জন্মান্তর

মাহবুবুর রহমান
গল্প
জন্মান্তর

চেম্বারের দরজার অটোমেটিক শাটারটা বেশ পুরনো হয়ে গেছে। অনেকদিন কোনো লুব্রিকেন্ট দেয়া হয়নি। ছোটবেলায় বাবাকে দেখতাম কব্জায় সর্ষের তেল দিতে। তেলটা ঢেলে দরজাটা একটু সামনে পেছনে নাড়াচাড়া করলে কটকট শব্দ সহসা দূর হয়ে যেত। ব্যাপারটায় বেশ মজা পেতাম। পরে একা একা সারা ঘরে দরজা নাড়িয়ে দেখতাম কটকট শব্দ হয় কিনা। যদি হতো সাথে সাথে তেল ঢেলে দিতাম। অমনি কব্জার কটকট রোগ ভালো হয়ে যেত। তাতে নিজেকে একধরণের ডাক্তার ডাক্তার মনে হতো। কব্জার ডাক্তার !

সে যাই হোক।  দরজার কটকট শব্দ ঠেলে একজোড়া তরুণতরুণী  আমার ঘরে প্রবেশ করলো। তখন পেছনের কাঁচের জানালা দিয়ে গোধূলী তার  মেঘের দেয়ালে সিঁদুরের আলপনা এঁকে প্রস্থানের প্রস্তুতি নিচ্ছে। এদিকে স্বপ্নশিহরিত সম্মুখের নতুন জীবনের এই যুগল এবং পেছনে বিষন্ন স্মৃতিকাতর একটি দিনের সমাপনের মধ্যখানে আমি বসে আছি মধ্যজীবনের এক চিকিৎসক।

তাদের সদ্য তারুণ্যতাড়িত কোমল নিষ্পাপ মুখ দুখানি এমনই এক আলোকিত বর্ণচ্ছটায় উদ্ভাসিত যে, আমি প্রথমেই বলে ফেললাম,  তোমরা বস।

‘ধন্যবাদ স্যার। আমি রিয়াজ। ও আমার স্ত্রী, তাবাসসুম।’

মুচি যেমন জুতোর মালিকের মুখমন্ডল দেখবার আগে জুতোর ময়লার দিকে সবার আগে  ক্ষুধার্ত দৃষ্টি নিক্ষেপ করে, চিকিৎসকও তেমনি যে কোন জ্যান্ত ব্যক্তির ভেতর সবার আগে একজন  রোগী খুঁজে বেড়ান।  ইউরোপীয় রেনেসাঁর পুরোধা বিশ্বখ্যাত শিল্পী মাইকেলাঞ্জেলোর  মধ্যেও এই দোষটি ছিল। যেকোনো পাথর খন্ডের ভেতরে তিনি একটি ভাস্কর্য দেখতে পেতেন। তাঁর কাজ ছিল সেই এবড়োথেবড়ো  জড় পাথরের ভেতর থেকে একটি নিখুঁত জীবন্ত ভাস্কর্য বের করে আনা।

যাই হোক আপাতদৃষ্টিতে আমার সম্মুখে আসীন যুগলের দুজনকেই  সুস্বাস্থ্যের অধিকারী মনে হলো। চিকিৎসকের প্রাথমিক পর্যবেক্ষণে তাদের কাউকেই রোগী বলে মনে হলো না।

ভাবলাম সিসিইউ তে ভর্তি কোনো রোগীর এ্যাটেনডেন্ট হবে।

বললাম,  ‘ তোমাদের জন্য কি করতে পারি?’

-স্যার, আমার স্ত্রীর হার্টের চারিদিকে পানি জমেছে। বিভিন্ন হাসপাতালে এই নিয়ে চারবার পানি বের করা হয়েছে। আমরা এর একটা স্থায়ী সমাধান চাই।

আমি একটু নড়েচড়ে বসলাম।

-তাই নাকি? দাও তো আগের রিপোর্টগুলো দেখি।

একে একে ঢাকার বিভিন্ন হাসপাতাল , পরে ব্যাংককের একটি হাসপাতালের সব পরীক্ষা নিরীক্ষার রিপোর্টগুলো দেখতে দেখতে আমার ভেতরটা দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হয়ে পড়লো। কিন্তু সেই দুশ্চিন্তার  কোনো বহিপ্রকাশ না ঘটিয়ে  চোখে মুখে  ‘তেমন কিছুই হয়নি’ ভাব করে বললাম,

-এখন কি সমস্যা তোমার?

