জলে জঙ্গলে (পর্ব- ১৩)

মাসুদ আনোয়ার
উপন্যাস, ধারাবাহিক
Bengali
জলে জঙ্গলে (পর্ব- ১৩)

পূর্বে প্রকাশিতের পর…

সকালে ঘুম ভাঙল মাঝির হাঁক ডাকে। ‘সিরাইজ্যা, ফয়জা আর মমিনা’ বলে এক নাগাড়ে চেঁচাচ্ছে লোকটা। যাদের ডাকছে, ওদের আগেই ধড়ফড় করে উঠে বসলাম আমি। গা থেকে বস্তা টেনে খুলে ফেললাম। এদিকে হো-উ-উ করে এক লম্বা হাই তুলল মেটমাঝি মমিন। মুখের কাছে তুড়ি মারতে মারতে জবাব দিল, ‘জ্যা-এ।’

মাঝি তার দিকে তাকালও না। আগের মতোই কর্কশ স্বরে ডাকল, ‘সিরাইজ্যা! এই হালা উডছ না ক্যা? হারা রাইত ঘুম গিয়ছ যে অয় ন’?’

আউ আউ করে কী যেন বলল সিরাজ, তারপর শিথান থেকে বিড়ির প্যাকেট নিয়ে ফস করে ম্যাচ মেরে বিড়ি ধরাল।

বস্তাটা ভাঁজ করে রাখলাম ওটার জায়গায়। টিনের চুলো থেকে পোড়া কয়লা নিয়ে কচ কচ করে চিবিয়ে গুঁড়ো করে ডানহাতের তর্জনী দিয়ে দাঁত মাজতে শুরু করলাম। আবুল মাঝি আমার দিকে চায়নি একবারও। তবে মুখ দেখে অনুমান করে নিলাম, বেজায় চটে আছে। সুযোগ মতো পেলে ঝেড়ে দেবে এক ধমক। ফয়েজ মুখ ধুয়ে নিয়ে ডাকল আমাকে, ‘তালতো আসেন পানি ফেলে দিই।’

নৌকোর চাকরিতে পানি সেচাটা নিয়মিত এবং জরুরি কাজ। অত বড় নৌকোর পানি সেচার কাজ একজনে করতে পারে না। নৌকোর তলা থেকে কাছা পর্যন্ত উচ্চতা এক মাথার চেয়ে বেশি। সুতরাং পানি ফেলার সময় নিচ থেকে একজনকে পানিভরা টিন তুলে দিতে হয় ওপরে যে থাকে তার হাতে। ওপরে বসা জন পানিভরা টিনটা এক টানে কাছায় তোলে। তারপর সেখান থেকে ঢেলে দেয় বাইরে। এভাবে পুরো একটিন পানি নিচ থেকে তোলা এবং বাইরে ফেলে দেয়া আসলে কঠিন পরিশ্রমের কাজ। আমার তো প্রথম দিনেই ক্লান্তিতে দম বন্ধ হয়ে মরার উপক্রম হয়েছিল। এখনো নিজের পালা এলে বুকের ভেতরে ভয়ে গুড় গুড় করে ওঠে। নাইয়ারা পালা করেই পানি সেচার কাজটা করে থাকে।

এবারকার পালা আমার আর ফয়েজের। তবে এই মুহ‚র্তে কাজটা পেয়ে যেন বেঁচে গেলাম। মাঝির ভাব-ভঙ্গি ভালো ঠেকছে না। বুঝতে পারছি, সুযোগ পেলেই ঝেড়ে দেবে রাগটা।

সুযোগ পেতেও দেরি হলো না। ফয়েজ নিচে থেকে টিন ভরে দিচ্ছিল, আর আমি নৌকোর কাছায় বসে ওর কাছ থেকে সেটা টেনে নিচ্ছিলাম ওপরে। ভালোই চলছিল। আচমকা টিনের ভারে ভারসাম্য হারিয়ে ফেললাম। ভারী টিন হাত থেকে ছুটে যাওয়ার উপক্রম হলো। টিনের ভারে আমি নিজেই কাছা থেকে পড়ে যেতে যেতে নিজেকে সামলে নিলাম। তবে টিনটা এসে লাগল কাছায়। তাতে শব্দ হলো ভীষণ আর পানি গেল ছিটকে। ফয়েজের গায়ে ঠাণ্ডা পানি ছিটকে পড়তেই লাফ দিয়ে সরে গেল সে জায়গা থেকে। ভীষণ বিরক্ত হযে বলল, ‘ধুর! টইন শক্ত করে ধইরতে হারেন না। এখন তো আমনেও হড়ি মইরতান।’

