জলে জঙ্গলে (পর্ব- ১১)

মাসুদ আনোয়ার
উপন্যাস, ধারাবাহিক
Bengali
জলে জঙ্গলে (পর্ব- ১১)

পূর্ব প্রকাশিতের পর…

বালুখালীর ফোঁড়ে পৌঁছে নৌকো থামাল মাঝি। শীতের সূর্য অনেক পশ্চিমে হেলে পড়েছে। দাঁড় টানতে টানতে খিদেয় নাড়িভুড়িসহ হজম হওয়ার জোগাড়। একটা গাছের শেকড়ে নৌকো বেঁধেই ঝুপ ঝুপ করে পানিতে নেমে পড়ল তিন জওয়ান। টুপ টাপ করে ডুব দিচ্ছে। হাসছে কী সব বলে বলে। পরনের লুঙ্গি খুলে গা রগড়াচ্ছে।

মমিন হাঁক দিল, ‘কী তালতো, গোছল কইরতান ন’?

শীতকালে পানি অনেক ঠাণ্ডা। ছোটকাল থেকেই দেখে আসছি, একান্ত ঠেলায় না পড়লে শীতের দিনে আমি গোসল খুব একটা করি না। বাবার বাড়িতে থাকলে গোসলটা ছিল কম্পালসারি সাবজেক্ট আর নানাবাড়িতে ঐচ্ছিক। ইচ্ছে হলে করতাম, না হলে…বাদ। নানী অনেক সময় বকুনি লাগাত। কিন্তু বুড়ির কথায় পাত্তা দেয় কে? তবে মামার পাল্লায় পড়লে ভিন্ন কথা। তখন রীতিমতো বখতিয়ার খিলজি। ওখানে ধানাই পানাই চলত না। ট্যাঁ ফোঁ করলেই নগদে চড় থাপ্পড়। বাড়িতেও সে একই ব্যাপার। তবে ওখানে চড়-থাপ্পড়েরও দরকার হতো না। বাবা-জেঠার বাঘমুখ দেখলেই লুঙ্গি কাঁধে পুকুরের দিকে ছুটতাম।

এখানে অবশ্য মামাও নেই, বাবা-জেঠাও নেই। যা-ই করব, নিজের সিদ্ধান্তে। কারো মাতবরি সইতে হবে না। আমি এখন এই শীতের দিনে গোসল করতেও পারি, না করলেও পারি।

প্রথমে ভাবলাম ‘না’ বলি। পরে মত পাল্টালাম। কাজ-কর্ম শেষ করে দুপুরে খাওয়ার আগে গা-গোছল ধোয়াটাই নিয়ম। আমার সহকর্মীরা সকাল থেকে দাঁড় টেনে এসেছে। এখন দুপুরের খাবার খাবে। তার আগে গোসল করে ফ্রেশ হয়ে নিচ্ছে। হ্রদের পানি ঠা-া। কিন্তু ঠা-াকে খুব একটা পাত্তা দিচ্ছে না। এখন আমি যদি ঠা-ার ভয়ে গোসল না করে খেতে বসে যাই, তারা অবাক হবে। সিরাজ হয়তো বলেই বসবে, ‘আরে আমনে না শিক্কিত ছেলে! স্কুইল্যা পোলা? আগোছইল্যা ভাত খাইবেননি? আমনে দেই আস্তা হেরত।’

‘হেরত’ মানে প্রেত। সন্দ্বীপের আঞ্চলিক কথায় নোংরা মানুষকে ‘হেরত’ বলা হয়।

গোসল না করে ভাত খেতে বসে গেলে সিরাজের ‘আস্তা হেরত’ মন্তব্যের জবাবে কিছু বলার থাকবে না। অগত্যা নিজের সিদ্ধান্তে অটল থাকার সিদ্ধান্ত বাদ দিয়ে নেমে পড়লাম পানিতে। এক নাগাড়ে তিন চারটা ডুব দিয়ে তারপর সাঁতার কাটতে শুরু করলাম।

