জলে জঙ্গলে (পর্ব- ৫)

মাসুদ আনোয়ার
উপন্যাস, ধারাবাহিক
Bengali
জলে জঙ্গলে (পর্ব- ৫)

কদিন বেড়ানোর আমন্ত্রণ পেয়ে মনটা একটু হালকা। দুপুরে খেয়ে দেয়ে বেরিয়ে পড়লাম। কাপ্তাই শহরটা একটু ঘুরে টুরে দেখব। কাল রাতে টেক্সিতে করে যেদিক থেকে এসেছিলাম, সেদিকে হাঁটতে শুরু করলাম। শান্ত, প্রায় নির্জন পথ। উত্তর-দক্ষিণে প্রলম্বিত রাস্তার পুবদিকে একটা সাইনবোর্ড নজর কাড়ল। কালো টিনের পাতে সাদা অক্ষরে লেখা:  সুইডেন-বাংলাদেশ কারিগরী মহাবিদ্যালয়।

দারুণ রোমাঞ্চ অনুভব করলাম মনের ভেতর। ওহ্, কলেজ, কলেজ! পাস করলেই তো আমি কলেজের ছাত্র।

একজন স্কুলের ছাত্রের কাছে কলেজ এক বিশাল সমুদ্রের মতো। আমার সামনে এই সে সমুদ্র। সুইডেন-বাংলাদেশ কারিগরী মহাবিদ্যালয়। হোক না কারিগরি, তবু কলেজ তো!  কলেজের বারান্দায় হাঁটাহাঁটি করতে দেখলাম কিছু ছাত্রকে। কেউ কেউ আড্ডা মারছে গেটের মুখে। ওদের দিকে তাকালাম। তারাও কেউ কেউ দেখল আমাকে। অন্তত সেরকমই মনে হলো।

মনে মনে নিজেকে ওদের মধ্যে কল্পনা করতে শুরু করলাম। দেখলাম, এরা সবাই আমার ভক্ত। পড়াশোনায় আমি সবার চেয়ে ভালো, আড্ডায় সবার চেয়ে চৌকস। মেয়েরা আমার নাম বলতে অজ্ঞান, আমার পিঠে তাদের চোখ লেপ্টে থাকে সুযোগ পেলেই। কিন্তু আমি শুধু একজনকেই ভালোবাসি। সে একজন সবার চেয়ে অনন্য।

দিবা স্বপ্ন ছুটে গেল পেছন থেকে গাড়ির হর্ন শুনে। চমকে উঠে সরে দাঁড়াই রাস্তার এক পাশে। পশ্চিম দিকের পাহাড়ের ভেতর দিয়ে একটা রাস্তা নেমে এসেছে–কিংবা রাস্তাটা উঠে গেছে ওপরের দিকে। গাড়িটা নেমে আসছে ওই পাহাড় বেয়েই।ওখানেও দেখলাম একটা বড় পাথরের ফলকে কালো অক্ষরে লেখা : নেভি ক্যাম্প। গাড়ির লোকগুলোকে খেয়াল করলাম। সাদা পোশাক আর কালো টুপি। আচ্ছা, এরাই তাহলে বাংলাদেশের নৌবাহিনী!

রিসিপশন গেটের কাছে চলে এলাম। গতকালকের মতোই পুবদিক থেকে শোনা যাচ্ছে হৈ চৈ আর গাড়ির আওয়াজ। ওদিকে হাঁটা শুরু করলাম। রাস্তার ডান পাশটা খালি। বাম পাশে দোকানপাট। সাইন বোর্ড পড়লাম : কাপ্তাই আপস্ট্রীম জেটিঘাট।

