জলরঙের কাব্য

সৈয়দ মনির হেলাল
গল্প
Bengali
জলরঙের কাব্য

হাঁটতেই থাকে পরান। সে জানে এ ছাড়া গতি নেই তার। গলির ধারের বেঞ্চিতে, কি ঐ এঁদো ডোবার মরচেধরা পাড়টায় বসা যায় খানিক্ষণ। কিন্তু তার কেবলই মনে হয়,  চলিশোর্ধ্ব একটা পোয়াতি মুরগির মতো দেখাচ্ছে নিজেকে। পলায়নপর খুনে আসামিও একটা সময় জবুথবু স্থানুর মতো পড়ে থাকে হয়তো। তবুও, ছাঁচে ঢালা মাল-সামানা কিংবা নিরর্থক বাগাড়ম্বের স্তুপ হয়ে বসে থাকতে পরানের অহংবোধে বড় চোট লাগে।

কিন্তু পথ খুঁজে পায় না সে।

মাঠ-ঘাট-খাল-বিল পেরিয়ে, একেবারে প্রান্তসীমায়- একটা প্রান্তিক হাট থেকে বলা যায় হোঁচট খেতে খেতে কেবল এই সেদিনই ফিরল সে। গ্রন্থভূক্ত পয়ারবর্ণনার প্রাগৈতিহাসিক একটা জনপল্লবিত হাট ছিল সেটা। মোয়া-মুড়কি, লবন-কেরোসিন আর আনাজপাতিতে ঠাসা হাটটা আস্তে আস্তে যখন নিভে যাচ্ছিল সমুখে গেঁথে রাখা মশালের ছাই হওয়া সলতের সাথে, তার আগেই পরান বসেছিল তার ছবি আঁকতে।

খাড়া দুপুররোদ তখন হেলে পড়ছে শিমুল গাছটার আরো পশ্চিমে। কেউ মাথায় করে আর কেউ-বা কাঁধে করে হাটের সদাইপাতি বয়ে নিয়ে আসছে যখন, তখন হাটের দক্ষিণ-পশ্চিম কোণের একটা ছাতিমতলায় পরান তার ইজেল বসানোর কায়দা করে। টিউবের রঙে জল মিশিয়ে খুব গভীর মমতায় পরান এঁকে যাচ্ছে তার প্রান্তিকজনের ছবি। নিখুঁত রেখা আর টানে আঁকছে শনে ছাওয়া চালাঘর, বাঁশের খুঁটির ওপর বসানো চাটাই, তার ওপর থরে থরে সাজানো মেথি, হরিতকি, আর তালমিছরি-ভরা চিনামাটির বৈয়াম। পাশেই চালাহীন এক উঁচু ঢিবিতে ক’জন বসেছে পানের টুকরি নিয়ে। কিছুক্ষণ পরপর এক নিখুঁত মুদ্রায় পানি ছিটিয়ে ছিটিয়ে পানপাতার মুর্ছা ভাঙানোর তদবির চলছে। হাট-ফেরৎ এবং হাটে আগন্তুক অনেক মানুষের এলোমেলো ত্রস্ততার মাঝ থেকে কেউ কেউ উঁকি মেরে একঝলক চোখ রাখে, কেউ কেউ মুখ চাওয়া-চাওয়ি করে অস্ফুট গুঞ্জন তুলে কোরোসিনের শিশি দুলিয়ে হন হন করে হেঁটে চলে বাড়ির পথে।  পরানের সামনে ঝুলে থাকা ছবির দিকে হা-করে বিক্ষিপ্তভাবে দাঁড়িয়েছিল যে দু-চারজন যুবক, বোধকরি  এ ছবির মধ্যে আহামরি কোনকিছুর সন্ধান না পেয়ে তাদের মরচেধরা সময়কে বয়ে নিয়ে হাঁটা ধরে করচ-শিকড় অভিমূখে, শ্মশ্রুমন্ডিত কবিয়ালের একতারা-আসরে।

