প্রক্সি
তারপর ইলেকট্রিক বিল জমা দিতে যাবো। আমার দেরি হবে আসতে। স্বামী অমর বলে, ঠিক আছে।…..
ঈদের পরদিন।
“ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ, তুই আপনাকে আজ বিলিয়ে দে, শোন আসমানী তাগিদ”…
চিরাচরিত ঈদুল ফিতর সঙ্গীতের মিষ্টি সুর টিভি থেকে বাড়ির জানালার গ্রিল গলিয়ে ছড়িয়ে পড়ছে রাস্তায়, পাশের বাড়ির গলিতে, ওপাশের নিকটতম প্রতিবেশি পরমাদের বাড়ির আঙিনায়, আকাশে বাতাসে। আরিফদের বাড়িতে আজ ওর সব বন্ধুদের নিমন্ত্রণ। ওরা চারজন হরিহর আত্মা। আজন্ম বন্ধু। একসাথে সেই প্লে নার্সারি থেকে আজ ভার্সিটি পর্যন্ত আছে। এদের বন্ধুত্বের সূত্র ধরে চার পরিবারের মধ্যেও একটা আঠালো সম্পর্ক গড়ে উঠেছে। ঈদ, পুজো, জন্মদিন বা যে কোন সামাজিক প্রোগ্রামে সবাই সবাইকে নিমন্ত্রণ করে। তুলনামূলক ভাবে আজকাল মানুষ বেশ উৎসব মুখর হয়ে উঠেছে। আজকের শ্লোগান “ধর্ম যার যার উৎসব সবার” এটা মাথায় রেখে, দেশপ্রেমের ধ্বজা তুলে দেশজ কালচারের পহেলা বৈশাখ, পহেলা ফাল্গুন, বর্ষা উদযাপন সেসবও মানুষজন পালন করছে বর্নাঢ্য ও সাবলীলতায়।
আরিফের মা, ছেলে ও ছেলের বন্ধুদের জন্য প্রচুর খাবারের আয়োজন করেছে। ছেলেটা দুবছরের অধিক হয় ঢাকায় চলে গেছে, সেখানে ওর চাচার বাসায় থেকে একটা প্রাইভেট ভার্সিটিতে পড়ে। বাড়িতে খুব কম আসা হয়। ছুটিছাটা ছাড়া আসতে পারেনা। সেজন্য আরিফের বাবা মা আয়োজনের কোন কমতি করেনি। গরুভুনা, খাশির রেজালা, হাঁসভুনা, মুরগির রোষ্ট, বড় বড় মাছ, কাবাব, মিষ্টি, আপেল, কমলা, আঙুর কিছুই যেন বাদ না থাকে হিসেব করে করে সবকিছুর ব্যবস্থা করেছে। উপজেলা পর্যায়ের এসব সচ্ছল পরিবারে যাদের জমিজমা আছে এবং যাদের পরিবারের দু/একজন মিডলইস্ট, মালয়েশিয়া বা অন্য কোথাও থেকে উদয়স্ত পরিশ্রম করে রসদ পাঠায় তারা যে কোন উপলক্ষে দুহাতে নয় চারহাতে খরচ করতে এতটুকু পিছপা হয়না। এদের ঘরে সন্তানেরা মুখ থেকে মায়ের দুধের গন্ধ না মিলাতেই হাতে পায় মোবাইল ফোন যা বয়সের সাথে সাথে আপগ্রেড হতেই থাকে। আর নাকের নিচে গোঁফের রেখা উঁকি দেবার অনেক আগেই এরা নতুন বাইকের হ্যান্ডেল হাতে ধরে। এসব বাড়িতে দিনভর চলে সনি, স্টার জলসা, স্টার মুভিজ। এসবই এদের সামাজিক স্টাটাস। উপরে উপরে প্রতিবেশীদের সাথে খাতির থাকলেও মনে মনে থাকে কম্পিটিশন। কার ঘরে লেটেস্ট মডেলের টিভি, মাইক্রো ওভেন, ঘরে অটবি নাকি হাতিলের ফার্নিচার, মেঝেতে কেমন ডিজাইনের টাইলস লাগানো হচ্ছে ইত্যাদি ইত্যাদি।
আরিফ, গৌতম, তুর্য আর শুভ এরা প্রাণের বন্ধু। চারজনই সচ্ছল পরিবারের সন্তান। শহর এবং গ্রামের সকল সুযোগ সুবিধা নিয়েই এরা এক সাথে বড় হয়েছে, একই স্কুল কলেজে একই বিভাগে এবং একই সেকশনে লেখাপড়া করেছে। বর্তমানে এরা এদের আরাধ্য রাজধানীর শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অধ্যায়নরত। সারাদেশে বহু ঐতিহ্যবাহী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থাকলেও এদের মানসিকতায় রাজধানীর উপর আর কিছু নাই। হোক না সেটা ভুঁইফোঁড় গজিয়ে ওঠা কোন ইন্সটিটিউট। ঈদের ছুটিতে সবাই বাড়িতে এসেছে।
শিল্পী: রিয়া দাস
আরিফদের ড্রয়িংরুম। দুপুরের আহারাদি শেষ। ডেজার্ট হিসেবে ড্রয়িং রুমের কাঁচের টেবিলের উপর রাখা পায়েশ, দই, সর মালাই এবং বিভিন্ন ফলমূল। সবাই পায়েসের বাটি হাতে নিজেদের মধ্যে গল্পে মশগুল। খামোখাই টিভিটা কানের পোকা বের করে দিচ্ছে। ঈদের প্রোগ্রাম চলছে কিন্তু কারো মনোযোগ সেদিকে নেই। অবশ্য এরা বাংলা চ্যানেলের তেমন কিছু দেখেনা, তার উপর সত্যি সত্যি আজকাল বিজ্ঞাপণের আগ্রাসনে কিছু দেখার উপায়ও নাই। ঢাকার ছেলেপেলেদের সাথে টেক্কা দিতে এরা এঞ্জয় করে বিটলস, হেনড্রিক্স, সিনাট্রা, ব্লুস, জ্যাজ। এরা বাইরে খেতে ভালোবাসে দেখতে ভালোবাসে স্টার ট্রেক, লর্ড অফ দা রিংস, হ্যারি পটার ইত্যাদি। সেই সাথে হিন্দি তো আছেই। দিপিকা পাডুকোনের সদ্য রিলিজ হওয়া কি একটা মুভি নিয়ে সবাই কথা বলছে। মাঝে একবার কে যেন বলে আজ সন্ধ্যায় ছাদে আয়েশার গান শুনতে হবে, নিজ নিজ ক্লাশে কোন মেয়ে দিপিকা, কে আনুশকা, আর কে সানি লিওনের মত দেখতে তা নিয়ে জমিয়ে কথার তুবড়ি ছুটছে এমন সময় বাইরে একটা হাল্কা পাতলা গোলযোগ উঠে। আরিফের মায়ের খোনা খোনা কন্ঠ তীব্রভাবে শোনা যায়-
