ছুটি

সুজাতা দাস
গল্প
ছুটি

সেই কোন ভোরে বাবার সঙ্গে বেরিয়ে ছিল মালতী। দূর তো কম নয়। ২৪ পরগনার ভেতরের গ্রাম থেকে ই্সস্টিশন তো কত যে দূর। তারপর ট্রেনের দীর্ঘ অপেক্ষা।

এর পর কয়েক ঘণ্টা পর বাবা তাকে নিয়ে এলো একটা আস্ত অফিসে। দাদাকে বলল খুব ভাল বাড়িতে নিয়ে যাব। বুঝে শুনে থাকবি। কোন ঝামেলা পাকাবি না। দাদা বউদি যা বলবে শুনবি। বুঝলি।

সম্মতি সূচক ঘাড় নাড়ল মালতী। বাবা কিছুক্ষণ পর তার মাথায় হাত রেখে বলল মানিয়ে গুছিয়ে থাকিস কি করব ওই তো অবস্থা নইলে অন্যের বাড়ী কাজ করতে পাঠাই বল চোখের জল মুছতে মুছতে মালতী অপলকে বাবার চলে যাওয়া দেখল। সংস্থার দাদা বলল কান্নাকাটি করিস না। জলে তো পড়িস নি। ভাল বাড়ীতেই দেব। সেই ভাল বাড়ীতেই কেটে গেল সাত দিন। দাদা বউদি ওদের ছেলে টুবান মালতীর কাজ ছিল দেখাশোনা করা। স্কুল থেকে ফিরলে টুবানকে খেতে দেয় ওর সাথে খেলা করে। বউদিও চাকরি করে ফিরতে ফিরতে সন্ধ্যা সাতটা হয়। দাদা আরও পরে।

বউদি মানুষটা ভাল। দাদাও ভাল। বউদি মালতীকে একটা জামা দিয়েছে বলেছে পরিস্কার পরিচ্ছন্ন থাকবি। বুঝলি। মালতী খুশি হয়েছে।

ছোট্ট  ফ্লাটের একচিলতে বারান্দায় মালতী যখন এসে দাঁড়ায় আকাশের বুড়ি চাঁদকে খল খল করে হেঁসে ওঠে। দূরে অপসৃয়মান বাবার ক্লান্ত চেহারাটা চোখের উপর ভেসে ওঠে। মনে পরে ভাইবোনের কথা। সব চিন্তা ছিন্ন হয়ে যায়। বৌদি ডাকে হাঁ করে কি রাতদিন আকাশ দাখিস। আমার সাথে হাতে হাতে জামা কাপড় গুছিয়ে দেনারে মালতী এগিয়ে  যায়। সদ্য উদ্দিপ্ত যৌবন উঁকি দিয়ে যায় বয়সন্ধির উন্মেষ। মনে পরে যায় গ্রামের তপুদার কথা যে তাকে অপলকে দেখত। একদিন অতর্কিতে চোখে পড়ে যায় দাদা বউদির দীর্ঘ চুম্বন। শরীরে অজানা স্রোতের ডাক শুনতে পায় মালতী। হাঁপিয়ে উঠতে থাকে তিন কামরার ছোট্ট ফ্ল্যাটে। তবে দাদা বৌদি খুব ভাল মানুষ। সেদিন দাদা ছোট ছোট মাংস ভাজা এনেছিল। বৌদি ওকেও দিল কি সুন্দর স্বাদ। এ ছাড়াও দুজনে বলে মালতী পেট ভরে খাবে। লজ্জা করবে না। আর টুবান তো মালতীদি বলতে অজ্ঞান। কত খেলা ওর সঙ্গে টুবানের। বাড়ী ছাড়ার রাতটা আস্তে আস্তে মনে পড়ছিল।

তারপর একদিন হটাৎ বেলটা বেজে ওঠে। বৌদি বলে দিয়েছিল আইহোলে লোককে না দেখে কখন দরজা খুলবি না। আজ দেখল মালতী। একটি অল্পবয়সী ফর্সা পানা ছেলে দাঁড়িয়ে। হাতে পাউরুটি । কে? মালতী জানতে চাইল। উত্তরে ছেলেটি বলল আমি পাউরুটি দি। বৌদি জানে। বৌদি তো বাড়ী নেই। পরে এসো। রাতে বৌদিকে বলায় বৌদি বলল হ্যাঁ হ্যাঁ ওই ছেলেটা পাউরুটি দেয়। ও আমাদের চেনা। ভাল ছেলে তুই দরজা খুলে নিয়ে নিস।

সাত দিন বাদে আবার বেল। আই হোলে মালতী দেখে সেই ছেলেটাই দাঁড়িয়ে আছে। দরজা ফাঁক করে রুটি নিতে গিয়ে ওর চোখের তারা স্তব্ধ হয়ে গেল। এ যেন তপুদার মতোই দেখতে। ছেলেটা আলতো হাসল মালতীও। বউদির রাখা সেঁকলে এগিয়ে পাল। তুমি রবি নতুন। হ্যাঁ বলেই দরজাই বন্ধ করে দিল মালতী। সেই রাতে ঘুম আস্তে অনেক দেরী হল। সদ্য ওঠা ফর্সা পানা ঐ ছেলেটার মুখটা বারবার তাকে ভাবাচ্ছিল। ভাবাচ্ছিল তাকে তপুদার স্মৃতি কে।  কি এক অনুচ্চারিত ভাললাগার স্মৃতির  ডানাগুলো যাচ্ছিল খুলে।