প্রান্তিক জনপদের এই হাট কিংবা হাটের মানুষদের এমন নির্মম নিলিপ্ততায় পরান বড় কাতর হয়। অথচ তার কিছুক্ষণ আগে সে যখন তুলির শেষ আঁচড়টা দিয়েছিল, তার মনে হয়েছিল গুম মেরে বসে থাকা হাট নিশ্চয়ই এবার জানু পেতে বসে পড়বে তার ছবির সাথে বারোয়ারি আলাপে। কিন্তু পরান দেখল তুলির আঁকাবাঁকা রেখা থেকে লাফিয়ে পড়ছে নানান রঙের মানুষ, আর পরমুহুর্তেই চারপেয়ে ধাবমান অশ্বতে রূপান্তরিত হয়ে ছুটে যাচ্ছে সদর রাস্তা ধরে। দেখতে দেখতে বাঁশের চাটাইয়ের ওপর সাজানো মেথি, হরিতকি আর তালমিস্রিরি বৈয়ামগুলো রঙিন রাংতামোড়া হয়ে, কপালে সোনালি টিপ পরে-  শীতল  ফ্রেমে শুয়ে পড়ল। আর হাটের মধ্যে এদিক সেদিক ছড়িয়ে থাকা মাটির ভিটে, বাঁশ, চাটাই কিংবা ছনের চালাগুলো বেওয়ারিশ বেআব্রু হয়ে পড়ে পড়ে কেবল গোঙাচ্ছে তখন।

পরানের ভেতর অতঃপর ছবি আঁকার জেদ চেপে যায় । আর নানান রূপ, নানান রেখায় সে আঁকতে থাকে একটার পর একটা ছবি। সে আঁকে নদী, পালতোলা নৌকা, ভাটফুল, মাটি ফুঁড়ে মাথা উঁচু-করা বাঁশঝাড়, খড়ের গাদা এবং ধঞ্চে গাছের সরল মিতালি; কিন্তু কেউই তার এসব ছবি থেকে বিশেষ কোন খোরাক খুঁজে পায় না, বরং কেউ কেউ  পরানকে ভরাট গলায় পরামর্শ দেয় এইসব অনাবশ্যক প্রগলভতা ছেড়ে  ধাবমান ষাড়, মোষ কিংবা অশ্বের ছবি আঁকতে।   কেউ কেউ  শকুন, চিল, বাজপাখি অথবা  সওদাগরি সাম্পান আঁকার ফরমায়েশ করে।

কিন্তু, পরান আবারো পালায় ।

তারপর হাঁটতে হাঁটতে হাঁটতে-

 

দুই

শেষপর্যন্ত ঘর নেয় সে। প্রাণখোলা আর নরম সে ঘরভর্তি ছিল শুধু মেঘ আর আকাশের খেলা । তারাদের সাথে এখানে কথা চলে অবিরাম।  উপরে শনের টালিঘেরা চাল ছুঁয়ে আছে প্রায় থানকুনি গাছগুলোর মাথা। চারিদিকে মাটির প্রলেপসমেত পাটকাঠির দেয়ালগুলো যেন এক প্রশান্তির আহ্লাদ তৈরী করে রেখেছে। পাটের দড়িবাঁধা বাঁশের সিটকিনি খুলে বের হলেই সমুখে আদিগন্ত সফেদ জলরাশির হাতছানি- একেবারে মরমে ঘা দিয়ে যায়।

হাওরপারের এই ভাসমান জলের দেশ পরানকে ভাসিয়ে নিয়ে চলে এক অথৈ রূপসায়রে। দুলতে থাকে পরান, দুলতে থাকে তার রঙ, রেখা আর মনপবনের নাও। ঢেউয়ের পর ঢেউ আছড়ে পড়ে পরানের রঙ মেশানো জলের বাটিতে। রূপালি ঘুঙুরের মোহময় মুদ্রায় রচিত হতে থাকে চিত্রল মহাকাব্য। খলবলিয়ে হেসে ওঠে পরানের সকাল, দুপুর এবং বিকেলের অনুক্ষণ। আর তার সাথে লেপ্টে থাকে বীনা, লেপ্টে থাকে রঙ, তুলি, ইজেল। পরাণ এঁকে চলে ছোট বড় অসংখ্য গাঙচিলের ধারালো ঠোঁট, নিঃসীম জলের ওপরে উড়তে থাকা দলছুট পতঙ্গের গ্রীবা বরাবর  ছোঁ মেরে গেঁথে নিচ্ছে ক্ষিপ্র উল্লাসে। ছবি আঁকার নেশা পেয়ে যায় তাকে।

বীনার বাপ ঐ হাওর কিংবা বিলের মধ্যেই পড়ে থাকে সারাটা বছর। জাল, মাছ আর বেপারীদের সাথেই তার মোহব্বত-মোলাকাত বেশি। কি বোশেখ কি আষাড়-শাওনের ঝড়-তুফান কি কার্তিকের শীত অথবা চৈতের চান্দিগরম রোদ- সব সময়ই সে আছে নদী, বিল কিংবা হাওরের জলকাদায়।

