ছাতিম ফুলের গন্ধ (শেষ পর্ব)

বিতস্তা ঘোষাল
উপন্যাস, ধারাবাহিক
Bengali
ছাতিম ফুলের গন্ধ (শেষ পর্ব)

হিম কুহুর গল্প

হিম : দুয়ার এঁটে ঘুমিয়ে গেছে পাড়া…

কুহু: কেবল শুনি রাতের কড়া নাড়া… সরি। দেরি হল রিপ্লাই দিতে। জানো তুমি বাংলা ভাষার কথা বলছিলে দেখে আমিও কলকাতার ইতিহাস দেখলাম। এর নামকরণ নিয়ে মজার তথ্য পেলাম। দেখলাম ‘কলকাতা’ নামটি এসেছে বাংলা ‘কলিকাতা’ নাম থেকে। ব্রিটিশরা আসার আগে অধুনা কলকাতা ভূখণ্ড যে তিনটি গ্রামে বিভক্ত ছিল, সেগুলির নাম ছিল সুতানুটি, কলিকাতা ও গোবিন্দপুর।

এটা তো আমরা সবাই জানি। কিন্তু ‘কলকাতা’ নামটির উৎস নিয়ে একাধিক মত প্রচলিত রয়েছে দেখলাম। যেমন মনে করা হয়, ‘কলিকাতা’ নামটি এসেছে ‘কালীক্ষেত্র’ নাম থেকে। অন্য মতে, বাংলা শব্দ ‘কিলকিলা’ , অর্থাৎ, ‘চ্যাপ্টা ভূখণ্ড’ কথাটি থেকে ‘কলিকাতা’ নামের উৎপত্তি। আবার কেউ কেউ বলছেন কলিকাতা’ নামটি ‘খাল’ ও ‘কাটা’ শব্দ দুটি থেকেও উৎপন্ন হয়ে থাকতে পারে। আবার কেউ কেউ বলেন, এই অঞ্চলে কলিচুন ও কাতা অর্থাৎ, ‘নারকেল ছোবড়ার আঁশ’ প্রচুর পরিমাণে উৎপাদিত হত। তার থেকেই এই অঞ্চলের নাম হয় ‘কলিকাতা’।

হিমঃ  বাঃ বেশ মজার তো!

কুহু : আরো ইন্টারেস্টিং কী জানো ! কলকাতার নিকটবর্তী চন্দ্রকেতুগড়ে প্রত্নতাত্ত্বিক খননকার্য চালিয়ে প্রমাণ পাওয়া গিয়েছে যে এই অঞ্চলটি বিগত দু’হাজার বছরেরও বেশি সময়কাল ধরে জনবসতিপূর্ণ।মধ্যযুগীয় বাংলা সাহিত্যের একাধিক গ্রন্থে হুগলি নদীর তীরবর্তী কলিকাতা গ্রামের উল্লেখ পাওয়া যায়।

হিমঃ আচ্ছা ,তাই ?

কুহুঃ হুঁ। আরো দেখলাম, রাজা টোডরমলের নির্দেশে সমগ্র বাংলা সুবা জরিপ করে ওয়ালিশ-ই-জমা তুমার নামে একটা তালিকা প্রস্তুত করা হয়েছিল।আবুল ফজলের আইন-ই-আকবরিতে উল্লেখিত সেই তালিকায় আর  গোলাম হোসেন সেলিম রচিত রিয়াজ-উস-সালাতিন নামক একটি ফার্সি গ্রন্থেও “কলিকাতা” গ্রামটির উল্লেখ রয়েছে।

হিম : খুব উপকৃত হলাম এত তথ্য জানাবার জন্য । আমি ভাবতাম আমি যখন গরমের ছুটিতে ইস্কুল বন্ধ হলে ওখানে যেতাম কাকার বাড়ি , তখনি বুঝি আমার চারপাশে হুড়মুড় করে জেগে উঠত কলকাতা শহর!

কুহু : আর আমি যখন ছোটোবেলায় গ্রামে যেতাম গঙ্গা দেখতাম, ভাবতাম- আমি কলকাতায় নেই বলে গঙ্গা আমার পিছু পিছু এখানে চলে এসেছে । আচ্ছা আজ চলি।বাই।

আধো ঘুমে আধো জাগরণে হিয়া লিখে যাচ্ছিল। এই লেখাগুলো কাল অবধি মনে থাকবে কিনা সে নিজেও জানে না। অথচ এই মুহূর্তে চরিত্রগুলো যেন তাকে দিয়ে লিখিয়ে নিচ্ছে। সেই লেখার শুরু বা শেষ কোনোটাই তার হাতে নেই। কেবল তার হাতে কলম। সেই কলম যেমন খুশি লিখে যাচ্ছে, সাদা পাতা জুড়ে অজস্র আঁকিবুকিতে সেজে উঠছে শব্দরা। চেতনার স্তর ভেঙে নিজের মত পথ খুঁজে নিচ্ছে। সে কেবল অবসারভার হয়ে সেগুলো দেখে নোট নিয়ে নিচ্ছে।

তারপর … আরো একদিন…

কুহু : তুমুল বৃষ্টি

হিম : তুমুল বৃষ্টি? সাবধানে। দেখ ভেসে যেও না। শক্ত হাত আশেপাশে আছে তো!

দীর্ঘ মৌনতা। ঘণ্টা চারেক বাদে …

কুহু : গাড়ি এ্যাক্সিডেন্ট হয়েছে । থানায় ছিলাম। এখন বাড়ি এলাম।

এবার ফোন এল।

হিম: কী করে হল? চোট লাগেনি তো!

কুহু : একটু লেগেছে।

হিম : কী হয়েছিল ? ডিটেল বলো ।

কুহু : ব্রিজের মাথায় গাড়ি খারাপ হয়ে গেল। পেছন থেকে আর একটা গাড়ি জোরে ধাক্কা মারল। মাথাটা গাড়ির ওপর ঠুকে গেল। গাড়ি শুদ্ধু আমাকে ট্রেকার আর পুলিশ উদ্ধার করল। গাড়ি পুলিশ নিয়ে গেছে। কোমরে লেগেছে। আর মাথায়।

হিম : ড্রাইভার ছিল না? ডাক্তার দেখিয়েছ?

