ইমন কল্যাণ
পরিচ্ছেদ ৩ শীত শেষ হয়ে আসছে।রাঙ্গালীবাজনা ঢোকার মুখের রাস্তাগুলো পলাশ ফুলে ভরে গেছে।অথচ ঠান্ডাই।…..
‘তালতো বোধ হয়, চাকমা মাইয়া গো কথা ভাবতাছে।’ আবুল মাঝির ঠাট্টা শুনে মাথা নিচু করে মুচকি হাসলাম।
‘না, বাইছা…’ সিরাজ মমিনদের মতো আমিও ‘বাইছা’ ডাকলাম মাঝিকে। ‘চাকমা মাইয়ার কথা ভাবছি না। ভাবব কী, ওদের তো এখনও দেখিইনি।’
‘দেখেননি? হা হা হা….’ গলা ছেড়ে হাসল আবুল মাঝি। ‘দেখলেই বুঝবেন। মাইয়া কারে কয়? কী কসরে ফয়জা?’
‘কীরকম?’
‘কীরকম মানি? দেখলে হাগল অই যাইবান গই। হুনেন, হলুদ দেইকছেন না? হেই হলুদের মতন গায়ের রঙ। আর পাছা? গোল, তবলার মতন। থাপ্পড় দিবান, বাজি উইডব ডডং ডং ডডং ডং।’ চোখ বন্ধ করে দু’হাতে তবলার বোল তুলল মাঝি টেবিলের ওপর।
হাসছে ফয়েজ। মমিনও। ওর নাকি আবার খালাতো ভাই মাঝি, বয়সেও বড়। বড় ভাইয়ের রসিকতায় চোরা হাসি হাসছে সে।
চা খেয়ে নৌকোয় ফিরে এলাম। সিরাজের ভাত রাঁধা শেষ। ওর জন্যেও গোটা দুয়েক মোয়া নিয়ে এসেছে মাঝি। কচ কচ করে ওগুলো চিবুচ্ছে সে।
ছইয়ের ওপর বসে আড্ডা মারছি এখন। ভাত খাব আরো পরে। মাঝি নিজের প্যাকেট থেকে বিড়ি অফার করেছে। মমিন ছাড়া আর সবাই বিড়ি ফুঁকছি। পাশের নৌকোগুলোর কোনোটায় খাওয়াদাওয়া চলছে, কেউ কেউ খেয়ে দেয়ে আমাদের মতোই গুলতানি শুরু করেছে। কয়েক নৌকো পরে এক নৌকো থেকে একজন গান ধরেছে, ‘পন্থর মাইঝে পড়ি লইয়ছ অ ভাই আঁতুরা, আঁতুরা ভাই পন্থ ছাড়ি দও না রে মুরাই রে…’
কান খাড়া করলাম ওদিকে। ভাষাটা চাটগাঁইয়া বটে, তবে ঠিক কোন অঞ্চলের বুঝে উঠতে পারছি না। কিন্তু গলাটা এত চমৎকার!
আমরা নৌকো ধরেছি সুবলং বাজারের পেছন দিকে। জায়গাটা একটা ঘোনা। বাজারের সাথে লাগোয়া। ঘোনা হলো পাহাড়ের ভাঁজ। প্রাকৃতিক কারণে ভেতরের দিকে ঢুকে যাওয়া কিংবা ঠেলে বেরিয়ে আসা অংশ। লেকের পানিতে ভাসমান নৌকো-সাম্পান ঘোনাতেই আশ্রয় নেয় রাত কাটানোর জন্যে। খোলা পানিতে থাকে না।
আমাদের ঘোনার দু’পাশে ঝোপজঙ্গল, পাহাড়। ভুতুড়ে অন্ধকার জেঁকে বসেছে। নৌকোয় নৌকোয় বাতি জ্বলছে। টিমটিমে বাতিগুলোকে দূর থেকে দেখলে মনে হবে শয়তানের চোখের মতো। এমন পরিবেশে নিজের অবস্থান নিয়ে মাঝে মাঝে নিজেই সন্ধিগ্ধ হয়ে পড়ছি। এটা সত্যি সত্যি আমি তো? আমি হলে এখানে কী করছি?
