ছড়ার সংকলন , প্রকাশ , বিচারবিশ্লেষণের ক্ষেত্রে আমাদের দেশে সবচেয়ে অগ্রণি ভূমিকা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের । সামাজিক পরিবর্তনের স্রোতে আমাদের জাতীয় সম্পদ ছড়াগুলি যাতে ভেসে না যায় সেজন্য পল্লিঅঞ্চলে মেয়েলি ছড়া , ছেলেভুলানো ছড়া সংকলন এবং সংরক্ষণের দায়িত্ব নিয়েছিলেন তিনি । রবি ঠাকুর ছড়াকে বলেছিলেন , ‘ চলিত ভাষার কাব্য ‘ ।
‘ ছেলেভুলানো ছড়া ‘ বলতে পাঠকমাত্রেরই চোখের সামনে ভেসে ওঠে এক অতি পরিচিত দৃশ্যপট । মা তার খোকাকে ভুলিয়েভালিয়ে খাওয়াচ্ছেন বা ঘুম পাড়াচ্ছেন । খোকা যথারীতি তার দস্যিপণায় মাকে ব্যতিব্যস্ত করে তুলছে । অপরদিকে মা খোকার শিশুসুলভ জ্বালাতনের মধ্য দিয়ে মাতৃত্বের অমৃতসম স্বাদটি পুনঃপুনঃ আস্বাদন করে চলেছেন ।
মা – সন্তানের এই অতিপরিচিত স্নেহের দৃশ্যপট ছাড়াও ‘ ছেলেভুলানো ছড়া ‘ পড়ে সম্পূর্ণ অন্য একটি দিকের প্রতি আমার মনোযোগ আকৃষ্ট হয়েছিল । তা হলো , এই রচনায় পশুপাখির প্রয়োগ । পশুপাখিদের মাধ্যমে কল্পনায় স্বপ্নপূরণ , শক্তিমান ও অসহায়ের লড়াই , অন্তেবাসী মানুষের দিনবদলের স্বপ্ন , কখনও বা নিছক ছেলেমানুষী রস সবটাই আস্বাদন করা যায় ।
‘ ছেলেভুলানো ছড়া ‘ তে ছেলেভোলানোর জন্যই পশুপাখিদের আগমন । পশুপাখিরা এখানে খোকাখুকুর সঙ্গী । তাই টিয়াপাখি নৌকায় করে খোকার কাছে আসে , সেই নৌকা বোয়ালমাছে নিয়ে চলে যায় , আবার এই গোটা দৃশ্য উপভোগ করে ভোঁদড় নাচতে থাকে । এ এক অদ্ভুত কল্পনার জগৎ । খোকার মা – ঠাকুমারা জানেন , এমন সব মজার জগতে খোকারা বুঁদ হয়ে থাকতে ভালোবাসে । তাই খোকাদের আপাদমস্তক এই সারল্যের জগতে পৌঁছে দিতে পশুপাখিদের হাত ধরেন মা – ঠাকুমারা ।
আর একভাবে পশুপাখির ব্যবহার লক্ষ করা যায় ছড়াগুলিতে । বাস্তবে মানুষ নিজেদের জীবনে নানারকম বিপদেরা সম্মুখিন হয় এবং সবসময় বিপদ থেকে উদ্ধার পায়না । বাস্তবের না – পাওয়াগুলিকে কল্পনায় প্রাপ্তির জগতে উত্তীর্ণ করতে মানুষ হাত ধরে পশুপাখির । একটি উদাহরণ দেখা যাক । প্রত্যেক মায়ের চিন্তা থাকে , তার মেয়ে নতুন শ্বশুর বাড়িতে গিয়ে মাকে কাছে না পেয়ে একাকীত্ব বোধ করবে । তাই মায়ের মন কল্পনা করে , সন্তান পুটুর সঙ্গে ঘরের সঙ্গী বিড়ালকে পাঠিয়ে যদি কন্যার একাকীত্ববোধ কিছুটা হলেও কাটানো যায় । আপাতঅর্থে ছড়াটি পড়লে মনে হয় নেহাতই শিশুকে ভোলানোর জন্য মা হয়তো ছড়াটি বলছেন । কিন্তু একটু মনোযোগ দিলেই ছড়ার গোপন স্তর থেকে সন্তানের জন্য মায়ের দুশ্চিন্তা এবং তার কাল্পনিক সমাধানের ইঙ্গিতটি টের পাওয়া যায় ।
সব মায়েরই স্বপ্ন থাকে খোকাকে বড়ো ঘরে বিয়ে দেওয়ার । ‘ ছেলেভুলানো ছড়া ‘ র মধ্যেও রয়েছে মায়ের সেই স্বপ্নের প্রতিফলন । মা খোকামণির বিয়ে দেবেন হট্টমালার দেশে যেখানে গাই – বলদ দিয়ে চাষ হয় , যেখানে মানুষ ‘ হীরের দাঁত ঘষে ‘ , যেখানকার ঘরে ঘরে রুইমাছ , পালংশাকের ছড়াছড়ি । বাস্তবে হয়তো মা নিজে দরিদ্র ঘরের গৃহবধূ , কিন্তু সন্তানকে ভুলিয়েভালিয়ে ঘুম পাড়ানোর সময় তার কল্পনা করার পরিধি হয় সুদূরবিস্তারী । কল্পনায় স্বপ্নপূরণে মানুষ আবারও হাত ধরে পশুপাখির ।
বাস্তবিকভাবে ‘ ছেলেভোলানো ছড়া ‘ খুবই শ্রুতিমধুর । প্রতিটি ছড়ার মধ্যে শিশুর সারল্য , মায়ের মাতৃত্ব আমাদের মতো জটিলমনস্ক পাঠকদের কাছে অমৃতের আস্বাদ নিয়ে আসে । হয়তো ‘ ছেলেভুলানো ছড়া ‘ কে এমন বিশ্লেষণী ভঙ্গিতে না দেখলেই ভালো হয় । কিন্তু তবুও একটু অন্যরকমভাবে পড়ার ইচ্ছেটা পাঠকের মন থেকে সরিয়ে রাখাও সম্ভব হয়না । বাস্তবের অপ্রাপ্তিকে কল্পনায় প্রাপ্তিতে উত্তীর্ণ করতে পশুপাখিরা প্রতিনিয়তই মানুষের সঙ্গী । মানুষের কল্পনায় পশুপাখিদের তাই অসীম ক্ষমতা । এই সবকিছু মিলিয়েই দস্যি খোকাখুকুকে ভুলিয়ে রাখার এক অসামান্য সংগ্রহ এবং সৃষ্টি রবি ঠাকুরের ‘ ছেলেভুলানো ছড়া ‘ ।