যতটা ভেবেছিলাম, ততটা ঠান্ডা নয়। সাঁতার কাটতে ভালোই লাগছে। অবশ্য একটু অস্বস্তিও বোধ করছি। বাড়িতে থাকতে পুকুরে সাঁতার কাটতাম গোসল করতে নামলে। কিন্তু পুুকুরে সাঁতার কাটা আর কাপ্তাই লেকের মতো বিশাল জলাধারে সাঁতার কাটা যে এক নয়, এই প্রথম বুঝলাম। পাড়ের কাছাকাছিই সাঁতরাচ্ছি। আরেকটু মাঝের দিকে যেতে ইচ্ছে হচ্ছে। কিন্তু কেমন যেন একটা ভয় ভয় অনুভূতি জাগছে ভেতরে। বার দুয়েক মাঝখানে যেতে গিয়েও ফিরে এলাম।

আমার ইতস্তত ভাব খেয়াল করল আমার সহকর্মীরাও। মমিন হেসে উঠল। ‘কী তালতো, ডর লাগেরনি। চাইয়েন বেশি মাইদগানে যাইয়েন না। নতুন মানুষ। কাপ্তাই লেইকের ভাও-ভাক্কা বুইজদান ন’….’
সাঁতার কাটা রেখে ওদের কাছে গিয়ে দাঁড়ালাম। লুঙ্গি দিয়ে গা মাজতে মাজতে বললাম, ‘ভাও-ভাক্কা মানে? বুঝলাম না।’

‘বেশি বুইজেন না!’ ঝাঁজিয়ে উঠল সিরাজ। ‘কাইলকা আইয়েরে আইজ্জা বেশি বুঝি গেলে সমস্যা আছে।’

‘কী সমস্যা আছে?’

‘কী সমস্যা আছে, হেগিন আস্তে আস্তে বুইজবান। এখন উডেন। শীতে হরান যার গই। হেডের ভোকে চির-কিরমি মরি যার। ভাত খামু।’

এক সাথে উঠে এলাম সবাই। কাপড়চোপড় ধুয়ে ভিজে কাপড় মেলে দিলাম নৌকোর ভেতর। খেতে বসলাম। জনপ্রতি তিন প্লেট করে ভাত ঠেসে উঠে বিড়ি ধরালাম।

ভেবেছিলাম খেয়ে দেয়ে নিশ্চয় ঘণ্টা দুয়েক জিরিয়ে টিরিয়ে তারপর ফের নৌকো ছাড়বে মাঝি। কিন্তু আধঘণ্টা না যেতেই মমিন ডাকল, ‘তালতো, নিচে নামেন। রশি খুলে দেন। নৌকো ছাড়–ম। সকাল সকাল সুবলং বাজার ধরন লাইগব।’

অবাক হয়ে চাইলাম সিরাজ আর ফয়েজের দিকে। দেখি তারাও উঠছে। মমিন বলল, ‘ফয়েজ, লগি ল’।’

আবার এগিয়ে চলা। বালুখালি ফাঁড়ির পরে রাঙামাটি ফাঁড়ি। তবে এবার স্বস্তির ব্যাপার হলো আমাদের নৌকো বালুখালির ফাঁড়ির মতো মধ্যখান দিয়ে যাচ্ছে না। আমরা যাচ্ছি ফাঁড়ির পুবধার ঘেষে পাহাড়ের কাছ দিয়ে।

