জীবনবাবুর জীবনলিপি

তন্বী হালদার
গল্প, পডকাস্ট
Bengali
জীবনবাবুর জীবনলিপি

কিছুক্ষণ আগে জীবনবাবুর পোস্টমর্টেম হয়ে গেছে। ডোম কাটাছেঁড়া করার পর ডাক্তারবাবু তার রিপোর্টে লিখেছেন –

দেহভঙ্গি – কিছুটা অস্বাভাবিক, তবে ঘুমন্ত মানুষের মতো।

মাথা – ডানদিকে হেলে আছে।

চোখ – আধবোজা। দু’ইঞ্চি।

মুখ – অল্প খোলা। জিব বেড়িয়ে গেছে, তবে দাঁত দেখা যাচ্ছে না।

নাসারন্ধ্র – শুকনো।

কান – পরিষ্কার।

হাত – সমান্তরালভাবে দেহের দুপাশে। আঙুলগুলো ছড়ানো অর্থাৎ করতল খোলা।

পা – সমান্তরালভাবে রয়েছে।

লিঙ্গ – ভেজা।

পায়ুদ্বার – মলত্যাগ হয়ে গেছিল।

স্বাস্থ্য – মাঝারি।

বয়স – একষট্টি বছর আঠের দিন।

মৃত্যুর কারণ – গলায় ফাঁস।

ডাক্তারবাবু এসব লিখে দেহের ভেতরকার অঙ্গগুলো ওষুধে ভিজিয়ে নিয়ে চলে গেলেন। এগুলো ময়নাতদন্তের জন্য কলকাতায় যাবে। জীবনবাবু বেঁচে থাকতে নৈহাটির বাড়ি ছেড়ে খুব ঠেকায় না পড়লে কদাচিৎ কলকাতা যেতেন। জীবনবাবু এখন কাটাকুটি করা একটা লাশ। ডোম সুরজ মণ্ডল খুব অভিজ্ঞ হাতে সেলাই করছে। মিলনী সিনেমা হলের কাছে যে মুচি বসে সেও ফুটবল লিক্‌ হয়ে গেলে অমনভাবে সেলাই করে। মেয়েদের স্কুলে এ সেলাই শেখায়। কাঁথা স্টিচ। চলতি কথায় দাঁড় সেলাই। জীবনবাবুর ফুসফুস তুলে নেওয়ার পর বুকের মাঝ বরাবর লম্বালম্বি জামার সব বোতাম খুলে রাখার মতো হা হয়েছিল। সুরজ সেই জামায় সেলাই করে দিচ্ছে। মাথার মাঝখানেও আড়াআড়িভাবে গণেশ পুজোয় দেওয়া নারকেলের মতো ফাটানো হয়েছে। কি সব মাথার ভিতর থেকে তুলে নিয়েছে। মাথার সেলাই হয়ে গেছে। এরপর সাদা কাপড়ে মাথা সুদ্ধু মুড়িয়ে শুধু মুখটা খোলা রেখে জীবনবাবুর দেহ হস্তান্তর করা হবে তার আপনজনদের হাতে। আপনজন বলতে দুই ছেলে, ছেলের বৌ, দু’জন নাতিনাতনি আর স্ত্রী। এক ছেলে ছিলেন জীবনবাবু। তাই ভাইবোনের কোনও গল্প নেই। আর তুতো সম্পর্কের যারা আছে তারাও বেশীরভাগ হেজেমজে গেছে। নতুবা ওপারে যাওয়ার পারানির কড়ি দিয়ে দিন গুনছে। আর তাদের ছেলেমেয়েরা আজকের দিনে কে কার খবর রাখে।

গল্পটির অডিও পাঠ শুনুন এইখানে:

জীবনবাবু মরে গিয়েও দু’ছেলে, ছেলে বৌদের মাথা হেঁট করে দিয়ে গেছেন। কারণ জীবন মুখার্জ্জী সম্পূর্ণ উলঙ্গ অবস্থায় সিলিং ফ্যান থেকে ঝুলছিলেন। পরনের লুঙ্গিটা দিয়েই গলায় ফাঁস দিয়েছিলেন তিনি। মলদ্বার থেকে মল পা বেয়ে গড়িয়ে লাল মেঝেতে পড়েছিল। গুয়ের গন্ধে মম করছিল  ঘরটা। ছোট ছেলের বৌ শুক্লাতো বমিই করে দিয়েছিল।