খাওয়া দাওয়া শেষ করে ঘুমের আয়োজন। নিজের ব্যাগ থেকে কম্বল বের করল মাঝি। সিরাজ-মমিনরা নিজ নিজ কাঁথা মুড়ে শুয়ে পড়ল। আমার আছে বস্তা। বস্তা গায়ে দিয়েই শুতে হবে। তারই আয়োজন করতে যাচ্ছি, মাঝি বলল, ‘আপনার তো কাঁথা-কম্বল নাই। বস্তা গায়ে দেন নাকি?’
আমি লজ্জা পেলাম। বস্তা গায়ে দিয়ে ঘুমাই, শুনতে কেমন? আবুল মাঝি হাসল। ‘ঠিক আছে। আর বস্তা গায়ে দেওন লাইগ ত ন’। আইজকা আমার কম্বলে শোন, কাল রাঙ্গামাইট্যা থেকে কম্বল কিনি দিমু একখান। কী কন, মাইনষে শীত কালে বস্তা গায়ে দিয়া থাইকতে পারে নাকি, অ্যাঁ? তাছাড়া আমার নিজের একখান ইজ্জত আছে না? আমার নৌকার মানুষ বস্তা গায়ে দিয়া ঘুমায়, মাইনষে হুইনলে ইজ্জত থাইকব? আসেন আসেন।’
কাপ্তাই থাকতে এতটা শীত টের পাওয়া যায়নি। সুবলংয়ে এসে বোঝা যাচ্ছে, পাহাড়ী শীত আসলে কী? ঘোনার মুখ দিয়ে ঢোকা উত্তুরে বাতাস গায়ে যেন বাঘের কামড় বসাচ্ছে। এমন শীত বস্তায় মানবে কিনা কে জানে?
কিন্তু আবুল মাঝির সাথে এক কম্বলে থাকার প্রস্তাব শুনে মন পিছিয়ে যাচ্ছে। সেদিন কাপ্তাই জেটিঘাটেও একই প্রস্তাব দিয়েছিল লোকটা। আমি রাজি হইনি। সম্ভবত বয়সের ব্যবধানের কারণে মন সায় দিতে চাইছে না।
বললাম, ‘না, থাক। আমি বস্তা গায়ে দিই। কোনো অসুবিধা হবে না।’
আবুল মাঝি ব্যস্ত হয়ে উঠল। ‘আরে না না, কী বলেন এসব? এখানে আশেপাশে আরো নৌকোর মানুষ রয়েছে। তারা কেউ দেখতে পেলে কী ভাইবব বলেন তো? আইয়েন।’
আমার সঙ্কোচের কারণটা বুঝতে পারছি না। আবুল মাঝিকে এ পর্যন্ত যতটা দেখেছি, একজন হৃদয়বান ও ভদ্রমানুষই মনে হয়েছে। হয়তো অশিক্ষিত, কিন্তু তাতে কী আসে যায়? অশিক্ষিত বলে কি কাউকে ঘৃণা করার নিয়ম আছে? মানুষকে ঘৃণা করতে নেই। সবাইকে ভাইয়ের মত জানতে হয়। আবুল মাঝি তো আমার বড় ভাইয়ের বয়সী হবে। শীতের রাতে আমার কষ্ট হবে বলেই হয়তো বারবার তার সাথে এক কম্বলে শোয়ার জন্যে পীড়াপীড়ি করছে। অথচ আমি কেবল সঙ্কোচে কুঁকড়ে যাচ্ছি। আচ্ছা, এটা কি আসলে সঙ্কোচ নাকি লোকটা অশিক্ষিত বলে তার প্রতি ঘৃণা কিংবা অবজ্ঞা। তাই যদি হয়ে থাকে, তাহলে ঠিক হচ্ছে না।
অবশ্য প্রচ- শীতে বস্তা গায়ে জড়িয়ে কুঁকড়ে মুকড়ে রাত কাটানোর চেয়ে কম্বলের ওমে ঘুমোনোর প্রলোভনটাও অনুভব করছি মনে মনে।
আবুল মাঝি শুয়ে পড়ল। পাশে জায়গা রেখেছে আমার জন্যে। ‘কই, বসি থাইকবেননি সারা রাইত? আরে আমনে কী চিন্দা গরেন কন তো? দোনো ভাই আইয়েন হুতি হুতি কথা কই।’
‘হুতি হুতি কী কথা কমু’ সেটা অবশ্য বুঝতে পারছি না। তবে শোয়ার ব্যাপারে আর আপত্তি করার কোনো কারণ খুঁজে পাচ্ছি না। বস্তাটা ফেলে রাখলাম এক পাশে। গুটি সুটি মেরে শুয়ে পড়লাম গরম কম্বলের ভেতর মাঝির পাশে। এতক্ষণ ধরে শীতের কামড় খাচ্ছিলাম। মুহূর্তে শীত পালাল, শরীর চাঙা হয়ে উঠতে শুরু করল। অবশ্য কিঞ্চিত ফাঁক রইল দু’জনের মাঝে। ফাঁকটা আমিই রাখলাম। ছোটবেলা থেকেই আমার একা একা থাকার অভ্যাস। কারো গায়ের সাথে গা লাগলে ঘুমের অসুবিধে হয়। আর এখানে তো রয়েছে সঙ্কোচ। হাজার চেষ্টা করেও যা কাটানো সম্ভব হচ্ছে না।
‘কী, নৌকোর কাম কষ্ট লাগে?’
