জলে জঙ্গলে (পর্ব- ৪)

মাসুদ আনোয়ার
উপন্যাস, ধারাবাহিক
Bengali
জলে জঙ্গলে (পর্ব- ৪)

একদিনের মধ্যেই সমুদ্র-নদীবেষ্টিত সন্দ্বীপ থেকে পাহাড়ী এলাকা কাপ্তাই। গতরাতেও শীত ছিল, তবে তেমন কনকনে ভাব ছিল না। আজ রাতে ঠাণ্ডা কী জিনিস তা যেন হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছি। বুক, পিঠ আর পেটের ভেতর যেন কেউ বরফ ঘষে দিচ্ছে। খেয়ে দেয়ে প্রায় কাঁপতে কাঁপতে লেপের তলে গিয়ে ঢুকলাম। বিশাল বিশাল দুই রূমের ঘর গোলাম মাওলার। বাঁশের বেড়া, ওপরে করোগেটেড টিনের ছাউনি। বেড়ার ফাঁক দিয়ে উত্তুরে বাতাস ঢুকছে। তবে লেপের ভেতর ঢোকার পর শীত কেটে গেল। আস্তে আস্তে উষ্ণ আরামে আবিষ্ট হতে শুরু করল শরীর ও মন।

কোনো টেনশন নেই আর। দুলাভাই নির্ঘাত চাকরি একটার ব্যবস্থা করে দেবেন। আমি চাকরি করব আর পড়াশোনা করব। এবার যদি ফেলও করি, কোনো সমস্যা নেই। আবার পরীক্ষা দেব। পাসও করব। তারপর আইএ পাস করব, বিএ পাস করব, ততদিনে চাকরিতেও উন্নতি করব। যখন বাড়িতে ফিরব, তখন আমি উচ্চশিক্ষিত ও সচ্ছল একজন পুরুষ, যে নিজের হাতে নিজের ভাগ্য গড়ে নিয়েছে।

নরম ও গরম লেপের উষ্ণতায় ঘুমিয়ে পড়ার আগে ভাবলাম তাহেরের কথা। মৌলভী আবদুল ফাত্তাহ কোরেশীর লেখা ‘সালেহা’ উপন্যাসের নায়ক তাহের। চাচীর অত্যাচারে পিতৃ-মাতৃহীন তাহেরকে ঘর ছাড়তে হয়েছিল ছোট বোন সালেহাকে সাথে নিয়ে। তারপর দুই ভাই-বোনের সেকি কষ্ট! কষ্ট নয় আসলে জীবন সংগ্রাম। এখান থেকে সেখানে, সেখান থেকে ওখানে। কত বাধা, কত বিপদ। কত অবহেলা, উপদ্র্রব। কিন্তু ভাই-বোন নির্বিকার। কোনো কষ্টই তাদের দমিয়ে রাখতে পারেনি। মানুষের নির্মমতা, নিষ্ঠুরতার পরিচয় যেমন পেল, তেমনি পেল উদারতা আর সৌন্দর্যেরও পরিচয়। তাহেরের সাথে কলেজে পড়ার সময় ঘনিষ্ঠতা হলো সহপাঠী জামালের। ঘনিষ্ঠতা থেকে বন্ধুত্ব এবং পরে জামালের বোনের সাথে পরিণয়। ওদিকে সালেহাকেও ভালোবেসে ফেলল জামাল এবং তার সাথেও বিয়ে হয়ে গেল। জীবনে সফলতা খুঁজে পেল একদিন ঘর ছেড়ে বেরিয়ে পড়া ভাই-বোন। কিন্তু এই সফলতা লাভ করার জন্যে জীবনে কঠোর সংগ্রাম করতে হয়েছে তাদের।
বাইরে কাপ্তাইয়ের পাহাড়ী শীতে জমাট কালো রাত। আর ঘরের ভেতর লেপের উষ্ণতায় আবিষ্ট হতে হতে আমি ভাবলাম জীবনে কঠোর সংগ্রামের মধ্য দিয়ে ‘মানুষ’ হওয়ার কথা। চোখের সামনে দেখতে পেলাম এক তুখোড় তরুণকে। কখনো সে অমায়িক হাসি হাসছে বন্ধুদের সাথে, কখনো কঠোর মুখে মোকাবিলা করার জন্যে রুখে দাঁড়িয়েছে প্রতিদ্বন্দ্বীদের বিপক্ষে। কখনো সে উদার প্রায় আকাশের মতোই, কখনো কঠিন, পাথরের মতো। তার ব্যক্তিত্বের সামনে নুয়ে পড়ছে সবাই। আর একটি, কেবল একটি ব্যক্তিত্বময়ী নারীর কাছে সে নমনীয়। কেবল ওই নারীই পারে তাকে নিয়ন্ত্রণ করতে ভালোবাসা আর মমতা দিয়ে। কে সে নারী? আনোয়ারা? সালেহা? মনোয়ারা? একে একে অনেকগুলো উপন্যাসে পড়া অনেক নায়িকার নাম পড়তে লাগল। তাদের মধ্যে কার মতো হলে ভালো হয় সে নারী, ঠিক করতে করতে তলিয়ে গেলাম ঘুমের গভীরে।