জীবনবাবুর স্ত্রী রমাদেবী সকালে চা দিতে এসে দেখে ভিতর থেকে দরজা বন্ধ। জীবনবাবুর ভোর পাঁচটায় ঘুম থেকে ওঠা বরাবরের অভ্যাস। কে জানে শরীর খারাপ হল কিনা! চিন্তায় কপালে ভাঁজ পড়ে রমার। খানিকক্ষণ ডাকাডাকি, ধাক্কাধাক্কি করার পর চায়ের কাপ হাতে বড় ছেলের ঘরে হাজির হয়। কাঁপা কাঁপা গলায় বলে – ও বাবু দেখতো তোর বাবার দরজা বন্ধ কেন? এত ডাকছি খুলছে না।

বিরক্ত হয় বড় ছেলে – আরে শরীরটরীর খারাপ হয়েছে বোধহয়। ঘুমাচ্ছে তাই। ঘুমাতে দাও না।

কথা বাড়ায় না রমা। চায়ের কাপটা নিয়ে রান্নাঘরে ফিরে আসে। ঠাণ্ডা চা মানুষটা একেবারে খেতে পারে না। তাই চাটা সিঙ্কে ফেলে দেয়। জাগলে পড়ে আবার বানিয়ে দেবে।

ছোট বৌমা ভরা মাসের পোয়াতি। তাই একটু বেলা করে ঘুম থেকে ওঠে। বড় বৌমা টোটোনকে স্কুলের জন্য তৈরি করছে। রমা বেশ কিছুক্ষণ ওভেনের সামনে জানলা দিয়ে আনমনা তাকিয়ে থাকে। সৌমেনদের বাড়ির উঠোনে বেশ কতগুলো শালিখ পাখি কিচিরমিচির করছে। সেই ছোট্টবেলায় শেখা একটা ছড়া মনে পড়ে যায় রমার –

জোড়া শালিখ নমস্কার
পা দুটো পরিষ্কার।
মাথা দুটো কালো
আজ দিনটা ভালো।

বড় বউমাকে প্রথম থেকেই ‘বড় বৌমা’ বলে ডাকে রমা। তাই বড় বৌমার টোটোনকে নিয়ে স্কুলের জন্য বাইরের গ্রিল খোলার শব্দে রান্নাঘরের বাইরে আসে রমা। একটু চাপাস্বরে বলে – বড় বৌমা।

সুপ্তি দাঁড়িয়ে যায় – পিছনে ডাকছেন কেন মা?

রমা এগিয়ে এসে বলে – তোমার বাবার ঘরের দরজা ভেতর থেকে বন্ধ। এত ডাকছি সাড়া দিচ্ছে না।

সুপ্তি হাতঘড়িটা একবার দেখে নিয়ে বলে – সেকি বাবা তো এতবেলা অব্দি তো  ঘুমায় না। আর একবার দেখুন না ডেকে। আমি যাই মা, আজ এমনিতে দেরী হয়ে গেছে। প্রেয়ার হয়ে যাবে। ছেলেটা বকুনি খাবে। ও হ্যাঁ, আজ আপনার ছেলের অফিসে খাওয়াদাওয়া আছে। চাল কম নেবেন।

ছোট ছেলে চোখ কচলাতে কচলাতে এসে বলে – মা চা দাও তো।

রমা ছোট ছেলেকে দেখে হাঁসফাঁস করে ওঠে – ও দেবু দেখ না তোর বাবা এখনও উঠছে না কেন? এত বেলা পর্যন্ত ঘুমাচ্ছে কেন? এত ডাকছি সাড়া দিচ্ছে না।

‘চলো তো’ বলে দেবু বাবার ন’ফুট বাই আট ফুট কামরা ঘরটার দরজায় জোরে জোরে ডাকতে থাকে। রমাও ধাক্কা দিতে দিতে ডাকতে থাকে – কি গো শুনছো। দরজাটা খোলো গো………।

দেবুর ডাকাডাকিতে বড় ছেলে ছুটে আসে। দুই ভাইতে চীৎকার চেঁচামেচি করে হাঁকাহাঁকি ডাকাডাকি, দরজা ধাক্কাতে থাকে। কেঁদে ফেলে রমা – ও বাবু, ও দেবু তোর বাবা সাড়া দিচ্ছে না কেন রে? ওগো শুনছো তুমি সাড়া দিচ্ছ না কেন? দরজাটা খোলো।

