ইমন কল্যাণ
পরিচ্ছেদ ৬ অনেক রাতে ফিরেছিল কল্যাণ ওরফে শহীদুল।গাড়িটা শেডে রাখার পর দু’বার হালকা করে মা…..
একটু ভয়ে ভয়ে বাসায় ফিরলাম। শাজু বু’ আর দুলাভাই কী বলে কে জানে? বাসায় ঢুকতে দৌড়ে এল শাজু বু’। উদ্বিগ্ন চোখে আমার আপাদমস্তক দেখে নিয়ে বলল, ‘কী রে দুলু? তুই রাতে কই আছিলি?
আমি হাসলাম। ‘জেটিঘাট।’
‘জেটিঘাট? ওখানে তোর পরিচিত কে আছে। কারে চিনস তুই? আমরা এখানে চিন্তা করতে করতে শেষ। তোর দুলাভাইয়ের প্রেশার বাড়ি গেছে। রাতে না আসলে আমাদের বলে যাবি না। এই, আফলাতুন মাঝির কাছে ছিলি নাকি রে?’
আফলাতুন মাঝি আমার আরেক মামাতো বোনের জামাই। আরে, ওর কথা তো আমার মনেই ছিল না! ওই লোকও শুনেছি কাপ্তাই থাকে। নিজের নৌকো আছে। কন্ট্র্রাক্টরিও নাকি করে। দুলাভাইয়ের বকা
থেকে বাঁচার জন্যে যাহোক একটা উপায় খুঁজে পাওয়া গেল। সহজ সরল শাজু বু’ নিজের অজান্তেই আমার একটা সন্তোষজনক কৈফিয়ত দেয়ার উপায় করে দিল। ‘হ্যাঁ।’
আমার ওই মামাতো বোনের নাম ছাওরা খাতুন। শাজু বু’ তার নাম ধরে বলল, ‘ছাওরির জামাই হুনছি ব্যস্ত মানুষ। তুই কেমনে হেইতেরে পাইলি? কী খাওয়াইল রে?’
কাল্পনিক কিছু একটা বলে শাজু বু’কে পাশ কাটালাম। ওর ছেলের গালে একটা ঠোনা মারলাম। বাপের মতোই কালো হয়েছে ছেলেটা। আজ অবশ্য ঠোনা খেয়ে কিছু বলল না। শুধু মার কোল ঘেষে দাঁড়াল একটু। মাকে কথা বলতে দেখছে আমার সাথে। সুতরাং ‘সন্দেহভাজন’ কেউ নাও হতে পারে, এরকম ভাবতে শুরু করেছে হয়তো।
শুক্রবার। দুলাভাই কলতলায় গোসল করছে। জুমার নামাজের সময় হয়ে এসেছে। গোসল শেষ বোধ হয়। কাপড় আছড়ানোর শব্দ শুনতে পাচ্ছি। মিনিট দশেক পরে বেরিয়ে এলেন। আমাকে দেখে দাঁড়িয়ে গেলেন ভেজা কাপড় হাতেই।
‘কী মিয়া, তুমি কাল সারারাত কই ছিলা?’
আমি চুপ করে রইলাম। কী বলব ভাবছি, এমন সময় শাজু বু’ই বলে দিলেন, ‘ছাওরার জামাইয়ের কাছে নাকি ছিল।’
‘তাই নাকি? আফলাতুন মাঝির বাসায় ছিলা। ওর বাসা চিনলা কেমনে?’
শাজু বু’ আফলাতুন মাঝির কথা বলেছে, সুতরাং কথাবার্তা ওই লাইনেই চালানো উচিত। আমি হাসলাম গোলাম মাওলার দিকে চেয়ে। বললাম, ‘দেখা হয়ে গেল জেটিঘাট।’
‘দেখা হয়ে গেল, না? মিয়া, কাইলকা কাপ্তাই আইসা আইজকা সেয়ানা হইয়া গেছ। আরে আফলাতুন মাঝি সন্দ্বীপ গেছে গত পরশু। মিছা কথা বলতাছ কেন, অ্যাঁ?’
এইবার সত্যি কথা বললাম, ‘দুলাভাই, মিছা কথার জন্যে নয়, ঝামেলা এড়ানোর জন্যে। কাল জেটিঘাটে আমাদের গ্রামের একটা ছেলেকে পেলাম। আমার প্রাইমারি স্কুলের ক্লাসমেট। বেচারা এখন লেখাপড়া করে না। কাপ্তাই নৌকো বায়। ও ছাড়ল না ওদের সাথে নৌকোয় রেখে দিল, তাই আসতে পারিনি।’
সত্যি কথা বলার পর গোলাম মাওলার কালো মুখ আরো কালো হয়ে গেল। নিজের মনে গজর গজর করতে লাগলেন। একটু পরে নামাজ পড়ানোর জন্যে বেরিয়ে গেলেন।
শাজু বু’ এসে বললেন, ‘কন ছেলে রে দুলু?
