জলে জঙ্গলে (পর্ব- ১৪)

মাসুদ আনোয়ার
উপন্যাস, ধারাবাহিক
Bengali
জলে জঙ্গলে (পর্ব- ১৪)

আগের পর্বের লেখা পড়ুন এখানে >>>

পূর্ব প্রকাশের পর

পরের দু’দিন কাটল প্রায় শুয়ে বসে। মাঝি চলে গেছে রাঙামাটি। তার নির্দেশ মতো দু’দিন ধরে নৌকোর পাল সেলাই করা হলো। ছেঁড়া জায়গাগুলো মেরামত করলাম দু’দলে বিভক্ত হয়ে। আমি আর ফয়েজ এক দলে, অন্যদলে মমিন আর সিরাজ। জায়গাটার নাম সুবলং। ফয়েজের মুখে শুনলাম, সুবলংকে বলা হয় হিলট্রাক্টসের নাভি। বলল, ‘বুঝলেন তালতো, উপরের দিকে, মানে মাইনি, মারিস্যা, কাছালং, মাছালং, বরকল, হরিণা যাই বলেন, আপনি যেখান থেকেই মাল নিয়ে আসেন, কাপ্তাই যেতে হলে পথ এই একটাই। এই সুবলংই। দক্ষিণ থেকে উত্তর দিকে বিরাট লম্বা পাহাড়ের মাঝখানে এই জায়গাটা যেন আল্লাই কইরা দিছে, নইলে আর কোনো খান দি কোনো পথ নাই।’

ছেঁড়া পাল সেলাই করে করে দু’দিন কাটল। মোটামুটি আরামের কাজ। একজন ছেঁড়া দুই অংশকে একত্র করে মিলিয়ে ধরবে, আরেকজন সূঁচ দিয়ে সেলাই করে যাবে। কিন্তু আমার ভাল লাগল না। নৌকোয় চাকরি নেয়ার আগে সিরাজদের চলাফেরা, জেটিঘাটে বেড়ানো, চায়ের দোকানে বসে আড্ডা মারা আর গান শোনা দেখে রোমাঞ্চিত বোধ করেছিলাম।  নৌকোর কাজকর্ম সম্পর্কে আদতেই ধারণা ছিল না। দাঁড় টানা, নৌকো থেকে পানি সেচে ফেলা, পাল ছিঁড়ে গেলে সুঁই-সুতো নিয়ে সেলাই করা…এসব কাজ করতে হবে কে জানত? তাছাড়া সিরাজের কাছ থেকে কর্কশ ব্যবহার, মাঝির নোঙরামি…এসব তো কল্পনাতেও ছিল না। কিন্তু গত তিন-চারদিনের মধ্যেই এসব কিছু একের এক ঘটে গেল, অবাক হওয়ার সময়টুকুও পেলাম না।

আমার ইচ্ছে হচ্ছে সুবলং বাজারে চায়ের দোকানে বসে আড্ডা মারতে, চা খেতে খেতে গান শুনতে অথবা দূরের পাহাড় কিংবা পাহাড়ের ওপরে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকতে। সত্যি, সে সময় এক অদ্ভুত ভাললাগায় আবিষ্ট হয়ে যায় মন। এক আলাদা জগতের অস্তিত্ব খুঁজে পাই যেন। সেখানে আমি সবার সেরা, আশে পাশের সবাই আমাকে সমীহ করে, যে কোনো কিছুতে আমার মতামতকে গুরুত্বের সঙ্গে নেয়। দোকানের টেপরেকর্ডারে গান বাজে : ন’ মাতাই ন’ বোলাই গেলি রে বন্ধুরে, মনর আশা ন’ পুরালি….’