কাল বিকেল বেলায় বাস থকে নামার পর কাপ্তাইকে মনে হয়েছিল নীরব, নিস্তব্ধ একটা শহর। মানুষজন বিশেষ নেই। কিন্তু আজ জেটিঘাট রোড ধরে যতই সামনে এগোচ্ছি, ততই দেখছি মানুষ আর গাড়িঘোড়ার ভিড়। রাস্তাও ঢালু হয়ে নেমে যাচ্ছে। ঢালু রাস্তা বেয়ে গোঁ গোঁ করে উঠে আসছে গাছবোঝাই ট্রাক। একটা বড় চায়ের দোকানের সামনে এসে দাঁড়ালাম। সাইনবোর্ডে নাম পড়লাম : আজমীর বেকারী। ভেতরে তাকাতেই দেখি অনেক লোক চা-নাস্তা খাচ্ছে। খদ্দেরদের হৈ চৈ, কলিং বেলের ক্রিং ক্রিং আর বয়-বেয়ারাদের হাঁকাহাঁকিতে চায়ের দোকান সরগরম। বাতাসে বিস্কুটের ঘ্রাণ। এই ঘ্রাণটা আমার খুব পরিচিত। আকবর হাটে একটা বিস্কুটের দোকান ছিল। ছোট বেলা বাজারে গেলে  নানার সাথে ওখানে চা-বিস্কুট খেতাম। সে ঘ্রাণটা এখনো নাকে লেগে আছে।

খুব চা খেতে ইচ্ছে হচ্ছে। কিন্তু পকেট খালি। একটা টাকাও নেই।

পুবদিকে ঢালু রাস্তা বেয়ে আরো নিচে নেমে গেলাম। একসময় গিয়ে থামলাম একদম পানির কাছে। দক্ষিণ দিকে তাকাতে দেখি কাপ্তাই ড্যাম। ষোলটি গেট দেখা যাচ্ছে। কাল ওই বাঁধের ওপর দিয়ে কাপ্তাইয়ের ভেতরে গেছি। কিন্তু বাঁধের ওপর থেকে গেটগুলো দেখা যায়নি। হ্রদের নীল পানিতে উত্তুরে বাতাসের মৃদু দোলা। ঢেউ জেগেছে তির তির করে। দু’একটা নৌকো-সাম্পান আসছে সামনের টিলার আড়াল থেকে। নৌকোগুলো বেশির ভাগ কাঠবোঝাই। আবার কিছু খালি নৌকো জেটিঘাট থেকে চলে যাচ্ছে পুবদিকে। সামনের টিলাটার আড়াল হয়ে যাচ্ছে। কোথায় যাচ্ছে ওগুলো?

ছোট বেলায় ভূগোল বইতে পড়েছি, চন্দ্রঘোনা কাগজের কলের জন্যে বিখ্যাত। আর কাপ্তাই বিখ্যাত জলবিদ্যুৎ উৎপাদন কারখানার জন্যে। দেশের সর্ববৃহৎ হাইড্রোইলেকট্রিক প্রজেক্ট। আমার কাছে অবশ্য আরেকটা কারণে কাপ্তাই বিখ্যাত। মাসুদ রানা সিরিজের প্রথম বইটি লেখা হয়েছিল কাপ্তাইকে কেন্দ্র করে। কাপ্তাই জলবিদ্যুৎ কেন্দ্রের উদ্বোধন হবে। স্বয়ং প্রেসিডেন্ট আসবেন উদ্বোধন করতে। এরই মধ্যে সদ্যনির্মিত বাঁধ উড়িয়ে দেয়ার পরিকল্পনা ফেঁদেছে এক পাগল বৈজ্ঞানিক। তার সাথে হাত মিলিয়েছে ভারতীয়রা। তারাও চায় না পূর্ব পাকিস্তানে এই বাঁধ হোক। পাগল বৈজ্ঞানিক কবীর চৌধুরীর কথা হলো, কাপ্তাই ড্যাম হওয়ার কারণে পাহাড়ের অভ্যন্তরে তিলতিল করে গড়ে তোলা তার বিজ্ঞানাগার ডুবে যাচ্ছে আচমকা বাধা পেয়ে ফুলে ওঠা কর্ণফুলীর পানিতে। তৎকালীন পিসিআই তথা পাকিস্তান কাউন্টার ইন্টেলিজেন্সি টের পেয়ে যায় এ ষড়যন্ত্র। ঠেকাতে গিয়ে বেশ কয়েকজন সেরা এজেন্টকে হারানোর পর মাসুদ রানাকে পাঠানো হলো। সেখানে কবীর চৌধুরীর সাথে মাসুদ রানার দুর্দান্ত লড়াই, ভারতীয় এজেন্ট সুলতার সঙ্গে নিটোল প্রেম–সব মিলিয়ে ‘ধ্বংসপাহাড়’।