গোলাম মাওলার কথায় খুব মন খারাপ হয়ে গেল। এই লোকটার আশায় আমার কাপ্তাই আসা। নইলে এই পাহাড়–পর্বতের জায়গায় কে আসে? এমনকী হয়তো আসাও হতো না। ফেল করার সব অনিবার্য প্রতিক্রিয়ার কথা আগাম জেনেও বাড়িতেই থেকে যেতাম। আমার তো বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়ার মূল ভরসা ছিলেন গোলাম মাওলা। উনিই তো আমাকে আশ্বাস দিয়ে বলেছিলেন এএসসি পাস করে তার কাছে চলে আসার জন্যে। আর এখন আসার পর সুর পাল্টে ফেলেছেন। কিন্তু সে জন্যে অভিযোগ করারও কিছু নেই। লোকটা তো আমার আপন মামাতো বোনের জামাই নন। মায়ের জেঠাতো ভাইয়ের মেয়ের জামাই। কতটুকু আর অধিকার?
দুপুরে ভাত খেতে খেতে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললাম। গোলাম মাওলা দিনকয়েক বেড়িয়ে বাড়ি চলে যেতে বলেছেন। কিন্তু আমি জানি বাড়িতে যাওয়া যাবে না। আমি বাড়ি থেকে বেরিয়ে এসেছি কঠোর সংগ্রাম করে মানুষ হওয়ার প্রত্যয় নিয়ে। আমি তা করবই। আমি সবাইকে দেখিয়ে দিতে চাই যে, আমি তা পারব। এমনকী গোলাম মাওলাকেও।
বিকেলে ফের জেটিঘাট গিয়ে হাজির হলাম। কবিতার খাতাটা শাজু বু’র জিম্মায় ছিল। সেটা নিয়ে এসেছি। সিরাজকে নৌকোয় পাওয়া গেল। খেয়ে দেয়ে তাস খেলছিল মমিনদের সাথে। আমাকে দেখে উৎসুক চোখে চাইল। ‘ভাইসাবজি!’
‘আপনার সাথে কথা আছে।’
এখানে বলবেন? নাকি উপরে যাওন লাগব?
‘উপরে চলেন।’
সিরাজ খেলা ফেলে উঠে দাঁড়াল। শার্টটা গায়ে চড়িয়ে নিয়ে বলল, ‘চলেন।’
জেটিঘাটে উঠে এলাম। আজমীর বেকারীতে এখন লোকজন কম। ওখানেই বসলাম। সিরাজ চায়ের অর্ডার দিয়ে বলল, ‘বলেন। আমনেরে খুব চিন্তিত মনে অইতাছে।’
আমি হাসলাম। ‘না, তেমন কিছু না। বাসায় ভালো লাগছিল না। ভাবলাম, জেটিঘাট গিয়ে আপনাদের সাথে আড্ডা মারি। সময় কাটবে।’
সিরাজও হাসল। গামছা কাঁধে মুখে হালকা বসন্তের দাগঅলা একটা লোক ঢুকে আমাদের টেবিলের কাছে এসে দাঁড়াল। সিরাজ সালাম দিল লোকটাকে। লোকটা সালাম নিয়ে বসে পড়ল একটা চেয়ারে। আমার দিকে একপলক তাকিয়ে সিরাজকে বলল, ‘এই মিয়া কে রে সিরাজ?’
‘আমগো গেরামের। আমরা এক সাথে ছোডবেলা এক কেলাসে পইড়ছিলাম।’
‘তো কাপ্তাই কোন উদ্দেশ্যে? নৌকোর চাকরি করবে নাকি?’
শুনতে কেমন লেগে উঠল কথাটা। আমাকে দেখে কি নৌকোয় কাজ করা ছেলে বলে মনে হয়?
‘আরে না।’ সিরাজ হেসে উঠল। ‘কী বলেন, মোল্লাভাই? অতদূর লেখাপড়া করে কেউ নৌকায় চাকরি করে নাকি?’
