জলে জঙ্গলে (পর্ব- ৬)

মাসুদ আনোয়ার
উপন্যাস, ধারাবাহিক
Bengali
জলে জঙ্গলে (পর্ব- ৬)

পূর্বে প্রকাশিতের পর…

বিশাল এক নৌকা বাঁধা। খালি। পাড় থেকে খুঁটি গেড়ে বাঁধা। তক্তার সিঁড়ি বেয়ে উঠলাম সিরাজের সাথে। সাবধানে নৌকার কিনার ধরে হেঁটে হেঁটে ছইয়ের ভেতর গিয়ে ঢুকলাম। ভেতরে আরো দু’জন। একজন সিরাজের বয়সী, আরেকজন অবশ্য আরো বছর চার পাঁচেক বড় হবে। কালো। মুখে থুতনির কাছে হালকা দাঁড়ির গোছা। দু’জনেই উৎসুক চোখে দেখছে আমাকে। সিরাজ বসে পড়ে বিড়ি ধরাল। আমার দিকে চেয়ে বলল, ‘বসেন ভাই। গরিবের চাকরি। আমনেরা কত বড় মানুষ।’

ওর কথায় আন্তরিক স্বীকৃতি। দারুণ ইজ্জত দিচ্ছে আমাকে। হালকা দাড়িঅলা জিজ্ঞেস করল, ‘কে রে, সিরাজ।’

সিরাজ সাড়ম্ভরে পরিচয় করিয়ে দিল আমার। ‘আমার গ্রামের লোক। ছোটবেলা এক সাথে ইস্কুলে পড়ছি ওনার লগে। কাপ্তাই বেড়াইতে আইছে। চায়ের দোকানে দেখা।’

‘তাই?’ হালকা দাড়ি হেসে উঠল চিকন গলায়। ‘হেই মিয়ারা বড়লোক। আন্ডা গরিব মানুষ। আন্ডার চাকরি কী দেইকব আর? ভাই বসেন বসেন।’

বসলাম। ওরা গল্প করতে লাগল নানা বিষয়ে। আমি চুপচাপ শুনছি। ভালো লাগছে। জেটিঘাটে বাঁধা আরো অনেক খালি নৌকা। কিছু কিছু অবশ্য মালবোঝাইও। কিছু নৌকোয় টিনের চুলায় ভাত-তরকারি রান্না হচ্ছে। জেটিঘাটে ট্রাকের গোঁ গোঁ শোনা যাচ্ছে এখান থেকেও। আস্তে আস্তে চারদিকে বিজলী বাতি জ্বলে উঠতে শুরু করেছে। আমি উসখুস করছি। বাসায় যেতে হবে। সিরাজকে বললাম, ‘সিরাজ ভাই, বাসায় যাব।’

সচকিত হলো সিরাজ। ‘আচ্ছা, ভালা কতা। আমনে কার বাসায় আইছেন? মানে এখানে কে আছে আমনের গো?’

আমি গোলাম মাওলার কথা বললাম। সুইডিস্ট মসজিদের ইমাম সাহেবের বাসা শুনে নিশ্চিন্ত দেখাল সিরাজকে। ‘আইচ্ছা, কালা হুজুর। ওনার বাসা আমি চিনি। অসুবিধে নাই। বসেন আরো কতক্ষণ। আমি আমনেরে বাসায় দিয়া আসমু।’

পুরোপুরি নিশ্চিন্ত বোধ করছি। অসুবিধে কী? বসি না আরো খানিকক্ষণ।

মসজিদ থেকে আজান শোনা গেল। মাগরিবের আজান। হালকা দাড়ি বলল, ‘সিরাজ ভাত রান্না কইরবি না?’

আমাকে নিয়ে ছইয়ের ভেতর থেকে বেরিয়ে এল সিরাজ। ‘মমিন ভাই, আইজকা তুই রান্না কর। আমি মেহমান নিয়া একটু বেড়াই।’

কিস্তি নৌকোর ছই উঁচু আর বড়। আমাকে নিয়ে ছইয়ের ওপর দাঁড়াল সিরাজ। বলল, ‘কাপ্তাইয়ের বান দেকছেন?’ দক্ষিণ দিকে হাত উঁচাল। ‘অই দেখেন। বইতে কী হইরছেন না হইরছেন? এখন নিজের চোখে দেখেন।’

আমি দেখলাম এবং মুগ্ধ হলাম। এক সাথে যেন ঝিকিয়ে উঠেছে কাপ্তাই বাঁধের ষোলটি গেইটের প্রায় হাজার খানেক বাতি। আকাশ, পানি আর বনানীর প্রেক্ষাপটে ইন্দ্রপুরীর মত দেখাচ্ছে। হ্রদের পানিতে উত্তুরে বাতাসের হালকা পরশ। বাঁধের গোড়ায় সোনাগোলা পানি ঢেউ হয়ে নাচছে।

‘এত সুন্দর!’ মুগ্ধতা ঝরে পড়ল আমার গলা থেকে। ‘সত্যিই নিজের চোখে না দেখলে এমন সৌন্দর্য কেবল বইতে পড়ে অনুভব করা সম্ভব নয়।’

সিরাজ হাসল। ‘চলেন, উপরে যাই। চা খাব।

‘উপরে?’ আমি অবাক হলাম।

‘উপরে মানি হলো জেটিঘাটে। দেখেন না আমরা পানিতে ভাসছি। তাইলে অইটা উপরে হবে না?’