না না, হাতের কাঁকনটা জলের মতন করন যায় না ? শাপলা ফুলগুলো কিন্তু খুব সুন্দর অইছে। দেন না একটা আমার খোঁপায় গুঁজে ! কথা আর কথা, খই ফোটে বীনার চোখে মুখে। পরান কখনো হাসে, কখনো মাথা ঝাকায়, কখনো বা মূনী-ঋষির মতো চোখ বুজে বসে থাকে ।  চোখের তারায় উড়তে থাকে নানান রঙ আর রেখাময় কথামালা। বসে থাকে বীনাও, এক ধ্যানস্থ যোগিনীর মতো। কিন্তু পরানের মতো তার ধৈর্য্যে কুলায় না অতো। সে ওঠে।  রিনিঝিনি শব্দ তুলে শাড়ির আঁচল ওড়ায়, ছড়িয়ে দেয় গাঙের সবুজ ঘাসে, মাথায় তুলে বউ সাজে। বীনা উঠে বিলের জলের দিকে হেঁটে যায়। হাঁটতে থাকে। তিরিতিরি হাওয়ায় নিস্তরঙ্গ জলে রংরেখা খেলা করে সমানে। দূর থেকে চোখ পড়তেই দেখে পরান ফের বসে গেছে তার ছবির সামনে রঙ তুলি নিয়ে । চৈত্রের শিরিসগাছের মগডালে টক্কর খাওয়া ছেঁড়া ঘুড়িটার মতো একটা পাখি পাক খাচ্ছে আর উড়ছে। ছবিটার সাদা জমিন ব্যাকুল করে তোলে বীনাকে। একটা মাছরাঙা-  তীক্ষ্ণচঞ্চুর মতো ঠোঁট । দ্যাখো দ্যাখো, ডিঙি নৌকাটা কেমন ঢেউরের তালে তালে উপরে ওঠছে আর নামছে। কিন্তু বীনা দেখতে পায় পরান আঁকছে সারা আকাশজুড়ে বিস্তৃত এক রঙধনুর ছবি। স্থির হয়ে বসে থাকে বীনা পরানের কাছ ঘেসে। থরে থরে সাজানো নানান রঙের ঝালর দেওয়া কারুকাজে সে যখন আস্তে আস্তে স্বপ্নময় হয়ে ওঠে, যখন তার আঁটোসাঁটো বিহঙ্গমন উড়বার জন্য পালক মেলতে শুরু করে, তখন সে দেখতে পায় রঙধনুর নিচে বিশাল জলরাশি ফুঁস করে তেড়ে আসছে চরগাঁওয়ের দিকে। বীনা আরো ঘনিষ্ট হতে থাকে রঙধনু আঁকতে থাকা পরানের নরম আঙুলের কিনারে। কিন্তু ততক্ষণে আকাশ কালো হয়ে ভীষণ তোলপাড় ওঠে, এক মহারণে জল আর আসমানের তোলপাড় করা সাগরসঙ্গমে ঢেকে যেতে থাকে বিস্তৃত রঙধনুর যাবতীয় সৌকর্য। খোদার আরশ চৌচির হয়ে উড়তে থাকে আগুনের ফুলকি, আর তার মাঝে ডুবতে ডুবতে- ভাসতে ভাসতে দিক হারায় একা এক ডিঙি নৌকা।

বীনার এতোদিনে জানা হয়ে গেছে, আয়নাল মিয়া- যার সাথে এমনি এক ঝড়ের রাতে মেহেদি রাঙা হাতে হাত রেখেছিল, সে আর ফিরবে না। তবু বীনার প্রতি কোনধরণের ভ্রুক্ষেপ না করে পাষাণ তুলিতে এঁকে চলে পরান তার জলরঙের বর্ণমালা।

 