ব্যাপারটা সত্যি। টিনসহ নৌকোর তলায় মোটা মোটা কাঠের বাঁকানো বীমের ওপর পড়লে মাথা ফেটে যেতে পারত। ওর বিরক্তি তাই মোটেও অকারণে নয়। আর আবুল মাঝি তার রাগ ঝাড়ার মোক্ষম সুযোগ হিসেবে নিল ব্যাপারটাকে। ছইয়ের ভেতর থেকেই গলা বাড়িযে বলল, ‘এগিন কি বালের কাম নি গরের? উগ্যা টইন আলগানোর শক্তি নাই, হে আইছে নৌকাত চাকরি কইরত। এগিন ইস্কুইল্যা হোলার কাম ন’। দশ ইঞ্চিয়া কলমের আতের কাম নয় দশ আইত্যা হালিশ টানন। আরও শক্ত অন লাইগব। সাইডে গেলে কাঁধে গরি গাছ টানন লাইগব। চিন্দা গরি চান থাইকবান, নাকি যাইবান গই। নৌকার চারকি মানি মাস্টরি ন’ কইলাম।’

অীষণ অপমান বোধ করছি। সিরাজও আমাকে ‘ইস্কুইল্যা পোলা’ বলে খোঁটা দিয়ে কথা বলেছে। এখন দেখছি, সে একই খোঁটা দিচ্ছে মাঝিও। অথচ এই মাঝিই কিনা গত কয়েকদিন ধরে আমি পড়ালেখা জানি বলে কত সমীহভরে কথা বলেছে। আমাকে উৎসাহ-উদ্দীপনা যুগিয়েছে। বলেছে, নৌকোয় চাকরি করতে এসে আমি নাকি ঠিক কাজটিই করেছি।

রাগে মাথায় আগুন ধরে গেল ‘চিন্দা গরি চান থাইকবান, নাকি যাইবান গই’ কথাটা শুনে। কী মনে করে লোকটা? টিনের পানিটা ঝপ করে বাইরে ফেলে দিয়ে বললাম, ‘আমি থাকার জন্যে এসেছি, চলে যাওয়ার জন্যে নয়। কিন্তু হুট করে আপনি আমার সাথে এরকম ব্যবহার শুরু করলেন কেন? কাল রাতেও তো চায়ের দোকানে বসে অনেক ভালো ভালো কথা বলেছেন। এখন কী হলো? কাজ করতে গেলে এক আধটু সমস্যা তো হতেই পারে। তাতে এমন রাগারাগি করার কী আছে?’

চোস্ত বাংলায় ঝেড়ে দিলাম কথাগুলো। আবুল মাঝির মুখ ঝুলে পড়ল। এভাবে যে মুখিয়ে উঠব, বেচারা সম্ভবত ভাবতে পারেনি।

‘আইচ্ছা আইচ্ছা হাইরলে ভালা কতা। হারন তো লাইগব। চারকি গইরতান আইছেন, ন’ হারি কঁডে যাইবান। হে হে হে…!’ সিরাজকে সাক্ষী মানল। ‘ কী কস রে সিরাইজ্যা? তর দেশিরে বুঝাই কইছ, নৌকার চাকরি মাউরগো বাড়ির ছুইল্যা কেলা ন’। হাতে লইলাম আর কোঁৎ গরি গিলি ফেইলাম।’

সিরাজের তো মজা। দাঁত কেলিয়ে হাসতে দেখলাম ওকে। আওয়াজ দিল, ‘হ, বাইছা। ঠিক কইছেন। চারকি চারকি। ইস্কুলের মাস্টরি ন’।’