শেষ রাতে ঘুমঘোরে আজানের শব্দ শুনতে শুনতে পাশ ফিরে শুলাম। আরামদায়ক লেপের বাইরে কাপ্তাইয়ের তীব্র পাহাড়ী শীত মাথা খুঁড়ে মরছে। আমার ঘুমের কোনো ব্যাঘাত ঘটাতে পারল না।

কিন্তু সকালে উঠেই গোলাম মাওলার গলায় অন্য সুর। একত্রে নাশতা করছিলাম। হঠাৎ গোলাম মাওলা বললেন, ‘মিয়া, তুমি তো পরীক্ষা না দিয়া বাড়ি থেকে পালায়ে আইছ।’

শাজু বু’ চোখ তুলে তাকাল। ‘হাঁচা দুলু, তুই পরীক্ষা না দিয়া পালাই আইচছ ?’

চিতুই পিঠা চিবুচ্ছিলাম। কোঁৎ করে গিলে ফেলে বললাম, ‘আরে নাহ! কী বলেন? আমি পরীক্ষা দিয়ে এসেছি।’

‘উঁহু।’ মাথা নাড়লেন গোলাম মাওলা। শাজু বু’কে বললেন, ‘তোমার ফুফাতো ভাই পরীক্ষা না দিয়েই বাড়ি থেকে পালাইছে।’

আমি যে পরীক্ষা না দিয়ে বাড়ি থেকে পালাইনি, এই ব্যাপারে হাজারটা যুক্তি এবং প্রমাণ উপস্থিত করলাম গোলাম মাওলার সামনে। বোঝাতে চাইলাম, এতটা বছর পড়ে এসে শেষে এসএসসি পরীক্ষা না দিয়ে বাড়ি থেকে পালিয়ে আসার কোনো কারণ থাকতে পারে না।

গোলাম মাওলা বললেন, ‘বেশ, তাইলে বলো কোন ডিভিশনে পাস করেছ?’

শাজু বু’ও দেখি আমার দিকে চাইলেন। অর্থাৎ তিনিও জানতে চান আমার পাসের খবর।

বললাম, ‘এখনো রেজাল্ট আউট হয়নি।’

গোলাম মাওলা বললেন, ‘রেজাল্ট আউট না হলে বাড়ি থেকে চলে এলে কেন? তার মানে তুমি পরীক্ষাই দাওনি। তোমার তো বাড়ি থেকে পালানোর রেকর্ড আছে। তোমার আপায় কয়।’

আমি আপার দিকে তাকালাম। শাজু বু’ হাসলেন। ‘আমি তোর নানীর কাছ থেকে হুনছি। তুই নাকি খালি বাড়ি থেকে পালাই যাছ।’ তারপর নিঃশ্বাস ফেললেন, ‘হুঁ….! মা মরলে বাপ তালই গো। ঘরে মন টিকতে হবে তো।’