শেফালী ঘোষের গানে কখনো কখনো হল্লা দেয় অশিক্ষিত খদ্দেরের দল, আদিরসে টৈ টুম্বুর মন্তব্য ছুঁড়ে দেয়…খারাপ লাগে শুনতে, তবুও মনে হয় এটাই জীবন। এভাবেই কাটা উচিত একজন মানুষের জীবন। গানে গানে, আকাশের দিকে তাকিয়ে চমৎকার কিছু ভাবতে ভাবতে আর মানুষের শ্রদ্ধা-সমীহ উপভোগ করতে করতে।

কিন্তু ইচ্ছে হলেই যে তা করা যায় না, সেটা যেন একটু কঠিনভাবে বুঝলাম। সিরাজ যখন বলল, ‘সারাদিন চার দোয়ানে বই থাকনের চারকি আমনেরে কে দিছে? আমগোও তো উরপে যাওনের ইচ্ছা হয়।’

অন্যায্য কিছু বলেনি সিরাজ। সন্ধের সময় বাজারে উঠে চায়ের দোকানে বসে দুই টাকা খরচ করেছি। টেপরেকর্ডারে গান শুনেছি ইচ্ছে মতো। গান নয়, হাসান-হোসেনের জারি। দারুণ গলা গায়কের। উঠতে ইচ্ছে হয়নি। নৌকো থেকে উঠে আসার সময় সিরাজ বলেছিল, আমি নিচে নামলে ওরাও বাজারে উঠবে। সুতরাং একটু যেন তাড়াতাড়ি ফিরি। কিন্তু আমি যে গানের সুরে মগ্ন হয়ে সব ভুলে বসেছিলাম! গান শুনতে শুনতে কাপের পর কাপ চার আনা দামের চা খাচ্ছিলাম আর বিড়ি ফুঁকছিলাম।

সিরাজ আর মমিন উঠে এল মাগরিবের আজানের পর। দোকানে ঢুকে আমাকে দেখতে পেয়ে কাছে এল। সিরাজই প্রথমে মুখ খুলল, জানতে চাইল, সারাদিন চার দোয়ানে বই থাকনের চারকি আমারে কে দিছে?

মমিন অবশ্য রাগারাগি করল না। বলল, ‘তালতো চা খাইছেন? এবার তাইলে নৌকাত যান। ফয়জারে পাঠান।’

বিল মিটিয়ে দিয়ে বেরিয়ে এলাম দোকান থেকে। সিরাজের কথায় আর আগের মতো প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হচ্ছে না মনে। বুঝে গেছি, এই ছেলের স্বভাবটাই এরকম। তাছাড়া আরো একটা ব্যাপার মনের ভেতর অস্পষ্টভাবে ধরা পড়তে শুরু করেছে যে, আমি নিজেকে যতটা দামী কিংবা সম্মান পাওয়া উচিত বলে ভাবি, আমার আশেপাশে যারা আছে, তাদের সেরকম মনে নাও হতে পারে। বুদ্ধি হওয়ার পর থেকে এই প্রথম সম্পূর্ণ ভিন্ন এক পরিবেশে এসে পড়েছি। এরা কেউ আমার আত্মীয়-স্বজন, খেলার সঙ্গী কিংবা সহপাঠী নয়; এদের সঙ্গে দেখা হচ্ছে আমার বর্তমান অবস্থায়। আর বর্তমান অবস্থায় আমার পরিচয় একজন নৌকোর নাইয়া মাত্র। তার মানে তারাও আমাকে একজন নৌকোর নাইয়া হিসেবে দেখছে। সত্যি কথা হলো, তাদের এই দেখাটা অস্বাভাবিকও নয়।

বস্তা গায়ে দেয়া শীতের রাত কাটছে ভালোই। কোমরের নিচের দিকে বস্তা, গায়ে গরম জামা, তার ওপরে শার্ট আর মুখ মাথা ঢাকা লুঙ্গি দিয়ে। শোয়ামাত্র দুনিয়া থেকে বিচ্ছিন্ন। তখন কেবল আমার সাথে আমি আর আমি। কথা বলি, স্বপ্ন দেখি, স্মৃতির পাতা ওল্টাই, ভবিষ্যতের ছবি দেখি। তখন আর আমি নৌকোর নাইয়া নই, আমার পাশে যারা শুয়ে ঘুমোচ্ছে, তাদের ধরাছোঁয়ার বাইরে। আমি যেখানে হাঁটি, কথা বলি, যাদের সাথে মিশি.. এরা তার ধারে কাছেও যাওয়ার কথা ভাবতে পারে না। আসলে এদের কথা তখন চিন্তাও করি না। আমার পাশে এসে দাঁড়ায় এক চঞ্চলা, সুন্দরী কিশোরী, যার মুখে অনেক হাসি আর চোখভরা মায়া আর দুষ্টুমি। সে কিশোরী আমাকে ভালোবাসে, আমিও তাকে ভালোবাসি। আমরা দু’জন উড়ে বেড়াই ভালোবাসার নীলাকাশে, ঘুরে বেড়াই প্রিয় চেতনার মগ্ন সৈকতে। ঘুমানোর আগের এই সময়টুকু আমার কাছে হীরের মতো দামি। সমস্ত পৃথিবী থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে নিজেকে নিয়ে বিভোর থাকার মাহেন্দ্র ক্ষণ।

