জলে জঙ্গলে (পর্ব- ১৬)

মাসুদ আনোয়ার
উপন্যাস, ধারাবাহিক
Bengali
জলে জঙ্গলে (পর্ব- ১৬)

আগের পর্ব পড়ুন এখানে >>>

না, উল্টো পাল্টা কিছু হয়নি। আবুল মাঝি চলে যাওয়ার পর মোটামুটি আনন্দেই কাটল আমাদের দিন। আমার অন্তত সেরকমই মনে হলো। বস্তা গায়ে দিয়ে রাত কাটানো অভ্যাস হয়ে গেছে। প্রথম দিন গাছের গুঁড়ি কাঁধে তুলতে গিয়ে যে অস্বস্তিতে ভুগেছিলাম, দ্বিতীয় দিন সে অস্বস্তি আর রইল না। কষ্ট অবশ্য হলো। তবে মমিন-ফয়েজরা, এমনকী সিরাজও কাঁধে বওয়ার গাছ পেলে বেছে বুছে ছোট টুকরোটাই দিল আমাকে। শিখিয়ে দিল কীভাবে কাঁধে করে ভারী জিনিস বইতে হয়। কীভাবে নিলে ওজনটা সহনীয় হয়। দু’তিন দিন কাজ করতেই মোটামুটি অভ্যস্ত হয়ে উঠলাম। একদিন রাতে ভাত খেতে বসে সিরাজ গল্প করল নিজের দক্ষতা নিয়ে। মমিনের কী একটা কথায় অসন্তুষ্ট হয়ে বলল, ‘মমিন ভাই, কাপ্তাই জেটিঘাটে এমন কোনো নাইয়া নাই, যে আঙ্গ উরদি বাহাদুরি গরি যাইত হাইরব। আঁরা দড় নাইয়া। নৌকার এমন কন কাজ নাই, যিয়ান জানি না।’

‘দড়’ মানে দক্ষ নাইয়া। কথাটা শুনতে চমৎকার লাগল। সিরাজের ছিপছিপে কিন্তু পেটা শরীর, রোদে পোড়া রুক্ষ কঠিন মুখ দেখে মনে মনে তার দক্ষতা স্বীকার করেও নিলাম। একসময় স্কুলে আমার সাথে পড়েছে। আমি পড়াশোনায় এগিয়ে গেছি, আর ও ছিটকে পড়েছে স্কুল থেকে। বইপত্রের দুনিয়ায় আমি যা জানি, ও তার কিছুই জানে না। স্বভাবতই ওর চেয়ে নিজেকে সেরা ভাবার প্রবণতা আছে মনের ভেতর। কিন্তু নৌকোয় ওর সহকর্মী হয়ে এখন অনুভব করতে বাধ্য হচ্ছি, পুঁথিগত দিক দিয়ে আমি যেমন ওর চেয়ে অনেক দূর এগিয়ে, তেমনি পেশাগত দিক দিয়ে ও আমার চেয়ে অনেক এগিয়ে গেছে। নৌকো বাওয়া, বোঝাই করা, পানি সেচা, মাল ভরা এসব কাজে সে রীতিমতো ওস্তাদ হয়ে বসে আছে। তার কাছে শেখার অনেক কিছু আছে আমার।

এর মধ্যে মমিন একদিন একটা কথা বলল, ‘তালতো মনে রাইখবান, সব কাজই একটা বিদ্যা। শুধু লেহাহড়াটাই বিদ্যা না।’

কথাটা সত্যি মনে হলো। স্বল্পভাষী ফয়েজ মমিনের কথায় মাথা নেড়ে সায় দিল। সিরাজ শুনিয়ে দিল নিজের এক অভিজ্ঞতার কথা। তারপর উপসংহার টানল, ‘দুনিয়াতে সব কাজ শিখতে হয়। এমনকী ভাত খাওনটাও।’

মাল ভরছি আমরা। মাঝে মধ্যে দু’একদিন বসে থাকছিও। মাল দিতে দেরি হচ্ছে পার্টির। আমাদের কিছু করার নেই। এর মধ্যে নিজের সম্পর্কে একটা জিনিস আবিষ্কার করে ফেলেছি আমি। বুঝতে পেরেছি, নৌকোর কাজে সিরাজ-মমিনদের মতো দক্ষ না হলেও অলস আমি নই। কাজকর্ম করি হুলুস্থুল উৎসাহ নিয়ে। অবশ্য সিরাজ-মমিন-ফয়েজরাও অলস নয়। আমাদের কথা হলো, কাজ করে বসে থাক। কাজ ফেলে রেখে আলসেমি করলে নিজের কষ্ট। কারণ, কাজটা নিজেদেরই করতে হবে। যাহোক, কাজের প্রতি আমার উৎসাহ আমার অদক্ষতাকে ঢেকে দিল কিছুটা। একটু একটু সমীহ আদায় করতে পারছি সহকর্মীদের কাছ থেকে।

