ইমন কল্যাণ
পরিচ্ছেদ ৫ আকাশে এখন আর মেঘ নেই। হাওয়া হচ্ছে।কদিন পরেই বর্ষা নামবে।একদিন হাসপাতাল থেকে ফিরতে…..
জীবনটা ঠিক ছবির মত। মনখেয়ালের তুলিতে রাঙানো যায় জীবনের ক্যানভাস।
ইংরাজী ১৯২০ সাল।বৃটিশদের বিরুদ্ধেলড়াই চলছে জোর কদমে।তখনকার সময়ে রায় পরিবারের সুমনের জীবনের ঘটনা।সুমন যাত্রাদলে বাঁশি বাজায়।আর গোপনে বিপ্লবীদের সাহায্য করে নানারকমভাবে। ঠিক একশো বছর আগে রাশিয়ার অক্টোবর বিপ্লব বিশ্বের আরও অনেক দেশের মতো ভারতেও কমিউনিস্ট আন্দোলনের জন্ম দিয়েছিল।গত শতাব্দীতে ভারতের বামপন্থী রাজনীতিও নানা ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্যে দিয়ে গেছে, আর তাতে অক্টোবর বিপ্লব তথা সাবেক সোভিয়েত রাশিয়ার একটা গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ছিল আগাগোড়াই।রুশ বিপ্লবের নায়ক ভ্লাদিমির লেনিন বা তার উত্তরসূরী স্তালিন একটা পর্বে ভারতের কমিউনিস্টদের প্রবলভাবে আলোড়িত করেছেন, কিন্তু পরে চীনের সাংস্কৃতিক বিপ্লব বা মাও জে দংয়ের আবেদনই যে ভারতের বামপন্থীদের কাছে বড় হয়ে ওঠে তাতেও বোধহয় কোনও ভুল নেই।কিন্তু ভারতে কমিউনিস্ট আন্দোলনের ইতিহাসে একশো বছর আগেকার সেই অক্টোবর বিপ্লব ঠিক কীভাবে ছায়া ফেলেছে?বিশ্ব জুড়ে কমিউনিস্ট আন্দোলনের একটা মূল কথাই হল আন্তর্জাতিক সংহতি বা সলিডারিটি। সুদূর রাশিয়ার বলশেভিক বিপ্লবের ঢেউ ভারতে আছড়ে পড়েই যে এদেশে কমিউনিজমের বীজ রোপিত হয়েছিল তা নিয়ে ঐতিহাসিকদের মধ্যে কোনও দ্বিমত নেই। পাঁচ ছেলের পরে আবার পুত্রসন্তান হয়েছে রায় পরিবারে।খুব সুন্দর দেখতে হয়েছে।কোনো লোকের যাতে নজর না লাগে তাই নাম রাখা হলো কালো। সুমনবাবু খুব খুশি।সুমনবাবুর বোন সুমিতাও খুব খুশি।সুমনবাবু খুব ভালো বাঁশি বাজান।যাত্রাদলে রাতের পর রাত তাকে বাঁশি বাজাতে হয়।আড় বাঁশি।তাই বেশির ভাগ রাতে তিনি বাড়ি ছেড়ে থাকেন।যাত্রাদলের মেয়ে রূপসী সুমনকে ভালোবাসে।সুমন সুদর্শন।ভালো চিত্রশিল্পী।সুমনরা দুই ভাই।বিমল তার ছোটো ভাই।সুমনের বৌ খেনী আর বিমলর বৌ কুড়ো।একদিন খেনী,কুড়ো আর বিমল গঙ্গায় স্নান করতে গেলো।বিমল সাঁতার জানে না।তাই কুড়ো বললো,বেশিদূর যাবে না। ভয় লাগে।
—-ঠিক আছে যাব না।
কিন্তু জোয়ারের টানে ভেসে গেলো কুড়োর সিঁদুর।বিমলকে খুঁজে পেলো না কেউ।তারপর কুড়োর সুন্দর চুলের বেণী কেটে ঝুলিয়ে রাখা হলো বাড়ির মাচায়।কুড়ো বাল্যবিধবা হলো।চিরজীবন বয়ে বেড়াবে কয়েক দিনের বিয়ের জীবনের স্মৃতি।খেনীর ছেলে কালো।খেনী নিজেওযেমন সুন্দরী আবার ছেলেটিও তাই।মহিলামহলে খেনীর রূপের খুব সমাদ। সুমন বাড়ি এলে বলে,তো মাকে আর বাঁশি বাজা তে হবে না।জমি জায়গা দেখাশোনা করার পর আমাদের আর কোন অভাব থাকবে না ।
সুমন বললো,দেখো আমি শিল্পী মানুষ।জমি জায়গা নিয়ে আমি থাকতে পারবো না।
—-পারবো না বললে হবে না। ছেলে মানুষ করতে হবে।জমি বেদখল হয়ে যাবে।
—-আমাকে বোঝার চেষ্টা করো দয়া করে।আমি শিল্পী মানুষ।আমি বাঁশি ছাড়া মৃত।আমাকে রেহাই দাও।
খেনী চোখের জলে অন্য ঘরে চলে গেলো।তার সংসারের চিন্তায় মন খারাপ হয়ে গেলো।আজ রাতে গান নেই।তাই ছুটি। বাড়িতেই আছে।তবু রাতে বৌ এর কাছে না থেকে বাগানে বাঁশি বাজায় সুমন।তার সুর শুনে খেনীর ভয় হয়।এই আপদ বাঁশি তার সংসার ভেঙ্গে দেবে না তো? এই চিন্তায় খেনী রাত কাটায়। আর সুমন সারা রাত রূপসীকে মনে রেখে বাঁশি বাজায় ক্ষণে ক্ষণে।তারপর রাত পোহালেই চা, মুড়ি খেয়ে বেরিয়ে পরে সুমন।আজ যাত্রা আছে।মীরার বঁধুয়া।মুরা রী বাঁশি মুখে ধরে থাকবে আর আড়াল থেকে বাজবে সুমনের বাঁশি।আজ কৃষ্ণ সাজবে মুরা রী। মীরা মুগ্ধ হবে সুরে।রূপসী আজ মীরা সাজবে।কত লোকে হাততালি দেবে।পুরষ্কার পাবে মুরারী।রূপসী জানে, দলের সবাই জানে বাহাদুর বংশীবাদকের বাহাদু। তবু মুরারী নামের কাঙাল সেজে কপটতা করে।সুমনের তর উপর রাগ হয় না। কৃপা হয়। রূপসীর পিছন পিছন ঘুর ঘুর করে মুরারী।কিন্তু রূপসীর মন পায় না। রূপসী আড়ালে সুমনকে বলে,ডিম,দুধ খাবে।আমার কাছে আসবে।আমি দেবো।
—আমার বেশি খেলে বদহজম হয়।হাল্কা মুড়ি আমার প্রিয়।
—-না না।মুখ দিয়ে রক্ত উঠবে।
—-বেশি খেলে আমার বাজাতে কষ্ট হয়।
—-ঠিক আছে।আমার কাছে এসে তুমি যখন বাঁশি বাজাও আমার মনটা কেমন হারিয়ে যায়।
—-জানি আমি।তোমার জন্য আমি বাঁশি বাজাই।তুমি আমার বাঁশি শুনলেই হবে।আর কাউকে চাই না।
সুমন বাঁশি বাজানোর সঙ্গে কোনো আপোষ করে না। তাতে না খেয়ে থাকতে হলেও থাকবে।কোনো আপত্তি নেই।অপরদিকে রাবণ অপেরা এদের প্রতিদ্বন্ধি।তারা সুমন কে নিজেদের দলে আনার জন্য নানারকম রাজনীতি করে। কিন্তু সুমন দল ছাড়বে না। মুরারী অপেরায় তার প্রিয়া রূপসী আছে। তাকে ছেড়ে কি করে সে বাঁশি বাজাবে।রাবণ অপেরার ম্যানেজার বললো , তোমার খুব অহংকার। আচ্ছা তোমাকে আমরা দ্বিগুণ টাকা দেবো।আমাদের দলে এসো।
—-না আমি পারবো না। আমাকে ক্ষমা করে দেবেন।
—আচ্ছা তোমাকে দেখে নেবো।
নিরহঙ্কার সুমনের লোভ নেই। সে সুরে সুরে মহাসুরের সঙ্গে মিলতে চায়।সুমনের ছয় ছেলের মধ্যে এখন শুধু বেঁচে আছে কালো।একবার গ্রামে ওলাউঠা হয়েছিলো।সেই মহামারিতে মরে গেছে সুমনের পাঁচ সন্তান। খেনীর এখন একমাত্র ভরসা এই কালো।সে ভাবে,তাকে মানুষ করতে হবে।বাবার মত বাউন্ডুলে যেনো না হয়।ভাগীদার গণেশ হাজরা জমি দেখাশোনা করে। সুমন ছমাসে,নমাসে একবার বাড়ি আসে। টাকা পয়সা মাঝে মাঝে পাঠায়। এইভাবে সময়ের তালে তালে কালো পড়াশোনা শিখে বড় হতে থাকে।কেতুগ্রামের মেনকা সম্পর্কে খেনীর আত্মীয়।রূপে,গুণে,সংগীতে মেনকার জুড়ি মেলা ভার।পড়াশোনায় তার সমকক্ষ কেউ নেই।মেনকা গ্রামের আপদে বিপদে সকলের আগে এগিয়ে যায়। গ্রামের লোকেরা খুব ভালোবাসে মেয়োটিকে।ক্ষ্যান্তবুড়ি মরে গেলে মেনকা চাঁদা তুলে পাড়ার দাদাদের নিয়ে তার শবদাহ করেছিলো।গ্রামের বয়স্ক লোকেরা তাকে দুহাত তুলে আশীর্বাদ করেছিলেন।মেনকা নিজে একজন স্বাধীনচেতা তরুণী। নিজেকে সুপ্রতিষ্ঠিত করে সমাজের মঙ্গল করাই তার লক্ষ্য।তার জন্য তিলে তিলে নিজেকে সে উপযুক্ত করে তোলে।এই গ্রামে এক সুদখোর লোক ছিলো।গরীবদের কাছে সে দশ শতাংশ হারে সুদ নিত।দেনা শোধ না করতে পারলে জমি জায়গা সোনাদানা কেড়ে নিত।মেনকা এই লোকটাকে দেখতে পারত না। তাকে দেখলেই রাগ হয়ে যেত।জব্দ করার ফন্দি আঁটত দিনরাত।মেনকা কৃষক পরিবারের সন্তান।সে হাঁস পুষত।তার হাঁসগুলো যখন ডানা ঝাপটে জলে নেমে ডুব দিত তখন সেও হাঁস হয়ে ডুব দিত অতল জলে।মক্ত খোঁজার আশায় তার ডুব। ডুবে ডুবে কখনও তার বেলা বয়ে যেত।কিন্তু মুক্ত তার অধরা রয়ে যেত। রাতে সে শিক্ষা নিত চাঁদের বাগানে।তার শিক্ষক বলতেন,চাঁদের বুকে অই যে কালো কালো দাগ দেখছো অইগুলো কলঙ্ক।তবু একটা তৃণ অবধি পৌঁছে যায় তার আলো।কাউকে বাদ দেয় না সে।তিনি মেনকাকে বলতেন, জীবনে যতই বাধা আসুক। এগিয়ে যাবার পথ থেকে সরে আসবে না। একদিন ঠিক সফলতা তোমার সঙ্গে সঙ্গে হাঁটবে।তারপর সকালে উঠেই মেনকা বই হাতে যায় শিক্ষকের বাড়ি। সঙ্গে ছাগল,ভেড়া, হাঁস।তাদের যথাস্থানে রেখে তারপর শিক্ষকের বাড়ি যায় ।
সুদখোর মহাজন মেনকাকে দেখে বললো,এই সুন্দরী শোন। এদিকে আয়।
মেনকা বলে,কি বলছেন বলুন?
—–একবার দুপুর বেলায় আমার সঙ্গে আমার বাড়িতে দেখা করিস তো।
—কেন? আমার সঙ্গে কি কাজ?
—গেলেই জানতে পারবে।মহাজন এমনি ডাকে না। তোমার কপালে আজ প্রাপ্তি্যোগ আছে। যেও বেশ।
—এমন আদরের ডাক কি আর ফেলতে পারি।যাব।
ঠিক দুপুরবেলায় মেনকা তার দলবল নিয়ে হাজির হলো মহাজনের বাড়ি।সবাই ভূতের সাজে উঠে পড়েছে আম গাছে।পাকা আম। সব পেড়ে খাচ্ছে সকলে।মেনকা সাদা শাড়ি পরে কড়া নাড়লো মহাজনের দরজায়।মহাজন বাইরে বেরিয়ে মেনকাকে দেখে পাগলপ্রায়।গায়ে হাত দিয়ে বলে, আয় ভেতরে আয়।
—-যাব,?আমরা ভূত পেত্নির দল তোর বাগানে থাকি।আজ মেনকার সাজে তোর কাছে এলাম। অই দেখ তোর বাগানে কত ভূত।
মহাজন খুব ভিতু।ভূতের ভয়ে সে রাতে বাইরে বেরোয় না। ভয়ে বললো,তোরা ভূত।ওরে বাবারে, আমার সব আম শেষ করে দিলো রে।
সঙ্গে সঙ্গে মহাজনের গালে এক থাপ্পড়।মহাজন জোড় হাতে ক্ষমা চাইছি।আমাকে ছেড়ে দাও।
—-ছেড়ে দিতে পারি।একটা শর্তে।যত দলিল,সোনা তুই চুরি করেছিস সবাইকে ফেরত দিবি।তা না হলে আবার আসবো।
—না না। আমি সব দিয়ে দোবো।আমি আর সুদের কারবার করবো না।
তারপর কিছুদিন পর সুদখোর মেনকার বাবার জমির দলিল ফেরত দিয়েছিল। হয়ত ভূতের ভয়ে তা না হলে লোকবলের ভয়ে।মেনকার বাবা বলতেন,মনে রাখবি মা,জল জল গঙ্গাজল।আর নল,বল লোকবল। বল বা শক্তির মধ্যে লোকবল শ্রে। তার প্রমাণ মেনকা হাতেনাতে পেলো।সুদখোর মেনকার সামনা সামনি হয়নি আর কোনো দিন।মেনকা জানে,ওরা সবলের ভক্ত আর দূর্বলের যম।মেনকার সঙ্গে সবসময় বন্ধুরা থাকত।প্রায় বিশ পঁচিশজন গ্রামের ছেলেময়ে খেলা করত একসাথে। দলবল নিয়ে গ্রামের বিভিন্ন সমাজসেবা মূলক কাজ করত নিঃস্বার্থভাবে।মেনকা এইভাবে বড় হতে লাগলো।তারপর সে গ্র্যাজুয়েট হলো।তার বাবা এখন খুব খুশিমনে কৃষিকাজ করেন।
😍😍😍😍😍😍😍😍
সুমনের বাঁশি বাজানো দেখে লাইনের অনেকে হিংসা করে।রূপসী বল,ভালো কাজ করলেই শত্রু বেড়ে যায়।সুমন বল,ছেড়ে দাও ওসব কথা।এসো আমরা সাধনা চালিয়ে যাই।তারপর সুমন বাঁশি বাজানো শুরু করলো। তার বাঁশির নবসুরে রূপসীর দেহ কেঁপে উঠলো।সুমন খুশি মনে স্নান সমাপন করলো।
্রূপসীর হাতের রান্না খুব ভালো।সুমন খেলো।রাতে আজ কাজ নেই।মুরারী রাতে রূপসীর ঘরে এলো।সে বললো,শোনো সবাই।যাত্রাদলের এখন কোনো কদর নেই।তাই আমি আপাতত আলকাপের দল করবো।
সুমন বললো,যাত্রাদল তাহলে উঠিয়ে দেবে।
-না। বন্ধ হলো আপাতত।আবার ডাক পেলে হবে নিশ্চয়।আলকাপের নায়িকা হবে রূপসী।
–না, দাদা রূপসী নয়। ঝুলনকে করো।
কেন? তোমার গায়ে লাগছে না কি?
সুমন বললো,রূপসী আজেবাজে ভাষা বলতে পারবে না। মু রা রী বললো,কি বলছো রূপসী।রূপসী বললো,আমি নাচ করবো।কিন্তু তোমার বিপরীতে অভিনয় করবে ঝুলন ভাই।বেশ তাই হবে।কালকে আমাদের আলকাপ হবে।বায়না দিয়ে গেছে।সুমন বলে,এখন আলকাপ শোনার লোক বেশি।আড়ালে রাতের বেলায় ভদ্রলোকেরাও চাদর মুড়ি দিয়ে শুনতে আসে আলকাপ।খিস্তিখেউড় শুনতে মজা লাগে।মেয়েদের নগ্ননাচ দেখতে ভালো লাগে দর্শকের।টাকা পয়সাও দেয় অনেক।তাহলে যাত্রার ভবিষ্যৎ কি?
