দাউদ হায়দার একজন বাংলাদেশী বাঙালি কবি, লেখক ও সাংবাদিক। তিননি ১৯৭৪ খ্রিস্টাব্দে বাংলাদেশ থেকে নির্বাসনের পর বর্তমানে জার্মানির বার্লিনে নির্বাসিত জীবন যাপন করছেন। তিনি দীর্ঘদিন ব্রডকাস্টিং সাংবাদিকতাও করেছেন। তিনি একজন আধুনিক কবি। তাঁকে সত্তর দশকের অন্যতম বিপ্লবী কবিও বলা হয়। তাঁর একটি বিখ্যাত কাব্যের নাম ‘জন্মই আমার আজন্ম পাপ‘। একইনামে তাঁর একটি কাব্যগ্রন্থও রয়েছে। যে গ্রন্থটি কবি দাউদ হায়দারের অনুমতিক্রমে অংশুমালীর পাঠকদের উদ্দেশে এখানে দেয়া হলো।
– জোবায়েন সন্ধি, প্রধান সম্পাদক ও প্রকাশক
অতন্দ্রিলা, তুই আমার কাছে থাক
(অতন্দ্রিলা, তুমি ঘমোওনি জানি/অমিয় চক্ৰব্রতী)
অতন্দ্রিলা; তুই এলি কেন, বরং চলে যা
দুঃখের নদীতে দ্যাখ গিয়ে পড়ে আছে আমার দুঃখপূর্ণ ভেলা
আমাকে আজ ঘুমোতে দে তুই
স্বচ্ছ আকাশে যন্ত্রণার ঝাপসা মায়া বাঁধলো কেনো ঘর
তুই জিজ্ঞেস কর বাতাস সাক্ষী হবে বকে রাধ কঠিন সাহস
তোর শরীরে আজ দেখি নিসর্গের আদি শোভা
আশ্চর্য হাওয়ায় তুই চুলগুলি উড়িয়ে এলি এতক্ষণ
হঠাৎ আনন্দ তোর বেজে ওঠে গুপ্ত সরোবরে
করোটি বিহীন শীতল অন্ধকার আসছে ওই
আলোটা জ্বালা
নিজস্ব সংসারে আমি ফিরে যাবো
তুই আজ যা অতন্দ্রিলা
তোর ছায়া ভীষণ ভয় লাগে; তবু তোর চোখ দুটো আমার চোখে
মারবেলের মতো জ্বলজ্বল করে
তোর হাঁটার শব্দে আমার ব্যাকুলতা বাড়ে—
বাসন্তী কাপড়ে তুই এসেছিস তব আমার চোখে ঘন্ত্রণা
আমার দুঃখের ভাগী হ’ এইবেলা
আমি কিছু স্বচ্ছ দেখি পৃথিবী তোকে
জননীর মতো হাতটা রাখ কপালে
দুঃখ আর দুশ্চিন্তায় মাথাটা ক্যামোন গরম দ্যাখ
জানালাটা বন্ধ কর সেই সাথে
অতীন্দ্রলা; তুই আজ আমার কাছে থাক
২৩/৯/৭০
অন্তর্গত উজ্জ্বল বিষাদ
(কবিরুল ইসলাম-কে)
যায় যায় সবই যায় নদীর কোঁকড়ানো ঢেউ ভাঙতে ভাঙতে যায়
হালকা হাওয়া নাচতে নাচতে যায় রমণীর নক্সী আঁচল উড়তে উড়তে যায়
পুরুষের দল হাঁটতে হাঁটতে যায় বহমান জনতার হাটে যায়; যায় যায়
যায় যায় সবই যায় খড়কুটো কবিতার শরীর ভেসে যায়
যায় যায় সবই যায় আমি এক পড়ে থাকি শুকনো শান্ত নদীর জলে পড়ে থাকি
অর্ধ-ডুবন্ত অৰ্ধ-জাগা পাশ ভাঙা খালি নৌকার মতো পড়ে থাকি
স্মৃতিরা ভীড় করে আসে আর সব যায় লালনীল নিশান উড়িয়ে যায়
মাছে শামুকের শুয়ে থাকে আমার পাঁজরায় আর সব যায়
আমি এক আর সব যায়; যায় ভালবাসার সরল হাত ধরে চলে যায়
নিপুণ সিম্ফনি বাজাতে বাজাতে যায়
উজ্জ্বল আলোর মেলায় যায় অন্তর্গত কান্নার ধ্বনি রেখে যায়
যায় যায় সবই যায়!
অলৌকিক বিকেল
কোঁকড়ানো চুলের মতো নদীর ঢেউ দেখে
তুমি বললে
সবুজ নিসর্গের দিকে তাকিয়ে দ্যাখো
একজন কামুক ক্যামোন উড়াচ্ছে কার
বেনারসী অঁচল।
আমার সুনীল মাংসে বাতাস খেলছে প্রবল
খোঁপার গোলাপ এই বিকেলে পড়ে যাবে অনায়াসে
হাত রাখো
বুকের নিবিড় গম্বুজে
ঢেউ তুলি শরীরে।
আমি বললুম—
তারপর স্নান করবো কোঁকড়ানো চুলের মতো
নদীর ঢেউ-এর জলে।
৪/৫/৭২
আন্দোলন; বারবার ফিরে আসে বাংলাদেশে যুদ্ধের বেশে
বাংলাদেশ কি আসলেই শোকের দুঃখের না যুদ্ধের?
তাহলে আমার মা কোথায়
কোথায় বর্ষিয়ান পিতা
আমার মেয়ে
গর্ভিণী স্ত্রী
ভিটে ঘর-বাড়ি
বলতে পারেন বাংলার সাড়ে সাত কোটি মানুষ?
হাঁ আমি জানি, আপনার পারবেন
পারবেন ভেজা-ভেজা কন্ঠে
চোখে জড়িয়ে রুমাল একজন যথার্থ প্রেমিকের মতো
মাটিতে পা ঠেকিয়ে
ঠায় রোদ্দুরে কিংবা প্রবল বর্ষণে
হাঁ, আপনারা পারবেন : পারবেন…
আমার মা; সেই মা
যে আমাকে না খেয়ে কোলে পিঠে মানুষ করেছেন
চোখের আড়াল হলেই তন্নতন্ন কোরে খুঁজেছেন
রোদ বৃষ্টিতে আঁচলে ঢেকেছেন
গেয়েছেন ঘুম পাড়ানিয়া
পরম আদরে চুমু দিয়েছেন সকাল বিকাল
পাঠিয়েছেন হাত পা ধুইয়ে
আঁচড়িয়ে চুল
আয়নায় দেখিয়ে মুখ
খেলার সাথীদের কাছে
সেই মা; যে আমার আবদারে বিরক্ত হয়নি কখনো
বরং কপালে মাথায় আশীর্বাদের হাত রেখে বুঝিয়েছেন ময়নার মতোন
সেই মা এখন কোথায়
যিনি রাত্রিকালে ঘুমিয়ে পড়ার আগে দেখে যেতেন পুনরায়?
পিতা, সেই বর্ষিয়ান পিতা?
যে আমাকে কাঁধে নিয়ে ঘুরতেন এমেলা ওমেলায়
কিনে দিতেন টিনের বাঁশি কাঠের ঘোড়া লাটাই সুতো
রঙীন ঘুড়ি
আমার ইচ্ছেমতো পোষাক-আশাক!
বোঝাতেন খেলাচ্ছলে সংসারের ঝামেলা
বিশাল জমিজমার টুকরো টুকরো নথিপত্র
চাইতেন একটা লাল টুকটুকে বৌ-মা
যে তাকে যখন তখন
জায়নামাজ তসবী আর পানের বাসন এগিয়ে দেবে
সহজেই ডাকবে ছেলের চেয়েও গভীর ভালবাসায়
সেই পিতা, যিনি আমাকে নিয়ে স্বপ্নে দেখতেন বিভিন্ন প্রহরে!
তিনি এখন কোথায়?
কোথাইবা আমার সেই পাঁচ বছরের মেয়ে?
যে গলা জড়িয়ে ঘুমিয়ে থাকত
হঠাৎ কোরে ধরতে গেলে দৌড়ে যেত
ভেঁঙচি কাটত হেসে খেলে
দোলায় চেপে হারিয়ে যেত সাতসমুদ্দুর তেরনদী
অফিস গেলে বায়না ধরতো পতুল আনতে
বিয়ে দিতো যখন তখন ছেলে মেয়ের
বাইরে থেকে ফিরে এলেই হাত রাখত পকেট মাঝে
লজেঞ্চুষের থলি পেলেই চুমু দিতো ঠোঁটের উপর
মাদুর পেতে খেতে গেলেই ঠাঁই নিতে সে মধ্যিখানে
সেই মেয়েটি কোথায় গেল?
কোথায় গেল গর্ভিণী সেই স্ত্রী বা?
এক পা হাঁটতে গেলেই পেটের ব্যাথায় পড়ে যেত
খাটের উপর শুয়ে থাকত অতিকষ্টে
ঘর গোছাতে মন বসেনা
বাটনা বাটে পাড়ার লোকে
চেয়ে থাকত একটি সময়
কেমন করে জন্ম নেবে একটি ছেলে—
বাংলাদেশে!
সবতো আমার চলেই গেলো
কোথায় থাকি এখন আমি
ঘর-বাড়ি তো পুড়েই গেছে
পোড়া ভিটেয় গাছ হয়েছে হাজার রকম
হাঁটতে গেলেও ভয় লাগে যে
পায়ে বাধে মেয়ের শরীর পিতার হাত মায়ের চুল
ছিদ্র করা গর্ভিণী এক স্ত্রীর বুক
এদিকে আবার হঠাৎ কোরে কানের মধ্যে ঢুকেও পড়ে
“দাঁড়াও তুমি—
বাংলাদেশে যুদ্ধ আসে এমনি কোরেই
পরক্ষণেই জিতে যাবে অনায়াসে
আমরা জানি; তুমিও জানো!”
৮/১০/৭১
আমরা যেন খাঁচায় পোষা পাখী
আমরা যেন খাঁচায় পোষা পাখী
যা বলো তাই শুনি তোমার কথা
দ্বিরুক্তি নেই, হাতে বাধছো রাখী
বুকের মাঝে শুধু অনল ব্যথা
আকাশে আজ ঘন মেঘের খেলা
বাতাসে ওই হাহাকারের সুর
ক্ষুধা পেটেই খাঁচায় কাটে বেলা
চালের আড়ত বুঝি অনেক দূর!
