জলে জঙ্গলে (পর্ব- ১৫)

মাসুদ আনোয়ার
উপন্যাস, ধারাবাহিক
Bengali
জলে জঙ্গলে (পর্ব- ১৫)

আগের পর্ব পড়ুন এখানে >>>

নৌকো যাচ্ছে পাহাড়ের ফাঁকে ফাঁকে। এখানে খোলামেলা কোনো জায়গা নেই। ডুবে যাওয়ার আগে পাহাড়ের ফাঁকে ফাঁকে যেসব নিচু জায়গা বা খাত ছিল, পানি হয়ে যাবার পর সেগুলো খালের মতো সরু সরু আঁকাবাঁকা জলাশয়ের রূপ নিয়েছে। এখন নৌকোর দু’দিকেই পাহাড়। তেমন উঁচু নয়। লাল মাটিতে সবুজ গাছপালা, বুনো লতাপাতার ঝাড়। রামকলাগাছের দঙ্গল। প্রচুর কলা ধরে রয়েছে। পেকে ঝরে যাচ্ছে। অবাক হয়ে ভাবছি, এত কলা কেউ পেড়ে নেয় না কেন? পাহাড়ীরা কি কলা খায় না?

পাহাড়ের ওপর মাঝে মধ্যে পাহাড়ীদের টংঘর। মহিলারা ঘাটে আসছে, পানির ঘটিবাটি-কলসী ভরাচ্ছে। দু’একটা শুয়োর চড়ছে নাকে অবিরাম ঘোঁত ঘাঁত শব্দ করতে করতে। দাঁড় টানতে টানতে এসব দৃশ্য দেখছি আমি।

কলার দিকে আমার তাকিয়ে থাকাটা বোধ হয় খেয়াল করছিল সিরাজ। আচমকা হেসে উঠে বলল, ‘তালতো, ক্যালা খাইবাননি?’

বাচ্চা বয়সে অনেক ‘ক্যালা’ খেয়েছি, ঠিক আছে। কিন্তু স্কুলের ওপরের ক্লাসে ওঠার পর থেকে আর খেয়েছি বলে মনে পড়ছে না।। তখন কলাই খেতাম। মানে শব্দটাকে ‘কলা’ বলতাম। তাই সিরাজের মুখে ‘ক্যালা’ শুনে একটু চমকে উঠলাম। কেন যেন মনে হলো, ছেলেটা আমাকে ব্যঙ্গ করে কথাটা বলল। অবশ্য কথাটা সে ঠাট্টা করেই বলেছে। আর এমন ঠাট্টায় মনঃক্ষূণœ হওয়ারও তেমন কোনো কারণ নেই। তবু সিরাজ বলেছে বলেই একটু বিরক্ত হলাম। কী বলব, ভাবছি, এমন সময় জবাব দিল ফয়েজই, ‘তালতো, এসব হলো রামক্যালা। বান্দরে খায়। বিচির জ্বালায় মাইনষে কামড় দিতে পারে না। আমি একবার কামড় দিয়ে থো থো গরি ফালাই দিছিলাম।’

ফয়েজও সে ‘ক্যালা’ই বলেছে, কিন্তু সেটা খারাপ লাগল না। দেখা যাচ্ছে, সিরাজকে আমি মনে মনে অপছন্দ করতে শুরু করেছি। ক্রিয়ার বিপরীত প্রতিক্রিয়া।

নৌকো এখন আরো ঘন পাহাড়ী এলাকায়। কখনো কখনো দু’দিক থেকে পাহাড় এত চাপা যে, দাঁড় টানার অবকাশ নেই। অগত্যা মাঝির হুকুমে লগি নিল ফয়েজ। লগির ঠিলায় এগোচ্ছে নৌকো। দাঁড় সোজা করে নৌকোয় তুলে নিয়েছি। মাঝি আর চাকমা লোকটি ভেতর থেকে বেরিয়ে ছইয়ের ওপর দাঁড়িয়েছে। নানারকম গাছপালা আর বাঁশঝাড়ে ঠাসা দু’দিকের পাহাড়।

