প্রক্সি
তারপর ইলেকট্রিক বিল জমা দিতে যাবো। আমার দেরি হবে আসতে। স্বামী অমর বলে, ঠিক আছে।…..
মানুষটা ব্যারাকের টানা বারান্দায় শুয়ে ছিল।
উত্তরে মাথা – দক্ষিণে পা দুটো,হাত বুকে ভাঁজ করা। মানুষটা ঘুমুচ্ছে। গভীর এক ঘুম। হঠাৎ দেখলে ভ্রম হয়। মনে হয় এইমাত্র মানুষটা পৃথিবীর সাথে তার যাবতীয় হিসাব নিকাশ চুকিয়ে দিয়েছে।তার আর কোন কাজ নেই। ক্লান্তিতে চোখ আর শরীর ভেঙ্গে আসা মানুষটা পরম নিশ্চিতে এখন ঘুমুচ্ছে। একটু পরেই সবাই আসবে। সুভ্রতায় জড়িয়ে তাকে নিয়ে যাবে অনন্ত আর এক ঘুমের রাজ্যে।
একজন দুজন করে বারান্দার দু প্রান্ত দিয়ে উঁকি মারে। এত বেলা করে বারান্দায় শুয়ে কেউ ঘুমায় নাকি? আরো একটু পরে কথাটা কানাকানি হয়। কেউ একজন বারান্দার পাশ দিয়ে যেতে যেতে হাঁক ছাড়ে-
হালায় কেডারে? মরছেনি!
হাঁক শুনে দু চারজন মুখ ফিরে তাকালেও শুয়ে থাকা মানুষটার কোন প্রতিক্রিয়া নেই। শুনতেই পেল কীনা কে জানে?
আরো কিছুক্ষণ পরে ব্যারাকের ছেলেমেয়রা বারান্দায় খেলতে এসে বিব্রত বোধ করে। মানুষটা বারান্দায় শুয়ে পুরো বারান্দাকে দু ভাগে ভাগ করে ফেলেছে। যে কোন এক ভাগে ওদের খেলা হবেনা। পুরো বারান্দাটাই ওদের চাই। সেটা সম্ভব হয়ে উঠছেনা মানুষটা শুয়ে থাকার কারণে।
শিশুগুলো শুয়ে থাকা মানুষটার চারপাশে গোল হয়ে ভিড় করে। মুখ ভর্তি দাড়ি আর এলোমেলো চুল দেখে অনেকেই ভয় পেয়ে যায়।পাগলের ভয়ে পেয়ে বসে ওদের।
ব্যারাকটার ঠিক সামনেই একটা চায়ের দোকান। টংঘরে বসে মহল্লার করমালী চা বিক্রি করে। চা বিক্রি করমালীর পৈত্রিক পেশা। ওর বাবাও এ মহলায় চা বিক্রি করতো।তার কোন নির্দিষ্ট দোকান ছিল না। যাকে বলে ভ্রাম্যমান চা বিক্রেতা। সে হিসেব কষতে গেলে করমালীর অনেকটাই উন্নতি হয়েছে। একটা টংঘর বানিয়ে তাতে মাথা গুঁজেছে। কলোনিতে ঢোকার মুখে এ যায়গাটিকে ক বছর আগেও ছিল জঙলে পরিপূর্ণ। ডিউটি শেষ করে শ্রমিকেরা ব্যারাকে ফেরার পথে এখানটায় দাঁড়িয়ে অথবা বসে কিছুটা হাল্কা হয়ে নিত। জায়গাটি পুরোপুরি সরকারি তাতে করমালীর কোন সন্দেহ নেই। বোকা বনে যায় তখন যখন মহলার উঠতি বয়সী ছেলেগুলো মাস শেষে সামনে এসে দাঁড়িয়ে হাত বাড়িয়ে বলে “চাচা এই মাসের ভাড়া দেও”।
কীসের ভাড়া চাও তোমরা? এইডাতো সরকারি জমি। গরিব মানুষ আমি, একটু দোকানদারি কইরা খাই।
করমালী প্রথমদিকে এমন জবাব দিয়েছিল। ছেলেগুলো করমালীর কাঁধে হাত রেখে বলে-
চাচার কথা হোন; সরকারি আবার কী? সরকারের আর কাম নাই? এইহানে আইয়া জমি পাহারা দিরো? আমরা কিয়ের লেইগ্যা আছি? সরকারের কামডা আমরা কইরা দিতাছি। দেও দেও আর দেরি কইরোনা।
করমালী কাচুমাচু করছে দেখে এখনও গোঁফ ওঠেনি এমন একটা ছেলে বলে
ভাড়া দিতে চাচার যদি কষ্ট অয় তয় যেন ছাইরা দেয়। আমাগো হাতে বহুত ভাড়াইট্টা আছে।
করমালী আর কোনদিন কথা বাড়ায়নি। যা বোঝার তা বুঝে নিয়েছে । টিনের কৌটার ক্যাশ বাকসটা থেকে দুটো পঞ্চাশ টাকার নোট বের করে বয়স কম বোঝে বেশি এমন ছেলেটার হাতে গুঁজে দেয়।
ছেলেটা নোট দুটো সবার সামনেই মেলে ধরে করমালরি দিকে কটমট করে চেয়ে থেকে বলে –
ওই বান্দির পো, আমরা কী ফকিন্নির পুত নি? ভিক্ষা দিতাছোস কি লা?