‘ন্না।’
‘সাবাইশ!’ উৎসাহসূচক ধ্বনি দিল মাঝি। ‘এইটাই হলো মরতপোলার মত কথা। মরতপোলা কোনো কামরে ডরায় না। আমনের হইব। আইজকাইল মানুষ মেট্টিক, বিএ,এমএ হাস করিয়েরে রাস্তা রাস্তা ঘুরে। কাম কইরত চায় না। কয় বেকার, চাকরি হায় না। আরে বাবা, চাকরি অইল যে চাকরি, বেতন হাওনটাই আসল কতা। কন’ কাম ছোড নয়। মানুষ আস্তে আস্তে বড় অয়। আঁই আমনেরে দেখিয়েরে বুইজজি, আমনের ভেতর আগুন আছে।’
এক নাগাড়ে প্রশংসার তুবড়ি ছোটাল লোকটা। শুনতে ভালো লাগছে। টুকটাক কথা বলছি আমিও। সঙ্কোচটা কাটতে শুরু করেছে ধীরে ধীরে।
কথা বলতে বলতে কিন্তু ঘনিষ্ঠ হয়ে এল আবুল মাঝি। শরীরের সাথে শরীর লাগল। বলল, ‘আমনে এত খিঁচাই রইছেন কিয়েল্লাই। শীতকাইল্যা গাঁজাগাঁজি করে শোওন লাগে। নইলে মাইজগান দি’ শীত ঢুকে। আরো কাছে আইয়েন।’ একটা হাত রাখল আমার গায়ে।
শীতের দিনে গাদাগাদি করে শুলে শীত কমে ঠিক আছে, কিন্তু সেটা আপনজন, পরিচিত কিংবা বন্ধুবান্ধব হলে। তাই বলে উটকো লোক গায়ে হাত দিলে সেটা ভালো লাগবে কেন? স্বাভাবিকভাবেই তার হাতটা নামিয়ে দেয়া যায়।
কিন্তু এখানে সমস্যা হচ্ছে, লোকটা আবুল মাঝি। আমার চাকরিদাতা। নৌকোয় চাকরি নেয়ার পর থেকে আমার সাথে যথেষ্ট ভালো ব্যবহার করছে। দোকানে নিয়ে নিজের পয়সায় চা-নাস্তা খাওয়াচ্ছে। শীতে কষ্ট পাব ভেবে নিজের কম্বলে শুতে দিয়েছে। আগামীকাল সঙ্গে করে রাঙামাটি নিয়ে গিয়ে কম্বল কিনে দেবে বলছে। একজন মহাপ্রাণ মানুষের সব রকমের লক্ষণ দেখতে পাচ্ছি তার মধ্যে। এমন একজন মানুষকে চট করে উটকো লোক ভাবাটাও একটু কষ্টকর বৈকী।
কিন্তু আচমকা চরম অস্বস্তিতে পেয়ে বসেছে আমাকে। গা শিরশির করছে। একটা বিজাতীয় অনুভূতি। কিন্তু কীই বা বলা যায়? বলব নাকি ‘বাইছা, গায়ের ওপর থেকে হাত সরান।’ সেটা কি ঠিক হবে? এমনও তো হতে পারে যে, লোকটার আসলে গায়ে হাত দিয়ে ঘুমোনোর অভ্যাস। আমাকে ছোটভাই মনে করেই একটা হাত তুলে দিয়েছে। এটা তো হয়তো আদরেরও প্রকাশ হতে পারে।
ব্যাপারটাকে স্বাভাবিক ভাবার চেষ্টা করছি। এটা হতেই পারে, এমনটা হয়ই তো। আমরা মানুষ তো!