সূর্য পশ্চিমে হেলে পড়েছে। রাঙামাটি শহরের ঘর-বাড়ি, দোকানপাট দেখছি। দূর থেকে বলে আবছা অবয়ব। শহর পেরিয়ে পুবদিকে পাহাড়শ্রেণী। মিশে আছে আকাশের গায়ে। আকাশী হালকা নীলের সাথে সবুজাভ গাঢ় নীলের এক সুন্দর কম্বিনেশন। পুরো ফাঁড়ি জুড়ে এখন নানারকমের নৌকো। পাহাড়সমান উঁচু একটি শন বোঝাই নৌকো এগিয়ে আসছে উত্তর দিক থেকে। অবাক হয়ে ওটা কী জিজ্ঞেস করতেই ফয়েজ বলল, ‘এটারে কয় জুড়িন্দা। দুই নৌকো এক সাথে পাশাপাশি বাইন্ধা ওপর থাইকা শন লই আয়ের।’

শন খুব হালকা জিনিস। তাই নৌকো পুরো লোড করতে গিয়ে নৌকোর ওপর পাহাড় জমিয়েছে। মজা পাচ্ছি দেখে। মাঝে মাঝে অবশ্য কাঠ বা পাথর বোঝাই নৌকোও যাচ্ছে পাশ দিয়ে। পানি সেসব নৌকোর একদম কাছা ছুঁই ছুঁই। আমাদের নদী, মানে মেঘনা নদী হলে এরকম কানায় কানায় বোঝা মাল নিয়ে নৌকো চালানো সম্ভব হতো না। প্রথম ঢেউয়ের ঝাপ্টাতেই ডুবে যেত। কিন্তু কাপ্তাই হ্রদে মেঘনার ঢেউ নেই। যতদূর চোখ যায়, পুরোটাকেই মনে হচ্ছে একটা বিশাল পুকুরের মতো। কেবল উত্তুরে বাতাসে জাগা ঝিরঝিরে ঢেউ ছাড়া আর কোনো নড়াচড়া নেই পানির।

পাহাড়ের কোল ঘেষে এগোচ্ছে আমাদের কিস্তি নৌকো। সবুজ গাছ আর লতাপাতায় ঢাকা লাল মাটির পাহাড়। ওপর থেকে ঢালু হয়ে নেমে গেছে পানির নিচে। কোথাও কোথাও এত বেশি ঢালু যে, আমাদের নৌকোর নিচেও মাটির আভাস দেখা যাচ্ছে। পানির ধারে ছোট ছোট লতাপাতার ঝোপ। ঝোপের ভেতর ফুটে আছে নানারঙের ফুল। প্রজাপতি উড়ছে, ছোট ছোট পাখা মেলে তিড়িক তিড়িক করে এক ঝোপ থেকে আরেক ঝোপে যাচ্ছে বুনো পাখি। কিচির মিচির শব্দ করে ভেঙে দিচ্ছে পাহাড়ের মৌনতা।

দাঁড় টেনে যাচ্ছি আনমনে। কোথায় যাচ্ছি জানি না। শুনেছি সুবলং, কিন্তু সেটা ঠিক কতদূরে বুঝতে পারছি না। গন্তব্য জানা না থাকলে আসলে মানুষ দারুণ অসহায় হয়ে পড়ে। আমাদের নৌকোয় মাঝিসহ তিনজনই জানে সুবলং জায়গাটা ঠিক কোথায়। তারা এর আগে আরো কতবার গেছে। সুতরাং কতটুকু পথ পেরিয়ে এসেছি এবং আর কতদূর যেতে হবে, তারা জানেই। তাই এ নিয়ে আলগা কোনো টেনশন নেই ওদের। কিন্তু আমার সমস্যা হলো, আমি ব্যাপারটা আঁচ করতে পারছি না। তাই ছটফট করছি কেবল।

দু’হাতে পড়া ফোসকাগুলো ফেটে গিয়ে ব্যথার জানান দিচ্ছে। তালুর লাল দগদগে মাংস দেখা যাচ্ছে। বারবার মুঠো খুলে ভাঁপ বের করে দিচ্ছি। বাড়িতে কোনো কাজ করলে এত কষ্ট কে করত। ফোসকা পড়ার সিরিয়াস কারণ দেখিয়ে ঘরে গিয়ে বসে থাকতাম। কিন্তু এখানে সে উপায় নেই। চাকরি করছি। নিজের ইচ্ছে মতো চলা আর সম্ভব নয়।

