ফিরে এসো
আমার বাবা ছিলেন অত্যন্ত সাহসী একজন লড়াকু মনের মানুষ।শত অভাব অভিযোগেও তাকে কোনোদিন ভেঙ্গে…..
বারান্দায় বসে একা একাই পড়াশোনা করছে জিনিয়া। দুপুর দুটা কি আড়াইটা হবে। একান্নবর্তী পরিবারে দম ফেলার সময় পায়না মা। দুপুরের খাওয়ার পরে বসে রেশন থেকে আনা গম ঝাড়ছে, এরপর চাল বাছতে বসবে। শুধু কি তাই! তারপরে শুকনো কাপড় ওঠানো, ঘরঝাড় দেয়া বিকেলের চা একের পর এক কাজের লিস্ট আছে। এরমধ্যেই মেয়েকে বারান্দায় পিড়ি পেতে পড়তে বসিয়েছে। নয় বছরের জিনিয়া খুব মেধাবী কিন্তু খুব কম পড়ে বলে মায়ের আক্ষেপ। নিজের ইচ্ছে ছাড়া ওকে পড়ানোর সাধ্য কারো নেই। কিন্তু মঞ্জরীও ভীষণ কড়া। এই মেয়েকে বাগে আনতে বেতই একমাত্র ভরসা। অথচ পড়াশোনা সে একাই করে ছোট থেকে। খুব একটা সাহায্য কোনদিন নিতে হয়না জিনিয়ার। ভীষণ চঞ্চল স্বভাবের, সারাক্ষণ ছটফট করতেই থাকে। নানারকম চিন্তা ও পরিকল্পনা তার মাথায় চলতে থাকে।
এইসময় আবার কদিন ধরে তার একটা জিনিস মাথায় ঘুরছে। মনে মনে ভেবেই রেখেছে আজ মায়ের চোখ ফাঁকি দিয়ে একবার বের হতেই হবে। খোলা উঠান, উত্তর থেকে দক্ষিণ হয়ে পশ্চিম দিকে ঘুরে গিয়ে ‘L’ আকৃতির বারান্দা। জিনিয়া উত্তর দিকে মুখ করে বসেছে। নীচে উঠান, মাঝে তুলসীবেদি, কাঁঠালিচাপা ফুলের গাছ, ওপাশে দুই হাত তফাত রেখে দুটি আমগাছ। এছাড়া পেয়ারা, নিম, কাঁঠাল, বেল ও নানারকম ফুল গাছে ভর্তি তাদের বাড়ি। অনেকরকম পাখি আসে এখানে, বাড়িতে আবার পায়রার খোপ আছে, মুরগীর বড় ঘর আছে। জিনিয়া রোজ সকালে দাদার সাথে পাখিদের চালের খুদ ও গম দেয়। পায়রা, কাক, চড়াই, শালিক কিচিরমিচির করতে করতে নেমে এসে খুঁটে খুঁটে খায় আর হরেকরকম আওয়াজ করে। প্রত্যেকের ভাষা আলাদা, কিন্তু মিলেমিশে এক অনবদ্য ধ্বনি কানকে খুশিতে ভরিয়ে দেয়। জিনিয়া তার প্রিয় কবিতার সঙ্গে মিল খোঁজার চেষ্টা করে চলে-
‘গুটি ছয় পায়রা ও গুটিকত হাঁস রে
আমাদের ঘরে করে একসাথে বাস রে
আসে কাক একঝাঁক
করে শুধু হাঁকডাক
কোকিলের কনসার্ট শুনবি তো যাস রে’
সামনের উঠান পেরিয়ে উত্তরদিকে বাড়ির একটা গেট, মানে কাঠের ফ্রেমে টিনের দরজা। সেটার দিকেই একভাবে কান খাঁড়া করে কিছু শোনার চেষ্টা করছে জিনিয়া। মঞ্জরী বারান্দার পূর্বদিকে বসে পশ্চিম মুখ করে গমের ড্রাম, কুলা, চালন নিয়ে গম ঝাড়ছে।
