জলে জঙ্গলে (১ম ও ২য় পর্ব)

মাসুদ আনোয়ার
উপন্যাস, ধারাবাহিক
Bengali
জলে জঙ্গলে (১ম ও ২য় পর্ব)

এক​

আসলে নূর নবী দরবেশই আমার শেষ ভরসায় পানি ঢেলে দিল।লোকটা যদি চায়ের দোকানে অতগুলো লোকের সামনে ওভাবে বিদ্রুপ নাকরত, তাহলে হয়তো এই কাহিনি লেখার দরকার হতো না। দিব্যি বাড়িতেথেকে যেতাম এবং….

কিন্তু তা হয়নি। নূর নবী দরবেশ এক দোকান লোকের সামনে আমাকেস্রেফ কাত করে দিল। কেবল প্রশ্নটা করেছি, অমনি মাচার ওপর থেকেদোকানদারের কাঁথা-বালিশের বান্ডিলটা হুড়মুড় করে সামনের টেবিলেরওপর পড়ল, আর অবাক হওয়ার প্রথম ধাক্কাটা সামলে নিয়ে নূর নবীদরবেশ হো হো করে হেসে উঠল। তার সাথে গলা মিলিয়ে চায়েরদোকানের ভেতরে বসা ও বাইরে দাঁড়ানো জনা বিশ-ত্রিশেক লোকও দাঁতবের করল।

সবচেয়ে উঁচু গলা সুলতান সুকানির। নূর নবী দরবেশের কেরামতির এআসরে ওই হোস্ট। মিনিটে মিনিটে চা-পান-বিড়ি সিগ্রেট আসছে দরবেশবাবার সামনে। বাবা কথা বলছেন, কথা বলতে বলতে আচমকা ‘হো-উ-ক’ করে একবার হাঁক মারছেন, অমনি সুলতান সুকানিসহ কয়েকজনকানফাটা আওয়াজে চায়ের দোকান কাঁপিয়ে দিচ্ছে, ‘মওলা!’

দরবেশকে ঘিরে বসা লোকগুলো এসেছে নানা আরজু নিয়ে। কারোছেলের অসুখ, কারো মেয়ের বিয়ে হচ্ছে না, কেউ অভাবে আছে, বাবাএকটু দোয়া করলে কপালটা ফিরে যায়–নানান ধান্দা।

দিন কয়েক ধরে বেশ নামডাক শোনা যাচ্ছিল বাবার। বাবার বাড়িচরলক্ষ্মী। বয়স অল্প, কিন্তু এই বয়সেও বিরাট কামেল। যা-ই বলে, তা-ইনাকি হয়ে যায়। কেবল মরা মানুষ বাঁচানো ছাড়া আর সব করতে পারে।

আমি অবশ্য এমন কাউকেই খুঁজছিলাম। এসএসসি পরীক্ষা দিয়েএসেছি। সবার ধারণা, প্রথম বিভাগ টিভাগ পাব। ছাত্র ভাল হলে যা হয়আর কী? সবাই আশা করে বসে থাকে। গবেষণা জুড়ে দেয় না জানিস্ট্যান্ডই করে বসে কিনা। আমি স্ট্যান্ড না করলেও অন্তত প্রথম বিভাগপাব, এমন আশা করার লোক নেহাত কম নয়। কিন্তু আমি জানি, পরীক্ষায় কী করে এসেছি। ভুগোলে ‘ভূগোলক’ পাবার ব্যাপক সম্ভাবনা।প্রথম বিভাগ দূরে থাক, রীতিমতো ফেল করার ভয়ে মনে মনে কাঁপাকাঁপিচলছে পরীক্ষা দিয়ে আসার পর থেকেই। একটা আতঙ্ক ঘিরে ধরেছে। যদিফেল করি, তাহলে….তাহলে বঙ্গোপসাগরের সব পানি ডাঙায় উঠে নাএলেও সমালোচনা আর ধিক্কারের যে ঘূর্ণিঝড় বয়ে যাবে, তা সামালদেয়া আমার পক্ষে সম্ভব হবে না। গার্জেনদের গর্জন, শিক্ষকদের দাঁতঘসটানি, বন্ধুদের টিটকারির রীতিমতো বন্যা বয়ে যাবে।

গর্জন, দাঁত ঘসটানি আর টিটকারি যে কপালে খুব অন্যায্য ভাবে জুটবে, তাও নয়। আপনি যদি দ্বিতীয় শ্রেণীতে ‘আনোয়ারা’ আর ষষ্ঠ শ্রেণীতে‘যৌবনের তুফান’কে ‘পাঠ্যবই’ বানিয়ে ফেলতে পারেন, তাহলে আপনারপক্ষে ক্লাসে প্রথম না হওয়াটা অপরাধ বৈকী? সে ‘অপরাধ’টা করতেপারতাম না বলে প্রতিবছর প্রথম হতাম। তাতেই ‘ভাল ছাত্র’ খেতাবটাকপালে জুটে গিয়েছিল।

যা-ই হোক, বিশাল এক বিশ্বাস আর ভক্তি নিয়ে গিয়েছিলাম নূর নবীদরবেশের কাছে। মাত্র দিনকয়েক আগে এসেছে লোকটা আমাদেরঅঞ্চলে। এসেই অনেক ভক্ত জুটিয়ে ফেলেছে। প্রায় শুনি ওর কেরামতিরকথা। তেমাথার কাসেম সওদাগরের চায়ের দোকানে বসে আড্ডাদিচ্ছিলাম। একজন হঠাৎ বলতে শুরু করল, ‘বুঝলে, এবার বোধ হয়নদী ফিরে যাবে। নূর নবী দরবেশ কসম খেয়ে বলেছে, নদী না ফিরিয়ে সেএখান থেকে যাবে না।’

মেঘনা নদী বড় বাড়াবাড়ি শুরু করেছে আমাদের অঞ্চলে। রাতদিনভেঙে নিচ্ছে চাকা চাকা মাটি। মানুষের ঘর-বাড়ি, খেতি খোলা গিলেখাচ্ছে। কোথায় ছিল সে পশ্চিমে পুরনো দারোগা হাটের কাছে! মনেআছে, নানার সাথে ছোটবেলায় একবার নদীর পাড়ে গিয়েছিলাম হেঁটেহেঁটে। হাঁটতে হাঁটতে পা ব্যথা, কিন্তু দারোগা হাটের দেখা আর মেলে না।নানার সাথে ঘ্যান ঘ্যান জুড়ে দিয়েছিলাম, ‘কই নানাজি, দারোগা হাটকই?’

মাত্র বছর কয়েকের মধ্যে অনেক পুবে চলে এসেছে মেঘনা। পুরনোদারোগা হাট ভেঙে পুবে যে নতুন দারোগা হাট হয়েছে, সেটাও ভাঙারমুখে। মাঝে মাঝে একা কিংবা কয়েকজন মিলে নদী দেখতে যাই। তখনদেখি এক একটা বাড়ি ভেঙে যাচ্ছে মেঘনার প্রবল স্রোতে। মানুষজনঘরবাড়ি সরিয়ে নেয়ার কাজে ব্যতিব্যস্ত। পুকুরের মুখ ছেড়ে দিয়ে মাছ ধরেনিচ্ছে, বড় বড় গাছ কেটে লাকড়ি বানিয়ে গরুর গাড়ি বোঝাই করাহচ্ছে। একই বাড়ির লোক বিভিন্ন জায়গায় চলে যাচ্ছে। যে যেদিকে সুবিধেপাচ্ছে।

বিষণ্ন মুখের সে কর্মব্যস্ত লোকগুলোকে দেখি। তাদের ছেলেমেয়েরা হৈ চৈকরছে, বুড়োরা মাথায় হাত দিয়ে বসা আর মহিলারা বিলাপ করতেকরতে জিনিসপত্র গোছানোর কাজ করছে।