কুহু : হ্যাঁ , ড্রাইভার ছিল। না দেখানোর দরকার নেই। আসলে এত বৃষ্টি  আর জল জমে গেছিল। গাড়ির স্টার্ট বন্ধ হয়ে গেছিল। আর ব্রিজটা এমন যে স্পিড কন্ট্রোল হয় না। আর দেখাও যায় না সামনে কী আছে। তার ওপর তুমুল বৃষ্টি। অন্য গাড়িটা স্পিড সামলাতে পারেনি। চিন্তা কোরোনা। এত সহজে যম আমায় নেবেনা। কী যেন বলে, যমেরও অরুচি!!

হিম: এখন কোথায় তুমি? আঘাত কি গুরুতর ?

কুহু : বাড়িতে । আরে না। মাথায় একটু লেগেছে আর কোমরে।

হিম : রক্ত পড়েনি তো ?

কুহু : না। তখন মুহূর্তকাল একটু ভয় পেয়ে গেছিলাম। তবে ড্রাইভার ঠিক আছে।সেটাই রক্ষে ।

হিম : চোখের সামনে একটা আঙুল ধরো। কটা দেখছ? হট ওয়াটার ব্যাগ আছে? দাও। নড়াচড়া কোর না।  চুপ করে শুয়ে থাক এখন ।

কুহু : শোনো তুমি এত সেনসেটিভ কেন? আমার কিছু হলে এত ভাবো কেন? আমি জানি, বুঝি এই ভাবনাটা

তোমার শুধু আমার জন্য নয়, সবার জন্যই হয়। আজকের পৃথিবীতে এত সংবেদনশীল হওয়া ভাল কিনা

জানি না। তবে তোমার এই মনটার জন্যই তোমাকে ভালবাসি।

হিম : কে বলল আমি সেনসেটিভ ? গণ্ডারের চামড়া আমার। আজকে কাতুকুতু দিলে কাল হেসে উঠব ।

কুহু: তাহলে এত ভেবো না আমার জন্য।(একটু হেসে ) আবার কারোর সাথে পরিচয় হলে তাকে নিয়েও ভাবতে হবে তো!

হিম : দূর, ওসব কিছু নয়। আসলে তুমি ভাবতেও পারবে না কি দুঃশ্চরিত্র একটা মানুষ আমি… তবে  যে

যাই বলো প্রেমের জন্য আমি পরের জন্মে কলসি হব… হবই।

কুহু : মেরেছ কলসির কানা , তা বলে কি প্রেম দেব না ? জানো নিশ্চয়ই।

হিম: কলসির কথা মনে এল। পেতলের এবং কোমরের খাঁজের ছবিও মানসচোক্ষে দেখলাম। ভরা ভাদর। শূন্য

মন্দির ।

কুহুঃ আর?

হিমঃ দোহাই তোমার, ওটাকে মাটির কলসি করে দিও না। মেরেছিস কলসির কানা… উফ্ বড্ড বেশি বৈষ্ণব কাব্য ! চৈতন্যদেব আপনি নগর সংকীর্তনে ব্যস্ত থাকুন… আমি এই বৃষ্টির দিনে আদি রসাত্মক কবিতায় বর্নিত পেতলের কলসি আর কোমরের কথা এখন সিলিং এর দিকে তাকিয়ে ভাবতে চাই…।

কুহুঃ ভাবো না! কে বারণ করল ! আজ আবহাওয়াটাও দারুন। লং ড্রাইভে গেলে ভাল হত।

হিমঃ বেড়িয়ে পড়ো

কুহু: দূর, গাড়ি তো গ্যারেজে । নইলে সত্যি বেরিয়ে পড়তাম গো

হিম : তাহলে কাউকে ডাকো।

কুহু : কাউকে ! কাকে?

হিম : যে পথ ভালবাসে, মাধুকরী ভালবাসে

কুহু : হুঁ… দেখি কাকে পাই

হিম : এমন একজন  যে বৈষ্ণব , যে শাক পাতা খায় , চাঁদে কবিতা লেখে ,বাটিকের পাঞ্জাবি পরে…

কুহুঃ আর?

হিম: লম্বা লম্বা চুল দাড়ি রাখে, চিবিয়ে চিবিয়ে কথা বলে …

কুহু : আমার তো জানা নেই এমন কাউকে।

হিমঃ তাহলে কী হবে? আমিই আসছি। তৈরি হয়ে নাও।

কুহুঃ এসো। ধীরে ধীরে এসো। আমি অপেক্ষা করছি।

হিয়ার আরো এক দিন

ওয়েক আপ। ওয়েক আপ। স্বপ্নের ঘুম ভেঙে গেল হিয়ার। ঊঠে পড়ল বিছানা ছেড়ে। শুরু হল আরো একটা দিনের প্রাত্যহিক কাজ। দিয়া, রান্না, শাশুড়ি সব সামলে রেডি হয়ে গাড়িতে উঠে অফিস যাবার পথে মোবাইলের নেট অন করল। ফেসবুক এক নজরে দেখে নিয়ে মহুলকে ফোন করল।

বলো। অফিস বেরলে?

হুঁ। তুমি কী করছ ?

আমি ভাবছি তুমি দিল্লী এলে আমি তোমাকে মিনা বাজার নিয়ে যাব। ঘোরাব সব। মলীন কবর থেকে তোমাকে নিয়ে খুঁড়ে বের করে আনব রাজকাহিনি। ঝন ঝন অস্ত্রের শব্দ, নাচের ঘুঙুর, রঙিন ওড়না, সুরমা পরা আঁখি আর…

আর…?