পানি সেচা শেষ করে ছইয়ের ভেতর ঢুকলাম। দারুণ খিদে পেয়ে গেছে। পাতিলে পান্তাভাত আছে। ভাবছি, এক্ষুণি সবাই হয়তো খেতে বসবে। আবুল মাঝি শার্ট-সোয়েটার পরে তৈরি হয়ে আছে। বাজারে উঠবে মনে হয় চা খেতে। ছইয়ের নিচ থেকে বেরিয়ে নৌকোর গলুইয়ে দাঁড়াল সে। ’মমিনা,’ হাঁক দিল ওখান থেকে। ‘আমি স্টীমারে রাঙামাইট্যা যামু। মাল বোধয় আইজ ভরা অইত ন’। কাইলকা নইলে হরশু সাইডে যামু। তোরা এক কাম গরিছ। শরগান (পাল) ছিলাই লইছ। কয়েক জায়গায় ছিড়ি গেছে গই। চাইছ, হুতি ন’ থাকিছ।’

‘ঠিগ আছে বাইছা,’ মিন মিন করে সম্মতি জানাল মমিন।

‘এখন চা খাইলে আয়। কইরে সিরাইজ্যা, ফয়জা, তোরাও আয়। তালতো নৌকাত থাকেন।’

হতাশ হলাম। চা-নাস্তা খেতে পেলে পান্তাভাত কে খায়? প্রথমে মনে হলো, লোকটা ইচ্ছে করে আমাকে নৌকোয় রেখে যাচ্ছে। সকাল থেকে তার রুক্ষ ব্যবহার দেখে বুঝতে পারছি, কাল রাতে অপমানিত হওয়ার শোধ নিচ্ছে। তিনজনকে নিজের পকেটের পয়সায় চা খেতে আমন্ত্রণ জানানোর মধ্য দিয়ে এটাই বোঝাতে চাইছে যে, ওর কথায় রাজি না হয়ে আমি নিজেরই ক্ষতি করেছি। পরক্ষণে আরেকটা কথা মনে হতে মনঃক্ষ‚ণœ ভাবটা চলে গেল। চারজন নাইয়ার সবাই চা খেতে ওপরে চলে গেলে নৌকো পাহারায় থাকবে কে? সুতরাং মন খারাপ হওয়া ভাবটা কেটে গেল।

তবে ওরা নৌকোয় ফিরে এলে তো আমি ওপরে যাব। কিন্তু পকেটে এক টাকাও নেই। তাই তাড়াতাড়ি ডাকলাম, ‘বাইছা!’

‘কী অইছে?’ বাইছা সাড়া দিল গম্ভীর গলায়।

‘আঁরে কিছু টেঁয়া দি যান। আর হকেটে এক টাকাও নাই।’

‘ন’ থাইকলে আঁই কিত্তাম? আন্নের হকেট খরচা আঁই দিমুনি?’

লোকটার কথাবার্তায় গা জ্বলে যাচ্ছে। কাল রাতেও বাজারের চায়ের দোকানে বসে আমাকে রাঙামাটি নিয়ে যাওয়ার কথা বলেছে। বলেছে, কম্বল কিনে দেবে। আর এখন?

অপমান বোধ করছি। কিন্তু কী বলব বুঝতে না পেরে চুপ করে রইলাম।

ও  থামল না। ‘আমনের চারকি কয়দিন অইছে? ক’ টিয়া হাইবান? এখনো মালের গোড়াত যাইতান হারেন ন। বই বইয়েরে খাইতেছেন, আর ইয়ার মধ্যে টেঁয়া চাইতেছেন।’

আচমকা একটা কথা মনে হলো। সিরাজ-মমিনদের কাছে শুনেছি, তাদের বেতন নাকি অ্যাডভান্স নেয়া আছে। তাইলে আমাকেও অ্যাডভান্স দেবে না কেন? সব চেয়ে বড় কথা হলো টাকা আমার লাগবে। বাজারঘাটায় নৌকো বাঁধা, বাজারে উঠব না চা খাওয়ার জন্যে?