যাদের বাড়ি এখনো ভাঙেনি, তাদের মুখেও দুশ্চিন্তার ছাপ। রাস্তাঘাটে, হাটে-বাজারে তারাও কথা বলে নদীর ভাঙন নিয়ে। তবে তাদের কারোকারো গলায় এমন আশাবাদও শোনা যায়, নদী অন্তত তাদের বাড়িপর্যন্ত পৌঁছাবে না। তার আগেই অলৌকিক কোনো কারণে পশ্চিম দিকেবিশাল চর দিয়ে পিছিয়ে যাবে। আশাবাদীদের দলে আছেন আমার বড়জেঠাও। খুব বড় গলা করে মাঝে মধ্যে ঘরে বসে কওয়া বলা করেন। তারমনে একটা বিশ্বাস খুব বড় হয়ে কাজ করছে। তার নাকি সব সময় মনেহয়, একটা নির্দিষ্ট জায়গায় এসে থেমে যাবে ভাঙন এবং সেটা অবশ্যইআমাদের বাড়ি ভাঙার আগে। কিন্তু যাদের বাড়ির একদম কাছে এসেগেছে মেঘনা, তাদের বিশ্বাসের জোর অতটা প্রবল নয়। তারা নিয়তিকেমেনে নিয়েছে। সবাই নিজ নিজ সুবিধা মতো মেঘনার পাড় থেকে দূরেসরে যেতে চাইছে।

নূর নবী দরবেশের ওপর মানুষের বিশ্বাস জমতে শুরু করেছে। অনেকেবোতলে ভরে পানি নিয়ে ওর মুখের ফুঁ দিয়ে পড়িয়ে আনছে। সে পানিখাচ্ছে বিভিন্ন নিয়ত করে। তেমাথার চায়ের দোকানে ফুঁ দেয়া সে পানিরফজিলতও শুনতে পেলাম সবিস্তারে। হাতেম কাকু নূর নবী দরবেশের ফুঁদেয়া পানি খেয়ে তার মায়ের কোমরের ব্যথা কীভাবে চলে গেছে, তারএকটা বিশদ বিবরণও দিয়ে ফেলল।

আমি ছাত্র ভাল ছিলাম, কিন্তু ছেলে হিসেবে মোটেই ভাল ছিলাম না।চঞ্চলতা ছিল একেবারে পা থেকে মাথা পর্যন্ত। মা ছিলেন না, তাই কেমনএক অস্থিরতায় মন আক্রান্ত হয়েছিল বুঝতে শেখার পর থেকেই। ঘরকেপর মনে হতো আর পরের কাছেই যেন নিজেকে খুঁজে পাওয়ার একটাপ্রবণতা গড়ে উঠেছিল। এরকম অস্থিরতা প্রভাব ফেলেছিল আমারআচরণে। বুদ্ধি হওয়ার পর থেকে তাই পাগল, উচ্ছৃঙ্খল, বেকুব এধরনেরকিছু বিশেষণ জুটেছিল কপালে। বিশেষ করে বাবা আর বড় জেঠাই বেশিব্যবহার করতেন বিশেষণগুলো। শুনতে শুনতে নিজের সম্পর্কে এরকমএকটা ধারণা গড়ে ওঠে আমারও।

কিন্তু এসব আগের গল্প। একটা ব্যাপার হলো এই যে, বয়সের যে সময়টায়মানুষ হঠাৎ করে সব কিছু এক সাথে বুঝতে শুরু করে, সে হলো কৈশোর।একজন কিশোরের মনে আচমকা যেন সব কিছু একত্রে ক্রিয়া করতে শুরুকরে। আর এসময়টায় দরকার কিশোরের প্রতি বড়দের সদয় ও সতর্কপর্যবেক্ষণ। আমার বেলায় সেটা হয়নি। ফলে শুরু হলো পড়াশোনায়পিছিয়ে পড়া। তাই এসএসসিতে প্রথম বিভাগ পাব, সেরকম দুরাশাবাবা-জেঠা কিংবা শিক্ষকদের মনে থাকলেও আমার ছিল না। সবচেয়েবড় কথা হলো, আমি ভূগোল পরীক্ষায় খারাপ করে এসে যে ফেল করারভয়ে মনে মনে কাঁপছি, তা কেউ জানত না। প্রথম বিভাগ না পাই, দ্বিতীয়বিভাগও যে পাব না, একেবারে ফেলই করব–এটা অবশ্য ছাত্র হিসেবেআমার অতীত পারফরম্যান্স যাচাই করলে কারো মাথায় আসার কথানয়।

তেমাথার চায়ের দোকানে হাতেম কাকুর মায়ের কোমরের ব্যথা ভালো হয়েযাওয়ার কথা শুনে আশান্বিত হলাম। হাতেম কাকু আমাদের পরিচিত।ওর মা বুড়িকেও চিনি। মাঝে মধ্যে আমাদের বাড়িতে যায় টায়। গ্রামসম্পর্কে দাদি ডাকি। সুতরাং নূর নবী দরবেশের পড়ানো পানি খেয়েএরকম চেনা-জানা একজন মানুষের ভালো হয়ে যাওয়ার সংবাদ শোনারপর তার কেরামতিতে বিশ্বাস না করার সঙ্গত কোনো কারণ থাকতে পারেনা।

মঙ্গলবার আর শুক্রবার আকবর হাট। মুন্সির হাট রোববার আরবিষ্যুদবার। শনিবার আর বুধবার হলো শান্তির হাট। মেঘনার উত্তালঢেউ শান্তির হাটের গায়ে থাবা বসিয়েছে। খাবলে নিচ্ছে মাটি।দোকানপাট সরে যাচ্ছে। শান্তির হাটে তাই যাওয়া হয় না। এখন চায়েরদোকানে নূর নবী দরবেশের নদী ফিরিয়ে দেয়া-সংক্রান্ত খবর শুনে মনেভারী একটা ভরসা পেলাম। লোকটা নিশ্চয় সে শক্তি রাখে। নইলে এমনবড় গলা করে বলে কী করে?

পকেটে টাকা-পয়সা থাকুক না থাকুক, বাজারবারে বাজারে যাওয়া চাই।কিছু না, স্রেফ আড্ডা মারা। বাহারদের মেকানিক শপ আর জসিমদেরগোলআলুর আড়ত আছে। বেশ দু’পয়সা থাকে প্রায় সময় তাদেরপকেটে। হাটবার দিন গেলে চা-সিগ্রেটের আপ্যায়নটা মোটামুটি ভালোইজোটে। সবচেয়ে বড় কথা হলো পরীক্ষার পর স্কুলের পাট চুকে যাওয়ারকারণে যেসব বন্ধুর সাথে এখন আর দেখা হয় না, তারাও আসে ওদেরদোকানে। দারুণ আড্ডা জমে ওঠে তখন।

সেদিনও জসিমের টাকায় চা খেয়ে সিগ্রেট ফুঁকছি, এসময় এলো সেবক, নোমান আর পারভেজরা। রেজাল্ট আউট হওয়ার সময় হয়ে এসেছে।দিন পনেরো পরেই জেনে যাব, কে কে পাস করেছে আর কে করেনি।আমার বন্ধুদের মধ্যে অবশ্য ফেল করার মতো কেউ নেই। ছাত্র হিসেবেকম বেশি সবাই ভালো। ফার্স্ট ডিভিশনের আশা কেউ করে না তারা, তবেসেকেন্ড ডিভিশনে যে সবাই উতরে যাবে, এ বিশ্বাস আছে। এদেরচালচলনেও দেখছি ব্যাপক পরিবর্তন। সবাই কলেজ টলেজ নিয়ে কথাবলছে। কারো কারো ঢাকায় চলে যাওয়ার প্রবল সম্ভাবনা। গম্ভীর মুখে তাবলছেও।

এসব গল্পে অবশ্য আমি সব সময় শুনিয়েদের দলে। ঢাকা গিয়ে কলেজেভর্তি হবো, এমনটা আমার সুদূর কল্পনারও বাইরে। ঢাকায় আমাদেরআত্মীয়-স্বজন কেউ থাকে না। আমার হয়তো বড়জোর চট্ট্রগ্রাম পর্যন্তযাওয়া হতে পারে। কিন্তু তার আগে পাস করতে হবে তো? আমার তো সেগ্যারান্টিও নেই। এসএসসিতে এক বিষয়ে ফেল করলেই পুরো ফেল।আমি জানি, আমি ভূগোলে ফেল করব। কারণ পরীক্ষা দিয়ে বেরিয়েএসে হিসেব করে দেখেছি, উনত্রিশের বেশি কোনোভাবেই পাচ্ছি না।তেত্রিশে পাস। সুতরাং ফেল অনিবার্য। একমাত্র অলৌকিক কোনোসাহায্য ছাড়া পাস করার কোনো উপায় নেই।