আর তার বদলে তুমি আমাকে ভিক্টোরিয়ার সামনে ঘোড়ার গাড়িতে বসিয়ে ন্যাশন্যাল লাইব্রেরি নিয়ে যাবে কিংবা ময়দানে আমার সাথে বসে তারা খসার শব্দ শুনবে। তোমার নিশ্চয়ই সব ঘোরা।

হিয়ার হাসি পেল। সে বলল, আকাশ যখন মেঘলা থাকে তখন কি মনও মেঘলা হয়? মন আর মেঘ। একসাথে মনে মেঘ জমতে থাক। আবার যখন কড়া রোদ, ঘামে গা ভিজে যায়, তখন সাময়িক বিরক্তি আর ক্লান্ত লাগলেও মন কিন্তু ঝরঝরে লাগে। বড়ই অবাক লাগে। আসলে প্রকৃতির সাথে বোধহয় এই যোগটা তৈরি হয়। ঠিক তেমনি রোজ এক পথ দিয়ে অফিস যাই অথচ রোজ তাকে নতুন লাগে। গিরিশ ঘোষের বাড়িটা রোজ দেখি। আজ হঠাৎ উপলব্ধি করলাম ভেতরে ঢুকে কখনো দেখিনি কি আছে।

পাশেই বলরাম মন্দির বা সারদা আশ্রম। মা ও ঠাকুর দুজনেই এ বাড়িতে থাকতেন। সামনেই নিবেদিতারও বাসভবন। সেও দেখা হয়নি। কিন্তু নিয়ম করে এদের স্মরণ করি।

আসলে এখানেই জন্ম এখানেই কর্ম বলে শহরটাই এমন নিজের যে তার বাড়িঘর সব-ই ভীষণ চেনা নিজের মনে হয়। আলাদা করে দেখা হয় না। কবি বুঝি তাই লিখেছিলেন, দেখা হয় নি ঘাসের ওপর একটি শিশির বিন্দু। দেশের সীমানা পেরিয়ে অন্য দেশ,এক শহর ছেড়ে অন্য শহর…ছুটে যাই। ইতিহাস- ভুগোল- সমাজ- সংস্কৃতি আঁতিপাতি করে খুঁজি। ছবি তুলি, ফেসবুকে দুনিয়াকেও দেখাই। কিন্তু নিজের ঘরের সামনেই যে মণি- মুক্তো তাকে ছুঁয়েও দেখিনা।

ঠিক। আচ্ছা শোনো তোমার অফিসটা ঠিক কোথায়? একজন জানতে চাইছিলেন।

সরাসরি সে প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে হিয়া বলল, অফিসের অঞ্চলটার নাম কেলা বাগান, কেন এই নাম তাও জানি না। এককালে কি খুব কলা পাওয়া যেত? কে জানে! হাতিবাগানে অবশ্য হাতির আস্তাবল ছিল এটা নিশ্চিত জানি। আচ্ছা ফুলবাগানে কি শুধু ফুল পাওয়া যেত বা যায়!

তাতো ঠিক জানি না। তবে মহুল বলল, একটা নিম পাতাকে দেখলাম নিঝুম দুপুরে সবুজ ঘাগড়া ঘোরাতে ঘোরাতে, শূন্য থেকে নেমে আসছে নিচে। ঘটনাটা একটু আগেই ঘটল। আর তখনি আবার মনে পড়ে গেল, একজন অন্ধ মানুষ..

আর তুমি শক্ত হাতে ধরেছিলে আমায়…।

একবার এক বন্দীকে দেখা গেল দিব্বি ঘুমচ্ছে এবং স্বপ্ন দেখছে পাখি হয়ে উড়ে যাচ্ছে আকাশে। আর একটা পুলিস সারা রাত জেগে বন্দীকে পাহারা দিচ্ছে। এখানে আসলে কে বন্দী? আর কে পাচ্ছে মুক্তির স্বাদ?

মহুলের প্রশ্নে হিয়া বলল, বন্দী। কারন, সে অন্তত স্বপ্নে মুক্তি পেয়ে গেছে। আসলে আমরা তো সবাই কারাগারেই থাকি। যেকোনো ফর্মেই হোক না কেন। মনে মনে ভাবি আমরা সবাই রাজা…এই রাজা হওয়ার ভাবনাটাই আসলে মুক্তি।

ঠিক ঠিক ঠিক। আমরা সবাই এই জন্য আকাশের গান গাই।

বেশ কিছুক্ষন বাদে মহুল বলল, চিত হয়ে অনেকক্ষন শুয়ে থাকলে ভারতীয় যোগ বিদ্যায় শবাসন বলে। সাত-আট ঘণ্টার বেশি হয়ে গেলে দেখতে এসো মহুল মরে গেল নাতো!

মরবে না। আমি যার হাত ধরি সে বেঁচে থাকে অনেক বছর। আর তুমি তো আমায় বাঁচিয়ে দিয়েছ। আমার এই বেড়ে যাওয়া আয়ূও তোমায় দিলাম।

বাড়তি আয়ূ নিয়ে কী করব! পৃথিবীতে একা নিঃসঙ্গ দিন রাত কাটাতে হবে। উফ্ ! ফিরিয়ে নাও এ বর, ফিরিয়ে নাও…।

বেশ তবে তাই হোক।

তথাস্তু বলে কপালে হাত ঠেকালে ফল বেশি হয়। মহুল মজা করে বলল।

আঙুলের ফাঁকে লেগে থাকা প্রতিটি শব্দ বলছে তুমি ভালো থেকো।

ভালো থাকার রেশ নিয়ে অফিসে ঢুকল হিয়া।

হিয়া ও অজিত

ম্যাডাম কতক্ষণ আছেন? আমার সে রকম  কাজ নেই। একবার ময়দান যাব, তারপর…

চারটে অবধি থাকবই ।

কী করতে যে বসে থাকেন! তাও যদি অনেক টাকা আসত ! অফিস আসাটা আসলে আপনার একটা নেশা।

অজিতের কথা শুনে গা পিত্তি জ্বলে গেল হিয়ার। রিক-এরও এটাই ধারণা। অফিসটা নাকি তার নেশা আড্ডার  জায়গা। চেঁচিয়ে উঠতে ইচ্ছে করল তার। মনে হল ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বের করে দিই ঘর থেকে। কিন্তু দাঁতে দাঁত চেপে মাথা ঠান্ডা করে বলল, হবে হয়ত। তবে টাকাটাই কি সব?