বাবু একটু থেমে গিয়ে বলে – ভাই দরজা ভাঙতে হবে। মা শাবলটা আনো।

ঘর ভর্তী থৈ থৈ করা অনেকদিনের চেনা প্রতিবেশীদের সামনে উলঙ্গ হয়ে সিলিং ফ্যান থেকে ঝুলছে জীবনবাবু। মেঝেতে পা বেয়ে টুপিয়ে পড়া পায়খানায় মাছি ভনভন করছে। দু’চারটে পিঁপড়ে শুঁকে শুঁকে চলে যাচ্ছে। প্রতিবেশীদের গুঞ্জন – ওনার কি মাথা খারাপ হয়ে গেছিল! নতুবা উলঙ্গ হয়ে কেউ আত্মহত্যা করে।

বড় বৌমা টোটোনকে স্কুলে দিয়ে ফিরে এসেছে। এই পরিবেশে তার একটি কথাই মনে হয় – ভাগ্যিস টোটোনকে স্কুলে দিয়ে এসেছি। নতুবা ওকে এই দৃশ্য দেখতে হত। মুখে বলে – মা খাটে উঠে বাবাকে লুঙ্গিটা পরিয়ে দিন।

দুই ছেলেরই একটি শব্দ মনে হয় – ছিঃ ছিঃ পাড়ায় মুখ দেখাব কি করে।

শুক্লা কিছু ভাবতে পারে না। মুখে হাত চাপা দিয়ে বেসিনে গিয়ে হড়হড় করে বমি করে দেয়।

রমার মাথাটা পুরো শূন্য হয়ে গেছে। শোকতাপ ভুলে হা করে চেয়ে থাকে। তারপর বড় বউমার তাড়ায় আলনা থেকে এই বিবাহবার্ষিকীতে রমারই দেওয়া বাটিক প্রিন্টের লুঙ্গিটা এনে স্বামীকে পরিয়ে দেয়। পরানোর সময় শরীরটা একটু দোল খায় জীবনবাবুর। তারপর একটা ব্লাউজ ছেঁড়া নিয়ে এসে মেঝের পায়খানা পরিষ্কার করে ফিনাইল ঢেলে দেয়। দুই ছেলে আর দু’একজন প্রতিবেশী মিলে জীবনবাবুর দেহটা নামিয়ে মেঝেতে শুইয়ে দেয়।

রমা শুধু বলে – বাবু তোর বাবার গলার লুঙ্গির ফাঁসটা খুলে দে না রে। এই প্রথম রমাদেবীর এই প্রথম মনে হয় লুঙ্গির ফাঁসটা খুলে দিলে জীবনবাবু উঠে বসে চা চাইবে।

কে যেন বলে – খবরদার না। বডি নামানোটাই ঠিক হল না। পুলিশ কেস কিন্তু।

রমা স্বামীর পাশে চুপ করে বসে থাকে। এই প্রথম তার কান্নায় বুকের ভিতরটা মোচড় দিয়ে ওঠে। কেন মানুষটা এমন কাজ করলো ভাবতে গিয়ে শব্দহীন হাহাকার করা হুহু কান্নায় কেঁপে কেঁপে ওঠে পাতলা শরীরটা।

বড় বৌমা স্বামীর দিকে তাকিয়ে বলে – টোটোন স্কুল থেকে ফেরার আগে বাবাকে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা কর।

পুলিশ এসে ঘরময় তছনছ করে যা যা পেয়েছে তাতে বাড়ির সকলের এমনকি রমারও চিবুক বুকের সাথে লেগে গেছে। জীবনবাবুর আলমারি থেকে পাওয়া গেছে বেশ কিছু নীল ছবির বই, খানকয়েক সিডি। বিভিন্ন ব্র্যান্ডের কন্ডোমের প্যাকেট আর একটা ডাইরি।