তক্তা বেয়ে নৌকো থেকে নামলাম। জেটিঘাট আর পানির মাঝখানে শুকনো চরের মতো। শন, কাঠ আর পাথরের স্তূপ। ঢালু রাস্তা উঠে গেছে ওপরের দিকে। রাস্তা বেয়ে উঠলাম আমরাও। পুরো জেটিঘাট আলোয় উজ্জ্বল। চায়ের দোকানে খদ্দেরের ভিড়। বয়-বেয়ারাদের হাঁকডাক, মানুষের গলার গম গম আওয়াজ আর টেপরেকর্ডারে গানের সুর–সব মিলিয়ে জমজমাট সন্ধে। সিরাজ আমাকে নিয়ে ঢুকল চায়ের দোকানে।

চিত্র: রিয়া দাস

‘ফুলের কথা শুনে ভোমর হাসে

কই তার মতো তুমি আমার পানে চেয়ে হাসো না তো…’

হেমন্তের দরদী গলার সুরে চাপা পড়ে যাচ্ছে সব চিল্লাচিল্লি। কেউ কেউ চা খেতে খেতে তাল দিচ্ছে গানের সুরে সুরে।

সিরাজ নানা গল্প করছে। ইস্কুলে পড়ার সময় একদিন আমার সঙ্গে নাকি কী একটা ব্যাপারে ঝগড়া হয়েছিল, সে কথা বলছে রসিয়ে রসিয়ে। ওর কথা শুনে মনে হচ্ছে, ব্যাপারটা খুব হাসির ছিল। তবে আমি মনে করতে পারলাম না ঘটনাটা। আসলে আমি সিরাজকে ঠিক কোন ক্লাসে সহপাঠী হিসেবে পেয়েছিলাম, সেটাই মনে করতে পারছি না এখনো।

কিন্তু তাতে তো বিশেষ কিছু আটকাচ্ছে না। সিরাজ আমাকে খুব ইজ্জত দিয়ে কথা বলছে। নিজেকে তাই খুব দামী আর উঁচু স্তরের মনে হচ্ছে ওর তুলনায়। সেও কিন্তু সেটা আমাকে বুঝিয়ে দিচ্ছে বারবার তার বিনয়ী আচরণ দিয়ে। একটু পর পর বলছে, ‘ভাই, আপনারা লেখাপড়া শিখেছেন। কত কিছু জানেন। কত বই পড়েছেন। আমরা তো পড়তে পারলাম না ভাগ্য খারাপ বলে। আপনেরে আমি কোথায় পাইতাম? আজ কাপ্তাই এসেছেন বলে….’

ক্যাসেটে এখন হিন্দি গান বাজছে। ‘তু গঙ্গা কি মৌজ ম্যায় যমুনা কি ধারা…’

আচমকা কেমন যেন লাগতে শুরু করল। ‘গঙ্গা কি মৌজ’এর সুর তুঙ্গে উঠল, আর আমার মাথার ভেতর কী যেন হয়ে গেল। চায়ের দোকান, কাস্টমারদের হৈ চৈ, কাপ-পিরিেিচর টুংটাং, কলিং বেলের খ্যারোরোৎ…কিছুই যেন নেই কোথাও। আমার সামনে বসে ইনিয়ে বিনিয়ে কথা বলা সিরাজ যেন কোথায় গায়েব হয়ে গেল। নিজেকে আবিষ্কার করলাম এক অপরিচিত পরিবেশে। সেখানে সব কিছু ছাপিয়ে কেবল আমিই। এক সুন্দর, স্বাপ্নিক তরুণকে দেখলাম হেঁটে যাচ্ছে দৃঢ় পদক্ষেপে সাবলীল গতিতে। সবার চোখ সে তরুণের দিকে। প্রশংসায় উন্মুখ। সে তরুণের মনের ভেতর গঙ্গা-যমুনার তরঙ্গধারা, দু’চোখ জুড়ে স্বপ্নের রঙিন ফোয়ারা। সে তরুণ সাফল্যে হাসছে, ব্যর্থতায় রুখে দাঁড়াচ্ছে।

এই তরুণ আমার বুদ্ধি হওয়ার পর থেকেই পরিচিত। এক সময় সে শিশু ছিল, তারপর কিশোর হলো। আমার কৈশোরিক স্বপ্নের পথ বেয়ে এসে এখন সে জীবনের বৃহত্তর পরিসরে এসে দাঁড়িয়েছে। আজন্ম  মায়ের স্নেহবিহীন এক শিশু তার একান্ত স্বপ্নের ভেতর তৈরি করে নিল নিজের জন্যে একটি জগৎ, সে জগতে সে মায়ের সাথে থাকে, মাকে ঘিরেই তার সব কিছু আবর্তিত। তারপর তার কৈশোরিক বয়সে মায়ের সাথে যুক্ত হলো আরো কিছু প্রিয় মুখ। এরা হলো তার ক্লাসমেট, খেলার সাথী। এদের মধ্যে আছে আবার দু’একটি কিশোরী মুখও। সলজ্জ, মিষ্টি।

‘কী ভাই, কী ভাবতেছেন?’