না। কিন্তু প্রয়োজন আছে। এই আমার কথাই ধরুন, এই মাইনেতে আর চলে না, আপনি বাড়াতেও পারবেন না, আয়ই তো নেই, আমি তো জানি।

হুঁ।

এবার বোধহয় আমায় অন্য কিছু ভাবতে হবে, বোঝেনই তো সব।

ভাল কিছু পেলে যাবে নিশ্চয়ই ।

সেই চেষ্টাই করছি। তবে ওই নিয়ে এখনি ভাবতে বসবেন না। অজিত হেসে পাশের ঘরে চলে গেল।

হিয়া এই অফিস শুরু করার পর থেকেই অজিত অফিসের ম্যানেজার। মাঝে মাঝে অজিত নিজেকে বলে,

চব্বিশ ঘন্টার সার্ভিস বয়। জুতো সেলাই থেকে চন্ডী পাঠ সবটাই করার একম্‌ ও অদ্বিতীয়ম কর্মী।

কথাটা যে খুব একটা ভুল বলে তা নয়। হিয়ার আজকের অফিস গড়ে ওঠার পিছনে সবচেয়ে বড় অবদান অজিতেরই।

অজিতের সবচেয়ে বড় গুন সে বিশ্বস্ত ও অল্প টাকাতে কীভাবে সব দিক বজায় রাখা যায় সেই চেষ্টা সব সময় করে। সে যখন অফিসে যোগ দিয়েছিল তখন প্রথম দিকে কোনো স্যালারি পেত না। মাত্র ছশো টাকা দিয়ে শুরু। অবশ্য তখন হিয়ারই বা কী ছিল! খালি ঘরটা ছাড়া! বড় বড় প্রকাশকদের থেকে বই তুলে এনে বিভিন্ন মেলায় বিক্রি করত তারা। সেখান থেকে একটা পার্সেন্টেজ নিজেদের পারিশ্রমিক হিসাবে নিয়ে পথ চলা।

তখনো অজিতের বিয়ে হয়নি। স্কুল শিক্ষক বাবা, পোস্ট অফিসের কর্মী মা, সরকারী চাকুরে বড়দাদা আর সরকারী রোড ও বিল্ডিং কন্ট্রাক্টর ছোটো ভাই। অজিত বংশের মেজছেলে। কলেজে পড়ার সময় রাজনীতিতে ঢুকে যায়। পড়াশোনা ক্রমশ কমতে থাকে, পার্টির কাজ বাড়তে থেকে।  একটা খুনের ঘটনায় জড়িয়ে গেল তার নাম। পুলিস এসে এ্যারেস্ট করল। জেলে মার খেতে খেতে একদিন পাল্টা মেরে জেল থেকে পালালো। সোজা ট্রেনে চেপে কলকাতা পার্টি অফিস। বেশ কিছুদিন সেখানেই থাকার পর এক সহৃদয় সাংবাদিক ও উকিলের সাহায্যে মিথ্যে খুনের মামলা থেকে মুক্তি পেল সে। হয়তো কলেজ ও পড়াশোনার ইতি ঘটে যেত তখনি। কিন্তু ঘটল না। নতুন করে আবার প্রাইভেটে পড়াশোনা শুরু করল অজিত। পাশ করে কিছুদিন এদিক ওদিক টুকরোটাকরা কাজ। তারপর এই অফিসে যোগ দিল। তাও নয় নয় করে বছর দশ।

সেদিনের ছশো টাকা বাড়তে বাড়তে আজ সাড়ে সাত হাজার। এর মধ্যে বিয়েও করেছে গরীব ঘরের একটি মেয়েকে। তাও বছর সাত হয়ে গেল।

কিছু দিন আগেও নিজের মাইনে পত্র নিয়ে বিশেষ ভাবত না অজিত। কারন পেনসন প্রাপ্ত মা বাবা আর যৌথ পরিবারের দৌলতে সংসারে সেভাবে টাকা দেবার কোনো প্রয়োজন হত না। বাড়ির এই মেজছেলে আর ছেলের বৌকে সবাই বেশ স্নেহই করত। অজিত বড়জোর মাঝে সাজে অফিস ফেরত দাদার বাচ্চা   , বৌদি, মা বাবার জন্য টুকিটাকি জিনিস, ভাল মিষ্টি ইত্যাদি নিয়ে যেত।

আসলে কী জানেন ম্যাডাম, হেঁশেল থেকেই তো সব সমস্যার শুরু যৌথ পরিবারগুলোতে। তা আমার মা’ই যেহেতু এখনো হেঁশেলের মালিক তাই কোনো ঝামেলা নেই। আর আপনার বোন সবার সঙ্গে ভালই মানিয়ে গুছিয়ে নিয়েছে। তাই অতটা চিন্তা করি না। অজিতের কথাগুলোয় বেশ আত্মপ্রত্যয় লক্ষ্য করত হিয়া।

কিন্তু সব আলোর পিছনেই অন্ধকার থাকে। অজিতের বাবা দীর্ঘ রোগ ভোগের পর গত বছর চলে গেলেন। মা’ও সেই শোকে দুঃখে অসুস্থ হয়ে পড়লেন। ফলে সংসারের অনেক সমীকরণ উলটে পালটে গেল।

অজিত তাই বাধ্য হয়েই টাকার কথা ভাবছে।

এসব ভাবতে ভাবতে হিয়ে মনে মনে বলল , একটু শান্তিতে কাজ করছিলাম, বেশ লিখছি নানা পত্র -পত্রিকায়, তাও এবার গেল, আবার নতুন করে কাউকে তৈরি করতে হবে। তা বেশ সময় সাপেক্ষ। তাছাড়া  পেলেও অজিতের সাবস্টিটিউট কী আর হবে? কিন্তু কি আর করা যাবে! তার দিকটাও ভাবতে হবে, এই টাকায় আজকাল কি আর হয় ! দেখা যাক কতদূর কী করা যায়! ভেবে নিজের অসমাপ্ত লেখায় মন দিল হিয়া।

অসম্পূর্ণ কথা

বেশ কিছুদিন বাড়ি, রিক, কৃষ্ণাদেবী, মহুল সবাই চুপ। যে যার মত নিজেদের নিয়ে ব্যস্ত ছিল।

তারপর এক রাতে মহুল বলল, কথা অসম্পূর্ণ রয়ে গেল। কাজের সুড়ঙ্গে ঢুকে পড়েছিলাম। আজ হুঁশ হল  টেবিলের উপর রাখা কাগজপত্র, দেওয়ালের ক্যালেন্ডার, ছাদে শুকোতে দেওয়া জামা কাপড় আর মাথার ভিতরের নাট বল্টু সব এলোমেলো। এখন যে কী করি!