টিনের গেট ও মুলিবাঁশের বেড়ায় ঘেরা বাড়িটি, তাই বেড়ার ওপর দিয়ে ওদিকে ঝন্টুদের বাগানের লম্বা লম্বা শাল, সেগুন, মেহগনি, কামরাঙ্গা, নারকেল সব গাছ স্পষ্ট দেখা যায়, প্রচুর পাখির বাস সেখানে। ঐ বড়ো গাছগুলোতেই আজ কদিন ধরে এইসব কাজ চলছে।
মা একটু ঘরে যেতেই বই গুছিয়ে একছুটে গেটের বাইরে, শিশু উদ্যান আর সমিতিঘরের মাঝের একচিলতে মাঠ এর সাথেই গলির রাস্তা। যেটা পাড়ার প্রধান রাস্তার শাখা। রাস্তার সাথেই ঝন্টুদের বাগান কাঁটাতারের বেড়া দেওয়া। সেখানে গিয়ে দাঁড়াতেই দেখে ছেলেমেয়েগুলো এসে গেছে। বছর উনিশ-কুড়ির তিনটি ছেলে, সাথে দুটো প্রায় সমবয়সী মেয়ে। তাদের গায়ে কতদিনের না কাচা কাপড় ও খাটো ধুতি। তেল-সাবানের যত্ন ছাড়া রুক্ষ ময়লা জট পেকে যাওয়া চুল। প্রত্যেকের কাঁধে পুরোনো কাপড়ের সেলাই করা পুঁটলি গোছের ঝোলা। একটি ছেলে বগলে ও বুকের সাথে জড়িয়ে রেখেছে এক গোছা নলের মতো বাঁশ।
জিনিয়া টিনের দরজার ফুটো দিয়ে কদিন দেখার চেষ্টা করেছিল যে ওরা কি করে ওখানে। তাই আজ সরেজমিনে তদন্ত করতে সরাসরি পৌঁছে গেছে। সে গিয়ে দেখতে পায়- সবথেকে বড়ো ছেলেটি গাছের মাথার দিকে অপলক চেয়ে একটি নলাকৃতি বাঁশকে ওপরে তুলছে সোজা করে। বাঁশটির আগায় বল্লমের আকৃতির খুব ছোট ধারালো একটা কিছু লাগানো আছে। একটি ছেলে একটা করে বাঁশ ওর হাতে এগিয়ে দিচ্ছে ও বড়ো ছেলেটি খুব সন্তর্পনে হাতে ধরা বাঁশের নীচে আরেকটি গুঁজে চলেছে। এইভাবে ছয়-সাতটি বাঁশ জোড়া দিতে দিতে গাছের মগডাল পর্যন্ত পৌঁছে গেল। সামান্য নীরবতা! কয়েক ফোটা রক্ত ছেলেটির কপালে ও নাকে। সেদিকে ওর বিন্দুমাত্র হুঁশ নেই।
বাকিদের মুখে খুশির ঝিলিক, একে অপরের মুখ দেখছে আর হাসছে। বাঁশগুলো যেমন জুড়ছিল ঠিক তেমনি করেই একটা একটা করে খুলতে লাগলো আর দৈর্ঘ্য কমতে থাকল। শেষেরটি বা প্রথমটির মাথায় ধারালো জিনিসের সঙ্গে বিধে ছটফট করছে একটি পাখি। তার পেট দিয়ে রক্ত পড়ছে। কি পাখি সেটা জিনিয়া চিনতে পারেনা। জিনিয়ার শিশুমন আতঙ্কিত হয়, চোখে জল। ছেলেটি পাখিটি উন্মুক্ত করে কাঁধের ঝোলাতে ঢুকিয়ে নেয়। ঢোকানোর সময় জিনিয়া দেখতে পায় ভেতরে আরও কটা পাখি।
একটু সাহস করে চোখে জল নিয়ে ওদেরকে জিজ্ঞাসা করে-
“তোমাদের কষ্ট হয়না, তোমরা পাখিটাকে মেরে ফেললে, কি করবে ওদের মেরে’?