“আর এই পাগলিকে নিয়ে পারা যায়না দুইদিন পর পরই আসি হাজির হয়। এ্যর বুড়ি মাটা তো মরছে, মরি বাঁচি গেইছে এখন এ্যার কোলে আবার একটা ঢ্যানঢ্যানি যে কই থাকি আসিল তা আল্লায় জানে। ছিঃ ছিঃ এগুলা দেখি রাগও লাগে আবার মায়াও লাগে। এ্যাক বাড়িত ঢুকতে দেওয়াও তো পাপ। কোন হারামজাদা লুচ্চা অবুজা পাগলিটার এই সব্বোনাশ করিল আল্লাহপাক তার বিচার করবে… কী দুনিয়ারে বাবা গুঙ্গা, লেংড়ি, পাগলি, ছাগলি কেউ আর নিরাপদ না। পাপে পাপে দুনিয়াটা ডুবতে আর বাকি নাই। কী নোংরা কী ময়লা! মাগো মা! এ্যাই! এ্যাই! যাহ! যা বাইরে গিয়ে বস খাবার দিচ্ছি… ওই আকবর! আকবর! গলা তুলে আবার চিৎকার করে অদৃশ্য আকবরের নাম ধরে, সাড়া না পেয়ে – এই ঢোড়াটা যে কই থাকে! কামের সময় এ্যাক পাওয়াই যায়না। কাজ কামের দিনে কিযে আজাইরা যন্ত্রনা” গজগজ করতেই থাকে…
অনতিদূরের এসব স্বগতোক্তি, খেদোক্তি, অভিশাপ, গজগজানি ভেতরের চার জোড়া কানের ভেতরে পশিতে টিভির ভল্যুয়ম একটুও অসুবিধা ঘটায়না।
আবার অচিরেই আরিফের মা বিলাসীকন্ঠে আকবরকে হুকুম দেন পাগলিকে খাবার টাবার দিতে। সঙ্গে এও বলেন সব খাবারই যেন পর্যাপ্ত দেয়া হয়। দিপিকা, আনুশকা চাপা পড়ে যায় ভেসে আসা ‘পাগলী’ কথা বার্তার আড়ালে। বাইরের হাল্কা পাতলা গোলযোগ যেন চার বন্ধুর কানে এক পুরনো পরিচিত ভগ্নপুঁথির মতো লাগে। চার বন্ধু পরস্পরের দিকে অর্থপুর্ন দৃষ্টিতে তাকায়। সুস্বাদু ঘন দুধের পায়েসের বাটি সবাই নামিয়ে রাখে, অতি নিঃশব্দে। গলা দিয়ে না নামলে তো হাত থেকে নামিয়ে রাখতেই হয় তা যতই সুস্বাদু হোক। আরিফ গৌতমকে একটা ইশারা করে। প্রথমে সে শরীর মুচড়ে গাইগুই করে পরে ওঠে বাইরে চলে যায়। কিছুক্ষণ পর ফিরে এসে ধপ করে সোফায় বসে পড়ে। ওর চোখে মুখে কেমন যেন একটা ভয়ের ছাপ। সে পাশে বসা শুভর কানে কানে কিযেন বলে। একটু দূরে সিঙ্গল সোফায় বসা তুর্য আর ডিভানে বসা আরিফ একই সাথে নিম্নস্বরে খেঁকিয়ে উঠে-
-“কিরে, কি বলছিস? আরে শালা জোরে বলনা আমরাও শুনি”
গৌতমের কানকথা শুনে শুভর মুখটাও কেমন যেন ফ্যাকাসে হয়ে যায়। তা দেখে তুর্য আর আরিফ একলাফে ওদের কাছে চলে এসে নিচু স্বরে একটু বিরক্ত হয়ে জিজ্ঞেশ করে-
-“কি হয়েছেরে! এমন ফিসফিস করছিস কেন? এখানে কে আছে? কে শুনবে? এই তুইনা আজ গরু খেয়েছিস, তাও তোর গলায় জোর নেই”! মনে হয় ইচ্ছে করেই ধেয়ে আসা একটুকরো কালো মেঘকে সরিয়ে রেখে ওরা হালকা মেজাজে কথা বলার চেষ্টা করে।
গৌতম বন্ধুদের বাসায় চুটিয়ে গরু খায়, সে নিয়ে বন্ধুরা খোঁচা দিতে ছাড়েনা আবার গৌতমের বাড়িতে ঘুণাক্ষরেও কেউ ফাঁস করেও দেয়না। গৌতম, আরিফ আর তুর্যকেও কানে কানে কিছু বলে আর হাত দিয়ে দরোজার ওপাশে দেখায়। শুনে এদের সবার চেহারা আমসি বর্ণ ধারন করে। দুশ্চিন্তার ছাপ মুখে নিয়ে নিজেদের মধ্যে নানা রকম আলোচনা করে। ওরা আঙ্গুলে গুনে দিন তারিখ হিসেব করে। পাগলির মা তাহলে মরে গেছে! কিন্তু ওর সাথে বাচ্চা এলো কোত্থেকে! বাচ্চার বয়স কত! এই বাচ্চার জন্ম কি রহস্যময়! পাগলির কি বিয়ে হয়েছে! এই পাগলিকে কে বিয়ে করবে! কার এত ঠেকা পড়েছে! নাহ ওর বিয়ে হয়নি। তাছাড়া বাচ্চার বয়স ওদের সময়ের হিসেব মায়ের গজগজ তো অন্যকিছু অর্থ বহন করে… ভীতিকর অসংখ্য প্রশ্নচিহ্ন ওদের সামনে এসে দাঁড়ায়… সময় কিছুটা হলেও ওদেরকে অভিজ্ঞ জীবনের দিকে এগিয়ে নিয়েছে, আজ ওরা সেই দু/তিন বছর আগের অপরিণত, নারীসঙ্গ নাচেনা, সীমাহীন কৌতূহলী উঠতি তরুণ নয়। তাইবলে একেবারে পরিপক্কও বলা যায়না।