তপুদা কোনদিন ওকে কিছু বলেনি। হয়ত বলত। কিন্ত তার আগেই তো মালতী চলে এলো শহরে।

জলছবি দিগন্তের এই শহরে একটু একটু করে বাঁচার আস্বাদ নিচ্ছিল মালতী। আর নিজের অজান্তেই তৈরি হচ্ছিল অন্নের জন্য প্রতীক্ষা । এই দেড় মাসে তিনবার নিতে নিতে ছেলেটা নাম জেনেছে সে। অল্প হলেও এটা জেনেছে যে ছেলেটা তার দিদি আর জামাইবাবুর কাছে থাকে মাধ্যমিক পাশ। রুটি দেয়া ছাড়া বাবুদের গাড়ী ও ধোয়া অলকের কাজ কিন্তু কেন জানিনা মালতীর মনে কোথাও যেন অলোকেরও চোখে ভালোলাগার রেশ জেগে ওঠে ওকে দেখলে।

বসন্তের ঋতু মল্লারের মত দুটি জীবনের নেপত্থে প্রথিত হতে থাকে কোন এক আগামীর বীজ। এর মধ্যে অলোক জল খেয়েছে। তবে খুবই ভদ্র ঘরে ঢুকতে চায়নি বা উঁকি ঝুঁকি ও মারেনি। মালতীর নারীত্বের বোধ তাকে জানায় এর সাথে নোঙর বাঁধা যেতে পারে। হয় তো।

ফিরে মালতী আমার বাড়ী ভাল লাগছে তো। হ্যাঁ বৌদি তোমরা খুব ভাল। খুব। আর ভাই তো খুব খুব খুব ভাল। বাবা এত খুব। বৌদি হেসে ওঠে। হ্যাঁ বৌদি তোমাদের ছেড়ে আমি কখন যাব না। যাস না রে তোকে আমাদেরও খুব পছন্দ।

তার পর এক রবিবারে বেল বেজে ওঠে। বাড়ীতে সবাই ছিল। মালতী দরজা খুলে দ্যাখে বাবা দাড়িয়ে। আনন্দে মন নেচে ওঠে তার এসো বাবা কতদিন পরে এলে। বাড়ীর সবাই ভাল আছে তো। হ্যাঁ রে সবাই ভাল তবে একটু কথা আছে দাদা বউদির সাথে।

বাবার আসার কারণ নেপত্থে জানা গেল। এ বাড়ী যে সংস্থা দিয়ে ছিল তারা আরও বেশী টাকার ভাল বাড়ীর খোঁজ দিয়েছে। তাই এখান থেকে মালতী কে চলে যেতে হবে। মাথায় যেন বাজ পড়ল মালতীর। এই বাড়ীর পরতে পরতে জরিয়ে পরেছিল সে। শুধু কটা বেশী টাকার জন্য দাদা বউদির স্নেহ টুবানের দিদি ডাক আর অলোকের পরিচয় সব ভুলে যেতে হবে তাকে। বুকের মাঝে রক্ত হিম হতে থাকে। বৌদি এসে বলে প্রায় এক হাজার টাকা বেশী চাইছে তোর বাবা। আমরা অতো পারব নারে দিতে।  তবে তুই যেখানে থাকিস ভাল থাকিস।  কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে মালতী। তারপর বৌদির হাতটা ধরে বলে ওঠে বৌদি তুমি সবসময় দাদা আর টুবানের হাতটা ধরে থেকো। ছেড়ে দিওনা। কেমন।

বাবার সাথে সব গুছিয়ে নিয়ে সেই সংস্থার পথে চলল মালতী। সেই সংস্থার অফিস বলল যে বাড়ীতে যাবি সেখানে এক বুড়ো দাদুকে দেখভাল করবি। খুব ভাল বাড়ী। হাসি পেল মালতীর। আবার একটা বাড়ী আবার কিছু অজানা মানুষ। কিছু স্নেহ ভাললাগা আকর্ষণের মিনার। তারপর আবার কিছু বেশী টাকার জন্য সেই বাড়ী ছেড়ে অন্য বাড়ী যাওয়া।

নতুন দাদুর বাড়ী যাচ্ছে মালতী। চোখের কোনে সদ্য ছেড়ে আসা দাদা বৌদি টুবান আর অলোকের প্রতিচ্ছবি। আর আকাশে পরিযায়ী পাখিদের ঝাঁক। ওরাও তো মালতীর মত নীড় নেই।

এই বিভাগের অন্যান্য লেখাসমূহ

বালির বেহালা

বালির বেহালা

বুড়িমাসি বলেন,জীবনটা বালির ঘর গো।ঢেউ এলে ধুয়ে যায় জীবনের মায়া।তবু বড় ভালবাসা ওদের দাম্পত্যে।রোদের চাদরের…..

তদন্ত

তদন্ত

  এক ড্রইং রুমে বসে রয়েছে সদ্য কিশোর উত্তীর্ণ তরুণ গোয়েন্দা সজীব। সামনের টেবিলে ছড়িয়ে…..