করমালী লজ্জা পায় , ওরা গরীর ছিল বটে কিন্তু ওর মা কোনদিনও বাদির কাম করেনি। তবু আজ শুনতে হলো বান্দির পো।
করমালী কথা না বলে আরো একশ টাকা বের করে দেয়।
ছেলেটা ছো মেরে করমালীর হাত থেকে টাকা নেয়। পরের বার কিন্তু আরো একশ বাড়াইয়া দিতে হইবো ,মনে রাখিস।
করমালী মনে মনে হেসে ওঠে। হাসার কারনটা অবশ্য ভিন্ন। যে ছেলেটা টাকাটা নিল ও যখন ঘুরে দাঁড়ালো তখন করমালীর চোখ যায় ছেলেটার পশ্চাদদেশে।রং চটা জিন্সের প্যান্টটা এতটাই নেমে গেছে যে পাছার দু পাশে দুটো মাংসপিন্ডের ঢিবিকে বিভক্তকারী সীমানা চিহ্ন অর্ধেকটাই বের হয়ে এসেছে। করমালী যখন এ বয়সে ছিল তখন নাভির উপরে প্যান্ট পড়াটাই নিয়ম ছিল। কারখানার শ্রমিকদের পুরনো প্যান্টগুলো ফেলে না দিয়ে ভালোবেসে ওরা করমালীর বাবাকে দিত বাবা আবার ভালোবেসে ওকে দু একটা করমালীকে দিত। যেটা কোমড় ঢিলা হতো সেটা দড়ি দিয়ে টাইট করে কোমড়েরর ওপড়ে বাঁধতে হতো। একবার অসতর্কতায় একটু নেমে গিয়েছিল তাই দেখে বাবা ধমকে বললেন “তোমারে দেখতে পকেটমাইরের মতন মনে হয়”
করমালী এ ভুলটা আর করেনি। ও ভেবে অস্থির হয় এই ছেলেগুলোর কী বাবা নেই?
বারান্দায় মানুষটা এখনও শুয়ে আছে। লোকজনের আনোগোনা বাড়ছে,কথা বাড়ছে।বারান্দাটার সামনেই যেহেতু করমালীর চায়ের দোকান প্রথম প্রশ্নের ঝড়টা তাই করমালীর উপর দিয়েই যায়।
অই মিয়া কেডায় এইডা?
হালায় বাইচ্চা আছে না মইরা গেছে?
করমালী তুমিতো সামনেই আছো মানুষটা এইখানে কোন সময় আইছে?
করমালী সকালে আইসা তুমি মানুষটারে এইখানে দেখছো?
আরো কত কত প্রশ্ন। করমালী কিছুটা বিরক্ত হলেও লোকজনের সমাগম দেখে খুশি। চা বিক্রির পরিমান বেড়ে গেল হঠাৎ করেই। চা বিক্রির দীর্ঘ দিনের অভিজ্ঞতায় করমালী দেখেছে আনন্দ আর টেনশনে থাকলে মানুষ চা টানে বেশি। অচেনা মানুষটা বারান্দায় শুয়ে কলোনীর মানুষের টেনশনটা বাড়িয়ে দিয়েছে বোঝাই যায়।
মানুষটাকে বৃত্তের মত গোল করে দাঁড়িয়ে দেখছিল ছোট ছোট শিশুরা। একটু পরেই দৃশ্যটা পাল্টে গেল। ছোটদের সরিয়ে দিয়ে যায়গা নিল বড়রা। শুরুতে দাঁড়িয়ে দেখল সবাই। একটু পরেই বসে পড়ল অনেকেই। একজন মানুষটার নাকের কাছে নিজের হাত এগিয়ে দিল
মরে নাই মরে নাই! বাইচ্চা আছে।
একজন ধমকে উঠলো
এই মিয়া ঘুমানোর যাগা পাস নাই? ওঠ ওঠ।
মানুষটা যেভাবে ছিল সেভাবেই শুয়ে থাকলো।
একজন মৃদু করে ধাক্কা মারে। একটু পরে জোরে ধ্বাক্কা মারে।
মানুষটা নড়ে ওঠে ; কারো সাথে কোন কথা বলেনা। উঠে বসে এবং এক সময় দাঁড়িয়ে যায়। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই বৃত্তাকারে ঘুরে সবার মুখের দিকে তাকায়। ভ্রু সামান্য কুঁচকানো। মনে হয় চেনা মুখ কাউকে খুঁজছে। না কাউকেই পায়না ; মুখে হতাশার ছাপ স্পষ্ট।