দু’দিন পরে মাঝি এল রাঙামাটি থেকে। স্টীমার থেকে নেমে নৌকোয় উঠেই তোড়জোড়। নৌকো ছাড়তে হবে। মাল রেডি। সওদাগর তাড়া দিয়েছে তাড়াতাড়ি মাল ভরে নিয়ে কাপ্তাই জেটিঘাট পৌঁছার জন্যে।

শীতকাল। দুপুরের ভাত খেয়ে উঠতে না উঠতে আসরের সময় হয়ে গেছে। ভাবছি, আজ হয়তো সুবলং বাজারে থেকে কাল সকালে নৌকো লোড করার জন্যে সাইটে পৌঁছানো হবে। বুকের ভেতর কেমন যেন লাগছে। সন্ধে বেলার সুবলং বাজারটাকে যেন ভালোবেসে ফেলেছি।

এই চায়ের দোকানে বসে গরম গরম চা-বিস্কুট খাওয়া, টেপরেকর্ডারে গান শোনা, বাঙালি-পাহাড়ী নানা চেহারার মানুষ দেখা, কান পেতে চট্টগ্রাম, নোয়াখালী, চাকমা ও মারমা ভাষার কথাবার্তা শোনা—এসবই আমার কাছে নতুন।

কিন্তু মাঝি ভাত খেয়ে উঠেই হুকুম দিল, ‘মমিনা, নৌকা ছাড়।’

এক ফুঁয়ে বাতি নেভার মত করে সব আশা উবে গেল। ফয়েজ ক‚লে উঠে নৌকোর রশি ছেড়ে দিল। সিরাজ দাঁড়াল লগি হাতে। আর আমি নিজের দাঁড়টা ঠিক করে পানিতে ফেলে টানতে শুরু করলাম। নৌকো চলতে লাগল আস্তে আস্তে। আবুল মাঝি ছইয়ের নিচে বসে বিড়ি টানছে।

সুবলং বাজারের ঘোনা ছেড়ে নৌকো বেরিয়ে পড়ল প্রশস্ত পানিতে। দাঁড় টানতে টানতে বাজারের টিলার দিকে তাকিয়ে আছি। আস্তে আস্তে দূরে সরে যাচ্ছে বাজারটিলা, দোকানপাট, ঘরবাড়ি। একটা বাঁক ফিরতেই অদৃশ্য হয়ে গেল।

সূর্য পাহাড়ের আড়ালে চলে গেছে। পানিতে নেমে এসেছে পাহাড়ের ছায়া। পানি নীল রঙ হারিয়ে গভীর ছাই রঙ ধরতে শুরু করেছে। আকাশ নীল। চারদিকে গাঢ় সবুজের প্রবল সমারোহ। আমাদের বিশাল কিস্তি নৌকো এগিয়ে চলেছে ধীরে ধীরে। কোথায় গিয়ে থামবে কে জানে? গন্তব্য জানা থাকলে পথ চলতে একঘেয়ে লাগে না।

সন্ধে হয়ে গেছে অনেক আগে। রাত নামতে শুরু করেছে। নিচে কালো পানি, ওপরে কালো আকাশ আর দু’পাশে কালো কালো সব উঁচু-নিচু পাহাড়-টিলা। আকাশ জুড়ে তারার মেলা। পুবাকাশে সামান্য রুপোলি আভা। চাঁদ ওঠার আগের সময়। আবুল মাঝি ছইয়ের নিচে বসে আছে। নাকি শুয়ে আছে কে জানে? নৌকোয় আলো জ্বালা হয়নি। অন্ধকারে মাঝে মধ্যে যে বিড়ি খাচ্ছে, আগুনের ফুলকি দেখে সেটা বোঝা যাচ্ছে। অবশ্য গানের সুরের মতো একধরনের শব্দও শুনছি হঠাৎ হঠাৎ। তিন দাঁড়ের শব্দ ছাপিয়ে কানে এসে লাগছে। বিড়ি টানতে টানতে গান গাইছে মনে হয়।