তিনদিনের অশৌচ মেনে পুলিশের ডাকে দুই ছেলে, বড় বৌমা, রমা থানায় যায়। শুক্লার শারীরিক অবস্থার কথা ভেবেই তাকে নিয়ে যাওয়া হয় না। টোটোন কাকিমার কাছে থাকে। সদ্যবিধবা রমার পরনে নীল পাড় সাদা থান। রমা ছাড়া সকলেই বিরক্ত।

থানার আইসি বলে – অনেকদিন তো চোর ডাকাত ঘাটাঘাটি করছি তবে আপনার বাবার ডাইরিটা পড়ে মনে হল থাপ্পড় খেলাম একটা। আমার বাড়িতেও বাবা মা আছে। মা আমার কাছে আর বাবা দাদার কাছে ছিল। ডাইরিটা পড়ে বাবাকে নিয়ে এলাম নিজের কাছে। ডাইরিটা পড়ি কেমন – শুনুন আপনারা –

৩১.১২.২০১১ – আজ আমার কর্মজীবনের সমাপ্তি। পঁয়ত্রিশ বছরের শেষ। কর্মজীবনের ছুটি। আজ অফিসে সকলে আমার সাথে যেচে সেধে কথা বলল। যেন ভিক্ট্রি স্ট্যান্ডে দাঁড়ানো আমি কোন বিজয়ী। আজ আমায় ঘিরে ফেয়ার ওয়েল উৎসব। সৌমিক ছেলেটা নাজির পোস্টে বেশ করিৎকর্মা। আজই পিএফ আর লিভ-এর চেকটা হাতে ধরাবে বলে প্রচুর ছোটাছুটি করলো। অবশ্য বিল সেকশনে শীর্ষেন্দু, পুষ্পেন, রেন্টু, অরুণ এরাও খুব খেটেছে। আজ আমাকে ঘিরে সন্ন্যাসীর গৈরিকে রাঙা হয়েছে সবার মন। রমাকে আসতে বলেছিলাম। দাদুভাইয়ের শরীর খারাপ তাই আসতে পারলো না। আমার সম্বন্ধে সকলেই ভালো ভালো কথা বলল। আর একমাস পরে কাজল দিদিমণি আর অরুণের বিদায়ের বাঁশি বাজবে। ওরা বলতে গিয়ে কেঁদেই ফেলে।

স্টেশন থেকে হাঁটা পথের বাড়িটায় আজ রিক্সায় বাড়ি আসলাম। দু’হাত ভর্তী উপহার। ফুল, মিষ্টি, বই, পেন, শাল। কাঁধে বহুদিনের সঙ্গী ব্যাগটাও আছে। রমাকে দেখলাম বারান্দার গ্রিল ধরে দাঁড়িয়ে আছে। আমায় দেখে তাড়াতাড়ি দরজা খোলে। হাতের থেকে দু’তিনটে প্যাকেট নিয়ে হাসিমুখে বলে – বা বা ওরা কতকিছু দিয়েছে গো। হ্যাঁ গো আজ সব্বাই এসেছিল? বড় সাহেব নিশ্চয়ই তোমার খুব প্রশংসা করলো। উনি তো তুমি না হলে এক পাও চলতে পারেন না। রমা একটা হাফ ছেড়ে বলে – যাক্‌ বাবা। তোমার ছুটি হয়ে গেছে বাঁচা গেছে। দেবুর আর আঠাশ দিন পর বিয়ে এবার একটু হাল ধরো দেখি। আমি আর ঘর বাইরে করতে পারছি না।

আজ খাওয়ার টেবিলে জানলাম বাবু অফিসের কাজে পঁচিশ দিনের জন্য ধানবাদ গেছে। টোটোন অসুস্থ। তাই বাবু পইপই করে মাকে বড় বৌমার সাথে রাতে শুতে বলেছে। আজ খুব ইচ্ছা করছিল রমাকে বুকের ভিতর নিয়ে সেই আগের মতো সারারাত গল্প করবো। রমা বলতো – বকবকম, বকবকম শেষ করে ঘুমাও এবার।

