ছিন্নবীণা ও পেত্নির ছোঁয়া

মৃদুল শ্রীমানী
ছোটগল্প
Bengali
ছিন্নবীণা ও পেত্নির ছোঁয়া

ছিন্নবীণা

আমি প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষক । বাড়ির কাছের স্কুলটিতে শিক্ষকতা পেয়ে গিয়ে আমি আর ফিরে তাকাই নি। বীণার সাথে যখন বিয়ে হোলো আমার তখন বাবা বলেছিল আপনাদের মেয়ের মতো আমাদের ছেলেও ঠিক একদিন হায়ার সেকেন্ডারি স্কুলে মাস্টারি পেয়ে যাবে । আমার শ্বশুর শ্বাশুড়ি দেখেছিলেন আমাদের নিজেদের বাড়ি । বাড়ির লাগোয়া বেশ খানিকটা জমিতে সেগুণ আর মেহগণি গাছ । গুঁড়ি তাদের বেশ মোটা হয়ে গিয়েছে।

বীণা ফিজিক্স পড়েছে । কিন্তু গান আর আবৃত্তিতেই ওর বেশি আগ্রহ । আমার বাবা মা যখন ওর সাথে আমায় একান্তে কথা বলতে দিলেন, তখন বীণা জানতে চেয়েছিল – আমার গান গাইতে ভালো লাগে। বিয়ের পর আমায় গাইতে দেবেন তো ?

আমি হেসে বলেছিলাম – সে কি, দেখো আমার বন্ধুরা গান শুনতে চেয়ে তোমায় পাগল করে দেবে।

বীণা বলেছিল, না না, সে রকম নয়, ভোরে উঠে আমি রেওয়াজ করি কি না … আপনাদের হয়তো অসুবিধে হবে …

আমি মনে মনে বলেছিলাম – বিয়ের পর প্রথম কয়েক বছর তোমায় ভোরে উঠতেই দেবো না ।

আমাদের বিয়ে হোলো । বিয়ের পর আমি বন্ধুদের আমার বাড়ি আসা একেবারে বন্ধ করে দিলাম। কেননা, ওরা বীণার দিকে হাঁ করে চেয়ে থাকতো। আরে এত হাঁ করে দেখার আছে টা কি?

আসতো আমার একটি মাসতুতো ভাই । সে বেচারার বুদ্ধি শুদ্ধি কম। পড়াশুনাও করতে পারে নি সে জন্যে । মাসি সন্দেহ করে খুব ছোটবেলায় পাঁচের বাড়িতে কারো হাত থেকে পড়ে গিয়েছিল। ভয়ে সে বলে নি । চিকিৎসা হলে ছেলেটার পড়াশুনা হতো বলে মাসি আপসোস করে। বলে তোর মতো মাস্টারি না পাক, নিদেন পক্ষে কি কেরানিও হতে পারতো না! দেখতে শুনতে তো ছেলে আমার খারাপ নয়!

তা ঠিক, ভাইটি আমার ভারি চমৎকার দেখতে।

আমার বিয়ের পর আমার সেই ভাই আমার বউয়ের পায়ে পায়ে ঘোরে। আমি বীণাকে বললাম – ভাইকে নিয়ে ভেবো না । ও দেখতেই যা বড়ো। আসলে ওর বোধবুদ্ধি একেবারে ছেলেমানুষের মতো । পরে আমি কখনো কখনো দেখেছি ভাই আমার বীণার চুল বেঁধে দিয়েছে, ভ্যানিটি ব্যাগের ভিতর থেকে পয়সা নিয়ে দৌড়ে গিয়ে চুলের ক্লিপ কিনে এনেছে।

বীণাকে বলেছিলাম ফ্ল্যাট কিনবো । বীণা শ্বশুর শ্বাশুড়িকে ছেড়ে যেতে চায় নি। বলেছিল – জ্ঞাতিরা আছেন, আত্মীয় কুটুম্বিতা রয়েছে । আমরা চলে গেলে বাবা মা সামলাবেন কি করে। আমি মুখ গোঁজ করে থাকতুম। বাবা মা বেশিদিন টিকলেন না । তখন বীণার বুদ্ধিতে আমাদের বাড়িতে প্রোমোটিং করিয়ে বেশ বড়োসড়ো একটা ফ্ল্যাট আর নগদ টাকা পেয়ে গেলাম।