-স্যার, সোজা হয়ে শুতে পারি না। মাঝরাতে হঠাৎ শ্বাসকষ্টে ঘুম ভেঙ্গে যায়।

বিয়ের মাত্র দশদিনের মাথায় প্রথম উপসর্গ দেখা দেয়। মাঝরাতে হঠাৎ কাশতে কাশতে ঘুম ভেঙ্গে যায় তাবাসসুমের। গায়ে হালকা জ্বর। রিয়াজ ভাবলো ঠান্ডা লেগেছে। বিয়ের সময় অনেক অনিয়ম হয়েছে। ঠান্ডা কাশির ওষুধ দিলে ঠিক হয়ে যাবে। নিজে উঠে  গরম জলে লেবুর রস দিয়ে স্ত্রীকে গড়গড়া করতে দেয়। আদা চা বানিয়ে দেয়। পরম যত্নে কপালে হাত বুলিয়ে ভরসা যোগায়।রিয়াজের বুকের গহীনে আশ্রয় খুঁজে নেয় তাবাসসুম ।

এস এম সুলতানের নড়াইল থেকে আগত আর্ট কলেজের শিক্ষানবিশ শিল্পী রিয়াজ প্রকৃতির অপরূপ সৌন্দর্যে অভিভূত, মুগ্ধ। কলেজের আম জাম বকুল শিমুলের ঘনপল্লবের শিরা উপশিরায় জীবনের রহস্য খুঁজে বেড়ায়। নবীন হাতের কম্পমান তুলিতে ফুটে ওঠে এক নতুন চিত্রপট। বকুলতলায় ঘুরে বেড়ায় এক অপ্রতিরোধ্য গন্ধমাতম নেশায়। ভোরের সদ্য ঝরে পড়া বকুলের রূপ ও গন্ধ দ্বিপ্রহরের রূপ ও গন্ধ থেকে আলাদা। আবার বিকেলের গোধূলীর ধূসর আলোছায়ায় বকুল তার আরেক পরিণত বিশুদ্ধ রূপমাধুর্য  উপহার দেয়। ফরাসী গ্রেট ক্লদ মনের শাপলা ফুলের সাথে সূর্যের তিন প্রহরের ঐন্দ্রজালিক খেলার কথা শুনেছে সে। শোনা যায় ক্লদ মনের পুকুরের বাস্তব শাপলার চেয়ে তাঁর আঁকা ক্যানভাসের ফুলেরা নাকি বেশি জীবন্ত। নিঃশব্দ কলকাকলীর ধ্যানমগ্ন এক গভীর খেলা।

আমাদের রিয়াজও ক্লদ মনের মত বকুলফুলের রূপগন্ধের এই খেলায় নিমজ্জিত হয়েছে। রূপসাগরে ডুব দিয়ে যখন অরূপরতন হাতের প্রায় নাগালের মধ্যে ঠিক তখনই সে নিজেকে আবিষ্কার করলো কার্জন হলের ঘনসবুজের এক নেশাময় রূপনগরে। কংকাল গল্পে যেমন জগতের সকল সুকুমার সুদর্শন কান্তিময় কার্তিকেরা বাতাসের ঘ্রাণে ভেসে ভেসে নায়িকার পদতলে এসে নিজেদের উৎসর্গ করে জীবন ধন্য করেছিল , আমাদের তরুণ শিল্পী রিয়াজ তেমনি জগতের সকল প্রেমিকপিপাসুদের প্রতিনিধি হয়ে কার্জন হলের লাল প্রাসাদের এক রূপকুমারীর পদতলে তার সব শিল্পসত্বা নিবেদন করে বসল।

তারপর দোয়েল পাখির ছাই রঙের ডানায় ভেসে শহীদ মিনারের রক্তাক্ত প্রান্তর হয়ে,  বাংলা একাডেমীর মাটির রস নিঙড়ে  শেকড় সন্ধান  সেরে ,টিএসসি তে রাজুর প্রতিবাদী ভাস্কর্যের পদতলে দীপ্ত শপথ নিয়ে , হাকিম চত্বরের কুঞ্জধ্বনির গুঞ্জরণ শেষে , অপরাজেয় বাংলার ধূলিতলে প্রেমদেবতার কাছে অপরাজিত থেকে জীবননাটকের প্রথম অংক শেষ করল।

‘স্যার মাত্র দশটি দিন আমাদের স্বপ্নের দিন ছিল। আমরা তো কোনো অপরাধ করিনি। কারো ক্ষতি করিনি। তাহলে এই শাস্তি কেন এলো আমাদের উপর?’

-‘দেখ, রোগের সাথে অপরাধের কোনো সম্পর্ক নেই। বড় বড় অপরাধীরাও দিব্যি আশি নব্বই পার করে দিচ্ছে। আবার যীশু খ্রীষ্টকে মাত্র তেত্রিশে বিদায় নিতে হয়েছে।’

কথাটা বলে তাবাসসুমের দিকে তাকাতেই বুঝলাম এভাবে  বলা টা ঠিক হল না।

-স্যার, আমার বয়স মাত্র চব্বিশ। আমি বাঁচতে চাই !’