এক জায়গায় থামানো হলো নৌকো। যেখানে থামলাম, সেখানে একটা কাঠের ¯তূপ। নৌকো থেকে সিঁড়ি নামানো হতেই লাফ দিয়ে নামল চাকমা লোকটা আর আবুল মাঝি। চাকমাকে বলতে শুনলাম, ‘এখানে বরাবর এক চের। নে, ভর।’

নৌকো থেকে গজফিতা নিয়ে নামল মমিন। কাঠের ¯তূপের গোড়ায় গিয়ে সেটার দৈর্ঘ্য-প্রস্থ-উচ্চতা মাপল। তারপর একটু হিসেব করে বলল, ‘একশ’ মণ।’

দু’জনের কথার আগা-মাথা কিছুই বোঝা গেল না। কী এক চের, মানে এক সের আর একশ মণ বলছে! সামনের কাঠের ¯তূপটায় কী পরিমাণ কাঠ আছে তার হিসেব তো? সেটা যদি একশ’ মণ হয়, তাহলে ঠিক আছে। ¯তূপের সাইজ দেখে বোঝাই যায়, এখানে যে পরিমাণ কাঠ আছে, সব মাপলে একশ’মণ হতেই পারে। কিন্তু সেটা আবার এক সের হয় কী করে? গাছের এক একটা খ-ের ওজনই তো পাঁচ ছয় সেরের কম নয়। আর মোটা মোটাগুলোর ওজন এক-দেড়-দু’মণের কম নয়। তাহলে?

যা-ই হোক, নৌকো বোঝাই শুরু হয়ে গেল। ¯তূপের গোড়ায় দাঁড়িয়ে সিরাজ এক একটা গাছের খ- তুলে দিতে লাগল ফয়েজের হাতে। ফয়েজ ওটা দিল আমার হাতে। আর আমার হাত থেকে নিতে লাগল মমিন। নৌকোর ভেতর থেকে হাত বাড়িয়ে ওটা নিতে লাগল আবুল মাঝি স্বয়ং। ধুপ ধাপ করে ‘খামাল’ দিতে লাগল। খামাল দেয়া মানে হলো ঠিক মতো গুছিয়ে রাখা।

এক সের হোক আর একশ’ মণ হোক, বেশিক্ষণ লাগল না ফায়ারউডগুলো নৌকোয় তুলে নিতে। তেমন কোনো পরিশ্রমও হলো না। সবার সাথে সমান তালে কাজ করেছি, একধরনের ভালও লাগল। শুধু একবার একটা উল্টো ঘটনা ঘটল। সময় মতো সামলে উঠতে পেরেছিলাম, নইলে মারাত্মক দুর্ঘটনায় পড়তে হতো।

কাঠের ¯তূপ থেকে তুলে নিয়ে একখানা করে কাঠ নিয়ে সিরাজের দিকে বাড়িয়ে দিচ্ছিল ফয়েজ। সিরাজ দিচ্ছিল আমার দিকে। আমি দিচ্ছিলাম মমিনকে। ভারী, কাঁচা কাঠ। সাবধানে একে অন্যের দিকে বাড়িয়ে দিচ্ছি। বাড়িয়ে ধরা কাঠটা অপর পক্ষ ঠিক মতো ধরে নিয়ে নিজের দিকে টেনে নিচ্ছে, এরকম আভাস পাওয়ার পরই ছাড়ছিলাম হাত থেকে। মোটামুটি ভারী একখানা কাঠ সিরাজরে হাত থেকে নিয়ে মমিনের দিকে বাড়িয়ে দিলাম। মমিন ওটা আমার হাত থেকে নিয়ে বাড়িয়ে দিল নৌকোর ভেতরে মাঝির দিকে। মমিনকে কাঠের টুকরাটা দিয়ে আমি সিরাজের দিকে ফিরতেই পরের কাঠটা ছুঁড়ে দিল সে আমার দিকে। একই সঙ্গে মুখে চেঁচিয়ে উঠল, ‘তালতো, ধরেন ধরেন।’

