর কি! তার আগের দিন দিয়েছিলে, আবার আজ–

রাগ হয়ে গেল হিয়ার। না খেতে ইচ্ছে হলে খেও না।

কুল মা, জলের বোতলটা ধুয়ে দিও। খুব পিঁপড়ে থাকে বোতলের মুখে।

হুঁ। সবেতেই কুল! ছেলেটা দেখতে সুন্দর, সেও কুল, রাগলেও কুল… কুলের আসল মানেটা যে কী এটাই এসব কথায় ভুলে যেতে বসেছি।

চিল্যা্কস মা। মাথা ঠান্ডা রাখো। সেই যে মাথার তেলের বিজ্ঞাপনটা দেয় দেখো না! মাঝে মাঝে তাই বলি টিভি দেখ। আম্মা মাকে একটু বুঝিয়ে দিও তো।

ভিতরের ঘর থেকে শাশুড়ি বললেন, ওকে ডার্লিং।

   দশটায়  দিয়া গাড়ি এল। পুরো যেন একটা ঝড় বইল বাড়ি জুড়ে। এবার একটু বিরতি। হিয়া নিজের জন্য চা বানিয়ে নিয়ে এতক্ষণে টেবিলে এসে বসল। চা মুখে দিয়ে ঘড়ির দিকে তাকালো। ওরে বাবা দশটা কুড়ি! সেই লেট!  ভাবতে ভাবতে দ্রুত চা শেষ করে স্নানে ঢুকে গেল।

রেডি হয়ে বেরতে বেরতে সেই এগারটাই। বেরবার মুখে রিক বলল, এত তাড়ার কী আছে? গিয়ে তো কোন কাজ নেই।

ঠিক, আড্ডা মারতে যাই। হিয়া জুতো পরতে পরতে উত্তর দিল।

লক্ষ্মীর আমদানি নেই, শুধু পেঁচার কচকচানি।

হিয়ার মাথা গরম হয়ে গেল। ধড়াম করে দরজাটা টেনে বেরিয়ে গেল।

হিয়া-মহুল

 আচ্ছা কী হচ্ছে বলতো আমাদের?

 অফিসে বসে ফাইল দেখছিল হিয়া। এ মাসেই ইনকাম ট্যাক্স রিটার্ন জমা দিতে হবে। যদিও তার যা রোজগার তাতে জমা না দিলেও অসুবিধা নেই, তবু এই দাখিলটা সে করে রাখে ভবিষ্যতের কথা ভেবেই। যদি কখনো ব্যবসা বাড়ে, মা লক্ষ্মী মুখ তুলে চান, তাহলে হয়তো লোন নেওয়ার দরকার হতে পারে। রিক বলে, খাতায় কলমে যেটুকুই আয়- ব্যয় করো তার সঠিক হিসেব রাখা যেকোনো মানুষের জন্য দরকার। আর এটা তো তোমার ব্যবসা। সবকিছুর পরিষ্কার হিসেব থাকলে মুক্ত মনে কাজ করতে পারবে। এসব ভাবতে ভাবতেই হিয়া মন দিয়ে ফাইলের কাগজপত্র দেখছিল।

এমন সময় টেবিলের একধারে সরিয়ে রাখা মোবাইলটা টুং করে বেজে উঠল। অন্য সময় হলে সে দেখত না হাতের কাজ শেষ না করে। আজ দেখল। এসে থেকে একটানা কাজ করতে করতে আসলে সেও ব্রেক চাইছিল মনে মনে। কে মেসেজ করল দেখতে গিয়ে মহুলের জিজ্ঞাসা যেন হঠাৎ তাকে আচ্ছন্ন করে দিল। সে উত্তর দিল,  আমরা ক’দিন আগেও পরস্পরকে চিনতাম না। আর এখন গল্প করছি। বেশ মজার।

 টুং টাং..  টুঁ টাং…. প্রথমে ধ্বনি..  তারপরে প্রতিধ্বনি… মহুল লিখল।

তাহলে এখন কোনটা!

টুং টাং টুং টাং টুংটাং ….

তাই?

উহুঁ, দাঁড়াও, আগে কান পেতে শুনি….

মহুলের কথায় হিয়ার গান মনে পড়ল। সে লিখল, আমি কান পেতে রই ও আমার আপন হৃদয় গহন দ্বারে…

কোনোটা বাতাসের কোনোটা দীর্ঘশ্বাসের। মহুলের উত্তর।

তাই! প্লিজ দীর্ঘশ্বাস ফেলো না। এত দূর থেকে আসতে তার কষ্ট হবে।

অতি দীর্ঘ পথ ধরে যদি সে আসে কাছে তবে তাকে রাখবে কোথায়?

হিয়া আনমনে কিপ্যাডে লিখল, রবিঠাকুর বলেছেন ‘যদি সে আসে তার চরণতলে বেদনা আমার দেব বিছায়ে….’

 আর তুমি কী বলছ? কী বা চাইছ?

