জলে জঙ্গলে (পর্ব- ৯)

মাসুদ আনোয়ার
উপন্যাস, ধারাবাহিক
Bengali
জলে জঙ্গলে (পর্ব- ৯)

খেয়ে দেয়ে দুই কিস্তি নৌকোর মাঝি-মাল্লায় মিলে দারুণ গল্প গুজব শুরু হয়ে গেল। এরা দেখছি সবাইকে সবাই চেনে। একে অন্যকে ভাই-কাকু বলে ডাকছে। অচেনার মধ্যে কেবল আমি। কেউ কেউ কৌতূহলী চোখে এক নজর দেখে নিচ্ছে। কৌতূহলের সাথে কিছুটা বিস্ময়ও যেন। কী ভাবছে কে জানে?

অবশ্য একটা জিনিস বুঝতে পারছি যে, এখানে নৌকোর নাইয়া-মাঝিদের মধ্যে আমি একটু ভিন্নতর। আমার বসার ভঙ্গি, চোখের চাউনি এবং মাঝে মাঝে আনমনা হয়ে যাওয়া ভাব তারা ঠিক বুঝে উঠতে পারছে না। শেষে বেঁটে লোকটাই খবর নিল আমার। বলল, ‘এই মিয়া কতা কর না ক্যা? নতুন নি, মমিন ভাই? কী চিন্দা গরের? কী ভাই, বাড়ির কতা মনে হড়ছে, না?’

বাড়ির কথা অবশ্যই মনে পড়ছে। কিন্তু সেটা কি বলা যায়? একটু হেসে বললাম, ‘না, আমি শুনছি। মজা লাগছে আপনাদের কথা।’

‘অ। তই হোয়ালেকা কইরছেননি? মনে তো অয় ইস্কুইল্যা হোলা। বাইত্তুন হলাই আইছেন।’

এবার ভালো লাগল না। এত বেশি ব্যক্তিগত খোঁজখবর নিতে চাইছে কেন লোকটা? কিন্তু ঘাপলাটা বাধিয়ে দিল মেট মাঝি মমিনই। কালো মুখের ভেতর ফকফকে শাদা দাঁতের সব কটি মেলে বলে উঠল, ‘হ্যাঁ বাইছা, হোয়ালেকা জানুইয়া মানুষ তেঁই। বাইত্তুন হলাই আইছে। অ্যাঙ্কা আঙ্গ কিস্তিত্তে চাকরি নিছে।’

‘কিয়া? হাঁছানি? কদ্দূর হইচ্ছেন অ’ অ ভাই?’

‘মেট্টিক হাস।’ জবাবটা সিরাজই দিল।

প্রচ- বিরক্ত হলাম। এদের এমন আগ বাড়িয়ে কথা বলার দরকার কী? আমার পড়ালেখা করার খবর তাদের বলেছি, তারা জানে। এটা ঠিক আছে। তাই বলে কি জনে জনে বলে বেড়াতে হবে নাকি যে, আমি শিক্ষিত, আমি মেট্রিক পাস? মেট্রিক পাস ছেলে নৌকোয় চাকরি করে, এটা নিশ্চয় ঢোল পিটে বলে বেড়াবার মতো খবর নয়। আমি তাই সাথে সাথে প্রতিবাদ করলাম, ‘আরে না না। আমি এই ক্লাস সিকস সেভেন পর্যন্ত পড়েছি মাত্র।’

বেঁটে লোকটা আমার দিকে চেয়ে রইল কিছুক্ষণ। তারপর একটু হেসে বলল, ‘আন্ডা হোয়ালেকা করি ন’। তয় হোয়ালেকা করইন্যা মানুষ দেখলে চিন্তাম হারি, ভাই। আন্নে শিক্ষিত মানুষ, হিয়ান তো আর মিছা অইত ন’।’

কী জবাব দেব আর? অগত্যা চুপ করে গেলাম। কিন্তু বেঁটে মাঝি হৈ চৈ বাধিয়ে দিল। ‘অরে শমসিয়ারে? শমসিয়া ? এই গাজী-কালুর হুতিগা ল’ত’। আঙ্গ এই মিয়া হোয়ালেকা জানে বলে, মেট্টিক হাস বলে। চাই, আইজ্জা হে মিয়ার মুখে হুঁতি হুনমু। হুঁতি হইড়তান জানেননি অ ভাই?’