ক্লাস ফাইভে ‘ধ্বংসপাহাড়’ পড়েছিলাম। প্রথম বইতেই প্রেমে পড়ে যাই মাসুদ রানার। তারপর একে একে ‘ভারতনাট্যম’, ‘স্বর্ণমৃগ’, বিস্মরণ, ‘মূল্য এক কোটি টাকা মাত্র’, ‘জাল’, ‘অটল সিংহাসন’। পুরো স্কুল জীবনটা হয়ে উঠেছিল মাসুদ রানাময়। সে মাসুদ রানার প্রথম বই ‘ধ্বংস পাহাড়’এর জন্যেও কাপ্তাই হয়ে উঠেছিল আমার কাছে বিখ্যাত একটি জায়গা। আর এখন আমি দাঁড়িয়ে আছি সে কাপ্তাইয়ে। শিহরিত হচ্ছি বৈকী?

কিন্তু তার সাথে মিলেছে এসে অন্যরকম এক শিহরণ। এত সুন্দর কাপ্তাই!

ওপরে অসীম নীলাকাশ, নিচে আদিগন্ত সবুজ। পাহাড়, পানি, নৌকো-সাম্পান, মানুষজন। আকাশ নীলের সাথে মুখর সবুজের অভূতপূর্ব কম্বিনেশন। প্রশান্ত গম্ভীর। তার মধ্যে মানুষের দৈনন্দিন কর্মপ্রবাহ, গাড়ির গাঁ গোঁ, সাম্পানের ক্যাঁক্কোরোৎ, ট্রাকে কাঠ বোঝাইয়ের ধুম ধাড়াক্কা শব্দ। মাঝে মাঝে আওয়াজ উঠছে, ‘ও..ও..ও..অউ…হেঁইয়া

সব দেখে শুনে আমি মুগ্ধ। কিন্তু একটা ব্যাপার কিছু বুঝতে পারছি না। এই যে আমি এতক্ষণ ধরে এখানে দাঁড়িয়ে আছি, এত লোক আমার পাশ দিয়ে আসা-যাওয়া করছে, আমাকে দেখছে, আমিও তাদের দেখছি, কেউ এখনো আমাকে একবারও জিজ্ঞেস করল না যে, আমি কে, কোত্থেকে এসেছি, এখানে কী চাচ্ছি। অথচ আমাদের ওখানে হলে এতক্ষণে কৌতূহলী মানুষের প্রশ্নবাণে জর্জরিত হয়ে যাওয়ার কথা। আমি চাইছি, কেউ আমার সাথে এসে আলাপ করুক, আমার পরিচয় নিক। তাহলে আমি নিজের কথা বলতে পারব। বলতে পারব কাপ্তাই কেন এসেছি। কিন্তু কেউ তো আমার দিকে তাকিয়েও দেখছে না।

মসজিদ থেকে আজানের শব্দে ঘোর ভাঙল। আসরের সময় হয়ে গেছে।

আজান শেষ হওয়ার পর নিঃশ্বাস ফেলে ওপরের দিকে উঠতে শুরু করলাম। একটা চায়ের দোকানের কাছে আসতে টেপ রেকর্ডারে গান শুনলাম, ‘মধুমালতী ডাকে আয়/ফুল ফাগুনের….

অসম্ভব প্রিয় একটা গান আমার। সেবক ব্যাঞ্জোতে এটার সুর তোলে এত চমৎকার করে। এই দেবশিশুর মতো ছেলেটাকে আমি ক্লাস ফাইভ থেকে ভালোবাসি। ও যখন ব্যাঞ্জোতে এই গানের সুরটা বাজায়, আমি মুগ্ধ হয়ে চেয়ে থাকি ওর দিকে। ঝাঁকড়া কালো চুলে ভরা মাথা নিচু করে মায়াবী চোখদুটো বুজে থাকে সে। ওর আঙুলগুলো খেলা করে যেন ব্যাঞ্জোর রিডের ওপর। অভূতপূর্ব এক মাদকতাময় সুর বেরোয়, মন চাহে যে ধরা দিতে…

চায়ের দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে পুরো গানটা শুনলাম। যতবারই, যেখানেই এই গানটা শুনি, ততবারই আমি মগ্ন হয়ে যাই। কোনো এক অজ্ঞাত রহস্যময়তা থেকে মধুমালতীর ডাক শুনি। ফুলফাগুনের খেলার আমন্ত্রণে শিহরিত হই।