নৌকো ছাড়ার পর প্রচÐ ক্লান্তি এসে ভর করেছিল শরীরে। এখন আর নেই। ক্লান্তি কাটানোর এই টেকনিকটা রপ্ত করে ফেলেছি আমি। কিছু না, কেবল ধৈর্য ধরে একটুখানি সয়ে নিতে হয়। কখন শরীরে পরিশ্রম সয়ে যায়, টেরও পাওয়া যাবে না।

তিন তিনটে দশহাতি দাঁড় চলছে থোড় বড়ি খাঁড়া, খাঁড়া বড়ি থোড়-এর মতো। অন্ধকারে বোঝাই যাচ্ছে না নৌকো চলছে কিনা।

এক সময় চাঁদ উঠল পাহাড়ের মাথায়। কালো পানিতে উত্তুরে বাতাসে জাগা চিকন ঢেউ স্পষ্ট হয়ে উঠল। দাঁড়ের আগায় মাঝে মধ্যে রুপোলি ঝিলিক। চাঁদের আলো আর কুয়াশা মিলে আকাশ ধোঁয়াটে। হঠাৎ হঠাৎ চিক চিক করে উঠছে দু’পাশের পাহাড়ের ঝোপঝাড়ের পাতা।

আস্তে আস্তে বাঁক নিচ্ছে নৌকো। পাহাড়ের প্রায় গা ঘেঁষেই। আমাদের পাশের পাহাড়টা ধীরে ধীরে পিছিয়ে যাচ্ছে। এখন বোঝা যাচ্ছে যে, থেমে নেই নৌকো। দু’পাশ থেকে নৌকোর দিকে ঘনিয়ে আসছে পাহাড়। পেছনে ঘাড় ফেরাতে দেখি একটা টিলায় বাতি জ্বলছে মিট মিট করে। নৌকোর গতি সে বাতিঅলা টিলার দিকে। ওখানে গিয়ে থামবে মনে হয়।

আলসেমি এবং অনীহা দুটোই কেটে গেল।  একটা গানের দুটো লাইন মনে এল। গাইতে ইচ্ছে হলো গলা ছেড়ে। কিন্তু চুপ করে রইলাম। নৌকোয় মাঝি আছে। নতুন মানুষ, গান গাইতে শুনলে কী ভাববে কে জানে?

বাতিজ্বলা সে টিলাটায় নৌকো ভেড়ানো হলো। একটা গাছের গোড়ার সঙ্গে বাঁধা হলো রশি। খালি নৌকোয় পানি জমেছে অনেক। আমি আর ফয়েজ পানি সেচতে লেগে গেলাম। সিরাজ রান্নার তোড়জোড় লাগাল। মাঝি উঠে গেল ওপরে। পার্টির সঙ্গে কথা বলতে। সওদাগরের নৌকো এসে গেছে মাল নেয়ার জন্যে। পার্টিকে সে খবর দিতে হবে এখন।

রাতে খেয়ে দেয়ে গল্পগুজব হলো কিছুক্ষণ। বক্তা আবুল মাঝি, শ্রোতা আমরা নাইয়ারা। মাঝে দু’এক কথা বলছে সিরাজও। ফয়েজ বরাবরের মতো চুপ। আমি নতুন মানুষ কী বলব? তাছাড়া তাদের গল্পের যা বিষয়বস্তু, সে সম্পর্কে আমার কোনো ধারণাই নেই। বেশিরভাগই ফায়ারউড, নৌকো লোড, চাকমা-তংচইঙ্গা, মারমা-বোমদের নিয়ে। কাপ্তাই লেকে নৌকো বাইতে গিয়ে আবুল মাঝির নানা অভিজ্ঞতার কথা শোনাচ্ছে। কখনো হাসির, কখনো কান্নার মতো। হাসির গল্পে আমরা হাসছি। সবচেয়ে সরব গলা সিরাজের। অট্টহাসি দিচ্ছে ও। আবার দুঃখের গল্পে ‘আহা উহু’ করে সমবেদনা জানাচ্ছে। আর তাতে দারুণ উৎসাহ পাচ্ছে আবুল মাঝি। বার বার ওকে সম্বোধন করে বলছে, ‘বুইজলি সিরাইজ্যা, টেঁয়া-হইছা কামানে বহুত কষ্ট রে। গার রক্ত হানি গরিয়েরে…..’