আমার স্কুল ছুটি হতো তাড়াতাড়ি । বীণারটা খানিক দূরে। বাস বদলাতে হয়। সময় লাগে। কাজের মেয়ে আমায় চা ধরে দেয় । আমি টিভি দেখি, কাগজ নাড়ি চাড়ি । তারপর বীণা এলে আমার আর ভালো লাগে না। ক্লাবে চলে গিয়ে ক্যারম পিটি ।

ফিরে এসে দেখি বীণা গানের রেওয়াজে বসেছিল ।

একদিন বীণার একটু দেরি হতে আমি জানতে চাইলাম – তোমার দেরি হোলো যে?

ও হেসে বললো – এই একটু কাজ ছিল ।

কি রাজকার্য জানতে পারি?

বীণা হাসল। সে ভারি সামান্য ব্যাপার। শুনলে তুমি হাসবে।

আমার হাসি পেল না। আমি খোঁজ খবর নিয়ে জানতে পারলাম বীণা স্কুলে সায়েন্স একজিবিশন করবে বলে ছেলে মেয়েদের তালিম দিচ্ছে । কিন্তু বীণা আমায় এ কথাটা বলল না কেন? আমি প্রাইমারি মাস্টার বলে বীণা কি ভাবছে আমি বিজ্ঞানের কি কিছুই বুঝি না? আমার রাগ হোলো ।

একজিবিশন মিটে গেলেও বীণার তাড়াতাড়ি ফেরার নাম নেই । আমি খোঁজ খবর নিয়ে জানলাম বীণা স্কুলে বাড়তি ক্লাস নিচ্ছে। আমার আরো রাগ হোলো।

বীণা আমি তোমায় বিয়ে করেছি তোমার সঙ্গ পাবো বলে । ফ্যা ফ্যা করে রাস্তায় ঘুরবো বলে তোমায় বিয়ে করি নি।

বীণা কোনো জবাব দিল না দেখে আমি জানতে চাইলাম – কোচিং ক্লাশে পড়াতে ভালো লাগে তোমার?

বীণা ঠোঁটের কোণে একটু হাসি টেনে এনে বলল – গাঁ ঘরের গরিব ছেলেরা বিজ্ঞানের আইডিয়া গুলো পেয়ে নিজে নিজে চিন্তা করতে শিখে গেলে সমাজটা বদলে যাবে ।

বীণাটা পাগল । সমাজ বদলের স্বপ্ন দেখে । আমি ওর নাইটির একটা সাইড দিয়ে ভেতরে হাত ঢুকিয়ে দিই। কয়দিনই চোখে পড়েছে ওর নাইটির ওখানটা সেলাই খুলে গিয়েছে। মহারাণী সেলাই করার সময় পাননি ।

একদিন একটা বাচ্চা মেয়েকে নিয়ে হাজির ।

কে এটা ?

জানো, ওর মা ওকে ফেলে গিয়েছে। আমি ওকে নিজের কাছে রেখে মানুষ করবো ।

তুমি জানো এসবের ঝক্কি কেমন?

মিনতি করে বীণা বললো – লক্ষ্মীটি , তুমি অমত কোরো না । আমার বাবা মা ওর জন্যে দু লাখ টাকা ফিক্সড করে দেবে বলেছে । তোমার টাকায় হাত পড়বে না।

আমি তো জানি বীণার বেতন হয় ব্যাঙ্কে, আর তার পাশ বই চেক বই সব গচ্ছিত থাকে আমার কাছে। আমি তাকে যেটুকু হাতখরচ দিই তাতে সে চালিয়ে নেয়। নতুন নাইটি কিনে দিই নি বলে অভিযোগ পর্যন্ত করে নি। বীণা কি ভাবে আমি একটা কঞ্জুস ?