মনটা খারাপ হয়ে গেল। আমি চলে এসেছি আমার ক্লাসমেটদের ছেড়ে। তারা সবাই নিজের নিজের বাড়িতে আছে। পাস করে কী করবে, কোথায় গিয়ে পড়বে, সেসব নিয়ে পরিকল্পনায় ব্যস্ত। আর আমি বাড়ি থেকে পালিয়েছি এক অনিশ্চিত যাত্রায়। এই যাত্রায় কঠোর সংগ্রামের কথা আছে, সে সংগ্রামে জয়ী হয়ে বাড়ি ফেরার প্রত্যয় আছে। কিন্তু জানি না সে সংগ্রামের রূপরেখা কী? কীভাবে তা শুরু করব, কীভাবে সম্পন্ন করব? ইচ্ছে হলো ফিরে যাই। আবার বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডায় মেতে উঠি, পারিবারিক অসংখ্য কষ্টের মধ্যে তাদের সঙ্গে আড্ডামুখর সে দিনগুলো ছিল আমার কাছে পাথেয়ের মতো। অনাবিল রাগ-অনুরাগ আর মান-অভিমানের মধ্য দিয়েই কেটেছিল আমার স্কুল জীবন। বিশেষ করে সেবক, পান্না এবং পরে পারভেজ ছিল আমার অনুভূতির অংশীদার। এদের সাথে ক্লাসের ফাঁকে ফাঁকে, টিফিন পিরিয়ডে কিংবা স্কুল ছুটির পর অনেক অন্তরঙ্গ সময় কাটিয়েছি। এমন দিনও গেছে ঘণ্টার পর ঘণ্টা আড্ডা মেরেছি, নিজেদের সুখ-দুঃখ, ভালোলাগা-মন্দলাগা শেয়ার করেছি, স্বপ্নের বীজ বুনেছি। তারপর দিনশেষে বিদায়ের বেদনায় মলিন মুখে যে যার বাড়ি ফিরেছি। ইচ্ছে হচ্ছে ফিরে গিয়ে আবার তাদের সাথে একত্র হই, নিজেদের সে প্রিয় মুহূর্তগুলোকে উপভোগ করি।

হ্যাঁ, ফিরে যেতে পারি। আবার ফিরে পেতে পারি নিজের সে পরিচিত পরিমণ্ডল।

কিন্তু…যদি পরীক্ষায় ফেল করি!

গান শেষ হতেই কাঁধের ওপর কার হাত। ঝট করে ঘাড় ফেরাতেই দেখি অলি আম্মত। হাসছে। এভাবে চোরের মতো এসে পেছন থেকে কাঁধে হাত দেয়াটা ভালো লাগল না। গা রি রি করে উঠল। লোকটার সাথে আমার এমন কোনো পরিচয় হয়নি যে, একদম পেছন থেকে এসে বন্ধুবান্ধবের মতো গায়ে হাত দিয়ে আলাপ জমাতে পারবে। হাতটা প্রায় ঠেলে নামিয়ে দিলাম কাঁধ থেকে।

’কী ব্যাপার?’ রুক্ষ স্ব^র বেরিয়ে এল গলা থেকে। ‘আপনি?’

‘হ।’ আমার বিরক্তি দেখেও ম্লান হলো না লোকটার হাসি। ‘বেড়াইছ?’

’তুমি’ শুনে অবশ্য কালকের মতো বিরক্তি লাগল না। কথার ধাঁচেই মনে হচ্ছে চরম অশিক্ষিত আর অসংস্কৃত এই লোক। এর কাছ থেকে এর চেয়ে বেশি ভদ্রতা আশা করা যায় না।

‘হ্যাঁ।’ মৃদু হাসলাম আমিও। ওর কথার ভঙ্গি নকল করে বললাম, ‘বেড়াইছি।’

‘আইও চা খাই।’ লোকটা আমার হাত ধরল।

‘কেন, আপনি আমাকে চা খাওয়াবেন কেন?’ বলে হাতটা ছাড়িয়ে নিলাম।

‘দূর মিয়া, বন্ধু হইছি না? চলেন চলেন। আপনি আমগো বড় মছিদের হুজুরের শালা। আমগো তালতো ভাই। হুজুরের এককান ইজ্জত আছে না।’