রূপসী বল,ছাড়ো তো ওসব কথা। এখন চলে গেলেই হলো।
মুরারী ভালো ব্যবসাদার। সে নিশিকান্ত কে দলে নিলো।ভালো আলকাপ করে। নাম আছে।দলের নাম দিলো,নিশিকান্তর আলকাপ।
তারপর পরের দিন রাতে শুরু হলো আলকাপ।সুমনের বাঁশির তালে নিশিকান্ত আর রূপসী নাচ আরম্ভ করলো।তারপর শুরু হলো আলকাপ।নিশিকান্ত একটা রসগোল্লার হাঁড়ি দুপায়ের ফাঁকে নিয়ে শ্বশুর বাড়ি এলো।তারপর ঝুলন মেয়ে সেজে নিশিকান্তর হাঁড়ি থেকে রসগোল্লা খেলো।আহা কি মি। আরও খাবো।
নিশিকান্ত বললো,তোকো হাঁড়ি উপুড় করে রস খাওয়াবো।আয় আমার শালি।
এইভাবে আসর জমে উঠলো। প্রচুর টাকা পেলো নিশিকান্ত।তার নাম শুনেই লোকে ভিড় করে আলকাপ শুনতে আসে।মুরারী বলে,দেখো সুমন, যাত্রার থেকে টাকা বেশি আলকাপে।মানুষ যা চায় তাই করতে হবে।তা না হলে না খেয়ে মরতে হবে।
সুমন কোনো উত্তর দেয় না। শুধু আকাশের দিকে তাকিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে।
সুমন আজ অনেক দিন পরে বাড়ি গেলো।ছেলেটি বড় হয়েছে।পাশে কুড়োর বাড়ি।বিধবা হওয়ার পর ও একা থাকে। একা রান্না করে খায়।একাদশী করে।প্রচুর উপোষ করতে হয়।সুমন একবার বলেছিলো,তুমি আমার ভায়ের বৌ।তুমি ভালো গান জানো।চলো যাত্রাদলে গান করবে।এভাবে জীবনটা নষ্ট করে কি লাভ।খেনী রেগে গিয়ে বলেছিলো,বেশি বাড়াবাড়ি কোরো না। গ্রাম থেকে বাস ওঠাবে না কি?ও ওর মত থাক।সুমন চিন্তা করে দেখলো,এখনও কুসংস্কার দূর হতে অনেক সময় লাগবে।তারপর নিজের সংসারের কথা ভেবে আর ওসব নিয়ে কথা বলে নি।কুড়ো,খেনী দুইবোন। কালোকে কুড়োর কাছে রেখে শান্তি পায় দুদন্ড খেনী।নিঃসন্তান কুড়ো কালোকে পেয়ে মাতৃত্বের স্বাদ অনুভব করে। মেনকা গ্রাম থেকে এসে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভরতি হয়েছে।এম.এ পড়ছে।লেডিস হোষ্টেলে থাকে।অনেক বান্ধবী আছে।ঠিকমত সময়ে খেয়ে নিয়ে একসাথে যাওয়া আসা করে।মাঝে মাঝে গ্রামের বাড়ি যায়।ছুটি থাকলে গ্রামে যায়।একদিন সকলে চিড়িয়াখানা গেলো।সেখানে পশু পাখিদের দেখে খুব আনন্দ পেলো সবাই।মেনকা খাবারের জোগাড় করলো।ডিম টোষ্ট আর শস,সঙ্গে স্যালাড।মেনকা বললো বান্ধবী সোমাকে,জানিস আমাদের গ্রামের বাড়ি মাটির ছোটো বাড়ি।বাবা বলেন যতই ছোটো হোক বাড়ি হলো মন্দির।জানিস আমার মা ছোটোবেলা থেকে আমাকে শেখাতেন, একটা পাখির বাসাও ছোটো। কিন্তু অবহেলার নয়।কত পরিশ্রম করে তিলে তিলে একটা বাসা তৈরি হয়। কোনো মন্দির,মসজিদ,গির্জা ছোটোবড় হয় না।সবখানেই সেই একই মালিকের বাস। সোমা বললো,তোর কথা শুনতে ভালোলাগে।আমদের ভারতবর্ষ মহান।চিড়িয়াখানা থেকে ফিরে রাতে ভাত, তরকারী আর মাছের ঝোল খেলো ওরা।তারপর ঘুমিয়ে পড়লো। সকালে উঠে সকলে প্রাতঃরাশের পরে গল্প করতে বসলো।আজ ছুটির দিন।মেনকা তার গ্রামের মেলা যাবার বর্ণনা করলো।সবাই মন দিয়ে শোনে তার সত্যি গল্প,তার জীবনের গল্প।বুঝলি সোমা একবার গ্রাম থাকে। গোরুর গাড়ি চেপে দধিয়া বৈরাগ্যতলার মেলা যাচ্ছি। পিছনে বাঁধা রান্না করার সরঞ্জাম। মেলা গিয়ে রান্না হবে। বনভোজন। সঙ্গে মুড়ি আছে। বড়দা বললেন,গিয়ে প্রথমে মেলা ঘোরা হবে। তারপর অবস্থা বুঝে ব্যবস্থা। মা বললেন,তোরা ঘুরবি আমি আর মানা রান্নাবান্না করবো। তারপর দুপুরে মেলা ঘুরবো। গাড়ি চলেছে ক্যাঁচর ক্যাঁচর শব্দে। গোপাল কাকা বললেন,আরে, দেখ দেখ জিম চলে এসেছে। বড়দার ভয়ে ব্যাটা গাড়ির তলায় হাঁটছে।
জিম নেড়ি কুকুর হলেও, আমরা ওকে জিম বলেই ডাকি। কুকুর ভাবি না। অনেক মানুষের থেকেও ওর ভব্যতা অনেক বেশি।আর একটা মেলায় যেতাম। পঞ্চাননতলার মেলা যেতে একটা আল রাস্তা ছিলো। আমরা ছোটোবেলায় বারবার ওই রাস্তা ধরে আসা যাওয়া করতাম। দুপাশে কাদা ভরতি ধানের জমি। কি করে কাউকে ওই কাদায় ফেলা যায়, এই কুবুদ্ধি আমাদের মাথায় খেলা করতো। আর তাই হতো। ধপাধপ কাদায় পরে যেতো অনেকেই। আর আমরা কি মজা, কি মজা করে চিৎকার করতাম। মার খেয়েছি খুব। বদ বুদ্ধির জন্য।যাইহোক, গোরুর গাড়ি একবার থামলো। তামালদা আর আমি জমি দিয়ে হেঁটে গেলাম। দেখলাম আখের জমি। বললাম,একটা আখ খাবো। তামালদা বললো, না পরের জমি।
— একটা তো, কিছু হবে না।
— যাও, তাড়াতাড়ি আসবা।
তারপর একগাছা সরালো আখ ভেঙ্গে খেতে খেতে চলে এলাম।গোরুর গাড়ি আবার চলতে শুরু করলো। দিগি দিগি, পা পা, করে গোরুর সঙ্গে কথা বলে চলেছে প্রিয় তামালদা।মন্থর গতিতে পৌঁছে গেলাম সকালের টাটকা মেলায়। ভোরবেলায় বেরিয়েছি বাড়ি থেকে। প্রায় কুড়ি কিমি রাস্তা চার ঘন্টা লাগলো। তবু ক্লান্তি নেই। মা বললেন,প্রথমে জল এনে এই ড্রাম ভরে ফেল।জল ভরার পরে আমরা মেলা ঘুরতে চলে গেলাম। কাঁচের চুড়ির দোকান পার করে নাগরদোল্লা। চাপলাম। ভয় নেই। মনে মজা।তারপর ঘুরে ঘুরে দেখার পালা। একই জিনিস ঘুরে এসে দেখে নতুন লাগছে। চির নতুন। কেউ বিরক্ত নয়। সবাই অনুরক্ত মানুষের ভিড়ে। এই প্রবাহ পুরোনো হবে না কোনোকালে।বড়দা বললেন,অনেক হয়েছে। এবার খাবে চলো। মায়ের কাছে গিয়ে দেখলাম, মুড়ি, তেলেভাজা, আর রসগোল্লা রেডি। ঘুরে ঘুরে খিদে পেয়েছে। খেয়ে নিলাম। জল খেয়ে ধড়ে প্রাণ এলো। এলো আনন্দ।মানা পিসি বললেন,চল আমি আর তুই একবার মেলা ঘুরে আসি। পিসি প্রথমেই চিতার কাছে গিয়ে বললেন,সব থেকে সত্য, এই চিতা। পিসি খুব তাড়াতাড়ি এই সত্যের সন্ধান কিছুদিন পরেই পেয়ে গিয়েছিলেন।
তামাল দা মাকে বললো,দিদিমুণি, ত্যাল দিন তো। আর ওই খোলের বাটিটা। গরুগোলাকে খেতে দি ভালো করে। ত্যাল মাকিয়ে দোবো। ওরাও তো মেলায় এয়েচে। অবিচার করলে হবে না।
মা বললেন,যাও, দাও গা। ভালো করে খেতে দাও।মা রান্না সারার পরে একবার মেলায় গেলেন। আমার ঘুরে ঘুরে পায়ের ডিমিতে লাগছে
তবু মেলা না দেখে মন মানছে না। ক্লান্তি ভুলে অবাক চোখ চালানো সারা মেলা জুড়ে। কোনো কিছু দেখা বাকি থাকলো না তো? তাহলে বন্ধুদের কাছে হেরে যাবো। বন্ধুরা বলবে, কেমন মেলা দেখলি। আমরা সব দেখেছি।আর দেখলাম মানুষের আবেগের রঙীন খেলা। কেউ নাগরদোল্লায়।কেউ খাবার দোকানে। আর অনেকে শুধু ভবঘুরের মতো চরকী পাক খাচ্ছে ভিড়ের মাঝে। মেলায় মিলন মানুষে মানুষে।জাতিতে জাতিতে,বললেন গোপাল কাকা।এই মেলায় হরিনাম এক প্রধান আকর্ষণ। তার সঙ্গে জড়িয়ে আছে অনেক ভক্তের মায়া।
আমার ঈশ্বর,আমার অনুভব,ভালোবাসা একান্তই নিজস্ব অনুভূতি। আমার জ্যান্ত ঈশ্বরের পরম করুণাময়ের সঙ্গে মিলিত হবার শেষ আয়োজনের শুরু হয়েছে। মনে পরছে, আমার সামনে থেকেও রকেটের দাগের মতো মিলিয়ে গেলো বন্ধু। গঙ্গার জলে ডুব দিয়ে আর উঠলো না নীলমণি। রোজ আকাশে ধ্রুবতারা হয়ে জ্বল জ্বল করে আমার অশ্রু আয়নায়। হাওয়ায় ওড়া আমার বেহিসাবী মন আজও দেখতে পায় অনন্ত আকাশে তার বিচরণ।দুপুর ঠিক দুটোর সময় মা খাওয়ার জন্য ডাকলেন। মা বললেন,থালাগুলো জল বুলিয়ে নিয়ে এসো সবাই।তারপর গোল হয়ে সবাই বসে পরলাম খেতে। মাটিতে বসে খেতে শুরু করলাম। আমি কলাপাতায় খেতে ভালোবাসি। এতো খাওয়া নয়,স্বপ্ন জগতে বিচরণ। এই ভালোলাগা বার বার আসে না। অকৃত্রিম আনন্দের জগৎ এই মেলা।সবার খাওয়া হয়ে গেলে মা ও মানা পিসি বসলেন খেতে। সবাইকে প্রথমে খাইয়ে তারপর নিজের খাওয়া। তাই ভারতমাতার সন্তানরা দেশের দশের জন্য সব ত্যাগ করতেও কুন্ঠিত হয় না। মায়ের কাছে এই শিক্ষা তারা পায় ছোটো থেকেই।তারপর বাড়ি ফেরার পালা। অনেক মৃতদেহ আসছে শ্মশানে। বলো হরি, হরিবোল ধ্বনিতে আকাশ বাতাস মুখরিত। তারা ফিরছে আপন ঘরে। আমরা ফিরছি গ্রীনরুমে।সন্ধ্যা হয়ে আসছে। মা চিন্তা করছেন। তামালদাকে বললেন,তাড়াতাড়ি ডাকাও। গোরু দুটোকে তামালদা বলছে,হুট্ হুট্,চ,চ দিগি দিগি। গোরু দুটো ছুটতে শুরু করলো। খুব তাড়াতাড়ি চললাম। টর্চের আলোয় রাস্তা দেখছি সবাই। হঠাৎ রে রে করে দশজন ডাকাত পথ আগলে দাঁড়ালো। দে যা আছে বার কর। হাতে তাদের বড় বড় লাঠি। মা বললেন,বললাম তাড়াতাড়ি করে বাড়ি চলে যায় চ, তোরা শুনলি না আমার কথা।হঠাৎ তামালদা আর বড়দা নেমে লাঠি কেড়ে নিয়ে বনবন করে ঘোরাতে লাগলো। আমরা গাড়িতে বসেই দেখতে লাগলাম লাঠির ঘায়ে ডাকাতগুলোর মাথা ফেটে রক্ত পরছে। সবগুলো শুয়ে পরে হাত জোড়া করে ক্ষমা চাইছে। মা বললেন,ছেড়ে দে। উচিত শিক্ষা পেয়েছে বাঁদরগুলো। খেটে খাগা যা, পালা।তারপর তামালদা ও বড়দা লাঠি দুটো নিয়ে সামনে বসলো। বড়দা বলছে,আয় কে আসবি আয়। সেই কেড়ে নেওয়া লাঠি আজও আছে। মা বলতেন,অন্যায় করবি না,আর অন্যায়ের সাথে আপোষও করবি না।মনমতো পছন্দের মামা আমাদের খুব প্রিয় ছিলেন। যখন মামার বাড়ি যেতাম মায়ের সঙ্গে তখন আমাদের দেখেই মামিমাকে মাছ,ডিম,মাংস রান্না করতে বলতেন। কখনও সখনও দেখেছি মামিমা নিজে ডেঙা পাড়া,সাঁওতাল পাড়া থেকে হাঁসের ডিম জোগাড় করে নিয়ে আসতেন। তখন এখনকার মতো ব্রয়লার মুরগি ছিলো না। দেশি মুরগির বদলে চাল,ডাল,মুড়ি নিয়ে যেতো মুরগির মালিক। নগদ টাকর টানাটানি ছিলো। চাষের জমি থেকে চাল,ডাল,গুড় পাওয়া যেতো। মুড়ি নিজেই ভেজে নিতেন মামিমা। আবার কি চাই। সামনেই শালগোরে। সেখানে মামা নিজেই জাল ফেলে তুলে ফেলতেন বড়ো বড়ো রুই, কাতলা,মৃগেল। তারপর বিরাট গোয়ালে কুড়িটি গাইগরু। গল্প মনে হচ্ছে। মোটেও না। এখনও আমার সঙ্গে গেলে প্রমাণ হিসাবে পুকুর,গোয়াল সব দেখাতে পারি। আহমদপুর স্টেশনে নেমে জুঁইতা গ্রাম। লাল মাটি। উঁচু উঁচু ঢিবি। আমি পূর্ব বর্ধমানের ছেলে। সমতলের বাসিন্দা। আর বীরভূমে লাল উঁচু নিচু ঢিবি দেখে ভালো লাগতো।আমাদের মাটি লাল নয়। কি বৈচিত্র্য। ভূগোল জানতাম না। জানতাম শুধু মামার বাড়ি। মজার সারি। দুপুর বেলা ঘুম বাদ দিয় শুধু খেলা। আর ওই সময়ে দাদু শুয়ে থাকতেন। ডিসটার্ব হতো।একদিন ভয় দেখানোর জন্যে বাড়ির মুনিষকে মজার পদ্ধতি শিখিয়ে দিয়েছিলেন। তখন ছেলেধরার গুজব উঠেছিলো। আমরা দুপুরে খেলছি। দাদু বার বার বারণ করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন,আজ কিন্তু ছেলেধরা আসতে পারে। আমি খুব ভিতু ছিলাম। আমার মামার ছেলে বাঁটুলদা,হোবলো,ক্যাবলা,লেবু। সবাইকে বললাম। তখন বারো থেকে পনেরো বছরের পালোয়ান আমরা। সকলের ভয় হলো। মামা কোনোদিন মিথ্যা বলেন না। কথার মধ্যে কনফিডেন্স না থাকলে তিনি রাগ করতেন। একবার আমাকে জিজ্ঞেস করেছিলেন,এই অঙ্কটা পারবি। পড়ে দেখ। আমি বললাম,বোধহয় পারবো। তিনি রেগে বললেন, বোধহয় কি? হয় বল না, কিংবা হ্যাঁ। নো অর ইয়েস। ধমকের চোটে কেঁদে ফেলেছিলাম। এই সেই মামা বলেছেন, আজ ছেলেধরা আসবে। সাবধান। সবাই ঘুমোবি। দুপুরের রোদে বেরোবি না। বাধ্য হয়ে শুলাম। দাদুর নাক ডাকা শুরু হলেই সবাই দে ছুট। একেবারে বাদাম তলায়। চিনে বাদামের একটা গাছ ছিলো। ঢিল মেরে পারছি। এমন সময়ে মুখ বেঁধে ছেলেধরা হাজির। হাতে বস্তা। বস্তা ছুড়ে ঢাকা দিতে চাইছে আমাদের । আমরা সকলেই প্রাণপণে বক্রেশ্বর নদীর ধারে ধারে গিয়ে মাঝিপাড়ায় গিয়ে বলতেই বিষ মাখানো তীর আর ধনুক কাঁধে বেড়িয়ে পড়লো। বীর মুর্মু। সাঁওতাল বন্ধু। ছেলেধরা তখন পগাড় পাড়। আর দেখা নেই। বড়ো হয়ে সত্য কথাগুলি জানতে পেরেছি। মামা ওই সাঁওতাল বন্ধুকে বকেছিলেন,ছেলেগুলোকে ভয় দেখাতে নাটক করছিলাম। আর তুই এক নম্বরের বোঙা। একবারে অস্ত্র হাতে। যদি মরে যেতো ছেল অনেক গল্প শুনেছিলাম দাদুর বীরত্বের গল্প। মা তার নিজের গল্পও বলেছিলেন অনেক।আমার মনে পরে সেইসব কথা।
গল্প বলতে বলতে কখন যেনো মেনকার চোখে জল এসে গিয়েছিলো।সোমা জল মুছে দিলো।বললো,আর পনের দিন পরেই পুজোর ছুটি।সবাই বাড়ি যাবো।কি মজা বল।মেনকা বললো,ঠিক বলেছিস।
কথায় বলে না ভালোলোকের শত্রুর অভাব নেই।সুমন নানারকম অসুবিধা থাকলেও এদল ওদল করে না। টাকার লোভ তার নেই।আর এইসব গান বাজনার লাইনে রাজনীতি খুব বেশি।অনেকে ভালো শিল্পীকে নিয়ে টানাটানি করে।সুমন আর রূপসী বড় শিল্পী।তবু তারা মুরারী অপেরা ছাড়ে নি।মুরারী এখন ভালো ব্যবহার করে।আলকাপের দল খোলার পর থেকে লাভের অঙ্কটা হু হু করে বেড়ে চলেছে।তাই সে খুব খুশি।সুমন এবার নেশা ধরেছে মদের।বাড়ির কথা মনে পড়ে তার।কিন্তু দল ছেড়ে সে থাকতে পারে না। তারপর বাড়িতে বাঁশি বাজাতে দেখলেই তার বৌ খেপে যায়।তাই অশান্তি করতে তার ভালো লাগে না। একবার তার বৌ বাঁশি ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছিলো।সেবার সুমন বৌকে একচড় মেরেছিলো ছেলের সামনে।মন খারাপ হয়েছিলো তার।ভাগীদার গণেশ হাজরা বলেছিলো,কাজটা আপনি ঠিক করেন নাই দাদাবাবু। সেবার গণেশকে বলে পালিয়ে এসেছিলো সুমন। এখন বাড়ি কম যায়।মাঝে মাঝে টাকা পাঠিয়ে দেয়।দলে একটা নতুন মেয়ে এসেছে বিজয়া।মুরারীর সঙ্গে খুব মাখামাখি।একবার পুকুরে চান করতে গিয়ে বিজয়া সুমনকে চুমু খেয়েছিলো।বলেছিলো,কি গো নাগর। রূপসী ছাড়া আর কাউকে ভালো লাগে না। তোমার রস একদিন আমাকে খাওয়াও।সুমন এসব পছন্দ করে না। সে বললো,আর কোনোদিন আমাকে এসব বলবে না। রূপসীও আমাকে বিরক্ত করে না। বকুনি শুনে ভিজে কাপড়ে পালিয়েছিলো বিজয়া। তারপর অনেক দিন পরে একটা যাত্রার পালা করতে সুমনরা গেলো কোপা গ্রামে।সেখানে মেনকার বাড়ি।মেনকা বাড়ি এসেছে কয়েকদিনের জন্য।আর বন্ধুরা সবাই মিলে আয়োজন করেছে এই অনুষ্ঠানে। ঠিক রাত দশটায় কনসার্ট বেজে উঠলো।সুমনের বাঁশির সুরে মাতোয়ারা হয়ে গেলো গ্রাম।পালাশেষে মেনকা সুমনের সঙ্গে আলাপ করলো। সে বললো,আমার এখন গবেষণার বিষয় এই, আড় বাঁশি।সুমন বললো,অনেক বড় হও মা। আমার তো বয়স হয়েছে।রূপসীও নেই।মরে গেছে।মেনকা বল, কে এই রূপসী।
–আমার ঘর বাঁধার স্বপ্নের পাখি।সে আমার সঙ্গে ঘর বাঁধতে চেয়েছিলো।আমি পারি নি।
–কেন,পারেননি কেন?
-আমার বৌ বাচ্চা আছে তাই।
-ও বুঝেছি।
-এই আড় বাঁশির আড়ালে অনেক কান্ড ঘটে গেছে মা।
–আপনি ঠিকানাটা দিন। একদিন আপনার বাড়ি যাবো।প্রণাম নেবেন।
তারপর সুমন কোপা ছেড়ে চলে এলো নিজের গ্রামে।এখন সবাই নতুন নায়ক নায়িকা। পুরোনো কেউ নেই।দল ছেড়ে এসে সে বাড়িতে বাঁশি বাজানোর শিক্ষা দিতে শুরু করলো।বহুদূর থেকে ছাত্র ছাত্রী এলো। সুমন তার স্কুলের নাম রাখলো, মধুবনি।শত শত শিক্ষার্থী এই মধুবনি থেকে বাঁশি বাজানোর শিক্ষা গ্রহণ করতে লাগলো।একদিন মেনকা এলো তার গবেষণার কারণে।এসেই খেনীদেবীর নজরে পড়লো সে।
তিনি বললেন,মা তোমার কোথায় বাড়ি।
-কোপা।্—তোমার বাবার নাম কি?