মোল্লাভাই চা খেয়ে চলে গেল। আমি উসখুস করছি, সিরাজকে কীভাবে কথাটা বলা যায়। বুঝতে পারছি, শুনলে সে রীতিমতো লাফিয়ে উঠবে অবিশ্বাসে। মোল্লাভাইয়ের কথায় ওর প্রতিক্রিয়া দেখে সেরকমই তো মনে হলো। কিন্তু আমি তো অন্য আর কোনো পথ দেখছি না।
চায়ের কাপে চামচ ঠুকে রূপবানের গানের সুর তুলছে সিরাজ। বাড়ির অ না দক্ষিণ ধারে গো….অ দাইমা কিসের বাদ্য বাজে গো…অ মোর দাইমা দাইমা গো…
আমি কান পেতে শুনছি। শুনছি না, আসলে ওকে দেখছি। আমি শিক্ষিত, ওর চেয়ে অনেক বেশি জানি, কিন্তু এখন কেন যেন মনে হচ্ছে, ও আমার চেয়ে অনেক চৌকস। কেমন চায়ের দোকানে বসে রূপবানের গান গাইছে। কাল বলেছিল, নিজের কামাই নিজে খাই, কারো ধার ধারি না। আচ্ছা, এত আত্মবিশ্বাস ও পাচ্ছে কোথা থেকে? না, ছেলেটার প্রতি শ্রদ্ধা এসে যাচ্ছে। আচ্ছা, আমিও কি ওর মতো এমন আত্মবিশ্বাসী আর চৌকস হতে পারব?
মনে হলো, আরো বেশি পারব। সিরাজ মূর্খ আর আমি শিক্ষিত। শিক্ষিত মানুষ সব রকম অবস্থায় মানিয়ে চলতে পারে। আমি যদি এখন নৌকোয় চাকরি নিই, তাহলে প্রথম প্রথম একটু খারাপ লাগবে হয়তো। কিন্তু একসময় সিরাজদের মতোই অভ্যস্ত হয়ে যাব। তার চেয়ে বড় কথা হলো, আমাকে সারা জীবন নৌকোর চাকরি করতে হবে না। লেখাপড়া জানি, একটা না একটা ব্যবস্থা করেই ফেলতে পারব।
‘সিরাজ ভাই,’ ডাকলাম ওকে।
রূপবানের গান থামাল সিরাজ। ‘বলেন। চা খাইবেন আরেক কাপ?’
‘না, চা খাব না। একটা কথা বলি?’
‘বলেন।’
‘আচ্ছা, ইয়ে শোনেন। আমি পরীক্ষায় খারাপ করে এসেছি। এক সাবজেক্টে বোধ হয় ফেল করব। মেট্রিক পরীক্ষায় এক সাবজেক্ট খারাপ করলেই ফেল। ’
চুপ করে রইল সিরাজ।
‘শোনেন, যদি শুনি পরীক্ষায় পাস করেছি, তাহলে বাড়িতে যাব। আর যদি ফেল করি, তাহলে বাড়িতে যাওয়া হবে না।
‘তাহলে কী করবেন?’ হেসে উঠল সিরাজ। ‘আমগো মতন নৌকাত চাকরি করবেন নি?’
‘হ্যাঁ, আমি তাই সিদ্ধান্ত নিয়েছি।’
‘কী?’
‘হ্যাঁ।’
এক মুহূর্ত গম্ভীর হয়ে রইল ও। তারপর বলল, ‘আপনি পারবেন না।’
গম্ভীর স্বরে বললাম, ‘পারব। মানুষ যা করেছে, মানুষ তা পারবে।’
সিরাজ হাঁ করে তাকিয়ে রইল। কথাটা সে বোঝেনি। বোঝার কথাও নয়। বলল, ‘আপনারা লেখাপড়া করেছেন। এতদূর লেখাপড়া করে নৌকায় চাকরি করবেন। কেমনে হয়?’