এক কাপ চা খেলে অবশ্য মন্দ হয় না। কিন্তু পকেটে এক টাকাও নেই। লোকটার সঙ্গে গতকাল পরিচয় হয়েছে। ও জেনেছে, আমি বড় মসজিদের ইমাম সাহেবের শালা। কিন্তু আমি জানি সেটা সত্যি নয়। আমি সুইডিস্ট মসজিদের ইমাম সাহেবের ফুফাতো শালা। লোকটা দেখি বড় মসজিদের ইমাম সাহেবকে বেশ ইজ্জত করে। সম্ভবত সে জন্যে আমাকেও ইজ্জত দিচ্ছে। ভুল করছে। ঠিক আছে, করুক। আমারও বা কী গরজ পড়েছে তার ভুল ভাঙানোর। মুফতে একটু ইজ্জত পেলে অসুবিধে কী? ইজ্জত-সম্মান পেতে কে না চায়?

গরম গরম পেঁয়াজু ভাজা হচ্ছিল। নাকে এসে লাগছে তেলেভাজা ঝাল ঝাল ঘ্রাণ। অলি আম্মতের আমন্ত্রণ অগ্রাহ্য করা শেষ পর্যন্ত সম্ভব হলো না। ভেতরে ঢুকে একটা টেবিল দখল করলাম দু’জনে।

দোকানের টেপ রেকর্ডারে এখন গান বাজছে, শুধু গান গেয়ে পরিচয়/চলার পথে ক্ষণিক দেখার একি শুধু অভিনয়…

আমার আরেক প্রিয় গান এটি। অবুঝ মন ছায়াছবির। এই সিনেমাটা দেখে আমি এতটা আবেগাক্রান্ত হয়েছিলাম যে, পুরো একটা দিন কারো সাথে কথা বলতে পারিনি। যার সাথে মিলে বইটি দেখেছিলাম, হল থেকে বেরিয়ে সে মাত্র বলতে গিয়েছিল, ‘দেখছ মিয়া, বন্ধুত্ব কারে….’ বাকিটা শেষ করতে পারেনি বেচারা। প্রচ- এক ধমকে থামিয়ে দিয়েছিলাম, ‘ধ্যাৎ মিয়া! চুপ করো তো।’

আমার মনে হয়েছে, এই কথা বলে ও আমার আবেগকে খুন করে ফেলতে চাইছে। এসময় কথা বলতে হয় না। বেদনা ও কষ্টের অনুভূতিগুলোকে চুপচাপ অনুভব করতে হয়। কথা বলে সেগুলোকে শুধু হালকাই করে দেয়া হয়।

ধমক খেয়ে আমার বন্ধু পুরো একমাস আমার সঙ্গে কথা বলেনি। মনঃক্ষূণœ হয়েছিল বেচারা। হওয়ারই কথা। তার পয়সায় সিনেমাটা দেখে এসেছিলাম কিনা। সিনেমা দেখে বেরিয়ে এসে দু’একটা কথা বলার হক তো তার ছিলই। কিন্তু তা বলতে গিয়ে এরকম বিনা নোটিসে ধমকটা আশা করেনি।

শুধু গান গেয়ে পরিচয়…সাবিনা ইয়াসমিনের গানটা শুনছি বেশ মন লাগিয়ে। কিন্তু অলি আম্মত এক পিনে আশি রেকর্ড বাজাতে শুরু করেছে। মন দিয়ে গান শোনে কার সাধ্য? এদিকে বয় এসে পেঁয়াজু দিয়ে গেছে। অলি আম্মত নিজে একটায় কামড় দিয়ে আরেকটা আমার হাতে তুলে দিতে গেল। আমি সেটা না নিয়ে নিজ হাতে একটা তুলে নিলাম। কামড় দিতেই বুঝলাম, দারুণ ভেজেছে এরা পেঁয়াজুটা।

মন প্রফুল্ল হয়ে উঠল। তাই আপাতত গান শোনা বাদ দিয়ে অলি আম্মতের কথায় মন দিলাম। অলি আম্মত মৃদুস্বরে চাটগাঁইয়া আর শুদ্ধ ভাষা মিলিয়ে যা বলছে, তার মর্মার্থ হলো, আমাকে দেখে তার মনে খুব পেয়ার হইছে। তাই আমার সাথে বন্ধুত্ব করতে চায়। জিজ্ঞেস করল, কাপ্তাই আমি কয়দিন থাকব। যদ্দিন থাকি, সে আমার সাথে বন্ধুত্ব রাখতে চায়। আমি যখন বড় মসজিদের ইমাম সাহেবের আত্মীয়…