খুব সুরেলা গলায় পুঁথি পড়তে পারি আমি। পয়ার-ত্রিপদী সব রকম ছন্দ মিলিয়ে। পুঁথি পড়তে ভালোও বাসি। নানার বাড়িতে মামাদের অনেক পুঁথি ছিল। সোনাভান, ছয়ফল মুল্লুক বদিউজ্জামাল, শ্যামারোখ জেবল মুল্লুক, আমির হামজা আর জঙ্গে কারবালাসহ আরো অনেক নামের পুঁথি। ছোটবেলায় মেঝমামার ভুল উচ্চারণে পড়া পুঁথি শুনতে শুনতে একবার ভুল ধরিয়ে দিতে গিয়ে প্রচ- ধমক খেয়েছিলাম। আমারই মতো তোতলা মেঝমামা প্রচ- রাগে কাঁপতে কাঁপতে বলেছিলেন, ‘ব্-ব্যাডা, থি-থিরিত না হোরে হরছ, ম্-মাস্টর অই গিয়ছ, না?’

এই মামাটা ছিল ভীষণ রাগী। ওর রাগ দেখলে বাড়ির কুকুরটা পর্যন্ত লেজ নামিয়ে দিয়ে পালাত। সুতরাং এক ধমকেই আওয়াজ বন।
‘শমসিয়া’ পুঁথি নিয়ে এল একটু পর। আপত্তি করলাম না। ছইয়ের ভেতর পুঁথি নিয়ে বসলাম। গলা খাঁকার দিয়ে পরিষ্কার করে নিলাম। তারপর শুরু করলাম :

আরে…
বৈরাটনগরে ঘর শাহা সেকান্দর
অজুপা তাহার পত্নী অতি মনোহর।
হইল সন্তান এক অজুপার ঘরে
চাঁদের সমান রূপ ঝলমল করে।
রূপেতে হইল আলো সমস্ত ভুবন
রাখিল তাহার নাম জুলহাস সুজন।
দিনে দিনে সেই পুত্র বাড়িতে লাগিল
দ্বাদশ অব্দের যবে বয়েস হইল।
একদিন চলিলেন করিতে শিকার
লইয়া অনেক লোক সাথে আপনার।
হইলেন উপস্থিত এক কাননেতে
কাননের মধ্যে মৃগ খুঁজে সকলেতে।
হঠাৎ হরিণ এক উঠে দৌড় দিল
ভূপের নন্দন তার পশ্চাতে চলিল।
মায়ার হরিণ সেই কি করে তখন
একটি সুড়ঙ্গ দিয়া করিল গমন।
দেখিয়া নৃপের সুত না পারে থাকিতে
সুড়ঙ্গের পরে চলে হরিণ মারিতে।
এখানেতে লোক সবে না দেখে তাহায়
কাননে কাননে তারা খুঁজিয়া বেড়ায়।
অনেক খুঁজিল নাহি পাইল দরশন
আক্ষেপ করিয়া সবে চলিল তখন।
সুড়ঙ্গেতে গিয়া সেথা সেকান্দর সুতে
দেখে হেন অন্ধকার রজনী হইতে।
এদিক ওদিক কিছু দেখিতে না পায়
বিপাকে পড়িয়া যুবা করে হায় হায় ।
পায়ের ঠাহরে তবে চলিতে লাগিল
এগার কোসের পথ চলে যদি গেল।
চক্ষু মেলি দেখে এক সুন্দর শহর
সুবর্ণের অট্টালিকা সুবর্ণের ঘর…..

প্রথমে আহ, উহ, তারপর সাবাস….এরপরই বেঁটে মাঝির উচ্ছ্বসিত প্রশংসা, ‘আহ, এরেই কয় হুঁতি হড়া। চালান ভাই, চালান…’

আত্মবিশ্বাস এবং অহঙ্কার দুটোই এক সাথে অনুভব করছি। মনে হলো, সিরাজ শুনুক, দেখুক। আমি যে ওর মতো মূর্খ নই, এখন বুঝে নিক। জেটিঘাট থেকে নৌকো ছাড়ার পর বহু অসম্মান করেছে আমাকে। এবার নিশ্চয় বুঝতে পারবে, ওর সাথে আমার পার্থক্যটা….

আরে! সেও দেখি বাহবা দিচ্ছে ‘সাবাস তালতো’ বলে!