তিন

সারা হাওরজুড়ে যখন মাছধরার মওশুম চলছিল, তেমনি এক বৈকাল বেলা চারপুরুষের টিকা-টিঁকুজিসহ মামুজির খোঁজে এলোমেলো এক যুবক আয়নাল মিয়া আবির্ভূত হয়েছিল বীনার বাপের সামনে। তিন দিনের জ্বর-কাশিতে কাবু হয়ে নিস্তেজ পড়ে থাকা বীনার বাপ  সেদিন আয়নাল মিয়াকে পেয়ে যেন একটা অবলম্বন খুঁজে পান। আয়নাল মিয়া তার পরিচয়পর্বটা যথাসম্ভব সঠিক বর্ণনায় তুলে ধরে এবং বীনার বাপ তার মা বাপের খোঁজ-খবর নিতে পারেন নি বলে আক্ষেপ করে যখন তাদের বেহেস্তনসিব প্রার্থনা করেন, তখন আয়নাল মিয়া তার মায়ের হাত ধরে নেংটো কালে এ বাড়িতে আসবার স্মৃতিচারণ করে, এবং তখন তার নিজের মধ্যে  হালকা একটা অনুভূতি খেলে যায়।  বীনার বাপ সঙ্গত কারণেই তখন মাছধরার মৌসুমটা মামু-ভাগনে মিলে ভালোভাবেই উদযাপন করবার ফিকির করছিলেন, আর ঠিক এমন সময় বীনার সপ্রতিভ উপস্থিতি বীনার বাপকে আরো বাচাল করে তোলে। বীনার মায়ের মৃত্যু, বীনাকে নিয়ে তার নানারকম দুশ্চিন্তা, নিজের শরীরের ভাবগতিক ভালো না যাওয়া- ইত্যকার নানান কথা একনাগাড়ে বলে গেলেও আয়নাল মিয়াকে পেয়ে তিনি যে আজ খুব খুসি সে কথাটা বলতেও ভুলে যান নি। অতঃপর বছর না ঘুরতেই বীনাকে সপে দিলেন আয়নাল মিয়ার হাতে।

পরানের মধ্যে সঞ্চরণশীল ভাব-অনুভাব সম্পর্কে কিছুই জানা গেল না তার অংকনমগ্নতার কারণে। স্থির হয়ে বসা বীনার ঠোঁট, মুখ, গ্রীবা এবং দুই হাতের মৃদু তৎপরতার দিকে পরানের মুগ্ধদৃষ্টি ছিল যদিও বা এবং এতে করে যে কেউ পুলকিত হতে পারে বটে, তথাপি জলরঙের ছায়ানির্মাণে তার দীর্ঘ মনোনিবেশ সকল কিছুকে একরৈখিক করে তোলে । পরান যখন উপুড় হয়ে তার জলরঙের বাটিতে গভীর  নিরীক্ষারত, তখন দেখা যায় বীনা হেঁটে হেঁটে একেবারে জলের কিনারে গিয়ে দাঁড়িয়েছে। আর ঢেউয়ের পর ঢেউ এসে ভিজিয়ে দিচ্ছে বহুবিধ বীনার পশ্চাতজগতকে। নিরাবরণ বীনার সামগ্রিকতা থেকে টপটপ করে ঝরে পড়তে থাকে আনকোরা জলের ওমগরম ফোটা। পরান তার স্বাভাবিক ঔদাসিন্য নিয়ে আবারো দাঁড়িয়ে পড়ে দন্ডায়মান ইজেলের মুখোমুখি।

কিন্তু জলের সাথে লেপ্টে থাকা আয়নাল মিয়া বীনার সোহাগী ছোঁয়ায় এক অন্য মানুষ হয়ে ওঠতে থাকে দিনদিন। জল জাল এবং মাছ থেকে সে ঘরেই পড়ে থাকত দিনের বেশিটা সময়। পায়ের কাছে আছড়ে পড়া ঢেউয়ের শুভ্র ফেনায় লুটোপুটি খায় চিরকালীন দুই মানবশিশু; আর বিক্ষিপ্ত ছড়িয়ে থাকা হিজল তমালের ছায়াঘেরা ঘর-গেরস্থালি হয়ে ওঠত এক স্বপ্নিল ক্যানভাস। দিন চলে যায়, কিন্তু কথা যেন আর ফুরাতে চায় না তাদের। একদিন ভীষণ ক্ষেপে ওঠেন বীনার বাপ। বিল থেকে বয়ে আনা মাছের চাঙাড়িটা এক ঝটকায় ঘরের দাওয়ায় আছড়ে ফেলে হন হন করে বিল-পারের দিকে দিশা করেন, আর কই টেংরাগুলো কানকা দিয়ে উজানের দিকে যাত্রা করে সহিষ্ণু পর্বতারোহির মতো।

শালার পুত বাদাইম্যা কোনহানকার, বসি বসি ঘরর ভাত গিলতে শরম  করে না ? বাপের এমন রোয়াব দেখে আতঙ্কে হিম হয়ে জমে যেতে থাকে বীনা।  ধামড়ি মাইয়া, বিয়ান হওয়ার আগেই ঐ জাইল্যার পুলারে গাঙে পাঠাইবা, আর না অয় ত বিলের পানিত দম বন্ধ করি নিজেই ডুব দিয়া শিং-মাগুরের গর্দান ধরে তুলে আনবা জমিনে, বুঝছ ?