ওরা নিজেদের মধ্যে কিছু পরামর্শ করে। একজন হয়ত একটা ভয়ংকর অনুমানকে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দেয়, পরক্ষণে আবার আরেকজন নানান প্রমাণ দিয়ে সেটাকেই সত্য বলে প্রতিষ্ঠিত করে। নিচু স্বরে বেশ কিছুক্ষণ আলোচনার পর ওরা কথা হারিয়ে চুপ করে নির্বাক বসে থাকে। ভাগ্যিস টিভিটা ছাড়া ছিল…
***
চার বন্ধু একসাথে বড় হচ্ছে। এক সাথেই তারা স্কুল, কোচিং, প্রাইভেট, ব্যাচে পড়তে যায়। খেলা ধুলা, বেড়ানো, গল্প আড্ডা সব একসাথেই করে। দেয়ালের ক্যালেন্ডার একের পর এক বদল হয়। ওদের টেবিলের বইগুলিও বদলাতে থাকে। ওদের শরীরে এবং মনশজগতে ধীরে ধীরে পরিবর্তন আসতে থাকে। স্বাভাবিক সহজাত পরিবর্তন। নানা বিষয়ে তারা কৌতূহলী হয়ে ওঠে, অনেক প্রশ্ন জমে ওঠে তাদের উঠতি মানসিকতায়। তাছাড়া আজকাল উঠতি কিশোর কিশোরীর জীবনে স্কুল কলেজ কোচিং বা লেখা পড়ার বাইরে এক ওয়াইফাই এ ঢোকা ছাড়া আর কোন আনন্দ বিনোদন আছে বলে মনে হয়না। মানুষ আজ সত্যি-ই ভুলে যাচ্ছে লুডু, ক্যারম, কাবাডি, বউচি, হাডুডু খেলার কথা।
আরিফের বাসায় আরিফ, তুর্য আর শুভ একসঙ্গে আরবী পড়ে। একজন ওস্তাদজী ওদের পড়ায়। আমপারা, কোরান শরিফ শেখানোর পাশাপাশি হুজুর আবার দৈনন্দিন জীবনের অনেক কিছুই শেখায় ওদেরকে। পাক, নাপাক, ওজু, গোসল, পবিত্রতা, আযানের দোয়া, কারো মৃত্যু সংবাদ শুনলে কি দোয়া পড়তে হয়, সালাম দেয়া শিখিয়ে দেয়। হুজুর মেয়েদের হায়েজ নেফায়েজের প্রসঙ্গ নিয়ে আসে। মহিলাদের সন্তান প্রসবের পর সর্বোচ্চ চল্লিশদিন সময়সীমা পর্যন্ত নেফায়েজ ধরা হয়। আর প্রতি মাসে মেয়েদের কদিন ধরে যে ব্লিডিং হয় তাকেই হায়েজ বলে। এসময় মেয়েদের বিধিনিষেধ কি কি তাও হুজুর পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে বলে দেয়। যদিও সেখানে কোন মেয়ে শিক্ষার্থী নেই। এরা তিনজনই প্রথম দিকে কুন্ঠিত হয়ে থাকে। পরে ধীরে ধীরে ওস্তাদজীর কাছে খুটিয়ে খুঁটিয়ে সবকিছু জেনে নেয়। এরপরে ক্লাশের মেয়েদের দিকে তাকিয়ে তাদের ইউনিফর্মের ভাঁজের ফাঁকফোকর গলিয়ে ওরা অনুমান করার চেষ্টা করত কার কার সেই বিশেষ সময় যাচ্ছে। ওরা এ নিয়ে ইশারা ইঙ্গিত ও ফিচকে হাসাহাসি করত। অবশ্য টিভিতে ওরা দেখতে পায় এ্যাডভান্স এ্যার্ডভার্টাইজমেন্ট এ মডার্ণ মডেলরা প্যাণ্টি পরে হাইজাম্প দিয়ে স্পষ্ট দেখিয়ে দিচ্ছে ‘হুইসপার’ সহ বহু রকম প্যাডের গুণগত মান।
কৌতুহলের বিষয় অনেক কিছুর সাথে বায়লোজি বইয়ের অনেকগুলি চ্যাপ্টার। সেগুলি নিয়ে ওরা নিজেদের মধ্যে আলাদাভাবে গোপনে কিছু আলোচনা করে। বলাবাহুল্য প্রায় গুলো সিলেবাসের বাইরে তবে জীবনের বাইরের নয়। এরপরে কৌতূহল মেটানোর জন্য ওরা হাতের মোবাইলের শরণাপন্ন হয়। নানাভাবে তারা সেখান থেকে নিষিদ্ধ জ্ঞানার্জন করে। সেখানেই বা কতদিন? দিন যায় বয়সের সাথে সাথে আগ্রহ কৌতূহল আর দুর্দমনীয় এক অনুভূতি অদম্য হয়ে ওঠে। নিজেরা সমাধানের ব্যাপারে নানারকম পরামর্শ করে আবার ভয়ে পিছিয়ে আসে। ওরা বোঝে কি একটা ব্যাপার সবাই জানে অথচ সেটা অলঙ্ঘনীয় ঘেরাটোপে ঘেরা। অপার রহস্য বলয়ে আবৃত। ততোদিনে সবার টেবিলে ল্যাপটপ পৌঁছে গেছে। সেখানে টাচ করলেই অজানা ও নিষিদ্ধ ব্যাপার চোখের সামনেই। সেগুলি ওরা ভয়ে ভয়ে দেখে। আনন্দ, শিহরণ, অজানা আকর্ষণ সব মিলিয়ে ওদের মনে একটা রহস্য ঘনীভূত হয়। এসব দেখতে দেখতে বুঝতে বুঝতে বছরের পর বছর গেলে একটা সময় আসে সকল ভয় কেটে গিয়ে কেবল হাতেনাতে জানার আগ্রহ প্রবল হয়ে ওঠে। এর মধ্যে ওদের এইচ এস সি কমপ্লিট হয়ে যায়। সবাই কোচিং এ ভর্তি হয়। এবারে যে যেখানে চান্স পাবে চলে যাবে। আর হয়ত এভাবে একসাথে থাকা হবে না। কোচিং এ প্রচুর লেখাপড়ার চাপ। চার বন্ধু খুব মন লাগিয়ে পড়াশোনা করে। ভালো কোথাও চান্স পেতেই হবে। নাহলে এতদিনের সব প্রচেষ্টা ভেস্তে যাবে। এতদিন ধরে এদের ১০টা সাবজেক্টের পেছনে হয়ত ২০ জন টিচার ছিলেন। স্কুল, কলেজে এরাই ছিল সেরা ছাত্র। সব দিক থেকেই এরা সেরা এমনকি পরিবারের স্টাটাসের দিক থেকেও কাজেই নামকরা কোন ইন্সটিটিউটে এবং সেটা রাজধানীতে চান্স পেতেই হবে।