বাড়ি থেকে পালানোর কথাটা অবশ্য মিথ্যে নয়। এবার পালানোর আগেও অবশ্য আরো বার কয়েক পালিয়েছি। ক্লাস সেভেনে পড়ার সময় একবার চট্টগ্রাম শহরে চলে এসেছিলাম। আরেকবার ক্লাস নাইনে বার্ষিক পরীক্ষার সময়। সেবার পালিয়ে এসেছিলাম সীতাকু-। মাসখানেক পরে অবশ্য ফিরে যেতে হয়েছিল। ভালো ছাত্র হওয়ার সুবাদে পরীক্ষা না দিয়েও ক্লাস টেনে উঠতে আটকায়নি। আসলে বুদ্ধি হওয়ার পর থেকে এক অস্থিরতায় পেয়ে বসেছিল আমাকে। একধরনের নিরাপত্তাহীনতা। আমার কোনোভাবেই ঘরে থাকতে মন চাইত না। ইচ্ছে করত সব সময় মায়ের কাছে চলে যেতে। কিন্তু মায়ের কাছে যাওয়া গেলেও সেখানে থাকার অধিকার ছিল না। নিজের মায়ের ওপর এই অধিকারহীনতার ব্যাপারটা যে কত কঠিন, সে কাউকে বোঝাতে পারতাম না। ওদিকে বাবা ছিলেন উদাসীন। আপনাকে বুঝতে হবে, যখন আপনি আপনার সন্তানকে মাহারা করবেন, তখন তার মায়ের স্থানটাও আপনাকে পূরণ করতে হবে।

মি চুপ করে রইলাম। গোলাম মাওলা খাওয়া শেষ করে বিশাল এক ঢেঁকুর তুলে বললেন, ‘আইছ ভালো কথা। বোনের কাছে দু’দিন বেড়াও। তারপর ঘরের ছেলে ঘরে ফিরে যাও। চাকরি বাকরি বললেই হয় না। কত কত বিএ এমএ পাস রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়ায়। তুমি তো মিয়া মেট্রিকও পাস করো নাই।’

ব্যস, এক কথায় রায় ঘোষণা হয়ে গেল। আমার আর কিছু বলার পথ রইল না। বাড়ি থেকে বেরোনোর পর গত দু’দিন ধরে যে আশার প্রাসাদ তিল তিল করে গড়ে তুলছিলাম, গোলাম মাওলার একটি কথার ধাক্কায় তা যেন ভেঙে চুরমার হয়ে গেল।

সকালে ঘুম থেকে ওঠার পর মন ছিল প্রজাপতির পাখার মতো হালকা, ফুরফুরে। চারদিক স্রেফ ঝলমল করছিল সুখস্বপ্নের মতো। শাজু বু’র বাসার পেছনে দুই পাহাড়ের মাঝখানে গভীর খাদ। খাদের দু’পাড়ে ঘন জঙ্গল। জঙলা লতাগুল্মের মুখে ফুটে আছে নানা রঙের ফুল। বাতাসে দোল খাচ্ছিল গাছের কচি পাতা। কী যে ভালো লাগছিল দেখতে। নিজেকে খুব যোগ্য মনে হচ্ছিল। মনে মনে ভাবছিলাম, বাবার গম্ভীর রাগী মুখের কথা। এতক্ষণে নিশ্চয় সবাই জেনে গেছে যে, আমি বাড়ি ছেড়ে পালিয়েছি। বড় জেঠা তার স্বভাবসূলভ ভঙ্গিতে মাথা নাড়তে নাড়তে বলছেন, তিনি জানতেন, এই ছেলে মানুষ হবে না। তার অনেক বড় আশা ছিল এই ছেলের ওপর। কিন্তু….বাকিটা তিনি আর শেষ করবেন না। মাথা নাড়তে থাকবেন। আর বাবা? কিছু বলবেন না। কেবল চুপ করে থাকবেন। তার মাথাটা গভীর চিন্তায় ঝুঁকে পড়বে বুকের ওপর। আর মুখে ফুটে থাকবে আমার ওপর গভীর আর রাগ আর বিতৃষ্ণার রেখা।