একি খেলা খেলা খেলছো মহাজন—
খাঁচা থেকে উধাও হলে আমি
পেয়েই যাবো গভীর ঘন বন
তখন কি আর তোমার ডাকে থামি !
২৩/৮/৭৩
আমাদের সফলতা, মৃত্যু
আবার চিৎকার শোনা গেল, শূন্যমার্গে চাঁদ হাওয়ার রাত হাসপাতালের
করিডোর নার্স স্যালাইন ছুরি
–তার মধ্যে আমি
উৎকন্ঠায় ইতঃস্তত ঘুরছি
তীক্ষ্ম আলোর ফোয়ারাগুলো আমার চোখের সামনে মধ্যপ্রাচ্যের যুদ্ধের
অবসানের মতো স্বপ্ন হয়ে দুলছিল
ব্যথা অস্থির স্ত্রী নতুন সময়ের কোলাহল পৃথিবীর উন্মত্ততা
সন্তানের জন্ম—অর্থাৎ,
প্রবল আনন্দ ঘিরে ধরল আমাকে
—ভোর পাঁচটায়
আমি বিশাল আকাংক্ষা নিয়ে ক্লান্তি কপালের ঘাম
সব মুছে ফেললাম—
ছিঁড়ে গেছে ঘুম, মসজিদের মিনার থেকে মুয়াজ্জিনের গাঢ় বেদনার
মতে সঙ্গীত সমস্ত নিস্তব্ধতার ছুটি দিল—
রক্তের ভেতর থেকে, দ্বৈত প্রশ্রয়ে যাহার জন্ম হলো আজি—
নিবিড় পিপাসার মতো ঘ্রাণ এসে
নাকের উপর রয়ে গেল
তারপর;–তারপর
সন্দেহ চিন্তা ঘন অন্ধকার, সভ্যতরে বিপুল গ্রন্থিতে দেখলাম
সমস্ত আয়োজন স্বপ্ন ও প্রতীক্ষা সাধনা ও সৌরভ
করতলে এক বিষাদের দীঘ ছায়া ঘিরিতেছে তখন।
কান্নায় বুক ভেঙে আসে, নবজাতকের ওষুধ খাদ্য সব বাজার থেকে উধাও
আমাদের রক্তের সফলতা প্রশ্রয় আনন্দ ও প্রার্থনার সাথে
একটি জন্ম-মৃত্যুর ঘন্টাধ্বনি শোনা গেল!
এখন পৃথিবীর সব নগর বন্দরে এক বিমৰ্ষ আঁধার এসে বাঁধিতেছে ঘর
হায় বাঁধিতেছে ঘর!
১৮/১০/৭৪
আমার পিতাকে
মুমূর্ষু পিতার সংসারে আমি এক নির্বোধ বালক
যেন। আমাকে দিয়ে কিছুই হবেনা কোন কালেই; জানেন
তিনিই শুধু। যার কোলে-পিঠে মানুষ আজীবন; তিনি এই পৃথিবী-লোক
ছেড়ে এখন কোথায় যে ছিটকে পড়ে আছেন
তা বলতেও পারিনা সহসা ৷ অথচ বাড়িতে তাকে
নিয়ে আমাদের ভাবনার অন্ত নেই। এদিকে গতায়ু হবেন
যিনি আজকাল কিংবা মাসাধিকাল পরে; আপাততঃ তাকে
নিয়ে কেউ-ই ঘামায় না মাথা। বুড়োটে শরীর তার
ভীষণ উত্তেজিত হাতের তুড়িতে একদা নিমেষে উধাও হতো সব। তিনি
আজ বিছানায় একা একা শায়ে ভাবেন আল্লার
আরশ। মুমূর্ষু পিতার সংসারে আমিই বড় ছেলে। সব দায়িত্ব আমাকে
কাঁধে তুলে দিয়ে ধুঁকে ধুঁকে মরে পালাতে চান যিনি
তাকেই বাঁচাতে চাই আপ্রাণ চেষ্টায়; আমার পিতাকে।
৮/৯/৭০
আমার ভালবাসা
(বিষ্ণু দে; শ্রদ্ধাস্পদেষু)
আমার উজ্জ্বল ভালবাসায় অবশেষে আপনাকেই জড়িয়েছি।
চৈতন্যের নির্জন প্রকোষ্ঠে যখন নিহত মানুষের ঘণ্টাধ্বনি বাজে –
পুনর্বার ফিরে যাই আপনার কবিতায়। কি পেয়েছি
বলতে চান? গোল চাঁদের স্নিগ্ধতায় বৃক্ষের সজীবতায় নক্ষত্রের নিপুণ
কারুকাজে
আমার ব্যাকুল যৌবন বাধা পড়েছে; য্যানো মধ্যরাতে রাজার দুলালী তার
সমস্ত অন্তর্বাস খুলে দেয়–দাঁড়ায় শস্যহীন দগ্ধপ্রান্তরে!
কুয়াশার পাংশুপটে যে বালক মিশে গেছে; তাকে আমার
কুশল বলিনি কখনো। নষ্ট মৃত্তিকার সোণামণি; যার শরীরে
বারুদের প্রবল ঘ্ৰাণ পাওয়া যাবে; তাকেও ভালবাসা আশীর্বাদ
দেইনি। সম্পন্ন প্রেমিকের মতো সকল অস্থিরতা পলাতক। ভীষণ আঁধারে
নীলাভ বাহু, নেচেছে দিনরাত। কোথাও পারিনি যেতে। সম্রাটের নিখাদ
আত্মহত্যা অর্থাৎ আমাকে দিয়েছে প্রাণ। সন্ন্যাসীর মতো ঘরে বসে তারে
আমি খুঁজি; খুঁজি এখানে ওখানে; মানুষের সরলতা শান্তি প্রেম
মমতা অপার বিশ্বাসে
পাওয়া যাবে? আমিতো সঠিক পেয়েছি আমার আত্মীয়ের হৃদয়ে!
বিশাল বিষাদ নেই; য্যানো এক মহান প্রেমিক আমাদের আশেপাশে
ঘুরছেন অলৌকিক ক্রাচে-নিজস্ব ভঙ্গিতে। বিষণ্ণ প্রাঙ্গণ এখন হয়ে
যাচ্ছে সবুজ শ্যামল–শ্যামলতায় ঢাকছে গৃহাঙ্গন; হলদে তজনী খেলে
বুকের নিভাঁজ অঙ্গনে। আমার লোকালয় বহুদূরে; শহরতলীর শেষ
প্রান্তে। তব, আমি বৃষ্টির মতোন সঙ্গীহীন চলে আসি; ফেলে
আসি বিধ্বস্ত জনপদ। হাঁটতে হাঁটতে মনে হয়; এইতো বেশ
চলেছেন আজীবন সঙ্গী আমার! মাঝে মাঝে বড় বেশী খেয়ালী;
বুঝি তাই
টেনে নেই বূকের গভীরে। আমার ভালবাসা
শুধুমাত্র স্মৃতি সত্তায় নয়; সমগ্র নিবিড়তায়। এখন যেখানেই যাই
সঙ্গে যায় মহান প্রেমিক–তাকে বলি “তুমিই আমার জীবন; তুমিই
আমার আশা”
২৫/৩/৭২
আমার স্ত্রীর প্রতি
রাগে আমার সর্বাঙ্গ জ্বলে নরকের আগুনের মতো
অথচ স্ত্রী আমার ভয় করে না বরং হেসেই কুটি কুটি
রাগে আমার শরীর কাঁপে কাঁপে পৃথিবী : ইচ্ছে হয় যতো
খুশী শাসিয়ে পাঠাঁই অনন্ত; চুলের ঝুটি
ধোরে। রাগে আমার কান্না আসে। চোখে দেখি শর্ষের ফুল—
যেন পা মাটিতেই চায়না পড়তে; মাথার সমস্ত চুল
যদি শূন্যেও ছুঁড়ে মারি; তবু আমার পড়েনা বিষণ্ণ
রাগ। সংসারে ছড়িয়ে বিষাদ কোন ফলই হয়না কখনো—
সে যতই দেইনা কেন মহাজনের প্রচন্ড হাঁক; জানি আদিকাল থেকে
যখনি মিছিলে সংগ্রামের ঢেউ; ঠিক তখনি আমি আদিগন্ত
সবুজ মাঠে লাউডস্পিকারে ফাটিয়ে গল ফিরেছি ঘরে;–সময় মতো!
রাগে আমার দাঁত কাঁপে; তব কাউকে পাইন ডেকে
স্ত্রী আমার শাড়ির আঁচলে মুখ রাখে। বোঝাই কতো
তবু বোঝেনা। অবশেষে দেখাই রাগ আসবাবপত্রে বাসন কোসনে
আমাকে দেখে কেউই ভয় করে না; শুধু বিড়ালগুলো পালায় গৃহকোণে।
৬/৬/৬৯
আমি তো প্রেমিক নই
আমিতো প্রেমিক নই, তবু, ক্যানো এ বসন্ত আমাকে পাগল করে!
ছায়া-ছায়া অন্ধকার সকালে নিসর্গ বাহু, মেলে
নিমেষে উধাও হয় আদিম শোভা
উজ্জ্বল প্রেমের মতো সমস্ত রঙীন দৃশ্যাবলী হঠাৎ দাঁড়ায় এসে
আমার সামনে!
এখন রাত্রিদিন বাতাস খেলা করে নিরিবিলি
নদীতে পালতোলা নৌকায় সর্বত্র অন্তরঙ্গ নর্তকীর মতোন গাছেরর
সবুজ পাতা
পায়ে পায়ে ছড়ার আশীর্বাদ মাঠে প্রান্তরে
ফাল্গুন আকাশের চাঁদ জলের নিকানো আঙিনায় পাতে নিবিড় সংসার
নিঃসঙ্গ গাছের ছায়া এলিয়ে সমস্ত শরীর শুয়ে থাকে একাকী;
এবং আমার তরুণ আঙুল
সরোদের আচ্ছন্ন হৃদয় ঘেঁষে যায়; কেঁপে ওঠে পুরোনো শহর
বস্তী গ্রাম
ঝেড়ে ফেলে নিজস্ব পোশাক মাটিতে ঘাসের ছিন্ন মেঝেয়
আমিতো প্রেমিক নই, তবু, ক্যানো আমার চোখোর নন্দন-কানন
মারবেলের বেঞ্চ, পাতা ঝরা, ফুল ফোটার অলৌকিক শব্দ?—কিছুরই
বুঝিনা—বুঝিনা হায় বিশেষত এবয়সে!