আরিফ ও গৌতমের বাসা একদম কাছাকাছি তুর্য থাকে হাইস্কুলের পাশে এবং শুভ থাকে রেললাইনের ওপাশে ষ্টেশনের কাছাকাছি। সরকারি বেসরকারি ভার্সিটি, ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ, মেডিকেল কলেজ সব জায়গায় ভর্তি পরীক্ষা দেয়া শেষ। পরীক্ষার আগের রাতে ওরা গোপনসুত্রে খবর পেয়ে দামদর করে কোশ্চেন পেপার কিনে এনেছিল। প্রতিবারেই কোশ্চেন পেপার আউট হয়ে যায় কাজেই এবারেও হবে এমন বিশ্বাস ওদের ছিল। ওদের বাবারা কোশ্চেন পেপার কেনার অর্থ রেডি করেই রেখেছিল। তাদের কথা হলো যে দেশের যে ভাও। সবাই কোশ্চেন কেনে আমরা কিনলে দোষ কি! এখন চার বন্ধু মনের আনন্দে ঘুরে বেড়ায়। দুটি বাইক নিয়ে চারজন উপজেলার পাশ দিয়ে যে রাস্তাটা গ্রামের দিকে চলে গেছে সেদিকে চলে যায় বেড়িয়ে আসে। কি এক অস্থিরতা যেন এদের সবাইকে তাড়িয়ে নিয়ে বেড়ায়। এক এক দিন একেক জনের বাসায় খাওয়া দাওয়া করে। কে কেমন পরীক্ষা দিয়েছে তা নিয়ে চলে জল্পনা কল্পনা। কোশ্চেন পেপার নিয়ে বসে বসে মেলায়। অনুমান করার চেষ্টা করে কে কোথায় চান্স পেতে পারে। গন্তব্যের আলোচনা শেষে যথারীতি তাদের সেই অদম্য কৌতূহলের বিষয়টি চলে আসে। চারজনের মাথা থেকে কৌতূহল পুরনের বহুরকম সমাধান আসে। সুযোগের অভাবে আবার সবাই সেটা বাতিল করে দেয়। কিন্তু এবারে ওরা অটল। ভার্সিটিতে যাবার আগে একটা কিছু হাতেনাতে করতেই হবে। কৌতূহল নিবারণ না করে ওরা ছাড়বেনা। কিন্তু কিভাবে? কি করে? কোন পথে?
পরিবারের ক্রমাগত চাপ, পরামর্শ ও উপদেশের জন্য ওরা কোন মেয়ের সাথে প্রেমে জড়ায়নি। জড়ানোর সাহস পায়নি। এই এক ব্যাপারে প্রত্যেকটি পরিবার থেকে খুব শক্ত নিষেধাজ্ঞা জারি ছিল।
চার বন্ধু পরস্পরকে চ্যালেঞ্জ করে, দোষারোপ করে, খোঁচা দেয় আবার খেদোক্তি করে ‘কিরে এই সামান্য কাজটাই করা হয়ে উঠছে না! সময় তো আর নাই! অপারেশন সাকসেস করার জন্য ওরা মরিয়া হয়ে ওঠে।
এরমধ্যে একদিন শুভ জরুরী তলব করে সবাইকে একজায়গায় নিয়ে আসে। সবাই খুব আগ্রহ নিয়ে জিজ্ঞেশ করে কিরে, কিছু পেলি? শুভ জানায় ওর বক্তব্য। এরপর সেটা নিয়ে সবাই পরামর্শ শুরু করে। প্রথমে কারো কারো কপাল কুঁচকে যায়, কারো মুখ সিটকে ওঠে, কেউ ঘেন্নায় ঠোঁট উল্টায়। কিন্তু একটা সময় পরে চার বন্ধুই একমত হয়, বলে যে-
“হ্যাঁ এটাই ঠিক আছে। আমাদের জন্য এরচেয়ে ভালো আর কিছু হবেনা। ফাঁস হবার জানাজানি হবার কোন চান্স নাই তাছাড়া ওই কেবল এমন প্রস্তাবে রাজী হবে। প্র্যাকটিক্যালি কিছু করার এটাই একমাত্র সহজ পথ। এছাড়া আর কোন উপায় নাই”
একমত হবার পরে তারা বেশ উত্তেজিত হয়ে ওঠে। সময় নিয়ে ঠান্ডা মাথায় ধীরে ধীরে ওরা একটা নিখুঁত প্ল্যান করে। প্ল্যানের খুঁটিনাটি নিয়েও কথা হয়। বার বার যাচাই করে দেখে প্ল্যানে কোন ফাঁক থেকে গেল কিনা। এরপর সবাই শুভর বুদ্ধির প্রশংসা করে পিঠ চাপড়িয়ে। সবাই মিলে ওকে জড়িয়ে সোল্লাসে বলে ওঠে আরে আমাদের বাটকু এবারে ফাটিয়ে দিয়েছে! এই এক শব্দে শুভর প্রচন্ড আপত্তি এবারে শুভ হাত পা চালাতে থাকে সমানে আর চিৎকার করে- শাটাপ গাইজ বাটকু বলবিনা বললে খবর আছে। সবাই ওকে ছেড়ে দেয়। ছেড়ে দিয়ে কেবল পিঠ চাপড়াতে থাকে সে এমনই চাপড়ানো যে শেষে শুভ বলে “ প্লিজ থাক আর না, তোদের ধন্যবাদ আমি পেয়ে গেছি পিঠের ছাল চামড়া তো ওঠে যাচ্ছে”।
*****
এ্যাডমিশন টেস্ট শেষ চার বন্ধু ঠিক করে ওরা বেড়াতে যাবে। কোথায় যাওয়া যায় ওরা আগে থেকেই ঠিক করে রেখেছিল। বাংলাদেশের দক্ষিণে কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতে বেড়াতে যাবে। যেমন কথা তেমন কাজ। প্রত্যেক পরিবার থেকেই প্রিয় পুত্রদের জন্য সব কিছু ব্যবস্থা করে দেয়া হয়। চাহিদা মাফিক কাউকে ক্যামেরা, কারো আবার চাই এই মোবাইল ফোনের পরের ভার্সন ওকে তাও সই। তাদের দামী শার্ট, প্যান্ট, জুতা, ব্যাগ সবকিছু গুছিয়ে সাতদিনের জন্য পাঠানো হয়। চলে যায় তারা পৃথিবীর সর্ববৃহৎ সমুদ্র সৈকতে। সেখানে সমুদ্র স্নান, আশপাশ অঞ্চলে বেড়ানো, ছবি তোলা, শপিং সব করে তারা ফিরে আসে।