এখন চায়ের দোকানে নূর নবী দরবেশের কেরামতির কথা শুনতে শুনতেমনে হলো, তিনি যেন খাস করে আমার জন্যেই এই সময়ে এসে হাজিরহয়েছেন। না, আর দেরি করা ঠিক হবে না। কালই যাব বাবার কাছে।

তুমুল হৈ চৈ করছে আমার বন্ধুরা। আমার দিকে কারো মনোযোগ নেই।আস্তে করে সটকে পড়লাম। আজ আমার মন ভালো নেই। শালারা হৈ চৈকরে মরুক। আমি আগে পাসের ব্যবস্থা করে নিই।

​​​​​​​​​​​অনেকক্ষণ লেগেছিল বাবার দৃষ্টি আকর্ষণ করতে। প্রথমত আমিমুখচোরা, দ্বিতীয়ত তোতলা। অনেক লোকের সামনে যেমন মুখ তুলতেপারি না, তেমনি অনেক লোকের সামনে খুলতেও পারি না। বাবা যেখানেঅধিষ্ঠিত আছেন মধ্যমণি হয়ে, পান চিবুচ্ছেন, চা খাচ্ছেন আর সিগ্রেটফুঁকছেন, সেখান থেকে হাত কয়েক দূরে কাঠের বেঞ্চিতে নিজেও প্রায় কাঠহয়ে বসে আছি। সবাই ‘বাবা, বাবা’ করছে। নূর নবী দরবেশের বাবারবয়সীও জনাকয়েক আছে চায়ের দোকানে। তারাও দেখছি ‘বাবা’ ডাকছে।আমি কী ডাকব ঠিক করে উঠতে পারছি না। বাবা ডাকতে লজ্জা করছে।বাড়িতে জলজ্যান্ত নিজের বাবা রেখে এসে আরেকজনকে বাবা ডাকতেযাব কেন?

দেখলাম, কেউ কেউ মামাও ডাকছে। ‘মামা’ ডাকটা মধুর। মনে ধরলআমারও। ঠিক আছে, আমিও মামা ডাকি। বার কয়েক রিহার্সেল দিলামমনে মনে। তোতলা মানুষ, কথা বলতে গিয়ে আটকে যাই। মামা ডাকতেগিয়ে ‘মমমমমমম-আ-আ’ করার ইচ্ছে নেই। একবারেই যেন মামাডাকটা বেরিয়ে আসে, সেটা মকশ করে নিচ্ছি।

মামা…মামা…মামা…মামা…সচ্ছন্দে মামাকে ডাকছি। মনে মনে। জোরেবলতে পারছি না। ঠোঁটদুটো ‘ম’এর মধ্যে আঠার মতো এঁটে যাচ্ছে, ছুটছেই না। জোর করতে গেলে ‘….ম্ম’ পর্যন্ত, ‘আ’ আর আসেই না।

হায়রে তোতলামি! ক্লাস থ্রিতে পড়ার সময় হুজুর স্যারের হাতে অমনবিশাল একখানা চড় খেয়েও সারেনি।

‘…ম্ম–আ–ম্মা!’ আচমকা বেরিয়ে এল ডাকটা। ‘মামা’ এবং ‘আম্মা’র মাঝামাঝি। দরবেশের কান অবধি পৌঁছেছে বলে মনে হলো না। আশেপাশের লোকজনও দেখি চেয়ে দেখল না, এমন জটিল মামা ডাকটাকোত্থেকে এসেছে। দু’একজন তাকাল অবশ্য। তবে তারাও আমার মতোহয় মুখচোরা, নয় তোতলা। অনেকক্ষণ ধরেই তো দেখছি ওদের। ‘বাবা-মামা’ কিছুই ডাকছে না।

যারা তাকাল, তাদের মধ্যে একজন কিন্তু তুখোড়। সে সুলতান সুকানি।আমি চায়ের দোকানে ঢোকার পর থেকে মাঝে মাঝে চোখ বুলাচ্ছেআমার ওপর। না, চোখ বুলাচ্ছে না, চোখের কড়া দৃষ্টি হানছে। লোকটাবছর দুই আগে থেকে খ্যাপা আমার ওপর। জায়গা মতো পেলে হাপিসকরে ফেলবে, এমন সন্দেহ করি। কারণ আমার মতো একটা ১৪/১৫বছরের বাচ্চার কাছে হেরে যাবার এক কাহিনি আছে ওর। একটা গোপনএবং নিষিদ্ধ ভাব নিয়ে লোকটা ভাব জমাতে শুরু করেছিল আমারসঙ্গে। কিন্তু বুদ্ধির অভাবে সুবিধে করে উঠতে পারেনি। মাঝখান থেকে২০-২৫ টাকা স্রেফ জলে ভেসে গেছে ওর। না, টাকা জলে ভেসে যায়নি, ভেসে গেছে ওই টাকা দিয়ে কেনা বাদামের খালি ঠোঙ্গাগুলো। মূর্খজাহাজের সুকানি বুঝতে পেরেছে, ‘ইস্কুইল্যা পোলা’ মানে বদের বদ, শয়তানের হাড্ডি।

লোকজনের আসা-যাওয়ার বিরাম নেই। যাওয়ার চেয়ে আসার সংখ্যাইবেশি। ভাগ্যিস, আগে এসে দরবেশ মামার কাছাকাছি জায়গা দখল করেবসেছিলাম। নইলে দেখছি, কাছেই ভেড়া যেত না।

কলা দেখাচ্ছি সুলতান সুকানির কড়া চোখকে। খুব হাসি হাসি মুখ করেচাইছি সবার দিকে। চা খেয়েছি এরই মধ্যে কাপ দুয়েক। একটা কিংস্টর্কমানে বগা সিগারেট ধরিয়ে লায়েকের মতো ধোঁয়াও ছাড়ছি ফুক ফুককরে। নিজেকে সত্যি সত্যি লায়েক মনে হচ্ছে। এখন আমরা আর ছোটনই। দশজনের সাথে চলার মতো বয়স হয়েছে। মজলিসে বসেস্বাধীনভাবে বিড়ি টানো, কেউ কিছু বলতে আসবে না। শুধু খেয়ালরাখতে হবে, বাবা-চাচা-বড়ভাই টাইপের কোনো মুরব্বি ধারে কাছে আছেটাছে কিনা।

কিন্তু ফুক ফুক করে ধোঁয়া ছাড়লে তো হবে না। যে কারণে এসেছি, সেটাতো পূরণ হওয়া চাই।

অনেকে দেখছি, মামার সাথে অবলীলায় কথা বলছে। মামাও তাদেরকথায় হাসিমুখে সায় দিচ্ছে। ঠাট্টা-মশকরাও করছে মাঝে মধ্যে। এরইমাঝে আবার আচমকা বিকট চিৎকার দিচ্ছে ’হৌক’ করে। সাথে সাথেদোকানসুদ্ধ লোকের কোরাস : ‘মওলা…!’

মনে মনে রিহার্সেল চলছে এখনো ’ম্ম্ম্’ করে। ‘মামা’টা বের করেআনতে পারছি না। ভীষণ রাগ লাগছে। নিজেকে চড়াতে ইচ্ছে করছে।পারছি না। নিজেকে চড় মারলে ব্যথা পাব। হাতটা তো আর হুজুরস্যারের না। নিজের হাত। নিজের হাত দিয়ে কে কবে নিজেকে মারতেপেরেছে আর!