সিরাজের প্রশ্নে চমক ভাঙল। বিব্রত মুখে হাসলাম। ‘না, এমনি।’

‘বাড়ির কথা ভাইবতেছেন?’

‘উঁ..হুঁ, না। আচ্ছা, সিরাজ ভাই, কাপ্তাইয়ে কলেজ নাই?’

‘কলেজ! কী জানি? কলেজ কীয়ের লাই?’ হাসতে শুরু করল সিরাজ। ‘আমগো কলেজ জেটিঘাট। আমগো কলম দশহাইত্যা দাঁড়, আমগো বই হলো….হি হি হি…’ হাসতে হাসতে দম বন্ধ হওয়ার জোগাড় হলো ছেলেটার।

‘না। আমি কলেজে ভর্তি হবো। আরো লেখাপড়া করব।’ গম্ভীরস্বরে জানিয়ে দিলাম ওকে।

‘আচ্ছা, ভাইসাবজি,’ সিরাজ চোখ তুলল আমার  দিকে। ‘সত্য করে বলেন তো, আমনে কি বাড়িত্তে পালাই আইছেন?’

‘হ্যাঁ।’ সরাসরি স্বীকার গেলাম। ‘বাড়িতে আমার ভালো লাগে না।’

সিরাজ আমার দিকে চেয়ে রইল কিছুক্ষণ। তারপর আস্তে আস্তে বলল, ‘আমনের মা কানবে না। বাপে…’

‘আমার মা নেই।’ হুট করে বেরিয়ে পড়ল কথাটা মুখ থেকে।

‘অ।’ ফস করে ম্যাচ মেরে বিড়ি ধরাল সিরাজ। এক মুখ ধোঁয়া গিলে নিয়ে ভুস করে ছাড়ল নাকে-মুখে। ‘হের লাইগ্যা।’ বড় করে নিঃশ্বাস ছাড়ল। ‘সত্য। মা না থাকলে বাপ তালই।’

বাপ ‘তালই’ না কি ‘খালু’ ওসব কখনো আমি ভাবিনি। তবে এটা বুঝি, মা না থাকা মানে একটা ছেলে অথবা মেয়ের জীবনের অর্ধেক অংশ মরে থাকা। বাবার সাথে আমার কখনো কোনো অন্তরঙ্গ সময়ের কথা মনে পড়ে না। ভাবলেই মনে পড়ে শাসন-ত্রাসন আর তর্জন-গর্জনের কথা। উচ্ছৃঙ্খল, ছন্নছাড়া, পাগল এসব বিশেষণ ছিল আমার জন্যে বাঁধা। মারধরের কথাও বেশ মনে পড়ে। অবশ্য বাবারা ছেলেমেয়েদের শাসন তো করেই থাকে। তবে সেটা খুব একটা বড় হয়ে বাজে না, যদি মারধর বা বকাবকি করে বাবা সরে যাওয়ার পর মায়ের আঁচল কিংবা স্নেহের হাত মাথায় কিংবা পিঠে নেমে আসে কোমল বৃষ্টির ফোঁটার মতো। যাদের মা থাকে না, তারা কেবল সেসব কিছু কল্পনা করতে পারে, বাস্তবে উপলব্ধি করতে পারে না। বাবার ওপর অভিমান হলে মা তা কাটিয়ে দেয় আদর-সোহাগ দিয়ে। আবার বাবাও হয়তো পরে এসে আদর করে ঠা-া মাথায় বুঝিয়ে সুঝিয়ে শান্ত করে দেয়। কিন্তু আমি কখনো বাবার কাছ থেকে পরের পর্বটুকু উপভোগ করতে পারিনি।

চিবুকে হালকা দাড়ি, গায়ে সাদা শার্টের ওপর কালো সোয়েটার. গলায় লাল মাফলার প্যাঁচানো একটা লোক এসে দাঁড়াল আমাদের টেবিলের সামনে। ডাকল ‘সিরাজ রে!’

সিরাজ সচকিত হলো। ‘বাইছা, আইছেন নি?’

‘হ্যাঁ, আইলাম।’ সিরাজের পাশের চেয়ারে বসল লোকটা। ‘চা খাছনি? মমিনা কই? ফয়জা? এই মিয়া কে? তোগো দেশি নি?’ সবগুলো প্রশ্ন সে আমার ওপর চোখ রেখেই করল।

মমিনা-ফয়জা’র খবর বলে আমার পরিচয় দিল সিরাজ। ‘বাইছা, ইনি আমগো দেশি মানুষ। আমগো গেরামের ছেলে। ছোডবেলায় আঁই আর উনি এক স্কুলে পড়ছিলাম। আমগো কোয়াল খারাপ। কাপ্তাই আইয়েরে নৌকা বাইয়র। উনি মেট্রিক পাস। কাপ্তাই বেড়াইত আইছে।’

লোকটা মিষ্টি করে হেসে আমার দিকে একটা হাত বাড়িয়ে দিল। আমিও নিজের হাত বাড়িয়ে দিলাম। সিরাজের মনিব যখন, তখন এইটুকু সৌজন্য অবশ্যই দেখানো উচিত। লোকটা আমার হাতটা আকড়ে ধরে ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে বলল, ‘আমার নাম আবুল মাঝি। সিরাজ আমার ভাইয়ের মতো। আমরা এক সাথে একখান কিস্তি চালাই।’

লোকটার সৌজন্যে রীতিমতো মুগ্ধ হয়ে গেলাম। উনি নিজে একখানা নৌকার মালিক। সিরাজ ওঁর নৌকায় চাকরি করে। অথচ বলছে কিনা সিরাজ আমার ভাইয়ের মতো!