২৫.০১.২০১২  – আর তিনদিন বাদে দেবুর বিয়ে। বাবু আজ ফিরেছে ধানবাদ থেকে। এ কদিন রমা বড় বৌমার সঙ্গেই ঘুমাচ্ছে। যদিও টোটোনের শরীর ভালো হয়ে গেছে। একদিন রমাকে বলেছিলাম – তুমি আজ আমাদের ঘরে এসো। রমা প্রায় খুব জঘন্য কোন প্রস্তাব শুনেছে এমনভাবে বলে – ছি ছি কি যে বল তুমি, বাবু পইপই করে বলে দিয়েছে মা তুমি সুপ্তির সাথে রাতে শুয়ো। রিটায়ারমেন্টের পর তোমার ভীমরতি ধরেছে। হঠাৎ করে মনে হয় রমা আমার ত্রিশ বছরের পুরনো বউ তার নাগাল পেতে এত কষ্ট হচ্ছে কেন! বাবু ফিরে রাতে দেবুকে নিয়ে আমার কাছে আসে। বলে – বাবা দেবু বিয়ে করে তিনদিন বাদ থেকে কোথায় থাকবে ভেবেছো?

মাথা নাড়ি – সত্যি না, এসব তো ভাবা হয় নি।

দেবু অনেকদিন ধরে এক সহপাঠিনীর সঙ্গে প্রেম করে। তিনমাস হল দেবু চাকরি পেয়েছে। মেয়েটির বাবা মা আর এক মুহূর্ত দেরী করতে চায় না। তাই তড়িঘড়ি বিয়ে। রমা দরজার পাশে দাঁড়িয়ে ছিল। বাবু মায়ের দিকে তাকিয়ে বলে – বলছিলাম দেবুতো বছর খানেকের মধ্যে ফ্ল্যাট কিনবে। ততদিন ভেতরের বারান্দাটায় কাঁচের শার্শি লাগিয়ে দারুণ ঘর বানিয়ে দিচ্ছি। বাবা থাকুক আর তুমি টোটোনকে নিয়ে দেবু এখন যে ঘরটায় আছে সেখানটায় থাকো।

আমি ভেবেছিলাম রমা আপত্তি জানাবে কিন্তু রমা ঘাড় কাৎ করে সায় দিল। অভিমানে ভেতরটা গুড়গুড়িয়ে ওঠে – বললাম তোদের মার যখন আপত্তি নেই ………।

দেবু ছোট বাচ্চার মতো আব্দার করে – মা এই তিনদিন কিন্তু আমার কাছে ঘুমাবে।

রমাকে দেখলাম গদগদ হয়ে বলল – তিনদিন পরে বিয়ে, পাগলামি গেল না এখনও।

মনে মনে রমাকে সাবধান করি, রমা তোমার সন্তানেরা আর কেউ ছোটও নেই পাগলও না। ওদের থেকে সাবধান হও।

৩০.০১.২০১২ – দেবুর বৌভাত। আজ থেকে আমি আমার কাঁচের ঘরে থাকবো। নিজেকে সাজাহান সাজাহান মনে হচ্ছিল। রমা একটা চওড়া লালপেড়ে গরদ, ঢাকাই কানের, দুহাতে শাঁখা পলা নোয়ার সাথে চূর, গলায় সীতাহার পড়েছে। হারটা আমার মায়ের। রমার মুখ দেখে দিয়েছিল। আমি গিলে করা ধুতি, পাঞ্জাবী, চেন, সোনার বোতাম পরেছি। খুব ইচ্ছা করছে রমাকে একবার সামনে নিয়ে মুখটা ধরে বলি – তোমায় কি সুন্দর দেখাচ্ছে গো। সখি “দেহি পদপল্লব মুদারম”।

রমা ঠোঁট টিপে হেসে বলুক – মরণ।

কাঁচের ঘরে সারারাত ঘুম হল না। হঠাৎ মাথায় কি খেয়াল হল খবর কাগজ থেকে কামনাশক্তি বর্ধক একটা ছবি কাঁচি দিয়ে কেটে আলমারিতে তুলে রাখি। তারপরই দেখলাম নিভু নিভু রাতে ঘুম চলে আসে।

২৮.০২.২০১২ – আমি আর রমা এখন দুই ভিন্ন গ্রহের বাসিন্দা। সকালে চা দিতে আসে। তখন ওর রাজ্যের ব্যস্ততা। আমায় রাগ দেখায় – কি গো তুমি রিটায়ারের পর থেকে একেবারে গর্তে চলে গেলে নাকি?