অন্যদের মত আরিফও ওর ছোটবোনের জন্য নিয়ে আসে ঝিনুকের মালা, দুল, চুড়ি, বার্মিজ আঁচার সহ আরো অনেককিছু। কিন্তু সেসবের দিকে ফিরেও তাকায় না আয়েশা। আয়েশা ক্লাস নাইনের ছাত্রী। লেখা পড়ার পাশাপাশি সে গান শেখে। ভাইয়া, ভাইয়ার বন্ধু, বা ওর নিজের বন্ধুদের অনুরোধে, স্কুলের বিভিন্ন প্রোগ্রামে মাঝে মাঝে গান করে। মেয়েটির কন্ঠ ভাল, একেবারে স্বর্গের অপ্সরাদের মতো ত্রিকাল ভুলানি কিন্নর কন্ঠ। এবং গানের প্রতি তার নিষ্ঠা দেখে ওর গানের টিচার ভীষণ তুষ্ট তিনি মনে মনে এই ছাত্রীকে নিয়ে উচ্চাশা পোষণ করেন। গানের মাষ্টার ভুবন বাবু সপ্তাহে দুদিন আসার কথা হলেও তিনি নিজের আগ্রহে বেশ কয়েকদিন আসেন। ছাত্রীও চায় গানের শিক্ষক আসুক। ঘরের দরজায় এসে তিনি আস্তে করে ছাতাটা মুড়িয়ে দরজার কোণায় রেখে ভেতরে ঢোকেন। উনি ঘরে ঢুকলেই পান, সুপুরি আর জর্দার গন্ধে পুরো ঘর মৌ মৌ করে। সব কিছুতেই তিনি অস্থির কেবল হারমোনিয়াম হাতে নিলেই তিনি হয়ে যান অন্যরকম। সঙ্গীত যেন তার কাছে এক উপাসনা। তিনি আয়েশাকে খুব মন দিয়ে তালিম দিচ্ছেন। তাছাড়া এমন ছাত্রীকে যেকোন শিক্ষকই মাথায় তুলে রাখবেন। সে একজন আজন্ম সঙ্গীত শিল্পী। সঙ্গীতের প্রতি এই বালিকার নিষ্ঠা, প্রীতি আর পারঙ্গমতাই বলে যে, তাকে নিয়ে আশা করা যেতে পারে। সে একদিন দশজনের একজন হবে।
তপ্ত মধ্যাহ্ন। আজ বাজার থেকে ৬ কেজি ওজনের একটি বোয়াল মাছ এনেছিল আয়েশার বাবা। সেটি প্রচুর শুকনো মরিচ দিয়ে আগুনঝালে লাল করে রান্না করেছে আয়েশার মা। আহারাদির পর গত রাতের মিস হওয়া সিরিয়ালের উপর চোখ রেখে তাকিয়ায় হেলান দিয়ে আয়েস করে নিজের নিচের ঠোঁট টেনে ধরে চিমটিখানিক গুল রাখলেন আয়েশার বাবা। রেখে হাততালি দিয়ে হাতের অবশিষ্ট গুল ঝাড়তে ঝাড়তে পান সাজাতে ব্যস্ত আয়েশার মাকে বললেন- “এরপর থেকে গানের মাষ্টার আর আসবেনা”। ঠোঁটের ফাঁকে গুল রাখা কন্ঠের এই উচ্চারণ কেমন যেন অশ্লীল শোনায়। যেন সিরিয়ালের মাঝে একটা শোক সংবাদ ঘোষিত হয় আর সেটা ঘুরতে থাকে ঘরময়। মোটা মোটা স্বর্ণের কংকন পরা হাতদুটি অকস্মাৎ পান আর চুনের মাঝে থমকে যায়। সে কিছুই বুঝতে পারেনা। আক্ষরিক অর্থেই মহিলার মুখ হা হয়ে যায়। সিরিয়াল হলে ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক হত দ্রিম! দ্রিম! আর ক্যামেরা জুম হত হা হওয়া মুখের উপর। হতবাক মহিলা জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে কর্তার দিকে তাকিয়ে রইলে তিনি খেঁকিয়ে ওঠেন-
-“কি সোজা বাংলা বোঝ না? চীনা ভাষা তো কই নাই। ওর আর গান শেখা লাগবেনা। এতদিন ছোট ছিল প্যাঁ পোঁ করেছে সে ভিন্ন কথা, এখন বড় হয়েছে। এখনও এসব চলবে? তোমার হুশজ্ঞান থাকলে তো আর আমার ভাবা লাগত না। মুসলমানের মেয়ে এসব কি? এসব হারাম। আর এসব চলতে দেয়া যায়না, চলবেনা ব্যস, বুঝছ!”। মহিলার আর বলার কিছু নাই। বলতে গেলেই হাত পা চালানোর অতীত ইতিহাস তেনার আছে। কিন্তু মাতো সন্তানকে চেনে, সন্তানের মনের কথা জানে, সে মনেমনে একেবারে বিচলিত বোধ করে। মেয়ে যে প্রাণের চেয়েও গান বেশি ভালোবাসে সে কিভাবে ব্যাপারটা নেবে! তাছাড়া সেই ক্লাশ টু/ থ্রী থেকে আজ অবধি ৬/৭ বছর ধরে মেয়েটা রীতিমত সাধনা করছে সেটা তো আর কেবল মাত্র প্যাঁপোঁ নয়। নেশার মত আকর্ষনীয় সিরিয়ালে আর কিছুতেই মন বসে না আয়েশার মায়ের।
এরপরে সাতদিন ধরে সঙ্গীত প্রেমী বালিকা নাওয়া খাওয়া লেখা পড়া স্কুল সব ভুলে বিছানায় পড়ে পড়ে কেঁদেকেটে নিজেকে নিঃশেষ করলেও কর্তার রায় বহাল থাকে। ছোট্ট মানুষ নানা যুক্তি তর্ক করে, ফোফাতে ফোফাতে বলে “ভাইয়া যা করতে চায় তাই করতে দাও, কক্সবাজার যেতে চাইল দিলা, তাহলে আমার বেলায় এমন কেন! আমি কেন গান শিখতে পারব না”! কন্যার প্রতি পিতার অন্ধ ভালোবাসাও হার মানে সেই রায়ের কাছে। হাকিম নড়লেও হুকুম নড়েনা।