আবুল মাঝি আবার চায়ের অর্ডার দিল। আমি বললাম, ‘এই মাত্র তো চা খেলাম। আবার…’

আমার আপত্তিতে কান দিল না আবুল মাঝি। ‘আরে খান তো।’

আরেক দফা চা হলো। আমি সিরাজকে বললাম, ‘সিরাজ ভাই, আমাকে এবার উঠতে হবে। আপা-দুলাভাই চিন্তা করবে।’

আবুল মাঝি বলল, ‘যাইবান গা? কেন, আজ আমাদের সাথে বেড়ান না। নৌকায় আমরা সবাই থাকমু। দেখেন না, আমরা নদীর মানুষেরা কী খাই, কোথায় ঘুমাই।’

কথাটা শুনতে খুব মজা লাগল। নদীর মানুষ! আরে তাই তো! এরা তো নদীর মানুষই। খাওয়া-শোয়া-ঘুম সব নৌকার মধ্যে। একটা নৌকো নয়, জেটিঘাটে কয়েক শ’ নৌকো আছে এখন। এরা সবাই তো নৌকোয় খায়, ঘুমোয়। এটা একটা দেখার মতো ব্যাপার বটে। এটা তো একটা বিচিত্র অভিজ্ঞতা হবে। থাকব নাকি?

সিরাজ আমার মুখের দিকে চেয়েছিল। সম্ভবত আমার ভাবান্তর তার চোখ এড়াল না। সে মৃদু হাসল। ‘থাকবেন নাকি? সকালে উঠে চলে যাবেন।’

মন্দ নয়। সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললাম। থাকব।

পরে জেনেছি, কাপ্তাই হ্রদের সবচেয়ে সুস্বাদু মাছ হলো বাছা মাছ। স্থানীয় ভাষায় বাছা মাছই বলে। অন্য কোনো নাম আছে কিনা জানা নেই। সে বাছা মাছের তরকারি দিয়ে আতপ চালের ভাত। এত ভালো লাগল। রেঁধেছে মমিন। এত ভালো রেঁধেছে যে, মনে হলো আরো দু’পিস মাছ আর ঝোল দিয়ে মেখে আরো দু’প্লেট ভাত খাই। কিন্তু আমি মেহমান মানুষ, মুখ ফুটে কী করে বলি? অবশ্য বললেও যে খুব লাভ হতো, তা না। কারণ প্রত্যেকের জন্যে এক পিস করে মাছ আর তরকারি। বাড়তি আমাকে খাওয়াতে গিয়ে মমিন আর সিরাজের পাতে পড়ল আধখানা করে।

তবে খাওয়াটা দারুণ অন্তরঙ্গ পরিবেশেই হলো। আবুল মাঝি আজই এসেছে গ্রামের বাড়ি মিরসরাই থেকে। বাড়ির গল্প বলল সে। গল্পটা হাসির। খেতে খেতে হাসাহাসি হলো প্রচুর। পরিচয়ও হলো। সিরাজের বাড়ি তো আমাদের এলাকায়। ফয়েজের বাড়ি নোয়াখালী। বয়সে আমার বড়ই হবে। বেশ গাট্টাগোট্টা শরীর। একটু গম্ভীর টাইপের মুখ। কথাবার্তা বেশি বলে না। তবে মৃদু হাসি এক টুকরো সারাক্ষণ ঝুলে থাকে ঠোঁটে। কালো নিগ্রো টাইপ চেহারা মমিনের। ওর বাড়িও মিরসরাই। মাঝির নাকি খালাতো ভাই। নৌকোয় মাঝি না থাকলে ও-ই মাঝি। মানে মেট মাঝি।

শীত পড়ছে খুব। উত্তর থেকে বওয়া বাতাসের সাথে যেন বরফের কুচি উড়ছে। ছইয়ের বাইরে বেরোলে গা শির শির করছে। আমার গায়ে শার্টের ভেতর হালকা একটা গরম গেঞ্জি। ঠা-া মালুম হচ্ছে, তবে খুব একটা পাত্তা দিচ্ছি না। আবুল মাঝি বলল, ‘আপনের গরম কাপড়চোপড় নাই?’

‘নাই’ কী করে বলি? বললাম, ‘আছে তো। আপার বাসায় রেখে এসেছি। দুপুরে বেরিয়েছিলাম তো। তাই বেশি কিছু আনিনি।’

‘ও আচ্ছা। তাহলে শুয়ে পড়েন।’

নিজের গায়ের গরম কাপড়চোপড় খুলতে শুরু করল সে। ‘অসুবিধে নেই। আমার কম্বল বড় আছে। আমার সাথে শুতে পারবেন।’

সিরাজের দেখি শোবার উদ্যোগ নেই। ছইয়ের ওপর বসে আছে। আবুল মাঝি ডাকল, ‘সিরাইজ্যা, শুবি নারে?’