দাঁড় টানতে টানতে ফাঁড়ির পশ্চিম দিকে চাইছি মাঝে মধ্যে। রাঙামাটি শহর। স্কুলে পড়ার সময় যখনই বইতে এই নামটা পেতাম, চোখের সামনে ফুটে উঠত এমন এক শহরের দৃশ্য, যার মাটি লাল। আমাদের এলাকার মাটি লাল নয়, নেহাত মেটে রঙেরই। লাল মাটির এ শহরটা দেখতে কেমন হবে, এরকম একটা কৌতূহল সব সময় জেগে থাকত মনে। এখন এ শহরটা এত কাছে! কিন্তু আমার যাওয়া হবে না। এখান থেকে তেমন কিছু বোঝা যাচ্ছে না। মাটিও তেমন লাল মনে হচ্ছে না। তবে মাঝে মধ্যে ঘরবাড়ি কিংবা দোকানপাটের আভাস পাওয়া যাচ্ছে টিনের চালে সূর্যালোক পড়ে ঝিকিয়ে ওঠা থেকে।

‘ফয়েজ ভাই।’ ডাকলাম একটা কথা জানার জন্যে।

‘কী, বলেন?’ দাঁড় টানতে টানতে জবাব দিল ফয়েজ।

‘আচ্ছা, আমরা কি রাঙামাটি যাব?’

‘কেন? রাঙামাটি যামু কেন?’ জবাবটা সিরাজই দিল।

ছেলেটাকে উপেক্ষা করলাম। জবাব দিলাম না। তবে সে কিন্তু ছাড়ল না। ভেঙচি কেটে বলল, ‘মিয়া গতকাইল আসিয়েরে আইজকাই রাঙামাটির খোঁজ নিতে শুরু করছেন? ভালা! খুব ভালা! আইজো হিলট্রাক্টের উত্তর-দইন চিননের আগে রঙ্গরসের খোঁজ।…..হাহ্!’

নাহ, জবাব দিতেই হয়। সিরাজ বড্ড বাড়াবাড়ি শুরু করেছে। মাতবরি। এই মাতবরি জিনিসটা আমি একদম পছন্দ করি না। সিরাজকে বুঝতে হবে যে, আমি মোটেই ওর পদের ছেলে না। আমি শিক্ষিত ছেলে। নৌকোর চাকরি করতে এসেছি বলে পচে যাইনি।

‘আপনার সমস্যা কী, সিরাজ? নৌকোয় ওঠার পর থেকে দেখছি খারাপ ব্যবহার শুরু করেছেন। আমি আপনার চাকরি করছি না তো। নাকি আপনি নিজেকে আমার মুরব্বি ভেবে বসে আছেন? শুনুন, আপনি হয়তো আমার সাথে সুন্দর ব্যবহার করবেন, নইলে কোনো কথাই বলবেন না। আমার ফাজলামি পছন্দ হয় না।’

‘মানি?’ রেগে উঠতে গেল সিরাজও। ‘কাইলকা মাত্র…’

‘কাইলকা মাত্র এসেছি তো কী হয়েছে?’ ছেলেটাকে কথা শেষ করতে দিলাম না। ‘কাইলকা আইছি বলেই কি আমনে সুযোগ নিতে শুরু করছেন? আমনের দায়ের নিচে মাছ মনে কইরছেন? আপনি যেমন এক মায়ের পোলা, আমিও এক মায়ের পোলা। মার দুধ খাইয়া বড় হইছি। গরুর দুধ খাইয়া নয়।’

‘মার দুধ খাইয়া বড় হইছি, গরুর দুধ খাইয়া নয়’–কথাটা আগে জানতাম না। গতকালই মাত্র শুনেছি সিরাজের মুখে। কাকে যেন বড় গলা করে বলেছিল। কথাটা দারুণ অর্থবহ আর লাগসই মনে হয়েছিল। আজ তার মুখে শোনা সে কথাটা তাকেই শুনিয়ে দিলাম।