চোখের কোণায় আচমকা ছুটে আসা কাঠ দেখে হোক আর সিরাজের চেঁচানি শুনে হোক, চমকে উঠে হাত বাড়িয়ে দিলাম। কাঠটা এসে পড়ল আমার হাতে। ধরার প্রস্তুতি না থাকায়, এবং এতক্ষণ ধরে অনুসৃত নিয়মের আচমকা ব্যত্যয় ঘটায়, কাঠটা ধরে ফেললাম বটে, কিন্তু আকস্মিক চাপটা সামলে নিতে কষ্ট হয়ে পড়ল। হাত থেকে পড়েই যাচ্ছিল প্রায়, কী করে যেন সামলে নিলাম। কিন্তু সামলাতে গিয়ে কোমর গেল বাঁকা হয়ে।  আর তাতে পাও গেল তক্তা থেকে হড়কে। এবার নিজেকে পড়ে যাওয়া থেকে বাঁচাতে গিয়ে হাতের কাঠটা ছেড়ে দিলাম। কাঠ পড়ল পানিতে আর আমাকেও ঝোঁক সামলানোর জন্যে দিতে হলো লাফ। একলাফে তক্তা ছেড়ে নিচে। যাহোক পানিতে পড়লাম না, পড়লাম গিয়ে কাদামাটিতে।

এদিকে আমাকে পড়ে যেতে দেখে আঁতকে উঠল মমিন। ‘এই তালতো, সাবধান!’

ওদিকে সিরাজ বিরক্তির স্বরে বলে উঠল, ‘ধ্যাত মিয়া, এই গাছটাও ধরতে পারলেন না। কী কাম গরেন…’

মমিন রুখে উঠল, ‘তুই ব্যাডা গাছটা ছুঁড়ে দিলি ক্যান? হেই মিয়া নতুন মানুষ, আইজও কামের ভাও-ভাক্কা বুঝেনি?’

কাঠটা ভেসে উঠেছে পানিতে। আমি ওটা তুলে নিলাম। চুপচাপ বাড়িয়ে দিলাম ফয়েজের দিকে। তারপর ফের নিজের জায়গায় এসে দাঁড়িয়ে সিরাজকে বললাম, ‘এতক্ষণ তো সমস্যা হয়নি। হঠাৎ এমন কী সমস্যা হলো ছুঁড়ে দিতে হলো?’

সিরাজ মুখ ঝামটা দিয়ে কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল, কিন্তু নাক গলাল মাঝি। ‘হালা সিরাইজ্যা, উলডা পালডা কাম কইরলে কিন্তু লাইত্তাইয়েরে গালের চোয়া ভাঙি দুমু, বুইজ্যস? হে মিয়া নতুন মানুষ, তর মতো পুরান অইলে তরে এক চোয়ার লাগাই দিত এখন।’

বাকি মালগুলো ভরা হয়ে গেল বিপত্তি ছাড়াই। নৌকো ছেড়ে দিয়ে আরেক ঘাটের দিকে যাত্রা শুরু হলো।

আরেক ঘাটের পঁচিশ মণ মাল। দূর থেকে দেখেই বলে দিল ফয়েজ। অবাক হওয়ার ভঙ্গি করল, ‘আরেব্বাবা! কী মোটা মোটা রে? কী গাছ, অ খুড়া?’

‘গোদা গাছ.’ এক গাল হেসে জবাব দিল খুড়া, মানে চাকমা পার্টি। ‘ছাগর ওজন!’

মানে অনেক ভারী ভারী গাছের টুকরো। লোকটার হাসি দেখে মনে হচ্ছে, ‘ছাগর’ ওজন হওয়ায় দারুণ খুশি সে। দু’তিন টুকরো কাঠ বড়। এগুলো হাতে আলগে নৌকো তোলা যাবে না।

আগে ছোটগুলো তুলে নেয়া হলো। ভারী গাছগুলো তোলার আগে একটু জিরিয়ে নেয়া দরকার। আবুল মাঝি নিজে থেকে বলল এ কথা। নৌকোর তলার পানিতে হাত ধুয়ে নিয়ে সিগারেট ধরাল। আমি, সিরাজ আর ফয়েজকে ডেকে দিল তিনটা। মমিনকে সাধল না। ও ছোটভাই। তাছাড়া মমিন বিড়ি খায়ও না।

