ছাতিম ফুলের গন্ধ (পর্ব – ৩)

বিতস্তা ঘোষাল
উপন্যাস, ধারাবাহিক
ছাতিম ফুলের গন্ধ (পর্ব – ৩)

হিম – কুহু 

কুহু : কেমন আছ?

হিম : ভালই। ওখান থেকে এক প্যাকেট বৃষ্টি পাঠাবার জন্য ধন্যবাদ।

কুহু : তা বেশ। তোমার খবর কী?

হিম : খুব খারাপ

কুহু : কেন? পাগলটা জ্বালাচ্ছে?

হিমঃ  হুম। এখন যে কী করি! হিজিবিজি হয়ে যাচ্ছে সব কিছু।

কুহু:  তা কী কী ঘটল?

হিম:  আধফোটা পদ্ম আর ভেসে ভেসে আসা ছাতিম গাছের গন্ধে এলোমেলো হয়ে যাচ্ছি …।

কুহু : বাঃ । সেতো ভাল ।

হিম : পাগলামি ঠিক করার ওষুধ তোমার জানা আছে ?

কুহু :  না। আমি তো নিজেই পাগল ।

হিম : তুমি কী করে পাগল হলে ?

কুহু : তোমার জন্য হয়েছি বলতে পারলে ভাল লাগত। কিন্তু আমি তো বহুদিন ধরেই …আসলে পাগল হওয়ার

      জন্য কোনো নির্দিষ্ট কারণ নেই ।

হিম : পাগল হবার কোনো নির্দিষ্ট কারণ না থাকলে পারিজাত ফুলের রস জ্যোৎস্নার আলোয় এক চামচ করে

       তিন দিন খেতে হয় ।

কুহু : পারিজাত ফুল এই শহরে দূর্লভ। যদি পাঠাও তো বড়ই উপকৃত হই।

হিম : এত মই আমি এখানে পাব কী করে! মইয়ের পর মই চাই …।

কুহুঃ  এত মই চাই কেন ?

হিমঃ পারিজাত পাওয়া যায় স্বর্গে। পৃথিবীতে নয়। তাই চাই। কিন্তু অন্য মইটা টেনে নিলে! আমি তো ধপাস

******

হিয়া এবার হিম আর কুহুকে যেন কিছুটা সামনে থেকে দেখতে পেল। তার মনে হল কুহুর সঙ্গে তার অনেক মিল। পরমুহূর্তেই মনে হল, এই মিলটা কি বাহ্যিক? নাকি যেহেতু সদ্য সদ্য তার সঙ্গে মহুলের পরিচয় হয়েছে এবং তারাও এভাবেই নিজেদের মধ্যে নানা কথা বলে যায়, সেইহেতু সে এদের সঙ্গে মিল খুঁজে নিচ্ছে! আসলে আমরা প্রতিটা মানুষ কী ভীষন একা হয়ে পড়ছি এটা বোধহয় তার প্রতিফলন।

আমাদের যাবতীয় সম্পর্ক গড়ে উঠছে এই ভার্চুয়াল জগতে। যার সঙ্গে প্রত্যেকদিনের জীবনের কোনো যোগ নেই। অথচ যার সঙ্গে সারা দিন অজস্র কথা বলে চলেছি সেই মানুষটা জেনে যাচ্ছে আমার যাবতীয় ভাল মন্দ সুখ দুঃখ, ব্যক্তিগত টানাপোড়েন এমনকী সারাদিনের রোজনামচা। এভাবে আমরা পরস্পরকে চিনে নিচ্ছি অথচ বিছানার পাশে কিংবা চার দেওয়ালের মধ্যে যে মানুষগুলো বাস করছি তাদের সঙ্গে দূরত্ব ক্রমশ বেড়ে যাচ্ছে। হিয়া নিজের সঙ্গে একা একাই কথা বলছিল।