তবুও এখন আমার সর্বাঙ্গে বসন্তের জোৎসনা মাখা রমণীয় সন্ধ্যাগুলো
লেপটে আছে প্রত্যহ!
১৪/৫/৭০
আমি ভাল আছি, তোমরা?
আমি ভালো আছি, তোমরা? –কি করছে। এই অবেলায়?
—একটি বালক খেলছে দ্যাখো বিমর্ষ ওই একলা হাওয়ায়!
চুলগুলো তার কাটছে স্মৃতি ভ্রান্তি ও ভুল দিবানিশি
মত্ত মেয়ে বুকের কাছে তবু তাহার দুঃখ বেশী!
কি দুঃখ?–বলতে মানা নানান কথাই হবে জানা রৌদ্রে কিংবা অন্ধকারে
ছিলেম ভালো ঢাকার আলোয় মেয়ের সাথে পার্কে এবং অভিসারে
এখন আমার দুঃখ অনেক কিন্তু আমি ভালো আছি তোমরা কেমন?
—ভালো থাকলেই ভালো কথা, ভালো কথায় খুশি থাকে প্রেমিক যেমন!
২৬/৬/৭৪
আমিও শহীদ হয়ে যাবো
পুনরায় কোন মহান গণ আন্দোলন শুরু হলে
আমিও আসাদের মতো
শহীদ হয়ে
তোমাদের স্মৃতির মণিকোঠায
জ্বেলে রাখবো অলৌকিক শহীদ উজ্জ্বল বাতি!
তুমি বাতি দেখে একদা ভীষণ ভয় করতে–
আলোয় তোমার মুখ দেখা যায় বলে
কেবলি আঁধারে মুখ রাখতে—
মুখ ঢাকতে ঢাকতে এখন
তোমার চেহারায় কালো দাগ
আমি বারবার তোমার মুখের কালো দাগ মুছে দিতে চেয়েছি
তুমি মুখ লুকিয়ে রাখো–
পাছে মুখের সঠিক কারুকাজ ধরা পড়ে যায়!
আমি আঁধার থেকে আলোয় আসতে চাই
তুমি তোমার বাহু দিয়ে শরীর জড়িয়ে রাখো
মিছিলে রক্তের খেলা হয় বলে!
আমি খেলতে খেলতে বাঁচতে চাই
বাঁচতে বাঁচতে মরতে চাই
মরতে মরতে তোমার বুকে
উজল করে লিখে যাবে।
এইতো আমি শহীদ হলাম
শহীদ হলাম
তোমার বকেই শহীদ হলাম!
৬/২/৭৩
আলোর গভীরে
আলোর গভীরে কেউ কেউ অনায়াসে যেতে পারে। যায়।
মিছিলে হঠাৎ শ্লোগান দিয়ে অনেকেই নেতা হবে। হোক।
আমাদের আঙিনায় ভালবাসা পলাতক আজীবন। জেনেছি।
ঘরে অলিন্দে বিভিন্ন সমস্যা চোখের সামনে ঠায় দাঁড়িয়ে। কিছুই
করার নেই।
এইসব লিখিত অলিখিত পব্দাবলী খেলেছে নিরবধি
দেখছি
এবং
শুনছি
শুনছি এবং দেখছি আমার শৈশব থেকে।
এ কথাগুলো শুনতে যেন কেমন লাগে। তাইনা? ঠিকই।
।২।
আমার একজন বন্ধু, ছিলেন। তিনি রাসেল।
এখন ঈশ্বরের রাজ্যে নতুন কোরে নথিপত্র দেখছেন।
সৃষ্টির প্রথমেই ঈশ্বর এক বিরাট ভুল কোরেছেন। অথাৎ মানুষ
এখন অনেক সময় নিয়ে তা আবার দেখতে হবে। দেখা উচিৎ।
এখন নদী হচ্ছে রক্তের
দেশ হচ্ছে যুদ্ধের
মানুষ হচ্ছে হিংস্র
পশু হচ্ছে ভদ্র
।৩।
বর্তমানে নতুন চালে সবাই খেলতে চায়। খেলে।
পকেট ভর্ত্তি কড়কড়ে নোট লুকিয়ে রেখে সৃষ্টি করে দুর্ভিক্ষ।
এদিকে তাই নিঃস্ব হচ্ছি রাত্রিদিন।
এখন তবে যাত্রা কোথায়? জানা নেই।
।৪।
মেয়েটা যাকে ভালবেসে বিয়ে করতে চেয়েছিল : করতে দিন
বাঁধা দেবেন না।
নইলে মনে একটা দুঃখ থেকে যাবে।
আমার চোখের দিকে যদি কেউ চেয়ে বলে—
তোমার চোখের মধ্যে কে?
আমি বলব—
তুমি|
এই উত্তরে যথার্থ কোন কাজ দেবে না। না দিক।
তবু, তার আনন্দেই আমার আনন্দ!
।৫।
আমরা সবাই আলোর গভীরে যেতে চাই
যেতে চাই উজিয়ে সকল বাধা
পেতে চাই কবিতা ও মানুষের ভালবাসা। তাই না? হাঁ!
২৫/৭/৭০
একটি নিষিদ্ধ কবিতা
গোল চাঁদের শেষ ঘণ্টাধ্বনি বেজে গেলে আমি পুনরায় বাড়ি থেকে
বেরুলাম
সকালের নিপুণ করতালিতে সুন্দর বনরাজি শিউরে উঠলো তুমুল
প্রেম-প্রেম খেলায় অন্ধকার নিবাসগুলো মেতেছিল বহুক্ষণ;-ভেঙে গেল
হঠাৎ
না আমাকে দেখে নয়; তাহলে কার অভিসম্পাতে? সঠিক জানিনা–
কিংবা এও হতে পারে আমারি বদৌলতে!
গোল চাঁদের শেষ ঘন্টাধ্বনি বেজে গেলে আমি দেখলুম; হৈহৈ করতে করতে
একদল রমণীও পুরুষ মিলিত রক্তের স্রোতের মধ্যে থেকে উঠে এল পরস্পর
বাতাস ছিলোনা তখন; সবেমাত্র আঁধার গিয়েছে ছিঁড়ে কিশোরীর
পাজামার গিঁটের মতোন
তারপর খুলে গেল সেই একল। কপাট!
যে রমণী ও পুরুষগুলো দেখলুম; আমাকে দেখেই তারা বলে উঠল—
‘তাহলে তুমিই সেই। প্রত্যহ ভোরে এসে দেখে যাও আমাদের লীলা-খেলা!
কেন সাথী হতে পারো না?
দাঁড়াও দেখাচ্ছি মজা; তোমার চৌদ্দপুরুষ উদ্ধার করবো এই প্রাতে
ফেরেশতা সেজে এই ভুবনে?
শালা শুয়োরের বাচ্চা; কোথায় যাও হে?
আমরাই পাপীরে হারামজাদা?
তাহলে তুমি কি হে?
যখন শালা তুমি হেঁটে যাও ওই বিভিন্ন লোকালয় ধরে: আমরা বলি–
“দ্যখি ওই যে যায়; যায়, যায় মহেন্দুনিদ্রিতকান্তি; শুভ্রবসন
মাথায় পাগড়ি; অলৌকিক পোশাক-আশাক; আননে কি রাপের মায়া
দেখলেই শ্রদ্ধা হয়
আর এখন তুমি ঈশ্বর নামক বদমাসের একান্ত অনুচর হয়ে আমাদের কাছে?
দেখাচ্ছি দাঁড়াও; একদিনে কয় বৎসর পাওনি তো টের—
হাজার জলপানি খেয়ে আমরাও হয়েছি মানুষ; ইকড়ি-মিকড়ি খেলায়
আমরাই এতদিন ছিলেম বলে লোকে দুর্নাম দিতো—
তুমি কি শৈশবে একবারও এক্কাদোক্কায় হেরে গিয়ে টাননি বাসন্তীর
সূক্ষ্ম অন্তর্বাস?
ওই সবদিনে ঘুমের ভান করে রাত্রিকালে কি করেছিস ঠিক কোরে বল্;
নইলে—
নইলে এক্ষুণি প্রস্রাবে ভরে দেব তোর মুখ; জুয়োচ্চোর ফেরেশতা সেজে
এই ভুবনে?—বলে
লোকগুলো নিয়ে গেল বিশ বছরের রমণীদের কাছে
দেখলাম; সেই রমণীবৃন্দ সমস্ত পোশাক খুলে; উন্নত বক্ষে দাঁড়িয়ে
হা হা করে হাসছে
আমি তখন মৃতপ্রায় মানুষের মতো আল্লাহ’র কাছে প্রার্থনা করলুম
“আল্লাহ; আমার প্রার্থনা কবলে করো; আমি যেন রোজ ভোর বেলা
এইভাবে আসি
আর এইভাবেই তোমার অপূর্ব হস্তের কারুকাজ দেখে যাই—
হে আমার দয়াময়
তোমার এমন শিল্পকর্ম এতো আমি দেখিনি আগে?”
২৮/৯/৭২
একটি বালক
আপন শিউলী বাগান নীলিমার মতো
লজ্জায় গ্রীবা রাখে সবুজ করতলে—
পরিশ্রান্ত প্রেমিক উদ্ভ্ৰান্ত সকল খেলায়; যতো
বার বলেছি তাকে মুখ রাখে কঠিন জলে!
তাহলে কোথায় যাবে এই অবেলায়?
হিরন্ময় কন্ঠের ভাঁজে বিষন্নতার ঘ্রাণ—
আষাঢ়ে মেঘের স্বর পলাতক বহুদিন; দিনরাত্রি হেঁকে যায়
একটি বালক, “এখানে কি পাওয়া যাবে জন্মের গান”?
