জলে জঙ্গলে (পর্ব- ১০)

মাসুদ আনোয়ার
উপন্যাস
Bengali
জলে জঙ্গলে (পর্ব- ১০)

‘তালতো, তালতো…’ কে যেন ডাকছে কাকে। অনেকক্ষণ ধরে শুনছি। চেঁচামেচির চোটে ঘুম ভেঙে যাচ্ছে। বিরক্তি বোধ করছি। কে ডাকে?

‘অই তালতো! তালতো!’ কে যেন ধাক্কা মারল গায়ে।

আরে! ধাক্কা মারে কে রে? কী ব্যাপার, ঘুমোতে দেবে না নাকি?

‘অই, গার উপর ঠাণ্ডা হানি মারি দে। এখন লাফ দি’ উইটব।’

ঠাণ্ডা পানি ঢেলে দেবে মানে? পুরোপুরি সচেতন হয়ে উঠলাম। ঠাণ্ডা পানি মেরে দেয়ার প্রস্তাবটা কার, বুঝতে পারলাম। গলাটা সিরাজের। ঘুম ভেঙে গেল। চোখ মেলতে গিয়ে মনে হলো কে যেন আঠা দিয়ে জুড়ে দিয়েছে পাতা।

মমিন চিকন গলায় বলল, ‘তালতো, উডেন উডেন। নৌকা ছাইড়ত অইব। চারিমিক্যা হ’র অই গেছে গই। উডেন।’

নৌকা ছাইড়ত অইব! চট করে মনে পড়ল আমি এখন নৌকার নাইয়া। জায়গাটা কাপ্তাই। আমার বাড়ি নয়। এখন আর শুয়ে থাকা যাবে না।

আড়মোড়া ভেঙে উঠে পড়লাম। গা থেকে ছুঁড়ে ফেললাম বস্তাটা। খুলে ফেললাম পরনেরটাও। মনে হলো ওরা হয়তো বস্তা গায়ে দেয়া নিয়ে হাসাহাসি করবে। কেউ কিছু বলল না। সিরাজ আর ফয়েজ নৌকোর পানি সেচে বাইরে ফেলছে। টিনের শব্দ হচ্ছে ঢঢং ঢং। মমিনের নির্দেশে নিচে নামলাম। আমাদের পাশের কিস্তিটা ছেড়ে দিয়েছে। সোজা উত্তরে চলেছে ওটা। ঘাটে বাঁধা ছোট বড় অন্য নৌকোগুলোও ছেড়ে দিয়েছে। বেশির ভাগই কাল রাতে আমরা যেদিক থেকে এসেছি সেদিকে অর্থাৎ কাপ্তাইয়ের দিকে যাচ্ছে।

‘দেন তালতো, রশি খুলি দেন।’ ছইয়ের ওপর উঠে হালের গোড়ায় বসল মমিন। আমি রশি খুলে দিয়ে কাঠের সিঁড়ি বেয়ে নৌকোয় উঠে টেনে নিলাম তক্তাটা। ‘হ্যাঁ, এইবার লগি লন। ঠেলা দেন।’

বাঁশের লগিটা হাতে নিলাম। মোটা গোড়াটা নিচে মাটির সাথে ঠেকিয়ে ঠেলাম দিলাম। ঘাট ছাড়ল নৌকো।

‘দেন, এইবার দাঁড়ে টান দেন।’ হালের গোড়ায় যুত হয়ে বসল মমিন।

তিন দাঁড়ের মাঝখানের দাঁড়টা আমি টেনেছি কাপ্তাই থেকে নৌকো ছাড়ার পর। ওটাই বাইতে শুরু করলাম। সিরাজ আর ফয়েজ এখনো পানি সেচে শেষ করতে পারেনি। বড় নৌকোর পানি সহজে ফুরোয় না। একঘেয়ে শব্দ হচ্ছে ঢঢং ঢং…।

সূর্য ওঠেনি এখনো। কিংবা উঠলেও পুবদিকের পাহাড় পেরিয়ে আসতে পারেনি। চারদিক অবশ্য ফরসা। আকাশের কিনারায় কুয়াশার পর্দা টাঙানো। হ্রদের পানিতে ঝিরঝিরে ঢেউ। নয়াবাজার থেকে উত্তর দিকে যাচ্ছে আমাদের নৌকো। পানির মাঝে মাঝে ছোটবড় পাহাড়। তার ফাঁকে ফাঁকে পথ।