রিকের সঙ্গে এই যে দীর্ঘদিন আমার কোনো কথা নেই, এক বিছানায় শোওয়া নেই, দুজন দুজনের কোনো ব্যক্তিগত মুহূর্তের বা কোনো আনন্দ বা কোনো দুঃখের কথা কত বছর জানি না, এমনকি আমরা নিজেদের চাওয়া পাওয়াগুলোও এখন আর ভাগ করে নিই না, অথচ দুজনেই বেশ ভাল আছি-এমনভাবে ব্যস্ত রাখি। আসলে কি আমরা ভাল আছি? নাকী ভাল মন্দর সংজ্ঞাটাই আমরা আজ আর জানি না! কী জানি! সব কেমন ঘেঁটে যাচ্ছে! এইসব ভাবতে ভাবতে সে কুহুর মোবাইলটা অফ করে আবার ফাইলে মন দিল।

মহুল- হিয়া

লাঞ্চ ব্রেকের খানিকবাদে মহুলের মেসেজ এল।

তুমি কোথায়? আমার খুব জানতে ইচ্ছে হচ্ছে যেখানে আছো সেটা কেমন, সেখানকার সব বলবে আমায়? আমি তোমার মধ্যে দিয়ে আমার প্রিয় শহরকে ছুঁতে চাই।

হিয়ার বুকে ঢেউয়ের শব্দ। সে লিখল, আমি এখন অফিসে। এটা মধ্য কলকাতার বইপাড়া। যে বাড়িটায় আমার অফিস সেটার বয়স প্রায় একশ বছর। না। যা ভাবছ তা নয়। ভেঙে পড়বে না। এই ঘর তিনটে বাবা লিজে নিয়েছিলেন আজ থেকে তিরিশ বছর আগে। তখন এর মালিক ছিলেন হিন্দু। এখন মালিকানা বদলে গেছে। নতুন মালিক মুসলিম। বাড়ির আর সব ভাড়াটেই মুসলিম। খালি আমরা আর সিঁড়ি দিয়ে উঠে আর এক ঘর হিন্দু। তাদের বইয়ের ব্যবসা।

এই যে হিন্দু থেকে মুসলিম মালিকানা তাতে কোনো অসুবিধায় পড়েছ? বলেই মহুল লিখল, কল করছি।

কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে হিয়ার ফোন বেজে উঠল। হ্যালো, বলা মাত্র ওপ্রান্ত থেকে মহুল বলল, টাইপ করতে ভাল লাগছিল না। তাই কল করলাম। অসুবিধায় ফেললাম নাতো ?

না। ঠিক আছে। যা বলছিলাম তোমায়, মালিকানা বদল হলেও আমাদের সাথে সম্পর্কের কোনো পরিবর্তন ঘটেনি। বরং এরাই সারাদিন জড়িয়ে আছে। আমার পাশের ঘরে থাকেন শামসুদ ভাই,তার স্ত্রী আর দুই ছেলে। ছেলেদুটো ফুলের মত সুন্দর, নিস্পাপ, মায়াময়। ভাবীও খুব স্নেহমাখা। আমাকে প্রায়ই চা করে খাওয়ান। ইদে  নিমন্ত্রণ থাকে। কিন্তু ওদিন আমার আসা হয় না।

ওদের হাতে খেলে জাত যাবে ? মহুলের গলায় বিদ্রুপ।

না, জাত যাবার বা কোনো সংস্কারের জন্য নয়, ওদিন আমায় মাম্মী বলে ডাকে এক ছেলে, ফিরোজ আমাকে খাইয়ে তবে নিজে খায়। তার সঙ্গে সেদিনটা থাকতে ভালবাসি। ফিরোজ প্রায় আমার-ই বয়সী। কিন্তু তাতে কি আসে যায়! মা তো মা- ই।

ফোনে বারবার বিপ বিপ আওয়াজ। কেউ ফোন করছে। আচ্ছা শোনো এখন রাখি। পরে কথা বলছি আবার।

বলে ফোন কেটে দিল হিয়া। রাখা মাত্রই হিয়ার ফোন আবার বেজে উঠল। দিয়া। তার মানে স্কুল থেকে ফিরে এসেছে। হ্যালো বলতেই ওপাশ থেকে ভেসে এল তার উত্তেজনাপূর্ন কণ্ঠস্বর।

  মা জানো আজ কী হয়েছে?