জিনিয়ার কথায় ওরা একটুও সাড়া দেয়না। বাগানের কোনার দিকের গাছটার সামনে গিয়ে নতুন করে শিকারের খোঁজ করে। জিনিয়া আবার ওদের পাশে গিয়ে একই কথা বলে। বিরক্ত হয়ে ওদের মধ্যে একটি মেয়ে চিৎকার করে বলে-
“এই বেটি তুই ঘর যা তো! কাজের সময় শোওর করিসনা”।
জিনিয়াও ছাড়বার পাত্রী না। একই কথা আওরাতে থাকে। বাধ্য হয়ে মেয়েটি বলে ওঠে-
“তোরা তো খানাপিনা ঘরের লোক আছিস, তোদের তো খাওয়ার কোনো পরেশানি নাই। ভুখ কাকে বলে জানিস? জানবি বা কি করে! তোরা মাছ -মছলি, হাস, মুরগি, ছাগল, শুকর কতো কিছুর মাংস খরিদ করে খাস। আমাদের ভুখ মিটবে কিসে? আমরা তাই এইসব মারি তারপর পুড়াই। তেলমশলা খরিদের পয়সা নাই। বুঝলি! যা এখন ইখান থিকে”।
জিনিয়া মুখভার করে ফিরে আসে বাড়িতে। ওদিকে মঞ্জরী তো মেয়েকে না দেখতে পেয়ে ভাবছে কোথায় গেল এতোটুকু সময়ের মধ্যে! এমন সময় টিনের গেটটি আধা খোলা দেখতে পায়। এই সময়ে কেউ তো আসেনি, তবে গেট খোলা কেন? সাতপাঁচ ভেবে গেটের সামনে আসে। দেখতে পায় জিনা ঝন্টুদের বাগানের এদিকে দাঁড়িয়ে আছে। সেখানে কয়েকজন বড়ো ছেলেমেয়ে, কেমন নোংরা কাপড় চোপড় পরা, লগার মতো কিছু নিয়ে গাছে খোঁচা দিচ্ছে। মঞ্জরী ভেতর থেকে একটা বেত এনে গেটের সামনে অপেক্ষা করতে লাগল। আজ দু-ঘা বসাতেই হবে, বড্ড জ্বালায় এই মেয়েটি। বড়ো দুইজন ছেলেমেয়ে কত শান্ত আর ধীরস্থির। ওদের নিয়ে কোনো ঝক্কি পোহাতে হয়না। আর এই হয়েছে একজন! সবকিছুতেই বেশি উৎসাহ।
কিন্তু মেয়ে যে ফিরে এসেছে চোখে জল নিয়ে, মাকে জাপটে ধরে হাউমাউ করে কাঁদতে থাকে। ‘ও মা জানো! ওরা পাখিগুলোকে কেমন করে মেরে ফেলছে, কত রক্ত’। মঞ্জরীর রাগ সেই মুহুর্তেই বিদায় নেয়। বড্ড অসহায় লাগতে থাকে, কচিমনের আবেগ ও কষ্টের ওজন যে পরিণত মনের থেকে বহুগুন বেশি। মঞ্জরী জানে তার এই ছোট মেয়েটি যতই ডানপিটে হোকনা কেন মনটা ভীষণ নরম। পশুপাখিকে ভীষণ ভালোবাসে, মাংস খেতে চাইতনা কোনদিন। যদিও মঞ্জরীও কোনদিনই মাংস খায়নি, এই মেয়েও তাই। আগে জোর জবরদস্তি করে খাওয়াতো ওর বাবা-কাকা-দাদারা, এখন হাল ছেড়ে দিয়েছে। মেয়ের কান্না দেখে মঞ্জরীর যত রাগ থেমে যায়। ভেতরে এনে হাতমুখ ধুইয়ে জল খাওয়ায়। আজ যেন জিনিয়া একদম শান্ত লক্ষ্মী একটা মেয়ে। মঞ্জরীর কাছে মেয়ে কেমন অচেনা মনে হয়।
জিনিয়ার বাবা কাজের সুত্রে বাইরে থাকে। সন্ধ্যের মুখে বাড়ি এসেছে। বাবা বাড়িতে ফিরতেই জিনিয়া বাবার কাছে যায়। স্নেহাংশু মেয়ের চুপচাপ শুকনো মুখ দেখে বলে- ‘কি হয়েছে জিনা মায়ের আজ’? মেয়ে কাঁদতে কাঁদতে দুপুরের ঘটনা বাবাকে জানায়। প্রশ্ন করে- বাবা পশুপাখিদেরও তো বাবা মা আছে। ওদেরও ব্যাথা লাগে, কষ্ট হয়। তবে সবাই কেনো ওদেরকে মেরে ফেলে, আমাদের খাওয়ার জন্য তো কত কিছু আছে, তাও আমাদের মাংস খেতেই হয়। তোমরা জোর করে এইসব খাওয়াতে চাও। আমার কষ্ট হয় বাবা। তোমরা বড়োরা কেন এমন করো? কারও কোনো মায়াদয়া নেই!