সুলতান সুকানির ব্যস্ততার শেষ নেই। ঘন ঘন চা এনে দিচ্ছে মামাকে।দোকানির ছেলেটাকে বিশ্বাস করতে পারছে না। ছেলেটা একবার নিজেরহাতে চা আনছিল। এক ধমকে থামিয়ে দিয়েছে ওকে জায়গায়, ‘সম্বন্ধীরপুত, কিছু বোঝস? শ্শালার ব্যাটা অজু আছে যে, বাবার সামনে চা নিয়েআসস! দে, এদিক দে।’

ছেলেটার হাত থেকে চা কেড়ে নিয়ে নিজের হাতে নিয়ে এল মামারসামনে। ভক্তি সহকারে টেবিলের ওপর রেখে হাসল। ‘নেন বাবা, চা খান।সিগারেট আছে?’ তারপরই কড়া হাঁক লাগাল দোকানদারের ছেলেটারউদ্দেশে, ‘এই শালার পুত, সিগারেট দেছ না ক্যা বাবারে?’

‘আরে সিগারেটের অভাব আছে নি, মিয়া!’ দরাজ গলায় হাসল নূর নবীদরবেশ। ‘কয় প্যাকেট চাই তোমার? নাও না…’ বলে পাঞ্জাবির পকেটেহাত ঢোকাল। এক প্যাকেট, দুই প্যাকেট, তিন প্যা…কেট, চার পাঁচছয়….আস্তে আস্তে চোখ কপালে উঠতে শুরু করল আমার। সাত আটপ্যাকেট সিগারেট বের করে ফেলল বাবা। রমনা, স্টার, বগা, সিজার….ওরে বাবা! একি কেরামতি! এক পকেটে কয় প্যাকেট সিগারেটআঁটে, অ্যাঁ?

সবার আগে চেঁচিয়ে উঠল সুলতান সুকানি। কাতর গলায় বলল, ‘বাবা, মাফ করে দেন, আর কমু না। আর বেয়াদবি করমু না। এই গালে গালেচড় খাইতাছি…আর বেয়াদবি করুম না।’

‘ঠিক আছে বাবা, ঠিক আছে।’ প্রশান্ত হাসি হাসল বাবা। সিগারেটেরপ্যাকেট বাড়িয়ে দিল। ‘সবাইকে একটা করে দে…সবাইকে সবাইকে….’ তারপরই আচমকা গলা ফাটিয়ে হাঁক, ‘হৌক!’

সাথে সাথে কানফাটানো চিৎকার, ‘মওলা…’

এবার কোরাসে আমিও ছিলাম। সবার ওপরে মনে হলো যেন আমারগলাই। ভক্তিতে আপ্লুত আমি। এক পকেটে বড় জোর তিনটা প্যাকেটঠাসাঠাসি করে ঢোকানো যায়, সেখানে ছয়-সাত প্যাকেট সিগারেটকেমনে আঁটে? নাহ, কেরামতি না থেকে যায় না।

আর কী আশ্চর্য! এটা চিন্তা করতে করতেই যেন তোতলামি দূর হয়েগেল। বাজখাঁই স্বর বেরিয়ে এল গলা থেকে, ‘মা-মা!’

নূর নবী দরবেশের সিগারেট-কেরামতি দেখে কেবল শুরু হতে যাওয়াঅবাক-গুঞ্জনটা থেমে গেল। সবাই ঘাড় ফেরাল আমার দিকে। দরবেশও।তারপর মধুর গলায় বলল, ‘কী রে ব্যাটা?’

ব্যস, ততোক্ষণে হয়ে গেছে আমার। এত লোকের চোখ আমার মুখে! মুখআবার বন।

‘বল না ব্যাটা তোর মনের মকছুদ কী? আরে, দেনেআলা তো আল্লা, আমি কেবল উছিলা… কী বলো মিয়ারা?’ হাঁক ছাড়ল ভক্তকূলেরউদ্দেশে।

প্রাণপণ চেষ্টা চালাচ্ছি মনের কথাটা বলে ফেলার জন্যে। বাবা হোক, আর মামা হোক, এখন আমার দিকে সরাসরি তাকিয়ে। এই বেলা বলেফেলতে পারলে মনে হয় কাম ফতে। এতক্ষণ ধরে খেয়াল করেছি, সুলতান সুকানি ছাড়া এতটা সময় এতটা আগ্রহ নিয়ে দরবেশ আরকারো দিকে তাকায়নি। আমার কাজ বোধ হয় হবে….

দাঁত-মুখ খিঁচে শব্দ বের করার চেষ্টা চালাচ্ছি মুখ থেকে। শেষ পর্যন্তপারলামও। ‘ইয়ে…ব্বাবা..মাম্মা-হ…আমি প-পরীক্ষায় প্পা…স ’

আর এমন সময় কিনা ধপ্পাস!

মানে মাচার ওপর থেকে দোকানির কাঁথার বান্ডিলটা এসে পড়ল আমারসামনে টেবিলের ওপর। অল্পের জন্যে মাথায় পড়েনি।

মাথা বাঁচল বটে, কিন্তু মুখ গেল বন্ধ হয়ে। কোনো শব্দই বেরোল না আর।স্রেফ হাঁ করে রইলাম। এদিকে সুলতান সুকানিসহ দোকানের লোকেরাগলা ফাটিয়ে হো হো শুরু করে দিল।

ভেবেছিলাম, দরবেশ হয়তো সবাইকে ধমক দিয়ে থামিয়ে দেবে। ওমা, উল্টো দেখি, বাবাজিও মজা পেয়ে গেছে! কষে একচোট হেসে নিল।তারপর বলল, ‘হ্যাঁ, পাইছস তো পাস? এবার বাড়ি যা। হে হে হে….’

‘হে হে হে!’ আরেকজনের গলা তাল মেলাল বাবাজির সাথে। ‘কাঁথাবালিশ নিয়া যা! বাবায় দিছে পরীক্ষা পাসের দোয়া।’

অপমানে মুখ লাল হয়ে যাওয়া বলে একটা কথা আছে। চায়ের দোকানেঅত লোকের টিটকারির মুখে আমার মুখের রঙ দেখতে পাইনি। তবেআন্দাজ করেছি, লালই হয়ে গিয়েছিল নিশ্চয়।

১৯৭৪। দেশ জুড়ে দুর্ভিক্ষ। যে এসএসসি পরীক্ষা হওয়ার কথা মার্চে, সেটাপেছাতে পেছাতে সেপ্টেম্বরে গিয়ে ঠেকল। ফল বেরোবে ডিসেম্বরে। পরীক্ষাশেষ করার পর টিউশনি করে প্রথম টাকা কামাই করা শুরু করলাম।জনাদশেক ছাত্রকে অঙ্ক শিখিয়ে মাসে একশ টাকা পাই। এক কাপ চাএক আনা, এক প্যাকেট স্টার সিগারেট এক টাকা পঁচিশ পয়সা। সময়ভালোই কাটছিল। বাবার পকেট কাটার দিন শেষ। বাবাও দেখি এখনসমীহ করে কথা বলেন। স্বপ্ন দেখেন আগামীর। ছেলে চাকরি করবে, টাকাকামাবে। একদিন জিজ্ঞেস করে বসলেন, প্রথম বিভাগ পাব কিনা। প্রথমবিভাগ পেলে তার ক্লাসমেট সাহেব মিয়াকে বলে কাটগড় স্কুলের প্রাইমারিসেকশনে মাস্টার হিসেবে ঢুকিয়ে দেয়া যায় কিনা চেষ্টা করে দেখবেন।সাহেব মিয়া কাটগড়ের চেয়ারম্যান। স্কুলের প্রতিষ্ঠাতার উত্তরপুরুষ।তিনি চাইলে কোনো ব্যাপারই না। তবে সেজন্যে প্রথম বিভাগ তোলাগবেই।

ভুগোলে তেত্রিশ নাম্বার পেলেও আমার দ্বিতীয় বিভাগ কেউ আটকাতেপারবে না, এমন বিশ্বাস আছে। কিন্তু যা বুঝলাম, সে বিশ্বাসের কথাশুনিয়ে বাবাকে খুশি করা যাবে না। তিনি প্রথম বিভাগ চান। বুঝলাম, আমাকে বাড়ি ছেড়ে পালাতেই হবে। যদি ফেল করি, তাহলে মনে হয়, বাবা ঘর থেকেই বের করে দেবেন।

কিন্তু বাবা ঘর থেকে বের করে দেবেন, সেটা তো পরের ব্যাপার। তারআগের প্রশ্ন হলো, আমি মুখ দেখাব কী করে? আত্মীয়-স্বজন, বন্ধুবান্ধব, ক্লাসমেট এবং শিক্ষকরা আমার ফেলের খবরটা কীভাবে নেবেন, সেটাচোখের সামনে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি।

যেমন বড় জেঠা। খবরটা শুনে প্রথমে স্তব্ধ হয়ে যাবেন। মিনিট দুয়েককথাই বলতে পারবেন না। তারপর মুখ খুলে গেলে প্রথম যে বাক্যটাবেরোবে, সেটা হলো, তিনি জানতেন। তিনি জানতেন যে, এ ছেলেকখনো মানুষ হবে না। আর বাবার কথা হবে একটাই, ‘ও যেন আমারঘরে আর না ঢোকে। আমি ওর ধার আর ধারি না।’

বাবা-জেঠাদের এসব অবশ্য স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া। সবার বাবা-জেঠাইএরকম বলে থাকেন। পরীক্ষায় খারাপ করলে বলবে না? আদর করবেনাকি?