-কার্তিক মাঝি।
ও তাহলে তুমি আমার পিসির গ্রামের দাদার মেয়ে।কোপার কার্তিক মাঝিকে আমি দাদা বলতাম ।যাওয়া আসা না থাকলে আপনজনও পর হয়ে যায় মা। এসো ঘরে এসো।
তারপর সুমন এসে তার জীবনের সমস্ত কথা বললো।মধুবনির স্বপ্নের কথা বললো।মেনকা বললো,আমি আপনার কাছে।সুমন বললো,তোমার যতদিন খুশি থাকো।আমার মধুবনিকে দেখো।আরও অনেক তথ্য পাবে।সুমনবাবুর ছেলে কালো, মেনকাকে দেখেই ভালোবেসে ফেলেছে।কিন্তু বলতে পারছে না।সুযোগ এসে গেলো।সুমনবাবু বললেন,কালো একবার মেনকাকে গ্রাম ঘুরিয়ে দেখাও।গ্রাম ঘুরতে ঘুরতে কালোর সঙ্গে মেনকার পরিচয় হলো।মেনকা জিজ্ঞেস করলো,তুমি বাঁশি বাজানো শিখেছো।কালো বললো,বাবা আমাকে মায়ের আড়ালে সুর শিখিয়েছেন।–কই বাজাও দেখি।কালো বাঁশি বাজালো।এযেনো রাধার পোড়া বাঁশির সুর।মেনকা সুরের প্রেমে ধরা দিলো।সে বললো,আমিও এই সুর শিখবো,বাজাবো।
-নিশ্চয় শিখবে।বাজাবে।
তারা দুজনে বাড়ি ফিরে দেখে প্রচুর ভিড় মধুবনি স্কুলে।ছুটে গিয়ে তারা দেখলো, সুমনবাবুর ক্ষত বিক্ষত মৃতদেহ।কে বা কারা মাঠে তাকে মেরে পালিয়েছে।তিনি মাঠে যেতেন বাঁশি বাজাতে।বাঁশিটাও ভেঙ্গে দিয়েছে।মেনকা সুমনবাবুর কাছে শুনেছেন কে বা কারা যেনো তাকে মারার চক্রান্ত করছে।তার মধুবনি ধ্বংস করতে চাইছে।পুলিশ এলো।তারা তদন্তের ভার নিলেন। সুমনবাবুর ছাত্র ছাত্রী সকলে কাঁধে করে শবদাহ করতে শ্মশানে গেলো।আগুনে বিলীন হলো নশ্বর দেহ। কিন্তু তার স্বপ্ন সফল করবে শত শত মধুবনির ছাত্র ছাত্রীরা।এমন একটা অঘটন ঘটে যাওয়ার জন্য মেনকা কালোর কাছে থাকলো অনেকদিন।এই বড় শোকে যে পাশে থাকে সেইতো আসল বন্ধু।কালোর মা বললেন,মেনকা তোমার মত একটা মেয়ে পেলে আমার জীবনে বাঁচার ইচ্ছাটা থাকবে।মেনকা বললো,একবার আমার বাবার সঙ্গে কথা বলবেন।তিনি বললেন,আমরা তোমাদের বাড়ি যাবো।মেনকা আর কালো দুজনে ঠিক করলো তারাই এই মধুবনির অপূর্ণ সাধ পূরণ করবে শত বাধা অতিক্রম করে।কালো বাঁশি বাজানো শেখাবে।আর মেনকা একটা গবেষণার গ্রন্থ প্রকাশ করবে।তার নাম দেবে,আড় বাঁশির আড়ালে।মেনকার গবেষণা তিন বছরে পড়েছে।আর এক বছরের মধ্যে পেয়ে গেলো পি এইচ ডি ডিগ্রি।এখন তার নামের আগে লেখে ডঃ,মেনকা বোস।সুমনবাবুর মৃত্যুর দুবছর পরে কালো আর মেনকা বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হলো। ভালোাসার জয় হলো।কালো এখন একজন অভিজ্ঞ শিক্ষক।ধীরে ধীরে মধুবনি সুরের আকাশে নক্ষত্রের জায়গা নিলো।জীবন এক আশ্চর্য অনুভূতি। মহাপুরুষরা বলে গেছেন পৃথিবী একটা নাটকের মঞ্চ। নাটকে অভিনয় শেষে সবাইকে প্রস্থানের পথে ফিরতে হয়। মানুষ মরে গেলে কোথায় যায়? মরে যাওয়ার পরে তার সেই অনুভূতি কি কাজ করে?স্বজনের কান্না-কথাবার্তা-ভালােবাসা-ঘৃণা কিছুই কি বুঝতে পারে? চিিিরদিনেসজীব প্রশ্ন। উত্তর জানা নেই। আমার মনে হয় যখন আমরা ঘুমােই তখন কি কোনাে পার্থিব বিষয় আমাদের মনে থাকে? কে বাবা, কে মা, কোথায় কে মনে আঘাত দিয়েছে কিংবা আমার প্রেমিক আমার প্রেমিকা কোথায় কি করছে ছুই মনে থাকে না। এক নিরুত্তর জীবন্ত প্রাণী শুয়ে থাকে তার সমস্ত চেতনা জলাঞ্জলি দিয়ে। আশ্চর্য মানবদেহ, তার চাহিদা আর তার রসায়ন। কোন রসায়নবিদ রচনা করেছেন এই রক্তমাংসের সজীব দেহ। মূর্তিমান অংশুমান রায় এখন তিপান্ন বছরে পা দিয়েছে। সে বসে বসে এইসব ভাবছে। এখন নন্দনপাড়ে বাস। বর্ধমান জেলার কাটোয়া শহরের একটা বস্তি নন্দনপাড়। নন্দনপাড়ে গরিব লােকের বাস। আর তার চারধারে বেশ কয়েক বর্গ কিলােমিটার জুড়ে গড়ে উঠেছে শহর। নন্দনপুকুর বলে একটি পুকুর আছে। তার পাড়ে গড়ে উঠেছে এই বসতি। অংশুমান নন্দনপাড়ের কাছেই দু-কাঠা জমি কিনে তার শখের বাড়িখানা তৈরি করেছে। মােটামুটি দু-খানা ঘর, একটা ডাইনিং আর বাথরুম। অংশুমানের একটি ছেলে ক্লাস ইলেভেনে পড়ে আর তার স্ত্রী দেবী সারাদিন ব্যস্ত থাকে সংসারের কাজে। অংশুমান একটা উচ্চ বিদ্যালয়ে পার্শ্বশিক্ষকের কাজ করে। বেতন সামান্য। তবু সংসার চলে যায় আনন্দে। আজকে অনেক পরিশ্রমের পরে অংশুমান। নন্দনপাড়ে এসে বাড়ি করে শান্তিতে বাস করছে। নন্দনপাড়ের বাসিন্দারা। সবাই তাকে খুব ভক্তি-শ্রদ্ধা করে। কিন্তু কিছু লােক থাকে তারা চিরকাল নিজেদের একইরকমভাবে চালাতে চায়। মানুষের প্রতি ভালােবাসার, প্রেমের সম্পর্ক তৈরি করতে চায় না। নিজেকে গুটিয নন্দনপাড়ের এইরকম আসর এই প্থম। এখনকার লােক দু-চারটে মূর্তি এনে গুজা করে শাস্তি। দিন আনা দিন খাওয় লাকে বাস এখানে। এখানে সাহিত্যের অনুপ্রবেশ মন ব্যাপার। এ একদিন ছিল, যখন এই নন্দনপাড়ের নামে লোকে ভয় পেত। এই পাড়া মানেই কিছু অসামাজিক প্রকৃৃতির লােকের বাস। সবাই এই মনে করতেন। সত্যি যা রটে তা কিছুটা বটে। তখন বেশ কজন ছিল, যারা চুরি-ডাকাতি করত। নেশা করে নিজেদের মধ্যে মারামারি করত। অপরের বউকে নিয়ে টানাটানি করত। কিন্তু চিরকাল একভাবে চলে না। অন্যায়-অত্যাচারের মাত্রা যখন বেড়ে যায় তখন মানুষ তার প্রতিকার করে। এক নতুন পথের চিন্তায় থাকে। এ যেন মানুষের সহজাত চিন্তা। পাপী লােক দু-দিন আর গুণবান যুগে যুগে অবস্থান করে মানুষের অন্তরে। অতীতের স্মৃতি রোমন্থনে ব্যস্ত অংশুমানের মন।। | অংশুমান ভাবে, যখন সে এল নন্দন পারে, তখন তার বাড়িঘর হয় নি। ফাঁকা মাঠে এসে বাড়ি করে ফেলল অংশুমান। চিতাভাবনা মা করে, বাড়ি ভাড়া করে থাকত গ্রথমে। তারপর ভাবনা করল।কম দাম দেখে অংশুমান একটা ঘর তৈরি করল। বাঁশের বেড়া দিল চারিদিকে। ন ছেলে পাঁচ বছরের। স্ত্রী দেবী খুব সাহসী মহিলা। তার সাহস না থাকল তো অংশুমানের এখানে এসে থাকা হত না। মানুষ মরে যাওয়ার পরে পেট ভরে ভােজনের রীতি আমাদের সমাজে। এই খাওয়ার পর্ব হয়ে আসছে পুরোনো কাল ধরে। ক্ষমতা থাক বা না থাক এই খাওয়ার রীতি। অংশুমান ভাবছে পাঁচজন মানুষকে খাওয়ালেও শান্তি।বেঁচে থাকতে যে মা ছেলের কষ্টে চোখের জল ফেলতেন, মমতা বলতে কিছু থাকে তাহলে চোখের আড়ালে থেকেও ছেলের কষ্ট সম্বরণ করতে পারবেন না। ভারতবর্ষে অনেক ছেলে আছে যা মায়ের ঠিকমতাে দাহকরতে, শ্মশানে আনার ব্যবস্থা করতেই হিমশিম খেয়ে যায়। অংশুমান ভাবে, তবুসমাজে থাকতে গেলে সমাজের নিয়ম মানতেই হয়। চাকরি-বাকরি পেলেও শুধু বসে থেকে মাথার চুল ছিড়লে হবে না। ব্যবসা করতে হবে, ভগবান যে দু-হাত দিয়েছেন, কর্মের মাধ্যমে সেই দুই হাতকে কাজে লাগাতে হবে। মূলধন নেই বলেই তাে অংশুমান ভাবে, টিউশনি আরও বাড়াতে হবে। সকালবেলা সাইকেল নিয়ে চা-মুড়ি খেয়ে বেরােয়। অংশুমান, সাতটা থেকে সাড়ে আটটা একটা তারপর সাড়ে আটটা থেকে দশটা অবধি আর একটা দল ছাত্র পড়ায় অংশুমান। আবার রাত্রিতে দুটো ব্যাচ। এইভাবেই অংশুমানের সময় কেটে যায় কর্মের মাধ্যমে। বাড়ি ফেরার পথে সবজি-বাজার, মুদি-বাজার সব করে নিয়ে আসে।। অংশুমান কাটোয়ার বাড়িতে বসেছিল। আজ রবিবার, টিউশনি নেই। হঠাৎ গ্রামের বাড়ি পুরুলে থেকে ফোন এল মায়ের, “অংশু, একবার বাড়িতে আসতে পারবি? আমার ওযুধ ফুরিয়ে গেছে, সঙ্গে নিয়ে আসবি।” অংশুমান। ফোনে বলল, “আমি তিন-চার ঘণ্টার মধ্যে তােমার কাছে যাচ্ছি।” স্ত্রী দেবীকে বলল, “পুরুলে থেকে একবার ঘুরে আসি। এখানে আজ ভাত খাব না। মায়ের কাছেই খাব।” এই বালে অংশুমান সাইকেল নিয়ে ওষুধের দেকানে ওযুধ আর তার সঙ্গে কিছু ফল-মূল, মিষ্টি নিয়ে পুরুলে মা-র কাছে গেল। অংশুমানরা চার ভাই, দুই বােন। দুই বােনের বিয়ে হয়ে গেছে। তারভাই এখন পৃথক হয়েছে। যে যার নিজের সংসার নিয়ে ব্যস্ত। বাবা নেই। মা যেখানে থাকতে ইচ্ছা করেন সেখানেই থাকেন। চার ছেলে চার জায়গায় থাকে। বাবার চাকরি সূত্রে মাকে যেতে হল হাওড়া জেলার লিলুয়া শহরের পটুয়াপাড়ায় মা তিনভাইকে নিয়ে বাবার কাছে চলে এলেন। বড়দা অংশুমানের কাকাবাবুর কাছে থেকে গ্রামে পড়াশোনা করে। অংশুমান ভাবে, তখন তার বয়স মাত্র সাত বছর। গ্রাম থেকে শহরে গিয়ে এতদিন ইলেকট্রিক আলাে দেখেনি অংশুমান। সন্ধ্যাবেলায় তার বাবা বাবা সুইচ অন করে দিয়েছেন। আলােতে চোখ বন্ধ হয়ে এল।কোথা থেকে আলাে আসছে অংশুমান বা তার ভাইরা বুতে পারল না। বাবা দেখিয়ে দিলেন আলাের উৎস। উপরে বাতি ঝুলে রয়েছে। প্রায় পঞ্চাশ বছর আগের কথা। অংশুর এখনও মনে আছে। তারপর সকাল বেলা বাবা প্রাইমারি স্কুলে নিয়ে গেলেন অংশুমানদের। অংশুমানের ছোটভাই তখন মাত্র দুই বছরের ছেলে। অংশুমান এবং তার মেজদা মাত্র তিন বছরের তফাত। দু-জনে মিলে স্কুলে ভর্তি হতে গেল। দাদা তৃতীয় শ্রেণিতে ভর্তি হল কিন্তু অংশুমান অঙ্ক একটু ভূল করায় একেবারে নার্সারি এসে ভর্তি হল। গ্রামের স্কুলে ক্লাস ওয়ান-এ ভর্তি হলেও এখানে নার্সারিতে ভর্তি হল। তখন থেকেই ভালাে করে পড়াশােনা করার জেদ মাথায় জাকিয়ে বসল। তারপর থেকে সে প্রত্যেকবছর ক্লাসে প্রথম স্থান অধিকার করে এসেছে। এসব কথা তার মনে আছে। অংশুমানের বন্ধু ছিল অশ্বিনী, মােহিনী, হার, গৌতম, গােরা, শঙ্কর প্রভৃতি বালকেরা। ধীরে ধীরে অংশুমানের পরিবার লিলুয়া শহরের পটুয়াপাড়ায় বেশ সুন্দরভাবে সবার সঙ্গে মিশে গিয়েছিল। অংশুমান ছােটবেলায় ক্রিকেট খেলতে খুব ভালােবাসত। ছােট ছােট বন্ধুদের নিয়ে পাড়ায় একটা ভালাে ক্রিকেট দল গঠন করেছিল, ক্যাপ্টেন ছিল সে নিজেই। একটা শুকিয়ে যাওয়া পুকুরের ভিতরে সবাই মিলে কোদাল, কুড়ি, ঝাটা নিয়ে শীতকালে ক্রিকেট খেলার জন্য “পিচ তৈরি করা শুরু করত। সুন্দর একটা সম্পর্ক ছিল সবার সঙ্গে অংশুমানের। মাঝে মাঝে ক্রিকেট ম্যাচও খেলা হত। বন্ধুরা সবাই মিলে মাঘ মাসে সরস্বতী পূজার জন্য চাদা তােলা শুরু করল। নিজেরাই বাঁশ পুঁতে নিজেদের মায়েদের, দিদিদের শাড়ি এনে সুন্দরভাবে প্যান্ডেল তৈরি করে ফেলল। এখন ঠাকুর আনার পালা। একটা রিকশাভ্যান ভাড়া করে সামনের পটুয়াপাড়া থেকে মূর্তি আনা হল। মূর্তি বসানাে হল বেদিতে। সারারাত জেগে প্যান্ডেলের কাজ করা হল। অংশুমান দেখেছে বড় বড় পুজো প্যান্ডেলে সারারাত জেগে প্যান্ডেল তৈরি হয়। তাই ওরাও সারারাত জেগে প্যান্ডেল তৈরি করবে। কিন্তু রাত যে অনেক বড়। প্যান্ডেল তৈরি হওয়ার পরে অফুরন্ত সময়। এখন কি করবে? ওরা भান করল ডিম-ভাত খাওয়া হবে এখানে। সঙ্গে সঙ্গে সবকিছু জোগাড় করে ওয়া-পাওয়ার জোগাড় শুরু হয়ে গেল। খেতে বসার সময়ে অংশুমানের মনে পড়ল, সরস্বতী পুজোর আগের দিন ‘বারের উপােস না করলেও কোনাে আঁশ জাতীয় খাবার খেতে নেই। পরে কাউকে কিছু না বলে ডিম-ভাত নিয়ে মাকে দিল। আর কোনাে ছেলের কথাটা মনে নেই। কষ্ট দিতে মন চাইল না অংশুমানের। ডিম-ভাত অংশুমান খেল।ঘড়িতে দেখল এগারােটা বাজে। রাতের বেলা প্যান্ডেলে সারারাত কাটানাে মুখের কথা নয়। কিন্তু বন্ধুরা যখন এসবে মাতে তখন কোনাে বাধাই বাধা নয়। সব সমস্যা যার নতে যায়। বন্ধুত্বের শক্তি এতটাই শক্তিশালী যে প্রত্যেক মানুষই তার জীবন মাধ্যমে এই তত্ত্ব বুঝে থাকেন। মশার কামড়েও যেন আনন্দের সুর। দাগ কাটে না বালক অংশুমানের মনে। পরের দিন সকালবেলা সবাই স্নান করে পুজো মণ্ডপে হাজির।ফল কাটা সব হয়ে গেছে। পুরােহিত এসে গেছেন। পুষ্পগুলি দিয়ে । পুরােহিতের সঙ্গে সবাই একসুরে বলছে, ভদ্রকালী নমঃ নিতং সরসত নমঃ নমঃ”—ভুল ইত্যাদি মন্ত্র। ঢাকের বাজনার সাথে সকলের নাচ হল। প্রসাদ বিতরণের পর মণ্ডপের সামনে একটা বেড়ার আড়াল দেওয়া হল। তারপ স্কুল যাওয়ার পালা। স্কুলে গিয়ে প্রসাদ খেয়ে তারপর বাড়ি ফেরা। আবার পরের দিন সকালে দধিকর্মার পূজা। পূজাশেষে পুষ্পাঞ্জলি। রাত্রিতে ঠাকুর বিসর্জন। ঠাকুর থাকবে কতক্ষণ, ঠাকুর যাবে বিসর্জন ঢাকের বােলে তালে তালে সবাই নাচতে নাচতে গিয়ে হারুদের পুকুরে ঠাকুর বিসর্জন দিয়ে এল। এইভাবে ভালাে-মন্দে সুখে-দুঃখে অংশুমানের জীবন কাটছিল। ধীরে ধীরে বয়স বাড়ার সাথে সাথে ক্লাসও বাড়ছে। ক্লাস সেভেনে উঠে টি.আরজি.আর খেমকা উচ্চবিদ্যালয়ে সিক্সে প্রথম স্থান অধিকারীর জন্য অংশুমান এক বই’ পুরস্কার পেয়েছিল। বাড়িতে এসে বাবা-মাকে দেখিয়ে সে কি আনন্দ তার। এখনও সব কথা মনে আছে। অংশুমান বন্ধুদের সাথে রেইনের পাশের রাস্তা ধরে স্কুলে যেত। কোনােদিন স্কুল কামাই ত না। তার জন্য শিক্ষক মশাইরা তাকে খুব ভালােবাসতেন।অংশুমান ছাত্রদের পড়ায় আর পড়ার বাইরে জানা অজানা অনেক ইতিহাস বা অন্য বিষয়ের কথা বলে। অংশুমান আজ নারীর স্থান সম্পর্কে কথা বলছেন। পুত্রকে ঘিরেই সাধারণত দশকর্ম পদ্ধতি আয়ােজিত হত হবে গর্ভাধান, পুংসবন ও সীমন্তোন্নয়ন এবং জন্মের পর নিষ্ক্রমণ, নামকরণ, গ্রেশন, চূড়াকরণ কৌটিল্য মন পুত্র বেশি অংশ ?নারী অধিকার মাতা। মৃত্যুর পর সম্পত্তি পুত্রদের মধ্যে বিভক্ত হবে এবং শে পাবে। পুত্রের অবর্তমানে কন্যা, জামাতা, মৃত ব্যক্তির পিতা, ভ্রাতা, | মাতা সম্পত্তির অধিকার লাভ করত। মৃত ব্যক্তির বিধবা পত্নী সম্পত্তির অংশ পাবেন কিনা সে সম্পর্কে মন কিছু বলেন নি।পেরকে, যাজ্ঞবল্ক্য পিতৃ ঋণ ও পৈত্রিক সম্পত্তি পুত্রদের মধ্যে সমভাবে বন্টন করার ব মতে পুত্রের অবর্তমানে তার স্ত্রী, কন্যা, পিতা-মাতা, ভ্রাতা, ভ্রাতুস্পুত্ররা অনুযায়ী সম্পত্তির অধিকারী হবে। সমাজে নারীর স্থান ও প্রাচীন ভারতে নারীর অবস্থা সম্পর্কে জানার জন্য । সমাজে নারী এতে প্রচুর উপাদান আছে। এ সম্পর্কে বেদ ও বৈদিক সাহিত্য, রামায়ণ, মহাভারত, মায়েদের হাতে প্রচুর উপাদান পুরাণ, গ্রিক পর্যটক ও ঐতিহাসিকদের বিবরণ, কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্র, পাণিনি ও পতঞ্জলি ব্যাকরণ, বিভিন্ন বৌদ্ধ ও জৈন গ্রন্থাদি, বিভিন্ন চােষ এবং সমকালীন সংস্কৃত সাহিত্য বিশেষ উল্লেখযােগ্য। এ ছাড়াও বিভিন্ন প্রত্নতাত্ত্বিক দর্শন, শিলালিপি ও তাম্রশাসন আমাদের নানাভাবে সাহায্য করে। | সিন্ধু সভ্যতার আমলে মেয়েদের অবস্থা সম্পর্কে জানার জন্য আমাদের হাতে কোনও দান নেই। তবে সিন্ধু উপত্যকায় প্রাপ্ত বিভিন্ন মাতৃমূর্তিগুলি থেকে বোঝা যায় যে এই র যা যুগে মেয়েরা সম্মানের আসনে প্রতিষ্ঠিত ছিলেন। ঋক-বৈদিক যুগে (খ্রিঃ পূঃ ১৫০০-খ্রিঃ পূঃ ১০০০) মেয়েরা যথেষ্ট মর্যাদার অধিকারি তাদের উপযুক্ত শিক্ষা দেওয়া হত, তারা বেদ পাঠ ও উপনয়নের অধিকারি ছিলেন মন্ত্র রচনা করেন, অধ্যাপনা করতেন এবং প্রকাশ্য সভায় তর্কযুদ্ধে অবতার। হতেন। সকলের জীবন তো সমানতালে চলে না। ছন্দপতন ঘটে যায় নিয়তি আসার মতাে। কে যে আড়ালে থেকে সুতাে ধরে পুতুলের নৃত্যে, নাচায়, তা একমাত্র জগাই ক্ষ্যাপা’ জানে। অংশুমানের কাকা যিনি গ্রামের বাড়িতে থাকতেন, তিনি মাত্র ত্রিশ বছর বয়সে মরে গেলেন। তড়িৎ, আলাককাকা, বাবলুকাকা, , বুলুকাকা, দিলীপদা, অমরকাকা, টুলাদা, বুলাদা সবার নাম মুখে মুখে হেমন্তবাবু অকলে চলে যাওয়ার দূঃখ।দিলীপদা তুলে নিলেন সংসারের সমস্ত দায়িত্ব। আর যে পথিক গােপনে গােপনে নীরবে সংসারের দায়িত্ব পান করে গেছেন তিনি আর কেউ নন, অংশুমানের মেজদা। তার নাম রিলিফ। সকলের, যন্ত্রণা ভুলিয়ে দেওয়ার হাত আছে। অংশুমান স্বীকার করে মনের গােপনে নীরবে হাসিমুখে। যাই হােক সেবার ক্লাস সেভেনে দ্বিতীয় স্থান অধিকার করেছে অংশু। গ্রামের বাড়ি পুরুলেতে সদলবলে পুনরাগমন। অংশুমানের বাবা জমি-জায়গা দেখাশোনা করেন আর লিলুয়া থেকে দুই দাদা সুবিধা-অসুবিধায় বাবাকে সাহায্য করেন।