নিজেকে মনে মনে ধমক লাগালাম। আসলে আমারই হয়তো দোষ। সহজ জিনিসটাকে কঠিন করে ভাবার কসরত চালাচ্ছি।
গুন গুন করে কথা বলছে মাঝি। বলছে, ‘তালতো, আমনের জন্যে আমার মনে অনেক মায়া হইতেছে। আমনের কথাবার্তায় বুঝতেছি, আমনেরা অনেক উঁচু পরিবারের মানুষ। বিপদে হড়িয়েরে আইজকা নৌকায় চারকি গইরতান আইছেন।’
আবুল মাঝি তার জীবনের কাহিনি শোনাচ্ছে আমাকে। বলছে, আমার মতো তারও নাকি সৎমা ছিল। সৎমা আদর করত না। বাবার কাছে উল্টাপাল্টা লাগাত। আর বাবা সৎমার কথা ধরে আবুল মাঝিকে যখন তখন মারধর করত। ‘ফোঁৎ’ করে দীর্ঘশ্বাস ফেলল লোকটা। ‘বুঝলেন তালতো। হারাদিন কাম-কাইজ করেও বাপের মন পাইতাম না। হাজুইন্না অইলে ডরাই ডরাই ঘরে ঢুইকতাম। খালি চিন্দা গইরতাম, আইজগা মায়ে বাপের কাছে কী লাগাইছে কে জানে? কন কতা ধরি না জানি মাইর শুরু করে দেয়? তারপর…’
তারপর আরেকটু বড় হয়ে প্রায় এই আমার বয়সেই আবুল মাঝি ঘর থেকে পালায়। পালিয়ে সোজা কাপ্তাই চলে আসে। কাপ্তাই এসে প্রথমে নৌকোয় চাকরি নেয়। তারপর নৌকোর নাবিক থেকে মাঝি হয়, মাঝি থেকে শেষে এই কিস্তি নৌকোর মালিক।
বলতে বলতে হাত চঞ্চল হয়ে ওঠে তার। আমার পিঠ থেকে কিলবিল করতে করতে ওটা কোমরের দিকে নামতে লাগল। ঠিক উরু সন্ধিস্থলের ওপর স্থির হলো। অস্থির পাঁচ আঙুল। কর্কশ, নোংরা। তবু কেমন যেন লাগছে। উরু সন্ধিস্থলে কৈশোরিক তীব্র প্রদাহ শুরু হয়ে গেছে। সমগ্র অস্তিত্ব জুড়ে বিদ্রোহের আলোড়ন, তার মাঝেও কেমন উদগ্র উষ্ণতা, উপভোগের চঞ্চলতা। নোংরা, তবু যেন কাম্য।
আড়মোড়া ভেঙে জেগে উঠছে এক সুপ্তিমগ্ন তরুণ পুরুষ। উপভোগ করছি তার জেগে ওঠাকে। চুপচাপ। সঘন নিশ্বাসে।
গুন গুন করে এক নাগাড়ে ক্যাসেট বাজাচ্ছে যেন আবুল মাঝি। সফলতার স্বপ্ন দেখাচ্ছে। বলছে, তার কথামতো চললে একদিন এরকম একখানা নৌকোর মালিক আমিও হতে পারব। কিন্তু কোনো নৌকোর মালিকানা পাওয়ার স্বপ্ন আমাকে আলোড়িত করছে না। কিশোর আলোড়িত হচ্ছে এক নিবিড় নিষিদ্ধ পুলক জাগানো যন্ত্রণায়। পুলক জাগানো সে নিষিদ্ধ যন্ত্রণার বিশাল মাঠে পাগলের মতো মাথা কুটতে চাইছে তার অরব চেতনা, যৌনতাকাতর অস্তিত্ব।
কাঁকড়ার ঠ্যাঙের মতো কিলবিল করছে মোটা কর্কশ আঙুলগুলো। নেমে আসতে চাইছে উরু সন্ধিস্থলের গভীরতম প্রদেশের দিকে। আচমকা সমস্ত আবেগ যেন তিরোহিত হয়ে গেল। ভেতর থেকে মোচড় দিয়ে উঠল তিক্ততা, লজ্জা, বিতৃষ্ণা এবং পৌরুষাভিমানযুক্ত এক অনুভূতি।
‘ধুর!’ ঝাপ্টা মেরে সরিয়ে দিলাম লোকটার হাত। ‘এসব কী?’