কিন্তু আমার সমস্যা হলো অন্য জায়গায়। আমি ভালো ছাত্র। কবিতালিখি, ইস্কুলে স্বরচিত জারিগান গাই। আমার ক্লাসমেটরা ভীষণ সমীহকরে। তাহলে আমি যদি ফেল করি? আমি যদি ফেল করি, কী ভাববেসেবক-পান্না-পারভেজ-নোমানরা? মুচকি হাসবে আমার প্রতিপক্ষ ভালোছাত্র তাহের আর তার দল।

এসব ভেবে ভেবে মাথা আউলা অবস্থা। বুঝতে পারছি না কী করব?

পালাতে হবে! আচমকা মাথার ভেতর ঢুকে গেল কথাটা। হ্যাঁ, পালাতেহবে আমাকে। পরীক্ষায় ফেল করে মুখ দেখানো সম্ভব নয় কাউকে। সেবড় লজ্জার ব্যাপার হবে। পরীক্ষার ফল বেরোনোর আগে বাড়ি ছেড়েচলে যাব। তারপর যদি দেখি পাস করেছি, তাইলে বাড়ি ফিরব। নয়তোনয়। শুরু হবে জীবনের আরেক অধ্যায়। কঠিন সংগ্রামের অধ্যায়। সেসংগ্রামে আমাকে জয়ী হতেই হবে। একদিন মানুষ হয়ে বাড়ি ফিরব।

​​​​​দুই.

৬ ডিসেম্বর রাজশাহী বোর্ডের রেজাল্ট আউট হলো। আমি কুমিল্লাবোর্ডের পরীক্ষার্থী। ভেতরে ভেতরে অস্থির হয়ে উঠলাম। যে কোনোদিনকুমিল্লা বোর্ডও ফল প্রকাশ করে দিতে পারে। তার আগেই পালাতে হবে।কিন্তু পালিয়ে যাব কোথায়?

কে যেন মন থেকে বলে দিল, ‘কেন, কাপ্তাই? সেখানে গোলাম মাওলাআছে না? শাজু বু’র জামাই।’

শাজু বু’ আমার মামাতো বোন। মায়ের জেঠাতো ভাইয়ের মেয়ে। বয়সেঅনেক বড়। শাজু বু’র জামাই থাকেন কাপ্তাই। ওখানকার বড় মসজিদেইমামতি করেন। ক্লাস এইটে যখন পড়ি, তখন একবার দেখা হয়েছিল।ভদ্রলোক আমার সাথে খুব হেসে টেসে কথা বলেছিলেন তখন। এতটাঘনিষ্ঠতা হয়েছিল যে, একদিন নিজের মনের গোপন ইচ্ছেটার কথাওজানিয়েছিলাম। বলেছিলাম, ‘দুলাভাই, আমি বাড়ি থেকে চলে যেতেচাই। বাড়িতে ভালো লাগে না।’

এটা আসলেই আমার মনের গোপন ইচ্ছে ছিল। সে ছোট্টবেলা থেকেই।বাড়িতে থাকতে একদম মন চাইত না। নিজেকে মনে হতো বন্দি একপাখির ছানার মতো। সারাক্ষণ ইচ্ছে হতো চলে যাই নানার বাড়িতে, নয়তো মায়ের কাছে।

গোলাম মাওলাকে ওই কথা বলার সময় শাজু বু’ও ছিল ওখানে ছিল।আমার কথা শুনে গোলাম মাওলা একটু চুপ করে যান। শাজু বু’ একটুহেসে বলেছিলেন, ‘মা না থাকলে ঘর ভাল লাগে না গো।’

গোলাম মাওলা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে বলেছিলেন, ‘হুঁ।’

শাজু বু’র মুখে শুনেছিলাম, গোলাম মাওলার নিজেরও মা নেই।

আমি বলেছিলাম, ‘দুলাভাই, আপনি আমাকে একটা চাকরি ধরিয়েদেবেন। আমি চাকরি করে করে লেখাপড়া করব।’

গোলাম মাওলা আবারও দীর্ঘশ্বাস ফেলেছিলেন। তারপর বলেছেন, ‘ঠিকআছে, তুমি আগে মেট্রিক পাস করে নাও। এরপর ইচ্ছে হলে কাপ্তাইযেয়ো। তখন দেখব কিছু করা যায় কি না। কিন্তু মেট্রিক পাস না করে বাড়িথেকে বেরোবে না।’

সুতরাং বাড়ি ছেড়ে কোথায় যাব, এ চিন্তা আসতে সবার আগে কাপ্তাইযাবার কথা মনে এল।

৮ ডিসেম্বর। শনিবার। সকাল থেকে এলাকায় বিশাল হৈ চৈ। মানুষেরমধ্যে উত্তেজনার শেষ নেই। নূর নবী দরবেশের আজ দরিয়া ফেরানোরদিন। বিশাল এক কর্মীবাহিনী তৈরি হয়ে গেছে স্থানীয় মাদ্রাসার ছাত্র-শিক্ষক আর এলাকার ধর্মপ্রাণ মানুষদের নিয়ে। আছরের পর থেকেশান্তির হাটে ওয়াজ মাহফিল। শুনছি বড় বড় পাঁচ-সাতটা গরুও নাকিজবাই করা হবে। দরিয়াতে ছুঁড়ে ফেলা হবে অর্ধেক মাংস।

মাগরিবের নামাজের পর সে মাহেন্দ্র ক্ষণ। সকাল বেলায় তেমাথারদোকানে গিয়ে এসব খবর শোনা গেল। দরিয়া কতটা ফিরবে, কিংবাআদৌ ফিরবে কিনা এই নিয়ে নানা জল্পনা কল্পনা। মানুষদের মধ্যে অতিবিশ্বাসী যেমন আছে, তেমনি নিম-বিশ্বাসী কিংবা অবিশ্বাসীর সংখ্যাওদেখছি কম নয়। মহাজন বাড়ির বদু কাকু তো কানেই তুলতে চাইছেন নাএসব কথা। উলু মিয়ার চায়ের দোকানে বসে কয়েকজনকে নিয়ে আসরজমিয়েছেন তিনিও। ফুক ফুক করে কাঁচি সিগারেট টানতে টানতে বলেচলেছেন, ‘দূর মিয়া, তোমরা এসব বিশ্বাস করো। দরিয়া নূর নবীদরবেশের কেনা গোলাম তো, কইলেই সালাম দিয়ে ফিরে যাবে। যতসববুজুরকি।’

একজন বলল, ‘বদুভাই, পীর আউলিয়া, গাউছ কুতুবদের অবিশ্বাসকরতে নেই। আল্লাহ কার উছিলায় কী করেন, কেউ বলতে পারে না।’

‘দূর মিয়া!’ বদু কাকু সিগারেটের ধোঁয়ার মতোই উড়িয়ে দিলেনলোকটাকে। ‘নূর নবী দরবেশ তো চ্যাঙড়া পোলা। চ্যাঙড়া পোলা আবারপীর আউলিয়া, গাউছ কুতুব হয় নাকি? গাউছ-কুতুবের কথা যখন বলছ, তাহলে বায়েজীদ বোস্তামী, আমানত শাহ, মোহছেন আউলিয়া এদেরদরবারে যাও। তাদের দোয়া পাও কিনা দেখ। নদী বাপ ডেকে ফিরে যাবে।কিন্তু তারা দোয়া করবেন তো? কার জন্যে দোয়া করবেন? আমরা তো সবপাপী বান্দা, আমাদের জন্যে দোয়া করে আল্লাহর কাছে শরমিন্দা হবেননাকি তারা?’