‘হবে। শোনেন, আমি একটা সমস্যায় পড়ে এ সিদ্ধান্ত নিয়েছি। কারণ, এখন আমার যে বিদ্যা, এতে বড় কোনো অফিসার টফিসারের চাকরি পাব না। তাছাড়া ছোটখাট চাকরিও পাব না। কারণ, আজকাল মামা–কাকা ছাড়া চাকরি হয় না। সুতরাং আপাতত হলেও আমাকে কিছু একটা করতে হবে। আর কোনো কাজই তো খাটো নয়।’
সিরাজ চুপ করে রইল। আমি থামলাম না। বলে চললাম, ‘আমি আরো লেখাপড়া করব। বিএ এমএ পাস করব। মানুষের মতো মানুষ হব। তবে সে জন্যে আমাকে কঠোর সংগ্রাম করতে হবে। আমি সে জন্যে তৈরি। আমি জানি, মানুষ যা করেছে, মানুষ তা পারবে।’
* * *
মাসিক নব্বই টাকা বেতনে আবুল মাঝির কিস্তি নৌকোয় চাকরি নিয়েছি আমি। আবুল মাঝি চাকরি করতে চাই শুনে উজ্জ্বল মুখে তাকিয়েছে আমার দিকে। বলেছে, ‘এই তো চাই। এই না হলে মরদ। শোনেন ভাইসাব, ছোডবেলা লেখাপড়া করি নাই। মা–বাপে চেষ্টা করছে, কপালে নাই। কিন্তু আমি লেখাপড়ার মর্ম বুঝি। আমনে চেষ্টা করতে চান শুনে খুব খুশি হইলাম। দুঃখ–কষ্ট সব মরদপোয়ার লাই। আমনে মরদপোয়া। একদিন মানুষের মতো মানুষ হইয়েরে বাড়িত যাইবান।’ তারপর সে তার এক অভিজ্ঞতার কথা শুনিয়েছে আমাদের সবাইকে। কী করে এক গরিবের ছেলে কষ্ট করে লেখাপড়া করেছে, মেসবাড়িতে ভাত রান্না করেছে, তারপর একদিন এক বড় চাকরি পেয়ে অফিসার হয়েছে। আবুল মাঝি বলেছে, ‘আপনি থাকেন। আমি আমনেরে নৌকাত রাইখতাম ন’। এখানে বড় বড় সওদাগর পার্টির কাঠের হিসেব রাখার জন্যে লেখাপড়া জানা ছেলে লাগে। আমনেরে একজনের সথে লাগাই দিমু। ওয়াদা দিলাম।’
লোকটার সৌজন্যে মুগ্ধ হয়ে গেলাম আবারও।
* * *
আমি বললাম, ‘মিলা মানে কী?’
সিরাজ দাঁড়টানা বন্ধ করে নৌকোর ভেতর থেকে বাঁশের লগি টেনে নিতে নিতে বলল, ‘মিলা মানি…ইয়া, ফয়জা ভাই, মিলা মানি কী বুঝাই দে তো তালতোরে…’
ফয়েজ আমার দিকে চেয়ে মৃদু হাসল। সেও তার দাঁড় শানে আটকাতে আটকাতে বলল, ‘মিলা মানি কমু। তয় আগে আমনের দাঁড় শানে আটকান।’
আমি তাদের দেখাদেখি দাঁড় আটকালাম। তারপর গলুই থেকে সরে এসে সিরাজকে লগি ধরার জন্যে জায়গা ছেড়ে দিলাম।
সিরাজ আর ফয়েজ পরস্পর হাসাহাসি করছে। ফয়েজ বলছে, ‘আ মিলাউয়া দৌল অবনে নে?’
সিরাজ লগির গোড়া পানিতে ডুবিয়ে নৌকোর গতি কমিয়ে আনার চেষ্টা করতে করতে বলল, ‘হি দৌল ন অদৌ? চাঙমা মিলানি দৌল ন’ অলে আ কন দৌল অবৌ?’
আমি তাদের কথা বুঝতে পারছি না। কিন্তু ভাবে–গতিকে বুঝছি, ওদের অবস্থা রসে টৈ টুম্বুর। আর ওদের কথাগুলো শুনতেও ভারী মজার। ‘চাঙমা’ শব্দটাই শুধু বুঝতে পারছিÑএবং তাতে মনে হচ্ছে তারা বুঝি চাকমা ভাষাতেই কথা বলছে। আমি আবার জিজ্ঞেস করলাম, ‘ফয়েজ ভাই, মিলা মানে কী বললেন না?’
ফয়েজ বলল, ‘মিলা মানি? তয় হুনেন। মিলা মানি মাইয়া, মাইয়া লোক , বুইজছেন?’
নৌকো টিলার কাছে এসে গেছে। হাল থেকে মমিন চেঁচিয়ে উঠল, ‘লগি ধর, লগি ধর….’
সিরাজ টিলার গায়ে লগি ঠেসে ধরে চাপ দিল। ‘মানি মাল। বুইজছেন, তালতো? মিলা মানি…হি হি হি…’
নৌকো গতি স্থির হয়ে গেল লগির প্রতিবন্ধকতায়। ফয়েজ রশিহাতে লাফ দিয়ে টিলায় নামল। একটা গাছের গোড়ার সাথে বাঁধল রশিটা।
মমিন হাল থেকে নেমে এসে ছৈয়ের ভেতর ঢুকল। সিরাজ আর ফয়েজকে ডাকল সেখান থেকে। একটু পর আবার বলল, ‘তালতো, আমনেও আসেন।’
কী এক বিচিত্র কারণে এরা আমাকে তালতো ডাকতে শুরু করেছে। সবচেয়ে অবাক করার বিষয় হলো, আমি যে মুহূর্তে নৌকোয় চাকরি নিয়েছি, তখন থেকেই সিরাজের ব্যবহার পাল্টে গেছে। কেন যেন মনে হচ্ছে আগের মতো দাম দিচ্ছে না আর। কথাবার্তায় সে সমীহ ভাব আর নেই। আমি যে এসএসসি পরীক্ষা দেয়া একটা শিক্ষিত ছেলে, ওদের চেয়ে অনেক কিছু বেশি জানি, এটা যেন ভুলেই গেছে। কেমন অবলীলায় হুকুম দিচ্ছে, তালতো এটা করেন, সেটা ধরেন। কিন্তু আমি ওদের কাছ থেকে শিক্ষিত হিসেবে একটু সমীহ আশা করছি।
সিরাজ আর ফয়েজের পিছু পিছু ছৈয়ের ভেতর গিয়ে ঢুকলাম আমিও। মমিন সিরাজকে বলল, ‘তালতোরে বুঝাই ক’।’
সিরাজ আমার দিকে চেয়ে চোখ মটকাল। তারপর মুচকি হেসে বলল, ‘তালতো, যাইবান?’