২৫/৯/৭০
একটি ভালবাসার মুখ
বরং আরো কিছুক্ষণ এক বুক অন্ধকারে হাত দুটো রাখতে দাও
পেতে দাও ঈশ্বরের অনাবিল শান্তি
এসেছি যোজন পথ পাড়ি দিয়ে মাড়িয়ে খড়কুটে শক্ত পাথর
বড় অসহায় ক্লান্ত আমি
য্যানো অনেক অনেক দিন সুখের মুখ দেখিনি
দেখিনি আত্মীয় স্বজন, পাইনি নিবিড় সান্নিধ্য তাঁর
শুধু চোখের সামনে সারি সারি তৃষ্ণার্ত মুখের মিছিল—বলে
উন্মাদ লোকটি ম্রিয়মান ঘাসের উপর এলিয়ে সমস্ত শরীর তাকালো শূন্যে
পরম কৌতুহলী দৃষ্টিতে
নরম ফুরফুরে বাতাসে মাথার ঝাঁকড়া উস্কোখুস্কো চুলগুলো বড়বেশী
ব্যস্ত হলো বাতাসের অন্তরঙ্গ নর্তকীর মতোন
আমি সামনে দাঁড়িয়ে অবাক দটিতে গালে হাত দিয়ে
দেখছি তার নিপুণ কলা কৌশল; বলার ভঙ্গি–
সহসা সমস্ত বিস্ময় চুরমার হলো
প্রচণ্ড হাওয়ায় ট্রাউজারের পকেটে পয়সার মিউজিক বেজে গেল
অন্ধকার চারদিকে, বড় বেশী মেতেছে খেলায়; নিজেরাই খেলছেতো
খেলছেই—
লোকটি উঠে দাঁড়ালো আবার; বললে
আমার চোখ দুটো কেড়ে নিয়ে হাত দুটো সরিয়ে নাও
সহ্য হয়না এখন, সহ্য হয়না কোন কিছুই
এমন কি আজন্ম সাধের বাসন্তীকেও
ওই যে আমার রঙীন স্বপ্ন গলে এখন আর তীর্থ করেনা তার ত্রিসীমানা
কৈশোরের প্রেমগুলো ধুঁকে ধুঁকে মরছে, মরছে সবখানে
আমাকে এখন কেউ ভালবাসেনা, কাছে টানেনা, মাথায় চুলে হাত বুলোয় না
তুমি দয়া করে, দয়া করে সখা হে
যদি পারো এনে দাও একটি ভালবাসার মুখ
একটি ভালবাসার মুখ।
য্যানো বা তার কথাগুলো ঠিক তক্ষুণি শহরের বিষণ্ণ মনুমেন্ট ছুঁয়ে ছুঁয়ে
নিমেষে উধাও হলো দৃশ্যের গভীরে
বিহ্বল চেয়ে দেখি ওই অন্ধকারেই মারবেলের মতো
জ্বলজ্বল করছে তার উজ্জ্বল চোখ দুটো!
১৮/৯/৬৯
একটি যথার্থ ভালবাসা
এইভাবে তুমিও পরস্পর কথা রেখে উঠে যাবে আসল গন্তব্যে
চলে যাবে নিসর্গ বিলাসীর কাছে; পড়ে থাকবে ম্ৰিয়মান ঘাস
ঘাসের ছিন্ন মেঝেয় ইচ্ছাকৃত স্মৃতি;–
অতঃপর চেয়ে থাকবো আজীবন
ভাসবে অতীত দৃশ্যাবলী; একদা
যেমন মুখোমুখী চেয়েছিলে সুসময়ে
পুনরায় হয়তোবা পেয়ে যাবো সোনালী ভবিষ্যৎ; অভ্যাস মতো
পাঠাব ‘তারার গোলাপ’; তোমার খোঁপার জন্যে—তুমি দেবে
একটি যথার্থ ভালবাসা
ঠাঁই নেবে হৃদয়ের সূক্ষ্মতন্ত্রীতে—
এই আশায়
অনায়াসে চলে যাচ্ছো রান্ত্রির নির্জন ট্রেনে : একটি বর্ণনাহীন পাড়াগাঁয়ে
বাতাস তোমাকে আশ্রয় দেবে; ছায়া আমার ঘুরে বেড়াবে চতুর্পাশে
ক্যামোন অসহায়; য্যানো
দীঘকাল শুয়ে আছি নিরবধি অন্ধকারে
একটি যথার্থ ভালবাসা পাবো বলে!
৬/৩/৭২
একদিন আমারো প্রেমিকা ছিলো
একদিন আমারো প্রেমিকা ছিলো
একদিন আমিও খুশিনীল স্বপ্নের শূন্যতায় উচ্চারণ করেছিলাম
পৃথিবীর সব মানুষের আনন্দ-হাসির মত্ততা!
আজ আমি এই মধ্যরাতে বিপুল সিগ্রেট জ্বালিয়ে
হুলুস্থূল সফরী ধোঁয়ায় নিজেকে দেখলাম; বড় বেশী একা, একলা—
আত্মঅহংকার যার কবিত্বের মধ্যে বন্দী; অথাৎ দুই চোখের মাঝখানে
আরেকটি চোখ এসে হয়ে গেছে তৃতীয় নয়ন!
আমি এখন তাঁর নামে একটি কবিতা লিখে বিশ্ব বাজারে
রপ্তানী করে দেব
কেননা, বিমর্ষ হাওয়া জানে কোথায় লুকোবে অধিকার মানুষের ঘ্রাণ
ব্যবহৃত সবুজ রুমাল!
একদিন আমারো প্রেমিক ছিলো
একদিন আমিও খুশিনীল স্বপ্নের শূন্যতায় উচ্চারণ করেছিলাম
শিল্পসম্মত মানুষের আনন্দ-হাসির মত্ততা!
১৩/৮/৭৪
একদিন কেউ কাউকে চিনবে না
(মেহবুবা শিরীন-কে)
সবই চলে যায় সবই চলে যাবে একদিন
তবু কেউ কারও মুখ দেখবোনা সঠিক
অস্পষ্ট ভালবাসা বরং থেকে যাবে ইতস্ততঃ
আজীবন ইচ্ছেগুলো ভেসে যাবে বাতাসে নীলিমায়
চোখে চোখে চোখ রাখলে কেউ কাউকে চিনবো না
ভুল কোরে পাশাপাশি হেঁটে গেলে কেউ কাউকে দেখবো না –
একদিন শরীরে শরীরে মিশে যাবো
একদিন জীবন সংগ্রাম থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবো
একদিন মিছিল থেকে চলে যাবো মরণ ভবনে
একদিন ডেকে ডেকে চলে যাবে অলীক ঠিকানায়
একদিন নির্ভুল নিয়মে দাঁড়াবো মুখোমুখী
একদিন আমি তুমি চলে যাবো কালের আঙিনায়
একদিন তবু কেউ কাউকে চিনবো না!
৭/৩/৭০
একলা হাতে
চাঁদ খসে পড়ল নষ্ট আকাশের বুক থেকে–
তারার মিউজিয়ম দুয়ার খুলে চকচক করে উঠল পুনরায়
আমি এক দাঁড়িয়ে; চাল উড়ে যাওয়া ভাঙা ঘরের মেঝেয়—
একল হাতে
পেছনে নটীর ছবিওলা আয়না
দেখলাম আয়নায় চাঁদের শরীর বিধ্বস্ত
নিসর্গের গাছপালা বেশ্যার মতো অদূরে দাঁড়িয়ে হাতছানি দিচ্ছে
আমায়
আমার শুদ্ধ প্রেম হঠাৎ তোমার হৃদয় থেকে ঝরে গেল।
আমি এখন সেই প্রেম এখানে ওখানে খুঁজি—
দেখি; আমার বুকের মধ্যে বসে কে যেন সেই প্রেমে
একাগ্রচিত্তে
সুন্দর করে আগুন লাগাচ্ছে ভীষণ; দ্রুত–
একলা হাতে!
২৯/২/৭৩
কবিতার এলোমেলো ভেলা
আমার বুকে অনেক ক্ষত
তব আমি বিক্ষত নই—
ভরদুপুরে একলা কত
খুঁজে বেড়াই হৃদয়টা কই!
কোথায় গেল এই বেলাতে—
দিন কেটে যায় অলস কাজে
বুকের মাঝে সন্ধ্যা রাতে
বীণার মতো দুঃখ বাজে
দুঃখ আমার ভালবাসা
তারে নিয়েই বেঁচে থাকা
বাঁচার মাঝে সকল আশা
সকাল দুপুর তারই দেখা!
২
চোখের সবুজ পৃথিবীটা নাচে হঠাৎ
রাত্রে
সুন্দরী এক লুকিয়ে থাকে রঙীন সাত
পাত্রে
অলীক প্রেমিক আরাম খোঁজে অন্ধকার
কক্ষে
কালো রঙের ইচ্ছে গুলো লাফায় তার
বক্ষে!
৩
আমি বলি—
অঞ্জলি
সন্ধ্যে হলো
বাইরে চলো
একলা ঘরে
বুকের ‘পরে
কতটুকু পাবে মোরে!
৪
হায়দার
এই দ্বার
আজ কেন রুদ্ধ?
তরুতলে কাছাকাছি
বসে আছি
গৌতম বুদ্ধ!
দিন নেই রাত নেই বসে শুধু ভাবছি
মমতায় ইশারায় চোখ দিয়ে ডাকছি—
কোথা সেই যুদ্ধ?
দেখলাম হায়দার
যুদ্ধই উদ্ধার
উদ্ধারে হয়ে যাবো সুন্দর শুদ্ধ।
[ কবিতাগুলো ‘৬৯ থেকে ৭৪-এ রচিত ]
কার জন্যে ভালবাসা
(রাশিদুল হাসান ও আনোয়ার পাশাকে)
এ বৈশাখে আমি কার জন্যে ভালবাসা রেখে যাবো?
সম্পূর্ণ ধ্বংসের ভিতর থেকে বিশাল ক্ষত এবং দুঃখ নিয়ে সবেমাত্র
বেরিয়ে এসেছি
আমার পেছনে আসছে বেলোয়ারী ঝড়; ভয়াবহ সোনালী বন্যার হাত ধরে
আমি কার জন্যে ভালবাসা রেখে যাবো?
আমার চৌদিকে একদা যে শিল্পসম্মত মানুষগুলো ঘুরতো সর্বদা
ঝলমলে আলোয় হাসি খুশি মুখ রাখতো পরম বিশ্বাসে
হাওয়ায় ফলে তোলা রুমাল উড়িয়ে চলে যেতো দূরে শহরে
গল্প করতো নিসর্গের সবুজ পার্কে; ডাকতো গভীর স্নেহে–
তাদের আমি আজ আর কাউকে দেখিনা
আমি কার জন্যে ভালবাসা রেখে যাবো?