‘কে-কেন?’ আবুল মাঝি ব্যস্ত হয়ে হাতটা আবার তুলতে গেল গায়ের ওপর।
ফের ঝাপ্টা মারলাম। ‘সরান তো! এসব আবার কোনধরনের অসভ্যতা? ছি!’
আমাদের পাশে কাঁথামুড়ি দিয়ে ঘুমাচ্ছে মমিন, ফয়েজ আর সিরাজ। নাক ডাকাচ্ছে একজন।
‘আস্তে।’ ফিস ফিস করল মাঝি। ‘ওরা হুইনব।’
‘হুইনবই তো।’ গলা নামালাম না আমি। ‘আপনি নোংরামি বন্ধ না করলে ওদের তো ডাকই দিমু আমি।’
জোঁকের মুখে নুন পড়ার মতো নেতিয়ে গেল যেন লোকটা। নিশ্চুপ হয়ে গেল। আস্তে আস্তে গায়ের ওপর থেকে কম্বল সরিয়ে উঠে বসলাম। রাগে কাঁপছি। অশিক্ষিত মূর্খ মাঝিটা কী ভেবেছে, অ্যাঁ? তার ঘরের বউ? ছি!
‘উডি বইসলেন যে?’ মিনমিনে গলায় জানতে চাইল লোকটা।
কোনো জবাব দিলাম না। লোকটার শয়তানি মন খারাপ করে দিয়েছে। ঘেন্না লাগছে নিজেকে একটুক্ষণ হলেও তার খেলার পুতুল হতে দিয়েছি বলে। যে রোমাঞ্চে আচমকা শিউরে উঠতে চাইছিল শরীর-মন, সেটাকে মনে হচ্ছে নিজেকে অপমান করার মতো। মুহূর্তের দুর্বলতার কারণে অতটা দুঃসাহসী হয়ে ওঠার সুযোগ পেয়েছিল লোকটা। নিজেকে খুব ছোট আর অপবিত্র মনে হচ্ছে যেন।
‘আইচ্ছা, আইয়েন। শুইয়া হড়েন।’ গলা নামিয়ে প্রায় ফিস ফিস করে বলল, ‘আর গইরতাম ন’। আরে আমনেরে টেরাই গরি চাইলাম। আমনে হোলা বালা। চরিত্রবান। আঁই খুব খুশি হইছি। এরকম একজন চরিত্রবান আর শিক্ষিত হোলা দরকার আঁর। আঁর ব্যবসা-বাণিজ্য সব তার হাতে তুলি দি’ এক্কানা নিশ্চিন্ত অন যাইব। আঁর লগে যেগুন আছে, এগুন তো আকাট মূর্খ। কই, আইয়েন? আইয়েন না কা?’