যাই হোক, ওকে কিন্তু আমাদের বিছানায় শুতে দেব না ।

না না , বাবা ওর জন্যে একটা সিঙ্গল খাট দেবে বলেছে।

খাট। সিঙ্গল? কোথায় রাখবে? আমার বেডরুম আমি শেয়ার করবো না।

না না, মেয়েকে নিয়ে আমি পড়ার ঘরে শোবো । বললাম, তোমার কষ্ট হবে।

আমার বলতে বাধল যে, তার শরীরটা রাতে আমার প্রয়োজন হয় ।

এভাবেই কাটছিল । বীণা শুচ্ছিল মেয়ের কাছে । মেয়ে ঘুমোলে বীণা আমাদের খাটের এককোণে জড়সড় হয়ে শুয়ে থাকত । স্কুলে যাবার সময় মেয়েকে নিয়ে যেত আর ফিরতো ফ্রি কোচিং সেরে।

আমি কয়েক প্রস্থ ক্যারম সেরে তাস ধরতাম। কখনো মোড়ের মাথায় গিয়ে লোকজনের চলাচল দেখতাম ।

আজ বীণার যেন খুব বেশি দেরি হচ্ছে। কি জানি আর কারো সঙ্গে … খুব তেতো লাগল মুখে ভেতরটা। কবার থুতু ফেলেও পরিষ্কার হলাম না। দেখলাম একজন মজবুত চেহারার লোকের সাথে বীণা আর তার মেয়ে হেঁটে যাচ্ছে । মাথায় খুন চেপে গেল । আজ ওদের দফা রফা করবো । আজ বীণা চাবি নিয়ে যেতে ভুলে গিয়েছে। থাকুক বন্ধ দরজার সামনে হা পিত্যেশ করে বসে।

ফিরে দেখলাম আমার মাসতুতো ভাই সিঁড়ি দিয়ে নেমে যাচ্ছে । জানতে চাইলাম – তুই এখানে?

স্কুল থেকে ফেরার সময় বৌদি আমায় দেখতে পেয়েছিল। বলেছিল – আমার মেয়ে হয়েছে , চল তোকে মিষ্টি খাওয়াবো। বাড়ি এসে দেখি তুমি নেই। দরজার বাইরে ওরা বসে আছে তোমার মুখ চেয়ে। আমায় খাওয়াতে পারলো না বলে দ্যাখো আমায় পঞ্চাশটা টাকা দিয়েছে । বৌদির ব্যাগে আর টাকা নেই।

তুই নিলি টাকা?

না নিলে বৌদি দুঃখ পাবে। তাই নিতে হল।

ওকে পিছনে ফেলে আমি দ্রুত ওপরে গেলাম। দরজার গোড়ায় চোখ বন্ধ করে বীণা বসে আছে । জল গড়িয়ে পড়ছে বন্ধ চোখের পাতা গলে ।

দামি পালিশ করা বন্ধ দরজায় একটা শয়তানের চেহারা দেখতে পেলাম ।

 

===

 

পেত্নির ছোঁয়া

ভূত পেত্নি বলে কিছু নেই। অমন কিছু হয় না। হতে পারে না। এই কথাটা আমি হাজার বার বলেও শমিতার মাথায় ঢোকাতে পারি নি। সে ভূতে বিশ্বাস করে। পেত্নিতেও। ভগবানেও। তার মুখে সব সময় লব্জ, ভগবান উপর থেকে সব দেখছেন, সব বিচার করছেন। তার চিন্তার আকাশে ভূতে আর ভগবানে রোজ দুবেলা এক সাথে ফুটবল খেলে। আর পেত্নি তাদের বাহবা দেয়।

এমনিতে কাজে কর্মে খুব দড় সে মেয়ে। কিন্তু ভূতে এবং ভগবানে তার অচলা ভক্তি। শত অবিচার চোখে দেখার পর সে মেয়ে হাত গুটিয়ে বলবে ভগবান উপর থেকে সব দেখছেন।