আংশুমান এবার গ্রাম থেকে চার মাইল দূরে অবস্থিত একটা স্কুলে, বিল্বেশ্বর উচ্চ বিদ্যালয়ে ভর্তি হবে তার বাবার সাথে স্কুলে গেল পায়ে হেটে। তখনকার দিনে পাকা পথ ছিল না। জমির আলরাস্তা ধরে স্কুলে গেল অশুমান। পায়ে ব্যথা ছিল। ধানের শিষে পা কেটে গিয়েছিল অংশমানের। স্কুলে একটা পরীক্ষা নেওয়া হল। প্রধান শিক্ষক মহাশয় খাতা দেখে বললেন, ভর্তি পরীক্ষায় অংশুমান সফল। আমরা ওকে ভর্তি নেব। ভর্তি হয়ে গেলাস এইটে। এবার অন্য এক জীবন। শহর থেকে এসে গ্রামের পরিবেশে খাপ খাওয়াতে হল এবার।পরের দিন থেকেই স্কুলে যাওয়া শুর করল অংশু। আল রাস্তা ধরে কাবে কােনাে ব্যাগ নিয়ে বন্ধুদের সাথে হাঁটতে হাঁটতে স্কুলে যাওয়ার অভিজ্ঞতা নতুন। মাঝে একটা কদর আছে। শীতকালে হাঁটু জল। কিন্তু হলে সর না হলে পার হওয়া যাবে না। তখন বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ছিলেন শ্রী অম্বুজাক্ষ দত্ত মহাশয়। ইংরাজি স্যার ছিলেন শ্রী দিলীপ উট্টোপাধ্যায়। কিছুদিনের মধ্যেই অংশুমানের বন্ধু জুটে গেল অনেক। অমল, রবীন্দ্রনাথ, বিনয়, টাদ, বিশ্বরূপ, মিল, অধীর, পিনু, শ্যামল ও আরও অনেক ৭। সবার সঙ্গে মেশার এক সহজাত স্বভাব অংশুমানের ছিল চিরদিন। একদিন অমল বলল-সবাই আমরা একসাথে দুর্গাপুর শহরে বেড়াতে যাব।” অংশুমান বলল-“তাহলে কথাটা প্রথমে আমাদের ভূগোল সার, মহিম বাবু কে বলি।” ক্লাসে মহিম কুমার সাধু মহাশয় পড়াতে এলে অংশুমান। বলল-“স্যার, দুর্গাপুর শিল্পনগরী। যদি আপনি নিয়ে যান, তাহলে ভালাে হয়।” মহিমবাবু নিয়ে গিয়েছিলেন দুর্গাপুর। সারাদিন ঘোরার পর তারা রাত্রিবেলায় ফিরেছিলাম নদীর ধারে। তখন। বর্যাকাল। অজয় নদীতে প্রবল জলের ঢেউ। রাত্রি মাঝিরা ওপারে ঘুমাচ্ছে। তাহলে নৌকা আনবে কে? মহিম বাবু বলামাত্রই নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়ল। বিখেশ্বর গ্রামের তিনটি সাহসী ছেলে। ভরা নদীর বুকে অতি সহজেই সাঁতার কেটে চলল তিনটি বালক। অংশগুরা পাড় থেকে চিৎকার করে বলছে, “তােরা। সবাই নিরাপদে আছিস তার?” উত্তর আসছে মাঝের নদী থেকে নেই। আমরা ঠিক আছি।” এইভাবে সাড়া দিতে দিতে ওরা ওপ গেল। তারপর নিজেরাই দড়ি খুলে নৌকা নিয়ে আসতে শুরু করল। নৌকা। এপারে এলে অংশুমান জিজ্ঞাসা করল-“কি রে, মাঝিদের ডাকলি ।ওরা উত্তর দিল—“সারাদিন খাটুনির পর ওরা একটু নিদ্রামগ্ন, কি করে, কোন লজ্জায় ওদের ঘুম ভাঙাই বল। ওরা আমাদের চেনে। আমরা ওদের ঘরের লােক।”অংশুমান চিন্তা করল, মানুষকে কতটা ভালােবাসে এরা, তারই প্রমাণ এই বাক্য। আবার নতুন করে মানুষকে ভালােবাসতে ইচ্ছে করল অংশুমানের। দশজন করে একটি নৌকায় মােট পাঁচবারে সমস্ত ছাত্রবৃন্দ নিরাপদে সেই রাত্রে নদীর এপারে চলে এল, ওই তিনজনের অসীম সাহসের ফলে। স্কুলে অংশুমানেরা সেই রাত্রি বেঞ্চিতে শুয়ে কাটালাে। পরদিন ছিল রবিবার। সকালে উঠেই হাঁটা রাস্তা ধরে চলে এল একেবারে নিজের বাড়ি পুরুলে’-তে। গ্রামের নাম ‘পুরুলিয়া’। কেতুগ্রাম থানায় অবস্থিত। সবাই ছােট করে গ্রামটিকে ‘পুরুলে’ বলেই চেনে। অংশুমানের স্বপ্নভূমি এই পুরুলে গ্রাম। -অংশুমান জানালার ধারে বসে ভাবছে গ্রামের কথা। পুরুলেতে পূজা বাড়ি আছে। এই বাড়িটি মােটামুটি দুইশত বছরের পুরােনাে বাড়ি। এখন ভগ্নস্তুপে পরিণত হয়েছে। একটি হাইস্কুল আছে। এটি দান করেছিলেন অতুলবাৰু তার বাবা মহেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের নামে। স্কুলটির নাম বর্তমানে মহেন্দ্র বিদ্যাপীঠ। তখন স্কুলটি মাধ্যমিক পর্যায়ে অনুমােদন পায়নি। ফলে অনেক ছেলেমেয়ে বাধ্য হয়ে বাইরের স্কুলে পড়াশােনা করতে যেত। অংশুমান এইভাবেই দিনের পর দিন, মাসের পর মাস বর্ষা-গ্রীষ্ম-শরতে হেঁটেই স্কুলে যেত। সময় তাে আর থেমে থাকে না। দেখতে দেখতে অংশুমানের মাধ্যমিক পরীক্ষা চলে এল। মাধ্যমিক পরীক্ষা নির্বিঘ্নে সমাপ্তও হল। শিবলুন স্টেশনে নেমে অংশুর মন খুশ।। আমের আর মাটির গন্ধে মন ভরপূর আনন্দে দিশেহারা হয়ে উঠত। সেখান খেকে পুরলে প্রায় তিন মাইল পথ। কিন্তু রাস্তার দু-ধারের আখ আর ফাঁকা মাঠ অংশুমানের পথের ক্লান্তি দূর করে দিত। এক পা করে আর সৰ পরিচিত লােকের কস্বর কি গাে দাদাবাবু, অনেকদিন পরে লেখার মধ্যে আন্তরিকতার ছোঁয়া। এই কথার মায়া আর মাটির আর আমি কোথাও পাওয়া যাবে না। হটিতে হটিতে আুমানের মনে পড়ে কবির লেখা সেই বিখ্যাত লাইন, “এইটি আমার গ্রাম আমার স্বর্গপুরী এইখানেতে হদয় আমার গেছ়ে চুরি।”বাবু বসে আছে বাইরের বারান্দায়। হঠাৎ একটি ছেলে এসে বলল, বাবুদা! ৩াড়াতাড়ি চলো, ও পাড়ায় একজন গলায় দড়ি দেবে বলে দোর বন্ধ করেছে, কিছুতেই খুলছে না।”বাবু চোখের পলক পড়ামাত্রই সঙ্গে সঙ্গে তার বাড়ি গিয়ে হাজির। গোলার তলায় শাবল ছিল, শাবল দিয়ে দরজাটা ভেঙে দেখল, একটা টুল এনে ছেলেটি গলায় গামছা বেঁধে কড়িকাঠে বাঁধছে। প্রায় ঝুলে পড়ার অবস্থায় বাবু ওর পা-দুটি কাঁধে রেখে বলল, “যা বলছি কর, গলা থেকে গামছা খোল।ছেলেটি বলল, “বাবুদা আমাকে মরতে দাও।”বাবু বলল, “তাের সুবিধা-অসুবিধার বিচার আমরা করব। তুই আগে দড়ি খােল।”বাবুর কথার অবাধ্য হওয়ার সাধ্য ছেলেটির ছিল না। দড়ি খুলে শান্ত ছেলের মতাে কাঁধ থেকে নেমে এল। ছেলেটির বাবা-মাকে একটু বকাঝকা করার পরে বাবু ছেলেটিকে নিজের সঙ্গে নিয়ে এল। বাবুর সঙ্গেই খাওয়া-দাওয়া করল ছেলেটি। মন শান্ত হলে বাড়ি গেল সে। এরকম অসংখ্য কাণ্ডকারখানা বাবুর সামাজিক জীবনে মিলেমিশে আছে। বড়দার বিয়ের দিন ঠিক হয়েছে বৈশাখ মাসে। বিয়ে হবে লাভপুরের আবাায়। বড়দা ও রিলিফদা চাকরি করে। প্রভাতবাবু দুই ছােট ছেলে বাবু আর অংশুমানকে নিয়ে যাবতীয় জোগাড় করলেন। সাঁইথিয়ার কাছে মথুরাপুরে একটি বিয়ে বাড়িতে প্রভাতবাবু মেয়েটির রুটি বেলা দেখে পছন্দ করেছিলেন। নিজের বড় ছেলের সঙ্গে বিয়ে দেওয়ার প্রস্তাব দিয়েছিলেন। তার ফলেই এই বিবাহ অনুষ্ঠান। অংশুমানরা ছােট লাইনে ট্রেনে করে বরযাত্রী গেল। আর বড়দা গেলেন জিপ গাড়ি করে। খুব আদর-আপ্যায়ন হল বিয়ে বাড়ি আবাভায়। পরের দিন সকালবেলায় প্রভাতবাৰু সদলবলে চলে এলেন পুরুলেতে। আর একঘণ্টা পরে এল বরের গাড়ি। কন্যাকে নিয়ে এসে মা রক্ষাকালী’র ধুলাে মাথায় দেওয়া হল। বেশ ধুমধামের সঙ্গে অংশুমানের বড়দার বিবাহ হয়ে গেল। তখন দিলীপের গ্রামের বাড়ি খড়ের চাল, মাটির দেয়াল। দিলীপ মনে মনে স্থির করল পাকা বাড়ি করতেই হবে। দিলীপ বাবাকে বলল, “বাবা দেখে নিয়াে, দু-বছরের মধ্যে আমি পাকা বাড়ি করব।” বাবা প্রভাত বললেন, “মা রক্ষাকালীর কৃপা থাকলে সবই হবে। মধুসূদনের কি অশেষ কৃপা। দু-বছরের মধ্যেই দিলীপ পুরুলেতে পাকা বাড়ি গড়ে তুলল। বাবা আশীর্বাদ করলেন, “তুই আরও বড় হৰি। বার, অংশুমান, বড়দার স্ত্রী, প্রভাতবাবু আর গীতাদেবী এই পাঁচজনকে নিয়ে সংসার। দুই বােনের বিয়ে দিলীপ দিয়ে দিয়েছে। আর রিলিফ ও দিলীপ নিজে দুজনে লিলুয়ায় স্টিল ফ্যাক্টরিতে চাকরি করে। প্রভাত বাবুর সংসার ভালাে-মন্দে, সুখে-দুঃখে বেশ ভালােভাবেই চলে ছিল। এখন আর বন্যায় বাড়ি ভেঙে পড়ার ভয় নেই। ছেলে পাকা বাড়ি করেছে। প্রভাত বাবুর কষ্টের জীবনে এটা বিরাট বড় ঘটনা।গ্রাজুয়েট হওয়ার পরে অংশুমান সুরেন্দ্রনাথ ল কলেজে ভর্তি হল। রাত্রিতে কলেজ আর দিনে টিউশনি করে রােজগার করে। সঙ্গে সাহিত্য চর্চা। বিভিন্ন লেখকের বই পড়াশােনা করা আর তার সঙ্গে নিজে লেখার অভ্যাস চালিয়ে যেতে লাগল অংশুমান। জোয়ার বলে একটি দেওয়াল পত্রিকা অংশুমান চালিয়েছে প্রায় দশ বছর ধরে। বন্ধু গৌতম এসে বলত, “ব্যাটা পড়াশুনার বেলায় নেই, চাকরি পাবি কি করে?সত্যিই একটা সামান্য চাকরি যে জীবনে কত প্রয়ােজনীয় তা এখন হাড়ে হাড়ে টের পায় অংশুমান। লিলুয়ার বন্ধুদের মধ্যে গােরা, গৌতম একই স্ট্যান্ডার্ডের ছাত্র হয়েও ভালাে চাকরি পেয়েছে। কারণ একটাই, নিয়মিত চাকরি সংক্রান্ত বই নিয়ে পড়াশুনা এবং তার অনুশীলন। অংশুমানের সাহিত্যচর্চা করতে গিয়ে কোনাে ভালাে চাকরি হল না। টাকাপয়সা না থাকলে,সম্মানও নেই। কিন্তু শুধু অর্থকেই যারা জীবনের মাপকাঠি করে তাদের জীবনে সুখ অধরাই থেকে যায়। নিজের মনুষ্যত্ব দিয়ে সাহিত্যচর্চার মাধ্যমে যে আনন্দ সমাজে ছড়িয়ে দেওয়া যায় সামান্য অর্থে কিন্তু সেই আনন্দ কেনা যায় না। অর্থই অনর্থের মূল কথা মাঝে মাঝে আমরা ভুলে যাই।অংশুমানের বন্ধুদের মধ্যে অনেকেই প্রেম করে সুন্দরী মেয়েদের সাথে এই বয়সে সব মেয়েই ছেলেদের কাছে সুন্দরী। রমেন অংশুমানকে একদিন এসে বলল, “আমার একটা কাজ করে দিবি? অংশুমান বলল,কি?” রমেন বলল, “শুধু ফেসবুকে কথা বলে বা হােয়াটস আ্যপের যােগাযােগে কাজ হচ্ছে না। আমি একটু নিরালায় প্রীতির সঙ্গে কথা বলতে চাই।” অংশুমান বলল, “কি করতে হবে বল?
“তুই বলবি রমেন তােমাকে চন্দন হলের কাছে থাকতে বলেছে,ঠিক আছে বলব। কিন্তু কখন ?”বিকাল তিনটের সময়।”ঠিক আড়াইটে থেকে অংশুমান প্রীতির কলেজ যাওয়ার পথে দাঁড়িয়ে আছে। এখন কলেজ থেকে বাড়ি আসবে। হঠাৎ দেখল সবুজ শাড়ি পরে প্রীতি ফুটি চালিয়ে আসছে। অংশুমান বলল, “এই যে ম্যাডাম, একটু দাঁড়ান।”প্রীতি অংশুমানকে চেনে রমেনের বন্ধু হিসাবে। প্রীতি বলল, “কি বলছেন বলুন।”
অংশুমান বলল, “তিনটের সময় চন্দন সিনেমা হলের কাছে তােমাকে পাড়াতে বলেছে রমেন।” প্রীতি বলল, “ঠিক আছে। আমি এই কুড়ি মিনিটের মধ্যে বাড়ি থেকে একটু চেঞ্জ করে আসছি।” রমেন সেইদিন অংশুমানকে আনন্দে জড়িয়ে ধরেছিল এতবড় একটা উপকার করার জন্য। কারণ রমেন একটি লাজুক, মুখচোরা ছেলে। কোনােদিন প্রীতির সঙ্গে পাঁচ মিনিটের বেশি কথা বলতে পারেনি। আজ চুটিয়ে প্রেমজীবনে অনেকরকম অভিজ্ঞতা সঞ্চিত করে একটি মানুষ তার চলার পথকে অভিজ্ঞ করে তােলে। পৃথিবীর এই রঙ্গমঞ্চে সবাই আমরা এক একটা অভিনেতা। প্রতিনিয়ত অভিনয় করে চলেছি। আবার কাল এসে সমস্ত নাটকের যবনিকা টানে একদিন। তবু মানুষ যতদিন বেঁচে থাকে ততদিন আশা করতে থাকে। এই আশা মানুষকে বাঁচিয়ে রাখে। আশা, এগিয়ে চলার লক্ষ্য নির্দিষ্ট না থাকলে একটা মানুষ জড় পদার্থে পরিণত হয়ে যায়। তাই যত দুঃখই আসুক, যত বাধাঁই পথ আটকে দাঁড়াক আমাদের এগিয়ে যেতে হবে নির্ভীকভাবে, স্থিরচিত্তে। মানুষকে ভালােবেসে মানুষের জন্য কিছু কাজ করতে হবে আমাদের। মহাপুরুষরা বেদ, বেদান্ত, উপনিষদ, কোরান, বাইবেল সব ঘেঁটে দেখেছেন মানুষের চেয়ে বড় আর কিছু পৃথিবীতে নেই। মানুষের মাঝেই দেবতা, তাদের মাঝেই শয়তানের বাস। মানুষের মাঝেই স্বর্গের আর নরকের যন্ত্রণা বিদ্যমান। প্রভাত বাবুর আবার একটি কন্যাকে পছন্দ হয়েছে। ধীর, স্থির শান্ত কন্যা। এই কন্যা তিনি মেজছেলে রিলিফের জন্য ঠিক করেছেন। মখারীতি সমস্ত নিয়ম মেনে রিলিফের সঙ্গে শান্ত কন্যাটির বিয়ে হয়ে গেল। বিয়ের পর রিলিফ বৌকে বাবা-মার কাছে রেখে চলে গেল। প্রভাতবাবুর শরীর খুব একটা ভালাে নেই। তাই তিনি সকলের সংসার গুছিয়ে দিয়ে যেতে চান। ছেলেরা সবাই সুখে থাকবে, এটা কি কম কথা !বই তিনি স্ত্রী গীতাদেবীকে বললেন, “অংশুমানের বয়সও তিরিশ পেরিয়ে গাছে। যদি তার বিয়েটাও দিয়ে দেওয়া যায় তা ভালাে হয়।”অংশুমান এখন কলকাতার একটা নার্সিংহােমে ভর্তি হয়েছে। অ্যাপেনডিক্স অপারেশন হবে। কত রােগী শত যন্ত্রণা অবজ্ঞা করে আনন্দে আছে না দেখলে বিশ্বাস করা যায় না। একটি বছর পঁচিশেক ছেলের অর্শ অপারেশন হয়েছে। আজ অংশুমানের হবে। একটু ভয় ভয় ভাব। ছেলেটি অংশুমানকে নিজের ব্যথা নিয়েও একটি গান শােনাচ্ছে, ‘তাোমার হল শুরু আমার হল সারা’, এই গান শুনে অংশুমানের চোখে আনন্দে জল এল, কত যন্ত্রণা সহায করে ছেলেটি শুধু তাকেই আনন্দ দিতে গান গাইছে। এ তাে মহাপুরুষের হৃদয়। এটিও এক ধরনের সমাজসেবা। সমস্ত ভয় কাটিয়ে অংশুমান অপারেশন থিয়েটারে প্রবেশ করল।অংশুমানের বড়দা দিলীপের পর পর ছয় বছরের মধ্যে তিন কন্যাসন্তান হল। মেজদা রিলিফের গত চার বছরে একটি কন্যা ও একটি পুত্রসন্তান জন্ম নিল। বড়া লিলুয়া থেকে এসে অংশুমানকে বলল, “কি রে বিয়েটা সময়ে সেরে ফ্যাল, যদি বিয়ে করতেই হয় তাহলে দেরি করে লাভ নেই।”অংশুমানের অপারেশন হওয়ার পর চার বছর কেটে গেছে। মনে মনে ভাল, বিয়েটা বাবা বেঁচে থাকতে করে নিলে ভালাে হয়। বাবার চোখে গ্লুকোমা। ভালাে দেখতে পান না। শরীরও খুব একটা ভালাে নেই। তাই বিয়েটা করে নেওয়াই স্থির করল অংশুমান। অংশুমান দেখতে কনেপক্ষ থেকে লােক এলেন। অংশুমনি বাবা-মার সঙ্গ বেশিদিন মিজি পায়নি। পুরুলেতে এসে দিলীগ বাড়ি দোতলা করাকাজগে নেনে পল। থেকে তিন মাসের মধ্যে দোতলা কমিটি। এখন আর খালার কথা । নেই। উপরের ঘরে একটিতে আগুন ও মা, মাটিতে মি । পরিবার। নিচে বাবা, মা ও বাৰু। বাু এখন ব্যবসা করে। সঙ্গে মিছিল-মিটিং অ্যাটেন্ড করে। বেশির ভাগ সময় না বাইরে কাটা। পলি পরে ভুল কুড়ি বাসস্ট্যান্ডে একটি জুতার দোকান করে। জুম চাষ দেখাশােনা করেন। দুটি মেয়ে এামের হইলে পড়ে। আর ছোট মেয়ে, এখনও ভর্তি হয়নি। প্রভাতবাবুর শরীর আরও ভেঙে পড়ল। যে সংসারকে তিনি কি সিরে আগলে রেখেছেন সেই সংসারকে ছেড়ে চলে যেতে হবে। প্রভাতশাষতে পেরেছেন আর বেশিদিন নয়। চোখে মুকোমা হওয়ার ফলে একলম দেশ পান না। অংশুমানের স্ত্রী দেবী ছয়মাস হল এক পুতসস্তানের জন্ম দিয়েছেন। প্রভাতবাবুর বড় আশা ছিল নাতিকে স্বচক্ষে দেখলেন। কিন্তু হয়। নিয়তি কেন বাধ্যতে’। তিনি নাতিকে কোলে নিয়ে আদর করেন। বিয়ের পরে অংশুমান তারাপীঠে মা তারার কাছে পুত্রস্তান প্রার্থনা করেছিল। মা তারা দয়া করেছেন, বড়দার তিন কন্যা, মেজদার এক কন্যা আর এক পুত্র। অংশুমানের এক পুর। সবাইকে সুস্থ অবস্থায় রেখে প্রভাত একদিন গভীর রাতে লীঘরে শেষ নিশ্বােস ত্যাগ করলেন। বটগাছের ছায়া থেকে বঞ্চিত হল সমগ্র পরিবার। দুঃখে-বেদনায় সকলে কান্নাকাটি আরম্ভ করে দিল। কিন্তু মৃত্যু তার নিষ্ঠুর সত। যুগে যুগে মৃত্যু তার আপন এর পতাকা উড়িয়ে সদ্পে চলেছে, চলবে। এর কোনো শেষ নেই। প্রভাতবাবুর শ্রাদ্ধ হয়ে গেল। দশদিন কঠোরভাবে পুরাে সাদা কাপড় পরে শোক পালনের মাধ্যমে পিতার প্রতি শ্রদ্ধাভক্তি জাপন করে তার আত্মারবাবার মৃত্যুর পর তার চার ছেলের মধ্যে সব থেকে ছোট ছেলে বাবুর বিয়ে বাকি আছে। আর সবাই নিজেদের সংসার নিয়ে ব্যস্ত। বাবু নিজের ব্যবসা নিয়ে ব্যস্ত থাকে।। একদিন বাবু শিবলুনে কোনাে একটা কাজে গেছে। বাবুর এক বন্ধু বলল, “বাবু, এখানে একটি ব্রাহ্মণের মেয়ে আছে। যদি পারাে একবার দেখে যেও, তােমার এবার বিয়ে করা উচিত।” বাবু অত গুরুত্ব না দিয়ে বলল, “দেখা যাবে”। বন্ধু বলল, “তাহলে শুক্রবারে শিবলুন এর একটি অনুষ্ঠান আছে। অনুষ্ঠানে মেয়েটি গান করবে, তুমি তখন দেখে নিতে পারবে।”