খুব উৎসাহের সঙ্গে বলে উঠি – চল রমা কাল থেকে তুমি আর আমি মর্নিংওয়াকে যাই।

সঙ্গে সঙ্গে ঝাঁঝিয়ে ওঠে রমা – তোমার কি সত্যি সত্যি বুদ্ধি সুদ্ধি লোপ পেল নাকি? ঘরে নতুন বউ। তাছাড়া টোটোন এখন স্কুলে যায়। বড় বৌমা ওকে একা সামলাতে পারে না। সকালে টোটোনকে স্কুলের জন্য তৈরি করা কি ঝক্কি যদি একবার দেখতে। কি সুন্দর সব ইংরাজি পদ্য শিখেছে। বাচ্চাটা নিজে থেকে না এলে ডাকোও না তো।

মুখটা ঘুরিয়ে নিয়ে বলি – বাংলা পদ্য শিখলে বলো, সেদিন ডাকবো।

খালি চায়ের কাপটা নিয়ে রাগ করেই উঠে যায়। বিকালে অটো করে ব্যান্ডেল আসি। বিনা কারণেই। এদিক ওদিক খানিক ঘোরাঘুরি করে চারটে রসগোল্লা খাই। তারপর ছোট একটা বুকস্টল থেকে দুম করে একটা শরীরী সম্পর্কের ম্যাগাজিন কিনে ফেলি। মনে হল রমার উপর একটা আচ্ছা শোধ নেওয়া গেল।

২৬.০৩.২০১২  – ক’দিন ধরেই ভাবছিলাম একটা ল্যাপটপ কিনবো। অফিসে কাজ করতে করতে কম্পিউটারটা শিখে গেছিলাম।

১৪.০৪.২০১২  – ল্যাপটপ কিনে আনলাম। বাবু, দেবু, বৌমারা এমনকি টোটোন পর্যন্ত দেখতে এলো। রমাও এলো। তবে এসে বলল – কি দরকার ছিল শুধু শুধু কতগুলো পয়সা খরচ।

রমাকে বলি – এসো রমা তোমার একটা ছবি তুলি। ল্যাপটপের ওয়ালপেপার করে রাখবো।

রমা চরম অস্বস্তিতে পড়ে। শুক্লা খিলখিল করে হেসে উঠলে ফস করে বলে উঠি – হাসছ কেন? দেবু তোমার একা ছবি তোলে না?

কেউ কোনও কথা না বললেও বুঝতে পারি পরিবেশটার ছানা কেটে দিলাম। বেশ করলাম। রমা হঠাৎ ফুঁপিয়ে উঠে আঁচল চাপা দিয়ে ঘর থেকে বেড়িয়ে যায়।

১৬.০৬.২০১২ – আমি আজকাল বাড়ির কোন ব্যাপারেই থাকি না। রমা মাঝে মধ্যে আসে। খুচরো কিছু কথাবার্তা বলে চলে যায়। ওর কথার বেশীরভাগ জুড়েই থাকে টোটোনের দৌরাত্ম্য। আজ একটা লাল পেড়ে শাড়ি পরে পুজোর প্রসাদ, প্রসাদী ফুল নিয়ে এসেছিল। খুব খুশী খুশী দেখাচ্ছিল। মাথায় প্রসাদী ফুল ঠেকিয়ে হাতে একটা কালাকাঁদ দিয়ে বলে – সুখবর আছে একটা, শুক্লা মা হতে চলেছে। তুমি আবার দাদু হবে।

খবরটা সত্যি ভালোই লাগে। অনেকদিন বাদে বাড়িতে সদ্যোজাত একটা শিশুর কান্না শুনতে পাবো।

রমা আবার বলে – রাজারহাটে দেবুর সেই কোওপারেটিভের ফ্ল্যাটটা হয়ে গেছে।

চুপ করে থাকি। টোটোন ঘরে ঢোকে। অনেকদিন বাদে টোটোনের সঙ্গে গল্প করতে ইচ্ছা করে। বলি – বস দাদুভাই, তোমার স্কুলের গল্প শুনি। টোটোন একটু আড়ষ্ট হয়ে খাটে উঠে বসে।