‘এই এই…’ মমিন নাক গলাল হাল থেকে। ‘কী হইছে? এই সিরাইজ্যা, চুপ কর তো।’

‘দেখ না মমিন ভাই,’ সিরাজ ঝাঁজিয়ে উঠল। ‘ কাইলকা আইয়েরে আইজগা সেয়ানা অই গেছে গই। মুখে মুখে কথা কয়। শালার দুনিয়াত কারো উপকার গরন নাই।’

‘আইচ্ছা থাক থাক,’ ফয়সালা ভঙ্গিতে বলল মমিন। ‘তালতো, হালিশ (দাঁড়) টানেন। বেইল থাইকতে থাইকতে সুবলং পৌঁছন লাইগব।’

আমি আর কিছু বললাম না। তবে সিরাজ থামল না। দাঁড় টানতে টানতে অবিরাম গজ গজ করতে লাগল। পাত্তা দিলাম না। ফয়েজকে বললাম, ‘হোঁ ফয়েজ ভাই, জোরসে টানেন হেঁইয়া। আরো জ্জোরে হেইয়া…’ বলতে না বলতে পেছনে উল্টে পড়ার দশা হলো। সামলে নেয়ার আগেই পিঠে ফয়েজের দাঁড়ের আঘাত অনুভব করলাম। ব্যথাও পেলাম।

না, ফয়েজ আমার পিঠে দাঁড় দিয়ে মারেনি। ওকে দাঁড় টানায় উৎসাহ দিতে গিয়ে নিজেও একটু দ্রুত টানতে শুরু করেছিলাম। তাতে দাঁড়ের পাতা পানিতে খাড়া হয়ে না পড়ে চেপ্টা হয়ে পড়তে ছিটকে যায় সামনের দিকে। আর পানিতে দাঁড় আটকানোর জোর না পেয়ে আমিও ছিটকে পড়ি পেছনে। ভাগ্যিস, বাড়িটা পিঠে লেগেছে, মাথায় পড়লে মাথা ফেটে যেতে পারত।

‘আস্তে তালতো,’ তাড়াতাড়ি নিজের দাঁড় রেখে আমার পিঠ মালিশ করতে শুরু করল ফয়েজ। ‘ব্যথা পাইছেন তো? দেখেন, আমনের এখনো জোরে টানার প্যাটটিস হয় নাই। হুঁশ গরি টাইনত অইব।’

ব্যথা পাইনি, তা নয়। ভালোই ব্যথা পেয়েছি। তবে একদম কাতর হয়ে পড়ার মতো নয়। তাছাড়া ব্যথা-ট্যথা এসবকে আমি সহজে পাত্তাও দিই না। বাড়িতে আমাদের এক মন্টুভাই আছে। খেলতে গিয়ে সামান্য একটু হোঁচট খেলেই সে ‘উহ, দুখাই, দুখাই’ (উহ, ব্যথা পেয়েছি, ব্যথা পেয়েছি) বলে বসে পড়ত। ওকে নিয়ে তাই হাসি-ঠাট্টা করতাম আমরা। নিজেরাও একটু ব্যথা পেলে ওর মতো করেই বসে পড়ে ‘দুখাই দুখাই’ শুরু করতাম। কিন্তু এখানে এটা খেলার মাঠ নয়, আর এই ছেলেগুলোও আমার খেলার সাথী নয়। বিশেষ করে সিরাজ। ও এরই মধ্যে একটা মন্তব্যও করে ফেলেছে, ‘শাস্তি।’
ফয়েজের প্রতি দ্বিতীয়বার কৃতজ্ঞতা বোধ করলাম। ছেলেটা মনে হয় সত্যিই ভালো। সিরাজের মতো বেয়াদব নয়।