এখন তাহলে চুপ করে বসে আকাশ দেখ। মনে মনে ভাবো সবার অলক্ষ্য শূন্যে মহা আকাশে এক বিরাট শিশু এই বিশ্ব নিয়ে আনমনে খেলছেন আর লীলা দেখাচ্ছেন।

ঠিক আছে। যথা আজ্ঞা। তাই করি বরং। ক্ষুধা তৃষ্ণা কিছুই নেই এখন আর…তোমারও কি এমন হয়?  মহুলের জিজ্ঞাসায় হিয়া লিখল, জানি না। তবে  কোনো কোনো দিন হঠাৎ হঠাৎ মন খারাপ করে। কেন যেন মনে হয় আমার আাশে পাশের কোনো কিছুর সাথে কোনো যোগ খুঁজে পাচ্ছি না। সব আছে, তবু কি যেন নেই। তাকে ধরার চেষ্টা  করছি, ধরতে পারছি না। খুব একা লাগে তখন। সব মানেহীন মনে হয়। নিজেকে বারবার প্রশ্ন করি কেন বেঁচে আছি। গোটা একটা দিন, কখনো বা আরো  কয়েকদিন এই জিজ্ঞাসা  নিয়ে কাটাবার পর এক সকালে ঘুম ভেঙে দেখি গাছে পাখি বসে, ফুলে ফলে ভরে, আকাশটাও মেঘের পানসী  ভাসিয়ে হেই হা হো হেই হা করছে। সঙ্গে সঙ্গে মন ভাল হয়ে যায়। বুঝি, এ পৃথিবী আমার, এ আকাশ এ বাতাস আমার। ঠিক তখন কলিংবেল বাজল। সামনে এসে দাঁড়াল এমন একজন সে তোমার খুব খুব আপন। ব্যস, মন বলল- পেরিয়ে এলাম অন্তবিহীন পথ … বোধ করি এই পথটা পেরোবার জন্য-ই এ কদিন বিষন্ন হয়ে ছিলাম। হয়তো তখন অন্য একটা গ্রহে পরিক্রমা করছিলাম। সেখানকার দেখা শেষ হতেই আবার ফিরে এসেছি নিজের ঘরে।

তোমার কথাগুলো বুকের থেকে ছুঁয়ে ঝরাচ্ছে। তাই এত আন্তরিক। কিন্তু তোমার দরজায় কে সকালে এসে দাঁড়ালে তুমি উদ্ভাসিত হয়ে ওঠো! ওই লোকটাকে আমি ঈর্ষা করি। রাতে জ্বলে পুড়ে খাঁক হয়ে যাব।

হা হা হা। এমন যদি কেউ আসত তবে নিশ্চয়ই চিৎকার করে গান গাইতাম গো। তবে এটা ঠিক সবার জীবনেই এমন  কেউ আসে। কখনও বুঝে কখনো না বুঝে। হিংসে না করে নিশ্চিতে ঘুমোও, আমি এখন ঘুমতে যাচ্ছি।

হিয়া ফোন অফ করে দিয়াকে জড়িয়ে শুয়ে পড়ল।

 

হিয়া ও মিতুল

দিদি , তোর ছোটবেলার কথা মনে পড়ে? মিতুল বলল।

পড়বে না কেন? কোনটা জানতে চাস বল।

সেই যে হলুদ প্রজাপতিগুলো, তুই দৌড়চ্ছিলি ধরবি বলে …

আম বাগানের মধ্যে । অ-নে-ক –অ-নে-ক  তাই না! ধরতে পারলাম কই? তার আগেই তো…

মা তোকে খুব মেরেছিল। লেগেছিল, না রে দিদি?

বোধহয় ,ব্যথাটা মনে পড়ে না। খালি প্রজাপতিগুলো উড়ে গেল।

তুই আমার উপর খুব রেগে গেছিলি না?

রাগব কেন?

আমি যদি মাকে বলে না দিতাম তাহলে মার খেতিস না, তুই ঠিক ওগুলো ধরতে পারতিস।

জানি নারে বোন। কোন কিছুই কি আদৌ ধরে রাখা যায়! শুধু মনের কোনে একাকি ঘুরে বেড়ায় সেগুলো।

তোর মনে আছে দিদি – তুই যেই ওই বাড়িতে পা রাখতিস ঠাম্মা তোকে জড়িয়ে ধরে বলত , ‘শিব -শিব- শিব এসে গেছে,বাঁচিয়ে রেখ,নইলে ছেলের কাছে মুখ দেখাতে পারব না’।

হ্যাঁ। এখন বুঝি ঠাম্মার কম্ম ছিল না আমাকে সামলানো। আমি নিজেই এখন দিয়াকে সামলাতে হিমসিম খাই।

দিদি কার সাথে কার তুলনা! দিয়া তোর মত দুষ্টু কখনোই নয়। তাছাড়া ওরা ফ্ল্যাটের চার দেওয়াল ছাড়া আর কী জানে! খেলা বলতে কম্পিউটারে বসে গেম আর গান শোনা,আর তুই ! সারাদিন টোটো কোম্পানি।  তোর পিছনে ছুটতে ছুটতে আমি ক্লান্ত হয়ে যেতাম। কী করে এত এনার্জি পেতিস তুই?