বাবু শুক্রবারে ঠিক সময়ে শিবলুনে গিয়ে হাজির হল। ঠিক দশটায় অনুষ্ঠান শুরু হল। উদ্বোধনী সঙ্গীত গাইবে বেলা চ্যাটার্জি। মাইকে ঘােষণা শুনে বাবু সামনের চেয়ারে বসল। বেলা একটি রবীন্দ্রসঙ্গীত গাইল, সুন্দর হে সুন্দর। বাবুর পছন্দ হয়ে গেল মেয়েটিকে। মেয়েটির বাড়িতে বড়দা ও বৌদিকে পাঠিয়ে দিল কথাবার্তা বলার জন্য। সবরকম কথাবার্তা পাকা করে বড়দা ও বৌদি ফিরে এলেন।। | অগ্রহায়ণ মাসের একটা শুভ দিন দেখে বিবাহ সুসম্পন্ন হল। চার ভাই, সকলের বিয়ে হয়ে গেল। সাজানাে সংসারে সকলে প্রাণমন খুলে থাকত। অভাব থাকলেও সংসারে সকলে হাসিখুশি থাকত। অংশুমান খাবার খেত খুব বুঝেশুনে। কানে মশলাযুক্ত খাবার সে পছন্দ করত না। একবার এক বিয়েবাড়িতে গিয়ে অংশুমান খাওয়া-দাওয়ার পর বড় এল। বাড়িতে এসে সেবার সে অসুস্থ হয়ে পড়লো। অনুষ্ঠান বাড়িতে সে সহজে যেতে চায় না। যে কোনাে অনুষ্ঠানে চলে যায় বাবু। একদিন বাবু ফোন করে জানালাে, অংশুমান আমাদের স্কুলে শিক্ষকের পদ খালি আছে। তুমি একটা দরখাস্ত দিয়ে যাও। অংশুমান সেই দিনই একটা দরখাস্ত লিখে জমা দিয়ে এল। এক সপ্তাহ পরে ইন্টারভিউ। বাড়িতে এসে পড়াশােনা করল। তারপর স্কুলে। ইন্টারভিউ দেওয়ার দু-দিন পরে জানতে পারল চাকরিটা অংশুমানের হয়েছে। পার্শ্বশিক্ষকের চাকরি হওয়ার পরে অংশুমান বাবুর কাছে কৃতজ্ঞতা স্বীকার করল। আর বাবু তাে এইরকমই ছেলে। কত ছেলে, কত পরিবারের উপকার করেছে তার হিসাব কে রাখে। পার্শ্বশিক্ষকের কাজ হওয়ার পর থেকে অংশুমান মায়ের ওযুধপত্র খাওয়া গ্রামের বাড়িতে কিছু টাকাপয়সা দেওয়া সবকিছুই করে। বাড়িতে মায়ের কাছে স্কুলের টিফিনের সময়ে ভাত খেয়ে আসে। দেবীকে সকালবেলায় রান্না করতে হয় না। সকালে উঠে চা-মুড়ি খেয়ে ওই স্কুলের আর এক শিক্ষক মহাশয় বিশ্বরঞ্জনবাবুর বাবুর মোটর সাইকেলে চেপে স্কুলে যায়। ছাত্র-ছাত্রীদের সঙ্গে সময় কাটাতে ভালাে লাগে অংশুমানের। আর অবসর সময়ে কিছু লেখালেখিও করে। এইভাবে বেশ চলে যাচ্ছিল অংশুমানের। অংশুমান কাটোয়ার নন্দনপাড়ে বাড়ি করেছে। কিন্তু সেখানে রাস্তাঘাট বা ইলেকট্রিকের আলাে নেই। অংশুমানের ছেলে সৈকত হারিকেনের আলােয় পড়াশােনা করে। প্রত্যেক বছর স্কুলে সে প্রথম স্থান অধিকার করে থাকে। সে পড়ে জানালাল শিক্ষা সদনে। পড়াশােনার ক্ষেত্রে নিজে বাড়িতে পড়ার পিছনে সময় দিয়ে, বাবার কাছে বিষয়গুলি বুঝে নিয়ে সৈকত এগিয়ে যেত, কিন্তু ইলেকট্রিক আলাের অভাবে বেশি রাত অবধি পড়তে পারত না। অংশুমান ঠিক করল যে করেই হােক বৈদ্যুতিক আলাের ব্যবস্থা করবে। অনেক বাধা-বিপত্তি অতিক্রম করে অংশুমান তার নিজের পাড়ায় বৈদ্যুতিক আলাের ব্যবস্থা করল। এই ব্যাপারে দেবীর বাবা কল্যাণবাবুও খুব সাহায্য করেছিলেন। অংশুমানের বাড়ির সামনে একটি গরিব লােকের পাড়া আছে যাকে অনেকে ভক্তি বলতে ভালােবাসেন। অংশুমান ওই পাড়ার ছেলে-মেয়েদের পড়িয়ে সাক্ষর করে তােলার চেষ্টা করে। একটা সুস্থ সংস্কৃতি গড়ে তােলার চেষ্টা করে অংশুমান। কিন্তু তার জন্য অনেক বাধা অতিক্রম করতে হবে।
বাবুর বিয়েতে এবার বরযাত্রীরা খেতে বসেছে। এমন সময়ে পাশের বাড়ির পুলিশের বেশে এসে বলছে, “আমি মহিলা পুলিশ। আমাদের মেয়ের কোনো অযত্ন হলে আমি কিন্তু রেগে যাব।” শেষে আমাদের সকলকে খাওয়ালো। খেতে খেতে আমার গান। বললেন, “আমি একটা গান শোনাবো। আপনারা খেতে আমার গান শুনুন।।”আহা কি আনন্দ আকাশে বাতাসে “গানটি ক রতে করতে তিনি নাচতে লাগলেন। সবাই ভালাে ভালাে বলে চিৎকার করছেন। তিনি বিয়ের বাড়ির পরিবেশটা আরও সুরময় করে দিলেন। পরের দিন কন্যা বিদায়ের পালা। অংশুমান আগে থেকেই সরে পড়েছে। সবাই কান্নাকাটি করছে। মেয়ে যাওয়ার সময় এই দৃশ্য সতি বড়দুঃখের। পাড়া-প্রতিবেশী-গাছপালা সবাই যে বিষাদের সুর গাইছে। বর-কনে চলে যাওয়ার পরে একটা অঘটন ঘটে গেল বাড়িতে। পাশের বাড়ির পুলিশ দিদিটা হঠাৎ করে স্ট্রোক হয়ে মারা গেল। চারিদিকে কান্নার রােল।অংশুমান, বাবু ছুটে ওদের বাড়ি গেল। আরও অনেক লােকন ডেকে শশানে নিয়ে যাওয়া হল। গত রাতে যে মেয়েটি নিজে পুলিশ সেজে গান করে সবাইকে আনন্দ দিয়েছে, সেই মেয়েটি আজ হঠাৎ করে কোনােরকম চিকিৎসার সুযােগ না দিয়ে অকালে চলে গেল ! জীবন এইরকমই। পদ্মপাতার জলের মতাে। কখন যে ঝরে পড়বে কেউ জানে না। তবু এত ঘৃণা, মানুষ বুঝেও বােঝে না। অবুঝ মন।। গতরাতে বাবুর শ্বশুর বাড়ি থেকে ফোন এসেছে, বাবুর বউ কে হাসপাতালে ভর্তি করতে হবে। লেবার পেইন উঠেছে। বাবু গতরাতে মােবাইলে ফোন করে সমস্ত ব্যবস্থা করে দিয়েছে। ডাক্তার বাবু ফোন করেন। আজ নার্সিংহোমে গিয়ে একবার দেখে আসতে হবে। অংশুমান বলল, তুই তাে শ্মশানে যাচ্ছিস যা, আমি না হয় নার্সিং হােমে যাই। নেমে আসতেই আনা গেল, মা ও নবজাতক তালে আছে। ফোন এর অংশুমান মেয়ে হবার খবরটা জানিয়ে দিল। আতমান নার্সিংহোম থেকে বেরিয়ে সােজা কাটোয়ার শশান চলে গেল। কানে গিয়ে তাকে ছেড়ে দিল। বাবু গঙ্গারান করে আনলে সােজা মিগ্রোমে চলে গেল। অংশুমান শ্মশানে বসে যোয়ার কুণ্ডলী দেখছে আর ভাবছে মানুষ এভাবে ধীরে ধীরে ছাই হয়ে যায়। ধোয়া হয়ে যায়। জীবনের আশা-নিরাশা, গখ-দুখ, আনন্দ-বেদনার সমস্ত কিছুর ছেদ টানে এই শ্মশানের চিতা।
😍😍😍😍😍😍😍
ইলেকট্রিক আলাে আসার পর অংশুমানের বাড়ির চারপাশে অনেকগুলি বাড়ি হয়ে গেল। প্রতিবেশী বলতে সামনের পাড়াটা আর দু-চারটি ঘর ছিল। কিন্তু এখন পােলে লাইট ঝুলছে। কল হয়েছে, জলেরও অভাব নেই। এখন লােকে জায়গা কিনে বাড়ি তৈরি করছে এইসব সুবিধার জন্য। জায়গার মালিক যারা তারাও ভালােরকম দাম পাচ্ছেন। ফলে অংশুমানের বাড়ির চারপাশে একটা পাড়া গজিয়ে উঠেছে। কিন্তু বেশিরভাগ লােক এখানে পড়াশােনা না জানা দলের। জানলেও হয়তাে সামান্যই জানেন। অংশুমান এদের ছেলেমেয়ের নিয়মিত পড়ায়। লেখাপড়া শিখলে নিশ্চয় কিছুদিনের মধ্যেই পরিবেশ ও পাল্টে যাবে। প্রায় কুড়ি বছর হল অংশুমান কাটোয়ায় এসেছে। এখন পার্শ্বশিক্ষকের কাজ করে। ছেলে ক্লাস ইলেভেনে পড়ে। দেবী সংসারের কাজকর্ম নিয়েই থাকতে ভালােবাসে। অংশুমানের পিসির ছেলে কালীচরণ সি.আর.পি.এফ-এ কাজ করে। হঠাৎ ফোন করে বলল, “অংশুমানদা তােমার বাড়ির সামনে পাকা রাস্তার ধারে একটা মহাকালী লজ আছে। তুমি অগ্রহায়ণ মাসের বাইশ তারিখে লজটা বুক করে এসে। অংশুমান সঙ্গে সঙ্গে গিয়ে লজ বুক করে এল। ছুটিতে এসে কালীচরণ অংশুমানের বাড়ি এল, কথাবার্তা বলার জন্য। কালীচরণ বলল, “তােমার বাড়ি মাঠের মাঝে হলেও শান্তি আছে। শুধু পাকাবাড়ি, বড় বাড়ি দেখলেই হবে না। শান্তিটাই তাে আসল কথা। এই শান্তি আর ভালােবাসাটা ধরে রাখাই
কাজ।”কালীচরণ মেয়ের বিয়ে দিল এই মহাকালী লজ থেকেই। বাড়ি থেকেসব দায় এসে লজে বিয়ে দেওয়াটা বেশ পরি..আজল নজে বিয়ে দেওয়ার পক্ষপাতী। কারণ অনুষ্ঠান হয়ে যাওয়ার প চaদিন খরে প্রায় পক্চাশ থেকে সতরজন লােকের খাবার ব্যবস্থা, শে ৰ ক সবার পক্ষে কিন্তু সহজ নয়। লজে বিয়ে হলে প্যান্ডেল অনেক কমে যায়। আর লজে বিয়ে মানে বেশ একটা ধনী লােকের এসে যায়। আবার স্টাইলের মাত্রাও বজায় থাকে। সবজি সবদিক থেকে কি করলে লজ বিয়ে দেওয়া সুবিধা বেশি। | অওমান ভাবে বড় বােনের বিয়েতে বাড়িতে দু-চারদিন লােক আসতে শুরু করেছিল। বিয়ের পরেও দু-দিন ছিল। সে। আজীবনের সঙ্গে প্রাণ খুলে মেশার সুযােগ, গানবাজনা, হৈ-হল্লোড়ে যে থাকত সারা বিয়েবাড়ি। কোথায় যেন একটা আলাদা সুর আছে বাড়িতে বিয়ে বা কোনাে অনুষ্ঠানের। লজে যেটা থাকে না, একটা কৃত্রিম আধুনিকতার গদ্ধতি এই সজ। অংশুমান ভাবে তার বড়দা দিলীপের কথা। নিজের ছেলে সৈকত বড়গার কথা বলে। বাবার মায়ের কথা, বাবার কথা শুনে শুনে সৈকতে মুখ হয়ে গেছে। বড়া গল্প বলত ভাইদের। একবার তিনি ছােটবেলায় ত বস হবে খেলে কি সতেরাে বছর, সেই সময় শ্রীরামপুরে বড় পিসির বাি যাচ্ছিলেন। বড় পিসির বাড়ি কেতুগ্রাম হয়ে গীতা ভবনের পাশ দিয়ে আহত সতীপীঠ বাঁদিকে রেখে সাইকেলে যেতে হত। তখন পাকা রাস্তা হয়নি। রেখে সাইলাম হয়ে দী মাঠর ধান তােলা হয়ে গেলে অগ্রহায়ণ-পৌষ মাসে গরুর গাড়ির চাকার দাগে রাস্তার মতাে হয়ে যেত। সেই রাস্তা দিয়ে সাইকেল চালিয়ে যাচ্ছিল বড়। কতকগুলি রাখাল গরু নিয়ে মাঠে ঘাস খাওয়াচ্ছিল। রাখালরা প্রায় শ বারােজন ছিল। ওরাও তাে ছােট। মনে করল সাইকেল নিয়ে একটা ছেলে যাচ্ছে, ওর সাইকেল কেড়ে নিলে ভালাে হবে। তারা একসাথে থাকে আক্রমণ করল। হাতে তাদের লম্বা লম্বা পাঁচন। বড়দা দেখল অব সুবিধের নয়। সাইকেল স্ট্যান্ড করিয়ে ওদের একজনের হাত থেকে নয়, वौংশের পাচন কেড়ে নিয়ে বো বো করে ঘােরাতে লাগল। ভয়ে রাখল সরে গেল। তারগর বড়দা পাঁচন মাটিতে দুম দুম করে মেরে বলল, আসবি আয় দেখি, সাইকেল নিবি আয়।” দাদার রুদ্রমুর্তি দেখে সবাই উ গালিয়ে গেল। হােট থেকেই বড়পা খুব সাহসী, পরােপকারী ও হৃদয়ব মানুষ। হাতে টাকা-পয়সা থাকলে বেশিরভাগ সময়ে তিনি দুঃস্থ গরিব পাখি করতেন। এই গুণের জন্য এখনও অনেকে তাকে শ্রদ্ধা করে।আজ অংশুমান ছাত্রদের ইতিহাসের গল্প বললেন।তিনি বললেন, বৌদ্ধ যুগের ভারতবর্ষে বিজ্ঞানে, চিত্রকলায়, দর্শনে সর্বত্র নিয়োজিত হয়েছিল এক প্রতিবাদ এবং সেগুলি জগতের কাছে আজও একটি বিস্ময়।মহামতি জীবককে পৃথিবীর সর্বকালের অন্যতম সেরা চিকিৎসক ও চিকিৎসাবিজ্ঞানী বলা যেতে পারে। কথিত আছে ইনি বারবনিতার সন্তানরূপে জন্ম নিয়েছিলেন আবর্জনার স্তুপে। পরিণত করেছিলেন তক্ষশীলা বিশ্ববিদ্যালয়। চিকিৎসা শাস্ত্র এবং বিজ্ঞান চিকিৎসক মন্ত্রিসভায় যোগদান করেন এবং ভগবান বুদ্ধের শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন।অজাতশত্রু প্রচন্ড বুদ্ধবিরোধী হলেও এবং পিতাকে বন্দি করলেও জীবকেকে চিকিৎসক পদে বহাল রেখেছিলেন। জীবকের অসাধারণ চিকিৎসা নৈপূণ্যের জন্য। সাধারণ জীবন যাপন করছেন জীবক। ধর্মপ্রচারের পরিবর্তে তাদের সেবায় নিজেকে নিয়োজিত করেছিলেন শেষে তার আচরণ অজাতশত্রু কে এতটাই মুগ্ধ করেছিল যে শত্রুতা করেও তিনি বৌদ্ধধর্ম গ্রহন করেছিলেন এবং তাদের পরামর্শে অজাতশত্রু প্রথম বৌদ্ধ সম্মেলন আহ্বান জানিয়েছিলেন। পর্বতের গুহায় সম্মেলন হয়েছিল এবং ভগবান বুদ্ধের বাণী গুলিকে একত্রিত করা হয়েছিল।বৌদ্ধ গ্রন্থ গুলি যুবকের প্রশংসায় পঞ্চমুখ। গ্রন্থ গুলি থেকে জানা গেছে তিনি দু-দুবার বুদ্ধকে কঠিন রোগ থেকে মুক্ত করেছিলেন। সংসার থেকে বৌদ্ধভিক্ষু 100 বছর বয়সে পদব্রজে বৌদ্ধবিহার গুলিতে যাওয়া আসা করতেন কেবলমাত্র চিকিৎসার কারণে।বহুদূর থেকে প্রতিদিন শত শত মানুষ ছুটে আসতেন চিকিৎসার জন্য। কাউকে বিমুখ করতেন না। জীবককে বলা হয় বেদোক্ত যুগের ধন্বন্তরি। রোগীকে না দেখেও কিরকম চিকিৎসা করতেন তা শুনলে চমকিত হতে হয়। কথিত আছে ভগবান বুদ্ধ একবার কঠিন রোগে আক্রান্ত হয়েছিলেন। ওষুধগুলো পদ্মফুলে মিশিয়ে রেখেছিলেন। বুদ্ধদেব গ্রহণ না করায় যুবকদের কাছে প্রেরণ করেছিলেন। ঘ্রাণ গ্রহণ করেই তাঁর রোগ ভালো হয়েছিল। সেবার কাজে নিজেকে শতত নিয়োজিত রাখলেও বিজ্ঞানকে বঞ্চিত করেননি জীবক চিকিৎসা সংক্রান্ত বেশ কয়েকটি মূল্যবান গ্রন্থ রচনা করেছিলেন। সেগুলো পরের দিকে হারিয়ে গেলেও পরবর্তীকালে ভারতীয় চিকিৎসা বিজ্ঞানীদের যথেষ্ট সাহায্য করেছিল তার শেষ বয়সে শ্রেষ্ঠ রচনা শিশু রোগ চিকিৎসা গ্রন্থ পৃথিবীর প্রথম শিশু চিকিৎসা সংক্রান্ত বই অতি মূল্যবান গ্রন্থ যা পরবর্তীকালে ভারতীয় চিকিৎসকদের শিশুরোগ সংক্রান্ত গবেষণায় উদ্বুদ্ধ করেছিল।মহর্ষি পতঞ্জলি পৃথিবীর বিরল প্রতিভা গুলির মধ্যে অন্যতম আবির্ভাবকাল কৃষ্টপুর তৃতীয় শতাব্দীর ব্রাহ্মণ্য ধর্মের পৃষ্ঠপোষক সঙ্গ বংশের প্রথম সম্রাট পুষ্যমিত্র সঙ্গের সমসাময়িক এবং তার মন্ত্রী কথিত আছে বংশের শেষ সম্রাট কে পরাজিত করে সিংহাসন দখল করেন এবং পুত্রের দ্বারা বিদেশি গ্রীকদের বিকৃতকরণ ঐতিহাসিক ঘটনাকে স্মরণীয় করে রাখতে পুষ্যমিত্র যজ্ঞ করেছিলেন সেই যোগ দিয়েছিলেন পতঞ্জলি।বিজ্ঞানী ও দার্শনিক হিসেবে পতঞ্জলি সুনাম জগৎজোড়া ব্রাহ্মণ্যধর্মের পৃষ্ঠপোষক হলেও বৌদ্ধ ধর্ম বিদ্বেষী ছিলেন না ও মানুষের কল্যাণে মানবজাতির নৈতিক মান উন্নত করা ছিল তার একমাত্র সাধনা মানুষের মনুষ্যত্বের বিকাশ এবং সর্ববৃহৎ রুটি এটি দূর করার জন্য তিনি একাধিক মূল্যবান গ্রন্থ রচনা করেছিলেন।
পতঞ্জলি মনে করতে মানুষের দোস্ত বিবিধ বাক্যের 10-10-10 মানুষের মনের 10 নিবারণের জন্য রচনা করেছিলেন পাতঞ্জল যোগ দর্শন এবং দৈহিক বৃদ্ধি করার জন্য এক সঙ্গীতা গ্রন্থ বিতর্ক থাকলেও কেউ মনে করেন কালজয়ী গ্রন্থ চরক সংগিতা পতঞ্জলি রচনা তবে পতঞ্জলি যোগ দর্শন রচনা বিজ্ঞান গ্রন্থ গবেষণামূলক গ্রন্থ নয় তবু সেই যুগে ধাতু নিষ্কাশন সম্বন্ধে বিস্তারিত বিবরণ লিপিবদ্ধ করেন জাতীয় গ্রন্থ রচিত হয়নি।মহর্ষি চরক এককালে পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ গ্রন্থ নামে পরিচিত চরক সংহিতা লেখক চরক সম্বন্ধে বিশেষ কিছু জানা যায় না অথচ বইখানি এককালে পৃথিবীর অধিকাংশ ভাষা অনুষ্ঠিত হয়েছিল এবং এখনো চরক সংহিতার খ্যাতি বিন্দুমাত্র কমেনি কিন্তু দুর্ভাগ্য আমাদের সেই সম্বন্ধে নির্ভরযোগ্য কোন তথ্য প্রমাণ নেই।চরক সংহিতায় আয়ু আত্মা সম্বন্ধে যে দার্শনিক মতবাদ উপস্থাপন করা হয়েছে সেই মতবাদকে গুরুত্ব দিয়ে অনেকে চরকে পতঞ্জলি ছদ্মনাম বলতে চান অপরদিকে একই পৌরাণিক কাহিনী অত্যমত্ম সমর্থক মৎস্য অবতার নারায়ন উদ্ধার করেছিলেন আয়ুর্বেদ রূপে ধরা হয়েছিল চিকিৎসাবিদ্যায় গ্রন্থ অনন্তদেব লাভ করেন এবং মানুষের প্রত্যক্ষ করার জন্য গুপ্তভাবে বাসায় আসেন।চরক সংহিতা আট ভাগে বিভক্ত একটি অঙ্গ ওই কারণে বলা হয় অষ্টাঙ্গ আয়ুর্বেদ শাস্ত্র অঙ্গুলি যথাক্রমে সূত্র স্থান নিদানস্থান বিমান স্থান শারীর স্থানীয় স্থান ইন্দ্রিয় স্থান চিকিৎসা স্থান কল্প স্থান এবং সিদ্ধি স্থান।নাগার্জুন খ্রিস্টীয় দ্বিতীয় শতাব্দীর আরেকটি বিস্ময়কর প্রতিভা মহাযান বৌদ্ধ ধর্মের প্রধান শাখা মাধ্যমিকের প্রতিষ্ঠাতা বৌদ্ধ নাগার্জুন একে ঘিরে ও কিংবদন্তির অন্ত নেই বৌদ্ধ ধর্ম গ্রন্থ গুলি এবং এককালে আসমুদ্রহিমাচল নাগার্জুনের জয়গানে মুখর ছিল স্বাধীনতার জীবন কাহিনী লিপিবদ্ধ করেছিল। নাগার্জুনের নামে বহু বই পাওয়া গেছে তেমনি বহু প্রবাদ ছড়িয়ে আছে সেগুলিকে ভিত্তি করে কেউ বলেন নাগার্জুন একজনই আবার কেউ বলেন সমসাময়িক সময়ে অন্তত চারজন নাগার্জুন আবির্ভূত হয়েছিলেন একজন বৌদ্ধ দার্শনিক নাগার্জুন একজন তন্ত্রশাস্ত্র রচয়িতা নাগার্জুন একজন রসায়নবিদ নাগার্জুন এবং আরেকজন সংস্কারক চিকিৎসাবিদ নাগার্জুন কেউ মনে করেন এত বড় প্রতিবাদ পক্ষে বিভিন্ন বিষয়ে পুস্তক প্রণয়ন অসম্ভব নয়।