-তুমি বাঁচবে না তো কি করবে? অবশ্যই বাঁচবে। তোমার যে রোগ, হজকিন লিম্ফোমা, এটা হলো ব্লাড ক্যান্সারের মধ্যে সবচেয়ে সহজে নিরাময়যোগ্য। কয়েকটা সাইকেল কেমো নিলেই সব শেষ। আমাদের শিল্পী সাবিনা ইয়াসমীনকে দেখ। দিব্যি ভালো আছেন।

-কিন্তু বারবার হার্টের চারিদিকে পানি আসছে কেন স্যার?

-সেটা হতে পারে। এই রোগে শরীরের বিভিন্ন  জায়গায় পানি আসতে পারে। কেমো কাজ শুরু করলে সব ঠিক হয়ে যাবে।

বুকের এক্সরে বলছে হৃদপিন্ড প্রশস্ত হয়েছে। ইকোকার্ডিওগ্রাম বলছে- হৃদপিন্ডের প্রশস্তের কারণ চারিদিকে পানির উপস্থিতি। যে পরিমান পানি জমেছে তাতে ভর্তি করে সুঁই দিয়ে পুনরায় তা বের করতে হবে।

তাবাসসুম কে সিসিইউ তে ভর্তি করাতে হলো। যাবতীয় সতর্কতা অবলম্বন করে আবারো হার্টের চারদিকে জমে থাকা পানি বের করে দিলাম। আরো কয়েকটা দিন পর্যবেক্ষণে রাখতে হবে।

চেম্বারে  ফাঁকে ফাঁকে আসার সুবাদে রিয়াজ বুঝে ফেলেছে যে, আমি একজন শিল্পভক্ত। বিশেষ করে ভ্যান গগ। আমার রুমে ভ্যান গগের দুটি বিখ্যাত ছবির রেপ্লিকা ঝুলানো আছে। একটি হলো সান ফ্লাওয়ার। আর একটি চার্চ অব নটর ডেম।

ওর কাছ থেকে মাঝে মাঝে শিল্পের বিভিন্ন তথ্য জেনে নিচ্ছিলাম। রেনেসাঁ যুগ, আধুনিক যুগ, ইম্প্রেশনিজম, পোস্টইম্প্রেশনিজম সহ নানান টুকিটাকি।

সৌভাগ্যবশত বাস্তবে চার্চ অব নটর ডেম দেখেছিলাম প্যারিসের নিকটবর্তী অভর সু অইস গ্রামে, যেখানে ভ্যান গগ তাঁর জীবনের শেষ দিনগুলো কাটিয়েছিলেন। আর প্যারিসের মিউজিয়াম ডি অরসে থেকে সংগ্রহ করেছিলাম তাঁর আঁকা মূল পেইন্টিং এর রেপ্লিকা। দুটো পাশাপাশি রাখলে বুঝা যায় যে, বাস্তব আর শিল্পের পার্থক্যটি কি। বাস্তবকে তীক্ষ্ম পর্যবেক্ষণ করে শিল্পী তাঁর মস্তিকে এমন একটি কারুকার্যমন্ডিত পরিমার্জিত ও পরিশীলিত  ছাপ বা ইম্প্রেশন তৈরী করেন যা বাস্তবতাকে হারিয়ে দেয়। এভাবে বাস্তবের আলোকচিত্রের সঙ্গে চিত্রশিল্পের যোজন যোজন পার্থক্য তৈরী হয়ে যায়।

চারদিন পর্যবেক্ষণ শেষে তাবাসসুম কে ছুটি দেয়া গেল। অনকোলজিস্ট এর কাছে কেমো দেয়ার জন্য রেফার করে প্রয়োজনীয় পরামর্শ দিয়ে বাড়িতে পাঠালাম।

বুকের ভেতর একটা আশার আলো দেখতে পেলাম।

প্রায় দুমাস পরে রিয়াজের সঙ্গে দেখা। এ কদিনে তার চেহারায় এক ধরণের পরিপক্কতা পরিচ্ছন্নতার ভাব এসেছে।

– তাবাসসুম কেমন আছে?

– জ্বী স্যার এখন একটু ভালো।

– তোমার শিল্পচর্চা কেমন চলছে?