সিরাজ আর ফয়েজের পানি সেচার কাজ শেষ। ফয়েজ এসে দাঁড়াল গলুইয়ের ওপর। বিড়ি ধরাল। তারপর শুরু করল দাঁড়টানা।

সিরাজ কই? ছইয়ের ভেতর কী করছে কে জানে? দেখা যাচ্ছে না গলুই থেকে। আমাদের দুই দাঁড়ের টানে কিস্তি এগিয়ে চলেছে ঢিমে তালে।

সামনের দিকে পাহাড় ঘন হয়ে উঠছে। বড় বড় গাছ, বুনো লতা আর শনে ভরা। জীবনে এই প্রথম পাহাড় দেখছি। না, ঠিক প্রথম দেখছি বলা যাবে না। এর আগে সীতাকু-ের পাহাড় দেখেছি। কিন্তু এতটা কাছে থেকে নয়। মজার ব্যাপার হলো, এগুলোকে ঠিক পাহাড় মনে হচ্ছে না। পানির বুকে জেগে থাকা টিলা-টক্করের মতোই দেখাচ্ছে। এসব পাহাড়ের ওপরের অংশ। গোড়ার দিকটা ডুবে গেছে অঠাঁই পানিতে। কখনো আর জাগবে না।

সিরাজ এসে যোগ দিয়েছে দাঁড়টানায়। তিনজনে মিলে বিড়ি টানছি। সামনের পথটা আস্তে সরু হয়ে উঠছে। মনে হচ্ছে দুই পাহাড়ের মাঝে হারিয়ে গেছে পথ। আর এগোনো যাবে না। কিন্তু আরেকটু যেতে সে বদ্ধ পথটা আস্তে আস্তে প্রসারিত হচ্ছে। এখন আমরা দু’দিক থেকেই একেবারে পাহাড়ের কোল ঘেঁষে যাচ্ছি। দু’পাশে নিঝুম পাহাড়। গাছপালা আর লতাপাতার ঠাসবুনোট। দাঁড়ের ক্যাঁ-কোঁ আর পানির ঝপাঝপ শব্দ ছাপিয়ে উঠে কানে এসে বাজছে ঝিঁঝিঁ পোকার ঐক্যতান। মাঝে মধ্যে হরিণের কর্কশ ডাক আর উল্লুকের হুকু-হুকু-উ আওয়াজ।

পাহাড়ের ভেতর দিয়ে এঁকে বেঁকে যাচ্ছে সাতশ মণী কিস্তি নৌকো। এত আস্তে আস্তে যে দু’দিকের পাহাড়ের দৃশ্যমান প্রায় প্রতিটি জিনিসই দেখতে পাচ্ছি অনেকক্ষণ ধরে।

আমার হাতের জ্বলুনি শুরু হয়েছে আবার। ফয়েজের পরামর্শ অনুযায়ী মুঠো খুলছি আর বন্ধ করছি। ভালোই কাজ হচ্ছে দেখছি। মুঠো খোলার সাথে সাথে ঠাণ্ডা বাতাস লেগে জ্বলুনির তীব্রতা কমছে কিছুটা। দু’হাতের তালুতে বুড়ো আঙুল ছাড়া বাকি আঙুলগুলোর গোড়ায় ফোস্কা পড়ে গেছে। এর মধ্যে গোটা তিনেক গেছে ফেটে। লাল মাংস দেখা যাচ্ছে। বাকিগুলোও খুব শিগগিরই ফাটবে মনে হয়। খুব একটা পাত্তা দিচ্ছি না জ্বলুনিকে। নানা কায়দা করে দাঁড় টানছি।

কেউ কথা বলছি না। নীরবে দাঁড় টেনে চলেছি। হালের গোড়ায় মাঝি পর্যন্ত চুপ। গতকাল রাতের মতো রূপবানের গানের সুর শোনা যাচ্ছে না। পাহাড়ের ফাঁকে ফাঁকে এঁকে বেঁকে যাচ্ছে আমাদের নৌকো। বুঝতে পারছি না কখন শেষ হবে পথ চলা। শুনেছি সুবলং নামের এক জায়গায় যাচ্ছি। কোথায়, কতদূরে সুবলং?