একলা এক আয়নাল মিয়ার জাত-গরিমায় বড় চোট লাগে সেদিন। ঘুম আসে না তার, কেবলই ছটফট করতে থাকে। যতই রাত গভীর হতে থাকে-  হাওরের ডাক ততই তার কানে নাচের ছন্দ তুলে শিহরণ জাগায়, এবং আয়নাল মিয়া রাত শেষ হওয়ার আগেই হাওরের দুরন্ত আফাল ঠেলে বেরিয়ে পড়ে ডিঙি নৌকা, বৈঠা আর জাল নিয়ে।

তারপর বীনা দেখতে পায়, চোখের পলকে ছেড়াবেড়া হয়ে গেল ইজেলের ওপর দাঁড়িয়ে থাকা জলরঙের সমস্ত বিত্ত-বেসাত। বৃত্তাকার রঙধনু ঢেকে যায় ছোপ ছোপ কালো পর্দায়। চিৎকার করে ওঠে বীনা, কিন্তু পরক্ষণেই অর্থহীন সকল ধ্বনিসমষ্টিকে পেছনে ফেলে পরান নির্বিকার হেঁটে যায় জলের দিকে।

অবশ্য তার আগেই জানা হয়ে গিয়েছিল, হাওরে যাওয়ার ঐ শেষ রাতে প্রচন্ড ঝড়-জলোচ্ছ্বসের পর আয়নাল মিয়াকে আর কেউ খুঁজে পায় নি; এবং ইতোমধ্যে তার জানা হয়ে গেছে যে, বিগত শতেক বছরে এমন ঝড় নাকি দেখে নি কেউ আগে।

 

চার

পরান চেয়ে থাকে জলের অনিঃশেষ স্থির জমিনের দিকে। পাখিদের দিগন্ত ছোঁয়া ওড়াওড়ি, ডিঙি নৌকার সপসপ আওয়াজ আর ঘন বৃক্ষমন্ডলীর ফাঁক গলে লীন হওয়া হলুদ সূর্য দেখতে দেখতে চষে বেড়ায় সে সমস্ত চরগাঁও, আর হাওরের জল-মাটিতে প্রতিদিন ভরে ওঠে পরানের শূন্য ক্যানভাস। দেখা এবং আঁকার কাজে বীনা তার সার্বক্ষণিক সাথী। কিন্তু কতরকমেই চেষ্টা করেছে বীনা পরানের ছবিগুলো একটু হাত দিয়ে ছুঁয়ে দেখবে, কিন্তু কী এক আড়ষ্টতায় বারবার কুঁকড়ে যায় সে। এক অবাধ্য পিয়াসায় সে পড়তে চেষ্টা করে পরানের বিবিধ রঙের ভাষাকে;  কিন্তু বড় দুর্বোধ্য ঠেকে, ব্যর্থ হয়ে বারবার ফিরে আসতে হয় তাকে।  ঘন্টার পর ঘন্টা দাঁড়িয়ে থাকে সে, কিন্তু তল খুঁজে পায় না কোন। আস্তে আস্তে এমন হতে থাকে, বীনা দেখতে পায় পরানের ছবিগুলো যেন শুধু দূরে চলে যাচ্ছে তার থেকে। সে আর খুঁজে পায় না তার চোখের সীমানায়। অবুঝের মতন তারপরও বসে থাকে সে। বসে থাকে পরানের ক্যানভাসের এক মিথ্যে ‘গাঁয়ের বধূ’ হয়ে। কিন্তু সে ছুঁতে পারে না কিছুই; না তুলি, না ইজেল, না পোস্টার পেপারটি। কতদিন তার মনে হয়েছে, সে একটু ছুঁয়ে দেখবে পরানের হাতে ধরা তুলিটি, কিন্তু পারে নি। মাঝে মাঝে পরানের আঙুলটি, তার হাতটি ধরতে বড় ইচ্ছে হয়, কিন্তু সে দেখতে পায় সমস্ত ক্যানভাসসহ পরান আর বীনার মধ্যে এক তীব্র দেয়াল উঠে যাচ্ছে ক্রমশ।  সে এক বিচ্ছিন্ন বিন্দু হয়ে মিলিয়ে যাচ্ছে জলের নিচে।