ছিন্নমসুল পাখীর মতো অবিরাম ঘুরছি; নগ্ন পা রাখছি ক্লান্ত
মাটির শরীরে
সবদিকে দুর্ভিক্ষের দারুণ কন্ঠস্বর, দয়ারে অনাথ বালিকার কান্না—
আমি তার মধ্যে হেঁটে যাই; হেঁটে যাই গোপন ভালবাসা বুকে নিয়ে
আমি কার জন্যে এই গোপন ভালবাসা রেখে যাবো—আমার ভালবাসা?
২/১/৭২
তবু দৃশ্যের কিছু, দৃশ্য থেকে যায় অবশেষে
টর্নেডো বন্যা মহামারী কিংবা ভয়াবহ যুদ্ধের শেষে
ধ্বংসের দারুণ ছবি খেলা করে হৃদয়ে চোখে
আকাশের সুনীল গম্বুজে প্রান্তরে নদীতে কল্পলোকে
শোক দুঃখ এবং কান্নার অবশিষ্ট অংশ
জমা হয় আমাদের পরিচিতি রাস্তা ঘাটে
লোকালয় বিধ্বস্ত হয়; পড়ে থাকে ঘরের ঝুল কবাট মাঠে–
উড়ে যায় সুদূরে কাকচিল চড়ুই হংস!
বিষাদ যন্ত্রণা ভালবাসা যাই বলো না কেন ধ’রে রাখে কিছু দৃশ্য
সময়ের ক্যামেরা
আদিগন্ত সবজ চিৎকারে ভাসে আমাদের শান্তির নীল ভেলা
বাতাসে জ্বলেনা মোমবাতি; অন্ধকারে জেগে থাকে বস্তি গ্রাম পাড়া—
এই সবই দেখা যায় বড় বেশী; প্রেম দুঃখের খেলা!
২৮/৭/৬৯
চলে এলুম
(চলে এলাম, তোমায় ছেড়ে চলে এলুম–
মঙ্গলাচরণ চট্টোপাধ্যায়)
চলে এলুম, তোমায় ছেড়ে চলে এলুম
রইলো পড়ে ছেঁড়া মাদুর, ভাঙ্গা সানকী
জীর্ণ কাঁথা মলিন বালিশ
মুলিবাঁশের ছিদ্রবেড়া, পচাঁ ডোবা
মাটির ঝাঁকি, পুরানো কোদাল
ফেলে রেখে চলে এলাম
চলে এলুম, তোমায় ছেড়ে চলে এলুম
দুঃখপূর্ণ মুখটি তোমার উঠলো ভেসে চোখের মধ্যে
ঘন্ট করা কচুর শাকে আমায় তুমি খেতে দিলে
মাটির ব্যকে পা ঠেকিয়ে অন্ন দিলুম মুখের ভেতর
হাতের খেলায় বিদায় নিলো ঘাসের যত মাছিগুলো
পাশে দেখলুম বুড়ো কুকুর শুয়ে আছে খালি পেটে
মাথার উপর কড়া রোদ্দুর কাকের শরীর
এবং তোমার
চোখের জলে ভিজে যাওয়া শাড়িটাকে
মনে ছিল, আসার বেলায় বলবো কিছু
খুচরো পয়সা দিয়ে যাবো
মুন্সী বাড়ি কাজের জন্যে বলেও যাবো
দিয়ে যাবো গামছাটাকে শাড়ি কোরে পরবে তুমি
কিন্তু আমার হয়নি বলা অত কিছু—
তবু আমায় আসতে হলো, আসতে হলো তোমায় ছেড়ে
গ্রামটা আমার ভেসে গেছে
চৈত্র এলে পুড়েও যাবে
কাজের জন্যে দুয়ার দুয়ার ঘুরেও কোন ফল হবেনা
এখন দেখি শহর আমায় রাখে কিনা!
বেঁচে থাকার ইচ্ছা নিয়ে গ্রামটি ছেড়ে চলে এলুম
চলে এলুম, তোমায় ছেড়ে চলে এলুম
৯/৫/৭০
চাঁদের ভেতরে একজন
চাঁদের ভেতরে একজন নগ্নপ্রায় ব্রোথেল রমণী বসে
আছে হাঁটুর ভেতরে মাথা গুঁজে; মার্কিনী নায়কের মতো হিংস্র
তার করতলে এক বিষাক্ত ছুরি
জ্যোৎস্নায় চকচকে করছে দীর্ঘকাল
আকাশের সুনীল কপালে একটা মারাত্মক টিপ
প্রেমের লন্ঠনের মতো উজ্জ্বল অথচ ভয়াবহ
উত্তরাধিকার সুত্রে বর্তমান দারুণ আগুন জ্বলে আমাদের হৃদয়ে
রক্তের সবুজ সঙ্গীত ঈশ্বরের একান্ত বন্ধ; স্কুলের মেয়েদের
মতো মিষ্টি
য্যানো মধ্যরাতে সমূহ চুম্বন। শরীরে নেচে বেড়ার অনুভূতির
পাগল জন্তুরা
সন্ধ্যায় রমণীর বিপণী থেকে পরিচিত আকৃতি বেরিয়ে আসে দ্রুত
ছিন্নভিন্ন রঙীন পথে; সোনালী আলোয়; কঠিন চোখে রাখি
ফেরেশতার নিত্য হরিণ
অতঃপর পরবর্তী বিশ্বাসের উপর নির্ভর করতে করতে চলে যায়
প্রতিবাদহীন ফ্ল্যাটে
এবং রাত্রি গাঢ় হলে যখন পরস্পর শরীরে শরীরে মিশতে থাকে—
দ্যাখে; জানলায়
আকাশের সুনীল কপালে মারাত্মক-অশ্লীল মহিলাটি ঠিক তখনে বসে
আছে নির্বিকার
য্যানো গিলে খাবে এই আমুণ্ড আমাকেই!
৬/৩/৭২
ছন্দে, ভুল ছন্দে গদ্যপদ্য খেলা
পাখির ভাষা কণ্ঠে নিয়ে যেতে যেতে পোশাক আমার বদলে নেব
প্রেমিক পুরুষ পথ ভুলে যায় উড়তে উড়তে পথটা আমি চিনিয়ে দেব–
বংশীধ্বনি পরাঙমুখ ভুল ভ্রান্তি দুঃখ সুখ
নদীর স্রোত সোতস্বিনী, আমি যাবো উল্টো দিকে—
দেখতে পাবো ঈশ্বরীকে বসে আছে মা জননী!
বনান্তরে ঘন্টাধ্বনি;– একলা হাওয়া হলদে ডাহুক
কোনদিকে যায়? – ঘন আঁধার খেলা করে অনিমিখে!
।দুই।
পোশাক আমার হরিৎপোশাক, হরিৎ নয়, হতেও পারে—
দোকলা স্বভাব মনের ভেতর, টানাপোড়েন –
আমার তেমন ভাল্লাগেনা নারী আছে সংসারে—
যৌথ খামার দোকানপাট তাহার মাঝে আমার বাস
বানের জলে ডুবল ঘাট কবির দুঃখ বারোমাস
বারে মাসেই যেতে যেতে পোশাক আমার বদলে নেব
মদবিহ্বল জ্যোৎস্না রাতে সকাল সাঁঝে নদীর মতো স্রোতস্বিনী নদী হবো।
১৫/১০/৭৪
জন্মই আমার আজন্ম পাপ
জন্মই আমার আজন্ম পাপ, মাতৃজরায়ু থেকে নেমেই জেনেছি আমি
সন্ত্রাসের ঝাঁঝালো দিনে বিবর্ণ পত্রের মত হঠাৎ ফুৎকারে উড়ে যাই
পালাই পালাই সুদূরে
চৌদিকে রৌদ্রের ঝলক
বাসের দোতলায় ফুটপাতে রুটির দোকানে দ্রুতগামী নতুন মডেলের
চকচকে বনেটে রাত্রির জমকালো আলো ভাংগাচোরা চেহারার হদিস
ক্লান্ত নিঃশব্দে আমি হেঁটে যাই
পিছনে ঝাঁকড়া চুলওয়ালা যুবক। অষ্টাদশ বর্ষিয়ার নিপুণ ভঙ্গি
দম্পতির অলৌকিক হাসি প্রগাঢ় চুম্বন
কাঁথায় জড়ানো শিশুর অসতর্ক চিৎকার
এবং
আমি দেখে যাই হেঁটে যাই কোথায় সামান্য বাতাসে উড়ে যাওয়া চাল–
অর্থাৎ আমার নিবাস।
ঘরের স্যাঁতসেতে মেঝেয় চাঁদের আলো এসে খেলা করে
আমি তখন সঙ্গমে ব্যর্থ, স্ত্রীর দুঃখ অভিমান কান্না
সন্তান সন্তুতি পঙ্গু
পেটে জ্বালা, পাজরায় তেল মালিশের বাসন উধাও–
আমি কোথা যাই? পান্তায় নুনের অভাব।
নিঃসঙ্গতাও দেখেছি আমি, উৎকন্ঠার দিনমান জ্বলজ্বলে বাল্বের মতোন
আমারি চোখের মতো স্বজনের চোখ–
য্যানো আমুন্ড গ্রাস করবে এই আমাকেই
আমিই সমস্ত আহার নষ্ট করেছি নিমেষে!
শত্রুর দেখা নেই, অথচ আমারি শত্রু আমি–
জ্বলন্ত যৌবনে ছুটি ফ্যামিলি প্ল্যানিং কোথায়
কোথায় ডাক্তার কম্পাউন্ডার?
যারা আমাকে অপারেশন করবে?
পুরুষত্ব বিলিয়ে ভাবি, কুড়িটাকায় একসের চাল ও একদিনের অন্যান্য
সামান্য দ্রব্যাদী মিলবে তো?
আমার চৌদিকে উৎসুক নয়ন আহ্লাদী হাসি ঘৃণা আমি পাপী
এরা কেন জন্ম নেয়? এরাই তো আমাদের সুখের বাধা অভিশাপ
মরণ এসে নিয়ে যাক; নিয়ে যাক
লোকালয়ের কিসের ঠাঁই এই শত্রুর?–বলে
প্রাসাদ প্রেমিকেরা
আমিও ভাবি তাই; ভাবি নতুন মডেলের চাকায় পিষ্ট হবো।
আমার জন্যই যখন তোমাদের এত দুঃখ
আহা দুঃখ
দুঃখরে!