সন্ধ্যা বৌদির জন্যেই শমিতার সাথে আমার বিয়েটা হয়েছিল। নইলে আমি হেন হতভাগাকে বিয়ে করত কে? চালচুলোহীন কাঠ বেকারের জীবন আমার। দর্শন শাস্ত্রে বিএ পাশ করেছি কোনোমতে। এমএ পড়া আর হলো না। টিউশনি পড়িয়ে দিন কাটত। পয়সা জুটত না। যে ছেলে মেয়েরা দর্শন পড়ত, তারা নেহাৎ অন্য কিছু পড়তে পায় নি বলেই দর্শন পড়তে এসেছিল। পড়ার অভ্যাস বা আকুতি, কোনোটাই তাদের বলবার মতো নয়। আমি জানতাম মেধাবীদের জন্য ডাক্তারি ও ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ার ব্যবস্থা আছে আমাদের দেশে। নিদেনপক্ষে বিজ্ঞান নিয়ে পড়া। কিন্তু দর্শন! হাসালেন মশায়। মুনি ঋষির দেশে দর্শন পড়ার জন্য মজবুত মনের ছেলে আসবে কেন? সুতরাং গরিবের সাদামাটা ছেলেকে পড়ানো বাবদে আমার পয়সা বাকি থাকত।

সন্ধ্যা বৌদির কাছে ওই জন্যে বিয়ে করতে আপত্তি করেছিলাম। একটা পেট বৌদি, তাই ঠিকমতো সামলে উঠতে পারছি না। দুটো পেট টানব কি করে? ঝামরে উঠেছিল সন্ধ্যা বৌদি। তুমি না পুরুষ মানুষ? পারছি না বললে শুনব কেন?

বললাম, শুনবেন না কেন? দুটো ডালভাতের খরচ জোটাতে গিয়ে জেরবার হচ্ছি, এমন অবস্থায় বিয়ে আমার কাছে বিলাসিতা মাত্র।

আমাকে করুণ মিনতি করে বলেছিল দেখো, তুমি ঠকবে না। মেয়েটা আমার পিসতুতো বোন বলে বলছি না, তুমি একটা উদ্যোগ না নিলে হবে না।

আমার বাড়িতে বাবা মা কেউ ছিলেন না। থাকার মধ্যে জীর্ণ পুরাতন দু কামরার ঘর। বিয়ে উপলক্ষে বাড়িটা যে একবার চুনকাম করা দরকার, সে চিন্তাকেও উৎসাহ দিতে পারতাম না।

সন্ধ্যা বৌদির ঢলঢলে মুখখানি আমায় মায়া জাগাত। তার মুখের দিকে তাকিয়ে শমিতাকে বিয়ে করতে রাজি হলাম।

ঠাকুরপো, দেখো, বিয়ে করছো বলে যেন বেশি কিছু হেঁকে বোসো না। মেয়েদের বাড়ির সামর্থ্য খুব কম। তোমার দাদার ভরসায় মেয়ে পার হচ্ছে। কানে ওর দুল আছে। হাতে চুড়িও। শাড়িটা আমি কিনে দেব। কিন্তু নমস্কারী বাবদে জনে জনে পোশাক আমি দিতে পারব না।

ঠিক হল বিয়ের রেজিস্ট্রিটুকু করে সন্ধ্যা বৌদির বাড়িতে দুই তরফের একটা সম্মিলিত জলযোগ করিয়ে দেব।

সেই শুনে শমিতা আকাশ থেকে পড়ল। সে কি কথা, বিয়ে হবে, শাঁখ বাজবে না, হুলুধ্বনি হবে না, সপ্তপদী হবে না, সে আবার কি রকম বিয়ে?

বলতে ইচ্ছে হয়েছিল, রেজিস্ট্রি করে বিয়ে আমাদের দেশে যথেষ্টই মান্য। এভাবে পয়সা নষ্ট করিও না।