জানি না, তবে ওই আনন্দগুলো ছিল বলেই এখনও দৌড়তে পারছি রে। নইলে কবে যে… হিয়ার কণ্ঠস্বরে বিষণ্ণতা।

তবে দিদি , তুইও একবার ভয় পেয়েছিলি। তোর মনে আছে?

থাকবে না? সারা গ্রামের যত হনুমান পিছনে দৌড়চ্ছে ,আর আমিও ছুটছি …  ছুটতে ছুটতে ঘরে এসে দরজায় ধাক্কা দিচ্ছি। লতা মামী কিছুতেই দরজা খুলছে না। জানলায় দাঁড়িয়ে মজা দেখছে।

খুব বাজে ছিল লতা মামীটা। ঠাম্মার পাশে শুয়েছিলাম, হঠাৎ তোর চিৎকার। ঠাম্মা ধড়মড়িয়ে উঠে ছুটে গিয়ে দরজা খুলে দিয়ে লতাকে মারল।

সেদিন প্রথম ভয় পেয়েছিলাম। ঠাম্মাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদেছিলাম। এখনও জানিস মাঝে মাঝেই ঘুমের মধ্যে ওই দৃশ্যটা দেখতে পাই। মনে হয় আমি দৌড়ে ঘরে ঢুকতে চাইছি,সব দরজা বন্ধ,ধাক্কা মারছি,চিৎকার করছি, তবু কেউ খুলছে না।এখন বুঝতে পারি যে দরজাগুলো একবার বন্ধ হয়ে যায় সেগুলো আর সহজে খোলা যায় না।

তুই কোন্ দরজার কথা বলছিস?

কে জানে!সারা বিশ্বে এত দরজা, কত আর খুললাম!

চল দিদি আমরা আবার আগের মত  সব ছেড়ে ওখানে চলে যাই…

আমি পারব,তুই পারবি না রে …

ঘুমের মধ্যেই চোখের পাতাটা ভারি হয়ে এল হিয়ার। কান্না পাচ্ছে। শৈশবের সেই দিনগুলো থেকে এই ফ্ল্যাটটা কতদূর ! কত আলোকবর্ষ পিছনে গেলে আবার সেই দিনগুলো ফিরে পাব?

হিয়ার ঘুম ভেঙে গেল। শৈশব আর চল্লিশ উর্ধ মধ্যযৌবনের দিনগুলোর মধ্যে সত্যি আজ কত ফারাক! লক্ষ লক্ষ দড়ি দিয়ে মেপেও দুই প্রান্তরের মধ্যে আর কখনো জোড়া লাগানো যাবে না। যে মিতুলকে ছাড়া একমুহূর্ত থাকতে পারতাম না তার সঙ্গেও কত বছর প্রাণ খুলে গল্প আড্ডা হয় না। সেও আজ নিজের সংসার নিজের কাজ নিয়ে ব্যস্ত।

আচ্ছা সত্যি কি নিজের বলে কিছু হয়! নিজেই কি নিজের? সবার সঙ্গে তাল মেলাতে মেলাতে কখন নিজের থেকে বেরিয়ে পরের হয়ে যেতে হয় টের পাওয়াই যায় না। সংসার – মা বলতেন, ‘সং’ কে ‘সার’ করার জন্যই মেয়েদের জন্ম। ছোটোবেলায় পুতুল খেলা শিশুরা বড় হয়ে নিজেরাই পুতুল হয়ে যায়। কখনো পিতার কখনো স্বামীর, কখনো সন্তানের। মানিয়ে নিতে হয়, যত মানাবি ততই সম্পর্ক মধুর হবে। এটা এখন প্রায়ই মনে হয়। আসলে পিতৃ্তান্ত্রিক সমাজে একজন পুরুষ –সে বাবা বা স্বামী যেই হোক না কেন সেখানে চিন্তার স্বাধীনতা আসে না। পরমুহূর্তেই তার মনে হল, সে অর্থে পৃথিবীর কোনো মানুষই কি স্বাধীন! এই শব্দটাই  বোধহয় মানেহীন।

আসলে কিছু কিছু ঘটনা, শব্দ, বিষয় কেবল স্মৃতি হয়েই থেকে যায়। অতীত বড় মায়াময়। মায়া মাখা রোদ, বৃষ্টি, শৈশব, কৈশর এমনকি যৌবনও। মায়ার বাঁধনে বাঁধা সব সম্পর্ক ,আবেগ, অনুভূতি। জাগতিক সব কিছুই মায়া। মায়া ছাড়া বাঁচা কঠিন। তবু ছাড়তে হয়, একে একে সব ছাড়তে হয়েছে, হয়, হবে… কেবল অপেক্ষা সময়ের।

অধরা মাধুরী

আরো এক দুপুরে অফিস পৌঁছনো মাত্র মহুলের ফোন এল। হিয়া হ্যালো, বলতেই বলল, কেউ কি এলো নিঃশব্দ চরণে তোমার দরজায় ?

মজা করে হিয়া জানালো, কাল রাতে বৃষ্টি এসেছিল আকাশ মাথায় করে। ফিরিয়ে দিয়েছিলাম। এখন দুয়ারে

দাঁড়িয়ে কলিং বেল বাজিয়েই চলেছে…।

কেন তাকে আসতে দিচ্ছ না? কেন তাকে ফিরিয়ে দিচ্ছ বার বার?