এর মধ্যে চাকমাদের ছোট নৌকো নিয়ে সুবলং বাজারও আসা হলো একদিন। পালা করে। প্রথম পালায় সিরাজ আর মমিন। সকাল বেলাটা ওরা বাজারে বেড়াল। বিকালে গেলাম আমি আর ফয়েজ। ছোট নৌকোর পাছায় বসে বৈঠা বাইছে ফযেজ। আমি বসে আছি গলুইয়ে। আমাদের দু’জনের ভরেই পানি নৌকোর কাছা ছুঁই ছুঁই। আমি দু’হাতে পানি ছুঁয়ে দিচ্ছি। কাপ্তাই হ্রদের পানি এত পরিষ্কার! দু’পাশ থেকে পাহাড়ের ছায়া পড়লে কিছু ছায়াময়। আর খোলা জায়গায় নীল, আকাশ উপুড়করা নীল ছায়া বুকে নিয়েও টলটলে স্বচ্ছ।

ধীরে ধীরে নৌকো বাইছে ফয়েজ। মুখ যথারীতি বন্ধ। জানি,  আমি আগে কথা না বললে ও নিজের থেকে কখনো কিছু বলবে না। এর স্বভাবটাই এরকম। নৌকোয় সিরাজ আর মমিন রাজা-উজিরের বংশ নিপাত করে, আর এ কেবল শুনবে আর মিটি মিটি হাসবে। পাহাড়ের বাঁকে বাঁকে চলছে আমাদের নৌকো। সুবলং থেকে আসার সময় এ পথেই এসেছিলাম। কিন্তু পথ টথ আর মনে নেই আমার। কেবল পাহাড়ের পর পাহাড় আর ফাঁকে ফাঁকে পানি। সব কিছু একাকার লাগছে আমার কাছে। ফয়েজ কীভাবে পথ চিনছে কে জানে? আমার চোখে বিস্ময়। সেটা দেখে বোধ হয় বুঝতে পারল ফয়েজ। আচমকা হেসে উঠে বলল, ‘কী তালতো, একা যাইতা হাইরবান সুবলং?’

সামনে পেছনে ডানে বাঁয়ে মাথা ঘোরালাম। তারপর ম্লান হেসে বললাম, ‘মাথা খারাপ! এ পথ দিয়ে একে একে তিনবার এলেও একা চিনে আসতে পারব না।’

সামনের বাঁকটা ঘুরতে ফয়েজ বলল, ‘এখন দেখেন তো। চিনতে হারেন?’

সুবলং বাজারের উত্তর পাশটা চিনে গেলাম। এরপরই দেখলাম বাজার টিলাটা। খুশি হয়ে বললাম, ‘এসে গেছি?’

সুবলং বাজার ছেড়ে গিয়েছিলাম দিন সাতেকের বেশি হবে না। তবু মনে হলো, মাসখানেক পরে বুঝি লোকালয়ে ফিরছি। মনে হচ্ছে এই সাতদিন আমি জন-মানুষ বিচ্ছিন্ন এক জঙ্গলে কাটিয়েছি। সে জঙ্গলে বাজার নেই, মানুষজন নেই, চায়ের দোকান নেই, গান-বাজনা নেই। সেখানে আছে মালকোচা মেরে পানি সেঁচার ঢকর ঢক, দাঁড়টানার ক্যাঁক্কোরোৎ আর ফায়ারউড লোড করার ধুম ধাম আওয়াজ। কিন্তু এসব আমার কাজ নয়। তবু করতে হচ্ছে। কারণ কাজটা আমিই বেছে নিয়েছি। কাপ্তাই জেটিঘাটের চায়ের দোকানে বসে টেপরেকর্ডারে গান শুনতে শুনতে তাৎক্ষণিকভাবে সিরাজদের নাবিক জীবনটাকে যতটা রোমাঞ্চকর মনে হয়েছিল, এখন তার ছিটেফোঁটাও আর অবশিষ্ট নেই। কিন্তু মানুষের যে কোনো সিদ্ধান্ত, সে ভুল হোক আর শুদ্ধ হোক, তার তাৎক্ষণিক প্রভাবটাকে এড়ানো সম্ভব হয় না। আবার ভুল নাকি শুদ্ধ সিদ্ধান্ত সেটাও বোঝা যায় না সাথে সাথে। আমি এখন বুঝতে পারছি না, ঠিক কী করেছি। তবে এটা বিশ্বাস করি যে, এরকম বেশিদিন করতে হবে না। শিগগিরই কেউ একজনের চোখে পড়ে যাব, যার থাকবে মায়াবতী এক কিশোরী মেয়ে……….