০৩.০৭.২০১২ – আজ রমার সঙ্গে ঝগড়াই হয়ে গেল। কেননা রমাকে বলেছিলাম রমা তুমি দাদুভাইকে আজ ওর বাবা মায়ের সঙ্গে ঘুমাতে পাঠাও। তুমি আমার কাঁচের ঘরে এসো। এমন কথা শুনে রমা লজ্জা, ঘেন্না, রাগে ফেটে পড়ে। চাপা গলায় ঝগড়া করে – তুমি কেমন অসভ্য মানুষ বলতো। বাড়ি ভর্তী ছেলে, ছেলের বউ, নাতি আর আমি তোমার কাছে শুতে আসবো! বলি হ্যাঁগো তোমার যত বয়স বাড়ছে তত মাথাটা খারাপ হয়ে যাচ্ছে। দুপদাপ শব্দ করে ঘর থেকে বেড়িয়ে যায় রমা।

১২.০৮.২০১২ –  আমি বাড়ির সকলের সঙ্গেই প্রায় কথা বলা বন্ধ করে দিয়েছি। রমা কাজের মেয়েটাকে দিয়ে চা পাঠায়। আজ দুটো নীল ছবির সিডি কিনে এনেছি। রাতে চালিয়ে দেখলাম। ভালো ঘুম হল।

২৮.০৮.২০১২ – আজকাল প্রায় আমি বিভিন্ন ব্র্যান্ডের কন্ডোম কিনি। ভালো লাগে। আলমারির লকারে রেখে দিই। ভালো লাগে। আরও দু’তিনটে সিডিও কিনেছি। ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখি। ভালো ঘুম হয়। বাইরের কারও সঙ্গে মিশতে আজকাল একদম ভালো লাগে না। চুপচাপ সারাদিন কাঁচের ঘরেই কাটাই। দিনের ভাত, রাতের রুটিও এ ঘরে এনে দিয়ে যায় কেউ না কেউ।

০৩.১০.২০১২ –  শুক্লার আজ সাধ দিচ্ছে রমা। স্ত্রী আচার নিয়ে খুব ব্যস্ত। আমায় একবার সাধ দেবে রমা? তোমার স্বাদ?

০৪.১১.২০১২ শুক্লা বাপের বাড়িতে বাচ্চা হতে গেছে। ফিরে এসে ওরা নতুন ফ্ল্যাটে উঠবে। সঙ্গে রমাকে নিয়ে যাবে। না আর নয়। এবার রমার মুখোমুখি হতে হবে।

৩০.১২.২০১২ রমা জানালো ওকে নাকি শুক্লার বাচ্চা সামলাতে কিছুদিনের জন্য যেতেই হবে। রমার সাথে কথা বলার ইচ্ছেটা মরে যায়।

৩১.১২.২০১২  রমা সংসারে তোমায় নিয়ে বড় টানাটানি। তাই তোমায় ছুটি দিলাম। আমার সকল দাবী থেকে তুমি মুক্ত। আর কিছুক্ষণ পরে নিজেকে মেরে ফেলবো আমি। আত্মহত্যা। তুমি তোমরা ভালো থেকো রমা। আমার মৃত্যুর জন্য তোমরা কেউ দায়ী নও, এমনকি আমি নিজেও। ঐ যে মন্দ্রিত হচ্ছে মহাকালের ডমরুধ্বনি। জড়ের বিরুদ্ধে চিৎ করলো বিদ্রোহ ঘোষণা। বিদায়।

রমা ডুকরে কেঁদে ওঠে। বাবু, দেবুও কাঁদছে। বাবার জন্য আর তাদের কোনও লজ্জা বা অপমানবোধ কাজ করে না। কি যেন অপরাধবোধে নুয়ে পড়ে শরীর, মন।

রমা চোখ মুছে বলে – বুঝলে বড় বৌমা আজ থেকে আমি ঐ  কাঁচের ঘরটায় থাকবো।

অফিসারও ছলছল চোখে ডাইরিটা বন্ধ করে।

এই বিভাগের অন্যান্য লেখাসমূহ

বালির বেহালা

বালির বেহালা

বুড়িমাসি বলেন,জীবনটা বালির ঘর গো।ঢেউ এলে ধুয়ে যায় জীবনের মায়া।তবু বড় ভালবাসা ওদের দাম্পত্যে।রোদের চাদরের…..

তদন্ত

তদন্ত

  এক ড্রইং রুমে বসে রয়েছে সদ্য কিশোর উত্তীর্ণ তরুণ গোয়েন্দা সজীব। সামনের টেবিলে ছড়িয়ে…..