কিন্তু তাতে আমার কিসসু আসে যায় না। আমি বাড়ি থেকে পালিয়ে এসেছি জীবনের প্রসারিত অঙ্গনে। এখানে নানা সুযোগ-সুবিধা। শাসন-ত্রাসন বিহীন মুক্ত জীবন। নিজের সিদ্ধান্তেই নিজে চলার সুযোগ। আসলেই এক অন্যরকম স্বাধীনতার আনন্দ পান করছিলাম ফোঁটায় ফোঁটায়। গতকাল বিকেলে সামান্য দেখা কাপ্তাই শহর আমার জন্যে এক অফুরন্ত আনন্দ আর রহস্য নিয়ে অপেক্ষা করছে। দুলাভাই গোলাম মাওলা আমাকে চাকরি ধরিয়ে দেবে আর আমি চাকরি করে করে নিজেকে গড়ে তুলব একজন কৃতী পুরুষ হিসেবে। কিন্তু এখন গোলাম মাওলার একটি মাত্র কথায় সব যেন শূন্য আর ফ্যাকাসে হয়ে গেল।

নাস্তা শেষ করে বাইরে এসে দাঁড়িয়েছি। বিড়ি ফুঁকছি। গোলাম মাওলার কথায় গভীর চিন্তায় পড়ে গেছি। ভাবছি কী করা যায়। শাজু বু’ বেরিয়ে এলেন একটু পরে। ডাকলেন, ‘দুলু, পান খাবি?’

বিড়ি ফেলে দিয়ে শাজু বু’র দিকে তাকালাম। ওনার হাতে পান। নিজেও খাচ্ছেন এক খিলি। পানের রসে ঠোঁট লাল। কিন্তু শাজু বু’র মুখ ম্লান। সম্ভবত কিছু একটা আঁচ করার চেষ্টা করছেন। তবে আঁচ করতে পারলেও কিছু যে করতে পারবেন না, সেটা ভালো করেই জানেন। তাই এখন আমি না চাইলেও পান নিয়ে এসেছেন আমাকে সান্ত¦না দেয়ার জন্যে।

আমাকে পান দিয়ে চুপচাপ কিছুক্ষণ পান চিবোলেন। পিচ করে পিক ফেলে বললেন, ‘এখন কী করবি? বাড়ি চলে যাবি, না?’

এখন কী করব, সেটা আমিও বুঝতে পারছি না। তবে এটা জানি যে, বাড়ি আমি যাব না। যদি ফেল করি….

‘না,’ মাথা নাড়লাম। ‘দেখি কী করা যায়।’

শাজু বু’ আর ঘাটালেন না। কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন, ‘কদিন এখানে বেড়া। মাথা ঠাণ্ডা কর।’

এটা খারাপ নয়। দুলাভাই গোলাম মাওলাও বলেছেন এ কথা। আমার মনে হয়, কদিন এখানে থাকলে একটা না একটা ব্যবস্থা হয়ে যাবে।

মাসুদ আনোয়ার। লেখক ও সাংবাদিক। জন্ম – দীর্ঘাপাড়, সন্দ্বীপ, চট্টগ্রাম। পেশায় সাংবাদিক। লেখালেখির শুরু ছাত্রজীবন থেকে। মাধ্যম ছড়া, কবিতা ও উপন্যাস। লেখেন বড়-ছোট উভয় শ্রেণির পাঠকের জন্যে। প্রথম ছড়ার বই ‘হুক্কাহুয়া‘, প্রথম কিশোর উপন্যাস ‘কেউ জানে না‘। কিশোর গল্প সঙ্কলন...

এই বিভাগের অন্যান্য লেখাসমূহ