‘অ্যাডভান্স দেন,’ আবুল মাঝির বকাবকি শেষ না হতেই ওর কানের কাছে হঠাৎ পটকা ফোটানোর মতো করে বললাম।

‘অ্যাডভাঁচ?’ আবুল মাঝি যেন আঁতকে উঠল। ‘অ্যাডভাঁচ কী?’

‘কেন, অ্যাডভান্স কী জানেন না? আমার পকেট খরচার টাকা নেই।’

আবুল মাঝি জবাব দিল না। সিরাজ-মমিন-ফয়েজদের নিয়ে ওপরে উঠে গেল। আমি তাকিয়ে রইলাম তাদের পেছনে। সিরাজ কী নিয়ে যেন কথা বলছে মাঝির সাথে। মমিন তা শুনতে শুনতে হাসার চেষ্টা করল। ওরা কেউ পিছু ফিরে চাইল না। কেবল ফয়েজ একবার চাইল। কিছু বলল না অবশ্য।

এই ছেলেটাকে পছন্দ হয়েছে আমার। চুপচাপ থাকে, কথা বলে কম। কিন্তু বেকুব নয়। নোয়াখালীর এই ছেলেটা অশিক্ষিত কিন্তু ভদ্র।

একা একা সময় কাটানো দায়। কী করব বুঝতে পারছি না। ছইয়ের ভেতর এদিক ওদিক তাকালাম। কোনো কোনো বই টই নিদেন পক্ষে একটা পত্রিকা বা ম্যাগাজিন হলেও পাওয়া যায় কিনা। গেল না।

ছইেয়ের ওপর উঠে বসলাম। ডান পাশে চেয়ে দেখি, টিলার ওপর চকচকে টিনের ছাউনি দোতলা কাঠের ঘর। একতলাও আছে খানদুয়েক। কারা থাকে এসব ঘরে?

 পশ্চিমে পাহাড়। সবুজ গাছপালা আর বুনো লতাপাতার ঝাড়। ফাঁকে ফাঁকে দু’একটা ঘর টরও। একটা টিলায় শুকর চরছে। চাকমা বাড়ি নিশ্চয়। বাঙালি শুকর পালে না, ছাগল পালে।

উত্তরেও পাহাড়। পাহাড়ের ফাঁকে ফাঁকে পানি। ছোট ছোট নৌকো ভাসছে পানিতে। মানুষ আসা যাওয়া করছে। একটা দুটো জেলে নৌকোও দেখা যাচ্ছে। সারারাত মাছ ধরে এখন বেচা বিক্রিতে মগ্ন।

কাল রাতে আবুল মাঝির ব্যবহার ভুলতে পারছি না। মাঝে মধ্যেই মনের মাঝে ভেসে উঠছে। রাগ আর ঘেন্নায় রি রি করে উঠছে গা। লোকটা কী ভেবেছে আমাকে? অমন নোংরামি করার সাহস হলো কী করে ওর? লোকটা আমার স্ট্যাটাস, লেখাপড়া আর ব্যক্তিত্বকে অপমান করতে চেয়েছে। তাছাড়া ও আমার প্রায় বাপের বয়সী একজন লোক।

রাগ হচ্ছে, তবে নিজের অসহায়তাও বুঝতে পারছি। আমি এখন স্কুলে পড়া ছাত্র নই। ওই জীবন বিদায় নিয়েছে আমার। লেখাপড়া, স্ট্যাটাস বা ব্যক্তিত্বের কোনো মূল্য পাওয়া যাবে না এখানে। সেটা নৌকোয় ওঠার পর থেকেই প্রতিটি আচরণে স্পষ্ট করে দিচ্ছে আমার বাড়ির কাছের ছেলে সিরাজ। আর গতরাতে আবুল মাঝির আচরণ থেকেও বুঝতে পারছি আমার দাম কতটুকু। সিরাজ-ফয়েজ-মমিনদের সমতুল্য একজন নাইয়া মাত্র কাটগড় হাই স্কুলের সেরা ছাত্রদের অন্যতম আমি। যে একজন কবিও।

কবিতার খাতাটার কথা মনে পড়ল। কাপ্তাই থেকে কেনা আমার কাপড় রাখার ঝোলার ভেতর রেখেছি ওটা। অনেকগুলো কবিতা লিখেছি। সে ক্লাস ফাইভ থেকে লেখা কবিতাগুলো সুন্দর করে নোট করে রেখেছি।