সুবলং বাজার ঘাটে যখন পৌঁছলাম, রাত তখন আটটার কম নয়।

চারদিকে ঘুটঘুটে অন্ধকার। শীতের রাত। বাতাস বইছে উত্তর থেকে। পশ্চিম, উত্তর আর দক্ষিণ দিকে পাহাড়ের সারি মাথা উঁচিয়ে আছে। পুবদিকেও পাহাড়, খানিকটা দূরে। মাঝখানের অংশটায় পানির মধ্যে মাথা জাগিয়ে আছে ছোট-বড় টিলা। আকাশে অসংখ্য তারা। সুবলং বাজারের দোকানপাটে জ্বলা মৃদু আলো পাহাড়ী অন্ধকারকে কেমন ভৌতিক রূপ দিয়েছে। এমন পরিবেশে সম্পূর্ণ নতুন আমি। অবাক হয়ে দেখছি চারদিক। দুনিয়াতে এমন জায়গাও আছে, কখনো কল্পনাও করিনি। অথচ এখন সে অকল্পনীয় পরিবেশের এক বাস্তব অংশ আমিও। এখানে আমার দুই সহকর্মী এখন দাঁড়টানা বন্ধ করে দাঁড়িয়ে আছে। একজনের হাতে লগি। আরেকজন বিড়ি ধরিয়েছে। সুবলং বাজার ঘাটে নানা ধরনের নৌকো। ছোট ছোট নৌকোগুলোর ছইয়ে বসে গল্প করছে নাইয়া-মাঝিরা। নৌকোর পেছনের অংশে টিনের চুলোয় রান্না চড়িয়েছে কেউ কেউ। কোনো কোনো নৌকোয় পানি সেচার আওয়াজ। এক নৌকোয় দেখি গানও জুড়ে দিয়েছে একজন। হেড়ে গলায় বিরহের গান গাইছে। মাঝে মাঝে কোনো নৌকো থেকে কাশির আওয়াজ। আমার চারপাশে এখন এমনই বাস্তবতা।

বুকের ভেতরটা কেমন শীতল শীতল লাগছে। স্কুল শেষ করে আমার তো কলেজে যাওয়ার কথা! তাইলে? এখানে আমার কী কাজ? কে ভেবেছিল এমনটা?

নৌকো ঘাটে লাগতে ওপর থেকে কে একজন ডাকল, ‘মমিনা? আইছত্তি রে?’

ছইয়ের ওপর থেকেই চিকন গলায় আওয়াজ দিল মমিন, ‘কিয়া, বাইছা নিও?

‘আইও। এতক্ষণ লাইগল যে তোর গো? রাঙ্গামাইট্যা গেছিলি নাকি?’

‘রাঙ্গামাইট্যা? বাইছা কিয়া কন? বাইছলামি করেন অ’?’

মমিন হাসছে। লোকটা কে বুঝতে পারছি না। একটু পরে সিরাজ সিঁড়ির তক্তা নামিয়ে দিল। তক্তা বেয়ে উঠে এল গায়ে চাদর আর মুখ-মাথায় মাফলার জড়ানো লোকটা। আমার দিকে তাকিয়ে হাসল আন্তরিক ভঙ্গিতে। ‘তালতো ভালা আছেননি?’

এবার চিনলাম। আসল মাঝি। মানে নৌকোর মালিক। সালাম দিলাম। ‘ওয়ালাইকুমুসসালাম’ বলে আমার পিঠে হাত বুলিয়ে দিল মাঝি। নৌকোর কাছা বেয়ে হাঁটতে হাঁটতে বলল, ‘আইয়েন, ভিতরে আইয়েন।’

ভেতরে গেলাম। কিন্তু বুঝতে পারছি না, মাঝি কখন এল? মাঝি তো কাপ্তাই রয়ে গেছে। তাহলে এখানে কীভাবে?

জবাবটা মমিনের প্রশ্নেই পেয়ে গেলাম। ‘স্টিমারে নাকি ইস্পিড বোটে আইছেন গো বাইছা?’