নীরবতা ভেঙে ফয়েজকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘সুবলং আর কত দূরে?’

‘কত দূরে?’ ফয়েজ নয়, হেসে উঠল সিরাজ। ‘বহুত দূরে। এক্কেবারে ওম মারে মার আগাত।’

‘ওম মারে মা’র আগাত! আগাত মানে তো আগায়। আমাদের অঞ্চলের ভাষায় এরকমই বোঝায়। কিন্তু তাহলে ‘ওম মারে মা’ মানে কী? এটা কি কোনো জায়গার নাম? জায়গার নাম ‘ওম মারে মা’ কী করে হবে?

বললাম, ‘বুঝলাম না। ‘ওম মারে মা’ মানে কী?’

‘‘ওম মারে মা’ মানে ওরে বাপরে বাপ। এইডা বুজেন তো? বুইজবান, বুইজবান। নৌকাত চাকরি যখন কইরতে আইছেন, তখন সব বুইজবান। বুজন লাইগব।’

কোনো জবাব দিলাম না। বুঝতে পারছি, ছেলেটা আমার সাথে ফাজলামো করছে। কেন করছে সেটা বুঝতে পারছি না। খুব কষ্ট আর অপমান লাগছে। ছেলেটা আমাদের গ্রামের, তার ওপর ওর কথা মতো আমার ছোটবেলার ক্লাসমেট না হলে এতটা কষ্ট পেতাম না। ও আমার শিক্ষাদীক্ষা এবং পারিবারিক মর্যাদা দুটোই জানে। জেনে শুনে কেন এটা করছে?

ফয়েজ অবশ্য ভালো ভাবে জবাব দিল। বলল, ‘সুবলং যেতে যেতে আজ বিকাল হয়ে যাবে, তালতো। হাঁঝও অইতে পারে।’

তার মানে সারাদিন দাঁড় টানতে হবে? ঘাবড়ে গেলাম। হাতের জ্বলুনিও যেন বেড়ে গেল হঠাৎ। কিছু বললাম না। কী বলব? চাকরি করছি তো।

পাহাড়ের ফাঁকে ফাঁকে লম্বা আঁকাবাঁকা এই পথটার নাম ধানপাতার ফোঁড়। নামটা গতকাল শুনেছি ফয়েজের মুখে। সে মমিনকে বলেছিল ধানপাতার ফোঁড়ে নাকি শান্তিবাহিনীর উৎপাত। আজ ফোঁড়ের ভেতর দিয়ে যেতে যেতে দু’পাশের জঙ্গলের দিকে তাকাচ্ছি। শান্তিবাহিনী ধরবে টরবে না তো! তাহলে খুব একটা খারাপ হবে না। শান্তিবাহিনীর নাম শুনেছি। দেখতে চাই তারা কী রকম। নিশ্চয় খারাপ ধরনের কিছু হবে। নাইয়া-মাঝিরা তাদের ভয় পায়, রাতে বিরাতে নৌকো চালাতে চায় না। ভয়ঙ্কর না হয়েই যায় না। কিন্তু ভয়ঙ্কর হলে শান্তিবাহিনী নাম কেন?

পাহাড়ের চিপা থেকে নৌকো আবার প্রসারিত পথে পড়ল। একটা জিনিস দেখতে পাচ্ছি। হ্রদের পানি টলটলে পরিষ্কার। নদীর পানির মতো ঘোলাটে নয়। দাঁড়ের পাতার সঙ্গে সশব্দ সংঘর্ষে ছলকে উঠছে। ছিটকে পড়ছে সামনের দিকে। ছোট ছোট ঘূর্ণি তুলে চলে যাচ্ছে পেছন দিকে। নৌকো এগোচ্ছে সামনে।

সবুজ। আল্লার দুনিয়ায় এত সবুজ আছে কে জানত? সামনে পেছনে, ডানে বামে পাহাড়ের পর পাহাড়। লাল মাটির পাহাড়ের গোড়ায় নীল পানি আর সারা গা জড়ানো সীমাহীন সবুজে। মাথার ওপরে অসীম নীলাকাশ। মৌন পাহাড় আর নির্বাক আকাশের অপলক দৃষ্টি বিনিময়। সৃষ্টির প্রথম লগ্নে শুরু, শেষ হবে হয়ত সে ধ্বংসে।