‘না,’ সিরাজ ছইয়ের ওপর থেকে জবাব দিল। ‘শরিয়ত মারফতি শুনতে যামু।’

শরিয়ত মারফতি! তাইলে তো আমিও যাব। সিরাজের পাশে গিয়ে বসলাম। ও জিজ্ঞেস করল, ‘শুইবান না?’

‘নাহ্, আমিও যাব শরিয়ত মারফতি শুনতে। আমার খুব ভালো লাগে।’

সিরাজ হাসল। ‘ঠিক আছে, চলেন তাইলে।’

নিচ থেকে আবুল মাঝি ডাকল, ‘কইরে সিরাজ, মেহমান কই? ঠা-ার মইধ্যে বসি থাকি লাভ কী?’

‘মেহমান এখন শোবে না বাইছা।’

‘ক্যা?’

‘শরিয়ত মারফতি হুইনতে যাইব বলে।’

নিচ থেকে বিড় বিড় করে কী যেন বলল আবুল মাঝি। মনে হলো, ব্যাপারটা পছন্দ হয়নি ওর। পাত্তা দিলাম না।

আসলে নৌকোয় থাকতে রাজি হয়ে বিরাট বেকুবি করে ফেলেছি। তখন ব্যাপারটাকে ইন্টারেস্টিং মনে হয়েছিল। ভেবেছিলাম, নৌকোয় রাত কাটানোর ব্যাপারটা হবে একটা অ্যাডভেঞ্চারের মতো। কিন্তু তার মানে যে নিজের চেয়ে বেশি বয়সী অজানা অচেনা একজনের সাথে এক কম্বলের নিচে ঘুমোতে হবে, সেটা কে ভেবেছিল। প্রস্তাবটা শুনেই বিব্রত বোধ করতে শুরু করেছিলাম। বুঝতে পারছিলাম না কী বলব। সিরাজের সাথে এক কম্বলে ঘুমোতে হলে আপত্তি হতো না। দু’জনেই আমরা সমবয়সী। কিন্তু ৪০-৫০ বছরের অচেনা এক লোকের সাথে ১৫-১৬ বছর বয়সী কিশোর কী করে ঘুমোতে পারে?

ওদিকে বাসায় না যাওয়ার কারণে নির্ঘাত চিন্তা করছে শাজু বু’। গোলাম মাওলা হয়তো চিল্লাচিল্লি শুরু করেছেন তার সাথে। নাহ, বাসায় না যাওয়াটা ভীষণ অন্যায় হয়ে গেছে। ওদের টেনশনে ফেলাটা উচিত হয়নি।

সিরাজ যেন কী করে আমার মনের চিন্তাটা বুঝে যাচ্ছে। ‘বাসায় চিন্তা করবে না?’

‘চিন্তা? হ্যাঁ, তা একটু করবে অবশ্য। কিন্তু কী আর করা? আসলে আপনাদের নৌকোর জীবন দেখার খুব ইচ্ছে হয়েছিল। তাই রয়ে গেলাম।’ মৃদু হেসে বললাম।

সিরাজও হাসল। ‘হাহ্! আমাদের আবার জীবন। কাঠ-পাথর-রদ্দা টানি ভাত খাই। কোথায় মা, কোথায় বাপ? হোঁ…’ নিঃশ্বাস ফেলল।

‘কিন্তু স্বাধীন জীবন। নিজের ইচ্ছে মতো টাকা আয় করে নিজের ইচ্ছে মতো খরচ করা। এর মজাই তো আলাদা।’

‘হ্যাঁ, এইটা অবশ্য ঠিক বলেছেন। নিজের কামাই নিজে খাই। কোনো শালার ধার ধারি না।…আমনেরা অবশ্য লেখাপড়া জানা লোক। বড় বড় চারকি গইরবান…’

আমি হেসে চুপ করে গেলাম। সিরাজ বিড়ি বের করে ধরাল। আমাকে দিল একটা।

বিড়ি ধরিয়ে চুপচাপ টানছি। আমার চোখ আলোকোজ্জ্বল কাপ্তাই বাঁধের ওপর। বাঁধের গোড়ায় অগাধ পানিতে মৃদু ঢেউ। পানিতে পড়া আলোর প্রতিবিম্বগুলো তাতে বেঁকে চুরে যাচ্ছে। ক্যাঁক্কোরোৎ ক্যাঁক্কোরোৎ করে সাম্পান আসছে পুবদিক থেকে। এত রাতে কোত্থেকে আসছে ওগুলো?

পুবদিকে পানিতে মাথা জাগিয়ে থাকা পাহাড়ের আড়ালে চলে গেছে হ্রদ। আকাশে এক টুকরো চাঁদ, অসংখ্য তারা ঝক মক করছে। আর দিনের বেলা যেগুলো সবুজ আর নীলপাহাড় ছিল, সেগুলো এখন অন্ধকারে ভুতুড়ে রূপ নিয়েছে।

‘আচ্ছা,’ সিরাজকে জিজ্ঞেস করলাম। ‘পুবদিকে আর কী কী জায়গা আছে?’