নাহ্, স্টার সিগারেটে লম্বা টান দিতে দিতে ভাবলাম, আবুল মাঝি লোকটা আসলে ততটা খারাপ নয়। তাছাড়া চালাকও। তিনটা সিগারেটে মাত্র দেড় টাকা খরচ করে নাইয়াদের আনুগত্যের হাওয়া কিছুটা হলেও চাগিয়ে দিয়েছে। অন্তত নিজের দিক থেকে হলেও আমি কৃতজ্ঞতা বোধ করছি। কাজ করতে গিয়ে ঢিলেমি দিতে খারাপ লাগবে।

সিগারেট টানতে টানতে আবুল মাঝি আমার দিকে তাকাল। তারপর মৃদু হেসে বলল, ‘কী তালতো, কষ্ট অয়নি? আমনে ইস্কুইল্যা হোলা। লেয়াহড়া কইরছেন। জীবনে কনদিন কাজ করেন ন’। নাইয়ার কাজ বড় শক্ত কাজ। হুঁশ গরি কাম না গইরলে আত-ঠ্যাঙ ছিড়ি যায়। চারিমিক্যা খেয়াল রাখন হড়ে, বুইজঝেননি?’

‘হ্যাঁ, বাইছা।’ মৃদু হাসলাম আমিও। মাঝির আচার-ব্যবহার চমৎকার লাগছে এখন। অবশ্য ‘ইস্কুইল্যা হোলা’ কথাটা ভাল লাগল না। একথাটা বলে বলে সিরাজ এতবার খোঁচা দিয়েছে যে, এখন শুনলে অপমান লাগে। মনে হয়, স্কুলে পড়ে বিরাট কোনো অন্যায় করে ফেলেছি আর এখন তার মাশুল দিচ্ছি। ব্যবহারের কারণে একটা ভাল কথাও কেমন খারাপ হয়ে যায়!

তবে মাঝি কিন্তু সিরাজের মতো খোঁচা মারার জন্যে শব্দটা ব্যবহার করেনি। এটা হলো সহানুভূতির প্রকাশ। নিজের কর্মচারীদের ওপর দায়িত্ব বোধ থেকে উৎসারিত।

সিগারেট খাওয়া শেষ। গোড়াটা পানিতে ছুঁড়ে মেরে উঠে দাঁড়াল আবুল মাঝি। সাথে সাথে আমরাও। মমিন এতক্ষণ নৌকোর কাচায় দাঁড়িয়ে মাল নিচ্ছিল আমার হাত থেকে। এবার সেও নামল নিচে। মোটাসোটা কাঠের এক মাথা ধরে দাঁড়িয়েছে ফয়েজ। মমিন গিয়ে দাঁড়াল অন্য মাথায়। দু’জনে দু’মাথা ধরে আলগা দিতেই সিরাজ গিয়ে কাঁধ ঠেকাল ওটার নিচে। তারপর কাঁধের ওপর যুৎসই ভাবে বসিয়ে নিয়ে হাঁটতে শুরু করল। নৌকো থেকে নিচের দিকে নামিয়ে দেয়া তক্তা বেয়ে উঠতে শুরু করল। ওর লিকলিকে শরীর বাঁকা হয়ে গেছে ভারী কাঠের চাপে। ল্যাগব্যাগ করে তক্তা বেয়ে উঠল। একটু থেমে এবার নৌকোর ভেতরের দিকে নামানো তক্তা বেয়ে নামতে লাগল। তলায় নেমে দুম করে ফেলল কাঠটা খামাল দেয়া কাঠের ওপর। মাঝির নিচু গলায় সাবধান বাণী শোনা গেল, ‘আস্তে।’

এবার আমার পালা।

ভয় লাগছে। তার চেয়ে বেশি লাগছে অস্বস্তি। শেষ পর্যন্ত কাঁধে গাছ বইতে হবে?