পুঁথিপড়া এগিয়ে চলে। রাত বাড়ে। আশে পাশের নৌকোগুলোর বাতি নিভে আসে। গাজী আর চম্পাবতীর প্রেমকাহিনি শুনতে শুনতে শ্রোতাদেরও চোখ ঢুলু ঢুলু হতে শুরু করে। একসময় হাই তুলতে শুরু করে মমিন। বলে ওঠে, ‘আজ থাক, বাইছা। বউত রাইত অই গেছে।’

পুঁথি বন্ধ করে ছইয়ের ওপর দাঁড়ালাম। চাঁদ চলে গেছে পাহাড়ের আড়ালে। একটা আলোকিত অন্ধকার চারদিকে। উত্তুরে বাতাস দিচ্ছে। কুয়াশার চাদর মুড়ে ফেলেছে চারদিকের পাহাড়। দক্ষিণ-পশ্চিম আকাশে আলোর আভাস। সম্ভবত কাপ্তাইয়ের বাতি। চমৎকার লাগছে।

বাজারের বাতি নিভে গেছে। ঘাটে বাঁধা নৌকো-সাম্পানের মানুষেরা ঘুমিয়ে পড়েছে। আবছা অন্ধকারে পানির রঙ কালো। ছোট ছোট ঢেউ খেলছে তাতে। দুই নৌকোর ছইয়ের ভেতর নাইয়া-মাঝিদের শোবার তোড়জোড়। বাইরে অন্ধকার পানি আর চারদিকের পাহাড়গুলোর দিকে তাকিয়ে আনমনা হয়ে গেলাম। অবাক হয়ে ভাবলাম, কোথায় ছিলাম, কী ছিলাম? ষোলো-সতেরো বছরের জীবনে কখনো কি ভেবেছি এমন দেশের কথা? এসব মানুষের কথা? সবচেয়ে অবাক করার বিষয় হলো, আজ আমিও এদের একজন। নৌকোর নাইয়া। ক্লাসমেটদের কথা মনে পড়ছে। মনে পড়ছে শিক্ষকদের কথা। হেডমাস্টার মনির মিয়া, বাংলা ও ইংরেজির শিক্ষক ঠাকুর স্যার, ভূগোল যিনি পড়ান সে গাজী আবদুল হাকিম স্যারের কথা। গাজী সাব বিএ বিটি পাস করে স্কুলের শিক্ষক হয়েছেন। যোগ দিয়েছেন কাটগড় হাই স্কুলে। প্রথম দিন ক্লাসে ঢুকেই নিজের পরিচয় দিলেন এভাবে : আমার নাম গাজী আবদুল হাকিম। বাড়ি বরিশাল। কোনো পোরশ্ন?

‘পোরশ্ন’ করব কী, ওনার ‘পোরশ্ন’ শুনেই চুপ হয়ে গেছি সবাই। মাওলার মতো চৌকস ছেলে পর্যন্ত স্রেফ বোবা। ইজ্জত বাঁচাল পিচ্চি ইব্রাহিম। আমাদের প্রায় সবারই কাঁধ পর্যন্ত উঁচু ওর মাথা। সেই কিনা সবার আগে বলে বসল, ‘স্যার, আসসালামুয়ালাইকুম…’

টনক নড়ল আমাদেরও। সাথে সাথে কোরাস, ‘ আসসালামুয়ালাইকুম…’

ষাট-সত্তর জন কিশোরের রিণরিণে গলায় বেজে ওঠা সালামের গমকে স্যার ভড়কে গিয়েছিলেন কিনা কে জানে। তাড়াতাড়ি চেয়ারে বসে পড়ে হাত তুললেন বাধা দেয়ার ভঙ্গিতে। ‘ওয়া আলাইকুমুসসালাম…বসো বসো।’

বসে পড়লাম। স্যার বললেন, ‘আমি তোমাদের ভূগোল পড়াব। ভূগোল মানে জান তো?’

চুপ করে রইলাম। ক্লাস সেভেনে পড়ি, ভূগোল মানে জানি না, স্যার এটা ভাবছেন কী করে?