আমাদের সংসার শমিতা ঝকঝকে তকতকে করে রাখত। আর আমি অবাক হয়ে ওকে দেখতাম। এত খুঁটিনাটির দিকে নজর মেয়েটার! বিয়ের পর ক’মাস যেতে না যেতেই দুটি চারটি করে ছেলে মেয়েকে ঘরে পড়ানো শুরু করল সে। আমি বাবার রেখে যাওয়া পুরোনো সাইকেলটা একেবারে বেজুত হয়ে যেতে হেঁটে হেঁটেই ছাত্র পড়াতাম। শমিতা আমার কাঁধের ব্যাগে জলের বোতল আর চিঁড়ে বা মুড়ি ভরে দিত। বলত অনেকক্ষণ না খেয়ে থাকলে শরীর খারাপ হয়। আমি ওর দিকে তাকিয়ে থাকতাম অবাক হয়ে। আমাদের ঘরের পাশে যে আধ কাঠা জমি পড়ে আছে সেখানে শমিতা লাউ কুমড়ো পেঁপে বসিয়েছে। গেরস্ত ঘরে দুচারটে সবজি ফললে শুধু যে টাকার সাশ্রয়, তাই নয়, দেখারও সুখ। ফুল থেকে কেমন একটু একটু করে ফল বেড়ে উঠছে দেখলে মনে একটা আরাম পাওয়া যায়। আমাদের এলাকার জুটমিলটায় গোলমাল চলছে। সময় থাকতে মালিক যন্ত্রপাতির বদল করে নি। শ্রমিক ইউনিয়নের কর্তারাও চোখ বুজে বসে থেকেছে। কেবল মাইনে বাড়াও নারা দিয়ে আজকের দিনের শ্রমিক আন্দোলন হয় না কি? শ্রমিকের শিক্ষা চাই, সুস্থ বিনোদন চাই, পরিবার পরিকল্পনা চাই। নইলে শ্রমিকের জীবনের মান উন্নত হয় না। কারখানা মালিক আর শ্রমিক নেতা দুয়ে মিলে শ্রমিককে পথে বসিয়ে দিয়েছে। কারখানা বন্ধ হলে এলাকায় হাহাকার নেমে আসবে। আমি এমন দু চারবার দেখেছি। কিন্তু শমিতাকে বলতে পারি নি।

একদিন ওর কাছে জানতে চাইলাম বাচ্চা পড়িয়ে কেমন লাগছে?

ও বলল, জানো, আমি ভাবতেই পারতাম না যে আমার কাছে কেউ পড়বে। আমি যে খুব সাধারণ। মাধ্যমিকে আমি সেকেণ্ড ডিভিশনে পাশ করেছিলাম জানো!

আমার খারাপ লাগে। আমিও মাধ্যমিকে সেকেণ্ড ডিভিশন। কিন্তু সেই নিয়ে আমার কোনো হীনমন্যতা নেই। বললাম, পরীক্ষার নম্বরটাই তো আর সব নয়। অথচ মনে মনে জানি, নম্বর খুব কম ছিল বলেই এম এ পড়তে পারি নি।

শমিতা হেসে বললো, তুমি খুব ভাল পড়াও, সে কথা এখানে সবাই বলে। খুব সুনাম তোমার।

আমার একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস পড়ে। একটা প্রাইমারি স্কুলের চাকরিও জোটাতে পারি নি। আমার চেনা কতজন কলেজে অতিথি শিক্ষক হয়ে পড়াচ্ছেন। খুব সামান্য মাইনে। নামমাত্র। শিক্ষা যদি মানুষের অধিকার হয়, তাহলে উপযুক্ত বেতনে শিক্ষক নিয়োগ হয় না কেন?


শমিতা আমাকে প্লেটে করে একটা অমলেট দিল। আমি বললাম ডিম পেলে কোথায়? সকালে আনতে বলেছিলে, আনতে পারি নি। পয়সা ছিল না।

সে বলল, ঘরের সামনে দিয়ে হেঁকে যাচ্ছিল, দেখে আর থাকতে পারি নি। চারটে কিনেছি।

কামড় দিয়েই বুঝলাম হাঁসের ডিম। বললাম হাঁসের ডিমের দাম তো অনেক।

ভেতরের কথাটা মেয়ে বুঝল। বলল ধারে কিনি নি গো। আজ একজন মাইনে দিয়েছে।

আশ্চর্য, সারা মাস খেটে সামান্য ক’টা টাকা মাইনে পেয়ে প্রথমেই বরের পছন্দের খাবার জিনিস কিনেছে। এদেশের মেয়েরা এত ভালবাসতে জানে!