ভেতরে ঢুকে পড়লে যে বন্যা হয়ে যাবে মহুল …

খানিক নীরবতা। তারপর মহুল বলল, ঝপাং …। সেই বন্যার জলে ঝাঁপ দিলাম।

কি জন্য ? সাঁতার জানো? হিয়া জানতে চাইল।

না। ডুবতেই চাই। সংক্ষিপ্ত জবাব মহুলের।

বাঃ। ডোবো তাহলে। খালি দেখে নিও ডোবার আগে সেটা কোনো পুকুর, নদী না সমুদ্র? তলিয়ে যাবার আগে তোলার জন্য কাউকে পাঠাব।

কাউকে! ভেবেছিলাম তুমি। না তাহলে আর ডুবতে বা ভাসতে চাই না…।

না চাইলেই ভালো। নোনা পচা জল নাকে মুখে ঢুকে গেলে চাপ হয়ে যাবে।

মহুল ফোন রাখার পর হিয়ার মনে হল, মহুলের সঙ্গে কি আমি গভীর কোনো সম্পর্কে জড়িয়ে পড়তে চলেছি! তাই যদি হয় তবে সেটা মেনে নেওয়া ঠিক হবে না। মেনে নেওয়া আর মানিয়ে নেওয়ার মধ্যে অনেক অনেক পার্থক্য। রিককে মানিয়ে নিতে নিতে আমি ক্রমশ মেনে নিয়েছি। অন্য কারোকে সেভাবে মেনে নেওয়া আর সম্ভব নয়।

হিয়ার বাবার কথা মনে পড়ল। প্রতিটা সম্পর্কে একটা টেবিল ডিস্টান্স রাখতে হয়। পুরোটা উন্মুক্ত করে দিলে বা মাঝের দূরত্বটা না থাকলে সব সম্পর্কগুলোই কিছুদিন পর একঘেয়ে, আর বাসী হয়ে যায়। তখন সেই প্রতিদিনের নুন তেল চালের গল্প। কিন্তু ভালভাবে বেঁচে থাকার জন্য বিশুদ্ধ অক্সিজেন টানতে হয়। তাতে অর্ধ মৃত শরীর প্রাণ ফিরে পায়। নইলে সেই একভাবেই বেঁচে থাকার অভিনয়… আসলে আমরা তো কেউ সম্পূর্নভাবে বেঁচে নেই। তারপরেই বাবা বলতেন, বুদ্ধি করে চল। ব্যালেন্স বজায় রাখ।তবেই শরীর মন আর মেধা সব পরিতৃপ্ত হবে।

এইমুহূর্তে এই কথাগুলো মনে এল তার। বাবা বোধহয় ঠিকই বলতেন, ভেবে দীর্ঘশ্বাস ফেলল হিয়া।

সেদিন অনেক রাতে মহুল জানালো , অধরা মাধুরী খুঁজছি… খুঁজেই চলেছি..

বহুদিন আগে একটা গল্প পড়েছিলাম। অধরা মাধুরী। তাতে নায়ক সারা জীবন মাধুরীকে খুঁজে গেল। হিয়ার

সেই গল্পের বিষয়ে বিন্দুমাত্র উৎসাহ না দেখিয়ে মহুল বলল, অক্ষর শব্দ হারিয়ে যাচ্ছে।

কেন কী হল আবার ?

আজকাল এক ধরনের নাথিংলেস কাজ করে…

হিয়া অবাক হল তার কথায় ।  বুঝলাম না। ক্লিয়ার করো।

উদাসীনতা। সংক্ষিপ্ত জবাব।

ওটা চিন্তাশীল মানুষের ধর্ম ।

আমি সেই মহাজ্ঞানী বটবৃক্ষ নই।

তাহলে?

ওটা একটা অসুখ, যা ফিরে ফিরে আসে…যার কোনো ওষুধ নেই।

হিয়ার মনে হচ্ছিল মহুল কোনো লম্বা নাটকের স্ক্রিপ্ট লিখছে। এর পরের ডায়লগ তার জানা। এই স্ক্রিপ্টটার বাকি অংশ সে কবেই লিখে রেখেছে। এখন শুধু জোড়া লাগাবার অপেক্ষা। সে আনমনে জানালো, আছে।

কি আছে জানাবে আমায়? মহুলের প্রশ্নে হিয়া জানালো, তার আগে কাউন্সিলিং করতে হবে।

দেবী, সে তো বড় দীর্ঘ চিকিৎসা পদ্ধতি! নিরাময়ের আর কোনো সহজ পথ নেই?

হিয়া শব্দ করে হাসল। আপনি কি ভাবছেন সেটা জানা যে দরকার। সেই বুঝে তো ওষুধ দেব।

মহুল প্রত্তুত্তরে বলল, সুচরিতা , নিরাময়তার খোঁজে চললাম।

আপনার যাত্রা পথ রঙিন হোক। যদিও  ঊষর, কণ্টকাকীর্ণ , বিপদসঙ্কুল সে পথ…তবু চরৈবেতী…চরৈবেতী…

বন্ধনহীন গ্রন্থি

নির্দিষ্ট দিনেই অনিরুদ্ধর হাতে নিজের লেখা তুলে দিল হিয়া। বেশ ক’দিন একটা একাকীত্ব ঘিরে থাকল তাকে। আসলে হিম কুহু বা যে কোনো গল্পের চরিত্রগুলোর সঙ্গে সহবাস করতে শুরু করার পর থেকে সে নিজেও সেই ঘটনার একটা চরিত্র হয়ে যায়। তখন সেই চরিত্রগুলো যা যা করে সেও তাই তাই করে যায় তাদের অনুসরণ করে। তাদের সঙ্গেই তখন গড়ে ওঠে সখ্যতা। তাদের সুখ দুঃখ প্রেম বিরহ এমনকি তাদের দৈনন্দিন জীবনের সব খুঁটিনাটির সঙ্গে আত্মিকভাবে জড়িয়ে পড়ে নিজের অস্তিত্ব। যেন তাদের ঘিরেই তার বেঁচে থাকা।

তারপর হঠাৎ করে চরিত্রগুলো নিজের গতিপথ পালটে নিয়ে সকলের অজান্তে ঘুমিয়ে পড়ে। আর তখন যেন হিয়ার ঘুম ভেঙে যায়। সে তখন বুঝতে পারে না আসলে সে কে! একটা যন্ত্রনা তখন বুকের মধ্যে বাসা বাঁধে। ক্রমশ সেই ব্যথাও সহ্য হয়ে যায়। চোখের সামনে নতুন কোনো মুখ এসে দাঁড়ায়। আবার তাদের নিয়ে মেতে ওঠে সে।