আমি বললাম, ‘কোথায়?’
ও বলল, ‘কোথায় আবার? আমরা যেইখানে যাই হেইখানে!’
ব্যাপারটা এতক্ষণেও না বোঝার মতো অবুঝ তো আর আমি নই। ওর চোখ মটকানি দেখে আমার ভেতরেও ততক্ষণে রোমাঞ্চের সাড়া জেগেছে। গোপনীয় কিংবা নিষিদ্ধ কোনো আনন্দ আস্বাদনের যে একটা সহজাত প্রবণতা মানুষের মনের চেতনে অবচেতনে নিত্য সঞ্চরমান, সে প্রবণতায় আমিও প্রবৃত্ত হতে উন্মুুখ হলাম। মনে হলো, এটা খুবই স্বাভাবিক এবং আমার বয়সে এটা হবে সর্বপ্রথম সচেতন অভিজ্ঞতা। নতুন তো বটেই। তাছাড়া সব নিষেধের বেড়াজাল ডিঙিয়ে আমার নিজের সিদ্ধান্তেই আমি কাপ্তাই এসেছি। নৌকোর চাকরি নিয়েছি, সেটা যতটা না উপায়ান্তরহীনতায়, তারচে’ বেশি রোমান্টিকতায়। জানতে হবে জীবনকে, বুঝতে হবে মানুষকে। উপলব্ধি করতে হবে বেঁচে থাকার নিগুঢ় রহস্যকে। আর তার জন্যে সবচেয়ে ভালো উপায় হচ্ছে সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রার সাথে নিজেকে মিলিয়ে দেয়া আর…ওরা যা করতে যাচ্ছে, এসব কিছুর মানেই তো নিজেকে জীবনের বিশাল প্রান্তরে ছড়িয়ে দেয়া। জীবনের সূক্ষাতিসূক্ষ্ম গ্রন্থির গিঁঠ খোলা। আর এটাতো তারই একটা অংশ। সবচেয়ে উদ্দীপক, উত্তেজক এবং সর্বোপরি সবচেয়ে বেশি রহস্যাবৃত অধ্যায় আবিষ্কারে নিজেকে সচকিত করা। আমার মনে হলো, সতেরো বছর বয়সে আমি নিশ্চয় সব ব্যাপারে নাক গলানোর মতো যোগ্যতা অর্জন করেছি, যার প্রমাণ এরাই। যোগ্য না হলে এরা নিশ্চয় আমাকে জিজ্ঞেস করত না–বরং লুকোত। সুতরাং তাদের সমকক্ষতা অর্জনের জন্যে আমাকেও যেতে হবে বৈ কী?
তবে এত তাত্ত্বিকতা ছাড়াও প্রথম প্রভাতের প্রথম পাখির গানের মতো, প্রথম সূর্যের সোনালি ছটার মতো আমার অন্তঃস্থল থেকে এক অন্ধ আবেগ ইচ্ছের মোড়কে তীব্র থেকে তীব্রতর গতিতে উৎক্ষিপ্ত হতে লাগল। পঞ্চমুখে সাড়া দিতে চাইল আমার মন, ‘যাবো যাবো, আমিও যাবো……’
কিন্তু কোত্থেকে যে এমন লজ্জা এসে জাবড়ে ধরল আমাকে! আমার কান গরম হয়ে উঠল। চোখ নামিয়ে মৃদু কণ্ঠে বললাম, ‘না, যাবো না….’
মমিন ক্ষুব্ধ হলো ভীষণ। ‘যাইবেন না! তাইলে কিস্তি ধইরলাম কিয়েরলাই?’