‘নিশ্চয় সবাই জানো। তবু আরেকবার জেনে নিই। ভূ অর্থ ‘পেরথিবী’, গোল অর্থ গোলাকার। যে পুস্তক পাঠ করিলে ‘পেরথিবী’র জল-‘ইস্থল’, পাহাড়-পর্বত, যোজক-‘পেরণালী’ ইত্যাদি বিষয় সম্বন্ধে বিস্তারিতভাবে জানা যায়, তাহাকে ভূগোল বলে।’

‘পেরথিবী’, ‘ইস্থল’, ‘পেরণালী’…ওরে বাবা! এসব কী উচ্চারণ! সামনে আমরা ভালোছাত্ররা প্রাণপণে হাসি চাপছি আর পেছনে ইবলিসমার্কা সব গাধা ছেলের দল খুক খুক করে কাশতে শুরু করেছে। স্যার অবশ্য পাত্তা দিচ্ছেন না। চোখ দুটো প্রায় বুজে বলে চলেছেন, ‘পেরথিবী’তে নানা জাতের মানুষ রয়েছে। তেমনি রয়েছে নানা ধরনের জীব-জন্তু, গাছপালাসহ নানা ‘পেরকিরিতিক’ বস্তু। ভূগোল পাঠের মাধ্যমে সেসব বিষয়ে আমরা ‘পরচুর’ জ্ঞান লাভ করতে পারি। কোনো ‘পোরশ্ন’?’

নিজস্ব আঞ্চলিক টানে শুদ্ধ বাংলায় কথা বলছেন স্যার। কিন্তু আমাদের অনভ্যস্ত কান তাতে ধাক্কা খাচ্ছে বারবার। কান পেতে স্যারের কথা শুনছি সবাই। তিনি কী বলছেন, সেটা খেয়াল করছি না, কীভাবে বলছেন আমাদের কান-মন দুটোই সেদিকে। নির্ধারিত সময়ের পর ঘণ্টা পড়তেই স্যার উঠলেন চেয়ার থেকে। বেরিয়ে গেলেন। তার পেছনে পেছনে মেয়েরাও। মেয়েরা স্যার চলে গেলে ক্লাসে থাকে না। তাদের নিজেদের কমনরূমে চলে যায়।
স্যার চলে যেতেই আচমকা বিস্ফোরণে ফেটে পড়ে পুরো ক্লাস। শুরু হয়ে যায় পেরথিবী, পোরশ্ন, পেরকিরিতিক আর পেরণালী নিয়ে হৈ চৈ।

চমকে উঠলাম। নিজের অজান্তে বেরিয়ে এসেছে দীর্ঘশ্বাসটা। খুব চমৎকার একটা স্কুলজীবন কাটিয়েছি। আর কখনো ফিরে আসবে না। গাজী স্যারের ওই উচ্চারণ ভঙ্গি নিয়ে স্কুলের শেষ দিনটিতেও মজা করেছি আমরা। স্যারও সম্ভবত উপভোগ করতেন আমাদের এই দুষ্টুমিটা। ক্লাসে অনেক সময় ‘র’ এবং ‘ল’ ফলা-অলা শব্দ উচ্চারণ করতে গিয়ে মুচকি হাসতেন।

‘তালতো,’ মমিনের গলা শুনলাম। ‘হিয়ানে কিয়া করেন। নামি আইয়েন। ঠা-া লাইগব। কাইল্যা বেইন্যা হবরে কিস্তি ছাড়ন লাইগব। আইয়েরে ঘুমাই হড়েন।’

কিছুটা ভারাক্রান্ত মন নিয়ে নেমে এলাম ছইয়ের ওপর থেকে। শুয়ে পড়েছে ওরা তিনজন। শীত থেকে বাঁচার জন্যে আপাদমস্তক কাঁথা মুড়ি দেয়া। এতক্ষণ ছইয়ের ওপর খোলা বাতাসে দাঁড়িয়ে থেকে শীত লাগতে শুরু করেছে আমার। আমার কাঁথা বালিশ নেই। গত রাতে সিরাজের সাথে ছিলাম। এখনো তাই সিরাজের পাশে গিয়ে শোয়ার উপক্রম করলাম। আমার আভাস পেয়ে নড়ে চড়ে শুল সিরাজ। কাঁথাটা আরো ভালো করে জড়াল নাকে-মুখে। কালকের মতো ডাকল না শোয়ার জন্যে।

ছেলেটার ব্যবহারে আমি বিরক্ত। গতকালকের সে বন্ধুসূলভ মনের ভাব নেই আর। এদিকে ওর নাকে মুখে কাঁথা মুড়ি দেবার ভঙ্গি দেখে মনে হলো নিজের কাঁথাটা একাই গায়ে দেবে। কিন্তু তাহলে আমি কাঁথা পাই কোথায়?