সিরাজকে যেটা দিয়েছে, তার চেয়ে একটু চিকন একটা বেছে নিল দু’জন আমার জন্যে। দু’জন দু’মাথা ধরে ডাকল, ‘তালতো আইয়েন।’

জীবনে কি কখনো কাঁধে করে গাছ টেনেছি? মনে করতে পারলাম না। অন্যকে টানতে দেখেছি অবশ্য। আমার নানাবাড়িতে এক লোক লাকড়ি চেরাই করতে আসত। নানা সারা বছরের জ্বালানির জন্যে বাগান থেকে গাছ কাটিয়ে চেরাই করে রাখতেন।  ওই লোকটি গাছ কেটে খ- খ- করে বয়ে নিয়ে আসত পরিষ্কার একটা জায়গায়। তারপর চেরাই করত। একটা আলগা ঘরে জমা করে রাখা হতো সে লাকড়ি। কালো রঙের প্রায় গোলাকার লোকটা যখন গাছের গুঁড়ি বয়ে আনত, দারুণ আগ্রহ নিয়ে চেয়ে থাকতাম। ভাবতাম, ইস, আমিও যদি এরকম কাঁধে করে গাছ বয়ে আনতে পারতাম। একদিন সে প্রস্তাব করতে লোকটা হেসে উঠে বলেছিল, ‘আরে নাতি, তুমি কি গাছ বইবা? তুমি তো বড় অইলে মাস্টরি কইরবা।’

লোকটার এ কথাটা আমার মনের ভেতর গেঁথে গিয়েছিল সম্ভবত। স্থির ধারণা জন্মে গিয়েছিল, আমরা বড় হচ্ছি, স্কুলে যাচ্ছি কাঁধে করে গাছটানার জন্যে নয়, কলমহাতে মাস্টারি করার জন্যে। শ্রেণীবৈষম্য সম্ভবত এমনি করে মনের ভেতর অঙ্কুর মেলে দেয়। শিশু তার অজান্তেই ভবিষ্যতের মাস্টার কিংবা রাখাল হয়ে ওঠার প্রস্তুতি নিতে শুরু করে। বড় হয়ে ওঠে সেটাকেই নেহাত স্বাভাবিক ভাবতে ভাবতে।

সুতরাং ‘তালতো আইয়েন’ কথাটা যেন মনের ভেতর প্রচ- ঝাপ্টার সৃষ্টি করল। আমাকে কি কাঁধে গাছ টানতে হবে? কিন্তু এটা তো আমার কাজ নয়, লেবারারের কাজ! আমি কী করে….

‘কই, তালতো? আইয়েন না….ডাক দিল মমিন। অসহিষ্ণু হয়ে উঠেছে।

‘আরে, খাড়াই খাড়াই কী চিন্দা গরেন। আগে মাল ভরেন নৌকাত। মাল ভরা অইলে হারাদিন বই বই চিন্দা গইরজেন!’ ঝামটা মেরে উপদেশ দিল সিরাজও।

ওর ঝামটা শুনেই যেন দিব্যজ্ঞান লাভ হলো। বুঝলাম, এখন আর আমি মাস্টার নই, লেবারার। আমার লেখাপড়ার ইজ্জত রাখতে কেউই আমার কাজ করে দেবে না। আমাকেই করতে হবে আমার কাজ। সে নৌকো বাওয়া হোক আর কাঁধে গাছটানাই হোক।

ওরা গাছ ধরে দাঁড়িয়ে আছে। আমি গাছের পাশে গিয়ে দাঁড়ালাম। বললাম, ‘দেন।

গাছ না দিয়ে খেঁকিয়ে উঠল সিরাজ, ‘অই মিয়া! কাঁধে কিছু দেন। নইলে কাঁধ ফাডি যাইব গৈ।’

ওর খেঁকানি পছন্দ হলো না। পাল্টা ঝামটা দিয়ে বললাম, ‘আরে মিয়া দেন তো। আর কাঁধের চিন্দা আমনের গরন লাইগদ ন’।’ বিশুদ্ধ সন্দ্বীপ্যা ভাষা।