– ভালো স্যার। আপনাকে নিমন্ত্রণপত্র দিয়ে যাব। আলিয়ঁস ফ্রঁসেজ  আমার একটি একক চিত্র প্রদর্শনীর ব্যবস্থা করেছে।

আমি শুনে খুবই খুশি হলাম। তার প্রদর্শনীতে অবশ্যই যাব বলে কথা দিলাম।

তারও প্রায় দুমাস পরে। মাঝখানে সপ্তাহখানেক দেশের বাইরে ছিলাম। ফিরে এসে চেম্বারের টেবিলে একটি ছাপানো আমন্ত্রণপত্র পেলাম। খামের উপর গোটা গোটা অক্ষরে আমার নাম লেখা। খামের উপরে বাম কোণে একটি মেয়ের  অপূর্ব সুন্দর ছাপচিত্র। দেখামাত্র চিনে ফেললাম। তাবাসসুমের ছবি।

সেদিন শুক্রবার । রিয়াজের একক প্রদর্শনী। আমি যথাসময়ে প্রদর্শনীতে হাজির হলাম। আমাকে দেখামাত্র রিয়াজ এগিয়ে এসে অভ্যর্থনা জানালো। মনে হলো সে আমারই অপেক্ষায় ছিল। বিভিন্ন মিডিয়ার লোকজনও উপস্থিত রয়েছে। সবাইকে অবাক করে দিয়ে রিয়াজ আমার প্রশংসা করে নাতিদীর্ঘ এক বক্তৃতা দিয়ে বসল। আমি তার স্ত্রীর জীবনে এক নতুন মাত্রা দিয়েছি ইত্যাদি ইত্যাদি।

নিজের প্রশস্তি  শুনে খুবই অস্বস্তি বোধ করছিলাম। আমার সামান্য চেষ্টাটুকু করেছি মাত্র। দায়িত্বের বাইরে তো কিছু করিনি।

তবে অন্তর্যামী জানেন একটি সম্ভাবনাময়  তরুণজীবন বাঁচাবার এই অপরিসীম কৃতিত্বে নিজের হৃদয়কে যথেষ্ট প্রশস্ত এবং স্বার্থক মনে হচ্ছিল।

যথারীতি আমাকে দিয়ে ফিতা কাটিয়ে প্রদর্শনীর উদ্বোধন করা হলো। ভেতরে ঢুকে অবাক হয়ে গেলাম। পঁচিশটি ছবি নিয়ে রিয়াজের একক প্রদর্শনী। অপূর্ব সব স্ট্রোক আর রঙের ব্যবহার। কালো রেখার অন্তপুর থেকে এক নিখুঁত আলোর ঝলকানি। যেন আলো আর কালো পরস্পর গভীর অভিসারে  মত্ত। এইসব রঙ রেখার ফাঁক দিয়ে বেরিয়ে আসতে চাইছে একটি বেদনাবিধুর করুণ মুখ। আশ্চর্য ! পঁচিশটি ছবির সবকটিতেই  ভিন্ন ভিন্ন ভঙ্গিমায় একটি মাত্র মুখ।

আলোর সোপান বেয়ে বহুদূরের একটি চেনা মুখ। আরে! এতো তাবাসসুম !

এতক্ষণে তাবাসসুমের কথা মনে পড়ল।

-রিয়াজ! এত সুন্দর করে তুমি এঁকেছ না !একটিমাত্র মুখ। একটিমাত্র বিষয়। অথচ কত বিচিত্র ভঙ্গিমায় তার প্রকাশ। চোখ জুড়িয়ে যায় । মনে প্রশান্তি আনে।

আচ্ছা তাবাসসুম কোথায়?

রিয়াজ হঠাৎ মুখ ঘুরিয়ে দেয়ালে ঝুলানো ছবির দিকে তাকালো।

-এই তো এখানে সে  !  রঙ আর রেখার জালে তাকে বেঁধে রেখেছি স্যার।

চিকিৎসক হিসেবে ভেতরে ভেতরে সঞ্চিত  আমার কিঞ্চিত দক্ষতার ও সক্ষমতার সামান্য গর্বটুকু নিমিষে শূন্যে মিলিয়ে গেল।

প্রশস্ত হৃদয় এবং প্রশস্ত হৃদপিণ্ড যে এক বস্তু নয় তা বুঝতে  জীবনের পঞ্চাশটি বছর কেটে গেল।

এই বিভাগের অন্যান্য লেখাসমূহ

বালির বেহালা

বালির বেহালা

বুড়িমাসি বলেন,জীবনটা বালির ঘর গো।ঢেউ এলে ধুয়ে যায় জীবনের মায়া।তবু বড় ভালবাসা ওদের দাম্পত্যে।রোদের চাদরের…..

তদন্ত

তদন্ত

  এক ড্রইং রুমে বসে রয়েছে সদ্য কিশোর উত্তীর্ণ তরুণ গোয়েন্দা সজীব। সামনের টেবিলে ছড়িয়ে…..