‘ওরে বাবা!’ আঁতকে ওঠার ভান করল সিরাজ। ‘তার নি আর শেষ আছে? শুনেন, রাইক্সক্ষং, কাসালং, মাসালং, সাজেক, বরকল, বোয়ালখালী, সুবলং, কাট্টলী, বিলাইছড়ি, তক্তানালা, মাইনি, মারিস্যা, হরিণা, আলিকং…..আরো অনেক জায়গা।’

একেকটা নাম মনের ভেতর যেন গেঁথে যেতে লাগল আমার। কেমন এসব জায়গা? কেমন এসব জায়গার মানুষরা? সিরাজ অবলীলায় বলে গেল নামগুলো আর প্রত্যেকটি নাম আমার কাছে ধরা দিল অপূর্ব এক রহস্যময়তায়। কাসালং, মাসালং, সাজেক, বরকল….মাইনি, মারিস্যা, হরিণা, আলিকং…..কী সুন্দর নামগুলো! শুনতে কেমন ঝিম ঝিম করছে মাথার ভেতর।

বিড়ি শেষ করে পানিতে ছুঁড়ে ফেলল সিরাজ। বলল, ‘চলেন। যাইবেন না?’

বিকেলে অলি আম্মতের সাথে যে দোকানে বসে চা খেয়েছিলাম, সে দোকানে গিয়ে বসলাম দু’জনে। এরই মধ্যে অনেক লোক হয়ে গেছে। ঝাঁকড়াচুলো আধবয়সী এক লোককে দেখা গেল চা খাচ্ছে। তার সামনে টেবিলের ওপর রাখা একটা বাদ্যযন্ত্র। একতারা বোধ হয়। গানটা মনে পড়ে গেল।

‘একতারা তুই দেশের কথা বলরে এবার বল

আমাকে তুই বাউল করে সঙ্গে নিয়ে চল।’

তাহলে এই লোক কি বাউল? বৈরাগী? না মনে হয়। বৈরাগীদের তো গায়ে গেরুয়া পোশাক থাকে। এই লোকের গায়ে খয়েরি রঙের পাঞ্জাবী, পরনে বোধ হয় সাদা পাজামা। বৈরাগী বলতে যে লালনশাহী চেহারাটা মনের ভেতর ফুটে ওঠে, তার কিছুই নেই।

আমরা চা খাচ্ছি। দোকানের টেপরেকর্ডার বাজছে না এখন। চাটগাঁ, নোয়াখালী আর সন্দ্বীপের আঞ্চলিক ভাষায় কথা বলছে লোকগুলো। একজন দেখি মাইজভা-ারী গানের সুর ধরেছে হেঁড়ে গলায়।

‘ওই বেডা ইয়া, এই থাম!’ ক্যাশের পেছন থেকে ধমকে উঠল দোকানদার। ‘মানুষ এন্ডে তোর ভ্যান ভ্যান পুনিবার লাই ন’ আইয়ে।’

ভেতরে জায়গা নেই। রাস্তায়ও দেখি জড়ো হয়ে গেছে অনেক মানুষ।

আমার ভেতরে এক অভূতপূর্ব অনুভূতি। শরিয়ত মারফতি গান আগেও শুনেছি। আমাদের অঞ্চলে শীতের দিনে শরিয়ত মারফতি গানের আসর বসে। দুই কবির লড়াই হয়। ক্লাস নাইনে ওঠার পর বাড়ির কাছে এই ধরনের আসরে দু’একবার গেছিও। সেখানে সব নিজের বাড়ি আর পাড়ার ছেলেরা মিলে হল্লা করেছি গান শুনতে শুনতে। কিন্তু এখানকার ব্যাপারটা সম্পূর্ণ ভিন্ন। এখানে এই সিরাজ ছাড়া আর একটি মানুষও আমার পরিচিত নয়। এখানে আমি সদ্য এসএসসি পরীক্ষা দিয়ে আসা একটি ছেলে। এখানে যারা আছে, তাদের সবার চেয়ে শিক্ষিত। এদের পরিবেশ, অভ্যাস, মূল্যবোধ সব কিছুর চেয়ে আলাদা এবং উন্নত। এদের সাথে আমার অনেক পার্থক্য।

আমি লক্ষ করছি এদের কথাবার্তা, আচার-আচরণ, হাসি-ঠাট্টা। আমার পরিচিত পরিম-ল থেকে অনেক ভিন্ন। এরা এই মাত্র পাশের জনকে ‘ভাই’ ডেকে পরমুহূর্তে ’শালা’ বলতেও দ্বিধা করছে না। আমার পাশে বসা সিরাজকে শুনছি কথা বলতে। দারুণ আলাপ জমিয়ে দিয়েছে সে পাশের জনের সাথে। কথায় কথায় হাসছে ও, একেকবার পাশের জনের মা বা বোনের সাথে বিশেষ সম্পর্কের কথা ঘোষণা করছে। আবার নিজের  মা-বোনের সাথেও ওই ছেলের সম্পর্কের কথা শুনছে। তবে তাতে কোনো প্রতিক্রিয়া হচ্ছে না কারো।