কথাটা অনেকেরই মনে ধরল। ‘হ্যাঁ হ্যাঁ’ করে সাড়া দিল তারা। অনেকেঅবশ্য চুপ করে রইল। তারা বোধ হয় একটু বেশি আশাবাদী। নূর নবীদরবেশের ওপর থেকে অত সহজে বিশ্বাসহারা হতে চাইছে না।

কিন্তু আমার তাতে কিছু আসে যায় না। আমি আজই বাড়ি থেকে পালাবসিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছি। নূর নবী দরবেশ যা-ই পারুক, আমাকে পরীক্ষায়পাস করাতে পারবে না। পারলে একটা অসহায়, প্রায় বাচ্চা ছেলেরসামনে কাকতালীয়ভাবে কাঁথার গাঠরি পড়া নিয়ে এক দোকান লোকেরসামনে অমন হ্যা হ্যা করে হাসতে পারত না।

দুপুর বেলা খেয়ে দেয়ে বেরিয়ে পড়লাম বাড়ি থেকে। রাতটা কাটালাম দূরসম্পর্কের এক আত্মীয় বাড়িতে। পরদিন ভোরে উঠে যাত্রা শুরু করারকথা

ভোর না হতেই ঘুম ভেঙে গেল। প্রথমে ঠাহর করতে পারলাম না কোথায়আছি। তারপরই সব মনে পড়ে গেল একযোগে। আমি বাড়ি ছেড়েপালাচ্ছি। এসএসসি পরীক্ষার রেজাল্ট আউট হতে পারে যে কোনোদিন। আমি পরীক্ষায় ভালো করতে পারিনি। ফেল করার মতো ভয়ঙ্করব্যাপারটা ঘটলে যে কী হবে, সেটা কল্পনাও করতে পারছি না।

মনটা হঠাৎ করেই যেন কেমন হয়ে গেল। একটা অজানা আতঙ্ক এসেভর করল। তলপেটে খালি খালি ভাব। শিরদাঁড়ায় অনিশ্চয়তার ঠাণ্ডাশিরশিরে অনুভূতি। কোথায় যাব? কী করব? আত্মীয়-স্বজন, বন্ধুবান্ধব, ক্লাসমেটদের প্রিয় সব মুখ ছেড়ে কোন অজানায় গিয়ে হাজির হবোআমি?

তবে বেশিক্ষণ থাকল না মনের এই বিষণ্ন ভাব। নতুন জীবন, নতুনমানুষ আর নতুন সব অভিজ্ঞতার লোভে আকুল হয়ে উঠল। মনে হলো, আজ থেকে শুরু হলো আমার সংগ্রামী জীবন। এই সংগ্রামে আমাকেজিততেই হবে। কল্পনায় নিজেকে দেখলাম, টগবগে এক তরুণ হিসেবে।দেখলাম, যেখানে যাচ্ছি সবাই আমাকে কেমন অবাক হয়ে বরণ করেনিচ্ছে, মেনে নিচ্ছে আমার শ্রেষ্ঠত্ব। দেখলাম, কোনো এক সহৃদয়মহাপ্রাণ ব্যক্তির সঙ্গে সাক্ষাৎ হয়ে গেছে আমার। আমার চলা ফেরা, কথা বলার ভঙ্গি আর কাজকর্ম দেখে মুগ্ধ ওই ভদ্রলোক আমাকে নিয়েগেলেন নিজের সাথে, তার বাড়িতে।…..তাঁর রয়েছে এক সুন্দরী মায়াবতীকিশোরী মেয়ে, আমরা দু’জন এক সাথে পড়াশোনা করি, কথা বলি, আর মাঝে মধ্যে বিরল কোনো মুহূর্তে একে অন্যের দিকে তাকাই চোরাচোখে, নিজেকে হারাই, চোখাচোখি হতেই দারুণ লজ্জায় চোখ ফিরিয়েনিই, মনের গহীনে একে অন্যকে ভালবাসি পাগলের মতো।

….তারপর স্বপ্ন আরো এগোয়….মান-অভিমান, মুগ্ধতা, ভুলবোঝাবুঝি…..

সকালে উঠে চিতই পিঠে খেয়ে আত্মীয়ের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বেরিয়েপড়ি। তারা বলল, আবার যেন যাই। আমি মনে মনে হাসি। তোমরা কিজানো, আমি কোথায় যাচ্ছি? আমি বাড়ি ছেড়ে চলে যাচ্ছি। একদিনমানুষ হয়ে, আরো অনেক লেখাপড়া শিখে, অনেক টাকা-পয়সা নিয়েফিরব। সেদিন আমার দিকে তাকিয়ে থাকবে সবাই অবাক হয়ে। আমারদিকে চাইবে প্রশংসার দৃষ্টিতে। ছোটরা শ্রদ্ধা করবে, আর বড়রা সমীহকরবে।

আত্মীয় বাড়ি থেকে বেরিয়ে পুবদিকে এগিয়ে চললাম নদীর দিকে।ঘাটঘরে গিয়ে নৌকোয় চড়ব। সাথে কোনো মালপত্র নেই। আছে শুধুএকটা খাতা। কবিতার খাতা। ফাইভ থেকে লেখা সব কবিতা নোটকরেছি ওই খাতায়। ওই খাতা আমার প্রাণের চেয়ে প্রিয়। আমি যেখানেযাব, সেখানে সবাই যখন দেখবে আমার কবিতা, অবাক হয়ে যাবে।তারপর অনেকক্ষণ পরে একজন অনেক সম্মানের সাথে বলবে, ‘আপনিএকজন কবি?’

কবি হওয়া অনেক বিশাল ব্যাপার। রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, জসীমউদদীন… একদিন ছাত্ররা সবাই পরীক্ষার খাতায় ব্যাখ্যা লিখবে, আলোচ্যাংশটুকু কবি মাসুদ আনোয়ারের….কবিতা থেকে নেয়া হয়েছে।এখানে কবি বলেছেন যে,…..

একঘণ্টা পরে নৌকোয় চড়লাম। পুবের দরিয়া ঠাণ্ডা। মেঘনার মতোরাক্ষুসী টাইপের নয়। ডিসেম্বরের সকাল। মিষ্টি রোদ গায়ে মেখে উত্তুরেবাতাস বইছে। নৌকোর গায়ে এসে লুটিয়ে পড়ছে ঢেউ। কল কল ছলছল….। দক্ষিণে সাগর। ঘোলাটে পানি আর ধূসর আকাশ মিশে গেছেদিগন্ত রেখায়। নৌকোর গলুইয়ে দাঁড়িয়ে তাকালাম পশ্চিমে। বুকের ভেতরহু হু করে উঠল। আমার আজন্ম পরিচিত ভূখণ্ড। আমার গ্রাম, স্কুল, খেলার মাঠ। আস্তে আস্তে পিছিয়ে যাচ্ছে। সজীব স্পষ্ট গ্রামের গাছপালাআস্তে আস্তে সবুজাভ, তারপর নীল হয়ে উঠতে শুরু করেছে। আকাশনেমে এসেছে নিচের দিকে। মিশে যাচ্ছে গাছপালার সাথে। কখন আসবআবার? মনে পড়ল বন্ধুদের কথা। সেবক, সাকী, পান্না, মাওলা, বাহার, পারভেজ, নোমান…ওরা সবাই রয়ে গেছে। ওরা থাকবে। কেবল আমাকেইচলে আসতে হলো ওদের ছেড়ে। আগামীকাল আকবর হাটে ওরা সবাইএকত্র হবে, আড্ডা মারবে…আমাকে পাবে না। তা নিয়ে অবশ্য খুবএকটা মাথাও ঘামাবে না। একটা আড্ডায় সবাই সবদিন হাজির নাওথাকতে পারে। কিন্তু ওরা তো জানবেই না যে, আমি বাড়ি ছেড়েপালিয়েছি।