 একটু কৌতূহল দেখিয়ে যতটা গম্ভীর স্বরে সম্ভব হিয়া বলল, বলে ফেল।

আজ না নেহা আর অস্মিতা মৌসুমী ম্যামের কাছে হেভি ঝাড় খেয়েছে।

ওহ! তুমি খাওনি?

আমি কেন খাব? বলেই দিয়া বলল, তুমি কি বিজি?

ছোট্ট করে একটু হুঁ, বলে হিয়া বলল, হাত মুখ ধুয়ে খেয়ে একটু ঘুমিয়ে নাও।

মা আজ আমার পড়া আছে। বাই।

ওকে। বেরবার সময় জানিও।

তুমি কখন ফিরবে?

দেরি আছে। যাও দেরি কোরো না, খেয়ে নাও।

ওকে। বলে হিয়া বলল, তাড়াতাড়ি ফিরো, তোমাকে ঘটনাটা বলব। আচ্ছা বাই। বি আই বাই মা।

বাই গসিপ মাস্টার। বি আই বাই বলে ফোন রাখার আগে বলল, মা সুমনকে বলতে হবে বাই এর বদলে আমার মা , যিনি কিনা সব সময় শুদ্ধ বাংলা আর বানান মেনে ইংরেজি উচ্চারণ করেন, তিনি এখন বি আই বাই বলছেন, বলে হেসে ফোন রাখল হিয়া।

ফোন রাখার পর হঠাৎ মনটা বিষন্নতায় ভরে গেল। মেয়েটা কিছু বলবে বলে স্কুল থেকে ফিরেই উৎসাহ নিয়ে ফোন করল, অথচ সে শুনল না ব্যস্ততার অজুহাত দিয়ে। কিন্তু একটু আগে যাবতীয় কাজ ফেলে নিশ্চিন্তে মহুলের সঙ্গে কথা বলছিল। তবে কি তার জীবনের প্রায়োরিটিগুলো দ্রুত বদলে যাচ্ছে! নিজের সন্তানের তুলনায় কদিনের পরিচিত এক মানুষ দ্রুত কাছে চলে আসছে?

মনটা দিয়ার জন্য আবার ভারাক্রান্ত হল। একবার ভাবল এখনি ফোন করি। পরমুহূর্তেই সে ইচ্ছাকে প্রশমিত করে মোবাইল সাইলেন্ট মোডে দিয়ে সামনে রাখা ফাইলগুলোর দিকে মনোনিবেশ করল।

দিয়া ও আম্মা

মায়ের সঙ্গে কথা বলে ফোন রেখেই দিয়া চিৎকার করল, আম্মা ও আম্মা। কোথায় গেলে?

কৃষ্ণাদেবী তখন বারান্দায় শাড়ি তুলছিলেন। কোন সকালে জামাকাপড়গুলো মেলা হয়েছে, এখন তুলে না নিলে রোদে ঝলসে রঙের দফারফা। আসছি আসছি, বলে নাতনীর চিৎকারে শুধুমাত্র শাড়িটা তুলেই তাড়াতাড়ি করে ঘরে এলেন।

দিয়া জড়িয়ে ধরে বলল, জানো, আজ কী হয়েছে স্কুলে?

কৃষ্ণা হেসে বলল, নেহা না অস্মিতা কে কী করল আজ আর কে বকা খেল?

 তুমি কী করে জানলে?

তোমার আম্মা সব জানে , কেবল জানে না মরবে কবে, বুঝলে? বলে নাতনীর গালে চুমু খেয়ে বলল, তা শুনি কী হল আজ?