সিরাজ হতাশ হয়ে বলল, ‘যাইবেন না কেন? আমরা সবাই তো যামু।’
এদের মধ্যে ফয়েজ একটু কম কথা বলে। সে এবার মাথা নেড়ে বলল, ‘না তালতো। এসব কাজে খালি একজনের ইচ্ছা হইলে হয় না। সবার আগ্রহ থাকন লাগে। তাছাড়া আমরা সবাই এক বয়সী। থাকি পরবাসে, বিদেশের বাড়িতে। বিদেশের বাড়িত থাইকতে অইলে মনে ফুর্তি রাখন লাগে। কী, খারাপ কইলামনি?’
খারাপ কোথায়? আমিও তো মনে মনে যেতে রাজি। আমার অন্তরাত্মা শিউরে উঠছে অজানা পুলক হাওয়ায়, রক্তের ভেতর কল্লোলিত হচ্ছে রহস্যের অতলান্ত; কোনো নীতির পীড়ন নেই, সংস্কারের শাসন নেই, বোধের দংশন নেই, উপরন্তু অনুভূতির অতলে অনাস্বাদিতের তীব্র আস্বাদনাকাঙ্ক্ষা—সে তো মিথ্যে নয়। আর সে সত্যের অনুকূলে প্রবাহিত হচ্ছে পৌরুষের ঊষালগ্নে উদঘাটনোন্মুখ আনন্দের থরো থরো পুবালি; সুতরাং এ অবস্থায় অরাজি, এমনকী নিমরাজি হবারও বা অবকাশ কোথায়? কিন্তু তবু কেন মুখ ফুটে ‘হ্যাঁ’ বলার সাহস হচ্ছে না আমার!
আমার চোখের সামনে বসে আমার দিকে চেয়ে আছে সেবক, পারভেজ, পান্না—আমার বন্ধুত্বের ভূবনে উজ্জ্বল ত্রিরত্ন, আমাকে কী যেন জিজ্ঞেস করছে রোকেয়া, হেনা, স্বপ্না, সুফিয়া—আমার অমল মুগ্ধতার গোলাপ–জবা–হাসনুহেনা; আর অবাক আমার প্রিয় শিক্ষকেরা। আমি এক অদৃশ্য জালে জড়িয়ে গেছি।
আমি মাথা নাড়লাম। ‘না, যাবো না।’
সিরাজ রেগে গেল। ‘যাইবেন না ক্যান?’
আমি ম্লান কণ্ঠে বললাম, ‘ভাল্লাগে না আমার।’
মমিন হেসে উঠল কল কল করে। ‘ভালা লাগে না? আরে মিয়া, চলেন চলেন। ভালা লাগনের লাইগাই তো কিস্তি ধরছি এই জাগায়। কই চলেন?’
আমি ফয়েজের দিকে চাইলাম। সে চেয়ে আছে আমার দিকে। ভাবলেশহীন চোখে। আমি বুঝতে পারছি না কী করব। অস্বীকারের প্রবলতা তো আমার মধ্যে নেই, আমার মনের খবর আমার চেয়ে বেশি আর কে জানে?
চোখের সামনে নাচছে একটা প্রজাপতি, একটা ফুল চেয়ে আছে যেন তাকে ছোঁয়ার অপেক্ষায়। সে ফুল হাসতে জানে, দুলতে জানে, রহস্যের ভেতর আরো রহস্য লুকিয়ে রাখতে জানে গহীনের গহীনে। সে তো আমাকে ডাকছে; আমি তো অজীব নই যে, তার ডাক শুনব না। আমিও তো সাড়া দিতে চাই। কিন্তু পারছি না কেন?
ফয়েজ বলল, ‘তালতো চলেন।’
আমি মাথা নাড়লাম। ‘না, আপনারা যান। আমি কিস্তিতে বসি।’
ফয়েজ হেসে বরল, ‘তা কী করে হয়? এক যাত্রায় দুই ফল কেমনে হবে? দোজখে যাই আর বেহেস্তে যাই, চারজন এক লগে। জানেন না, একের বোঝা, দশের লাডি? না কী বলেন?’