হালের গোড়ায় বসা মাঝির মনে হঠাৎ যেন ফুর্তির আমেজ লাগল।বাদাম খাটিয়ে দিয়েছে বাতাসে। উত্তুর-পশ্চিম কোনা থেকে বয়ে আসাবাতাসে পেট ফুলিয়ে উড়ছে। নৌকো এগিয়ে চলেছে সীতাকুণ্ডের দিকে।

…..আল্লা আল্লা আল্লা আল্লা……মাঝি চেঁচিয়ে উঠল আচমকা। সাথেসাথে নাইয়াদের কোরাস, তার সাথে গলা মেলাল যাত্রীরাও…..এ এএ……..লাইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাছুলুল্লা……

মজা লাগল দারুণ। এমন আর কখনো দেখিনি। আমাদের চারদিকেপানি। বাতাসে দুলছে। উত্তরে-দক্ষিণে-পুবে পশ্চিমে যেদিকে তাকাও, আকাশ মিশে গেছে পানির সাথে। গভীর দরিয়ার বুকে কাঠের তৈরিএকটা নৌকো কেমন তর তর করে এগিয়ে চলেছে। যাত্রীরা কথা বলছে, গান গাইছে, বিড়ি টানছে। কেউ কেউ উদাস চোখে তাকিয়ে আছেনদীর ঢেউয়ের দিকে। কেউ উৎফুল্ল, কারো চোখে বিষাদ, কেউ নির্লিপ্ত।

আর আমার চোখে স্বপ্ন। ভবিষ্যতের স্বপ্ন। নতুন দেশে নতুন মানুষেরসাথে পরিচয় হওয়ার স্বপ্ন, নিজেকে সফল একজন মানুষ হিসেবে দেখারস্বপ্ন।

​​​​​​কাপ্তাই পৌঁছলাম বিকেল প্রায় তিনটার সময়। শীতের দিন। সূর্য হুড়মুড়করে নিচে নামতে শুরু করেছে। বাস থেকে নেমে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়েগেলাম। বাস যেখানে থেমেছে সেটা ছোট একটা রাস্তার মতো। একদিকেদোকানপাট, আরেকদিকে খালি। ডানে বাঁয়ে সামনে পেছনে তাকালেইপাহাড়। মানুষজন খুব বেশি দেখা যাচ্ছে না। সরু রাস্তা বেয়ে পুবদিকথেকে পশ্চিম দিকে এগিয়ে আসছে গাছ বোঝাই ট্রাক। গোঁ গোঁ শব্দ শুনেমনে হচ্ছে বেশ কষ্ট হচ্ছে ট্রাকগুলোর বোঝা পিঠে নিয়ে ছুটতে। উত্তরপাশের দোকানপাটে মানুষজন কেনা কাটা করছে। খুব বেশি ভীড় নেই।ভারী ছিমছাম মনে হলো কাপ্তাই শহরটাকে। ভালো লাগছে। কিন্তু একইসাথে বিষণ্নতায় ভরে উঠছে মন। কালও এসময় আমি বাড়িতে ছিলাম।তখন ছিল বাড়ি থেকে পালিয়ে আসার উত্তেজনা আর উদ্বেগ। আরএখন উত্তেজনা নেই, মনের ভেতর জমে উঠতে শুরু করেছে দুশ্চিন্তা।অনিশ্চয়তার উদ্বেগ। সূর্য পশ্চিমে পাহাড়ের আড়ালে চলে যাবার তোড়জোড় করছে। পাহাড়ের নীল অবয়বে ধূসর ছায়া। অন্ধকার হতে শুরুকরেছে। কেমন যেন ধোঁয়া উড়ছে পাহাড়ের গা থেকে। পুবদিকে কাছেরটিলা-টক্কর ছাড়িয়ে আরো দূরে আমার নজর। দিগন্তের এদিক থেকেওদিক পর্যন্ত নীলের বেড়ার মতো অগণিত পাহাড়ের সারি। খুব হৈ চৈ-ওশোনা যাচ্ছে সেদিক থেকে। এক সাথে অনেক মানুষের চিৎকার। যাবনাকি ওদিকে? কী হচ্ছে দেখে আসব?

সূর্য ডোবার আর বেশি বাকি নেই। কাপ্তাই শহরের আগা-মাথা কিছু চিনিনা। সুতরাং লোভ সামলাতে হলো। আগে গোলাম মাওলার বাসা খুঁজেনিই। অবশ্য খুঁজে পেতে খুব একটা কষ্ট হবে না। কারণ তিনি তো কাপ্তাইবড় মসজিদের ইমাম। বড় মসজিদের সামনে গেলেই হবে। একটু পরেইতো মাগরিবের নামাজ শুরু হবে। তিনি ইমামতি করবেন। মসজিদের সামনে গিয়ে দাঁড়ালে নামাজ শেষ করে বেরিয়েই আমাকে দেখবেন।আমিও দেখব।

একজনকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘ভাই, বড় মসজিদটা কোন দিকে?’

‘বড় মছিদ?’ লোকটা এমন ভাবে তাকাল যেন আমি এক অদ্ভুত কথাজানতে চেয়েছি। আর সে যেন বড় মসজিদ কথাটাও এই প্রথম শুনল।পকেট থেকে বিড়ির প্যাকেট বের করে ফস করে ম্যাচ জ্বালাল। তারপরধরাতে ধরাতে বলল, ‘জানি না।’ ভুস করে ধোঁয়া ছাড়ল। ‘বাড়িকোঁতায়?’

পরিচয়ের আগেই যদি কেউ হুট করে জানতে চায়, বাড়ি কোথায়, সেলোককে পাত্তা দেয়ার দরকার নেই। এটা খুব সহজ ব্যাপার। তাছাড়ালোকটা বলছে বাড়ি কোঁতায়? ‘কোঁতায়’ মানে কী? কেমন একটা বিশ্রীভঙ্গি। যেন ঠাট্টা করল? সুতরাং ওর প্রশ্নের জবাব না দিয়ে সামনে হাঁটতেশুরু করলাম।

কিন্তু অবাক কাণ্ড! লোকটা দেখি পেছন থেকে ডাকতে শুরু করেছে, ‘এইএই হুন হুন…এই পোয়া?’

এসএসসি পরীক্ষা দিয়েছি। কলেজে ভর্তি হবো কয়েকদিন পরে।অপরিচিত লোকদের মুখে ‘আপনি’ শুনতে চাই। আর এই লোক তোসাধারণ লেবার শ্রেণির, সে আমাকে ‘তুই-তোকারি’ করবে আর আমি যেএখন আর নেহাত ছোট নই, সেটা খেয়াল না করে ‘পোয়া’ ডাকবে, এটাপছন্দ হলো না।

‘কী হয়েছে?’ রুখে দাঁড়ালাম। লোকটার দিকে ঘাড় বেঁকিয়ে বললাম, ‘অভদ্রের মতো কথা বলছেন কেন? ভদ্রতা কাকে বলে জানেন না?’

‘কী কইলি?’ লোকটার চোখ সরু হয়ে উঠল। ‘এই খাড়া।’ আমার দিকেআসতে শুরু করল।

অপমানে কান লাল হয়ে উঠতে শুরু করেছে। কিন্তু ভয়ও পেলাম। আমারসরু লিকলিকে হাত-পা। লোকটার দিকে তাকালাম। বেশ ষণ্ডা-গুণ্ডাটাইপ চেহারা। থাপ্পড় একটা দিলে মনে হয় স্রেফ উড়ে যাব, খুঁজেও পাওয়াযাবে না আমাকে। তবু গ্যাঁট হয়ে দাঁড়ালাম। কী করতে পারবে ও?

লোকটা কাছে এসে দাঁড়াল। আমার পা থেকে মাথা পর্যন্ত খুঁটিয়ে দেখল।তারপর হাসল একটু। ‘নতুন আইছ কাপ্তাই?’

যাক, ‘তুই’ থেকে ‘তুমি’তে উঠেছে। গলার স্বরও কিছুটা নরম শোনাল।

‘হ্যাঁ। কিন্তু আপনি আমাকে ‘তুই’ করে বলছেন কেন? আমি কি বাচ্চাছেলে?’