লোকটার ভুল ভেঙে দেয়া দরকার মনে করলাম। কারণ আমি বড় মসজিদের হুজুরের আত্মীয় নই। অন্যের সাথে মিথ্যে আত্মীয়তার কথা বলে সুযোগ নেয়ার ব্যাপারটা অন্যায়। বললামও সে কথা।

‘ও তাইলে আমনে সুইডিচ মছিদের হুজুরের আত্মীয়!’

‘হ্যাঁ…কিন্তু আপনি তাকেও চেনেন নাকি?’

‘চিনি মানি?’ অলি আম্মত যেন ধপপাস করে গাছ থেকে পড়ল। ‘আরে ওনার লগে আমার অনেক পরিচয়। আমনে পুছ কইরেন বাসাত গেলে। আঁর নাম কইয়েন অলি আম্মত। ওনার নাম ইয়ে…ইয়ে…’

মুখ দিয়ে বেরিয়ে পড়ল, ‘গোলাম মাওলা।’

‘হ্যাঁ হ্যাঁ…’ ডান হাতের তর্জনীটা তুলে আমার মুখের ওপর নাচাল লোকটা। ‘গোলাম মাওলা। মুখে দাড়ি আছে, না?’

ছাগল নাকি লোকট! গোলাম মাওলা ইমাম মানুষ, পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়ান। তার মুখে দাড়ি থাকবে না তো আমার মুখে থাকবে নাকি? ঘোড়ার ডিম চেনে ও গোলাম মাওলাকে। আচ্ছা, তাহলে লোকটা মিথ্যে কথা বলছে কেন?

চা খাওয়া শেষ। ওদিকে দোকানদারও ক্যাসেট পাল্টে এখন হিন্দি ক্যাস্টে চালু করে দিয়েছে। সুতরাং অহেতুক আর বসে থাকার কোনো মানে হয় না। উসখুস করতে শুরু করলাম। অলি আম্মত অবশ্য তার চা শেষ করেনি এখনো। আমার সাথে নানা কথা বলতে গিয়ে চা শেষ করতে দেরি হচ্ছে তার।

‘এমন করেন ক্যা? আরে বসেন। চা শেষ গরি। এখন কই যাইবেন? আইজকা বেড়ান। চলেন, আইজকা ছিনেমা দেখে আসি। ভালা একখান বই লাগাইছে অলিম্পিয়া ছিনেমা হলে,’ অলি আম্মত প্রস্তাব দিল।

লোকটার মতলব কিছু বুঝতে পারছি না। তবে ভালো যে নয়, সেটা আঁচ করতে পারছি। একটু ভয় পাচ্ছি। তবে ভরসাও পাচ্ছি। এত লোকের মধ্যে সে আমার কী করতে পারবে? তাছাড়া আমি লেখাপড়া জানা ছেলে। ওর মতো মূর্খ একটা লোককে কাত করে দেয়াটা কোনো ব্যাপারও না।

‘না। সিনেমা দেখব না। এখন চলে যাব। সন্ধে হয়ে আসছে।’

‘আরে না, বসেন তো।’ অলি আম্মত পীড়াপীড়ি শুরু করে দিল। ‘হুনেন….’

‘কীরে অলিভাই।’ এক লোক চায়ের দোকানে ঢুকতে ঢুকতে ডাকল অলি আম্মতকে। ‘চা খাছনি? মেহমান কে?’ অলি আম্মতের পাশের খালি চেয়ারটায় বসতে বসতে লোকটা চাইল আমার দিকে। হাসল।

অপরিচিত লোকের দিকে এভাবে তাকিয়ে হাসাটা সৌজন্যের মাপকাঠিতে ঠিক পড়ে না। তবু লোকটার হাসিটা ততটা খারাপ লাগল না। অন্তত অলি আম্মতের হাসির মতো ঘিনঘিনে লাগল না। অবশ্য আরেকটা কারণও হয়তো আছে। লোকটা কথা বলছে আমার নিজের আঞ্চলিক ভাষায়। আমিও আগ্রহ নিয়ে চাইলাম ওর দিকে।