শীতের রোদ গায়ে আরাম ছড়িয়ে দিচ্ছে। খিদে পেয়েছে প্রচ-। এরা খাওয়ার কথা বলছে না কেন, কে জানে? খাবে না নাকি? ডেকচি ভরা পান্তাভাত তো আছে জানি। আমার কেন যেন ধারণা জন্মে গেছে যে, সিরাজ মনের কথা পড়তে জানে। তারই প্রমাণ আরেকবার দিল সে। মাঝিকে ডাক দিয়ে বলল, ‘মমিন ভাই, সামনের টিলায় নৌকা ধর। ভাত খাব।’

পান্তাভাত জীবনে কম খাইনি। ছোটবেলায় নানী নারকেল কোরার সাথে পোড়া মরিচ ডলে দিত। নিমেষে প্লেট খালি। চিংড়ি কিংবা চিরিং মাছের শুটকি ভেজে পান্তা খাওয়ার স্বাদও জীবনে ভোলার নয়। কিন্তু ধানপাতার ফোঁড় থেকে বেরিয়ে বালুখালি ফাঁড়ির মুখে নিঃসঙ্গ একটা ন্যাড়া টিলায় নৌকো বেঁধে পান্তাভাত খেতে গিয়ে যে মজাটা পেয়েছিলাম, সেটা বোধ হয় আর জীবনেও পাওয়া হবে না। তরকারি ছিল না। রাতেই সব শেষ হয়ে গিয়েছিল। হাত-মুখ ধুয়ে ভাত খেতে বসলাম। মাটির শানকিতে ঠেসে ভাত বেড়ে দিল মমিন। আমার দিকে তাকিয়ে হাসল একটু। ‘তালতো, তরকারি ছাড়া ভাত খাইবেন। ক্যাঁচা মরিচ ভাঙি লন পাতে। ভাতের মধ্যে মাখি ফেলান। দেইকবান, কীরকম হোয়াদ লাগে।’

খাবার দাবার নিয়ে আমার ততো খুঁতখুঁতি নেই। ক্ষুধার মুখে হাতের কাছে খাওয়ার যোগ্য কিছু পেলেই হলো। চুপচাপ চাঁদমুখ করে খেয়ে নিই। তবু পান্তাভাতে কাঁচা মরিচ ভেঙে খাওয়ার কথা শুনে কেমন যেন লাগল। আড়চোখে সিরাজ আর ফয়েজের দিকে তাকালাম। ওরা ব্যস্ত কাঁচা মরিচ ভেঙে নিয়ে চটকানোর কাজে। একটু পরেই হাপুস হুপুস শব্দ শোনা যেতে লাগল।

পেটে বাঘের খিদে। সকাল থেকে দশহাতি দাঁড় টানতে টানতে নাড়িভুড়িসহ হজম। সুতরাং বিনা প্রতিবাদে তাদের মতো করেই মরিচ চটকে নিয়ে খাবার আয়োজন করলাম।

প্রথম গ্রাস মুখে নিয়েই বুঝলাম, সিরাজ-ফয়েজদের ব্যস্ততার কারণটা। পরিমাণ মতো লবণ পান্তাভাতের পানসে ভাব দূর করে দিয়েছে। কাঁচা মরিচের ঝাল ঝাল গন্ধ ঢুকে গেছে তার ভেতর। আর তাতেই তৈরি হয়েছে অন্যরকম এক স্বাদ। পরিশ্রমে ক্লান্ত শরীর আর ক্ষুধার্ত পেট। দু’মিনিটেই সবার সানকি খালি।

খাওয়ার পর মিনিট পাঁচেক বিশ্রাম। বিড়ি টিড়ি খাওয়া। আবার নৌকো খুলে দিতে হবে। কিন্তু ইচ্ছে করছে শুয়ে পড়তে। সেটা সম্ভব নয়, তাই পাঁচ মিনিটের এই বিশ্রামটাকে মনে হলো অনেক দামি।

শীতের দিন। হালকা বাতাস বইছে উত্তর থেকে। বেলা প্রায় নটার মতো বাজে। কুয়াশা কেটে গিয়ে চমৎকার রোদ উঠেছে। একটা ছোট জেলে নৌকো তীরবেগে চলে যাচ্ছে আমাদের পাশ দিয়ে। মমিন হাঁক দিল, ‘ওই ভাই, মাছ আছেনি?’