***
কয়েকটা গরু মোষ চরে বেড়াচ্ছে রেলের বিস্তীর্ণ ঘাসমাটিতে। লম্বা লম্বা উলু ঘাসের ডাঁটিতে বসে কিছু ছোট্ট পাখি তীক্ষ্ণ চোখ রাখছে ঘাস ফড়িং, ছোট ছোট পোকাদের দিকে সুযোগ পেলেই ক্ষুধা নিবারণ। ক্ষুধা নিয়ে কেউই বেঁচে থাকতে পারেনা। যেভাবে হোক তা মেটাবেই। এটাই জাগতিক নিয়ম। পাশের ঝোপঝাড় থেকে ছোট ছোট পাখি উড়ছে, তারা চমৎকার আকাশের কোমলতায় ঘাই দিয়ে আবার তীরবেগে সোজা নিচে নেমে আসছে নির্ধারিত লক্ষ্যবস্তুর দিকে। পাশেই একটি ডুমুরের গাছ শরীর চিরে থোকা থোকা ডুমুর ফলিয়েছে। গাছটির আগা গোঁড়া ডুমুরে ডুমুরে ডুবে আছে। এতদাঞ্চলে এই ফল বা সবজিটি খুব একটা কেউ খায়না বলে গাছ ভর্তি হয়ে আছে। কিছু দূরত্বে থাক থাক করে রেলের স্লিপার সাজানো আছে। এগুলি কতদিন ধরে পড়ে আছে কে জানে! এগুলির গা থেকে আগাছা বের হয়ে সেগুলিও সাইজে বড় বড় হয়ে গেছে। গায়ে শ্যাওলা। মাঠের একেবারে কিনারের লাইনে দাঁড়িয়ে আছে কিছু পরিত্যাক্ত ওয়াগন। সেগুলি কোনটার অবস্থা জড়াজীর্ণ হলেও কোনগুলি বেশ মজবুত আছে।
শুভরা এগুলি কয়েকবার এসে জরিপ করে গেছে। ওরা জেনে নিয়েছে কোন ওয়াগন কিছুটা ভাল আর ইউজাবল আছে।
শীত আসি আসি করছে। বাতাসে টান ধরেছে। সকাল সন্ধ্যায় গায়ে একটা কিছু না জড়ালে হাত গুটিয়ে আসে বুকের কাছে। বিকেলগুলো তার দীর্ঘতা হারিয়ে ছোট হয়ে আসছে। ব্যস্ত জংশনে সারাক্ষণ কত ট্রেন আসে যায়। কতশত যাত্রী ওঠানামা করে। কেউ কি কাউকে চেনে! জানে! কত তাড়া আর ব্যকুলতা তাদের মাঝে। ষ্টেশন একটি আজব জায়গা। বড় রহস্যে ঘেরা মনে হয়। এমন এক সন্ধ্যায় চার বন্ধু সাথে একটি মেয়েকে নিয়ে নিরাপদ একটি ওয়াগনে ঢূকে যায়। ওরা মেয়েটির জন্য এক সেট জামাকাপড়, একটি বড় তোয়ালে, চুলের ফিতা চিরুনি, আর কিছু খাবার নিয়ে এসেছে। সাথে ক বোতল পানি। ওরা মেয়েটিকে সাবান পানি দিয়ে পরিস্কার হতে বলে, মেয়েটি তাই করে। ওকে বলে নতুন ড্রেসটা পরতে সেটাও সে করে এবং সেটি মেয়েটিকে চমৎকার মানিয়ে যায়। নতুন ড্রেস পরে তার খুশি ধরেনা। জামার ঝুল তুলে একে একে সবাইকে দেখায় আর ফিকফিক হাসে। আবার চুলের ফিতা দেখিয়েও হাসে, সে হাসি ভ্রুহীন মোনালিসার হাসির চেয়ে কম কিছু নয়। পরিস্কার পরিচ্ছন্ন হয়ে নতুন জামা পরে চুল বেঁধে সমবয়সী মেয়েটিকে দেখতে বেশ লাগে। শুভদের ক্লাসের সুন্দরী মেয়েদের মতই লাগতে থাকে। অন্তত ওদের তাই মনে হয়। পাউরুটি কলা খেয়ে ওরা ওকে পানি খেতে দেয়। সাথে আনা একটা একার্জি ড্রিংসও খেতে বলে। নিয়ে আসা বেডকভারটা ওরা বিছিয়ে নেয়। সবাই মেয়েটিকে নিয়ে গোল হয়ে বসে। যেন ল্যাবে ওরা ব্যাঙ বা তেলাপোকা নিয়ে ডিসেকশন করার জন্য রেডি…
***
প্রায় সকল গ্রামে মহল্লায় দু’একজন করে শারীরিক বা মানসিক প্রতিবন্ধী মানুষ থাকে যাকে গ্রামের মানুষ পাগল বা পাগলি বলে। তারাও কিন্তু আসলে মানুষই। ওদেরও ক্ষিধা পায়, ওদেরও কাপড় চোপড়ের দরকার হয়, ওদের চিকিৎসারও দরকার হয়, শারীরিক সব ধরনের অনুভূতি এবং চাহিদা তাদেরও থাকে। রেললাইনের পাশে একটি অতি ক্ষুদ্রকায় ঝুপড়ি যার একটা পাশের দেয়াল হয়ে আছে সেখানে রক্ষিত স্লিপারের পাহাড়। সেখানেই এক বুড়ি তার একটি বোবা কালা মেয়ে নিয়ে থাকে। এই বুড়ি যে কোত্থেকে এখানে এসেছে কে জানে! বুড়ি ভিক্ষা করে। মেয়েকেও সাথে নিয়ে যায়, না নিয়ে কি করবে মেয়েটি বোবা তায় সেয়ানা। যা দিনকাল পড়েছে এই সেয়ানা মেয়েকে কার কাছে রেখে যাবে! তাছাড়া ওকে দেখে কেউ কেউ মাঝে মাঝে দয়াপরবশ হয়ে কিছু বাড়তি চাল বা টাকা পয়সা হাতে দেয়। অত্র এলাকার প্রায় সব বাড়িতেই বুড়ি ভিক্ষায় যায়। সবাই বুড়িকে চেনে। এই বুড়ি এবং বোবা পাগলি গৌতম, তুর্য, শুভ, আরিফ সকলের বাসাতেই বহুবার গেছে ভিক্ষার জন্য। এরা কখনই এসব তরুণদের নজরে পড়েনা। না পড়ারই কথা। তরুণদের উচাটন মন দৃষ্টি থাকে অন্যকিছুর প্রতি, চকচকে ঝকঝকে তরুণীদের প্রতি। ফকিন্নিকে দেখার সময় কোথায় তাদের! কিন্তু প্রয়োজন যখন একেবারে মাথায় নেহাই পেটাচ্ছে তখন শুভর নজরে পড়ে যায় ফকিন্নির বোবা কালা মেয়েটা।