‘আমনে ঘুম যান। আঁই এক্কানা হরে হুতমু,’ গম্ভীর স্বরে বললাম।
‘আরে আইয়েন তো। আমনে দে মশকারিও বুঝেন না।’ আমার হাত ধরে টান দিল লোকটা। ‘আইয়েন ভাই।’
আস্তে করে হাতটা ছাড়িয়ে নিলাম। তারপর উঠে ছইয়ের বাইরে এলাম। ছইয়ের ওপর উঠে বসলাম। ঠা-া বাতাস বইছে। গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল শীতে। আশেপাশের নৌকোগুলোয় কেউ জেগে নেই। একটু দূরে একটা নৌকোয় পানি সেচার শব্দ শোনা যাচ্ছে।
বিড়ি ধরিয়ে বসলাম ছইয়ের ওপর। বাঁশের তরজায় তৈরি ছইয়ের শক্ত ছাদ। ঠা-া। পশ্চিমের পাহাড়গুলো দাঁড়িয়ে আছে আদিম অন্ধকারের মতো তাদের নিরেট অবয়ব নিয়ে। চাঁদ কবে চলে গেছে পাহাড়ের আড়ালে। মাঝে মধ্যে রাতজাগা পাখির ডানা ঝাপটানোর আওয়াজ। দূরে পাহাড়ের কোলে একটা আলো জ্বলছে। কিসের আলো কে জানে? বাজারের ওপর থেকে একটা বাঁশির সুর শোনা যাচ্ছে। আনাড়ি হাতের বাঁশি। মন টানছে না, বিরক্তিই বাড়াচ্ছে শুধু।
ঠান্ডা বাতাস হাড়ে হুল ফোটাচ্ছে। ঠির ঠির করে কাঁপতে শুরু করেছি। শিউরে উঠছি মাঝে মাঝে। তবু নামতে মন চাইছে না। আবার কি লোকটার পাশে শোব? প্রশ্নই আসে না। তার চেয়ে বাবা আমার বস্তাই ভালো। আরাম কম, তবু ঘুম হারাম হওয়ার মতো নয়।
অতএব আবার সে ’বস্তামানব’। কোমর থেকে নিচের দিকে বস্তা, কোমরের ওপর থেকে শার্ট আর তার ভেতরে মোটামুটি একটা গরম গেঞ্জি।
স্বভাবতই ব্যাপারটা পছন্দ হলো না আবুল মাঝির। অবাক হয়ে জানতে চাইল, ‘বস্তা গায়ে দিয়া হুইতবান? কম্বলে কী হইছে।’
জবাব না দেয়াটাই ভালো মনে করলাম। মাঝিও আর দ্বিতীয়বার আওয়াজ করল না। একটু পরে তলিয়ে গেলাম ঘুমের গহীনে।
শেষ রাতে ঘুম ভেঙে গেল। শীতের কামড় টের পাচ্ছি সারা শরীরে বস্তা ভেদ করেও শীত ঢুকে গেছে উরুতে, পায়ে। ওপরের অংশেও একই অবস্থা। শার্ট আর গরম গেঞ্জি দুটোই যেন বরফে চুবানো। দু’হাঁটু কুঁকড়ে নিয়ে এসেছি বুকের ভেতর। শীত সামাল দেয়ার চেষ্টা চালাচ্ছি। আমার বামপাশে ঘুমোচ্ছে আবুল মাঝি তার উলের মোটা কম্বল গায়ে জড়িয়ে। ডান পাশে মমিন, সিরাজ আর ফয়েজ। চিকন সুরে নাক ডাকাচ্ছে মমিন। দুনিয়াতে সবচেয়ে সুখী মানুষ মনে হচ্ছে এখন এই চারজনকেই। পাহাড়ী শীতের রাতে কাঁথা বা কম্বল মুড়ি দিয়ে ঘুমোনোর চেয়ে আরামের আর কী আছে, অন্তত এই মুহূর্তে মনে করতে পারছি না।
চলবে…
পরিচ্ছেদ ৩ শীত শেষ হয়ে আসছে।রাঙ্গালীবাজনা ঢোকার মুখের রাস্তাগুলো পলাশ ফুলে ভরে গেছে।অথচ ঠান্ডাই।…..
দ্বিতীয় পর্ব মইদুল সারারাত এপাশ ওপাশ করেছে।রাতে মনে হয়েছিল প্রেসার বেড়েছে। হাইপ্রেসার আছে ওর বাবারও।বাড়ি…..
পরিচ্ছেদ- ১ সুবীরেশ সেন। কবি। সদ্য নর্থবেঙ্গল এসেছে।এখানেই শহীদুলের সঙ্গে দেখা হওয়ার কথা। শহীদুল বিএ…..
পর্ব – চার ঘরের দক্ষিণ প্রান্তে মাটির উপর খড় বিছিয়ে দেয়া হয়েছে। খড়ের উপর মোস্তাগের…..