এদের সঙ্গে পরিচয়ের সময় ছিল পারস্পরিক সম্ভ্রম ও সৌজন্য বোধ। তারই সুবাদে আমার মুখে ছিল বিশুদ্ধ মানভাষা। স্কুলে ওপরের ক্লাসে ওঠার পর থেকেই ওটার চর্চা শুরু করেছিলাম নিজের অজান্তেই। ক্লাসমেটদের সঙ্গে বলতাম, শিক্ষকদের সঙ্গে বলতাম। স্কুলের বাইরে অপরিচিত বা স্বল্প পরিচিতদের সঙ্গেও বলতাম শুদ্ধভাষা। তাই কাপ্তাই এসেও এরা অশিক্ষিত হলেও ওদের সঙ্গেও শুদ্ধভাষা বলতে শুরু করেছিলাম সৌজন্য হিসেবে।  কিন্তু পরিচয়ের সূচনায় সে সৌজন্য ও ভদ্রতার রেশ কাটতে সময় লাগেনি। যখনই ওরা আমাকে নিজেদের সমপেশায় পেয়ে গেল, তখনই আমার সাথে তাদের আচার-ব্যবহারের ধরনও পাল্টে গেল। সুতরাং পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে আমার পক্ষেও আর আগের সে ভাব বজায় রাখা সম্ভব হচ্ছে না। ওদের নিত্যাচরিত কথাবার্তা আর আচার-আচরণের সাথে ফারাক বজায় রাখা এখন আর সম্ভব হয়ে উঠছে না। সুতরাং সিরাজকে পাল্টা ঝাড়ি দেয়ার সময় ওদের ভাষাই বেরোতে শুরু করল মুখ দিয়ে।

পাল্টা ঝাড়ি খেয়ে সিরাজ আর কিছু বলল না। মমিনের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘দেরে মমিন ভাই, তয় কাঁধের ছড়-ছল্লা উডি গেলে আঙ্গ দোষ যেন ন’ দেয়।’

দু’জনে দুই মাথা ধরে গাছের গুঁড়িটা তুলে দিল ওরা আমার কাঁধে। বাম কাঁধে নিয়ে বাম হাতেই আকড়ে রাখলাম ওটাকে, যাতে পড়ে না যায়। হাঁটতে শুরু করলাম নৌকো থেকে সিঁড়ি হিসেবে নামিয়ে দেয়া তক্তার দিকে।

এবড়োখেবড়ো বাকলঅলা গাছটা ভারীও বটে। হাঁটতে গিয়ে দু’পায়ের টলো মলো অবস্থা টের পেলাম। ওদিকে কাঁধের চামড়ায় যেন সূঁচ গাঁথতে শুরু করেছে। প্রচ- ব্যথা করছে। চামড়া ফুঁড়ে কী যেন ঢুকে যাচ্ছে ভেতরে। সিঁড়ি বেয়ে উঠতে গিয়ে মনে হচ্ছে, এই বুঝি পড়ে গেলাম গাছসহ নিচে। কিন্তু বুঝতে পারছি, অন্তত সেটা করা যাবে না। গাছটা নিয়ে নৌকোয় পৌঁছাতেই হবে। যদি পথের মধ্যে কোথায় ফেলে দিই ব্যথা সহ্য করতে না পেরে, তাহলে সিরাজদের টিটকারির চোটে টিকে থাকা দায় হয়ে যাবে। ইস্কুইল্যা পোয়া..ইস্কুইল্যা পোয়া কথাটা কানের ভেতর দিয়ে ঢুকবে আগুনে পোড়া লোহার শলাকার মতো। সুতরাং কোনোভাবেই ফেলা যাবে না কাঁধ থেকে।

টলো মলো পায়ে এগোচ্ছি, বেয়ে উঠছি কাঠের তক্তা দিয়ে বানানো সিঁড়ি। এক..দুই..তিন…আরেকটু গেলেই নৌকোর কাছায় উঠে যাব। কাঁধ অসাড় হয়ে পড়েছে, চামড়ার ভেতরে কী যেন বিঁধে গেছে। জ্বলছে ভীষণ। চার..পাঁচ..ছয়…উঠে গেছি নৌকোর কাছায়। এবার ভেতরের সিঁড়িটা বেয়ে নামতে হবে।

পেছন থেকে সিরাজের তাচ্ছিল্যমাখা হাসির শব্দ শুনতে পেলাম। একই সঙ্গে মমিনের উৎসাহ জাগানিয়া কথা, ‘সাবাইশ তালতো। এই হলো মরতপোলার কাম। কে কয় তালতো হাইত্ত ন’, অ্যাঁ!’