দাঁড়াও সু সু লেগেছে জোরে।এসে বলছি। বলেই বাথরুমের দিকে দৌড়ল দিয়া।

একেবারে হাত মুখ ধুয়ে নাও। জামা বদলে এস। খাবার খেতে খেতে শুনব।

তুমি খাওনি এখনো? এই জন্যই রাগ হয়। কতবার বলেছি তোমায় এতক্ষণ না খেয়ে থাকবে না। বাথরুম থেকে আম্মাকে বকতে বকতে দ্রুত হাত পা ধুয়ে জামা বদলে টেবিলে এল দিয়া।

কৃষ্ণাদেবী জানেন, এবার স্কুলের সব ঘটনা তার নাতনী তাকে পুঙ্খানুপুঙ্খ বলবে। তিনি দুজনেরই ভাত ডাল তরকারি বেড়ে চেয়ারে বসলেন।

দিয়া আর কৃষ্ণাদেবী, নাতনী আর ঠাম্মা যেন একে অপরের সঙ্গে অবিচ্ছেদ্য বন্ধনে জড়িয়ে। কথায় বলে, আসলের চেয়ে সুদ বেশি মধুর। এ কথার মানে আগে না বুঝলেও এখন গভীরভাবে উপলব্ধি করতে পারেন তিনি। বলতে গেলে সারাদিনের কয়েক ঘন্টা বাদ দিলে নাতনীকে কেন্দ্র করেই তার জীবন এখন আবর্তিত বিবর্তিত। হিয়া বা রিক দুজনের কেউই বাড়ি থাকে না। হিয়া কোন সকালে উঠে রান্নাবান্না করে মেয়েকে স্কুলে পাঠিয়ে টেবিলে সব খাবার ঢাকা দিয়ে রেখে কোনো রকমে স্নান পুজো খাওয়া সেরে অফিস বেরিয়ে যায়। ফিরতে ফিরতে প্রায় আটটা। তবু তার সঙ্গে সংসারের কিছু কথা যেমন কী রান্না হবে, বাজার কী আনব? দুধ আছে? ইত্যাদি কেজো কথার বাইরে হয়তো মিনিট কয়েক টিভির সামনে বা রাতে টেবিলে একসঙ্গে খাবার বেড়ে খেতে বসা হয়। কিন্তু রিকের সঙ্গে সে অর্থে কবে যে শেষ ভালভাবে মন খুলে কথা হয়েছে কৃষ্ণা মনে করতে পারেন না।

রিক বড়ই ব্যস্ত। এতটুকু একসঙ্গে বসে আড্ডা মারার সময় নেই তার। দিয়া হিয়া দুজনেই এই নিয়ে অভিযোগ করে। তখন অবশ্য তাকে বাধ্য হয়েই ছেলের পক্ষ নিতে হয়। মুখ কালো করে হিয়াকে শুনিয়ে বলেন, তোমার বাবা তো আর ফূর্তি করতে গিয়ে রাত করছে না বা বাড়িতে থাকছে না! কাজের জন্যই তার বাইরে যাওয়া, রাত করা। তোমাদের পছন্দ না হলে বাবা বদলে নাও। আর কেনই বা বাবা তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরবে? তুমি কি বাবা ফিরলে বার গা হাত পা টিপে দাও? ছেলে আমার দিয়া দিয়া করে চেঁচিয়ে মরে, কতটুকু যত্ন নাও বাবার?

আর তোমার মা’ই বা তার স্বামীর প্রতি কোন দায়িত্ব পালন করেন? আমার ছেলে কোন সুখ পেল তোমার মার থেকে? তার তো এখনো শরীর মনের নানা চাহিদা আছে। সে চাহিদা কি পূরণ করে তোমার মা? যদি অন্য কোথাও সে এই সুখ পায় তবে বেশ করে দেরি করে ফেরে।

ঘেন্নায় মন ভারাক্রান্ত হয়ে যায় হিয়ার। এমন যে মা তার সন্তান যে কোনোদিনই স্ত্রী বা সন্তানের প্রতি মনোযোগী হবে না তাতে আর আশ্চর্যের কী আছে! সে চিৎকার করে দিয়াকে নিজের ঘরে ডেকে নেয়। বলে আম্মার বয়স হয়ে গেছে, তাই এমন কথা বলছেন, তুমি আম্মার সঙ্গে চেঁচিও না।