ঘাটে পৌঁছে একটা ঠনা গাছের শেকড়ের সাথে নৌকো বেঁধে দু’জনে উতরাই বেয়ে উঠতে শুরু করলাম। ফয়েজ কী ভাবছে জানি না, তবে আমার মনে শিহরণ। কতদিন পরে আবার চায়ের দোকানে গিয়ে বসব! চা খাওয়াটা বড় ব্যাপার নয়, ব্যাপার হলো আমি আবার নিজেকে ফিরে পাব। টেপরেকর্ডারে গান বাজবে, আর আমি একহাতে চায়ের কাপ, আরেক হাতে বিড়ি ধরিয়ে হারিয়ে যাব গানের সুরে। টেপ রেকর্ডারে বাজবে, মধুমালতী ডাকে আয়…..আর আমি মধুমালতীর ডাক শোনার জন্যে আনমনে হারিয়ে যাব অন্য এক দেশে, যেখানে নৌকোর দাঁড়টানা নেই, পানি সেচা নেই, মাল ভরার ধুমধাড়াক্কা কর্কশ অকরুণ আওয়াজ নেই।

ফয়েজ আর আমি উতরাই বেয়ে উঠছি। ফয়েজ হাঁটছে কোমর আর মেরুদ- বাঁকা করে। ওর সাথে হেঁটে পেরে উঠছি না। কারণ আমি হাঁটছি ধীর পদক্ষেপে, একজন শিক্ষিত মানুষ যেভাবে হাঁটে। শিক্ষিত মানুষ লেবারারের মতো হাঁটতে পারে না। তার হাঁটার ভঙ্গিতেও ফুটে ওঠে আভিজাত্য। নৌকোর নাইয়া হলেও আমার অভ্যস্ত সে অভিজাত ভঙ্গি যাবে কোথায়?

বাজারের ওপর উঠল ফয়েজ। পেছনে ফিরে বলল, ‘আরে, আপনি এখনো এত দূরে? জোরে হাঁটেন না। ভাত খান ন’।’

আমি মুচকি হাসলাম। ফয়েজ আমার সহকর্মী বটে, সমশ্রেণীর নয়। আমার কাছে যে হাঁটাটা আর্ট বা শিল্প, সেটা ওর কাছে ভাত না খাওয়াজনিত শারীরিক দুর্বলতা।

সেদিনের সে চায়ের দোকানটায় গিয়ে বসলাম দু’জনে। এখান থেকে পুবদিকে পাহাড়ের মাঝখানে বিস্তীর্ণ জলরাশি চোখে পড়ে। পুবদিকের নীলপাহাড়ের আবছায়া। দেখতে জানলে  চোখে ঘোর জাগায়। চায়ের দোকানে টেপরেকর্ডার বাজছে। মধুমালতী’র গান নয়, হিন্দি চলছে। পাগল করে দিচ্ছে মোহাম্মদ রফি।

বাস্তি বাস্তি পার্বত পার্বত……….

এই লোকটা এত উঁচুতে তুলতে পারে গলা!

টেবিলে তুমুল তবলা বাজাচ্ছি আর মাথা নাড়ছি গানের তালে তালে। ফয়েজ চা খাচ্ছে চুক চুক করে। আচমকা দোকানদার কথা বলে উঠল, ‘কী ওয়া, গান ক্যান লার? ভালা লার না?’

আমি চোখ ফেরালাম। মাথা নেড়ে সায় দিলাম। দোকানদার হাসল আবার। ‘বাংলাদেশে উগ্যা আছিল আবদুল আলীম আর ভারতে মোহাম্মত রফি। ইতারার’ গান পুনিলে প’ল অই য’ন গৈ পড়ে। আল্লায় দিয়্যে দে বাপ তারারে।’

চাটগাঁর ভাষায় বকে যাচ্ছে দোকানদার। ভাল বুঝতে পারছি না। তবু মাথা নাড়াচ্ছি ঘন ঘন।

শীতের দিন দেখতে না দেখতে ফুরিয়ে যাচ্ছে। পাহাড়ের ছায়া পড়েছে সুবলং বাজারের সামনের জলরাশিতে। ওপর থেকে আসছে নানা রকম নৌকো। একটা স্টিমার এসে ভিড়ল ঘাটে। দু’তিনজন যাত্রী নামল, উঠলও জনা কয়েক। ভোঁ বাজিয়ে আবার চলতে শুরু করল স্টিমার। পাহাড়ের ফাঁকে ঢুকে অদৃশ্য হয়ে গেল। রাঙামাটিতে যাচ্ছে ওটা।

দেখতে দেখতে আচমকা এক বিষণœতায় আক্রান্ত হলাম। স্টিমারের যাত্রীদের মনে হচ্ছে, অনেক  সুখী আর স্বাধীন। তাদের নৌকো বাওয়ার চাকরি নয়। একটু পরে রাঙামাটির আলোকোজ্জ্বল শহরে গিয়ে উঠবে। আর আমাকে যেতে হবে নৌকোয়। ইচ্ছে হচ্ছে, আমিও রাঙামাটি চলে যাই।

‘হাম য্যায় ছো কে ভাগমান লিখা চাহাত কা ভারাদান নাহিন….’