বাইছা অবশ্য জবাব দিল না। তার আগে বলল, ‘ভাত চড়িয়ে দেরে, খুব খিদা পাইছে। তরকারি কী রানছস রে সিরাইজ্যা? মাছ আছেনি?’

আমাদের দু’পাশে আরো নৌকো আছে। বেশিরভাগই কাঠবোঝাই। পাহাড়ের মতো উঁচু হয়ে আছে এক একটা নৌকো। ডানপাশের নৌকোটাও কাঠবোঝাই। চিকন-মোটা গাছের গুড়ি সাজিয়ে রাখা হয়েছে। দু’বাহু মেলে দিয়েও বেড় পাব না, এমন মোটা মোটা গুড়িও আছে।

সিরাজ ভাত চড়িয়েছে টিনের চুলোয়। আবুল মাঝি ডাকল আমাকে, ‘তালতো, উপরে চলেন। ভাত অইতে অইতে চা খাইয়া আসি। কইরে, ফইজা আয়।’
একটু পরে আমি, মমিন আর ফয়েজ মিলে মাঝির পিছু পিছু বাজারের দিকে উঠতে শুরু করলাম।

হাঁটতে হাঁটতে কথা বলছে মাঝি, ‘বুইজলি মমিনা। মাল পাইতে দুইদিন দেরি অইব। চাকমারা এখনো কাডি সাইরতে হারে ন’।’

‘দুইদিন বই থাকমু ঘাডে…বাইছা ডেমারেজ দিবনি?’

‘দূর বেডা তোর ডেমারেজ!’ মাঝি পাত্তাই দিল না মমিনকে। ‘লগে লগে আসি মাল পাওন যায় নি রে? দুই-চাইর-পাঁচদিন বই থাকন লাগে মাঝে মধ্যে।’
বাজারে পৌঁছে একটা চায়ের দোকানে বসলাম। দোকানের তাকে বয়ামভরা মোয়া। দুটো করে মোয়ার অর্ডার দিল মাঝি। বয় মোয়া এনে দিতেই একটা তুলে নিয়ে কামড় বসাল। কচ কচ করে চিবোতে চিবোতে বলল, ‘কাইল আবার রাঙ্গামাইট্যা যামু আমি। তোরা নৌকাত থাইকবি। পালটা মনে হয় কয়েক জায়গায় ছিড়ি গেছে, মেরামত করে নিবি।’

আমার দিকে তাকিয়ে চোখ নাচাল। ‘কী তালতো যাইবান নাকি রাঙ্গামাইট্যা? গেছেন কখনো?’

আমি কিছু বললাম না। মোয়া চিবোতে চিবোতে লাজুক হাসি হাসলাম। আবুল মাঝি এবার মমিনের দিকে চাইল। ‘কী কস রে মমিনা? তালতোরে রাঙ্গামাইট্যা ঘুরাই আনি গই? ফয়জা কী কস?’

ফয়েজ কিছু বলল না। চুপচাপ নিজের মোয়া চিবুচ্ছে। তবে মমিন একদম গলে পানি হয়ে গেল।

সাদা ঝকঝকে দঁতের ঝিলিক ফুটিয়ে বলল, ‘অবইশ্য। কাইল যখন মাল ভরা নাই, তখন আর সমস্যা কী?’