দাড়িঅলা লোক। গায়ে সোয়েটার, গলায় মাফলার। মাথায় কান টুপি। শীত মোকাবিলা করার মতো সব রকম উপকরণ।

অলি আম্মতকে একটু বেজার মনে হলো। লোকটার গায়ে পড়া আলাপ বোধ হয় ভালো লাগছে না। ‘কাম শেষ?’ বিরস মুখে বলল।

‘হ্যাঁ।’ মাথা নাড়ল লোকটা। ওর চোখ আমার দিকে। ‘ভাইয়ের বাড়ি কই?’ প্রশ্নটা অবশ্য আমাকে করল না।

কিন্তু জবাব দিলাম আমি। অলি আম্মত বলার আগেই বললাম, ‘আমাদের বাড়ি সন্দ্বীপ।’

‘সন্দ্বীপ?’ অবাক হলো লোকটা।

‘হ্যাঁ সন্দ্বীপ।’ খিক করে হেসে উঠল অলি আম্মত। ‘তোমগো দেশী।’

এবার আমি নিজেই আগ্রহী হয়ে উঠলাম লোকটার প্রতি। ‘আপনাদের বাড়ি সন্দ্বীপ?’

‘হ্যাঁ।’ মাথা দোলাল লোকটা। ‘সন্দ্বীপ কোন গ্রাম আমনের গো?’

‘দীর্ঘাপাড়।’

‘ডিগ্যার।’ আরেকটু উৎসুক দেখাল লোকটাকে। ‘ডিগ্যার কার বাড়ি?

বাড়ির নাম বললাম। লোকটা আমাদের বাড়ির একজনের নাম বলল। জানতে চাইল চিনি কিনা। এরপর বাবার নাম জানতে চাইল। বাবাকে অবশ্য চিনল না। তবে বড় জেঠার নাম বলতে চিনে গেল। বলল, ‘আইচ্ছা, আমনে ওনার ভাতিজা। উনি তো খুব ভালা ডাক্তর।’

বড় জেঠা হোমিওপ্যাথ ডাক্তার। স্কুল মাস্টারির পাশাপাশি ওটাও তার পেশা। মোটামুটি ভালো ডাক্তার হিসেবে নিজ গ্রাম ছাড়াও আশেপাশের গ্রামের লোকও তাকে চেনে অল্প-বিস্তর। আমিও লোকটার পরিচয় জানতে চাইলাম। আমাদের পাশের গ্রাম সন্তোষপুরের লোক।

আচমকা মনটা যেন ফুরফুরে হয়ে উঠল। এতক্ষণ অলি আম্মতের সাথে কথা বললেও মনে একটা উদ্বেগ ছিল। সকালে দুলাভাই গোলাম মাওলার কথায় আমার স্বপ্নসৌধ অনেকটা ধুলিসাৎ হয়ে গেছে। যে বিশ্বাস নিয়ে বাড়ি থেকে পালিয়ে কাপ্তাই এসেছি, চিড় ধরেছিল তাতে। অবশ্য হতাশায় ভেঙে পড়িনি, কিন্তু মনের ভেতর অনিশ্চয়তা আর অসহায় ভাবটুকু টের পাচ্ছিলাম। এই অজানা অচেনা কাপ্তাই শহরে আমি কার কাছে যাব? গোলাম মাওলার বাসায় কদিন থাকতে পারব?

জানতে চাইলাম, ‘ভাই, এখানে আপনি ছাড়া সন্দ্বীপের মানুষ কি আরো আছে?’

‘কত চান আমনে?’ লোকটা হেসে উঠল। চায়ের দোকানে আরো লোক চা-নাস্তা খাচ্ছিল। তাদের কয়েকজনকে দেখিয়ে বলল, ‘এইটা সন্দ্বীপ্যা, ওইটা সন্দ্বীপ্যা। ওইটা…অই সিরাইজ্যা, এদিগে আয়। দেখ, তোরগো গেরামের লোক।’

ডাক শুনে ‘সিরাইজ্যা’ উঠে এল চায়ের কাপ হাতেই। কাছে এসে তাকাল আমার দিকে তীক্ষ্ম চোখে। তারপর ওপর-নিচ মাথা দোলাল। বলল, ‘হ্যাঁ, আমনেরে আঁই চিনছি। আমনের গো অমুক বাড়ি। আমনে অমুকের ভাতিজা।’