ভিড় ঠেলে মানুষটা সামনে এগিয়ে যায়। করমালীর চায়ের দোকান ফেলে আরো কিছুটা এগিয়ে গিয়ে ফুলের দোকানটার সামনে দাঁড়ায়। গাড়ী থামিয়ে দুটো মেয়ে ফুল কিনছিল। মানুষটা সাদা রঙের গাড়িটার পাশে গিয়ে দাঁড়ায়। কাউকে কিছু না বলে সাদা গাড়িটার শরীরে পেচ্ছাব করে দেয়। ফুলের দোকানের ছেলেটা একটা লাঠি হাতে দৌঁড়ে আসে।মানুষটা কিছুদুর দৌঁড়ে গিয়ে ব্যস্ত সড়কটার মাঝখানে বসে পড়ে। নিক্সন মার্কেটের পুরনো কোটটা গায়ে চাপানোই ছিল। কোটের পকেটে হাত ঢুকিয়ে টুকরো ভাঙ্গা চক পেন্সিল বের করে আনে। মানুষটার পেছন পেছন আসা ছেলে পুলে আর উৎসুক মানুষের একটা জটলাতো ছিলই। জটলাটা ক্রমশঃ বাড়তেই থাকে। মানুষটাকে ঘিড়ে রাস্তার মাঝখানেই একটা জটলা তৈরী হয়ে যায়। দুপাশে আটকে থাকা রিকসার টুং টাং আর গাড়ির হাইড্রোলিক হর্ণের বিকট শব্দে জটলা আরো বাড়াতে সহায়ক ভূমিকা পালন করে।
মানুষটা এতটাই নির্বিকার যে সে মুহূর্তে তার পাশে অন্য কারো অস্তিত্বই স্বীকার করে বলে তার আচরণ দেখে মনে হয়না।
মানুষটা তাকে ঘিড়ে তৈরী বৃত্তের মধ্যেই চক পেন্সিলে একটা ডাইনোসরের ছবি আঁকে ; মাথাটা মেয়ে মানুষের। দর্শকরা মানষিক ভাবে কয়েক ভাগে বিভক্ত হয়। কেউ কেউ ছবিটির শিল্পগুণ খুঁজতে থাকে কেউ মানুষটাকে এখানে উটকো ঝামেলাই মনে করছে। আবার কেউ তীক্ষè দৃষ্টিতে রহস্য ভেদ করার চেষ্টাও করছে। তবে বিরক্ত হচ্ছে এমন মানুষের সংখ্যাই বেশি বলে মনে হয়।
এই হালায় পাগল নাকী?
আরে না না জাতের পাগল তালে ঠিক আছে।
আরে ভাই পাগল টাগল কিছুই না ;এই বেডায় মতলববাজ পাছার মইধ্যে দুইডা লাত্থি মারেন দেখবেন সব বাইর হইয়া গেছে।
এমন সব কথায় কেউ কেউ অতি উৎসাহি হয়ে রহস্য ভেদ করতে এগিয়ে যাচ্ছিল অমনি একজন চেচিয়ে উঠলো-
এই কেউ গায়ে হাত দিবি না। আমি হেরে চিনি।
কই থাকে?
কই থাকে?
তা কইবার পারুমনা।
নাম কী?
তাও কইবার পারুমনা।
নাম কইবার পারেন না,ঠিকানা কইবার পারেন না তয় কী কইবার
পারেন ?
একটা হাসির রোল ওঠে।
লোকটা এবার বলে, হেরে সবাই আলাউদ্দিনের বাবা নামে ডাকে।
এবার মানুষটা সচকিত হয়। রাস্তার মাঝখানেই লাফাতে বলে “বাঁচার মত বাঁচতে চাই”
ভিড়ের মধ্য থেকে কেউ একজন বলে “ কম্যুনিষ্ট না কি”?
কোথায় যেন কী ঘটে যায়। হাজারটা পারমানবিক বোমার যেন বিস্ফোরণ ঘটে। মানুষটা বুক টান করে সোজা হয়ে দাঁড়ায়। শব্দটা যেদিক থেকে এসেছিল সেদিকে মুখ ঘুরিয়ে বলে
“তুই কুত্তার বাচ্চা”
তারপর মানুষটা সোজা সামনে দৌঁড় লাগায়।
সামনের দিক থেকে পোশাক শিল্প শ্রমিদের বেতন বাড়ানোর দাবিতে একটা মিছিল আসছিল মানুষটা সেই মিছিলে মিশে যায় অথবা হারিয়ে যায়।
তারপর ইলেকট্রিক বিল জমা দিতে যাবো। আমার দেরি হবে আসতে। স্বামী অমর বলে, ঠিক আছে।…..
নভেম্বর চলছে। অনির সাথে আজ দেখা হবে তা জানাই ছিল। এই তো ক’দিন আগেই দেখা…..
বুড়িমাসি বলেন,জীবনটা বালির ঘর গো।ঢেউ এলে ধুয়ে যায় জীবনের মায়া।তবু বড় ভালবাসা ওদের দাম্পত্যে।রোদের চাদরের…..
এক ড্রইং রুমে বসে রয়েছে সদ্য কিশোর উত্তীর্ণ তরুণ গোয়েন্দা সজীব। সামনের টেবিলে ছড়িয়ে…..