আমিই পাপী; বুঝি তাই এ জন্মই আমার আজন্ম পাপ।
২/২/১৯৭২
জর্ণাল: স্মৃতিচিত্র
কাল সারারাত বৃষ্টি হয়েছিল
মেঘের প্রবল খেলার ভঙ্গিতে আমি এক নিবিড় শুয়েছিলাম
কোমল শয্যার শরীরে
আমার চৌদিকে বৃষ্টির নিপুণ করতালি
ডাকছিল আমাকে।
“আয় আয় ভিজে উঠি গুরুজনের দারুণ চোখ ফাঁকি দিয়ে”—
যেন পেয়ে গেছে বালকবেলার সাথী!
কাল সারারাত একা একা বৃষ্টি হয়েছিল
টিনের ছাদে খেলছিল তুমুল
যৌবনের ব্যস্ত প্রেমিকের মতো ছুটেছিল পার্কে বাগানে—
নদী কি এখনো বসে আছে ভীষণ উৎকন্ঠায় ?
আমিতো মেঘের অনুচর বিষে নীল গোলাপ
শহরময় হেঁটে গেলে ঘেমে যায় ক্ষয়িত পাথর
আমিতো জোৎস্নার শত্রু, ঘন কুয়াশা বক্ষের বন্ধু!
আমার খেলার ভঙ্গিতে বর্ষাতি চাপিয়ে গায় ছুটে যায় মহাজন
রাজাধিরাজ
ব্যাকুল চেয়ে থাকে সম্রাজ্ঞীর করুণ হৃদয় কিশোরীর বুক
আমিতো খেলছি এই মধ্যরাতে ; টিনের ছাদে খেলছি একা একা
সখী নেই
আমিতো এক্ষুণি চলে যাবো বিষন্ন মেঘের ইশারায় –
হয়তো বা
সেই মেঘ ভেবেছিল বহুবার?
আমি একা শুয়ে আছি; নিবিড় শুয়ে আছি
কোমল শয্যার শরীরে
সেই বৃষ্টি এখনো কি সখীবিনা ঘরে বেড়ায় আকাশের একলা পথে
আমি যেমন শুয়ে আছি এই বিজন ঘরে?
১২/৭/৭২
জেব্রা ক্রসিং-এ
এই চাঁদ খসে পড়ল জেরা
ক্রসিং-এ। তাঁর শরীরে আলোর
যে বন্যা; কে যেন মাড়িয়ে
গেল নিমিশে। জ্যোৎস্নার ব্লাউজ ব্রা
রক্তে ভেজা। ছুরির তীক্ষ্মতা যেন মোর
বুকের উপর তখনো দাঁড়িয়ে।
কোন্ ঈশ্বর এই জ্যোৎস্নময়ী
চাঁদের স্তনে আঘাত করেছিল? — জানিনা!
তবু মনে হলো বেশ্যার অপরাধ
কতটুকু? ঈশ্বরতো সবারই জয়ী।
মুদ্রার কাছে শুধু বেশ্য পরাজিতা বৈশ্যাকে ঘরে রাখতে পারিনা
বলেই ঘর থেকে বের কোরে দেয়া–কি স্বাদ
আমি তো বুঝিনা। সেই চাঁদের কলঙ্ক আমি জানি। যেমন সবাই বেশ্যার
কলঙ্ক জেনেও তাঁর কাছে বারবার
যাওয়া আসা; দু’পায়ের গোপন ফাঁদের নিবিড়ে ধরা দেয়া। কি আশার
কথা তুমি শোনাবে এখানে?—জানা আছে আমার!
পড়ে থাকা চাঁদের রাউজ ব্রা
সব কুড়িয়ে যখন ঘরে ফিরছি; দেখি
ভীষণ রক্তে ভিজে গেছে জেব্রা
ক্রসিং। মনে মনে বলি, “তাহলে ঈশ্বরই মেকী!”
২৮/৫/৭৩
তুমি আমার কবিতা পড়োনা
আমি কখনো প্রেমিক ছিলুম না
প্রেম কি বুঝতে চাইতুম না—তুমি শেখালে
আমি হয়ে উঠলুম প্রেমিক
সকল বাঁধা বিপত্তি অমান্য কোরে তোমার কাছে যাই
অনিচ্ছায় বলি “কি সন্দের তোমার চুল চিবুক চোখের ইশারা
শরীরের রঙ
চন্দ্রের সাথে তোমাকে তুলনা করা ভুল হবে!
এমনি হাসি কখনো দেখিনি;–ঠিক যেন মুক্তো ঝরে—
আমি আসলে ঠিকই তোমাকে আবিস্কার করেছি
তোমাকে দেখলেই কবিতার কথা মনে পড়ে যায়
তুমি যেন সাক্ষাৎ কবিতা হয়ে ওঠো
কবিতার সমস্ত উপমা তোমাতেই
আমি তাই কবি হয়ে গেছি!
তোমার জন্যেই আমি আজ কবিতা লিখি–
মিথ্যে বলতে বলতে কবিরা যেমন সৎ হয়ে যায়
সবকিছুই ইচ্ছাকৃত ভুল কোরে চিৎকার কোরে ওঠে এইটেই ঠিক
আমিও তেমনি অলীকে আশ্রয় নিয়ে বলি
“তুমিই আমার জীবন যেন নদীর জলধারা আমাতে স্বয়ং
যৌবনের প্রাচুর্যে আমি এক গ্রীসীয় রাজা–হৃদয়ে আমার
খেলছো সর্বদা!
আমি তোমাকে পাবার জন্যে মিথ্যে উপমা দিয়ে কবিতা লিখি
কবিতার বদৌলতে আমি কবি হয়ে গেলাম—
কিন্তু তুমি আমার কবিতা পড়োনা!
২/৪/৭৩
তুমিই আমার প্রেমিকা। যেহেতু
তুমিই আমাকে প্রথম ভালবাসা শেখালে
কি কোরে ভালবাসতে হয়।
একদিন দেখলাম; একজন বিদেশী যুবা
তোমাকে ক্যামোন জোর করে টেনে নিচ্ছে—-
তুমি নিরুপায়!
হয়তো তোমার বিশ্বাস ছিল
তোমার ভালবাসার প্রতিদানে
আমি তোমাকে উদ্ধার করবো। আমি তাই করেছি
আমি তোমার জন্যে মুক্তিযুদ্ধে গেছি
মর্টার ধরেছি, দাঁত দিয়ে গ্রেনেডের ক্লিপ ছিঁড়েছি—
দ্যাখো, তার সঠিক ফলাফল পাওয়া গেছে
একটি চরম যুদ্ধে।
অতএব এসো, এখন জ্বলজ্বলে দিনের আলোয় পুনমিলন হোক্
আমাদের–
যেহেতু আমি তোমার আশৈশব প্রেমিক—
তোমার ভালবাসা আমার শরীরে!
১৫/২/৭২
তৃতীয় বিশ্বের শিশুদের
তৃতীয় বিশ্বের শিশুদের । নবারুণ ভট্টাচার্য
অন্ধকারে জন্ম তোর
দেখেও যাবি অন্ধকার
অন্ধকারে মৃত্যু হবে
অন্ধকারে জন্ম যার।
অনন্তকাল থাকবে ক্ষুধা
দারিদ্র ও মৃত্যু শাপ
মশাল হাতে নাচবে প্রেত
বন্যা, খরা, দুর্বিপাক।
অনাথ শিশু, চক্ষু বসা
চলছে চলবে গুরুর দশা
চলছে চলবে গুরুর দশা
মরণ, মারণ—চলবে তাই।
জুলবে কুমির, বাঘের চোখ
আমিষ গাছের বিষম ফল
লতাবে সাপ কাটায় কাটায়
পচা নদীর বদ্ধ জল।
অন্ধকারে জন্ম তোর
দেখেও যাবি অন্ধকার
অন্ধকারে মৃত্যু হবে
অন্ধকারে জন্ম যার।
তোমার ছায়া ঘিরে রাখে
সকাল থেকে সন্ধ্যাবেলা
যখন কিনা কাজের ফাঁকে মনে পড়ে
ছায়ায় তখন তোমাকে দেখি
ইচ্ছে করে শুধাই কিছু
এখন কেমন চলছে তবে
আমার মতোন সঙ্গীহীন বুঝি
এখন আমি যেমন আছি!
তোমার ছায়া ধরতে গেলেই
দাঁড়ায় সে যে অনেক দূরে
বলতে গেলে মুখটা তুমি ফিরিয়ে রাখো
হয়না বলা তখন কিছু
পার্কে কিংবা নদীর ঘাটে
বাড়ায় শুধু ব্যাকুলতা
হাতের মুঠোয় ফুলটা তাই
লুকিয়ে থাকে অনেক আগেই
কেমন করে দুঃখটাকে
থামাই বলে এখন তবে!
তোমার ছায়া ভাল লাগে
যখন কিনা একলা ঘরে
তোমায় নিয়ে থাকি মেতে
কিংবা যখন তাকাই আমি সুদূর পানে।
তোমার ছায়া ভাল লাগে সকাল থেকে সন্ধ্যেবেলা।
১৭/৭/৬৯
পুনর্বার ফিরে যাবো মধ্যরজনীতে আমি ও আমার সকল সুন্দরতম শত্রু
ফিরে যাবো সেই রমণীর কাছে; যার নিবাসে নিরপরাধ প্রেম
লুকিয়ে থাকে
সগৌরবে তুলে ধরে বাহু
ভাবনার একান্ত নক্সী ভায়োলীন
সিম্ফনির মতো বাজতে থাকে একলা বাতাসে–
আমরা তাকে ডেকে এনে
জ্যোৎস্নাহীন জ্যোৎস্নায় হত্যা করবো
খুলে নেব সমস্ত ভূষণ প্রেমের মাদুলী
শুধু রক্ষা করবো তাঁর একমাত্র প্রিয় গাঁথা!
পুনর্বার ফিরে যাবো; ফিরে যাবে সুশোভনাকে সঙ্গে নিয়েই
ফিরে যাবো
ফেলে যাবো রজনীগন্ধার বনে শাড়ি ব্লাউজ ও গোপন অন্তর্বাস
নতজানু হয়ে অবলোকন করব হৃদয়; হৃদয়ের সমস্ত ভালবাসা
সৌন্দয় এবং নগ্নতা
তোমরা সবাই চলে গেলে; চলে গেলে হে আমার সুন্দর শত্রুরা
আমি সুশোভনাকে তুলে নিয়ে ফুলের মতে সাজিয়ে রাখবো–
সাজাবো আমার গোলাপ-টেবিলে!