ছইয়ের ভেতরে ঢুকে কবিতার খাতাটা বের করলাম। তারপর ওটা খুলে বসলাম। নিজের লেখা সবচেয়ে প্রিয় কবিতাটা খুললাম। কবিতাটার নাম ‘জিজ্ঞাসা’।

‘যে টাকা দিয়া বানায় বেলুন চন্দ্রে যাইবার তরে

সে টাকা দিয়া লাখো মানুষের এক বেলা পেট ভরে

ভগবান ভগবান!

মানুষে মানুষে হানাহানি বলো কবে হবে অবসান?’

১১১ লাইনের কবিতা। পুরো কবিতাটা পড়লাম খুব আবেগের সাথে। মন ভালো হয়ে গেল। আমি কবি। আমাকে কেউ আটকে রাখতে পারবে না এই নোংরা পরিবেশে। আমি ঠিকই এসব ভেদ করে উঠে যাব আমার উপযুক্ত জায়গায়। কীভাবে যাব জানি না। তবে কেউ না কেউ হাত বাড়িয়ে দেবে। একজন এসে একদিন বলবে, ‘আপনি এত ভালো কবিতা লেখেন? আপনি নৌকোয় চাকরি করছেন কেন? চলেন, আপনি আমার সাথে।’

আমি চলে যাব ওর সাথে। কলেজে ভর্তি হবো। পেপারে পত্রিকায় ছাপা হবে আমার কবিতা। চারদিকে সাড়া পড়ে যাবে। সবাই মুখে মুখে বলবে, ‘যে টাকা দিয়া বানায় বেলুন চন্দ্রে যাইবার তরে/সে টাকা দিয়া লাখো মানুষের এক বেলা পেট ভরে…’

কার লেখা? না, কবি….। সত্যিই, অসাধারণ!

আধঘণ্টা পরে নৌকোয় এল মমিনরা। কী কারণে যেন খুব হাসাহাসি হচ্ছে তিনজনের মধ্যে। আমাকে নিয়ে কিনা কে জানে? কবিতার খাতাটা বন্ধ করে ঝোলার ভেতর রেখে দিলাম। একবার ইচ্ছে হলো, ওদের ডেকে দু’একটা কবিতা শোনাই। তারপর মনে মনে হেসে ভাবলাম, এরা কবিতার কী বুঝবে?

‘তালতো,’ নৌকোর কাছা বেয়ে হেঁটে আসতে আসতে মমিন ডাকল। ‘উপরে যাইবান নাকি?’

‘যান যান,’ একগাল হেসে তাল মেলাল সিরাজ। ‘মাঝি বই রইছে আমনের লাই। মনে অয়, কতা টতা আছে।’

সিরাজের এমন হাসাহাসির কারণ বুঝতে পারছি না। মনে হচ্ছে কোনো কারণে দারুণ মজা পাচ্ছে। পাত্তা দিলাম না ওকে।

শার্ট পরে নামলাম নৌকো থেকে। মমিন বলল, ‘তালতো, তাড়াতাড়ি আইয়েন। কাম আছে।’