এটাও একধরনের মশকরা বটে। তবে সিরাজের মন্তব্যে যেমনটা থাকে, সেরকম গা জ্বালানিয়া ভাব নেই। হঠাৎ করে মনে হলো বইতে পড়া সে কথাটা, মানুষ যা করেছে, মানুষ তা পারবে। সিরাজ যদি গাছটা নৌকোয় নিয়ে ফেলতে পারে, আমিও পারব।

শেষ পর্যন্ত পারলামও। নৌকোর ভেতরের দিকে তক্তা বেয়ে নেমে দড়াম করে ফেললাম গাছটা।

‘আহ্,’ চেঁচিয়ে উঠল আবুল মাঝি। ‘এত জোরে ফেললে নৌকোর তলা ফাডি যাইব তো।’

আবুল মাঝির নৌকোর তলা ‘ফাডি’ যাক আর না যাক, এই মুহূর্তে আমার কিছু আসে যায় না। আমি ব্যস্ত হয়ে পড়েছি আমার কাঁধ নিয়ে। গাছটা ফেলে দিয়েই কাঁধে হাত বুলিয়ে আগে পরখ করে নিলাম ছড়-চামড়া উঠে গেছে কিনা। ভীষণ জ্বালা করছে কাঁধ। তবে মাথা ঘুরিয়ে যেটুকু দেখা গেল, ব্যস্ত হয়ে পড়ার মতো কিছু আছে বলে মনে হলো না। দগদগে দাগ পড়ে গেছে কেবল। ভেবেছিলাম কাঁধ ছড়ে গিয়ে রক্ত টক্ত বেরিয়েছে। কিন্তু তেমন কিছু দেখা গেল না। স্বস্তির নিশ্বাস ফেললাম। বুঝলাম, কাঁধের ওপর গামছা টামছা কিছু একটা রাখা উচিত ছিল।  সিরাজরা অভিজ্ঞ নাইয়া বলে সেটা জানে এবং আমাকেও তা করতে বলেছিল। কিন্তু আমি গোঁয়ার্তুমি করে ¯্রফে উড়িয়ে দিয়েছিলাম ওর পরামর্শ।

৭০০ মণী কিস্তি নৌকোয় মাল বোঝাই  দেয়া অত সহজ ব্যাপার নয়। প্রথম দিন যা মাল পেলাম, তাতে নৌকোর তলাও ভরল না। দ্বিতীয় দিন আর মাল পাওয়া গেল না। পার্টি জানাল,  আরো দিনদুয়েক দেরি হবে বাকি মাল পেতে। গালি দিয়ে বলল, ‘মোগোদাগুন ট্যাঙা খাই বই রয়্যন। কিচ্ছু হাম ন’ গরতন।’ মানে ওর মানুষগুলো টাকা খেয়ে বসে আছে, কিন্তু ঠিক মতো কাজ করেনি।

তার মানে পরের দু’দিন কোনো কাজ নেই, খাওয়া আর ঘুমানো ছাড়া। আরো মজা হলো মাঝি চলে যাবে কাপ্তাই। তার অন্য কাজ আছে। ভোরে চাকমাদের নৌকোয় চড়ে সুবলং যাবার আগে বলল, ‘মমিনা, ঠিকঠাক মতো মাল ভরি আনিছ। চাইছ, উলডাপালডা যেন ন’ অয়।’

চলবে…

মাসুদ আনোয়ার। লেখক ও সাংবাদিক। জন্ম – দীর্ঘাপাড়, সন্দ্বীপ, চট্টগ্রাম। পেশায় সাংবাদিক। লেখালেখির শুরু ছাত্রজীবন থেকে। মাধ্যম ছড়া, কবিতা ও উপন্যাস। লেখেন বড়-ছোট উভয় শ্রেণির পাঠকের জন্যে। প্রথম ছড়ার বই ‘হুক্কাহুয়া‘, প্রথম কিশোর উপন্যাস ‘কেউ জানে না‘। কিশোর গল্প সঙ্কলন...

এই বিভাগের অন্যান্য লেখাসমূহ