আমি চুপ করে রইলাম। ভেতরে ভেতরে দ্বিধা কাটিয়ে উঠতে চাচ্ছি।
মমিন মলিন স্বরে বলল, ‘সিরাজ, তাইলে কিস্তি এরি দে। তালতো আমাদের নিরাশ করল আরি! এরকম অইলে হের লগে আমাদের মিল–মিশ হইব না। এক সাথে চলতে গেলে….’ কথা শেষ করল না সে। মুখ গোমড়া করে বসে রইল।
আমার দ্বিধার বাঁধ ভাঙল। আসলে এরকম একটা অজুহাতের অপেক্ষায় ছিলাম যেন। এখন মনকে চোখ ঠারার মোক্ষম পথ পেয়ে গেলাম। ওদের সাথে এক সাথে চলতে হবে আমাকে।
এক সঙ্গে চলতে হবে জীবনের সাথে, জগতের পথে, তাল মেলাতে হবে মানুষের সাথে। ভেঙে ফেলো পুরাতনের জীর্ণ দেয়াল, সংস্কারের বেড়া। কী ছিলাম সেটা বড় কথা নয়, কী হবো সেটাও পরের ব্যাপার। আসলে কেমন আছি সেটাই দেখার বিষয়। বর্তমানের আয়না হতে চেহারা লুকিয়ে চললে আয়নার ক্ষতিবৃদ্ধি কিছু নেই, বরঞ্চ নিজেরই অলাভ। একদিন হয়তো দেখা যাবে নিজের চেহারাই ভুলে গেছি।
আমি বললাম, ‘ঠিক আছে। চলেন।’
মমিনের মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল। সিরাজ টিটকারি মেরে বলল, ‘মিয়া, যাইবেন তো এত তাল গরেন ক্যা? শুধু শুধু সময় নষ্ট।’
আমরা চারজন নৌকোর গলুইয়ে গিয়ে দাঁড়ালাম। ওদের কথা জানি না, তবে আমার কল্পনায় তখন উলঙ্গ নারী, রক্তে প্রথম বাঁধভাঙার তীব্র টান, মর্মের গভীরে নীরব গর্জন; তবু দু’পা কেমন আড়ষ্ট, গলা শুকিয়ে কাঠ। বারবার ঢোক গিলছি, ঠোঁট ভেজাচ্ছি জিভে চেটে; আর আমার নিঃশ্বাস–প্রশ্বাসের গমণ–নির্গমণের প্রক্রিয়া সশব্দ, সঘন এবং…উষ্ণ।
মগ কিংবা চাকমা বুড়োটা এতক্ষণ তার ঘরের উঠোনে বসে সম্ভবত আমাদের লক্ষ করছিল। আমার নৌকোর গলুই থেকে টিলায় নামলাম। দেখে সে বসা থেকে উঠে এগিয়ে এল।ওপর থেকে একটু ঝুঁকে টিলা বেয়ে উঠতে থাকা আমাদের দিকে তাকিয়ে হাঁক দিল, ‘ঐ খুড়া, হেই বাঁআল, আ হিত্তি এজত্তে? (এই চাচা, এই বাঙাল, কেন আসছিস তোরা?)’
আমি ভয় পাচ্ছি। বুড়োর কথা বুঝতে পারছি না। তবে মনে হচ্ছে গালাগাল দিচ্ছে। ফয়েজকে ফিস ফিস করে বললাম, ‘কী বলছে বুড়ো?’
ফয়েজ আমার চেয়ে নিচু গলায় ফিস ফিস করে বলল, ‘চুপ চুপ! কতা কইয়েন না।’
সিরাজ একটু উঁচু গলায় বলল, ‘আ হিত্তি এজঙর খুড়া। ম’ তাগলান দাঁত্তান ভাঙ্গি যেয়ন বুলি সক্কে উক্কা বানা পড়েত্তে আয়ি। তমা তাগলান দেবা? (আর কী জন্যে আসব, চাচা? আমার দাওয়ের ডাঁটটা ভেঙে গেছে। একটা নতুন ডাঁট লাগাতে হবে। তোমার দাওটা দেবে?)’
সিরাজের কথা শুনে মমিন হাসতে হাসতে টিলা থেকেই গড়িয়ে পড়ে আর কী? সেও ফিস ফিস করে বলল, ‘শালা সিরাইজ্যা! কিস্তা এককান বানাইছছ যা অক। দুই দুই খানা দা আছে নৌকোয় নতুন ডাঁট লাগানো। আর কছ কিনা দায়ের ডাঁট ভাঙি গেছে…..হি হি হি…..’
সিরাজ ধমকে উঠল, ‘চুপ ব্যাডা!’
বুড়ো ওপর থেকে বলল, ‘আ নেবে আয়ি.. (ঠিক আছে, নিবি আর কী?)’
আমরা বুড়োর উঠোনে গিয়ে উঠলাম। বুড়ো ডাবা হুঁকো ধরিয়ে আনল। টানতে টানতে চারজনের মুখের দিকে তিন–চারবার করে চোখ বুলিয়ে চেয়ে নিল। এরপর মুখ থেকে হুঁকো নামিয়ে একগাল ধোঁয়া ছেড়ে কাশতে কাশতে বলল, ‘মাছিবা কন? (মাঝি কে?)’