আচমকা বাড়ি থেকে অনেক দূরে সম্পূর্ণ অজানা অচেনা কাপ্তাই জেটিঘাটে এক শীতের রাতে চায়ের দোকানে শরিয়ত মারফতি শুনতে বসে চা-বিড়ি খেতে খেতে মনে হলো, ‘বড় হয়ে গেছি। দুনিয়ার মানুষের সাথে চলার সময় হয়ে গেছে। আমি আর বাড়ি ফিরে যাব না। নিজের জীবনের দায়িত্ব নিজেই বইব এখন থেকে।’

একতারার টুং শব্দে সচকিত হয়ে উঠলাম। ঝাঁকড়াচুলো লোকটা পান খেতে খেতে একতারায় টুং টাং শব্দ তুলছে। মানুষের হৈ হল্লা কমে আসতে লাগল। একতারার টুং টাং প্রথমে ধীর, তারপর আস্তে আস্তে দ্রুত হয়ে উঠতে লাগল। ভরাট গম্ভীর গলার সঙ্গত শুরু হলো তার সাথে, আ..আ..আ..

প্রথমে একটা গান গাইল লোকটা। গান নয় ঠিক, বন্দনা। পুব-পশ্চিম, উত্তর-দক্ষিণ, মক্কা-মদীনা, হিমালী পাহাড়, পীর-পয়গাম্বর, আউলিয়া-দরবেশ, মা-বাবা, ওস্তাদ…গানের মাধ্যমে সবার কাছে সালাম পৌঁছে দিয়ে তাদের দোয়া কামনা করল লোকটা। তারপর উপস্থিত শ্রোতা-বন্ধুদের জানাল, আজ দাউদ নবীর একটা কাহিনি শোনাবে সে। কীভাবে দাউদ নবী এক মহিলার প্রেমে পড়ে তার স্বামীকে খুন করে তাকে স্ত্রী হিসেবে পেতে চেয়েছিলেন এবং তাতে আল্লাহতায়ালা দাউদ নবীর ওপর কীরকম নাখোশ হয়েছিলেন, সে কাহিনি।

লোকটা আবার একতারায় সুর তুলল। প্রথমে বিলম্বিত লয়ে, তারপর আস্তে আস্তে দ্রুত, দ্রুততর হয়ে উঠল। একতারার মধুর সুরে আবিষ্ট হয়ে পড়ল পুরো দোকান আর রাস্তায় দাঁড়ানো মানুষগুলো। পিনপতন নিস্তব্ধতা কথাটার মানে যেন নতুন করে বুঝতে পারছি। এর মধ্যে বেসুরো হয়ে বাজছে মাঝে মধ্যে কোনো কোনো শ্রোতার চা দেয়ার জন্যে বয়কে ডাকাডাকি। তবে সেও খুব জোরে নয়। যতটা শব্দ না হলে নয়, তারচে’ উঁচু গলায় কথা বলছে না কেউ।

আচমকাই থেমে গেল গেল একতারা। তারপর দু’একবার টুং টাং। এরপরই ভরাট গলায় গেয়ে উঠল লোকটা :

পাক নামে ভরসা করি

দিয়াছি সাঁতার

পার করো, ডুবাইয়া মারো

মহিমা তোমার…

দয়াল, তুমি ছাড়া এই ভূবনে কে আছে আমার?

একতারায় সুর উঠল মুখবন্ধের। আমি তাকিয়ে রইলাম লোকটার দিকে। হ্যাঁ, বাজাতে পারে বটে লোকটা। প্রাণকাড়া টুং টাং শব্দ শ্রোতাদের মন কেড়ে নিয়ে ছড়িয়ে পড়ছে আকাশে বাতাসে, হ্রদের জলে আর নীলপাহাড়ের গায়ে।

ভুল বলেছে সিরাজ। শরিয়ত মারফতি নয়, এটা একটা জারি। হাসান-হোসেনের জারির মতো দাউদ নবীর জারি। তবে গাইছে বটে লোকটা। রীতিমতো ওস্তাদ।

শেষ রাতে নৌকোয় ফিরে এসে সিরাজের পাশে শুলাম। ওর কাঁথা ছোট, খুব টানাটানি হলো দু’জনে। তবু ঘুমিয়ে পড়লাম। মনে হলো ঘন্টা খানেকও হয়নি, আবুল মাঝির চেঁচামেচিতে উঠে পড়লাম।

‘ওই মমিনা, ফয়জা, সিরাইজ্যা….উঠ উঠ উঠ। হারা রাইত ঘুমাইঅ তোর গো ঘুমের টক মিডে ন’, না?’

ওদের সাথে ধড় মড় করে উঠে গেলাম আমিও। বেরিয়ে এসে ছইয়ের ওপর দাঁড়ালাম। রোদ উঠেছে অনেক আগেই। বেলা নয়টার কম নয়। কুয়াশা অবশ্য এখনো কাটেনি। কাপ্তাই বাঁধের বাতি নিভে গিয়ে এখন ম্রিয়মাণ দেখাচ্ছে গেটগুলোকে। জেটিঘাট থেকে অনেক নৌকো ছেড়ে যাচ্ছে। মাল বোঝাই নৌকোও এসে ভিড়ছে কিছু কিছু। নামার চরে ট্রাক এসে ভিড়েছে নৌকোর সাথে। কাঠ, পাথর, রদ্দা লোড আনলোড চলছে। কাজের ব্যস্ততায় নাইয়া-মাঝিদের হৈ চৈ, আর লেবারদের ডাক : ও ও হেঁইয়া…হেঁইয়া…

আবুল মাঝি ডাকল আমাকে, ‘বাইছাব, নিচে যাইবাননি? চা খাইবান না?’