 মহুলের প্রশ্নে খানিকক্ষণ চুপ করে বসে হিয়া জানালো, “কী বা চাওয়ার ছিল? কী বা দিতে পারি তোমায়! শরীর বা মন! অনেক হল। তার চেয়ে দেব তোমায় এক আকাশ মেঘ ,নদীর ছলাৎ ছলাৎ  কিম্বা দীর্ঘ প্রেমের কবিতা…হাসছ তুমি? ভাবছ শেষে কবিতা! তবে দিলাম সাত সমুদ্র জল- যত ইচ্ছে নিও। তারপর বৃষ্টি হয়ে ঝরে যেও এই মন কেমনের শহরে”।

এটা কি তুমি লিখলে?

হুঁ , বলে আনমনা হিয়া।

 তুমি খুব ভাল লেখ। তোমার স্কুলে আমি ভর্তি হতে চাই।

 হা হা হা। লিখে হিয়া নিজেও হেসে উঠল।

মহুলের সাথে হিয়ার পরিচয় মাত্র চার’মাস আগেই। দিল্লী কালিবাড়ির উল্টোদিকে হাইরোডে রাস্তা পার হচ্ছিল সে। একটু বুঝি অন্যমনস্ক ছিল। খেয়াল করেনি কখন পেছন থেকে একজন তার ঘাড়ে এসে পড়েছে। সেই মুহূর্তে সে উপলব্ধি করল একটি শক্ত হাত তীব্রভাবে তাকে টেনে নিল তার দিকে। চমকে দেখল আর একটু হলেই সে চলে যাচ্ছিল বাসের তলায়। ঘটনার আকস্মিকতা কাটিয়ে সে দেখল তার পিছনে এক অন্ধ মানুষ। আর তার হাত ধরে রয়েছে তীব্রভাবে অন্য একজন, যার সাথে মিনিট দশেক আগেই তার মৌখিক পরিচয় হয়েছে বুক স্টোরে কফি খেতে খেতে। মহুল নামের সেই ভদ্রলোক বললেন, এক্ষুনি কী ঘটতে যাচ্ছিল বুঝতে পেরেছেন? আপনি তো আশ্চর্য মানুষ। অন্ধের মত রাস্তা পার হচ্ছিলেন!

সেই মুহূর্তে হিয়ার হাসি পেল। তাকে ধরে যে মানুষটি রাস্তা পেরবার চেষ্টা করছিল সে সত্যি একজন অন্ধ মানুষ। আর সে চশমা পরেও অন্ধ। সে কোনো উত্তর না দিয়ে বোকাবোকা হাসি হাসল।

 তার এক হাত ওভাবেই ধরে রাস্তা পার করে মহুল বললেন, কোথায় যাবেন বলুন তো আপনি?

নর্থ ব্লক, সংক্ষিপ্ত উত্তর দিয়ে হিয়া মহুলের দিকে তাকাল। নিজেকেই প্রশ্ন করল, এনাকে কি চিনি আমি? এই তো পরিচয় হল। তবে এর ছোঁয়া অচেনা লাগল না কেন? নাকি এই লোকটার জন্যেই মুহূর্তের মধ্যে তার মৃত্যুর মুখ থেকে বেঁচে ফেরা, তাই অবচেতন স্বত্বা তাকে নিজের কেউ ভেবে নিচ্ছে !

মহুল বললেন, আপনাকে আজ আর একা ছাড়তে ভরসা হচ্ছে না। চলুন ছেড়ে দিয়ে আসি।

হিয়ার মনে হল এই মানুষটি তাকে আগেও কোনো এক নির্দিষ্ট ডেসটিনেশনে পৌঁছে দিয়েছিল।এক মুহূর্ত না ভেবেই সে বলল, বেশ তবে যাওয়া যাক।

কলকাতায় ফেরার পর সে মহুলের মেসেজ পেয়ে অবাক হল।

কাল রাতে হঠাৎ দেখলাম তুমি অন্ধের মত রাস্তা পার হচ্ছো। আর একটা বাস … ভয়ে ঘুম ভেঙে গেল।একটু সাবধানে চলাফেরা কোরো।

অত চিন্তা করবেন না। আমি গাড়িতে যাতায়াত করি। এ্যনিওয়ে থ্যাঙ্কস।

সেই শুরু। হিয়া আর মহুল। দুই আলাদা শহরের বাসিন্দা হয়েও নিবিড়ভাবে বাঁধা পড়ল তারা।

###

তুমি আমার দিদিমণি হবে?’

একটু মজা পেয়ে হিয়া লিখল, গেল রে! নিজেই কিছু জানি না।

পেরেককে হাতুড়ি করতে পারবে না? অথবা রোড রোলারকে আলপিন? এইটুকুই আমার চাওয়া।

হাসল হিয়া । তাই?

সে প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে মহুল জিজ্ঞেস করল, আচ্ছা কলকাতার মন আজ ঠিক আছে? তুমি যে পথ দিয়ে অফিস যাও সেটা কোথায়?