খুব ভাল লাগল। কিছুক্ষণ আগের পেটের ভেতর জেগে ওঠা শীতল ভাব কেটে গেল অনেকখানি। চায়ের দোকানে টিমটিমে আলো জ্বলছে। ঘুটঘুটে পাহাড়ী অন্ধকারের সাথে লড়াই করছে সলতেঅলা টিনের বাতিগুলো। গতরাত নয়াবাজার ছিলাম। নয়াবাজারকে এমনটা মনে হয়নি। ওখানে চারদিক ছিল আরো অনেক উজ্জ্বল আর ফরসা। দক্ষিণ-পশ্চিম দিকের পাহাড়ের ওপরের আকাশ ছিল কাপ্তাইয়ের বিজলী বাতির ছটায় আলোকিত। কিন্তু এখানে এ জায়গার নাম সুবলং। কাপ্তাই থেকে অনেক দূরে। জীবনে কখনো শুনিনি আর এরকম নাম।

তবু এখন এই চায়ের দোকানে বসে মচমচে মোয়া চিবুতে চিবুতে অন্যরকম এক ভালোলাগায় আবিষ্ট হতে শুরু করেছি। দিনভর নাগাড়ে দাঁড় টেনে আসার হাঁড়ভাঙা খাটুনির কথা ভুলে গরম চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে ভাবতে শুরু করলাম, ‘এটাই জীবন।’

এই আমি আছি বাড়ি থেকে অনেক দূরে পার্বত্য চট্টগ্রামের এক অচেনা জায়গায়। এখানে আমি কাউকে চিনি না। কেবল সদ্যপরিচিত কয়েকজন মানুষ আমার সাথে এক টেবিলে বসে চা খাচ্ছে, গল্প করছে। আমি নিজেও তাদের একজন। এদের সাথেই যেন আমার আগামী জীবনের গাঁটছড়া বাঁধা হয়ে গেছে। এদের সাথেই চলতে হবে আমাকে। সুখ-দুঃখ বাঁটোয়ারা করে নিতে হবে। কিন্তু যত যা-ই হোক, শেষ পর্যন্ত আমি এদের সাথে থাকব না। আমার লেখাপড়া আর যোগ্যতাই তাদের বুঝিয়ে দেবে, আমি তাদের চেয়ে সেরা।

আবুল মাঝি গুন গুন করে কথা বলে যাচ্ছে। নৌকো, নাইয়া-মাঝি, ফায়ারউড, পার্টি, সওদাগর…। এসব কথা আমার কানে ঢুকছে, তবে সব যে বুঝছি, তা না। আমার চিন্তায় সুবলং বাজারের স্বল্পালোকিত চায়ের দোকান, বাইরে অন্ধকার, পানির কাছ থেকে বাজারের দিকে সিঁড়ি বেয়ে ওঠা-নামা করা অপরিচিত মানুষ জন। মমিন আর ফয়েজ অবশ্য একান্ত বাধ্য শ্রোতার মতো শুনছে, নিজেরাও কথা বলছে। কিন্তু ওইদিকে কান দেয়ার তেমন গরজ বোধ করছি না। কারণ আমি জানি, আমি বেশিদিন নৌকোয় চাকরি করব না। একদিন কোনো এক সহৃদয় ভদ্রলোকের সঙ্গে আমার দেখা হবে, যিনি আমার আসল পরিচয় পেয়ে সাথে করে নিয়ে যাবেন। তার আছে একটি ছোট্ট সুন্দর পরিবার। একটা সুন্দরী কিশোরী মেয়ে…
‘তালতো তালতো…’ কে যেন ডাকছে। কে ডাকে? কাকে? ‘তালতো…’ আচমকা ধাক্কা খেয়ে সচকিত হলাম।

চলবে…

মাসুদ আনোয়ার। লেখক ও সাংবাদিক। জন্ম – দীর্ঘাপাড়, সন্দ্বীপ, চট্টগ্রাম। পেশায় সাংবাদিক। লেখালেখির শুরু ছাত্রজীবন থেকে। মাধ্যম ছড়া, কবিতা ও উপন্যাস। লেখেন বড়-ছোট উভয় শ্রেণির পাঠকের জন্যে। প্রথম ছড়ার বই ‘হুক্কাহুয়া‘, প্রথম কিশোর উপন্যাস ‘কেউ জানে না‘। কিশোর গল্প সঙ্কলন...

এই বিভাগের অন্যান্য লেখাসমূহ