মায়ের হাতে যখন সংসার ছিল, মা কয়লার উনুনে রাঁধতেন। ঘরের বাইরে চালা ঘরে রান্না। খুব বৃষ্টির দিনে তোলা উনুনে রান্না হত। শমিতা বলল জ্বলন্ত উনুন নিয়ে হাঁটা চলা বিপজ্জনক। আমি বললাম কেরোসিন স্টোভও বিপজ্জনক। মা যদি সামলে সুমলে পেরে থাকেন, তুমিও পারবে। শমিতা কিছু বলল না। আমি ভাবলাম কথাটা তার পছন্দ হয় নি। আমি অন্য দিকে তাকিয়ে রইলাম। মনে পড়ল মা কিভাবে সংসার চালাতেন। বাবার ওপর কোনো রকম চাপ দিতেন না। পরে মনে হল, বাবাকে মা ভয় পেতেন। শমিতা আমায় ভয় পায় না। ভয় পেলে কি ঠিক হত?

আমি মনে মনে হিসেব করতে থাকি গ্যাস নেবার খরচ খরচা কি রকম। নাঃ , আমি একটা নেহাতই বেআক্কেলে লোক। সাংসারিক খোঁজ খবর কিছুই জানি না।

কদিন বাদে শমিতা আল্টিমেটাম দিল দু দিনের মধ্যে গ্যাস যদি এনে দিতে না পারো, আমি বাপের বাড়ি চলে যাব।

বলে কি মেয়েটা? বাপ নেই, মা নেই, কাকাদের সংসারে হাঁড়ি ঠেলে মানুষ। একটা মোটে এক কামরা ঘর সেখানে। বিয়ের পর থেকে সেখানে এক বারও যায় নি। কাকারা খোঁজ পর্যন্ত নেয় নি। আর সেই বাপের বাড়ির দেমাক দেখায় শমিতা? আচ্ছা আহাম্মক তো? সেখানে গেলে খাবে কি? শোবে কোথায়?

রাগ দেখিয়ে বেরিয়ে পড়তে যাব, এমন সময় আমাকে জড়িয়ে ধরে হাসিতে ভেঙে পড়ল শমিতা। বাব্বা, রাগলে তোমাকে কি গম্ভীর দেখায়।

আমি বললাম ভয় করো না আমাকে?

শমিতা বলল, তুমি কি ভূত, যে তোমাকে ভয় পাবো?

বললাম, ভূত হলে ভয় পেতে নিশ্চয়?

আমার মুখে দ্রুত হাত চাপা দিয়ে সে বলে উঠল বালাই ষাট। কি অলুক্ষুণে কথা দ্যাখো।

তার মেয়েলি স্পর্শ আমার বুক ভরিয়ে দিল।


বিকেলে সে মেয়ে কাগজ দেখালো গ্যাসের কানেকশন আসছে। বললাম দরখাস্ত করলে কবে?

মুখ টিপে হাসে শমিতা। বলে বলব কেন?

আমি বললাম আমার নাম করে দরখাস্ত জমা দিলে, আমাকে কই বলো নি তো?

সে আমার কোলের কাছে ঘেঁষে এসে বলল আমি এই সংসারের রানি। আমার যা খুশি তাই করব।

আমি ওর মাথাটা কোলে নিতে নিতে মনে মনে বললাম, তাই কোরো।


গ্যাসে তরকারিটুকু হয়। আর দুধ ফোটে। রুটি বাইরে থেকে আনায় শমিতা। দুজনের রুটি কটা বাড়িতে করতে পারো না?