শুভসহ তিনজনের বাসায় জানে ওরা আজ সবাই আরিফদের বাসায় থাকবে। এটা কোন নতুন ঘটনা নয়। এমন প্রায়ই ঘটে থাকে। কাজেই ওয়াগনে রাত কাটানোর ব্যাপারটা কারোরই গোচরে আসেনা। কেউই কিছু বুঝতে পারেনা। সুতরাং বিশেষ একটা রাত ওরা কাটায় রেলের পরিত্যক্ত কামরায় ওদের ভাষায় অসম একটি অভিজ্ঞতার সাথে, যেটি নতুন আর গোপন এডভেঞ্চার ছাড়া আর কিছু মনে হয়না ওদের কাছে। অপারেশন সাকসেসফুল এটা একটা আনন্দ আর আরেক ধরনের নতুন অভিজ্ঞতা নিয়ে ওরা ঘরের ছেলে ঘরে ফেরে। যেমন ফিরত পরীক্ষার খাতায় এ প্লাস নিয়ে। যাতে বাবা মা খুশি হয়ে হাতে ধরিয়ে দিত প্রতিশ্রতি অনুযায়ী কোন গিফট।
নতুন অভিজ্ঞতাকে ওরা অবশ্য কিছু দাম ধরে দেয়। আরো কিছু খাবার কিছু টাকা আর কিছু মেয়েলি সাজের চুড়ি টিপ ইত্যাদি। বোবা মেয়েটিও মহা খুশি। খুশি মনেই সে তার ঝুপড়িতে চলে যায়। তখন ভোরের আকাশ কেবল উদ্ভাসিত হতে যাচ্ছে। আকাশকে বিধবা বানিয়ে ফুটকি তারাগুলোও আর দেখা যাচ্ছেনা লুকিয়ে যাচ্ছে একটি একটি করে দিবসের অন্তরালে। থোক থোক আঁধার কেটে কোমল আলো ছড়িয়ে পড়ছে চারপাশে। চারদিক থেকে কুয়াশার পর্দা, হিমের পর্দা, নিদ্রার পর্দা ক্রমশ নিঃশব্দে ওঠে যাচ্ছে। জংশন জেগে ওঠছে। হকাররা ধীরে ধীরে নিজ নিজ ব্যস্ততায় ঢুকে যাচ্ছে, কাঠকয়লার চু্লার ধোঁয়া গলগল করে উড়ছে… প্লাটফর্মে ঘুমিয়ে থাকা মানুষেরা কেউ হাই তুলছে, কেউ হেঁটে হেঁটে নিমের ডালের দাঁতনে দাঁত মাজছে… নিদ্রিত জগত জেগে ওঠছে আপন নিয়মে।
***
নিস্তরঙ্গ ড্রয়িং রুমে একটা মৃদু তরঙ্গ তুলে শুভ বাইরে এসে দেখে আরিফদের বাড়িতে ঢোকার মুখে ডালিম গাছের তলায় পাগলি বসে খাচ্ছে আর পাশেই একটি নিটোল ন্যাংটো শিশু বসে বসে একটা কিছু নিয়ে খেলছে, সেটাই আবার মুখে দিচ্ছে। অদূরেই এদের পুকুরের উপর নারীর অভিমানের মতো হালকা সবুজ সর ভাসছে। পাগলির পাশেই একটি কুকুর ভাতঘুম আলিস্যি আর মাছি নিয়ে শুয়ে আছে। কিছু মুরগি বাচ্চাসহ চারপাশে ঘুরে বেড়াচ্ছে আর পাগলির থালা থেকে ঠুকরে খাবার খাচ্ছে। শিশুটির গায়ে ধুলোমাটি ময়লা। তার চুল লালচে জটা জটা কিন্তু আশ্চার্য তার হাসি। কী অনাবিল! শুভ ভাবে শিশুর হাসি ত এমনই হয়। সে ঘুরে চলে যেতে চায় কিন্তু ওকে দেখে শিশুটি আবার ফিক করে একটা হাসি দেয় আর শুভ্রর বুকে বিদ্যুতের ফলা চিরে যায়। শিশুটির দুদিকে দুটি দাঁত উঁচু ঠিক শুভর বহুল আলোচিত দাঁতের মত। একেই নাকি গজদন্ত বলে! শুভর পা গেঁথে যায় মাটির সাথে। সে নিজের অজান্তেই ঝুকে পড়ে শিশুটিকে কোলে নেবার জন্য কিন্তু তটস্থ হয়ে আবার থেমে যায়। চারিদিকে তাকায় কেউকি দেখে ফেলল! অবাক কান্ড শিশুটি আবার ওকে দেখে হেসে ফেলে শুভ আর ঠিক থাকতে পারেনা। মানব সৃষ্টির তত্ত্বকথা ওর মনে পড়ে যায় সে এখন অনেক কিছু জানে… তাহলে কি… ও পালিয়ে আসে…সোজা চলে যায় বাথরুমের আয়নার সামনে সেখানে ফুটে ওঠে একটা শিশুর হাসিমাখা মুখ পাশে নিজের মুখ মুখে গজদন্ত … একটা শিশুর মুখ পাশে নিজের মুখ মুখে গজদন্ত…
গৌতম এসে শিশুটিকে দেখে। পাগলিকে আজ আর কেউ দেখেনা। দেখে নিজের পৌরুষ্যকে। গৌতম নিশ্চিত হয় বাচ্চাটি ওরই কারন ওর মাথার চুল অস্বাভাবিক রকম কোঁকড়ানো বাচ্চাটিরও ঠিক তাই। ওর বুকে তোলপাড় ওঠে… ও ভাবে আমি একি করেছি! না বুঝেই করেছি কিন্তু এখন করনীয় কি! মনে মনে সে নিজের কাছে একটি শপথ করে এর দায়দায়িত্ব সে পালন করবে…সারাজীবন পালন করবে… কিভাবে সে জানেনা কিন্তু করবে… নিজের মাথার চুল খামচে ধরে সে এলোমেলো পায়ে ঘরে চলে যায়…
তুর্য দেখে শিশুটির গাত্রবর্ণ ঠিক ওর মতই শ্যামা শ্যামা। আসলে কালোই বলা যায় মা খালারা আদর করে শ্যামলা বলে। আগে থেকেই অনুমিত ভাবনা মাথায় নিয়ে দেখতে এসে সেও নিশ্চিত হয় আমিই ওর পিতা। পিতা! বুকের মধ্যে একটা ধাক্কা লাগে… পিতা কাকে বলে সেটাই তো এখনও ও ভালোরকম জানেনা…অথচ ও পিতা হয়ে গেল! একটা খেলা খেলতে গিয়ে এটা কী ঠিক হল! এতে পাপ হবেনা! বাবা শুনলে পিটিয়ে মেরে ফেলবে…হতবিহবল সে কয়েক মুহুর্ত… কিন্তু হঠাত করে বুক চিতিয়ে সে এবাউট টার্ন নেয়। কিসের কী! জগতে ত কত কালো শিশু আছে! সবাই কী ওর সন্তান নাকি! যত্তসব নাটুকেপনা! এদের খালি সেন্টুমার্কা কথাবার্তা! হনহনিয়ে ভনভনিয়ে অতি দ্রুত গেট দিয়ে বের হয়ে যায় সে …