‘আছে, চাপিলা মাছ,’ সাড়া পাওয়া গেল জেলে নৌকো থেকে। গতি কমিয়ে আস্তে আস্তে আমাদের কিস্তির পাশে এসে ভিড়ল ওটা।

চাপিলা নামের একটা মাছ যে আছে, এর আগে জানতাম না। সাদা রঙের মাছগুলো দেখতে বাচ্চা ইলিশের মতো। আমি প্রথমে ইলিশ বলেই ভেবে বসলাম। পরে মনে হলো, না, এগুলোর নাম তো চাপিলা মাছ। লোকটাই তো বলল।

এক কেজি মাছ নেয়া হলো পাঁচ টাকা দিয়ে। সিরাজ মাছ নিয়ে নৌকোর পেছনে চলে গেল। আমি আর ফয়েজ মিলে দাঁড় টানতে শুরু করলাম। নৌকো আস্তে আস্তে বালুখালি ফাঁড়িতে গিয়ে পড়ল। সামনে যতদূর চোখ যায় পানি। অনেক উত্তরে দেখা যাচ্ছে সবুজ কয়েকটা টিলা। আমাদের নৌকোর গলুই সেদিকে। ফয়েজকে জিজ্ঞেস করে জানলাম, ওটা বালুখালির ফোঁড়।

এক মনে দাঁড় টানছি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে। দাঁড়ের গোড়া মুঠোয় পুরে একপা এগিয়ে সামনে ঝুঁকে চ্যাপ্টা পাতা পানিতে গেঁথে পেছনে প্রায় চিতিয়ে গিয়ে হ্যাঁচকা টান। নৌকোর দু’পাশে পানি উল্টে গিয়ে ছলাচ্ছল শব্দ তুলে সরে যাচ্ছে পেছনের দিকে। আর নৌকো এগোচ্ছে সামনে। ঢিমে তেতালে। মনেই হচ্ছে না যে চলছে। তবে দু’পাশের টিলাগুলোর দিকে তাকালে মনে হয় আমরা দাঁড়িয়ে নেই।

বেলা বাড়ছে। হ্রদের পানিতে বিলি কাটছে শীতের মনোরম বাতাস। মৃদু ঢেউ জেগেছে। মিছিল করে আসছে যেন উত্তর থেকে দক্ষিণে। পুবদিকে সারি সারি সবুজ পাহাড়-টিলা। সেগুলোর মাথার ওপর দিয়ে আরো পুবে তাকালে দিগন্তের কোলে নীল পাহাড়। পশ্চিমেও তাই। তবে পুবদিকের মতো দিগন্তবিসারী নীল নয়। ধোঁয়াটে সবুজ।

ওপরে অসীম নীলাকাশ। নিচে নীল টলটলে পানি। চারদিকে পাহাড়। শীতের কোমল হলদেটে রোদ আর মৃদু ঝিরিঝিরি বাতাস। আমাদের দু’জনের দাঁড়ের দাপটে দু’পাশের পানি গর্জাচ্ছে। হালের গোড়ায় বসে আছে মাঝি, মাঝে মাঝে কথা বলছে সিরাজের সাথে। সিরাজ রান্না করছে। দুপুরের খাবারের আয়োজন। কী নিয়ে যেন ব্যাপক হাসাহাসি চলছে দু’জনের মধ্যে।

ফয়েজ গুন গুন করছে। কী একটা সুর ভাঁজছে নাকে। একজনকে গান গাইতে শুনলে আরেকজনেরও গাইতে ইচ্ছে হয় মনে হয়। অন্তত আমারও ইচ্ছে হচ্ছে গাইতে। কিন্তু নতুন একজন মানুষের জন্যে হঠাৎ গান গাওয়াটা কেমন দেখাবে ভেবে চুপ করে আছি।

ফয়েজের গুন গুন করাটা অবশ্য ভালো লাগছে না। সুর নেই। ওর চেয়ে আমার গলা অনেক ভালো। চাইলে শুরু করতে পারি। কিন্তু সঙ্কোচ কাটিয়ে উঠতে পারছি না।