এখন ছেলে সৈকত ত্রিকেট খেলা দেখতে সুপার মার্কেট গেছে। এখানে বুড়ো, সৈকত ভালাে ক্রিকেট খেলে। তার বন্ধুরা সবাই সৈকতকে ডেকে যায় বিকালবেলায় খেলাধুলা করলে শরীর ও মন দুটোই ভালাে থাকে। অংশুমান মাঝে মাঝে নিজে খেলা দেখতে যায়। মাঠের ধারে বসে মন ফিরে গেছে নিজের ছেলেবেলার যুগে। পুরুলে গ্রামের বাড়িতে এই ক্রিকেট দল ছিল। মিলুদা, টুলাদা, রিলিফদা, বিশ্বরূপ, অংশুমান, ভাল, বুড়াে, তাপস, সঞ্জয়, বাবন, চনা ও আরও অনেকে মিলে ক্রিকেট অংশুমানের মনে আছে। একবার বেলুনগ্রামে ছােট পিসির বাড়ির পাশে মাঠে ক্রিকেট ম্যাচ খেলতে দলবল নিয়ে গিয়েছিল। বেলুনগ্রামের দলকে শােচনীয়ভাবে হারিয়ে দেওয়ার পরে শ্লোগান দিতে দিতে বাড়ি ফিরেছিল। শ্লোগান ছিল, “বেলুন ফুটো করল কে? পুরুলে ছাড়া আবার কে?” ছােটবেলার সেইসব স্মৃতি এখন মনের কোণে সােনার ফ্রেমে বাঁধানাে আছে অংশুমানের। আবার একবার এই ক্রিকেট দল নিয়ে বিশ্বেশ্বরের মাঠে ক্রিকেট ম্যাচ খেলতে গিয়েছিল। ম্যাচে জেতার পর মাস্টারমশাই সুধীন কুমার মণ্ডল মহাশয় পেট ভরে মিষ্টি খাইয়েছিলেন। তখন তিনি হাইস্কুলের সহকারি শিক্ষক ছিলেন। এখন তিনি কাটোয়া কে, ডি আই-এর প্রধান শিক্ষক। তার এই পুরস্কারে অংশুমান খুব অনুপ্রাণিত হয়েছিল। যতীনপুর গ্রামেও একবার অংশুমান ক্রিকেট খেলতে গিয়েছিল। অংশুমানের হঠাৎ সম্বিৎ ফিরে এল। মাঠের ধারে বসে সে এতক্ষণ বাল্যকালের সময়ে চলে গিয়েছিল। সৈকতকে নিয়ে সন্ধেবেলায় অংশুমান ফিরে এল ঘরে। নন্দনপাড়ের আশেপাশে বাড়িঘর কম বলে ফাকা লাগে। তবু এখানে থেকে আনন্দ আছে। এখানে বায়ুদূষণ, শব্দদূষণ সবই কম। লােকালয় থেকে অনেকটা দূরে হওয়ায় এখানে সর্বদা গ্রামের পরিবেশ বিরাজ করে।অংশুমান বাড়ি এসে হাত-পা ধুয়ে ঘরে বসল। সৈকত অন্য ঘরে গিয়ে পড়তে বসল। দেবী রান্না করছে। বিয়ের পর থেকেই দেবী অংশুমানের প্রতি হা ও ভক্তি দেখিয়ে আসে। ভারতবর্ষে পতিরা দেবতার আসনে অধিষ্ঠিত কে। দেবী কথায় কথায় আজ অংশুমানকে নিজের কিশােরীবেলার কথা ।ৈ দেবী একজনকে ভালােবাসতাে বিয়ের আগে। এও কি ভুলতে পেরেছে তার প্রথম প্রেম। আশ সখে প্রথম শ্রেমকে মনের এককো সতের লালিত করে ॥ সারাজীবন। আজ তিপাম বছর খাওে সেই প্রেম মনের কোণে কলি সু্যের আলাের মতো আলােকিত করে হৃদয়। সৈকতের পড়া হয়ে গে,। প্রায় সাড়ে আটটা বাজে। এরপর কি সিরিয়াল দেখে খাওয়া-দাওয়া করে তিনজনে শুয়ে পড়ল। শুয়ে দেরি কথা মনে করে অংশুমান। নাবা-মাকে ছেড়ে একা স্বামীর ভরস্য মেয়েরা চলে আসে। সংসারে তারাই থান কাণ্ডা। যে ঘরে কোনাে মহিলা নেই সে ঘরে শান্তি থাকা সম্ভব হয় না। পৃথিবীতে মেয়েদের অবদানই বেশি। তারাই তাে গড়ে তােলে ভবিষ্যতের সুস্থ নাগরিক। পুরুষ তার ছায়াসঙ্গী। মেয়ে-পুরুষের সমবেত প্রচেষ্টায় গড়ে উঠুক সােনার পৃথিবী। আর বন্ধ হােক ধর্ষণ, খুন, পারিবারিক অপরাধ আর জাতিভেদ। অংশুমান মাঝে মাঝে ভাবুক হয়ে পড়ে। পৃথিবীর ভবিষ্যৎ নিয়ে তার আশা অনেক। পরের দিন সকালবেলা দরজায় ঠক ঠক আওয়াজ। দেবী উঠে পড়েছে। বলছে, “কে? কে?” উত্তর এল, “আমি আমিনা”। ছোটবেলার বান্ধবী আমিনা। একসাথে ওকড়সা হাইস্কুলে পড়ত। দেবী ওকে ডেকে এনে বসালাে। চা খাওয়ালাে, তার সঙ্গে চলল গল্প। অংশুমান সৈকত উঠে পড়েছে। আমিনার সঙ্গে পরিচয় হয়ে ভালাে লাগল অংশুমানের। অংশুমান আজ ঠিক করল দেবী আর সৈকতকে নিয়ে মায়াপুর ঘুরতে যাবে। চান করে সবাই রিকশা করে স্টেশনে চলে এল। ট্রেন ধরে নবধীপ স্টেশনে নেমে সােজা গঙ্গার ধারে। সেখান থেকে নৌকা করে ওপারে গিয়ে মায়াপুরে ইসকনের মন্দির। মন্দির ঘুরে ঘুরে দেখার পর ওখানেই খাওয়া-দাওয়া করল। একটা বনভােজনের মতাে আনন্দ হল। নবদ্বীপে এসে শ্রীগৌরাঙ্গ স্মৃতিবিজড়িত বিভিন্ন স্থান, বিুুপ্রিয়ার বাড়ি সব দেখা হল। বিকাল পাচটায় ট্রেন ধরে আবার কাটোয়া শহরে।ফিরে আসতে প্রায় সন্ধ্যা হয়ে গেছিল। দেবী বাড়িতে এসে খুব তাড়াত স স্টোভে খিচুড়ি রান্না করল বিভিন্নরকম সবজি দিয়ে তারপর গরমনে চিড়ি খেয়ে ওরা তিনজনে শুয়ে পড়ল। সকালবেলা ঘুম থেকে উঠে আবার শুভ সংবাদ বের বাবা আসবেন। ফোন করে জানিয়ে দিলেন। দেবী খুব খুশি। বাবা এলে দেবীর মুখ আনন্দে উল হয়ে ওঠে। বাবা চলে এলেন বেলা দশটা নাগাদ। বতিতে উৎসবের আবহাওয়া শুরু হয়ে গেল। দেবীর বাবা কল্যাণ বাবু বিডি.ও, অফিসের কাশিয়ার ছিলেন। তিনি খুব ঈশ্বরবিশ্বাসী। সকালে তিন ঘন্টা রহিতে তিন एলটা আহ্নিক করেন নিয়মিত। সমাজসেবক হিসাবেও তার নাম আছে। কল্যাণবাবু একবার শিলিগুড়িতে ট্রান্সফার হয়ে গিয়েছিলেন চকরি প্রথমদিকে। তখন মাইনে বেশি ছিল না। একদিন অফিস থেকে ফিরে এসে দেখেন বয় চাল নেই। রান্না কি করে হবে? হােটেলে বা বাইরের কোনো দোেকানে খান না। যাই হােক এক্লাস জল খেয়ে নিলেন। সামনে কোনাে দোকান ছিল না, কোনো কারণে বন্ধ ছিল। অন্য কোনাে খাবারও নেই। আশা ছেড়ে তিনি মশারি টানিয়ে শুয়ে পড়লেন। একটু পরেই দরজায় ঠক ঠক আওয়াজ। দরজা খুলে দেখেন পাশের বাড়ির ভহিলা একটি পায়েস নিয়ে এসেছেন। তার বাড়িতে আজ কৃপূজা হয়েছে। কল্যাণবাবু হাসিমুখে পায়েস খেয়ে পেট ভরালেন। কল্যাণ বাবুর জীবনে আর একবার প্রমাণিতহল জীব দিয়েছেন যিনি আহার দেবেন তিনি। ঈশ্বরবিশ্বাদী কল্যাণবাবু দু-হাত কপালে ঠেকিয়ে প্রণাম জানালেন ঈশ্বরকে কল্যাণবাবু কাটোয়ায় মেয়ের বাড়িতে এলেই অংশুমানকে এইসব গল্প শুনিয়ে থাকেন। গল্প হলেও সত্য ঘটনা। দেবী বাবার ব্যাগ খুলে তার শাড়ি, সৈকতের জামা, মিষ্টি সব বের করল। এবার বাবার জন্যে চা বসালাে গ্যাস সটোভে। অংশুমান ছাদ থেকে চেঁচিয়ে বলল, “আমার জন্য এক কাপ জল বেশি ও।” দেবী বলল, ঠিক আছে।” অংশুমান চা-পাউর লেলিয়ে গেল। দেবীর বাবা এখন দু-দিন থাকবেন। উনি বাড়িতে এলে করে খুব ভালাে লাগে। সাধু মানুষের আগমনে পরিবেশ সুন্দর হয়ে যায়।সে ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গ ভলােবাসে।। সুবীর যােষ, শমীক , , রাজীব নন্দী, ,নতুন বিশ্বাস সবাই অংশুমানকে খুব ভক্তি করেন। অংশুমান স্কুলে যায়। স্কুল ছুটি হওয়ার পর বিশ্বন ন কাটে এসে সাহিত্যসভা বা কোন ধর্মীয় সভায বয। সি থাকতে পারলে অংশুমানের মন খুব ভালো থাকে। ইবনে নয়। অর্থের প্রয়ােজন থাকলেও আমাদের মনে াখা উচিত ত মূল তবু অর্থই এখন সমাজের শাসনকর্তা। যেদিন আর্থের প্রাণ মানুষের গুণের সমাদর হবে, তখন দেশ পৃথিবীতে শ্রেষ্ আস বে। অংশুমান মাঝে মাঝেই এইসব মনোৱেহকার।দেবী আজ বাবার সামনে অংশুমানকে নিয়ে বসল। সৈকতের উপ এবার হওয়া প্রয়োজন। বারো পেরিয়ে তেরা এতে সাধারণত উপনযন হ অনেকে এর আগে দিয়ে থাকেন। বেশি বস হলে আবর প্রাশি হয়। ওসবের প্রয়ােজন নেই। পৈতেটা দিয়ে দেওয়াই ভালাে। বড়িতে জায়গা। আবার খরচও বেশি। তাই ওরা সামনের খাজুরডিহি প্রেমের ও বর আশ্রমে পৈতে-টা দেওয়া মনস্থির করল। উপনয়নকে চলতিথেয় পৈতে নেওয়া’ বলে। ঠিক হল ১৫ই অগ্রহায়ণ হবে। অনুষ্ঠানের আগের দিন সমস্ত বাজার করে অংশুমান আশ্রম পৌছে দল। পরের দিন সকালে আশ্রমে চলে গেল সপরিবারে। আয়োজন আসতে শুরু করেছে। অংশুমানের মা সীতা দেবী, বডদ দিলীপবাব চলে এসেছে। দেবীর বাবা সমস্ত ব্যবস্থা ঠিকমতাে হয়েছে বিশ্বে নিলেন যত উপনয়ন সুন্দরভাবে হয়ে গেল। উপনয়নের সাজ সৈকতকে দর শেখা একটা বড় কাজ হয়ে গেল। এবার অংশুনানের মায়ের চোখ অপারেশ করতে হবে। দেবী মাকে নিয়ে আনতে বলল। মা নীতাদেবী উপনয়নের দশদিন পরকাটোয়া এলেন। তারপর সকালবেলা অংশুমান ও বাবা কতদিন গিয়ে চোখ অপরেশন করিয়ে মা-কে রিবশা করে নিয়ে এল। মা এ
এমন হল তার যার বিজ্ঞান পরিষদ, , অজয় সাহিত্য পর্ষদ মাসে মাসে সাহিত্য আসর করে, অংশুমান উপস্থিত থাকে। ভাল পত্রিকা কাটোয়ায় আছে। ধুলামন্দির, অজয়, ফিনিক্স অরিত্র, বিস্তুতি, শিউলি, আলো , সবুজ সাথী, অন্বেষণ প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য। অধরা পত্রিকা অট্টহাস থেকে প্রকাশিত হয়। অংশুমান লেখা জমা দেয় মাঝে মাঝে। এইভাবে অংশুমান স্কুলআর সংসার আর নিজের ওতে এ কটা ব্যালেন্স তৈরি করে চলে। একদিন দেবি বলল, আমি ঘুরে আসি।” অংশুমানের বললো, চলো। এখানেই কবি কবিশেখর কালিদাস রায়ের বাড়ি দেখে এল। আজ চারদিন পর ওরা কাটোয়ায় ফিরে এল। কাটোয়া কিকে দেখে কলের বডিটা চোরে খুলে নিয়ে পালিয়েছে। ভারি সমস্যা । কেউ বাড়িতে না থাকলে চোরের উপদ্রব হয় বেশি। কিন্তু প্রথম যখন ওরা এসে বড়ি করে তখন কুড়ি দিন বাড়িছাড়া ছিল। তখন কিন্তু চুরি হয়নি। সৈকত বলল, “বাবা অনেকদিন স্কুলে যায়।আজকে যাব এসেছে বাড়িতে। সৈকত বন্ধুদের সঙ্গে একসাথে স্কুলে চলে গেল। অংশুমান আর দেবী দু-জনে মিলে বাড়িঘর পরিস্কার করল। পাওয়া-সাওয়ার পর দু-জনে খাটে শুয়ে পুরােনাে দিনের কথা মনে করে গল্প করল। দেবী বলল, “দাঁড়াও, সবসময় ভাল্লাগে না।” বলে হাসি হাসি মুখে প্রতিক্রিয়া দেখছে বরের। অংশুমান দেবীকে জড়িয়ে ধরে আদর করল। সংসারে শান্তিই বড়। শুধু অর্থ কখনই শাস্তি আনতে পারে না। শাস্তির জন্য মন চাই, প্রেম চাই আর চাই সহ্য করার শক্তি। | বিকেল সাড়ে চারটের সময় সৈকত স্কুল থেকে ফিরে এল। ফিরে এসে কিছু খেয়ে গল্পের বই নিয়ে বসল। সৈকত ছোট থেকেই গল্পের বই পড়তে ভালােবাসে। অংশুমান টিউশনি চলে গেল আর দেবী নিজের কাজ নিয়ে তার একসপ্তাহ পরেই দেবীর বাবা এসেছেন। এসেই রান করে আহিনকে কসে পড়েছেন। তিন ঘণ্টা আহ্নিক করার পর ভাত খেলেন। আজ রবিবার, ুটা তাই সৈকত আজ বাবার সাথে বিকেলবেলা স্টেডিয়ামের মাঠে লে দেখতে গেল। বাড়িতে ফিরে দেখে অসংখ্য লােকের ভিড়।
একদিন ভিড় দেখে, অংশুমানের বুকটা ভয়ে কেঁপে উঠল। কাছে এসে দেখল কি উঠোনে একটা শাঁখামুটি সাপ ঢুকেছে। সাপকে কি করে। তাই লােকজন চেষ্টা করছে। সাপটা বেশ বড়। শাঁখামুটি সাগ থাক আশেপাশে অন্যান্য বিষধর সাপ থাকে না। কারণ, রাজসাপ সব সপে গিলে খায়। তাই অন্যান্য সাপগুলাে ভয়ে পালায়। রাতে অংশুমান খবর পেল রিলিফ অনেকদিন পরে গ্রামের বা এসেছে সপরিবারে। স্ত্রী চন্দ্রাণী ওই গ্রামেরই মেয়ে। তাই । চন্দ্রাণীরও খুব আনন্দ হয়। বাবা-কাকা-মা-ভাই সবাইকে দেখে মনে শৰ পায়। রুদ্কা আর ইন্দ্র মামার বাড়িত এসে খুব আনন্দ করে। আবার যখন খুব ভালােবাসে। খুশি নিজেদের বাড়িতে চলে আসে। ঠাকুমাকে ওরা খুব ভাল ঠাকুমাও অনেকদিন পরে ওদেরকে পেয়ে আনন্দে আত্মহারা হয়ে রিলিফ বরাবরই ভ্রমণপিপাসু লােক। কোথাও গেলে সে স্থির হয়ে থাকার লােক নয়। দু-দিন পরেই বৌদি রুণাকে বলল, “চলাে সবাই ৪ একসঙ্গে আমরা অট্টহাস ঘুরে আসি। আর অট্টহাসের কাছেই শ্রীরাম বড় পিসির বাড়ি, সেখানেও দেখা করা যাবে।” | পুরুলে গ্রামেই ভুলু বাঁড়ুজ্যের একটা সুমাে গাড়ি আছে। সেই গাড়ি ভাড়া করে ওরা সবাই অট্টহাস যাবার উদ্দেশে বেরিয়ে পড়ল। এক ঘণ্টার মধ্যেই ওরা পৌছে গেল। পঞ্চমুণ্ডির আসন, মন্দির, গাছপালা সব ঘুরে ঘুরে ওরা দেখল। রিলিফের ছবি তােলা চিরকালের অভ্যাস। ও ছবি তুলল সবার। তারপর দুপুরে আশ্রমেই খাওয়া-দাওয়ার ব্যবস্থা হল। ফিরে আসার পথে শ্রীরামপুরে বন্য পিসির সঙ্গে দেখা করে ওরা সন্ধ্যাবেলা পুরুলে ফিরে এল।। রিলিফ পুরুলে এলেই এরকম ব্যবস্থা করে থাকে। হৈ-হুল্লোড় লােকজন ও খুব পছন্দ করে। রিলিফ মুখে বলে, আমি নাস্তিক। কিন্তু জ্ঞানী যারা তারা একটু কথা বলেই জানতে পারে রিলিফের ভিতর গভীর জ্ঞানের পরিচয়। ছােট থেকেই বাস্তবের সঙ্গে লড়াই করে রিলিফ বড় হয়েছে। প্রচুর বন্ধু-বান্ধবের সঙ্গে মেশে। ফলে বাস্তব জ্ঞান অনেক বেশি। এই বাস্তব জ্ঞানকে পাথেয় করে রিলিফ লিলুয়ায় বাড়ি করেছে। নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছে। দু-একবার মিতালি সংঘের সম্পাদকও হয়েছে। ও দোখন দিয়েছে বাপকা বেটা, সিপাহি কা ঘোড়া, কুছ নেহি তো থােরা থােরা। অস্বীকার করার কোনাে জায়গা নেই। রিলিফের বন্ধু হারু এসেছে সঙ্গে, হার বলল, “আমি আজকে লিলুয়া যাচ্ছি। তােরা দু-দিন পরে চলে আয়।”লিলিফ আজকে মা-কে ভ্যানে চাপিয়ে নিয়ে বেলুনগ্রামে ছােট পিসির বাড়িতে গেল। পিসির বাড়ি বলছি। কিন্তু ছােট পিসি আর বেঁচে নেই মনে করতে বলল রিলিফ। মা রিলিফের কথা শুনে কাদতে শুরু করল। রিলিফ পালটে বলল, মা দেখো আমরা বেলুন চলে এসেছি।” বেলুনে সোশায় ও তার ছেলেদের সঙ্গে দেখা করে মা শান্তি পেল। মা পিসেমশায়কে লন, “মাঝে মাঝে পুরুলে যেও ঠাকুরজামাই।” পিসেমশায় রাশভারী লোক। মাকে খুব শ্রদ্ধা করেন। উনি বললেন, “নিশ্চয়ই যাবো।”রিলিফ বেলুনে থেকে মায়ের সঙ্গে পা-ভ্যানে ফিরে আসছে। মা বললেন, ছােট পিসি মারা যাওয়ার পর থেকে পিসেমশায়ের শরীরটা ভেঙে পাড়েছে।” রিলিফ বলল, “এই তাে ক-দিনের নাটক মা। অভিনয় শেষ হলে প্রত্যেককেই ফিরে যেতে হবে যথাস্থানে। ওর জন্য বেশি চিন্তা করে লাভ নেই।মা চোখের জল ফেলেন। আর ছােটকাকা, পিসি, চণ্ডীদা, বাঁটুলদা সবার কথা মনে করেন। মা বলেন, “যারা মরে যায় তারা তাে ভালােই যায়। কিন্তু যারা বেঁচে থাকে তাদের স্মৃতি বুকে করে, তাদের হয় জীবন্ত অবস্থায় মরণ। এই তাের বাবাকেই দ্যাখ, কেমন ড্যাং ড্যাং করে চলে গেলেন আর আমি বেঁচে থেকে তােদের গলগ্রহ হয়ে রইলাম।” রিলিকের চোখে জল এসে গিয়েছিল। সহজে রিলিফ কাঁদে না, তবু মায়ের কথা শুনে অশ্রু সম্বরণ করতে করতে পারেনি। মাকে আড়াল করে চোখ মুছে নিল। | রিলিফ ভাবছে, সংসারে এমন কিছু ঘটনা ঘটে, তার পিছনে মানুষের হাত থাকে না। অবস্থার বিপাকে পড়ে রিলিফ মাধ্যমিক পরীক্ষা নিজের বাবা-মার কাছে থেকে দিতে পারেনি। সবাই দই-এর ফোঁটা দিয়ে আশীর্বাদ দিয়ে ছেলেকে পরীক্ষায় পাঠায়। কাজের জন্য অনেক সময় রিলিফকে লরির তলায় শুয়ে রাত কাটাতে হয়েছে। এখন ছেলেমেয়ে সবাই আছে। স্ত্রী আছেন। কিন্তু মনের এই গােপন কথা রিলিফ অন্যদের মতাে ফলাও করে বলতে পারে না। এখনও জগতে অনেক ছেলে দুঃখকে সহজমনে মেনে দেয়া জগতে আর কিছু না পারি মানুষের মতা মানুষ যেন হতে পারি’—মনে ন এই প্রার্থনা করে রিলিফ। আদির, দোকানে এসে অংশুমান দেখা পায় বিখ্যাত সব সাংবাদিক, শ্রী দীপ্তিকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়, কৌলাল পত্রিকার সম্পাদক ও গবেষক ড স্বপন ঠাকুর, কবি রাজকুমার রায়চৌধুরী প্রমুখ ব্যক্তিত্বের সান্নিধ্যে অংশুমান ভাববিহ্বল হয়ে পড়ে। আজ কবি ও গবেষক শ্রী তারকেশর চট্টরাজ মহাশয় বাড়িতে ডেকে পাঠিয়েছেন প্রসাদ খাওয়ার জন্য। তিনি অংশুমানকে করেন। তারকেশরবাবু ক্লেহের চোখে ছােটদের লেখেন ও ভালো তিনি বলেন, “সকলকে নিয়ে একসাথে চলার যে সুখ তা ভাষায় প্রকাশ করা যায় না। কবি অনিলবাবু বলেন, আমার সম্বন্ধে কোনো প্রশংসার কথা বলবেন না , “আমি ওসব পছন্দ করি না।” অমায়িক লােক। তিনি বলেন, আমার নামের আগে যেন কবি লিখ না। কাটোয়া তথা পশ্চিমবঙ্গের এক বিখ্যাত সাহিত্যিক কবি তারকেশ্বর চট্টরাজ মহাশয়। অংশুমান বাড়িতে অবসর সময় পেলেই লেখালেখি করে আর যখন ডাক পায় তখন সাহিত্য আসা গিয়ে বসে। কিছু ভালাে কবিতা, ভালাে গান বা ভালাে কথা শুনতে যাওয়াই তার লক্ষ্য। সে জানে সে তারই মতাে। বলে, আমার ক্ষমতা যতটুকু, ততটুকই আমার পক্ষে সম্ভব। এর বেশি আমি কোথা থেকে পাই। আর মনে করে আদিত্যর কথা “কিছু নাই পারেন অংশুদা, অন্তত একজন ভালাে মানুষ তাে হতে পারেন।