ইদানিং মহুলের সঙ্গেও সে অর্থে আর কথা হয় না। হয়তো যে কথাগুলো বলার ছিল সেগুলো বলা হয়ে গেছে, কিংবা কোনো কথাই আসলে বলা হয়নি। মহুল হয়তো তার মনের মধ্যে লুকিয়ে থাকা এক স্বত্তা, যেগুলো তার নিজেকেই বলার ছিল, কিন্তু প্রকাশ করতে পারছিল না। মহুল নামক একজন সেই কথাগুলোকেই কেবল টেনে বের করে নিয়েছে তার অবচেতন মন থেকে। আর সে ক্রমাগত নিজেকে প্রকাশ করেছে। এটা হয়তো মহুল না হয়ে অন্য কেউ হলেও এভাবেই কিংবা আরো অন্য কোনো ফর্মে প্রকাশিত হত।

হিয়ার হঠাৎ মনে হল, মহুল একটা নাম, যার সঙ্গে সে জড়িয়ে গেছিল একটা ভার্চুয়াল জগতের হাত ধরে। এবার সেখান থেকে বেরিয়ে আসার সময়। তার আরো মনে হল, হয়তো মহুল নামের সেই ব্যক্তিটিও একই ভাবছে। তাই আর কোনো ফোন বা টেক্সট নেই।

কিংবা দুজনে মিলেই দুইপ্রান্তে বসে একটা দীর্ঘ গল্প লিখছিল, সেটা শেষ। তাই হিয়া বা মহুল নামগুলোর আর কোনো অস্তিত্ব নেই। ঠিক যেমন কোনো কোনো ব্যক্তির টেলিফোন নাম্বার এক সময় খুব ভাল ভাবে জানা থাকলেও হঠাৎ একদিন জানা যায়, আপনি একটি ভুল নাম্বারে ফোন করেছেন। এই নাম্বারটির কোনো অস্তিত্ব নেই।

একটা নাম্বার বা নাম দিয়ে কি মানুষের প্রকৃত পরিচয় পাওয়া যায়? অস্তিত্ব শব্দটাই আসলে ভীষণ জটিল একটা শব্দ যার মানে আজো বুঝে উঠতে পারলাম না। নিজের মনেই বিড়বিড় করল সে।

হিয়া আবার ফিরে এস তোমার পুতুল খেলার সংসারে, ফিরে এস প্রতিদিনের ব্যস্ত বা অকেজো জীবনের ছন্দে। নিজেকে বোঝালো হিয়া।

আরো কিছুদিন পর এক বৃষ্টির রাতে বারান্দায় বসে আকাশ দেখতে দেখতে হিয়া মহুলকে জানালো:

মহুল কোনো কোনো পথ থাকে, যা একাই হাঁটার। কোনো রাস্তায় ক্লান্তি ভরা মিছিল। কোনো রাস্তায় অজানা বাঁক-হাইরোড কিংবা খানা খন্দ। কিন্তু আমি যে পথে হাঁটছিলাম, তার মাথার উপর বিবর্ণ একফালি চাঁদ। সে পথেও কাদা ছিল। তবু সেই বেঁধে দিল আমাদের। কিন্তু আমি যে কোনো বন্ধনে আটকে থাকতে পারি না। তাই বন্ধনহীন ভালবাসাটুকু থাক, বাকি সব জমা করে রাখলাম মেঘ পিওনের কাছে। কোনো না কোনো সময় সে ঠিক আমাদের দুজনের খবর দুজনকে পৌঁছে দেবেই।

সেই রাতেই ঘুমোতে যাবার আগে হিয়া শহরের বাইরে থাকা রিককে মেসেজ পাঠালো, এই যে তুমি নেই, মানে আমিও নেই কিংবা আমরা দুজনেই আছি। নিঃশ্বাসের মত,প্রতি পলেই আছে অথচ আছে যে তা বুঝতেই পারি না। তবু অবিরাম বয়ে চলা সময়ও জানে তার মূল্য কত! আমি নিশ্চিতভাবেই জানি সব কথা শেষ হলে, নীরবতাই মুড়ে দেবে তোমাকে।

বাইরে মেঘ তখনও ভেসে চলেছে। ঘরটায় কালো অন্ধকার। অথচ বিদ্যুতের ছটায় বিছানায় শুয়ে থাকা দিয়ার মুখ আলোকিত। সেই মুখের দিকে তাকিয়ে দেখতে দেখতে হিয়ার মনে হল জীবনের চাওয়া-পাওয়ার হিসেবগুলো বড় আপেক্ষিক। রোদ মেঘ বৃষ্টি এগুলো আসবে- যাবে। অথচ বর্ষায় ছাতিম ফুলের গন্ধ যখন ভেসে আসে তখন মন উদাস হয়ে যায়। যার রেশ থেকে যায় সারা জীবন ধরে।

আসলে আলো- আঁধারের মায়াময় এই জীবনে সবাই মিলে আনন্দের সঙ্গে বেঁচে থাকাটাই পরম প্রাপ্তি। বাকি সব সামলে নেওয়া যায়। এইসব ভাবতে ভাবতে হিয়া দিয়াকে বুকের কাছে টেনে নিয়ে নিশ্চিন্তে বালিশে মাথা রাখল।

বিতস্তা ঘোষাল। কবি, গল্পকার ও অনুবাদক। জন্ম ৫ই জানুয়ারি, ভারতের কলকাতায়। ইতিহাসে এম এ, কলেজে সাময়িক অধ্যাপনা। অনুবাদ সাহিত্যের একমাত্র পত্রিকা ‘অনুবাদ পত্রিকা’র সম্পাদক। ‘বাংলা আকাডেমি’, ‘একান্তর কথা সাহিত্যিক', 'চলন্তিকা' পুরস্কারপ্রাপ্ত। বিতস্তার প্রকাশিত বই ২২টি। তাঁর কবিতা হিন্দি, ওড়িয়া, অসমিয়া ও ইংরেজিতে...

এই বিভাগের অন্যান্য লেখাসমূহ