না, পারি না। বাইরে থেকেই রুটি আসবে। গ্যাস আমি উল্টোপাল্টা খরচ হতে দেব না।


জুটমিলটা বন্ধ হলোই। এলাকায় নামল কান্নার রোল। আমি দূরে দূরে তেমন বাড়ি দেখে টিউশনি খুঁজে নিলাম, যাঁরা জুটমিলের উপর নির্ভরশীল নন।

হাতে পয়সা নেই দেখে শমিতা কুড়িটা টাকা আমার পকেটে ঢুকিয়ে দিল। বলল ফেরার পথে রুটি এনো।

দেশে সাংঘাতিক অব্যবস্থা চলছে। ঋণ নেবার ছলে ব্যাঙ্কগুলিকে পথে বসিয়ে বিদেশে পালাচ্ছে প্রতারকের দল। আশ্চর্য, এদের খুঁটির জোর কম না। আর্থিক দুর্নীতিতে দেশের এক বিরাট সংখ্যক মানুষ জড়িয়ে রয়েছে। প্রশাসন আছে কি না, টের পেতে কষ্ট হয়। দলে দলে চাষী আত্মহত্যা করছে। নারী ও শিশুর উপর অত্যাচার সাংঘাতিক রকম বেড়ে গিয়েছে। ছেলে মেয়েদের স্কুলে যাবার আগ্রহ কমছে। কর্মসংস্থান তলানিতে।

ভাবতে ভাবতে আনমনে পথ চলি আলো আঁধারিতে। সহসা এক মহিলা আমায় জাপটে ধরে। সারি সারি ট্রাক। ট্রাকের আড়ালে ছেলে মেয়ের মুখে দুটি অন্ন দেবে বলে দেহ বেচছে চাষি বৌ। দীর্ঘ যৌনতাবঞ্চিত ট্রাক ড্রাইভার দুটো পয়সার বিনিময়ে নারীমাংস কিনছে। এই আমার ভারতবর্ষ।

কুড়িটা টাকা মহিলাকে দিয়ে রেহাই পেলাম। সে যেভাবে আমায় আঁকড়ে ধরেছিল, টাকা কটা না দিলে ছাড়তই না। নিজেকে ছাড়িয়ে নিতে হাঁচড় পাঁচড় করতে গিয়ে কোথাও একটু আঁচড়ে গিয়েছে। বাড়ি গিয়ে ডেটল দিয়ে নিতে হবে।


আমাকে মাথা নিচু করে খালি হাতে ঘরে ফিরতে দেখে অবাক হল শমিতা।

রুটি পাও নি, তাই না?

অন্য দিকে মুখ ফিরিয়ে বললাম রাতে আজ ভাত খাব।

কোনো প্রশ্ন না তুলে শমিতা ভাত বসিয়ে দিল। আমি ওর ঘাড়ের কাছে চুলগুলি একমনে দেখছিলাম।

রাতে নিরালায় সে মেয়ে প্রশ্ন করলো টাকা ক’টা অন্য কোথাও কাজে লেগেছে, তাই না?

আমি তাকে ট্রাকের আড়ালে দেহ ব্যবসার কথা বলতে পারলাম না।

বললাম, জানো, আজ একটা পেত্নি আমার পকেট থেকে টাকাটা নিয়ে নিয়েছে।

শমিতা বলল সে কি? পেত্নি বলে কিছু হয় না কি?

আমি বললাম হয়, হয়। এই দ্যাখো, আমায় খামচে দিয়েছিল।

শমিতা নীরবে উঠে আমার ক্ষতে ডেটল লাগিয়ে দিল।

তারপর আলো নিভিয়ে অন্য পাশ ফিরে শুয়ে রইল।

আমি কিছুতেই ওকে বিশ্বাস করাতে পারলাম না যে আজ সত্যি একটা পেত্নি আমাকে পাকড়াও করেছিল।

মৃদুল শ্রীমানী। কবি। জন্ম- ১৯৬৭, বরানগর। বর্তমানে দার্জিলিং জেলার মিরিক মহকুমার উপশাসক ও উপসমাহর্তা পদে আসীন। প্রকাশিত বই: 'জমি জরিপ,  কি দেখে জমি বাড়ি কিনবেন,  ফ্ল্যাট ও বাড়ি,  তথ্য জানার অধিকার', 'মানুষের বাঁচার অধিকার সংক্রান্ত- মেয়েদের আইন', 'সে একটি পল্লবিত...

এই বিভাগের অন্যান্য লেখাসমূহ