দিয়া তারস্বরে চিৎকার করে। বয়স হলে ঠাকুর দেবতার নাম করুক মা। তুমি সব মেনে নাও বলেই এত অসম্মানিত হও বারবার। কেন মা তুমি সবার কাছে ভাল হতে চাও? এই মহিলা অন্ধ ধৃতরাষ্ট্রের মত দুর্যোধন ছেলেকে সাপোর্ট করে। জান না এই শাসন ছাড়া অন্যায় মেনে নেবার পরিনতি কী হয়েছিল ! পুরো কৌরব বংশ নির্মূল হয়ে গেল।

দিয়া তুমি এগুলো কীভাবে জানলে? তুমি মহাভারত কোথায় পড়লে? ততোধিক ঠান্ডা স্বরে হিয়া মেয়েকে বোঝাবার চেষ্টা করে।

 আম্মা বলেছে।

তাহলে ভেবে দেখ আম্মা তোমাকে কত ভালবাসেন, তিনি যখন তোমাকে রামায়ন- মহাভারত পড়াচ্ছেন তার মানে তোমাকে কিন্তু নীতি শিক্ষাও দিচ্ছেন, তাই না? তাঁর সঙ্গে এভাবে কথা বলা তোমার শোভা পায় না।

দিয়া আরো উত্তেজিত হয়ে বলে, মা তুমি হচ্ছো পৃথিবীর সবচেয়ে নির্লজ্জ আর বোকা মানুষ। কারোর কোনো দোষ তুমি দেখতে পারো না বলেই তোমাকে এত কিছু সহ্য করতে হয়।

জানতো দিয়া, তোমার দাদু বলতেন, পৃথিবী জুড়েই তো কেবল হিংসা- মারামারি- রক্তপাত আর অশান্তি। কোথাও শান্তি নেই। তাই বেঁচে থাকার আর শান্তিতে থাকার একমাত্র উপায় অন্যের সমালোচনা না করে নিজেকে প্রতি মুহূর্তে ছেদন করো, আত্মবিশ্লেষণ করে দেখ কোথায় তোমার ত্রুটি, তাকে ঠিক করে নাও আর সকলকে ভালবাসো, সমালোচনা না করে মেনে নাও কেন তিনি এভাবে বলছেন। তাহলেই আর তোমার খারাপ লাগবে না।

মা তোমার এই জ্ঞান আর বোকাবোকা ভালবাসাই একদিন তোমাকে পথে বসাবে, তখন তুমি কেঁদে কূল পাবে না, এই বলে দিলাম আমি। মিলিয়ে নিও।

রেগে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যায় দিয়া। সেদিকে মন না দিয়ে হিয়া নিজের ঘর থেকে বেরিয়ে এসে বলে, চা খাবে মা ?

তারপর নিজের মনে গুনগুন করতে করতে রান্নাঘরে গ্যাস জ্বালিয়ে চায়ের প্যান বসায়। যদিও সে জানে এই জের থাকবে আগামী আটচল্লিশ ঘন্টা। ছেলে ফিরলে ভারী বর্ষনের মধ্যে দিয়ে আরো নানান কূ-কথা শুনিয়ে তবেই নিম্নচাপ থামবে।

কৃষ্ণাদেবীও মনে মনে জানেন তিনি যে কথাগুলো বলে হিয়া আর দিয়াকে আক্রমণ করেন, বারবার বৌমাকে ছোট করেন সেগুলো তার মনের কথা নয়। রিক সত্যি সংসারের কোনো কিছুর প্রতিই যত্নশীল নয়। তার জামাইরা যদি এমন হোত তাহলে দুঃশ্চিন্তায় তিনি এতদিনে পাগল হয়ে যেতেন। ছেলে তাঁকেও বিন্দুমাত্র সময় দেয় না। গভীর রাতে বাড়ি ফিরে বাইরের ঘরে শুয়ে আইপড বা মোবাইলে কিছু লিখতে লিখতে আপন মনে হাসে। কিছু বলতে গেলে খেঁখিয়ে ওঠে, বিরক্তি নিয়ে বলে, খাবার টেবিলে ঢাকা দিয়ে শুয়ে পড়ো। ওষুধ খেয়েছ তো?