আরিফ আসে সবার শেষে। ওরা একজন একজন করে আসে। একসাথে এলে কেউ যদি কিছু সন্দেহ করে, ভয় হয় কেউ যদি কিছু বুঝে ফেলে। আরিফ কিছুটা আবেগ প্রবণ। ও দেখে নির্মল, সচ্ছন্দ প্রাণ শিশুটি দুহাতে ধরে একটা মুরগির ঠ্যাং মুখে ঢুকিয়ে কামড়াচ্ছে, চুষছে, মুখ থেকে লালা ঝরছে হাত পা ধুলায় ধুসরিত। পাশেই পাগলি খাওয়া নিয়ে ব্যস্ত। আম্মু সব আইটেম যথেষ্ট পরিমানে দিয়েছে, পাগলিও আপনমনে খেয়ে যাচ্ছে। মাঝে মাঝেই জিভ ও টাকরার সুখ শব্দ তুলে খাবারে মাখামাখি আঙ্গুল চুষছে। জামা কাপড়ের ঠিক নাই ছেঁড়া জামার গলায় ভরাট পুরষ্ট স্তন স্পষ্ট… কিন্তু সেদিকে দেবার মতো মনের অবস্থা ছেলেদের নয়।
ওকে দেখেও শিশুটি অদ্ভুত এক হাসি দেয়। হাসির সাথে সাথে লালাও ঝরে পড়ে। লালা দেখে আরিফের গা রিরি করে ওঠে। কিন্তু শিশুর হাসিটি একেবারে অনাবিল। দাঁতগুলি অপ্রত্যাশিত শুভ্র আর সুন্দর। দেখতে ভাল লাগে। সে বাচ্চাটির দিকে তাকিয়ে ভ্রু নাচায় আর বাচ্চাটি আরো জোরে হেসে ওঠে। আর ঠিক সেই মুহুর্তে একেবারে আচমকা আরিফের পায়ের নিচে ভূমিকম্প হয়! বিস্ফারিত চোখে দেখে বাচ্চাটির ডান হাতে ছয়টি আঙ্গুল। সে ঝুকে পড়ে ভাল করে দেখে, নাহ কোন সন্দেহ নাই। আরিফের ভিত্তি নড়ে ওঠে! ও ঠিক বুঝতে পারেনা এই ভূমিকম্পের নামই কি পিতৃত্ব! এতো একেবারে সহজ হিসাব এখন ও জানে নারী পুরুষ উভয়ের শরীর থেকে জিন সন্তানের শরীরে আসার সময় দুই ভাগ হয়ে যায় এবং এই দুই অর্ধাংশ একত্র হয়ে সন্তানের জেনেটিক গঠন তৈরি করে। সে তার ডান হাতটি চোখের সামনে নিয়ে তাকিয়ে থাকে… ওর ভেতর থেকে এক দলা কান্না বেড়িয়ে আসতে চায়, কেন তা কে জানে! এই দুর্ভাগা শিশুটি ওরই জিন বহন করছে! এই হতভাগ্য প্রাণটির জন্য ওই দায়ী! ওই ওর জন্মদাতা! মাটিতে বসে কুকুর, ছাগল আর মুরগির সাথে একসাথে খাবার খাচ্ছে যে শিশু সে তারই ঔরসে! ওর খুব খারাপ লাগে! কোথায় যেন একটা ফাঁক থেকে যাচ্ছে! কোথায়! এই প্রাণ কি স্রেফ কৌতুহল মেটানোর ফল! এই প্রাণ কি শুন্যতা ও যৌনতার প্রতীক! এই প্রাণ কি অশিক্ষা আর মূল্যবোধের অবক্ষয়ের প্রতীক! নিজেকে অপরাধী মনে হয়। অবশ্যই কোথাও একটা বিশাল ফাঁক থেকে যাচ্ছে! কোথায় সেটা! মনে হচ্ছে আরো প্রচুর জানতে হবে, শিখতে হবে। জীবন কেবল কিছু নোটবই আর কোচিং এ স্যারদের দেয়া পেপার্সের সমষ্টি নয়, কেবল এ প্লাস নয়! এ আরো কিছু। এর ব্যাপ্তি অসীম। আত্মগ্লানি, অনুশোচনায় ও মুষড়ে পরে… ও এখন কী করবে! এসব কাকে জানাবে! এসব কী কাউকে জানানো যায়! আর কাউকে জানিয়েই বা কি হবে! মনের ভেতর পাহাড় সমান অপরাধের বোঝা নিয়ে বাকিদের মত সে ত্বরিত নিরাপদ আশ্রয়ে না গিয়ে সোজা রাস্তার দিকে হাঁটতে থাকে। পৃথিবীর সবচেয়ে উন্নত এবং মহামূল্যবান যে প্রাণ সেই মানব প্রাণ সৃষ্টি এতটাই পলকা হেলাফেলার! বলা চলে তাচ্ছিল্যের!
বিকেল মরে আসছে একটু পরেই সুর্যটা পশ্চিম আকাশে ওই অশ্বত্থ গাছটির মাথার উপর দিয়ে দূর অস্তাচলে যাবে। আরিফ হাঁটতে হাঁটতে চলে যায় রাস্তা ছেড়ে মাঠের মাঝ দিয়ে, প্রৌঢ়া নারীর সিঁথির মতো মেঠো পথ ধরে দূরে আরো দূরে… একটি ঘটনা যেন এই নব্য যুবককে অনেকটা পরিণত করে দেয়। চেনা অচেনা অনুভূতির জলোচ্ছ্বাসে ভাসতে ভাসতে সে ভাবতে থাকে…জীবন আসলে কি? মানুষের সংজ্ঞা কী? মানুষ, আমরা কেন মানুষ? কিংবা কেন মানুষ নই?
তারপর ইলেকট্রিক বিল জমা দিতে যাবো। আমার দেরি হবে আসতে। স্বামী অমর বলে, ঠিক আছে।…..
নভেম্বর চলছে। অনির সাথে আজ দেখা হবে তা জানাই ছিল। এই তো ক’দিন আগেই দেখা…..
বুড়িমাসি বলেন,জীবনটা বালির ঘর গো।ঢেউ এলে ধুয়ে যায় জীবনের মায়া।তবু বড় ভালবাসা ওদের দাম্পত্যে।রোদের চাদরের…..
এক ড্রইং রুমে বসে রয়েছে সদ্য কিশোর উত্তীর্ণ তরুণ গোয়েন্দা সজীব। সামনের টেবিলে ছড়িয়ে…..