নৌকো এগোচ্ছে নিজের মতো করে। ধানপাতার ফোঁড় এখন অনেক পেছনে পড়ে গেছে। বারবার ঘাড় ঘুরিয়ে বালুখালী ফোঁড়ের দিকে তাকাচ্ছি। প্রথমে দিগন্তের কোলে ধূসর সবুজ রেখার মতো দেখাচ্ছিল। এখন অনেক স্পষ্ট। গাছপালার ফাঁকে ফাঁকে দু’একখানা বাড়িঘরও দেখছি।

আমাদের আশে পাশে নৌকো আসছে যাচ্ছে। ধানপাতার ফোঁড় থেকে বেরিয়ে এসেছে দু’খানা। ওদিকে বালুখালীর দিক থেকেও আসছে মালবোঝাই সরঙ্গা আর সাম্পান।

প্রচ- ক্লান্তি লাগছে। সাথে সাথে অবাকও বোধ করছি। নিজেকে মেলাতে পারছি না বাস্তবের সাথে। আমি লেখাপড়া জানা শিক্ষিত ছেলে। এখানে নৌকার দাঁড় টানছি কেন? বারবার আনমনা হয়ে যাচ্ছি। চোখের সামনে ভেসে উঠছে ক্লাসমেটদের মুখ। সাকী, সেবক, মাওলা, পারভেজ। এসএসসি পাস করে এরা সবাই কলেজে যাবে। আমারও তো তা-ই যাবার কথা। কিন্তু হুট করে সব কীভাবে উল্টাপাল্টা হয়ে গেল? পরীক্ষা ফেল করার ভয়ে বাড়ি ছাড়লাম আর কাপ্তাই এসে একদম নৌকোর নাইয়া হয়ে গেলাম?

কিছু একটার ক্ষরণ টের পাচ্ছি ভেতরে। বেশিক্ষণ অবশ্য রইল না। মনে হলো, আরে, এটা তো সাময়িক। আমি কি আর সারাজীবন নৌকোয় চাকরি করব নাকি? দাঁড় টানতে টানতে ডুবে গেলাম সে কল্পনাটায়।

….একদিন এক ভদ্রলোকের সাথে দেখা হয়ে গেল। ভদ্রলোক কাপ্তাই বেড়াতে এসেছেন। সঙ্গে তার স্ত্রী আর একমাত্র মেয়ে। কাপ্তাই জেটিঘাটে হাঁটছেন বিকেল বেলায়। চারদিকের দৃশ্যাবলি দেখছেন। কথা বলছেন স্বামী-স্ত্রীতে। মেয়েটার চোখে অবাক দৃষ্টি। আমিও হাঁটছি জেটিঘাটে। জেটির লেবার কিংবা নৌকোর নাইয়াদের মতো নয়, আমার হাঁটার মধ্যে ফুটে উঠছে একজন শিক্ষিত ছেলের হাবভাব। কাপ্তাই জেটিঘাটের প্রত্যেকটা মানুষের চেয়ে আলাদা করে বেছে নেয়ার মতো সে হাঁটা চলা ও কথা বলার ভঙ্গি।

ভদ্রলোকের মুুখে স্মিত হাসি, সহৃদয়ভাব। হঠাৎ আমার ওপর চোখ পড়ল তার। কিছুক্ষণ স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে তারপর ডাকলেন ইশারায়। আমি এগিয়ে এসে বললাম, ‘আমাকে ডেকেছেন?’

আমার মুখে শুদ্ধ ভাষা শুনে ভদ্রলোক আরো অবাক হলেন। বললেন, ‘হ্যাঁ, তোমাকে। তুমি কে বলো তো? তোমাকে তো এখানকার কেউ মনে হচ্ছে না।’

ভদ্রলোকের মেয়েটিও চেয়ে আছে আমার দিকে। ওর চোখেও কৌতূহল। মেয়েটাকে উপেক্ষা করলাম। গম্ভীর কণ্ঠে ভদ্রলোককে বললাম, ‘আমি কেউ না। আমি এখানে নৌকোয় চাকরি করি।’

ভদ্রলোক অবাক হয়ে বললেন, ‘কী, তুমি নৌকোয় চাকরি করো? তোমাকে দেখে তো শিক্ষিত ছেলে মনে হচ্ছে।’

আমি চুপ করে রইলাম।

ভদ্রলোক আবার বললেন, ‘সত্যিই তুমি নৌকোয় চাকরি করো?’