 আজ কলকাতার মন দারুন ভাল। একটু গরম হলেও মেঘলা। আমি যে রাস্তা দিয়ে অফিস যাই, ব্রিজ পেরোতেই দু’দিকে কৃষ্ণচূড়া রাধাচূড়া।এই জায়গাটা বাগবাজার আর শ্যামবাজারের মাঝামাঝি। পুরো উত্তর কলকাতার সোঁদা গন্ধ এখানকার আকাশে বাতাসে। যদিও এটাও দ্রুত বদলে যাচ্ছে। পাড়াগুলো ভেঙে আকাশচুম্বী বিল্ডিং। মাঠ বদলে শপিং মল। তবু নোনা ধরা পুরোনো প্রাচীরের গায়ে আজও জেগে বট গাছের শিকড়। কতগুলো দুধে আলতা ফুলও অনাদরে উঁকি মারছে। বেশ ভাল লাগে। এই যে পথ বদলে গেছে, পাড়া ভাঙছে, তবু যেন ভীষনভাবে বেঁচে আছে সব কিছু নিয়ে।

আসলে প্রতি মুহূর্তে রোদ যদি বদলে যায়, ভেঙে যায় এক আকাশ থেকে অন্য আকাশে, তবে এ বদল তো প্রকৃতির-ই খেলা। আমরা  নিমিত্ত মাত্র। জানো আমি কলকাতাকে খুব মিস করি। মহুলের কথায় বিষন্নতার ছোঁয়া।

কতদিন আগে ছেড়েছ এই শহর?

আমি সেভাবে কখনোই কলকাতায় থাকিনি। বাবা থাকতেন ভূপালে। সেখানেই আমার জন্ম,পড়াশোনা। হায়ার স্টাডি মুম্বাই, তারপর চাকরি নিয়ে দিল্লী। এখানেই এখন সেটেলড্। কিন্তু ওখানে আমার অনেক আত্মীয় বন্ধুবান্ধব। মাঝে মাঝে যাই। অদ্ভুত একটা প্রাণ আছে শহরটায়। বার বার টানে…।

সেকি! তুমি প্রবাসী? তোমার কথা  শুনে এতটুকুও বোঝা  যায় না।

হিয়ার কথায় মহুল বলল ,আসলে আমি যেখানেই থাকি না কেন নিজের উৎসকে ভুলতে চাইনি, চাইও না। তাই বোধহয় বোঝা যায় না। এনিওয়ে ধন্যবাদ।

কেন? হঠাৎ ধন্যবাদ কিসের জন্য?

একটা কারণ নিঃসন্দেহে তোমার মধ্যে দিয়ে আমি কলকাতাকে দেখতে শুরু করেছি নতুন করে, তার জন্য। আরেকটা কারণ তুমি আমাকে তুমি সম্মোধন করছ। আমার ভাবতে ভাল লাগছে তুমি আমাকে আপন করে নিয়েছ।

হিয়া এর কোনো উত্তর দিল না। এই তুমি বলাটা তার সহজাত অভ্যাস। কয়েক মুহূর্তের পরিচয়েও সে তুমি  সম্বোধন করে ফেলে।তাই তার মধ্যে আপন বা দূর করার মতো কোনো কিছু লুকিয়ে নেই। তবু কী যেন একটা শিরশিরানি, ভাল লাগা তাকে গ্রাস করছিল। তার বুকের ভিতরে একটা অজানা নদী কুলকুল করে বয়ে যাচ্ছিল অজানা পথের দিকে। যার গতিবিধি তার এইমুহূর্তে অচেনা অজানা। শুধু একটা অদ্ভুত অনুভূতি নিয়ে সে তীব্রভাবে মহুলের পরবর্তী মেসেজ বা ফোনের প্রতীক্ষায় রইল। আর তখনি তার মনে পড়ল হিম কুহুর কথা। সকাল থেকে তাদের সঙ্গে বসা হয়নি।

এ এক অদ্ভুত অনুভূতি। আচ্ছা এরাও কি আমার আর মহুলের মত দুটো ভিন্ন শহরের বাসিন্দা? দুজন কি দুই প্রান্তে বসে খুঁজে নিতে চাইছে নিজেদের শিকড়? ভাবতে ভাবতে ব্যাগ থেকে মোবাইলটা বের করে অন করল হিয়া।

চলবে…

বিতস্তা ঘোষাল। কবি, গল্পকার ও অনুবাদক। জন্ম ৫ই জানুয়ারি, ভারতের কলকাতায়। ইতিহাসে এম এ, কলেজে সাময়িক অধ্যাপনা। অনুবাদ সাহিত্যের একমাত্র পত্রিকা ‘অনুবাদ পত্রিকা’র সম্পাদক। ‘বাংলা আকাডেমি’, ‘একান্তর কথা সাহিত্যিক', 'চলন্তিকা' পুরস্কারপ্রাপ্ত। বিতস্তার প্রকাশিত বই ২২টি। তাঁর কবিতা হিন্দি, ওড়িয়া, অসমিয়া ও ইংরেজিতে...

এই বিভাগের অন্যান্য লেখাসমূহ