৮/১/৭৩
না পারলেও পুনর্বার ভেবে দ্যাখো তুমি
ইন্দ্রিয়ের কাছে জেনে নাও কি কোরে পূনর্মিলন হবে আমাদের–বলে
সে নিজেই মধ্যাহ্নের খরতাপে ছুঁড়ে দিল প্রিয় রমণীর মতো একটি
গোলাপ ও সিগ্রেট
অশ্রু নির্মিত সরোবরে
আরেকটি পদ্মের ঠিক হৃদয়ের মাঝখানে
তুমুল অগ্নিপ্রপাতের দিনে পাশাপাশি যেতে যেতে
একজন মায়াবী মহিলার কাছে শব্দের তোরণ খুলে দিয়ে
আভুমি নতজানু হয়ে
তাকালে নয়নে সখা তাকালে নীলিমায়
।। দুই।।
এই ভাবেই হোকনা শুরু এই ভাবেই হোকনা শেষ —
জীবনের সজল পল্লব জয় করবার ইচ্ছায় চকিতে উড়াও
কামিনী ডালের পাখিদের, আঙিনার পায়রা, ভোরের পবন,
শ্রাবণের মেঘ মেলা, আমাদের প্রিয়তম সুন্দরীতমারে!
না পারলেও পুনর্বার ভেবে দাখো তুমি; ভেবে দ্যাখো
সরোবরের পদ্মপাতার ফাঁকে অমল জ্যোৎস্নার লকোচুরি
নর্তকী অমরাবতীর সোনালী যৌবন
সুবর্ণ পদাবলীর কোমল হৃদয়
পার্কের বিকেল বেলায় খুনসুটি
চুলের নিবাসে রজনীগন্ধার বসবাস—এইসব দেখা ও পাওয়া
বুঝি সব ব্যথা যাবে
বৃথা যাবে অন্ধকারে দুজনে মুখোমুখী বসিবার?
[কবিতার দুটো লাইন এলিয়ট এবং জীবনানন্দের কাছ থেকে ধার নেয়া]
তাতে কি, পুনর্বার জলে নেমে শুদ্ধ কর গা
যে গন্ধময় পাপ করেছ ধারণ
না হয় নামলেই এই শীতে
সমস্তই ধুয়ে যাবে জলের তরলতায়-বলে
আমার সুজন মিশে গেল হাওয়ার গভীরে
চারদিকে সকালের নিবিড় কুয়াশা
পাখিও জাগেনি তখন
অন্ধকার কেবল ছায়া-ছায়া
আমি সেই জলের উদরে পা রাখতেই
কনকনে ঠাণ্ডা এক ঘিরে ধরল শরীর
তাড়াতাড়ি উঠে পড়লাম তীরে
তারপর হাঁটতে হাঁটতে আমিও চললাম শহরে
শহরের এক প্রান্তে এসে যখন দাঁড়িয়েছি
দেখলাম, আমার সুজন মিশে গেল মানুষের ভীড়ে
প্রাণপণে ডাকলাম যেন না-শোনার ভানে হাঁটতে থাকলো দ্রুত
আমি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সিগারেটে শেষ টান দিচ্ছি
দেখি, একটি বাস এসে দাঁড়াল আমার কাছে—
আমি তাঁর হাতল ধরে উঠতে চাইলাম—
মানুষগুলো ঠেলে দিল মাটিতে
পুনরায় আমি হাঁটতে লাগলাম
হাঁটতে হাঁটতে একটি রাস্তার মোড়ে এসে দাঁড়িয়েছি
সবাই নাকে আঙুল চেপে চলে গেল –
আমি বুঝতে চেষ্টা করলাম
মানুষের কিসে এই অনীহা!
মনে পড়ল সুজনের কথা—
“যে গন্ধময় পাপ করেছ ধারণ–
না হয় নামিলেই এই শীতে
সমস্তই ধুয়ে যাবে জলের তরলতায়!”
আমি আবার হাঁটতে হাঁটতে নিজের ঘরে ফিরে এলাম
দরজায় টোকা দিতেই ভেতর থেকে শব্দ এলো
‘কে’?
বললাম
‘খোলো’
খুলে গেল বন্ধ কপাট
ভিতরে ঢুকতেই নির্দ্ধিধায় কাছে এলে বাসন্তী
শরীরে হাত রেখেই বলে উঠলো
‘ঘেমে দেখছি অস্থির হয়ে গেছ”
বাসন্তী তখন জামার বোতাম খুলে, সামনে বসে, মাথায় হাত
বুলাতে বুলাতে
বাতাস দিতে থাকলো—
আমিই সেই বাতাসে কখন যেন ঘুমিয়ে পড়েছি
তারপর এক সময় জেগে দেখি
বাসন্তীর মুখখানি পড়ে আছে আমার বুকের উপর।
৩/১০/৭২
কখনো যাবোনা আর-
যেহেতু তার
হিংস্রতার
কঠিন কুঠার
হানা দেয় অনিবার।
একদা যখন টাকার
ছড়াছড়ি আমার
রাজার
দুলালী এসে ছিঁড়ে দিত গিঁট পাজামার।
এখন গিয়েছে সব; ঘরেতে আঁধার–
বিধাতার
অদৃশ্য খেলার
হাত; মমতা যার
কবিতার
মতো অপার—
বোঝা ভার।
নিরপরাধ বৃক্ষমূল ভেঙেছে সে; যাবো না আর
২/১১/৭২
রাস্তায় গাঢ় দিন হেঁটে যায়। মধ্যরাত
তোমার নিবাসে; সমুদ্র উধাও; দুই হাত
বিজয়িনীর স্বর্ণ মাখা। ভালবাসার নাম
কোথায়? বিভিন্ন সবর আমার মধ্যে। দাম
সব জিনিসের। পলাতক প্রত্যেকে। বাজারে আগুন।
আমি নিঃস্ব। চৌদিকে ঝড়; ঝড়ের খেলায় খুন
হয় ঘরবাড়ি। কোথায় যাবো প্রাক্তন বন্ধুরা?
হাঁটুজল ভাঙতে অভ্যস্ত; বাসে বাদুড় হই; যারা
ভেঁঙচি কাটে; রক্ত তাদের ভিন্নমুখী। এখানে বাঁচার
অর্থ কি? সঠিক সংজ্ঞাটা দিতে পারেন থিবির রাজার
স্ত্রী। এখনো বালক; উপলদ্ধি যদিও প্রখর নয়—
লোকে বলে। তব, আমি অন্ধকার করিনা ব্যবসা। সময়
উর্ধ্বমুখী। পত্র আজ ছিন্ন; ছেলে মেয়ে উপোস যায়।
মাঝে মাঝে ভরসা পাই; হকার হাঁকে রাস্তায়
দৈনিকের হেডলাইন। ঘরে শুয়ে দেখি রোজ
আকাশে নক্ষত্র; ডালপালাহীন তরুরাজি। খোঁজ
নেই আমার হপ্তাখানেক। যুদ্ধ চলে পেটের নিবাসে।
দিন সব বাঘের মতো। রাত্রি; দুঃখ নিয়ে আসে
ঈশ্বর প্রচন্ড ক্ষমতাবান জানি; তব, আমাদের এই পাপ
হয়না কেন স্খলন? এসবের মালিক কে? কে করেন মাফ?
বুঝি দরিদ্র? মধ্যরাতে সজাগ হয় চিন্তা; দুঃখ হানা দেয় আমার নিবাসে
বস্ত্রহীন ছেলে মেয়ে; দ্রব্যমুল্যের বৃদ্ধির খবর আসে
আমার কাছে; তাহলে কিসের স্বাধীন?
মৃত্যু অনিবার্য; এমনিই কাছে আমাদের দিন।
২৭/৪/৭২
প্রেম দ্যাখো বয়স মানেনা কোনদিন
ছোটবড় তালার মতো সব বয়সের কপাটে ঝুলে পড়ে হঠাৎ
প্রেম, সবুজ নিসর্গ থেকে পলাতক কয়েদীর মতোন নিঃশবেদ বেরিয়ে
আসে দ্রুত
ঠাঁই নেয় বিভিন্ন লোকালয়ে; খেলা করে সকাল বিকাল
তোলপাড়ে ভেঙে যায় নীলিমার আজীবন আশীর্বাদ-গড়ে তোলে
সুখ-দুঃখ
পড়ে থাকে বয়স্কদের দারুণ চোখ
প্রেম, সেতো বয়স মানে নি কোনদিন-বুঝি তাই
তীক্ষ্ম চকচকে সোনার ছুরি এনে বসিয়ে দেয় সকল প্রহরে
মেতে ওঠে ভয়াবহ বন্যার জলের মতো বাদশাহী হৃদয়ে–এবং
ছিন্নভিন্ন হয়ে যায় পারিবারিক স্নেহ-মমতা
অথচ শুধু, বেঁচে থাকে পরস্পর হৃদয়ের সদর দৃশ্যাবলী!
।২।
প্রেম, একটা ক্ষুধার্ত হিংস্র বাঘ : নিমেষে গ্রাস করে দীর্ঘকায় শরীর
প্রচন্ড থাবায় কখনো আবার ছিঁড়ে নেয় লালিত মাংস–ছিঁটিয়ে দেয়
বিষাক্ত লবণ
জ্বলতে থাকে আজীবন!
প্রেম; য্যানো গোলাপ-নীলিমা-নিসর্গ-নক্ষত্রে মোড়া আদুরে পুতুল—
নির্জনে থাকেনা পড়ে; অথচ একবার উপযুক্ত হৃদয়ে ঠাঁই পেলে কেউই
রুখতে পারেনা সহজে এবং
সৃষ্টি করে রিশাল বাগান
যা কখনো ফেলে রেখে কোথাও যাওয়া যায় না; শুধু ঈশ্বরের মতো
ক্ষমতা সম্পন্ন হয়ে যায় মুহূর্তে!
৬/৬/৬৯
লক্ষ মানুষ বিলিয়ে দিয়ে
তোমায় পেলুম একটি নামে—
স্বাধীনতা
তোমার শরীর রক্তে মাখা –
চোখের জলে সিনান কোরে উঠে এলে রণপায়ে; দীপ্ত চোখে
স্টেন্গান ফেলে দিয়ে বুকের ভেতর জড়িয়ে নিয়ে
চুম দিলাম আদর কোরে
পাড়ার লোকে দেখতে এলো মালা হাতে
ভুলে গেল দুঃখাবলী, কঠিন শোক, অত্যাচারী রাজার কথা—-
এখন আমি তোমায় নিয়ে নেচে বেড়াই প্রাণের সুখে
সামনে আমার দাঁড়িয়ে তুমি হাসতে থাকো ভীষণ জোরে
আমার মেয়ে মাটির ব্যকে পা ঠেকিয়ে
কাঁদতে থাকে কেমন কোরে–
দ্যাখো তুমি
মায়ের প্রেম হারিয়ে এখোন তাকিয়ে আছে বোনের দিকে–
আসবে ফিরে
ভায়ের কথা স্মরণ কোরে শুধায় শুধু এই পিতাকে
“আসবে কখোন যুদ্ধ থেকে–বাংলাদেশে”?