আমি বললাম, ‘জি, আমি নৌকোয় চাকরি করি। আমি নৌকোর নাইয়া।’

ভদ্রলোক অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলেন আমার মুখের দিকে। তারপর বললেন, ‘আমরা অনেকক্ষণ ধরে বেড়াচ্ছি। এখন চা খাব। তুমি কি আমাদের সাথে একটু বসবে?’

আমি প্রথমে না না করলাম। কিন্তু ভদ্রলোক বললেন, ‘আরে এসো তো। তোমার সাথে আরো কথা আছে।’

আমি চট করে কিশোরীর দিকে চাইলাম। ওর চোখেও দেখি অনুরোধের ভাষা। ভদ্রলোকের স্ত্রী বললেন, ‘চলো, ওই দোকানটায় বসি।’

এরপর আর আপত্তি করার ঝুঁকি নিলাম না। আমি তো চাই-ই এরকম একজন মহৎ মানুষের সাথে আমার পরিচয় হোক। ওদের সাথে বেকারিতে গিয়ে ঢুকলাম। যারা দেখল, তাদের মধ্যে আমার পরিচিতদের চোখ কপালে উঠল। তারা লেবার শ্রেণীর মানুষ, নৌকোর নাইয়া-মাঝি। ভাবতেই পারছে না এমন ফিটফাট একজন ভদ্রলোক, তার স্ত্রী ও সুন্দরী মেয়ের সঙ্গে আমার মত একজন একই টেবিলে গিয়ে বসবে।

একটা টেবিলকে ঘিরে চারটা চেয়ার। আমি আর ভদ্রলোক একপাশে বসলাম। অন্যপাশে বসল মা আর মেয়ে। মেয়েটা আবার আমার সামনা সামনি বসল। আমি গম্ভীর মুখে তাকিয়ে আছি টেবিলের দিকে। মেয়েটিকে অসম্ভব ভালো লাগছে। কিন্তু ওর দিকে একবারও চাইছি না। মেয়েটিকে বুঝিয়ে দিতে চাই, আমি যা তা নই, একজন ব্যক্তিত্ববান ও সৎ ছেলে। সহজে মেয়েদের দিকে তাকাই না।…

দাঁড় টানতে টানতে ফয়েজ আচমকা ‘হোঁ’ করে উঠল। কল্পনার রশি ছিড়ে গেল আমার। বাস্তবে ফিরে এলাম। কাপ্তাই হ্রদে ৭০০ মণী নৌকোর দাঁড় টানছি আমি।

শীতের সূর্য মাথার ওপর থেকে হেলে পড়েছে পশ্চিমে। হলুদ রোদ একধরনের ঝিমঝিমে ভাব ধরেছে। দাঁড়টানার পরিশ্রমে কপালে চিকন ঘাম জমেছে। পুবে-পশ্চিমে পাহাড়গুলোকে কিছুটা ধূসর দেখাচ্ছে এখন। পাহাড়ের গায়ে মাঝে মাঝে সাদা ফিতের মতো রেখা। এঁকে বেঁকে গেছে। এমনটা দেখাচ্ছে কেন, কে জানে। জিজ্ঞেস করতে গিয়েও থেমে গেলাম। সিরাজ আবার কী থেকে কী বলে ফেলে ঠিক নেই।

মাসুদ আনোয়ার। লেখক ও সাংবাদিক। জন্ম – দীর্ঘাপাড়, সন্দ্বীপ, চট্টগ্রাম। পেশায় সাংবাদিক। লেখালেখির শুরু ছাত্রজীবন থেকে। মাধ্যম ছড়া, কবিতা ও উপন্যাস। লেখেন বড়-ছোট উভয় শ্রেণির পাঠকের জন্যে। প্রথম ছড়ার বই ‘হুক্কাহুয়া‘, প্রথম কিশোর উপন্যাস ‘কেউ জানে না‘। কিশোর গল্প সঙ্কলন...

এই বিভাগের অন্যান্য লেখাসমূহ