যেন ওষুধ খেয়ে ঘুমিয়ে গেলেই শান্তি। নীরবে যে কত রাত চোখের জল ফেলেন তিনি তা ঈশ্বর ছাড়া কেউ টের পায় না। তবু ছেলের নামে কেউ কিছু বললে কেন যে মাথাটা বিগড়ে যায়! ছেলের মা বলেই বোধহয় প্রচ্ছন্ন অহং বোধ তাকে দিয়ে এমন করিয়ে নেয়।

 হিয়া কিন্তু এত ঘটনার পরেও কিছুই মনে রাখে না। এমনকী মেয়েকেও তাঁর বিরুদ্ধে তাতায় না। অথচ তিনি নাতনীকে হিয়া কিছু বললেই সটান বলে দেন, সারাদিন মেয়েকে কতটা সময় দাও? নিজেকে নিয়েই তো ব্যস্ত চব্বিশ ঘন্টা।

নির্লজ্জের মত হেসে মেয়েটা বলে, মা নাতনীটা তোমার। আমি নাই বা দেখলাম, তুমি তো আছ।

তা আছে বইকী! তিনি যেমন দিয়া ছাড়া অসহায়, দিয়াও তেমনি আম্মা অন্ত প্রাণ। নাতনীটা আমার বড় ভাল, ভাবতে ভাবতে নিজের জন্য বাড়া ভাত মুখে তুললেন সদ্য ষাট পেরোনো কৃষ্ণাদেবী।

দিয়া ভাত মাখতে মাখতেই জিজ্ঞেস করল, দুপুরের ওষুধ খেয়েছিলে? উত্তরে হ্যাঁ শুনে বলল, শোনো তবে কী হল আজ। প্রথমে তো স্কুলে ঢুকেই এক কান্ড। আমাদের ক্লাসে মোহর বলে একটা নতুন মেয়ে এসেছে। মেয়েটা বিশ্ব ন্যাকা। কনভেন্ট থেকে এসেছে। তাই সে বাংলা বলবে না।

তোদের স্কুলে তো বাংলায় কথা বলা বারণ।

সেতো ক্লাসে বলা বারণ। কিন্তু নিজেদের মধ্যে বলাই যায়। তাছাড়া মোহরের তো সেকেন্ড লাঙ্গুয়েজ বাংলা।

ও, তাই?

তবে আর বলছি কী? আচ্ছা শোন তারপর কী হল। আজ তো থার্ড পিরিয়ডে মৌসুমী ম্যামের বাংলা ক্লাস। মনে আছে তো কোন জন মৌসুমী ম্যাম!

যেন মাস্টার পড়া ধরছেন, ছাত্রীকে উত্তর দিতেই হবে এমন ভাবে মুখ কাচুমাচু করে কৃষ্ণা বললেন, ওই যে যিনি দ্রৌপদীর বস্ত্রহরণ নিয়ে নাটক লিখেছিলেন।

নাটক নয় আম্মা।ডান্স ড্রামা। যাহোক তিনিই। তার আগে হয়েছে কী, আমরা স্কুলে দারোয়ান কাকুর সঙ্গে  বাংলায় কথা বলি। কাকু তো আর ইংরেজি জানে না। কিন্তু মোহর কাকুকে ইংরেজিতে কিছু একটা এমন বলেছে যে কাকু ভীষন রেগে গেছে। সেই নিয়ে প্রিন্সিপ্যাল দারোয়ানকাকু আর মোহর দুজনকেই ডেকে পাঠিয়েছিলেন।

তা বলেছিলটা কী?