‘সিরাইজ্যা’ মানে সিরাজ আমার সমবয়সী। গায়ে গতরে অবশ্য আমার চেয়ে অনেক শক্তপোক্ত। একটু লম্বাও। আমার পাশের খালি চেয়ারটায় বসল। তারপর দোকানদারের দিকে তাকিয়ে হুকুম দিল, ‘অই মিয়া চা দেও এইখান দিয়া। এই মিয়া আমগো গেরামের লোক।’

আমি বললাম, ‘আরে না, আমি তো এইমাত্রই চা খাইলাম।’ অলি আম্মতের দিকে তাকালাম। ‘এই মিয়া খাওয়াইছে।’

সিরাজ পাত্তা দিল না। ‘আরে ভাইসাবজি খান তো। আমনে আমগো গেরামের লোক। আমনেরে কাপ্তাই হাইছি যে অনেক ভাগ্যের ব্যাপার।’ তারপর সে দাড়িঅলা লোকটার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘বুইজছেন কাকু, এই মিয়া অনেক বড় বাড়ির পোলা। আমরা একত্রে ইসকুলে পড়ছি। আমগো ভাইগ্যে কুলাই নাই, পইড়তে পারি নাই। হেই মিয়ারা লেকাপড়া শিখি এখন অনেক বড় মানুষ। এইসব মাইনষেরে আমরা পাই কঁডে।’ তারপর সে আমার সাথে স্কুলে পড়ার মোটামুটি একটা বর্ণনা দিয়ে ফেলল।

বুকটা অহঙ্কারে দুলে উঠল। এই ছেলের সাথে কোন বছর স্কুলে পড়েছি, আমার মনে নেই। কিন্তু সে যেভাবে বর্ণনা দিচ্ছে, তাতে ভুল হচ্ছে না একটুও। যাহোক ছোটবেলা নিজের ক্লাসমেট ছিল শুনে টান অনুভব করছি ওর প্রতি।

অলি আম্মতের দিকে তাকালাম। লোকটার চোখ-মুখের ভাব দেখে মনে হচ্ছে না, আমাদের এই আসরটা খুব একটা উপভোগ করতে পারছে। চোখে চোখ পড়তেই অপ্রসন্ন মুখে উঠে দাঁড়াল। সিরাজকে বলল, ‘অ সিরাইজ্যা। তুই ঔডা তোরঅ দেশি পাইয়ছ, এখন আর আঁর দরকার নাই। আঁই যাইরগৈ।’ চোখ ফেরাল আমার দিকে, ‘ঠিক আছে ভাইসাব। পরে দেখা অইবু, ক্যা-ন?’

লোকটার দিকে তাকিয়ে স্রেফ মাথা নাড়লাম। সিরাজকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘আপনি চাকরি করেন এখানে?’

সিরাজ বিনয়ে বিগলিত। হাসিমুখে বলল, ‘আহ ভাইসাবজি, আমগো আবার চাকরি। আছি কন মতে…যাইবাননি আমগো নৌকাত?’

‘চলেন।’ রাজি হয়ে গেলাম এক কথায়। আসলে খুব ভালো লাগছে। মনে হচ্ছে, আর কোনো চিন্তা নেই। আমার সমবয়সী, যে কিনা ছোটবেলায় ক্লাসমেট ছিল, সে এখানে চাকরি করে, সুতরাং আমিও কিছু একটা করতে পারব। কী করতে পারব, পুরোপুরি বুঝতে পারছি না, তবে কিছু একটা যে করতে পারব, তাতে কোনো সন্দেহ নেই।

মাসুদ আনোয়ার। লেখক ও সাংবাদিক। জন্ম – দীর্ঘাপাড়, সন্দ্বীপ, চট্টগ্রাম। পেশায় সাংবাদিক। লেখালেখির শুরু ছাত্রজীবন থেকে। মাধ্যম ছড়া, কবিতা ও উপন্যাস। লেখেন বড়-ছোট উভয় শ্রেণির পাঠকের জন্যে। প্রথম ছড়ার বই ‘হুক্কাহুয়া‘, প্রথম কিশোর উপন্যাস ‘কেউ জানে না‘। কিশোর গল্প সঙ্কলন...

এই বিভাগের অন্যান্য লেখাসমূহ