লক্ষ মানুষ হারিয়ে আমি তোমায় পেলুম তোমায় পেলুম
তোমার বুকে মাথা রেখে ঘুমাই আমি পরম সুখে—
তুমি এলে রণপায়ে, দীপ্ত চোখে; স্বাধীনতা!
১/২/৭২
ভালবাসার বাগান থেকে একটি গোলাপ তুমি চেয়েছিলে
তোমার গম্বুজের মতোন অলীক খোঁপার জন্যে—
আমি তোমাকে দিতে পারিনি
তুমি তাই চোখের জলে প্রতিশোধ নিলে
মুখ রাখলে শাড়ির কাছে
আমি বারবার তোমাকে ডাকলাম; তুমি সাড়া দিলে না
বরং ভাসালে নিকানো আঙিনা কুয়োতলা
বিজন ধোঁয়ার মতো উড়ে গেল আমাদের দীর্ঘদিনের পরিচয়
বৃদ্ধি করলে বুকের হিংসার নদী
আমি পেছনে ফিরে তাকালাম একবার; দেখি—
নিজস্ব দুঃখের ঘরের দরজা তখন হাট কোরে খোলা!
১৪/৪/৬৯
(সিলভিয়া ইসলাম-কে)
মধ্যরাতে রূপোলী চাঁদের মতো বিশাল দুঃখ নিয়ে পড়ে আছি
তোমার করতলে হে আমার মাধবী
সবুজ নিসর্গ থেকে উঠে এলে একাকী
মুখে কালো কাপড় জড়িয়ে; ফেলে রেখে ভাবনার ভায়োলীন
আমি এই মধ্যরাতে তোমার সম্পতি কুড়াবো
বিজন প্রেমে উল্লসিত হবোনা আর—
ভেবেছি বহুদিন
আমার সুনীল মাংসে ভয়াবহ ক্ষতের চিহ্নাবলী—
যেন আদিগন্ত চিৎকারে ভেসে যায় নিবিড় যামিনী!
মধ্যরাতে এখনো পড়ে আছি; রাপোলী চাঁদের মতো পড়ে আছি
চতুর্দিকে ছেঁড়া ট্রাউজার উড়ছে শুন্যে নীলিমায়
হয়তোবা আজন্ম দুঃখগুলো এখানেই পাওয়া যাবে–
কিছুমাত্র লুকোবার নেই
আমি আমার দুঃখের কাছে যাবো হে মাধবী
তুমি তোমার করতল উর্দ্ধে তোলো
মধ্যরাতে রূপোলী চাঁদের মতো পড়ে আছি
থাকতে দাও!
৪/৪/৭২
আমার মায়ের চোখে আমি ছাড়া য্যানো পৃথিবীর কোন সুন্দর-ই
সহজে লাগে না আর তার কাছে
দিনের আলোর মতো উজ্জ্বল ভালবাসা সমস্ত শরীরে রেখে
বেঁচে থাকেন পরম তৃপ্তিতে—
কখন তার সোনালী প্রহর গড়িয়ে যায়; দৃষ্টি নেই সে দিকে
অথচ ভীষণ মায়াবী চোখে আমাকে নিয়ে খেলা করে সারাদিন
এবং
মেলে রাখেন আত্মীয় পাড়াপড়শীর কাছে!
আমার মায়ের চোখে কোন দুরন্তপনাই ধরা পড়েন। কখনো; য্যানো
বিরাট গণের অধিকারী
সুবোধ বালক আমি
ঠোঁটস্থ সকাল বিকাল তার আমার সমস্ত কাজ-বুঝি তাই
পরম স্নেহে চোখে মুখে ছুঁয়ে যায় আশীর্বাদের নরম হাত!
আমার মায়ের চোখে আজীবন দুধের শিশুই রয়ে গেছি আমি—
এখনো রাত্রিকালে তিনি সেই শিয়রে বসে দেখে যান; গেয়ে যান
ঘুমপাড়ানিয়া গান!
৮/৮/৬৮
মিছিলে তোমার মুখ ছিলো সেদিনের রক্তগঙ্গা রাজপথে
গ্রামকে গ্রাম উজাড় কোরে অবশেষে এইখানে এসে কোন মতে
বাঁধলে কঠিন বুক পরম সাহসে; হৃদয়ে আশা দোলে; যেন সব
সম্রাজ্ঞী স্বপন
অথবা বিধাতার স্বর্গীয় শান্তি খোঁজো রাত্রিদিন এই দারুণ মিছিলে। কখন
যে পাপময় বাতাস বয়ে গেল গাছের ডালে; একটু চোখ তুলে দেখলেও
না তুমি–
বরং বললে; “এখানে নিবিড় ভালবাসা আছে অথচ কি যেন নেই—
হায় আমার বাংলা আমার জন্মভুমি!”
—বলে সেই যে হারিয়ে গেলে ফিরে তাকালেও না আর–
জানিনা একি অপার মমতা যে হৃদয়ে তোমার!
৩/৭/৬৮
তাহলে এবার চৈতন্যের নির্জন প্রকোষ্ঠে সহজ সরল বাহ, রাখো—
সমবেত প্রেমিকবৃন্দের উন্নত বক্ষে ঝুলিয়ে দাও লম্বিত মাদুল
দ্রিমিদ্রিমি
বাজুক সমস্বরে; নীলিমায় চোখ রেখে উলঙ্গ করো
নাভীমূল স্তন ও অন্যান্য যৌনাঙ্গ
আমরা এই রঙ্গমঞ্চের অভিজ্ঞ নট পশ্চাতেই নটী
ঘোমটায় কেউ আর পর্দার আড়াল ভেদ কোরে উন্মুক্ত আলোয় আসিনা
যেহেতু অন্ধকারে আমরাই অনেক বালক জন্ম দেই—এইসব
বালকইতো যত সব নটের মূল; পকেটে বিষাক্ত ছুরি
চকচকে সর্টগান
ধারে কাছেও যাওয়া যাবেনা!
ন। যাবোনা; কোথাও যাবোনা; সমস্ত যাত্রা বাতিল
তোমার চিৎকার জুড়ে দাও এই ব্রোথেলে; তুমুল হৈ চৈ বাধাও
ব্যাকুল হও নিজস্ব ভঙ্গিতে —
সমুদ্রের নিঃস্বনে কিবা লাজ; অরণ্যে আমাদের বাস
রোধ করি মহামারী
সহবাসে সন্তান কই? কেবল উঠোন ছেড়ে অলিন্দে ঠাঁই?
এসো সমবেত প্রেমিক প্রেমিকা; নাচো এই রঙ্গমঞ্চেই নাচো—
দেখাও ভালো খেল্ অথাৎ সার্কাসী ভঙ্গিমা
আমরাই শ্রোতা ও দর্শক
তোমাদের নিপুণ ভঙ্গির তালে তালে আমরাও করতালি দেব–
শুধু উলঙ্গ করো নাভীমূল স্তন ও অন্যান্য যৌনাঙ্গ!
২/১২/৭২
স্বদেশ, তোমার মুখ, আমার আশৈশব প্রার্থনার একান্ত সঙ্গীত
বেঁচে থাকার পরম ইচ্ছায় তোমার বুকের উপর মাথা রেখে শুয়ে আছি
ক্যামোন নিবিড়
য্যানো সপ্রেমে টেনে নেই তোমার দীর্ঘকায় শরীর, আমার শরীরে
স্বদেশ, তোমার সূক্ষ্ম ভালবাসার শিল্পসম্মত ছাপ
হৃদয়ের উজ্জ্বল প্রকোষ্টে অন্তরঙ্গ সখার মতো নিশ্চল নিঃশব্দ
ঝুলে আছে প্রগাঢ় বিশ্বাস নিয়ে!
তোমার আদিগন্ত সবুজ চিৎকারে ছুটে যাই, তুলে ধরি
স্ফিংসের মতোন শক্তসবল বাহু
রক্ষা করি প্রতিটি রোম; ছুঁড়ে ফেলি গন্ধযুক্ত আৰ্বজনা
গভীরতম ড্রেনে, গর্তে
স্বদেশ, তোমার কল্যাণী মুখের রেখা আমার আনন্দে কিংবা প্রেমে
উধাও হয়নি কোন জটিল অন্ধকারে
অথবা এক ভয়াবহ ষড়যন্ত্রের গহ্বরে!
স্বদেশ, দ্যাখো, তোমার সমস্ত ভালবাসায় আমার ভালবাসা
একাকার হয়ে মিশে আছে
ক্যামোন নিবিড় অন্তরঙ্গতায়!
৮/৮/৭০
আমিতো বলিনি হেলেনের মতো একটি চুম্বন অমর করো আমাকে!
অথচ তুমিই একদা প্রতিবিম্বহীন মেঘমেলায় কুসমগন্ধ রেখে
কি গান শুনিয়েছিলে!
আমার সত্তায় সেই শ্লোক গভীর মমতায় এখনে৷ বেজে ওঠে কিন্নরী!
আমিতো অগ্নির কাছে নতজানু হয়ে বলিনি
—রক্তের অশুদ্ধতা প্রজ্জ্বলিত হোক তোমার বিশ্বাসে
অতলান্ত প্রেমে মুছে যাক সুবর্ণ পদাবলী
প্রত্যাখ্যাত ভালবাসায় ফিরে যেতে বড় ভালবাসি।
সকল সম্ভার থেকে মুক্ত করো দুচোখের সজল সরোবর।
বুঝিনি সানন্দে পুষ্পবীজ নক্ষত্র বাগানে—
প্রেমিক হবো বলে গ্রন্হিতে প্রতিজ্ঞার কোন চিহ্ন নেই আমার–
অথচ তুমিই একদা হেলেনের মতো একটি চুম্বনে
অমর করেছো কিন্নরী!
এ অমরতার জন্যে তুমিই দোষী হে আমার প্রিয়তম সুন্দরী।
২৫/৫/৭৩