টাকা-পয়সা কামাতে গিয়ে গায়ের রক্ত ‘হানি’ নাকি জল হয়, সেটা টের পেয়ে গেছি আমিও দিনদুয়েক দাঁড় টানতে গিয়ে। হাতে ফোসকা পড়া জায়গাগুলো এখনো জ্বলছে। মুঠো করতে গেলে টের পাই। কিন্তু এ-মুহূর্তে আমার চিন্তা সেটা নিয়ে নয়। আমি ভাবছি, রাতে ঘুমোতে গেলে আবুল মাঝি আবার তার সাথে এক কম্বলের নিচে ঘুমোনোর আব্দার জুড়ে দেয় কি না। চিন্তাটা আমাকে বারবার বিরক্ত করছে। লোকটার গোছা দাঁড়িঅলা মুখের দিকে তাকাতে পারছি না। গা ঘিন ঘিন করছে। টের পাচ্ছি মাঝে মাঝে সেও দেখছে আমাকে চোরা চোখে।

একটু পরে গল্প বন্ধ হলো। আবুল মাঝি তাস খেলার প্রস্তাব দিল। সিরাজ লাফিয়ে উঠে বলল, ‘তিন তাস।’

আবুল মাঝি মুখ ভেঙচাল। ‘শালার ভাই শালা, টেঁয়া বেশি অই গেছে, না? জুয়া ছাড়া তাস খেলন যায় না?’

মুখ কালো করে ফেলল সিরাজ। ‘তাহলে টুয়েন্টি নাইন।’

একটু পরে তাস খেলতে বসল ওরা চারজন।

পাস, ষোলো, সতেরো, বিশ, গোলাম, কুড়ি, রঙ……শুনতে শুনতে বিরক্ত হয়ে গেলাম একটু পরেই। ওরা খেলায় মগ্ন, আমি গিয়ে ছইয়ের ওপরে উঠে বসলাম। আজ কেন জানি, শীত একটু কম লাগছে।

পরদিন সকালে উঠে পান্তাভাত খেয়ে তৈরি হয়ে গেলাম। মাঝি ওপরে উঠেছে পার্টিকে ডেকে আনার জন্যে। সিরাজ মুচকি হাসল আমার দিকে চেয়ে। ‘তালতো, মাল ভরা পড়িব।’

মাল ভরা মানে নৌকোয় ফায়ারউড লোড করা। সেটা জেনে গেছি এতদিনে। কিন্তু কীভাবে লোড করে, তা এখনো জানি না। কাজটা নিশ্চয় খুব কষ্টের হবে। ভাবতে গিয়ে পেটের ভেতর মাঝে মাঝে গুড় গুড় করে উঠছে। ঝোঁকের বশে নৌকোয় চাকরি করতে এসে কতটা ভুল করলাম জানি না। তবে সিরাজের মজা-মারা হাসি দেখে মনে হচ্ছে, ফায়ার উড লোড করার কাজটা চায়ের দোকানে বসে চা খেতে খেতে টেপ রেকর্ডারে গান শোনার মতো সুখকর হবে না।

‘তাতে কী অইল?’ জবাব দিল মমিন। ‘তুই তালতো রে ডর লাগাছ ক্যা? তালতো মরতপোলা। সব কাজ হাইরব। কী কন তালতো? হাইরতান ন’?’