‘কার কাছে আইছ? কে আছে এখানে? দেখে তো মনে হয় বাচ্চা ছেলে।’

‘না, বাচ্চা ছেলে না। আমি এসএসসি পরীক্ষা দিয়ে এসেছি।’

‘মানি?’

‘মানে হলো মেট্রিক পরীক্ষা দিয়ে এসেছি। কিন্তু আপনি আমার সাথেএরকম করছেন কেন?’

‘মেট্টিক! পাস কইরছ? কও কী?’

‘কেন, বিশ্বাস হয় না। আপনি আমাকে তুই করে কথা বলেন কেন? আপনি করে বলবেন।’

‘আইচ্ছা, আইচ্ছা।’ লোকটা হাসল খিক খিক করে। ‘তয় এখন কইযাইবান? বাড়ি কই?’

এবার বাড়ির কথা বললাম। লোকটাকে দমিয়ে দিতে পেরে ভালোলাগছে। একজন ব্যক্তিত্ববান মানুষের মতো আচরণ করতে পেরেছি।আমার ব্যক্তিত্বের কাছে হেরে গেছে একজন অশিক্ষিত লোক। সমীহ করেকথা বলছে এখন। ভাল লাগছে খুব।

‘চা খাইবান? চলেন, চা খাই…..’ হঠাৎ আপ্যায়ন করতে শুরু করললোকটা। কিন্তু আমি রাজি হলাম না। বললাম, ‘না, আমি চা খাই না।ধন্যবাদ।’

লোকটা পীড়াপীড়ি করল না। ‘কই যাইবান এখন? রাতে থাকনেরজায়গা আছে?’

‘আছে। আমার দুলাভাই আছে। কাপ্তাই বড় মসজিদের ইমাম সাহেব,’ সগর্বে জানালাম।

এবার যেন লোকটাকে একটু ভয় পেয়েছে মনে হলো। ‘বড় মছিদের ইমামসাব আপনার দুলাভাই। দূর, আগে কইবান না? শোনেন, উনি তোকাপ্তাইয়ের ভেতর থাকেন। আমনে রিসিপশন গেটে ঢুকে…না, চলেন তোআপনাকে ভেতরে ঢুকিয়ে দিই…চলেন চলেন….’

রিসিপশন গেট মানে অভ্যর্থনা ফটক। পরে জেনেছি, রিসিপশন গেটেরভেতরেই মূল কাপ্তাই শহর। গেটের বাইরে জেটিঘাট, নতুন বাজার, রুফলাইন…এসব হয়েছে পরে। কাপ্তাই বাঁধ মূল শহরে। নিরাপত্তার কারণেজনসাধারণের অবাধ যাতায়াত নিয়ন্ত্রণ করা হয় রিসিপশন গেটেরমাধ্যমে। চাইলেই আপনি হুট করে ভেতরে ঢুকতে পারবেন না। রিসিপশনগেটের সেন্ট্রিদের কাছে গিয়ে পরিচয় লিপিবদ্ধ করিয়ে ভেতরে ঢোকারউদ্দেশ্য এবং কার কাছে যাবেন, এসব নানা ফিরিস্তি দিয়েই ঢুকতে হবে।

যাহোক, লোকটার সাহায্য পেয়ে সুবিধে হলো খুব। ওর প্রতি আর রাগওরইল না। ভাবলাম, বেচারা অশিক্ষিত মানুষ। ব্যবহার শিখবে কোত্থেকে? শিক্ষিত সমাজের আদব-কায়দাও জানে না, কারণ কখনো শিক্ষিতমানুষের সাথে মেশেনি হয়তো।

অথচ অশিক্ষিত হলেও কেমন আন্তরিক! চা খাওয়াতে চাইল। আরএখন না চাইতেই সাহায্য করছে কাপ্তাইয়ের ভেতরে যাওয়ার ব্যাপারে।সত্যিই ওর সাহায্য না পেলে দারুণ বেগ পেতে হতো। শেয়ারের টেক্সিতেতুলে দেয়ার আগে বলল, ‘যেখানে টেক্সি থামব, ওখানেই বড় মছিদ।কাউকে জিজ্ঞেস করলে দেখাই দিবে হুজুরের বাসা।’

আমি হাসিমুখে কৃতজ্ঞতা জানালাম। বললাম, ‘ভাই, আপনাকে অসংখ্যধন্যবাদ। ’

লোকটা হাত বাড়িয়ে দিল। হ্যান্ডশেক করবে। আমি একটু ইতস্তত করেহাত বাড়ালাম। লোকটা আমার হাত মুঠোয় নিয়ে মৃদু চাপ দিল।‘কাইলকা বেড়াইতে আইসেন জেটিঘাট। আমার নাম অলি, অলিআম্মত। যে কাউরে জিগাইলে দেখাই দিব।’ হাসল লোকটা।

‘ঠিক আছে,’ হাত টেনে নিলাম। লোকটার হাসি ভালো লাগল না।কেমন বিশ্রী দেখতে।

সালাম দেয়ার ভঙ্গিতে কপালে হাত ঠেকাল লোকটা। তারপর হাসিমুখেইবলল, ‘আল্লা হাফেজ…’

টেক্সি ছেড়ে দিল। এগিয়ে চলল দক্ষিণ দিকে। প্রশস্ত রাস্তার দু’পাশেদেখার মতো দৃশ্য। পুবদিকে কাপ্তাই হ্রদ, পাহাড়, সবুজ গাছপালা; পশ্চিমেও তাই। নীলপাহাড় আর সবুজ বৃক্ষশ্রেণি। পাগলের মতো দু’দিকেদেখার চেষ্টা করছি। পনের ষোলো বছরের জীবনে এমন দৃশ্য তো আরদেখিনি।

কিন্তু সূর্য পাহাড়ের আড়ালে চলে গেছে অনেক আগে। শীতসন্ধ্যায় ধোঁয়াউড়ছে পাহাড়ের গায়ে। ধোঁয়া নয় আসলে, কুয়াশা। এরই মধ্যে মোড়ঘুরল টেক্সি। আচমকা বাম দিকে চোখে পড়ল অগাধ পানির আধারআর ডানপাশে রাস্তা থেকে বহু নিচে বাড়িঘরের সারি। পানি আর রাস্তারকোল ঘেষে স্লুইস গেটের মতো। একটা দুটো নয়। আচ্ছা, এটা কী? গেটগুলো কিসের? চিন্তা করতে করতে পাথরের ফলায় লেখাটা চোখেপড়ল, ‘মেন ড্যাম : প্রধান বাঁধ।’

ধীরে সুস্থে বিজলী বাতি জ্বলে উঠতে শুরু করেছে চারদিকে। মাগরিবেরআজান শোনা গেল দক্ষিণ দিক থেকে। নিশ্চয় বড় মসজিদের আজান।মন ভরে উঠল হঠাৎ আনন্দে। নিশ্চয়তার আনন্দ। একটু পরেই দেখাহতে যাচ্ছে দুলাভাই গোলাম মাওলার সাথে। বড় মসজিদে নামাজপড়াতে আসবেন তিনি। ইমাম না?

টেক্সি থামল বড় মসজিদের কাছাকাছি এক জায়গায়। সবাই নেমেপড়ল। নামলাম আমিও। ড্রাইভারকে জিজ্ঞেস করতেই দেখিয়ে দিলমসজিদটা। তারপর টেক্সি নিয়ে চলে গেল ফের যেদিক থেকে এসেছেসেদিকে।

মাসুদ আনোয়ার। লেখক ও সাংবাদিক। জন্ম – দীর্ঘাপাড়, সন্দ্বীপ, চট্টগ্রাম। পেশায় সাংবাদিক। লেখালেখির শুরু ছাত্রজীবন থেকে। মাধ্যম ছড়া, কবিতা ও উপন্যাস। লেখেন বড়-ছোট উভয় শ্রেণির পাঠকের জন্যে। প্রথম ছড়ার বই ‘হুক্কাহুয়া‘, প্রথম কিশোর উপন্যাস ‘কেউ জানে না‘। কিশোর গল্প সঙ্কলন...

এই বিভাগের অন্যান্য লেখাসমূহ