চুপচাপ শুয়ে রইলাম কিছুক্ষণ। শীত লাগতে শুরু করেছে আরো বেশি। গুড় গুড় করে কাঁপছি। সিরাজ কালকের মতো কাঁথার ভাগ দিচ্ছে না। একসময় নাক ডাকতে শুরু করল সে।

‘সিরাজ ভাই,’ অগত্যা ডাকলাম ওকে।

‘উঁ!’ জবাব দিল ও। ‘কী হইছে, ঘুমাই হড়েন না? সারা রাইত জাগন থাইকবান নাকি? বেইন্যা উডিয়েরে কিস্তি ছাড়ন লাইগব।’

‘কাঁথা দেন না। শীত লাগের তো…’

‘কেয়া? আমনের কাঁথা নাই? আঁর ইয়ান তো গুরা কাঁথা । দুইজনেরে হোয়াই ত ন’।’

‘তাইলে? আমি গায়ে দুমু কী?’

‘গায়ে দিবান কী মানি? তয় আমনে কাঁথা-বালিশ লই আইবান না? বিদেশ বাড়িত শীতের দিনে কার কাঁথা-বালিশ কে আমনেরে দিব, অ্যাঁ?’

অবাক নয়, যাকে বলে একেবারে হতভম্ব হয়ে গেলাম। কী বলব, বুঝতে পারছি না। সিরাজ কাঁথা দিচ্ছে না, ঠিক আছে। কিন্তু ওর কথাবার্তা এমন ঔদ্ধত্যপূর্ণ কেন? গতরাতেও আমরা দু’জন একই কাঁথার তলে ঘুমিয়েছি। মোটামুটি বড় আছে ওর কাঁথাটা। খুব একটা টানাটনি হয়নি। তাহলে আজ হঠাৎ কী হলো?

‘বিদেশের বাড়িত নিজের কাঁথা-বালিশ লাগে, তালতো।’ মমিন বলল কথাটা। ‘এক কাজ করেন। আমগো সবার কাঁথা ছোট। একজইন্যা। আমনে আমনের গরম কাপড়চোপড় হিন্দিয়েরে হোতেন। আর এন্ডে বস্তা আছে। নিচের মিক্কা বস্তা হিন্দেন। দেইকবান শীত লাইগত ন’ আর।’

অর্থাৎ পা থেকে কোমর পর্যন্ত বস্তার ভেতর ঢুকিয়ে শুতে বলছে মমিন।

অভিনব প্রস্তাব। শুনে রাগ আর ঘৃণায় গা রি রি করে উঠল। কী মনে করেছে এরা আমাকে? ওদের মতো? ওরা জানে না আমি কে? আমি একজন শিক্ষিত ছেলে। এসএসসি পরীক্ষা দিয়েছি। ওদের বোঝা উচিত আমার গুরুত্বটা। যত কিছুই হোক, ওরা অশিক্ষিত। একজন শিক্ষিত মানুষকে সম্মান করা ওদের কর্তব্য।

কিন্তু ওরা সেটা বুঝতে চাইছে না। জোর করে কি বোঝানো যাবে?

কোনো জবাব দিলাম না মমিনের কথায়। আমার রাগ হচ্ছে সিরাজের ওপর। ছেলেটা আমাকে যেন ইচ্ছে করে অপমান করছে। কেন সেটা বুঝতে পারছি না। অথচ ওর কাছেই সবচেয়ে বেশি সমীহ পাবার আশা করেছিলাম। কারণ ও আমাকে চেনে। আমার লেখাপড়া, পারিবারিক মর্যাদা, পরিবেশ কিছুই ওর অজানা নয়। অথচ সব জেনে শুনেই ও আমাকে অপমান করছে, বাকি দু’জনের কাছেও ছোট করে দিচ্ছে।

‘ঠিক আছে, আমনেরা শোন।’

‘তয় আমনে? আমনে শুইবেন না?’

‘আমার চিন্দা আমনেরা গরনের দরকার নাই।’ ঝাঁজিয়ে উঠলাম মমিনের উদ্দেশে।

একটা জিনিস খেয়াল করলাম। আমি এখন আর শুদ্ধ ভাষায় কথা বলছি না। ওদের মতোই আঞ্চলিক ভাষা বেরোচ্ছে মুখ দিয়ে। অথচ গতকাল বিকেলেও চায়ের দোকানে আবুল মাঝির সাথে কথা বলার সময় নিখুঁত শুদ্ধ ভাষা বলেছি। এর কারণ কী? আমি কি ওদের মতো হয়ে যাচ্ছি?