বীনা অবশেষে হাঁপিয়ে ওঠে। তার সর্বাঙ্গ থেকে ঝরে পড়ে আকুল করা নিবেদন- এমন একটা জলের মানুষকে আঁকতে পারো না তুমি, যা মলিন হবে না জরাগ্রস্ততায় কোনদিন ? দোহাই লাগে- তুমি থামো এবার, তোমার এই ফুল পাখি-বেষ্ঠিত হাসিমুখের ছবিগুলো আমাকে মোহগ্রস্থ করে দিচ্ছে, অথচ আমি  জলের পিঠে পা চালিয়ে ঐ দিগন্তরেখার দিকে ছুটে যাব বলে তোমার পাশে বসে থাকি রোজ ! তারপর, নিঃশব্দের ভেতর থেকে আড়মোড়া ভেঙে উঠে দাঁড়ায় বীনা। ইজেলে গেঁথে রাখা সমূহ কাঁচা-পাকা ছবি টান দিয়ে ছিঁড়ে ফেলতে থাকে কুটিকুটি করে, এবং পরানের হাতধরে টেনে নিয়ে চলে উঁচু ঢিবির ওপর মাটির দেয়াল তোলা ঘরের দিকে।

সারা রাত একফোটাও ঘুমাতে আরে নি পরান। চোখ বুজলেই দেখতে পায় তার সিথানে ভাজ করে রাখা সমস্ত ছবি একটার সাথে আরেকটা ঠুকাঠুকি করছে, জলরঙের ক্যানভাস থেকে ঝরে পড়ছে ফোটাফোটা রক্তের ধারা। ভীষণ তেষ্ঠায় সে যখন ইজেলে ভর করে উঠে দাঁড়াতে চেষ্টা করছে তখন বীনার খোলা বুক দেখে চমকে ওঠে, ঠিক বীনার স্ফুর্তিভরা কণ্ঠ শোনা যায়- দ্যাখো দ্যাখো, এই- এইখানে বসবাস করে অগুনতি খাঁপখোলা চাঁদ, তুমি নিঃশেষে পান করে যাও সে চাঁদের বেহুস আলো-

পরান কিংবা পরানসংক্রান্ত একটা চিহ্নও আর খুঁজে পাওয়া গেল না সমস্ত চরগাঁওয়ের সকালে।

 

পাঁচ

পরান পালায়। বাঁচতে চায় পালিয়ে থেকে, এবং যত্নে আঁকা ছবি, তুলি আর ইজেল তাকে দাবড়িয়ে নিয়ে চলে অনবরত। বিবিধ অমীমাংসার দ্বন্দ্বে দুলতে দুলতে- ঝুলতে ঝুলতে অবশেষে প্রশস্ত এক নীল চাঁদোয়ার সাথে সাক্ষাৎ ঘটে তার। সেখানে ঝলমলে তারাবাতির উচ্ছ্বলতা স্বাগত জানায় পরানকে।

এবং অনায়াসেই সবকিছু পাল্টে যায় কয়েকদিনেই মাত্র।  সেই মধ্যবয়সী দম্পতি অনেকগুলো জ্যোৎস্না-ধবল ছবি বাছাই  করেছিলেন সেদিন। কথা বলতে বলতে কালো গ্লাস-মোড়া প্রকান্ড গাড়ির দরজা অবধি এগিয়ে গিয়েছিল পরান তাদের বিদায় জানাতে। মধ্যবয়সী ভদ্রলোক তার পিঠে হাত রেখে একটা ভিজিটিং কার্ড তুলে দিয়েছিলেন পরানের কম্পমান হাতে। তারপর একে একে  দৃশ্যান্তর হতে থাকে জল-জলা আর খড়বিছানো সময় । মেটো দুনিয়ার গেয়ো সমাচারের যবনিকাপাত শেষে উদয় ঘটতে থাকে ইটবিছানো পলেস্তারা; কুর্ণিশ জানায় পরানকে।  ঝকঝকে তকতকে নর এবং নারীসমেত পরিপাটি দৃশ্যাবলি  হেসে উঠে পরানকে রঙিন করে দেয়। দিনরাত আঁকতে থাকে পরান। মূর্ততার সারল্য ভেঙে বিমূর্ত হতে থাকে গৃহবাসী পায়রা, মুক্তাফলা ঝাড়বাতি আর ইউক্যালিপটাস ডালিয়া। জলরঙের স্থান দখলে নেয় চকচকে তেলরঙের পসরা; নানান ধরণের হ্যাট, বিবিধ পরিমাপের বুট আর চাবুক-বন্দুকে ভরে ওঠে কংক্রিটের ক্যানভাস। চারদিকে জোর হাততালি পড়তে থাকে মুহুমুহু। প্রতিদিন ছবির হাট, প্রদর্শনী চলতে থাকে আজ এখানে তো কাল ওখানে।