মাঝি মমিন। নিজেকে দেখিয়ে বলল, ‘আমি।’
বুড়ো তার হাতে হুঁকোটা ধরিয়ে দিয়ে বলল, ‘নে, ধুন্দা খা, খুড়া।’
মমিন বিড়ি–সিগ্রেট খায় না। তবু বুড়োর সম্মানে ওটা হাতে নিয়ে দু’চারটা টান দিয়ে সমানে কাশতে লাগল।
লম্বা একটা গাছের গুঁড়ি পড়েছিল উঠোনে। বুড়ো সেটা দেখিয়ে দিয়ে বল, ‘বছ, মাছি।’ তারপর আমাদেরও বলল, ‘আ তরাঅ’ বছ না খুড়া। বছ বছ।’
আমরা বসলাম। বাচ্চা একটা ছেলে আমাদের কাছে এসে দাঁড়াল। আমি তার দিকে তাকালাম। কুঁতকুঁতে চোখে রাজ্যের সারল্য। হলদে রঙের গায়ে সাদা ধুলোর আস্তর। ডিমের মতো ফোলা দু’গালে সদ্য ফোটা মুরগীর বাচ্চার মতো তুলতুলে ভাব। আমি হেসে বললাম, ‘তোমার নাম কি, খোকা?’
ছেলেটা কিছু বলল না। আমি আবার তার নাম জানতে চাইলাম। কিন্তু এবারও কথা বলল না সে। সুতরাং আলাপ জমল না। কিন্তু ওকে যে আদর করতে ইচ্ছে করছে আমার! কী করি?
শেষমেষ চুপ মেরে গেলাম।
এদিকে বুড়ো মমিনের সাথে এক নাগাড়ে কথা বলে যাচ্ছে চাকমা–বাংলায় মিশিয়ে। মমিন মাথা নাড়ছে সমঝদারের ভঙ্গিতে। মাঝে মাঝে খুব উৎসাহের সাথে হুঁ– টুঁও দিচ্ছে।
একটু পরেই একটা মেয়ে বেরিয়ে এল ঘরের পাশের জঙ্গল থেকে। মেয়েটার হাতে কয়েকটা শুকনো গাছের ডাল আর পেছনে একটা শুয়োরের বাচ্চা। ঘোঁৎ ঘোঁৎ করছে অনবরত। আমাদের দেখে এগিয়ে এল ওটা। নিরাপদ দূরত্বে দাঁড়িয়ে নাক ফুলিয়ে সমানে ঘোঁৎ ঘোঁৎ চালিয়ে যেতে লাগল। যেন আমাদের পছন্দ হচ্ছে না, তাই অসন্তোষ জানাচ্ছে সরাসরি।
মেয়েটা হাতের লাকড়ি রেখে ঘরের বেড়ার সাথে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আমাদের দেখতে লাগল। আমি খেয়াল করলাম, সিরাজ তার দিকে তাকিয়ে চোখ টিপল। মেয়েটা তা দেখে নড়ে চড়ে দাঁড়িয়ে বিড় বিড় করে কী যেন বলল।
এদিকে বুড়ো মমিনকে বলছে, ‘আ খুড়া, হেই ন’ পাং। উয়াস্যা রয়ন। তমা হাছে চল নেই দুগা? মরে এমমুট চল দেবা? (আহা চাচা, খেতে পাচ্ছি না। উপোস করছি। তোমার কাছে চাল নেই? আমাকে দু’মুঠো দেবে?)’
আমি মেয়েটির দিকে তাকালাম। চোদ্দ–পনের হবে বয়স। ভরা স্বাস্থ্য। সুন্দর। তার স্বাস্থ্যকে ঢাকতে পারেনি পরনের ‘থামি’ কাপড়। দু’চোখে অবাক দৃষ্টি। সারল্য যেন উপচে পড়ছে। কিন্তু আমার চেখে তার নগ্ন অবয়ব। শিরায় শিরায় অগ্নিস্রোত। অপেক্ষা করছি কখন….তাকে…. কখন….!
পরিচ্ছেদ ৬ অনেক রাতে ফিরেছিল কল্যাণ ওরফে শহীদুল।গাড়িটা শেডে রাখার পর দু’বার হালকা করে মা…..
পরিচ্ছেদ ৫ আকাশে এখন আর মেঘ নেই। হাওয়া হচ্ছে।কদিন পরেই বর্ষা নামবে।একদিন হাসপাতাল থেকে ফিরতে…..
পরিচ্ছেদ ৪ ভোর হয়ে আসছে।রাতে ভালো ঘুম হয়নি।ঘুমের ঘোরে মনে হচ্ছিল দম বন্ধ হয়ে আসছে।এরকম…..
পরিচ্ছেদ ৩ শীত শেষ হয়ে আসছে।রাঙ্গালীবাজনা ঢোকার মুখের রাস্তাগুলো পলাশ ফুলে ভরে গেছে।অথচ ঠান্ডাই।…..