চুপচাপ শুয়ে রইলাম। ভেতরে গরম গেঞ্জি আর ওপরে শার্ট। হাতদুটো ভাঁজ করে নিয়েছি বুকের সাথে। পা কুঁকড়ে এনে হাঁটুদুটো প্রায় মাথার সাথে লাগিয়ে ফেলেছি। যাকে বলে কুকুর কু-লী অবস্থা। সহকর্মীদের ওপর প্রচ- অভিমান বোধ করছি। এমনটা তো আশা করিনি। সিরাজ কাঁথার ভাগ না দেয়ায় যতটা কষ্ট পেয়েছি, তার চেয়ে বেশি অপমান বোধ করেছি মমিন বস্তা গায়ে দিতে বলায়। আমি কি বস্তা গায়ে দিয়ে ঘুমানোর ছেলে? কী ভেবেছে ওরা আমাকে? ওদের মতো?

জীবনে এই প্রথম দাঁড়টানার মতো কঠিন পরিশ্রম করেছি। কখন ঘুমিয়ে পড়েছি জানি না। তবে জেগে উঠলাম প্রচ- শীতে কাঁপতে কাঁপতে। সারা গায়ে কে যেন বরফ ঘষে দিয়েছে। আমার সহকর্মীরা যার যার কাঁথার তলে নাক ডাকাচ্ছে। আমি কী করব বুঝতে পারছি না।

কুকুর কু-লীতে কাজ হচ্ছে না আর। একটা লেপ বা কম্বল, নিদেন পক্ষে একটা বড় কাঁথা মুড়ি দিয়ে শুতে না পারলে শীত বন্ধ হবে না। কিন্তু লেপ-কম্বল পাব কোথায়? শাজু বু’র বাসায় লেপ মুড়ি দিয়ে শোয়ার কথা মনে পড়ল। আরামদায়ক উষ্ণতায় ভরা ছিল পুরো শরীর। শীত কাছেই ঘেঁষতে পারেনি। শীতের রাত কাঁথা-কম্বল ছাড়া কাটানোর কোনো অভিজ্ঞতাই নেই। শীতে কাঁপতে কাঁপতে ভাবছি, কী করি কী করি?

মমিনের বুদ্ধি ধরব? বস্তা গায়ে দেব? ভাবতে গা রি রি করে উঠল। কাঁথা নেই বলে বস্তা পরে শোব?

আমাদের পাশের বাড়ির এয়াছিন মহাজনের কথা মনে পড়ল। লোকটা কৃপণের একশেষ। টাকা খরচের ভয়ে লেপ কেনে না। শীতকালে বউ-ছেলেমেয়ে সবাই নাকি বস্তা গায়ে দিয়ে শোয়। সত্যি-মিথ্যে জানি না। তবে এ নিয়ে আমরা প্রচুর হাসাহাসি করতাম। আমিও কি তবে আজ এয়াছিন মহাজন হবো? শীতের জ্বালায় বস্তা গায়ে দেব?

বাইরে ছইয়ের ওপর টপ টপ করে কুয়াশা পড়ার শব্দ শুনতে পাচ্ছি। আর কোনো সাড়া-শব্দ নেই কোথাও। আশে পাশের নৌকো-সাম্পানের মানুষেরা ঘুমোচ্ছে। বস্তা কোথায় রাখা আছে জানি। খুব সাবধানে উঠে বসলাম। দুটো বস্তা নিয়ে একটা পরে ফেললাম লুঙ্গির ওপর দিয়ে। আরেকটা গায়ে জড়ালাম। তারপর শুয়ে পড়লাম গুটি সুটি মেরে। আস্তে আস্তে শীত কেটে যেতে লাগল। গরম হয়ে উঠছে গা। সিরাজের ওপর প্রচ- ক্ষোভে ফুঁসতে ফুঁসতে কখন ফের ঘুমিয়ে পড়লাম।

মাসুদ আনোয়ার। লেখক ও সাংবাদিক। জন্ম – দীর্ঘাপাড়, সন্দ্বীপ, চট্টগ্রাম। পেশায় সাংবাদিক। লেখালেখির শুরু ছাত্রজীবন থেকে। মাধ্যম ছড়া, কবিতা ও উপন্যাস। লেখেন বড়-ছোট উভয় শ্রেণির পাঠকের জন্যে। প্রথম ছড়ার বই ‘হুক্কাহুয়া‘, প্রথম কিশোর উপন্যাস ‘কেউ জানে না‘। কিশোর গল্প সঙ্কলন...

এই বিভাগের অন্যান্য লেখাসমূহ