কিন্তু একই আবর্তনে হাফিয়ে ওঠে পরান। মাটির দলা পাকানো গুলতির ব্যর্থ নিশানা নিষ্ফলা সূর্যের দিকে ছুঁড়ে দেয় একটার পর একটা। এক শূন্য প্রান্তরে পরানের দিন নিভে যায় প্রতিদিন। আর নির্ঘুম রাতের ভেতর বৃষ্টির প্রার্থনায় মেঘের ফাঁকে ফাঁকে হামাগুড়ি দেয় সে । বৃষ্টির নরম একটা ছোঁয়া কিংবা একফাঁলি চাঁদের ওম পাওয়ার জন্য ছটফট করতে থাকে সে।

আবারো পথে নামে পরান; পথ খোঁজে, হাতড়ায় আর বেজান হাঁটতে থাকে।

 

ছয়

সামনে নিঃসীম শূন্যতা, মনে হয়- এ পথ যেনো শেষ হবার নয় কোনদিন। এতক্ষণ বেশ শীত শীত লাগছিল। ওভারকোটটা গায়ে দিয়েই পা চালিয়েছিল আশপাশ না তাকিয়েই। এখন চনচন করছে গরমে। ঘাম দিয়ে যেন জ্বর ছাড়ল এখনই। আনমনেই হেসে উঠে পরান। দেখ দেখি কান্ড ! ওভারকোটের বোতাম খুলতে যেয়ে দেখে এক জায়গার বোতাম আরেক জায়গায় পুরে রেখেছে। হ্যাঁ, একটু দম নেওয়া দরকার। পরান দেখতে পায় গলির শেষ মাথায় একটা পান-বিড়ির দোকানের ভাঙাচোরা চোয়ালের চাচা মিয়া দিনের ক্লান্তিতে নুয়ে পড়ে তার ঝাঁপ লাগানোতে ব্যস্ত। চাচা, একটা স্টার- পকেট হাতড়ে টাকা বের করে দাঁড়িয়েই থাকে বেকুবের মতন। চাচা মিয়া বিরক্তিসহকারে চেয়ে থাকে তার দিকে। তারপর নিজের কাজে মন দেয়। চাচা, একটু আগুন—। চোখে কম দেহেন নাকি, ঐ যে দেহেন–। শরমে তার মাথা কাটা যাওয়ার দশা। হ্যাঁ, একটা পাকানো দড়ি ঝুলছে লাইট পোস্টের গা বেয়ে। দড়িটা হাতে নেয় পরান। খুবই সাধারণ, অথচ কী সৃজনবোধ, দড়িটা দেখে খুব অভ্যস্ত সে। কিন্তু আজ সে দড়িটাকে দেখতে থাকে অন্যভাবে। সকালে হয়তো আগুন জ্বালানো হয়েছে, কিন্তু জ্বলে চলেছে সারা দিনমান। আগুনের এই দড়ি পরানের মাথায় জট পাকাতে থাকে।

না, অতোশত ভাববার সময় নেই তার। সামনে এখনো অনেক পথ বাকি। স্টার সিগারেটটা বাম হাতের দুই আঙুলের ফাঁকে চেপে ধরে বার দুই জোর টান দেয়। মুখভর্তি ধোঁয়া ছেড়ে পা চালনা করে পুনর্বার। পরানের মাথায় তবু দড়ি পাকাতে থাকে। চোখের ওপর ঝুলতে থাকে পাকানো দড়ির লাল লাল টিপ।  পথটাকেও মনে হয় পাকানো দড়ি। কেবল এঁকেবেঁকে ছুটে চলেছ, শেষ হতে চায় না।