রুদ্রজ ব্রাহ্মণ সম্মেলন অনুষ্ঠানে অংশুমান সৈকতকে নিয়ে গেছে। প্রণব আর আদিত্য নিমন্ত্রণ করেছে। বড় স্টেজে অনুষ্ঠান হচ্ছে। অনুষ্ঠানে এসেছেন মধা শ্রী স্বপন দেবনাথ, আসাম ও পুরী থেকে দু-জন সাধুবাবা, পৌরপ্রধান অমর রাম, বিধায়ক শ্রী রবীন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায়, গবেষক স্বপন ঠাকুর, কবি তারকেশ্বর চট্টরাজ প্রমুখ বিশিষ্টজন ছাড়াও আরও অনেকে। সবাইকে মালা-চন্দন দিয়ে বরণ করা হল। উদ্বোধনী সংগীত হল। ডঃ স্বপন ঠাকুর গবেষণধর্মী একটি বক্তব্য রাখলেন। সমবেত সুধীজনের হাততালিতে ভরে উঠল সভাপ্রাঙ্গণ। এবার একটি সংগীত গাইছে একজন কিশোরের। ইতিমধ্যে রােমাঞ্চিত হল। এতবড় একজন পণ্ডিত মানুষ আমার পাশে-বলল অংওমান দেখি “আমার পাশে ত্রিপলে মাটির মানুষ ডঃ স্বপন ঠাকুর। আমার দেই আদিত্যকে। আদিত্য বলল, “অবাক হচ্ছেন কেন? পৃথিবীতে যারা বড় তার এইরকমই হন। এটাই স্বাভাবিক। আমি মঞ্চে উপবিষ্ট মানেই আমি সব। এসব নিচু মানসিকতার লক্ষণ। আদিত্য আবার আলাদা। এই ধারণা শুনিলে প্রাণপাগল করা সেই গান- যারা সুজন নাইয়া, উজান বাইয়া বােকাই করে মাল স্বদেশে ফিরে গেছেন তারা, থাকিতে সকাল, থাকিতে সকাল রে, থাকিতে সকাল। এমনি কত গান পাগল আদিত্য, অংশুমানের পাড়ার ভাই। বার্তাসূচী সাপ্তাহিক পত্রিকার সম্পাদক শ্ৰী দেবাশীষ রায়ের সঙ্গে আশুমানের এখানেই পরিচয়। আদিত্য অংশুমানকে বলল, “বার্তাসূচীর সম্পাদক মহাশয় কে লেখা দেবেন। আপনার লেখা ছাপা হবে।” সম্পাদককে বলে দেখে অংশুমান। শ্রী দেবাশীষ রায় সমস্ত লেখককেই সম্মান দেন। তার পত্রিকা এখন বাজারে বেশ নাম করেছে। পত্রিকাটিতে সম্পাদকের ভাবনার ছাপ স্পষ্ট। আত্যি এখন সরস্বতী পূজার প্রস্তুতি নিয়ে খুব ব্যস্ত। প্রথ্যাত জি, খ্যাত কবি অসীম সরকারকে নিয়ে আসছে আদিত্য। প্রায় দশহাজার লোক জমায়েত হয় এই কবির গান শােনার জন্য। যুবকদের সঙ্গে থেকে আদিত্য এইসব অনুষ্ঠান পরিচালনা করে থাকে। আদিত্য অংশুমান বলল, এবার সরস্বতী পুজোর সময় কবি অসীম সরকারকে দেখতে আসবেন, দেখবেন ভালো লাগবে।এবার অনেকদিন পর কাটোয়ায় অংশুমানের বাড়িতে এল। সঙ্গে পরেশ তার মাসীর ছেলে। অংশুমান ও পরেশ ছােটো থেকেই বন্ধুর মতাে। ওরা একসঙ্গেই থাকত কোনাে বিয়ে বা অনুষ্ঠান বাড়িতে। অংশুমানের পিসির ছেলে কালীচরণ ও বড়পিসির ছেলে অপু। ওরা সবাই সমবয়সি। যখন কোনাে বিয়েবাড়িতে ওরা একসাথে থাকে তখন বিয়েবাড়িও যেন আলাদা একটা মাত্রা পেয়ে যায়।। বাৰু পরেশকে সঙ্গে এনেছে কারণ পরেশের ছােট দিদির ছেলের জন্য এক পার্থ প্রয়ােজন। বিয়ে দিতে হবে। ছােট দিদির ছেলে রমেশ। রমেশ অরে। কিন্তু পছন্দ মতো মেয়ে পাওয়া যাচ্ছে না—বলল পরেশ। পরেশকে বলল, “চলাে অংশুমানের বাড়ি ঘুরে একবার ছােট মামীর গিয়ে বলে দেখি।” পরেশ বলল, “হ্যা, যা করেই হােক এক বছরের নয় বিয়ে দিয়ে দিতে হবে। পরেশ সাঁইথিয়া হোমিওপ্যাথি দোকানের মালিক। খুব সৎ, সত্যবান ও পরিশ্রমী। ফুটবল খেলতাে ভালো। এখন বিয়ে করে সংসারী হয়েছে। পরেশ বলে, কত, জানিস অংশুমান জীবনে লােভে আদর্শ ভ্রষ্ট হয় নি । আমি আমার আদর্শ নিয়ে সঠিক এ জীবনে পরেশ কারাের সাথে খারাপ ব্যবহার কোনোদিন করেনি। সবাই তাকে সৎ, সাহসী ছেলে বলেই জানে। ওদের এ ডাকাতের উপদ্রব। রাত্রি হলেই সবাই ভয়ে ভয়ে কাটাতে। এই হয়-এরকম ভাব। গরেশ ও তার বন্ধুরা নিয়ম করে লাঠিসেসাঁটা নিয়ে রাত পাহারা দিয়ে চিৎকার করে সমস্যার শুরু করল। ওরা হাঁক দিত, ‘ও-ও-ও হ্যাৎ’-চিৎকার করে । কিছুদিনের মধ্যেই ডাকাতদের অত্যাচার কমে গেল। সবাই । ঘুমুতে পারল। অংশুমান মাসির বাড়ি গেলেই পরেশের সঙ্গে ময়ূরাক্ষী নদীর তীরে যেত। ওখানে বালির চরে ফুটবল খেলা হত। অংশুমান বলত, পরেশ আ তােদের এখানেই থেকে যাবাে। পরেশ বলত, “নিশ্চয়ই থাকবি।” সেসব ছােটবেলাকার কথা মনে পড়ে আর ভালাে লাগে—অংশুমান বলল দেবীকে। সব ছােটবেলার কথা অংশুমান তার ছেলে সৈকতকে বলে। সৈকতের এসব শুনে শুনে মুখস্থ হয়ে গেছে। সৈকত আজ মন দিয়ে বাংলা পড়ছিল। বাংলা বইয়ে ভালাে ভালাে লেখকের গল্প-কবিতা আছে। লালন ফকিরের একটা কবিতা আছে, ওটাই সৈকত পড়ছে, “বাড়ির কাছে আরশিনগর, ও এক পড়শি বসত করে।” অংশুমান সৈকতকে থামিয়ে বলল, এর অর্থটা জেনে নিস। শেষে অংশুমান নিজেই বলল, আরশি হল আত্মদর্শনের এক মাধ্যম অর্থাৎ যা নিজেকে দেখা যায়। তাই আরশি’ হল মানুষের মন। আর ‘পড়শি বলট বােঝানাে হয়েছে প্রত্যেক মানুষের মধ্যে বাস করা আর এক মানুষ বা ঈশ্বর বা মনের মানুষ। যাকে অন্য গানে লালন অধর মানুষ’, ‘সহজ মানুষ। অলখ সাঁই ইত্যাদি বলেছেন। সৈকতের খুব ভালাে লাগে বাবার কথা। অংশুমানের ক্লাসমেট’ সুলেখক ডা রবীন্দ্ররনাথ মণ্ডল খুব ভালোবাসে তাকে। তার কাছে অনেক প্রয়োজনে অংশুমান উপকার পেয়েছে।কিছু লোক যদি এইরকম হৃদয়বান হতেন, তাহলে মানুষের উপকার হত। সুলেখিকা সুজাতা বন্দ্যোপাধ্যায় সম্পর্কে অংশুমান লেখা পড়ে অনেক অনা তথ্য জানতে পেরেছে। বিবেকানন্দবাবু ও আরও লােকজনের সঙ্গে দেখা হয় । টিফিনে বাড়িতেই থাকে। মানুষ কেন খাওয়া-খাওয়া করে। আর মাসে যতটুকু পারে সাহায্য করে। বড়দার হাতে দেয়, মায়ের ওষুধ দেয়। আজ কবি বলছেন সভায় “গুরুজনদের প্রণাম। সবাইকে যথাযােগ্য সম্মান জানিয়ে আমি দু-চারটে কথা বলব। ধর্ম কথার অর্থ, । ধারণ করে থাকে। সমাজের শান্তি, সুস্থ মন ও কর্ম হচ্ছে ধর্মের ফল। কথাটি সন্ধিবিচ্ছেদ করলে অন্যের কথা আসে। কিন্তু সেই নিয়ম। সুস্থ নিয়ম পালন পুর্বক আমরা যদি প্রত্যেক কর্ম করি, তাহলে ধরে সেটা হল সনাতন ধন অনুশাসন সার্থক হয়। সনাতন ধর্ম। ধর্ম একটাই। সেটা হল সনাতন আর বাকিগুলাে হল সম্প্রদায় বা গােষ্ঠী। এক-একটি গােষ্ঠি করে চলতে ভালােবাসে। আমরা একদম প্রাচীন যুগে যদি চলে যখন মানুষের সৃষ্টি হয় নাই, তাহলে দেখা যাবে, এককোষী প্রাণী থেকে ধীরে ধীরে বিবর্তনের মাধ্যমে মানুষ এসেছে। আর একজন মানুষ পিতা থেকে আমাদের সৃষ্টি। একজন পিতা আর একজন মাতা থেকেই ধীরে ধীরে এই বিশ্বের মানুষরা এসেছেন। অনেকে বলেন এই পিতামাতার নাম আদম ও ঈভ। তাহলে প্রশ্ন আমরা মানুষ হয়ে তাহলে আলাদা ধর্মের হতে পারি কি করে? আমরা লড়াই করি কেন? এসব প্রশ্নের উত্তর জানার জন্য আমাদের। শিক্ষার মাধ্যমে নিজেদের উন্নত করতে হবে। অংশুমান বলছে, আমি অনেক কথা বলেছি। আর কিছু বলব না। আপনারা সকলেই বুদ্ধিমান। সবাই আমার প্রণাম নেবেন-এই বলে অংশুমান সভা থেকে নিচে নামল। চা-বিস্কৃত খেলাে তারপর সভা শেষ হলে বাড়ি ফিরল। তখন প্রায় দশটা বাজে। পরের দিন স্কুল আছে। তাড়াতাড়ি খেয়ে শােয় অংশুনান। মা ও ছেলে তখনও টি.তি, দেখছে। দু-দিন পরে ডঃ স্বপনকুমার ঠাকুর, আদিত্য ও অংশুমান একটি গ্রামে যাবে ঠিক করল। ডঃ ঠাকুর প্রত্নগবেষক। তিনি বললেন, “ভারতবর্ষ নদীমাতৃ দেশ। বড় বড় নদীর ধারে বড় বড় বসতি তৈরি হয়েছে। আমরা যেখালে যাব সেই গ্রামটিতে গঙ্গা নদীর নিকটবর্তী গ্রাম। আদিত্য বলল, “শুনেছি ওই গ্রামে একটা পুরােনাে বাড়ি আছে। ও বাতে অনেক ঐতিহাসিক নিদর্শন আছে। আমরা তার ছবি তুলে নিয়ে বললাম, “তাই হবে। এই পুরােনাে বাড়িতে রাজরাজেশ্বরীর মূর্তি আছে। আবার ওখানে একটি পরিবার বাস করেন। তারা বলেন, এইটি পাঁচশাে বছর আগেকার বাড়ি।”শঙ্কর বললেন, “তথ্য থাকলে তবেই এসব কথা বিশ্বাস করা যাবে। | ঠাকুর বললেন , কথা দিয়ে উপন্যাসের মতাে এইসব কথা বলা যায় না। তার জন্য উপযুক্ত তথ্যপ্রমাণাদি প্রয়োজন।” ওরা সবাই গিয়ে একবার গ্রামে ঘুরে আসার মনস্থির করল। অংশুমান আবার আদিত্যর কাছে গেল। আদিত্য খুব ভালাে গান করে। “নির্মল বাংলা’ নিয়ে একটি গান লিখেছে খুব সুন্দর। অংশুমান গান গাইতে জানে। তবু একবার গানটি গাইবার চেষ্টা করল। অংশুমানকে উৎসাহ দেয় সবাই খুব। গান, কবিতা, গল্প, উপন্যাস লিখতে বলে। অংশুমান উৎসাহ পেয়ে বাড়ি এসে অনেক পড়াশােনাও করে। বর্তমানে দেশে যে রাজনৈতিক অস্থিরতা চলছে তার বর্ণনা করতে গেলে খুন, ধর্ষণ লেগেই আছে। সংবাদপত্র খুললেই শুধু রক্তারক্তির খবর। মানুষে মানুষে হানাহানির খবর। অংশুমানের ভালাে লাগে না। দেশে শান্তি আসবে। সবাই সুস্থভাবে খেয়ে পড়ে বেঁচে থাকবে। বাঁচো এবং অন্যকে বাচতে দাও’—এই আদর্শ নিয়ে সবাই চলবে। তবে হবে সুস্থ। দেশের সুস্থ নাগরিক। অংশুমান জানে সেই দিন নিশ্চয়ই আসবে। এখনও শাসকদলে অনেক ভালাে লোক আছেন। তারাই একদিন ছাত্র-যুব সবাইকে এক ছাতার তলায় এনে একতার গান গাইবেন। আজ অংশুমান পুরুলেতে এসেছে। বড়দা দিলীপ বলল, “সৈকত আর বৌমাকে একদিন পাঠিয়ে দিস। অনেকদিন আসেনি ওরা।” অংশুমান বলল,ঠিক আছে।”রিলিফ লিলুয়া থেকে স্ত্রী-পুত্র-কন্যাসহ পুরুলে এসেছে। অংশুমানের স্কুল। বর। ভাবল বড়দা মাঝে মাঝেই সৈকতকে যেতে বলে। এইসময় পাঠালে বর সঙ্গেই দেখা হয়ে যাবে। অংশুমান দেবীকে বলল, “যাও তুমি আর সৈকত একবার পুরুলে থেকে ঘুরে এসে।”সে বলল, “তাহলে তুমি চলে যেও না ঘর ফাকা রেখে। যা চোরের ম” অংশুমান বলল, “না না, আমি বাড়ি থেকে বেরােব না। দু-দিন সবাই যাও তােমরা ঘুরে এসো। পর আর সৈকত সকালবেলা বেরিয়ে পড়ল। অংশুমান নিশ্চিন্ত হল,আর নয় এখন বেড়াতে যেতে পারে না। যখন মায়াপুর গেছি তখন মনে আছে, নজনেই গেছিল। তখন একটা ঘরে ছিল তিনজন । এখন যা হােক দুটো-একটা জিনিস হয়েছে। চোর। এসে নিয়ে তাহলে আর বােধহয় অংশুমান ঘুরে দাঁড়াতে পারবে। পুুরুলেতে গিয়ে সৈকত আর ইন্দ্র দু-দিন খুব ঘুরে বেড়ালাে। সেই নতুনপুকুর , হাড়ি পাড়া, পুজো বাড়ি, হাইস্কুল আর দক্ষিণের খােলা মাঠ। সেখানে। গিয়ে কি করে যে সময় কেটে যায় পাখির গান শুনে, বাতাসের শিহরনে। তা ওরা বুকতেই পারল না। সৈকত আর ইন্দ্র যেন অংশুমান আর বিডি ছােটবেলার ছবি। তারা যেভাবে যীতলায় বেলগাছের ডালে উঠে খদের গায়ে লাফ মারত। সৈকত আর ইন্দ্র আরও অন্যান্য বন্ধুদের সঙ্গে একইরকমভাবে খেলে বেড়াচ্ছে। সেই ছোটবেলা, ছোলামুড়ি আর লুকোচুরি খেলার দিন ফিরে এসেছে। ঘেঁটুফুল, ঘাসফড়িং সবকিছুই নতুন করে চেনা এক ধারাবাহিক পদ্ধতি। এত শিশু আসে আর এক শিশু বড় হয়ে যায়। আবার তার জায়গায় আর এত শিশু এসে ফনি ধরে, লুকোচুরি খেলে, ডিগবাজি খায়, হাওয়াতে দোলে। এ-এক চিরন্তন প্রবাহ জেগে ছিল, জেগে আছে, জেগে থাকবে। এক অসীম নিরবছিন্ন খেলা। দু-দিন পরে আবার ওরা কাটোয়াতে ফিরে এল। কাটোয়াতে এসে প্রায় দু-দিন ধরে সৈকত বলছে, “বাবা, ঠাকুমার জন্যে মন খারাপ করছে, ইন্দ্র জন্যে, বাড়ির সবার জন্যে, ষষ্ঠীতলার জন্যে, নতুন পুকুরের জন্যে মন খারাপ করছে?”অংশুমান বললাে, “মন খারাপ কোরাে না। আবার সুযােগ পেলে ওখানে চলে যাবে। অংশুমান বাবার চাকরিসূত্রে বিভিন্ন জায়গায় কাটিয়েছে। অংশুমান ও তার বন্ধুরা অনেক জায়গায় ঘােরাঘুরি করেছে। পুরী, দার্জিলিং, দিঘার সব জায়গায় গেছে। এখন ঘরে বসে অবসর সময়ে এইসব কথা লেখে। একটা জীবন একটা উপন্যাসের মতাে। অনিলদার বাড়ি। অনিলদা বলেন “চলো অংশুমান, আজ আয়ের সাহিত্য আসর। চলো ঘুরে আসি। অংশুমান বলল, “চলুন ভালােই হবে, একটা কবিতা পাঠ করব। আজয়ের আসরে গিয়ে ওরা দু-জনে কবিতা পাঠ করল। তারকেশ্বর বাবু বললেন ,, “পরবর্তী মাসের আসর কাটোয়া মহুকুমা মন্দিরে অনুষ্ঠিত হবে। সাহিত্য আসরেই পরবর্তী মাসের আসরের দিন ঘোষণা করা হয়। আবার মাসের প্রথম শনিবার বিজ্ঞান পরিষদে অনিল ঠাকুর সাহিত্য আসরে গিয়ে অনুগল্প পাঠ করল। অনিল ঠাকুর বললেন, আমরা একসঙ্গে বাড়ি যাবাে। তুমি চলে যেও না।” অনুষ্ঠান শেষে ওরা বাড়ি এল, কবি ও গবেষক অনিল ঠাকুর সতিই খুব গুণী মানুষ।অংশুমান কথা বলে মোবাইল রেখে দিল। তারপর দেবীকে বল,পুরুলেতে জেঠুমা মারা গেছেন। এই দশ মিনিট আগে।” তখনও খিচুড়ি, ডিমভাজা, আলুভাজা খাওয়া হয়নি। সব কুকুরকে খাওয়ানো হল। সঙ্গে সঙ্গে তিনজনেই রওনা হল পুরুলে গ্রামের বাড়ির উদ্দেশ্যে। প্রায় ধু-ঘন্টা পরে ওরা পুরুলে পৌছে গেল। পাশের বাড়িতে জেুমা থাকতেন। সুই ছেলে বুড়ো আর ভােম্বল। ভবদেব মারা গেছে আগে। ওরা মোট তিত এক বোন। বড়দা, বাবু, অংশুমান সবাই কাটোয়ার শানে যাওয়ার নিল। বিলিফদাকে ফোন করে দেওয়া হয়েছে। রিলিফদা বলল, “আ বোলপুর এসেছি। রাস্তায় ঠিক দেখা করে নেব। তারপর তোমাদের স ববাে।” বাবা মারা যাওয়ার সময় সব ভাইরা একত্রে শাক পালন করেছেন। আবার জ্যাঠাইমা মারা যাওয়াতে সবাই এক হল। কাটোয়ার শ দাহকার্য সমাপ্ত করে সবাই গঙ্গান্নান করার পর সাদা কাপড় পড়শীরা যারা এসেছিলেন সবাই গঙ্গন্নান করে নিলেন। গ্রমের বাবু বাবন , মলয়, নিতাইদা, গোপালদা, , প্রশান্ত, ও আরও অনেকে এসেছেন।এইভাবে কথাবার্তা চলছে। এদিকে দেবী, বড় বোন মামণি, ছােটো বােন পপন ও তাদের ছেলেমেয়েরা, জমাইরা সবাই এসেছে। ঘর মানেই তো মানুষের সমাহার। যে ঘরের মানুষ যত ভালো, সেই ঘর ততটাই সুন্দর। বাই একসাথে এখন থাকবে দু-চারদিন। কারণ চলে গেলে আবার যে লেগে যাবে। আবার কবে দেখা হবে কেউ নিয়ে খুব তাড়াতাডল বাণুর বন্ধু মলয মণল মলয় ও অংশুমানের ভাই-এর ম।। প গাশানে গিয়ে অনেকক্ষণ হরিনাম হয়েছিল। হরিনামের মল যে ছিল ভইা। কাটোয়া শশান গঙ্গার প্রায় কাছাকাছি। তখন ইংলফটিক In tv না। কাঠের আগুনে বা কয়লার আগুনে দাহকার্য সমাপ্ত এ। । ভবা পাগলার সেই বিখ্যাত গান মাইকেে বাজছে। ” ও আমার ব্যথা এভাবে চলে গেলেন তা নয়, যেতে হবে আমাদের আমরা শুধু আমার আমার করেই কাটিয়ে দিই সময়। বৈরাগ্য হলেই তো হবে না।এমন আবেগ আমাদের, মানুষদের করা হল হিংসা,, লোভ পাপ করে সতিকারে মানুষ এখন। আর কিছু হতে না পারি এক এ কারও মাথা নেই। ফলে থেকে সবাই যে যার চলে গেল। পুরুলেতে থাকল বাকি সংসার পরিজন। অংশুমান নিজের পরিবার। । শহরে চলে এল। দেবী তাে ঘরে এসেই বুল ঝাড়া, ঝটি দেওয়া করতে লাগল। সৈকত একটা গল্পের বই নিয়ে বিজ্ানায় পড়তে । অংওমান বাজারে গেল কিছু বাজার করে আনার জন্য। ঠিকঠাক করে রবাি হতে প্রায় বেলা দুটো বোঝা গেল। দেবী কল, “সৈকত আয় খাবি আয়।সৈকত ডাকল বাবাকে। খওয়া-াওয়া হয়ে গেল। দুপুরে একটু শুয়ে সকলে বিশ্রাম করে নিল। বিলকেলায় দেখি ও অংশুমান হাঁটতে বেরােয় আর সৈকত খেলতে যায়। নাড়ের প্রতিবেশীরা সকলে খুব ভালােবাসে। তারা বলে, “আপনারা সকলে বেড়িয়ে যাবেন না। একজন ঘরে থাকবেন।” ঘরে মানুষ থাকলে চোর সাধারণত ঢুকতে সাহস পায় না। | প্রায় মাস হয়ে গেল জেঠাইমা মারা গেছেন। সবই ঠিকঠাক চলছে। একদিন সকালে উঠে দেবী বলল, “ওঠো, দেখাে আমাদের জলের কল চুল নিয়ে গেছে। রাত্রে চোর এসেছিল।”