বলতে যাচ্ছিলাম, মানুষ যা করেছে, মানুষ তা পারবে। কিন্তু থেমে গেলাম। এটা আসলে বইপত্রের কথা। সত্যি বটে। কিন্তু বাস্তব জীবনে তা পারতে গেলে কাজ করতে হয়। এই কাজ করার ব্যাপারটাই আসল। কে কতটা করতে পারে, সেটা করতে গেলেই বোঝা যায়। করার ইচ্ছেটাই হলো মুখ্য। আমার কি সে ইচ্ছে আছে? কিন্তু এ মুহূর্তে ইচ্ছে থাক আর না-ই থাক, করতেই হবে। না করে থাকার উপায় তো দেখছি না।

মমিনের কথায় মৃদু হাসলাম। কিছু বলার জন্যে মুখ খোলার আগে ফয়েজই জবাব দিল, ‘সিরাইজ্যা, নিজেরে কী মনে গরছ? খাইল্যা তুই-ই বেডা? মানুষেরে ডর লাগাছ ক্যা? হইলা দিন তুই-ই কি হারছিলিনি বেক্কিন বরাবর? তালতো ইস্কুলে হড়ইয়া মানুষ। আঙ্গ লগে এখন কাম কইরত আইছে। আঙ্গ উচিত হেই মিয়ারে কাম শিখান। কাম গরনের আগে ডর লাগাই দিলে বেচারা যাইব কডে?’

এত কথা ফয়েজ এর আগে কখনো বলেনি। মনে হয়, রেগে গেছে সিরাজের ওপর। সিরাজ হাসল। মোক্ষম জবাব পেয়ে মুখে আর কথা জোগাচ্ছে না। চুপ করে গেলাম আমি। আমার কথা ফয়েজই বলে দিয়েছে।

একটু পরে মাঝি নেমে এল পার্টিসহ। ধুপ ধাপ করে তক্তা বেয়ে নৌকোয় উঠতে র্উঠতে হুকুম দিল, ‘মমিনা, নৌকা ছাড়।’

চাকমা পাড়ার ঘাট ছেড়ে নৌকো আরো ভেতরের দিকে চলল। পঙের ভেতর গল্প জুড়ে দিয়েছে মাঝি আর চাকমা  লোকটা। দু’জনে খুব হাসাহাসি করছে দেখছি। মাঝির গলাই একটু বেশি সতেজ।

নৌকো বোঝাই করতে যাচ্ছি আমরা। ফায়ার উড, মানে কাঠ বোঝাই করা হবে। কীভাবে  করা হবে জানি না। তবে কাজটা যে আরামের হবে না, সেটা বুঝতে পারছি। কাপ্তাই জেটিঘাটে নৌকোর ওপর থেকে কাঁধে বয়ে কাঠ নিয়ে ট্রাক বোঝাই করতে দেখেছি জেটির লেবারারদের। এখানেও নিশ্চয় সে কাঁধে বওয়া বওয়ির ব্যাপার আছে। নৌকোর দাঁড় টানতে টানতে এসব ভাবছি। দুশ্চিন্তায় মুখ টুখ বোধ হয় শুকিয়ে গেছে আমার। এত বড় নৌকো লোড করতে কী পরিমাণ কাঠের দরকার হবে কে জানে?

আমার সহকর্মীদের দেখি তেমন কোনো ভাবান্তর নেই। তারা পুরনো নাইয়া।  দাঁড় টানতে টানতে গল্প করছে সিরাজ আর ফয়েজ। মাইনী না লংগদু কোথায় মাল ভরতে গিয়েছিল কখন, সে কথা বলছে। বলতে বলতে ফয়েজ হাসছেও খুব।

মাঝে মাঝে তলপেটে শীতল ভাব টের পাচ্ছি। বুকের ভেতর যেন ধক করে উঠছে। তবে একই সাথে এটাও টের পাচ্ছি যে, সিরাজ, ফয়েজ, মমিন এরা আমার বর্তমান সময়ে আমার চেয়ে অনেক বেশি বড়, অনেক বেশি যোগ্য। আমার স্কুলে পড়া বিদ্যা এখানে কোনো কাজে আসবে না।

চলবে…

মাসুদ আনোয়ার। লেখক ও সাংবাদিক। জন্ম – দীর্ঘাপাড়, সন্দ্বীপ, চট্টগ্রাম। পেশায় সাংবাদিক। লেখালেখির শুরু ছাত্রজীবন থেকে। মাধ্যম ছড়া, কবিতা ও উপন্যাস। লেখেন বড়-ছোট উভয় শ্রেণির পাঠকের জন্যে। প্রথম ছড়ার বই ‘হুক্কাহুয়া‘, প্রথম কিশোর উপন্যাস ‘কেউ জানে না‘। কিশোর গল্প সঙ্কলন...

এই বিভাগের অন্যান্য লেখাসমূহ