মেয়ের প্রশ্নে বাবা খানিকটা অস্বস্তি বোধ করে। স্নেহাংশু নিজের মতো করে সহজ ভাষায় যুক্তি দিয়ে বাস্তুচক্র বোঝানোর চেষ্টা করে। পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করার তত্ত্ব জানায়। তারপর কাছে টেনে নিয়ে দুপুরের ঐ ছেলেমেয়েগুলোর সম্প্রদায় ও জীবনযাপনের কথা শোনায়। বলে-
“ওরা যাযাবর শ্রেণীর ব্যাধ সম্প্রদায়ের মানুষ। ওদের জীবনে বেঁচে থাকার প্রয়োজন ওদেরকে এইসব করতে বাধ্য করে। ওদের কোনো স্থায়ী ঠিকানা নেই, সরকারের কোনো প্রকল্পের আওতায় ওরা নেই। তবে এখন কেউ কেউ ছোটখাটো যোগালির কাজ করছে, কেউ টুকিটাকি ওদের হাতের কাজ তৈরি করে রাস্তায় বসে বিক্রি করে, বাকিরা ভিক্ষা করে একেক সময় একেক ঠাকুরের ছবি দেখিয়ে। এইভাবেই চলছে ওরা। তুমি কষ্ট পেওনা জিনামা।
বাবার কাছ থেকে চলে গিয়ে নিজের মতো করে চিন্তাভাবনার বাক্স খুলে বসে জিনিয়া। ছোট মনে কতরকম প্রশ্ন কত কথা শুধু ঘুরপাক খেয়েই চলেছে। হঠাৎ পড়ার টেবিলে রাখা পশুপাখিদের ছবির বই নিয়ে পাতা ওল্টাচ্ছে আর শুকনো মুখে অপলক তাকিয়ে দেখছে। বাবার বলা কঠিন কঠিন কথা সে বোঝেনি। বোঝার মতো বয়সই বা কোথায় হয়েছে! তার মনের মধ্যে কষ্টগুলো দলা পাকিয়ে একতাল জৈষ্ঠ্যের মাটি। ফেটে চৌচির অথচ বৃষ্টিতে ভিজিয়ে নরম করার মতো পরিবেশ ফেরার। বইয়ে পড়া কথার সাথে বাস্তবের মিল খুঁজে পাচ্ছেনা সে। মানুষের বুদ্ধি যদি সবচেয়ে বেশি হয় , তাহলে মানুষই কেনো অন্যদের এতো কষ্ট দেয় নিজেদেরকে ভালো রাখার জন্য!
আরও একটা কথা বারবার মন খারাপ করে দিচ্ছে জিনিয়ার, কিছুতেই ভুলতে পারছেনা- ‘আমাদের ভুখ মিটবে কিসে’?
আমার বাবা ছিলেন অত্যন্ত সাহসী একজন লড়াকু মনের মানুষ।শত অভাব অভিযোগেও তাকে কোনোদিন ভেঙ্গে…..
ভার্সিটির বাস ধরতে হয় আমাকে খুব সকালে। বাড়ি থেকে একটু হেঁটেই রিকসা। তারপর বাস। হাঁটা…..
আজকের সন্ধ্যাটা থমকে যাওয়া মেঘেদের। ঝিরিঝির বৃষ্টি ছিল দিনভর। ঢাকা শহরের পথঘাট জল কাদায় মাখামাখি।…..
জোছনা করেছে আড়ি আসে না আমার বাড়ি গলি দিয়ে চলে যায়, গলি দিয়ে চলে যায়…..