লোকটার নৌকোয় কাল রাতে ভাত খেয়েছি। সৌজন্য দেখিয়েছে, হাসিমুখে গল্পগুজবও করেছে। এখন আবার চা খাওয়ার আমন্ত্রণ জানাচ্ছে। মুগ্ধ হয়ে গেলাম। নাহ, অশিক্ষিত মানুষের মধ্যেও দেখছি অনেক ভদ্রলোক। আসলে কেবল শিক্ষিত হলেই মানুষ ভদ্র হয় না। ভদ্র যারা, তারা আলাদা। এসব কথা এতদিন অনেকের মুখে শুনেছি। নিজের চোখে আজ প্রথম দেখলাম এমন একটি লোক।

ক্ষিধে পেয়েছে খুব। তবু ভদ্রতা করে বললাম, ‘না, আমি বাসায় গিয়ে খাব।’

‘আরে না। কী বলেন? আপনি আমার মেহমান না? মেহমানরে মানুষ না খাইয়ে বিদায় দেয় নাকি?’

আপত্তি করার আর কোনো সঙ্গত কারণ খুঁজে পেলাম না। সত্যিই তো, মানুষ কি না খাইয়ে মেহমান বিদায় করে কখনো?

লেবারদের হেঁইয়া হেঁইয়া, কাঠ-পাথর লোড-আনলোডের ধুপধাপ শব্দ আর ট্রাকের গোঁ গোঁ আওয়াজ পেছনে রেখে আজমীর বেকারীতে গিয়ে ঢুকলাম আমি আর আবুল মাঝি। পরোটা আর স্যুপের অর্ডার দেয়া হলো। খেতে দারুণ ভালো লাগল আজমীর বেকারীর পরোটা। ক্যাশে বসে আছে পেটমোটা হুজুর টাইপের একজন। ফরসা অভিজাত চেহারা। মনে হয় মালিক। সুখি আত্মতৃপ্ত ভাব। এরকম ভাব কর্মচারীদের মুখে আসে না। একজন বয়ের দিকে নজর গেল আমার। সুন্দর মায়াকাড়া বড় বড় চোখ ছেলেটার। আমার ক্লাসমেট সেবকের কথা মনে পড়ে গেল হঠাৎ। সেবকেরও এরকম মায়াবী চোখ। শালা অবশ্য বড় হতে হতে ক্লাস ফাইভ-সিক্সের সে মায়াবী চেহারা কিছুটা হারিয়ে ফেলেছে এখন। ব্যাটা ব্যাটা ভাব চলে এসেছে মুখে। কথাবার্তায়ও। অবশ্য বড়লোকের ছেলে। আস্তে আস্তে বড়লোকী ভাব তো ফুটে উঠতে শুরু করবেই।

ছেলেটাকে ডাকলাম। কাছে এসে দাঁড়াল ছেলেটা। কিছুটা অবাক। নাম জিজ্ঞেস করতে বলল, ‘ফখর।’

ছেলেটার চেহারা অনুযায়ী নামটা তেমন মায়াবী মনে হলো না। একটু আধুনিক হলেই যেন ভালো হতো। অবশ্য গরিবের ছেলের নাম এরকমই হয়। গরিব নিশ্চয়, লেখাপড়া করতে পারেনি। নইলে এই বয়সে কাপ্তাই এসে চায়ের দোকানে চাকরি করে কেন?

‘বাড়ি কোথায় তোমাদের?’

‘সন্দ্বীপ।’

আরে, এ যে দেখছি আমাদের এলাকার লোক! এতক্ষণ তো আদর লাগছিল, এখন যেন সেটা আরেকটু বেড়ে গেল।

কাস্টমার আসতেই চলে গেল ছেলেটা। আমিও একটু পরে  বিদায় নিলাম আবুল মাঝির কাছ থেকে। আবুল মাঝি বিশেষ করে বলে দিল, কাল যেন আবার অবশ্যই আসি। ওদের নৌকো জেটিঘাটে থাকবে আরো দিনকয়েক।

মাসুদ আনোয়ার। লেখক ও সাংবাদিক। জন্ম – দীর্ঘাপাড়, সন্দ্বীপ, চট্টগ্রাম। পেশায় সাংবাদিক। লেখালেখির শুরু ছাত্রজীবন থেকে। মাধ্যম ছড়া, কবিতা ও উপন্যাস। লেখেন বড়-ছোট উভয় শ্রেণির পাঠকের জন্যে। প্রথম ছড়ার বই ‘হুক্কাহুয়া‘, প্রথম কিশোর উপন্যাস ‘কেউ জানে না‘। কিশোর গল্প সঙ্কলন...

এই বিভাগের অন্যান্য লেখাসমূহ