তুঙ্গে উঠে গেছে মোহাম্মদ রফির গলা

‘যিসনে হাম কো জনম দিয়া হো পাত্থার হ্যায় ভগবান নাহিন

পাত্থার হ্যায় ভগবান নাহিন…

বাস্তি  বাস্তি….’

গান শুনতে শুনতে মাঝবয়সী দোকানদারের  ভাবও যেন তুঙ্গে উঠে গেছে মোহাম্মদ রফির গলার মতো। হেঁড়ে গলায় সেও ধরে বসল, ‘….পার্বাত পার্বাত গা থা যা য়ি বানজারা

লে কার দিলকে ইখতারা।’

দোকানে কাস্টমারের আনাগোনা  বাড়ছে। আমাদের ডানপাশে দুই চাকমা কী নিয়ে ঝগড়া করছে। কিসসু বুঝতে পারছি না কী বলছে ওরা। ঝগড়া বোঝা যাচ্ছে দু’জনের প্রবল হাত নাড়ানাড়ি আর ডানে বাঁয়ে মাথা সঞ্চালনের বহর দেখে। ওদিকে হুট করে কয়েকজন ঢুকে পড়ে দুম দাম করে চেয়ার টেবিল টেনে বসে পড়েছে। চাটগেঁয়ে ভাষায় নাগাড়ে বক বক জুড়ে দিয়েছে তারাও। একজন আচমকা আওয়াজ দিল, ‘ওয়া সদাগর, তোঁয়ার অই ক্যাসেটটান এক্কেনা বন্ধ গর না’ হতক্ষণের লাই। জরুরি হতা হইরত।’

‘অ্যাঁ বদ্দা,’ বলেই সুইচ টিপে দিল দোকানদার।

মেজাজ খিঁচড়ে গেল। ইচ্ছে হলো ‘জরুরি হতা’র দু’কানে দুটো থাপ্পড় লাগাই। ব্যাটা বাঁদর, জরুরি কথা থাকলে বাইরে যা। এখানে কী?

চায়ের দোকানে আর ভাল লাগছে না। মনে হচ্ছে, একটা সঙ্গীতময় আলোকিত জগৎ হঠাৎ আড়াল হয়ে গেল চোখ থেকে, চেতনা থেকে। ‘জরুরি হতা’অলাদের বক বক, চাকমাদের অবোধ্য কথাবার্তা আর চায়ের দোকানের বয়-বেয়ারাদের হাঁক ডাক অসহ্য লাগছে। উঠে যাব ভাবছি, ফয়েজ নিজেই প্রস্তাব দিল, ‘চলেন, তালতো। এবার যাই গৈ।’

‘চলেন।’

বেরিয়ে পড়লাম দোকান থেকে। শীতের সূর্য অনেক আগে সুবলঙের পশ্চিমের পাহাড়ের আড়ালে চলে গেছে। কেরোসিনের বাতি আর হ্যারিকেন জ্বালতে শুরু করেছে দোকানদাররা। একটু পরে আলোকোজ্জ্বল হয়ে উঠবে বাজারটা। মানুষজন দিনশেষের বিশ্রাম উপভোগ করার জন্যে চায়ের দোকানে এসে হাজির হবে। চায়ের দোকানে গান বাজবে। কিন্তু এসব আমরা দেখব না। আমরা চলে যাচ্ছি বাজার থেকে দূরে ঘন পাহাড়ের ভেতরে এক চাকমা পাড়ায়। ওখানে আলো নেই, মানুষজন নেই, গানবাজনা নেই। ভাল্লাগছে না আমার। কবে যে ফের কাপ্তাই যাব?

চলবে…

মাসুদ আনোয়ার। লেখক ও সাংবাদিক। জন্ম – দীর্ঘাপাড়, সন্দ্বীপ, চট্টগ্রাম। পেশায় সাংবাদিক। লেখালেখির শুরু ছাত্রজীবন থেকে। মাধ্যম ছড়া, কবিতা ও উপন্যাস। লেখেন বড়-ছোট উভয় শ্রেণির পাঠকের জন্যে। প্রথম ছড়ার বই ‘হুক্কাহুয়া‘, প্রথম কিশোর উপন্যাস ‘কেউ জানে না‘। কিশোর গল্প সঙ্কলন...

এই বিভাগের অন্যান্য লেখাসমূহ