আঁকাবাঁকা রাস্তা বেয়ে উঠে যাচ্ছি বাজারের দিকে। পশ্চিম দিক থেকে আসা বিশাল উঁচু এক পাহাড়ের তুলনামলক নিচু অংশটাতে গড়ে উঠেছে এই বাজার আর স্থানীয়দের বাড়িঘর। কেন জানি না. অসম্ভব ভালো লাগছে। জন্ম থেকে এ পর্যন্ত বেড়ে উঠেছি সমতল ভ‚মিতে। পাহাড়ও দেখিনি কোনোদিন। আর এখানে পার্বত্য চট্টগ্রামে বিশাল বিশাল পাহাড় আর পাহাড়ের ফাঁকে ফাঁকে এমন পানি, এমনটা তো কল্পনা করাও হয়ে ওঠেনি কোনোদিন। হ্রদের গভীর নীল পানির বুকে মাথা জাগিয়ে থাকা গাঢ় সবুজ পাহাড়। জীবনের ক্ষুদ্র, নিস্তরঙ্গ, সোজাসাপ্টা অভিজ্ঞতায় এ যেন গভীর রহস্যমাখানো প্রলেপ। এ অপরিচিত বারোয়ারি মানুষজন, পাহাড়ের ফাঁকে ফাঁকে বিশাল জলাধার, অচেনা বুনো লতাপাতা,ওপরে নিবিড় নীল আকাশ আর শীতের কুয়াশামাখা প্রকৃতি—হাঁটতে হাঁটতে কেমন যেন ঘোরে আক্রান্ত হয়ে গেলাম। মনে হতে লাগল, বড় হয়ে গেছি আমি। নিজের সিদ্ধান্তে নিজের পথ বাছাই করার ক্ষমতা পেয়ে গেছি। ভাবলাম, পুরুষের জীবন আসলে এমনই হওয়া উচিত। আর এমন জীবনকেই তারিয়ে তারিয়ে চেখে দেখার এরকম সুযোগ পেয়ে গেছি হঠাৎ। গুন গুন করে পথ চলেছি। মাঝে মধ্যে বাজারের দিক থেকে নেমে আসা মানুষের সাথে দেখাও হচ্ছে। আহ, নীল আকাশের নিচে আমি রাস্তায় চলেছি একা….

গতরাতে নৌকো বেঁধে যে দোকানে চা খেয়েছিলাম, সে দোকানেই পেলাম আবুল মাঝিকে। বিড়ি না সিগ্রেট ধরিয়ে ফুক ফুক করে টানছে। ভাব দেখে মনে হচ্ছে ভাবছে কিছু একটা। আমি ঢুকতে গলা খাঁকার দিয়ে ডাকল। ‘তালতো।’

চাপদাড়িঅলা শ্যামলা মুখে এখন রাগের কোনে চিহ্ন নেই। কাছে যেতেই বলল, ‘বসেন। এই পোয়া, ইনদি’ চা-নাস্তা দে।’

এমনটা আশা করিনি। অবাক হলাম। লোকটা হঠাৎ এত ভালো ব্যবহার শুরু করল কেন? অবশ্য একটু পরেই টের পেলাম। পরোটা ছিড়ে ভাজিসহ মুখে পুরতেই বলল, ‘সকালে আমনের লগে খারাপ ব্যবহার করছি, কিছু মনে করিয়েন না।’ গলা নামাল একটু। ‘ আর কাইল রাতেও ভালো কাজ করি নাই। আসলে মানুষে মানুষে আগে বন্ধুত্ব অওন লাগে, নইলে…’ থেমে তাকিয়ে রইল আমার মুখের দিকে।

চুপচাপ পরোটা-ভাজি গিলছি আমি। লোকটা শেষ পর্যন্ত কী বলতে চায়, বোঝার চেষ্টা করছি।

খানিকক্ষণ চুপচাপ আমার খাওয়া দেখল আবুল মাঝি। তারপর মুখ খুলল ফের। ‘কাল রাতে আমনের বস্তা গায়ে দিয়ে ঘুমানো দেখে খুব খারাপ লেগেছে আমার। আমি বুঝতে পারি নাই, আমনে এতটা মনে কষ্ট নিবেন।…যা হোক, ভুল অই গেছে। আমনে কিছু মনে নিয়েন না, ভাই।’

আবেগটা আমার একটু বেশি। গলে গেলাম মাঝির কথায়। মনে হলো চোখে পানি চলে আসবে। কেন এমন হয় জানি না। কেউ একটু আদর করে কথা বললে তাকে খুশি করার জন্যে পাগল হয়ে যাই।

চায়ে চুমুক দিয়ে ভাবলাম ওর কথাগুলো। তারপর বেশ একটু আত্মতৃপ্তিও পেলাম। লোকটা বোধ হয় আমার অনড় ব্যক্তিত্বের কাছে নিজের ক্ষুদ্রতার ব্যাপারটা বুঝতে পেরেছে। তাই এখন অনুতপ্ত হয়ে এসব কথা বলছে। মন হালকা হয়ে উঠল। মাঝির সাথে ঝগড়া বা ভুল বোঝাবুঝির অবসান হয়ে যাচ্ছে। এটা খুব ভালো দিক। মাঝি আমাকে ইজ্জত দিলে সিরাজরাও দিতে বাধ্য হবে। সকালে নৌকো থেকে নামার সময় দেখা সিরাজের ঘিনঘিনে হাসির দৃশ্যটা চোখের সামনে ভেসে উঠল।