তারপর বীনার সামনে এসে দাঁড়ায় পরান। সেই চেনা গাছ-বৃক্ষ-নদী, সেই জল-মাটির চরগাঁও ঘিরে দাঁড়ায় দুজনকে। বীনার দুটি হাত তুলে নেয় পরান নিজের হাতের শক্ত বাঁধনে। কিন্তু বীনা খুঁজতে থাকে পরানের রঙ আর তুলি, অনুবাদ করতে চায় তার অগ্র-পশ্চাৎ, আদিঅন্ত । নিরাবরণ পরান মেলে ধরে নিজেকে, এবং বীনা স্পষ্ট দেখতে পায় পরানের জলরঙের ক্যানভাস থেকে সকল অপার্থিব রচনাবলি উড়ে যাচ্ছে ধোঁয়ার কুন্ডলী হয়ে।  এবং অনতিবিলম্বে আসমান কালো হয়ে শোঁ শোঁ বাতাস বইতে থাকে প্রচন্ড বেগে। গুরুগুরু গর্জন আর বিদ্যুৎ চমকে সমস্ত হাওরপার যখন জেগে উঠতে থাকে, যখন আলোর ঝিলিকে  আগুনের ছররা ছুটতে থাকে চারিদিকে, তখন পরানকে দেখা যায় তার পিঠে ঝুলানো চিত্রাবলি নিয়ে নিরুদ্বিগ্ন বীনাকে আঁকড়ে ধরে আছে। আর তখনই হৈ হৈ রবে সমস্ত চরগাঁও মাথায় তুলে নাচতে থাকে বীনার বাপ, বেজান ছুটছে আর চিৎকার করছে-

বেশুমার রুই-কাতল-বোয়াল-গজার বিলের পানিতে শূন্যে লাফাচ্ছে দ্যাখো, ঐ- কইরে তোরা, ডিঙি নাও আর জাল-চাঙাড়ি নিয়ে বিলের দিকে দৌড়াও দলবেঁধে সকলে-

হাসতে হাসতে লুটোপুটি খায় বীনা- হাওরপারের মাইনষের কাছে ঝড়-তুফান এক উৎসবের দিন গো ! তারপর লগি-বৈঠা নিয়ে ডিঙি নাওয়ের গলুইয়ে দাঁড়িয়ে জোর ধাক্কা দেয় এক, জলের পিঠে দূর-পিদিমের মতো নাচতে থাকে বীনা।  বিদ্যুৎ চমকের সাথে মাথার উপর দিয়ে আগুনের আরেকটা হল্কা ছুটে গেলে সাহসী হয়ে ওঠে পরান এবং লাফ দিয়ে নেমে পড়ে হাওরের সাঁতার-জলে। ডুবতে ডুবতে প্রাণপণ এগিয়ে চলে বীনার ডিঙির দিকে। চিৎকার করে বীনাও ঝাপ দেয় হাওরের জলে। তার আগেই পরানের পিঠে ঝুলানো সমস্ত প্রিয় চিত্রকর্মগুলো বুঁদবুঁদ হয়ে ভেসে ওঠে, আর দুজনের মাঝখানে এক চক্রব্যুহ রচনা করে গড়িয়ে যেতে থাকে ভাটির দিকে। এমন এক দ্বান্দ্বিকতার মুহূর্তে দেখা যাবে হাওরের সীমাহীন প্রান্তরজুড়ে জলরঙের এক বর্ণিল চিত্রপট রচিত হচ্ছে আর তারই সীমানার শূন্য বিন্দুতে এসে পরান আর বীনা এক দীর্ঘ আলিঙ্গনে বেঁধে ফেলে পরস্পর, সেখানে বীনার উদোম বুকের সাথে লেপ্টে আছে তার সমান বয়সী অগুনতি হলদে চাঁদের ওম । তারপর জলরঙের ক্যানভাস হয়ে তারা ভেসে চলে হাওরজলের দুর্বার যৌবনের দিকে।

সকলেই জানে, বিল-হাওরের জিয়ল মাছ বশীকরণে চরগাঁওয়ের পরান জাইল্যার সমান আর একজনও নাই।

সৈয়দ মনির হেলাল। লেখক ও আইনজীবি। জন্ম ও বাস বাংলাদেশের সিলেট।

এই বিভাগের অন্যান্য লেখাসমূহ

বালির বেহালা

বালির বেহালা

বুড়িমাসি বলেন,জীবনটা বালির ঘর গো।ঢেউ এলে ধুয়ে যায় জীবনের মায়া।তবু বড় ভালবাসা ওদের দাম্পত্যে।রোদের চাদরের…..

তদন্ত

তদন্ত

  এক ড্রইং রুমে বসে রয়েছে সদ্য কিশোর উত্তীর্ণ তরুণ গোয়েন্দা সজীব। সামনের টেবিলে ছড়িয়ে…..