সেকি আর জানা যায় গো আম্মা! কিন্তু আমি তো গসিপ মাষ্টার। পেটে পেটে প্ল্যান ভর্তি আমার। টিফিনে ক্যান্টিনের সামনে দাঁড়িয়ে কাকুকে জিজ্ঞেস করলাম। সে তো প্রায় কেঁদেই ফেলল। তারপর বলল, মোহর নাকি স্কুল ড্রেস পরা অবস্থায় সিগারেট খাচ্ছিল স্কুলগেটের বাইরে দাঁড়িয়ে। কাকু আজ তাই দেখে বলেছে, এতে তোমার শরীরেরও ক্ষতি আর স্কুলেরও বদনাম। মোহর তখন তাকে খিস্তি দিয়েছে। কী দিয়েছে সেটা আর কাকু বলল না। কিন্তু আমি জেনে নিয়েছি।

তা কাকু অন্যায় কিছু বলেনি। এইটুকু মেয়ে সিগারেট খাবেই বা কেন আর তাও আবার স্কুলের সামনে দাঁড়িয়ে?

ঠিক। আর জান ও কাকুকে বলেছে ব্লাডি বেগার। রিপোর্ট করলে চাকরি খেয়ে নেবে। ভাব, কাকুর কত কষ্ট হয়েছে এটা শুনে।

কেন ও বুঝি স্কুলের মালিকের মেয়ে?

আরে না।ওর কোন আত্মীয় নাকি স্কুলের বোর্ড মেম্বার। কিন্তু ও তো আর জানে না, আমাদের প্রিন্সিপ্যালকে। যা ঝাড় দিল না কী বলব~!

বুঝলাম। কিন্তু এর সঙ্গে নেহা আর মৌসুমী ম্যামের কী সম্পর্ক?

আরে এই ঘটনায় তো এমনিতেই সব ম্যামের মাথা গরম ছিল, তার উপর নেহা অস্মিতাকে ক্লাসে বলেছে, মৌসুমী ম্যামের ক্লাস করা মানে সময়ের অপচয়। ব্যস, আর যায় কোথায়! উত্তম মধ্যম ঝাড় খেল দুজনেই । ম্যাম এত রেগে গেছেন যে বলে দিলেন নেক্সট ডে থেকে যেন ক্লাসে এসে উনি তাদের মুখ না দেখতে পান।

 তাহলে আজ গোঁসাইপুর সরগরম!

পুরো সরগরম। শেষ গ্রাস মুখে নিয়ে দিয়া বলল, আম্মা একটু শুচ্ছি। সাড়ে ছটায় পড়তে যাওয়া। ছটায় ডেকে দিও।

কোথায় যাবি পড়তে?

স্যারের কাছে। বলে মুখ ধুয়ে নিজের ঘরে ঢুকে গেল দিয়া।

কৃষ্ণাদেবীও উঠে পড়লেন চেয়ার ছেড়ে। এখনো অনেক কাজ বাকি। বুড়ির খাবার বেড়ে বাড়তি খাবারগুলো ফ্রিজে রেখে দিয়ে তবে শান্তি। বুড়ি, টেবিল মুছে বাসনগুলো নিয়ে নিস, বলে হাত ধুয়ে নিলেন তিনি। তারপর নিজের বিছানায় ফিরে গিয়ে, এবার একটু গড়াগড়ি না দিলে পিঠ কোমর ধরে যাবে ভাবতে ভাবতে শুয়ে পড়লেন।

চলবে…

বিতস্তা ঘোষাল। কবি, গল্পকার ও অনুবাদক। জন্ম ৫ই জানুয়ারি, ভারতের কলকাতায়। ইতিহাসে এম এ, কলেজে সাময়িক অধ্যাপনা। অনুবাদ সাহিত্যের একমাত্র পত্রিকা ‘অনুবাদ পত্রিকা’র সম্পাদক। ‘বাংলা আকাডেমি’, ‘একান্তর কথা সাহিত্যিক', 'চলন্তিকা' পুরস্কারপ্রাপ্ত। বিতস্তার প্রকাশিত বই ২২টি। তাঁর কবিতা হিন্দি, ওড়িয়া, অসমিয়া ও ইংরেজিতে...

এই বিভাগের অন্যান্য লেখাসমূহ