‘কই, কিছু কন না যে?’ আবুল মাঝি তাড়া দিল। ‘এখনও রাগ অই রইছেন? আরে মিয়া, মানুষ চাইলে আল্লার কাছে মাফ পায়, আর আমি আমনের কাছে মাফ পামু না?’

‘আরে না, কী বলেন আপনি, বাইছা।’

মাঝি সদ্যকেনা স্টার সিগ্রেটের প্যাকেট বাড়িয়ে দিল। ‘নেন, খান। আল্লার কছম কইয়র, কাইলকা রাইতকা আমারতুন খুব খারাপ লাইগছে। শীতে অনেক কষ্ট পাইছেন, না?’

গত রাতের ওই ঘটনার জন্যে আবুল মাঝিকে অনুশোচনায় একদম কাতর মনে হচ্ছে। ওর অনুতাপমলিন চেহারা দেখে আমারও রীতিমতো কাতর হয়ে পড়ার জোগাড়। চা শেষ করে ওর প্যাকেট থেকে সিগ্রেট বের করে ম্যাচ জ্বালিয়ে বললাম, ‘বাইছা, আঁই বুইঝঝি। মানুষ মানেই ভুল। আপনে আর এটা নিয়ে কথা বলবেন না। শুনতে খারাপ লাগছে।’

শান্ত হলো আবুল মাঝি। টেবিলের ওপর রাখা প্যাকেট থেকে সেও সিগ্রেট ধরাল। তারপর ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে বলল, ‘চলেন, রাঙামাইট্যা যাই। আমনের লাই কম্বল কিনত অইব। নইলে এই পাহাড়ী শীতে বাঁইচতান ন’।’ একটু খানি চোখ মটকে বলল, ‘শোনেন, আমনের কোনো খরচ নাই। সব খরচ আমার। আপডাউন ভাড়া, চা-নাস্তা, হোটেল খরচ, সিনেমা, কম্বল কিনা—সব খরচ আমার। চলেন।’

ঝট করে মাথা তুলে তাকালাম লোকটার চোখে। এটাই ওর মতলব! তাই বুঝি এত কাতর ভাব, এত অনুতাপ-অনুশোচনা। গা ঘিন ঘিন করে উঠল। রাগ চেপে বললাম, ‘না। আমার বস্তায় শীত মাইনব। কম্বল লাইগদ ন’।’

রাগের ঝিলিক দেখা গেল লোকটার চোখে। মিনিটখানেক তাকিয়ে রইল আমার দিকে। তারপর পকেট থেকে ২০ টাকার একটা নোট বের করে ছুঁড়ে দিল টেবিলের ওপর। ‘আচ্ছা, সেটা আমনের ইচ্ছা। এখন ২০ টাকা নিয়া যান। অ্যাডভাঁচ। আমনের চায়ের বিল দিয়া যাইয়েন। আর নৌকাত যাই ঠিক মতো কামকাজ করেন। আমি রাঙামাইট্যা যামু। যান।’

চলবে…

মাসুদ আনোয়ার। লেখক ও সাংবাদিক। জন্ম – দীর্ঘাপাড়, সন্দ্বীপ, চট্টগ্রাম। পেশায় সাংবাদিক। লেখালেখির শুরু ছাত্রজীবন থেকে। মাধ্যম ছড়া, কবিতা ও উপন্যাস। লেখেন বড়-ছোট উভয় শ্রেণির পাঠকের জন্যে। প্রথম ছড়ার বই ‘হুক্কাহুয়া‘, প্রথম কিশোর উপন্যাস ‘কেউ জানে না‘। কিশোর গল্প সঙ্কলন...

এই বিভাগের অন্যান্য লেখাসমূহ