আমি রাতে কোনাে শব্দ পাই নি। কিন্তু কি করে যে চোরে কল তুলে নিল কোনাে শব্দ না করে তা আজও রহস্য থেকে গেল ওদের কাছে। সংসারে। আলো-মন্দ লোক আছে। সবাই তাে আর দয়ালু মানুষ হয় না। জল দেওয়ার জন্য একটা লােক রাখল অংশুমান। সে দু-বেলা রােজ খাবার জল দিয়ে যায়। আসনপন্ন যে, কাপড় কাচা প্রভৃতি কাজের জন্য একটা কুয়াে আছে। দেবী। এখানেই মায়। আ রাত্রে অংসুমান একবার ছাদে এল। আকাশে অসংখ্য তারা। শ কে তাকিয়ে অংশুমানের মনটা ভালাে হয়ে গেল। কোনাে ব, কোনো সমস্যা এখন আর নেই। তার অন্তরে এখন আকাশের সুর। গছে। সে অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে নক্ষত্রের দিকে। তার মন সে টিনিন আকাশের নক্ষত্র ছুঁতে চায়। তখন আরও স্বল্প দেখে। সে নক্ষত্র রয়েছে। সারা বিশ্বের ভালো মন্দ র আর তার উপর ন্যস্ত হয়েছে। সেই অবস্থায় অংশুমান পৃথিবীর। নর মানচিত্র মুছে ফেলে একটা গ্লোবে পরিণত করতে চায়। পৃথিবীর ওয়েব থেকে আর মােবাইলে গান পাঠানাে যায় ঠিক সেইরকম মানুষের হৃদয়ের মিলনের সুর সারা দুনিয়ার মানুষের মন সেনানে যাবে না কোনাে হন্দ, ইবা কিভাবে জাতের নামে বতি। ভারতবর্ষের সনাতন ধর্ম, ঐতিহ্য, সংস্কার পৃথিবীতে , ভারতবর্ষের আদর্শে অনুপ্রাণিত সারা পৃথিবী, সেখানে সবাই কে ক, মহিলার সম্মান আর শিশু-যুবকের অধিকার। অংশুমান আয় নিচে শুয়ে ভাবছে তার অতিক্রম করে আসা জীবনের কথা।কতউল জীবন-মৃত্যুকে উপেক্ষা করে আজও এই বয়সে নবীন সবুজ মনে পৃথিবীর আজ তার কোনো দুঃখ নেই, শােক নেই। সারা জীবনের অভিজ্ঞতাই তার আজ পাবো। এক দুর্নিবার আকর্ষণে তার মন ছুটে চলেছে অজানা অসীম আনন্দের সরােবরে। সেখানে সে রাজহংসের মতাে শুধু দুধের বুকে, জীবনের সার বস্তুর কথা ভাবে।ও মন সওদাগর / কেন মিছে লত র / দেশের মানুষ দেশে ফিরে চল”। সারা পৃথিবীর মানুষ আহ তার সুরে সুর মিলিয়ে বলে চলুক এক মন্ত্র, আমরা এখানে এসেছি দু-দিনে অতিথি হিসাবে। এখানে হিংসা, মুগার কোনাে জায়গা নেই। চলে যেতে হবে আমাদের সকলকে। পৃথিবী ছেড়ে চলে যাবার আগে এসাে আমরা সবাই মানুষের কল্যাণের জন্য পৃথিবীকে আরও সুন্দর করে তুলি। সারা পৃথিবী জুড়ে মানব-মনের ভাব প্রকাশের জন্য একটা ভাবা হােক, যে ভাষা ভৌত জগতের মর্ম সীমা অতিক্রম করে যাবে। মরমে প্রবেশ করে নামী মনের গভীরে সুর তুলবে। স্বপ্ন দেখার তাে কোনাে বিধিনিষেধ নেই। বু আগমনের মনে হয় এই স্বপ্ন একদিন সত্য হবে। রাষ্ট্রবিরােধী, সন্ত্রাসবাদী শব্দগুলি অবলুপ্ত হয়ে রাষ্ট্রকল্যাণকারী, আশাবাদী মানবিক পৃথিবী এক হয়ে যাত্রা শুরু করুক। অংশুমান যখন ছোট ছিল তখন দেখেছিল মানুষের মনে হিংসা, ঘৃণা কম ছিল। কিন্তু যতই দিন যাচ্ছে আলট্রা ভায়ােলেট রে যেন সমগ্র বিশ্বকে গ্রাস কর শেষ করে দিতে চাইছে। আমিন সহজে পৃথিবীকে ধ্বংস হতে দেবে না। তার জন্য সে তার সমস্ত দিতে প্রস্তত, ধবধবে সাদা পােশাকে আজ অংশুমান মন্দিরে বলে প্রার্থনা করছে পৃথিবীবাসী শাস্তির জন্য। তক্তিপনূত সামাজিক এবং নান্দনিক জন আন্দোলনের মাধ্যমে পৃথিবীতে শুভ হবে। স্বেচ্ছা পরিশ্রমের ফসল পাবে পৃথিবী। দৈনন্দিন জীবনযাত্রার অবলুপ্তি ঘটবে। স্বেচ্ছা পরিশ্রমের অতীন্দ্রিয়তার স্পর্শ পেতে বেঁচে থাকার সমস্ত সামাজিক এবং সঙ্গে সঙ্গে অতীন্দ্রিয়তার স্পন গুণাবলির প্রকাশ ঘটবে। গােলােকায়নের এই সুন্দর সাবলীল স্বপ্ন সাংস্কৃতিক গুণাবলির প্র অংশুমানকে আচ্ছন্ন করে তুলেছে। আজ সে রাত্রিতে স্বপ্নে দেখেছে একদিকে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আর থার উপর শ্রীকৃষ্ণ ভগবান অংশুমানকে সাহস দিচ্ছেন, অভয়বাণী শােনাচ্ছেন এগিয়ে যাওয়ার মন্ত্রে। অংশুমান বুঝে গেছে আর বেশিদিন নয়। সমগ্র পৃথিবী সংঘবদ্ধ হবে। পৃথিবীজোড়া মানবজাতি ধীরে ধীরে একত্র হবে। বিশ্ব মানবতার এক ধর্মে, এক ভাবনায়। এই আত্মিক শক্তির আড়ালেই রয়েছে মানুষের প্রাণের স্পন্দন, শাশ্বত সুন্দরের বীজমন্ত্র।পনেরো বছর নন্দনপাড়ায় কেটে গেল সৈকতের। এখন সে গ্রাজুয়েট হয়েছে। সেও বাবার মত ছাত্র পড়ায়।ইতিহাসের গল্প করে তাদের সঙ্গে।সৈকত বলে, আরেক মুসলমান ঐতিহাসিক ইসমী বলছেন, লক্ষণ সেন কখনই দুর্বল রাজা ছিলেন না। অত্যন্ত মহৎ, উদার ও সাহসী যোদ্ধা ছিলেন তিনি। বলা হয়ে থাকে নদীয়ার দুর্গ দুর্ভেদ্য ছিল, মোটেও এমনটা নয়। নদীয়ার যে দুর্গে মুহাম্মদ খিলজী আক্রমন করেন, তা ছিল অতি সাধারণ গঙ্গাতীরবর্তী একটি তীর্থস্থান। গঙ্গার তীর ঘেসে ছিল রাজার প্রাসাদ। এই প্রাসাদ সুদৃঢ় অট্টালিকা নয়। তদানীন্তন বাঙলার রুচি ও অভ্যাসানুযায়ী কাঠ ও বাঁশের তৈরী সমৃদ্ধ বাংলা বাড়ী। সেখানে পর্যাপ্ত পরিমানে সৈন্যবাহিনীও উপস্থিত ছিলেন না। ১৮ জন সৈন্য নিয়ে মুহাম্মদ খিলজী যখন নগরে প্রবেশ করেন তখন সবাই ভেবেছিলেন তারা বোধ হয় ঘোড়া ব্যবসায়ী। সেই সুযোগে খিলজী প্রাসাদে আক্রমন করে বসেন। তখন সময় দ্বিপ্রহর। মুসলমানেরা যা লুকায় তা হল, খিলজী প্রাসাদে আক্রমণ করার প্রায় সাথে সাথেই তার পিছনে থাকা বিশাল তুর্কী বাহিনীও নগরে ঢুকে যায় এবং প্রাসাদের সকলকে হত্যা করে। ইসমী বলছেন, অতর্কিত হামলা করার পরেও বৃদ্ধ লক্ষণ সেন হাল ছেড়ে দেননি। তিনি ও তাঁর সৈন্যরা সাহসিকতার সাথে দস্যু খিলজীদের মোকাবেলা করেন। একসময় পরাজয় নিশ্চিত জেনে তিনি বিক্রমপুরের দিকে পালিয়ে যান।দস্যু খিলজীর অত্যাচারের কাহিনী তখন লোককাথায় পরিণত হয়েছে। যেখানেই যা পেয়েছেন লুট করেছেন। যেখানেই যা পেয়েছেন ধ্বংস করেছেন। নির্বিচারে নগরের সাধারণ মানুষদের হত্যা ও শিরচ্ছেদ করেছেন। নিম্নবর্ণের হিন্দু, ব্রাহ্মণ ও বৌদ্ধরা দিকবিদিক পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়েছেন। অত্যাচারে টিকতে না পেরে অনেকেই ইসলাম ধর্ম গ্রহন করেছেন। বৌদ্ধ লামা তারনাথের লেখাতেও যার সাক্ষ্য আছে।অংশুমান আজ সৈকতকে হারিয়ে যাওয়ার গল্প বলছেন।সৈকত মন দিয়ে শোনে। অংশুমান বলে
হাতে একটা ময়লপড়া ঝোলা হাতে শিলকোটানি হেঁকে চলত, শিল কোটাবে গো শিল, শিল কোটাও গো শিল…
বাড়ির বৌ ঝি রা ত্রস্ত হয়ে বেরিয়ে আসত বাইরে। বাইরে এসে বলত, এসো গো আমার দ্বারে আমার শিল একবার কোটাতে হবে। শিলকোটানি লোকটা ময়লা ঝোলা থেকে বের করত ছেনি, হাতুড়ি। তারপর পাথরের শিলের উপর নক্সা ফুটিয়ে তুলতো ঠকঠক শব্দে। আশেপাশে কচিকাঁচা ছাড়াও প্রতিবেশিদের বৌরা দেখত আগ্রগভরে এই শিলকোটা। কিভাবে ধীরে ধীরে ফুটে উঠছে নক্সা হাত ও হাতুড়ির যুগলবন্দীতে।
তারপর একজনের দেখে প্রতিবেশিদের দশজন কুটিয়ে নিত শিল। পাশের বাড়ির অনিতা বললো, আমাদের বাঁটনা বাঁটা শিলটাও কেমন সমান হয়ে গেছে। ফুটো ফুটো না থাকলে মশলা ভালো করে বাঁটা যায় না।
শিলকোটানি লোকটা বলে, নিয়ে এসো গো মা। কুটে দিই শিলটা। আবার কবে আসব জানা নাই।
তারপর দশ বারোটা শিল কুটে রোজগার করে শিলকোটানি চলে আসত তার বাড়ি।
ছেনি, হাতুড়ির সব সময় ঠিক রাখত। অনেকে পাথরের শিল মাথায় করে নিয়ে আসত তার কাছে। কত যত্নে সে শিল কুটতো। তখন তার শিল্পীহৃদয় নিয়ে যেত কল্পনার জগতে। সেখানে রঙ আর রঙীন মেঘের আনাগোনা। সেই মেঘের আশীর্বাদ পেয়ে সে বোধহয় এই কাজ পেয়েছে। সে এই কাজ পেয়ে খুব খুশি। অবসর সময়ে বাগানে গাছ লাগাতেন। আবার সকাল হলেই বেরিয়ে পড়তেন শিকোটানোর কাজে। এখন আর শিলকোটানোর যুগ নেই। মিক্সির চাপে পেশাই হয়ে গেছে প্রচলিত এই পেশা। সেই শিলকোটানোর লোকটির বাড়িতে এখন নাতিদের মিক্সির বাজার। হারিয়ে গেছে পুরোনো সেই শিলের কথা। আর এক সম্প্রদায়ের মানুষ ছিল তারা হাবু গান গাইতো সাথে লাঠি দিয়ে পিঠে আঘাত করত। এইসব আঘাত দেখে সহ্য করতে না পেরে বেশি টাকা দিয়ে তাদের এই খেলা দেখাতে বারণ করত। এইভাবে হাবুগান চলত কিন্তু তার প্রচলন এখনো দু-এক জায়গায় রয়ে গেছে।
হাবু গানে প্রচলিত গান গুলো ছাড়াও কাউকে ব্যঙ্গ করে বা কোন সমাজের অত্যাচার কে ব্যঙ্গ করে গান গাওয়া হতো ।বীরভূম থেকে বহুরূপী সম্প্রদায় এখানে এসে অন্যরকম সাজে অভিনয় করে দেখাতো বহুরূপী রাম সীতা হনুমান এইভাবে তারা বিভিন্ন রকম সাজে সজ্জিত হয়ে আনন্দিত এবং তার বদলে টাকা-পয়সা উপার্জন করে তাদের সংসার চলত। বহুরূপী সম্প্রদায় এখনো অনেক জায়গায় আছে শহরের বিভিন্ন জায়গায় মাঝে মাঝে দেখা যায় হনুমান সেজে কেউ ঘুরে বেড়াচ্ছে কেউ রাবণ সেজে এসে ঘুরে বেড়াচ্ছে এবং তারা বিভিন্ন জায়গায় ভান করে বা মজার ছড়া বলে না কিছু উপার্জন করছে এবং এই উপার্জিত টাকা পয়সা তাদের জীবন নির্বাহ হয়। প্রচণ্ড গরমে তারা সারা দেহে রং মেখে এইভাবে পরিশ্রান্ত হয়ে দিনের পর দিন অর্থ উপার্জন করে এবং দিন চলে গেলে তখন তাদের আর কাজ থাকেনা তখন তারা অন্য কাজ করে। আমরা ছোটবেলায় দেখেছি ভুলো লাগা ব্রাহ্মণ এসে বাড়ি বাড়ি ঘুরতে তারা ছড়ার মত করে বলতো না বিভিন্ন গ্রামের নাম করত এবং বলতো যেসব গ্রাম ঘুরে এসে শেষে আপনাদের বাড়ি এলাম। হয়তো গ্রামগুলো আশপাশের গ্রামগুলোর নাম বলতো, মেলে পোশলা কোপা ভুলকুরি হয়ে তারপর মুলগ্রাম শিবলুন তাড়াতাড়ি হয়ে তারপর আমাদের গ্রামে এসেছে। দিক দিয়ে ভুলো লাগা ভূত নাকি তাকে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে শেষে এইগ্রামে এনেছে। তারপর ঘুরতে ঘুরতে রাস্তা ধরে প্রচন্ড গরমে মালিকের বাড়িতে এলাম বাড়িতে এসে দাঁড়াতেই কথা বলতেন একথা শুনে শিশু থেকে বৃদ্ধ এবং তাকে বসিয়ে হয়তো তার উপার্জিত অর্থ দিয়ে সংসার চলতো সংসার চলত।তারপর এক ধরনের ব্যবসাদার ছিল তারাও সরু লিকলিকে বাসের উপর সেই বোম্বে মিঠাই মিঠাই নানান রঙের মিঠাছড়ি এনে বাচ্চাদের বিভিন্ন রকম পুতুল তৈরি করে দিতে হতো বলতো আমাকে সাপ তৈরি করেছে মিঠাই মিঠাই দিয়ে তৈরি করে দিত আর আমাকে পুতুল বানিয়ে দাও বিভিন্ন নতুন নতুন ছোটদের মনভোলানো আর দেখা যায় না এর অর্থ উপার্জন করত।এই বোম্বাই লাঠি বানানোর জন্য প্রথমে নিজেকে ফুটিয়ে ফুটিয়ে হাজারের মতো তৈরি করা হতো আটা লেগে গেলে বিভিন্ন রঙে রঙিন করা হলুদ নীল সবুজের জরিনা জরিনা হতো প্রথমে তারপর যদি না হতো এবং তাতে প্লাস্টিক জড়িয়ে রাখো ধুলোবালি যাতে না পড়ে তারপর শিশুদের চাহিদামত পুতুল তৈরি করা হতো।
রদের খুব তাছাড়া একটা টিনের বাক্স নিয়ে শনপাপড়ি বিক্রেতা শোনপাপড়ি বিক্রি করত। তারা একটা চাকা ঘোরাতো টিনের বাক্সের মধ্যে থাকা এবং তাতে চিনির জল বিভিন্ন রং মিশিয়ে চাকা ঘুরিয়ে দিলে মাকড়সার জালের মত মিঠাই তৈরি হত। সেটাকে এক জায়গায় করে শোনপাপড়ি বিক্রি হতো। এক টাকায় হয়তো একটা দেখা গেল একটা বড় ফুটবলের মত শোনপাপড়ি। অনেকে এর নাম দিয়েছিল দিল্লিকা লাড্ডু। এখনো অনেক জায়গায় দেখা যায় ঘটিগরম বলে একটা জিনিস যেটা ভুজিয়া জাতীয় জিনিস দিয়ে মিশিয়ে দেওয়া হয়। সেই হাতেধরা জায়গায় থাকে একটা উনুুন এবং সেই উনুনে গরম করে পিঁয়াজ ও নানারকম মশলা মিশিয়ে ঘটিগরম তৈরি করা হয়। বাবার কাছে বড় হয়েও সৈকত গল্প শোনে। ইতিহাসের গল্প বলে ছাত্রদের অবসর সময়ে। আজ বৈদিক যুগের কথা বলছে সৈকত ছাত্রদের।সে বলছে,প্রশাসনিক ব্যয়-নির্বাহের জন্য বাধ্যতামূলক কর ও রাজ হয়ে ওঠে। ঋক বেদের যুগের (১৫০০-১০০০ খ্রিঃ পুঃ) মানুষ ছিল যাযাবর ও পণপ সময় রাষ্ট্রের উৎপত্তি হয় নি, এবং এজন্য করপ্রদান বা কর আদায়ের কোনও প না। দলবদ্ধ মানুষ বা বিভিন্ন গোষ্ঠী নিজেদের প্রয়োজনে দলপতি রাজা মনোনীত করেছেন। সাধারণ মানুষজন দলপতি বা রাজা করেছেন। সাধারণ ; তাঁর কাজের বিনিময়ে নিজেদের উৎপাদিত শস্যের একটি অংশ প্রদান করত। এর হত বলি। বলি কোনও কর নয়এটি উপহার বা সেচ্ছাদান বাধ্যবাধকতা ছিল না।পরবর্তী-বৈদিক যুগে (১০০০-৬০০ খ্রিঃ পৃঃ) আর্যরা উত্তর ও মধ্য গাঙ্গেয় উপ সম্প্রসারিত হয়। কৃষি মানুষের প্রধান বৃত্তিতে পরিণত হয়। এই অঞ্চলের লােহার হাতিয়ার কৃষিতে উদ্বৃত্ত ফসল ফলায়, সময়ে সময়ে পরবর্তী বৈদিক যুগ কলি হয়ে পড়ে।যুগ সৃষ্টি হয়, রাষ্ট্রের পত্তন ঘটে এবং রাজকীয় ক্ষমতা ৪০ সামরিক ও প্রশাসনিক ব্যয়-নির্বাহের জন্য কর আরােপ জরুরি হয়ে পতে যাকে ‘বলি’ ছিল স্বেচ্ছাকর বা স্বেচ্ছা-উপহার। এখন তা বাধ্যতামূলক হল। এই সময় প্রজাকুলকে ‘বলি ও শুল্ক” বলে দুধরনের কর দিতে হত। রাজাকে বলা হচ্ছে বলি আহরণকারী। অথর্ববেদে ‘বলি’-র গতি করা হয়েছে এক-ষােড়শাংশ, অর্থাৎ উৎপন্ন ফসলের এক-ষােড়শাংশ এবং পণ্যের ক্ষেত্রে মুনাফার এক-ষােড়শাংশ। ব্রাহ্মণ ও ক্ষত্রিয়দের কর দিতে হত না।বােঝা বইতে উৎপাদনের সঙ্গে যুক্ত বৈশ্য ও শূদ্ররা। ঐতরেয় ব্রাহ্মণ রাজাকে শৈম অর্থাৎ বৈশ্য ও কৃষকদের গ্রাসকারী বলে বর্ণনা করা হয়েছে। এই যুগে সংগঠ। ভাগদুখ নামক দু’জন কর্মচারীর উল্লেখ পাওয়া যায়। “সংগ্রহিত্রী’ হলেন কোষাধ্যক্ষ ভাগদুখ হলেন রাজস্ব আদায়কারী। এই যুগে জিনিসপত্রের মাধ্যমে রাজস্ব দিয়ে। কারণ তখনও মুদ্রার প্রচলন হয় নি। খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতকের মধ্য গাঙ্গেয় উপত্যকায় কৃষিকার্যের ব্যাপক সম্প্রসারণ। এই অঞ্চলে রাজশক্তি সুদৃঢ় হয় এবং ষােড়শ মহাজনপদের উত্থান ঘটে। কৃষির প মহাজনপদের যুগ বিকাশের ফলে হরপ্পার নগর সভ্যতার বিলুপ্তির প্রায় হল পর ভারতে আবার দ্বিতীয়বার নগরায়নের সূচনা হয়। এই যুগে ‘গহপতি ও ক্ল নামে দুই শ্রেণির সমৃদ্ধশালী কৃষকের আর্বিভাব হয়। ভূমিরাজস্বের হয়। ভূমি রাজস্ব হার ছিল এক-) থেকে এক-দ্বাদশাংশ। রাজা ও কৃষকের মাঝে কোন মধ্যস্বত্বভোগী ছিল রাজকর্মচারীরাই কর আদায় করতেন। (১) মৌর্য যুগের শাসক বর্গ সর্বপ্রথম রাজকীয় সম্পদের উৎস হিসেবে করের উপলব্ধি করেন এবং এই যুগেই করব্যবস্থা সর্বপ্রথম সুসংগঠিত ও সুনিয়ন্ত্রিত হয়। সকল কর্মোদ্যোগের জন্য অর্থ প্রয়ােজন। তাই কৌটিল্য : জাকে সর্বদা অর্থসংগ্রহ রাজকোষ পূর্ণ রাখার নির্দেশ দিয়েছেন। ফুলে মধু সংগ্রহ করে বেড়ায়, কিন্তু ফুলের কোনও ক্ষতি করে না। রাজাও তেমনি র প্রজাদের কাছ থেকে অর্থ আহরণ করবেন। কৌটিল্যের মতে, রাজা সর্বপ্রকার অর্থনৈতিক কার্যকলাপের উপরেই রাজস্ব আরােপ করবেন। ডঃ রণবীর চক্রবর্তী বলেন যে, “কর ব্যবস্থার দ্বারা সম্পদ তা মৌর্য আমলে বিশেষভাবে প্রকট। ভারতীয় ইতিহাসে যথাযথ প্রশাসনিক হের প্রবণতা মৌর্য অ হার দ্বারা সম্পদ সংগ্রহের প্রয়াস এই আমার প্রথম দেখা যায়।” (২) অর্থশাস্ত্র | এনুসারে সমগ্র করব্যবস্থার সংগঠন ও পরিচালনার দায়িত্ব ছিল দু’জন পদস্থ কর্মচারীর হর্তা’ ও ‘সন্নিধাতা’। ‘সমাহর্তা কর নির্ধারণ করে তা সংগ্রহ করতেন। ছিলেন মুখ্য হিসাবরক্ষক ও পরীক্ষক। সমাহর্তা’ সাতটি সূত্র থেকে কর আদায় সেগুলি হল দুর্গ, রাষ্ট্র, খনি, সেতু, বন, ব্রজ ও বণিকপথ। (৩) ভূমিরাজস্ব ছিল আয়ের প্রধান উৎস। ভূমিরাজস্ব তিনভাগে বিভক্ত ছিল-সীতা, ভাগ ও বলি। এর জমিকে সীতা’ বলা হত এবং এই জমি থেকে রাষ্ট্রের বেশ কিছু আয় হত। (ক) রাজার খাস জমি সীতা’ জমিতে কয়েদি বা ক্রীতদাসদের দিয়ে চাষ করা হত এবং সরকার থেকে রে লাঙল, বলদ, বীজ ও অন্যান্য সরঞ্জাম সরবরাহ করা হত, সেই জমির উৎপাদিত সালের সব রাজকীয় শস্যাগার জমা পড়তো। (ii) কখনও কখনও আবার এইসব এমিতে ভাড়াটে কৃষক নিয়োগ করা হত এবং এই কৃষকরা কৃষির যাবতীয় উপকরণ নিজেরাই যোগাড় করেনি। সে ক্ষেত্রে উৎপন্ন ফসলের অর্ধাংশ ছিল রাজার প্রাপ্য। jil) অনেক ভাড়াটে কৃষক রাষ্ট্রের কাছ থেকে কৃষির সব উপকরণ পেত, এবং তার নিজস্ব লিতে ছিল শুধু শ্রম। সেক্ষেত্রে ফসলের তিন-চতুর্থাংশ বা তিন-পঞ্চমাংশ রাজকোষে জমা পড়ত। (খ) ব্যক্তিগত মালিকানাধীন জমি থেকে রাজস্ব হিসেবে সরকার উৎপন্ন ফসলের এক-ষষ্ঠাংশ পেতেন। তাকে বলা হত ‘ভাগ’। প্রজার জীবন ও সম্পত্তি রক্ষার বিনিময়ে রাজা ভাগ আদায়ের অধিকারী ছিলেন। (গ) ঋক-বৈদিক যুগে ‘বলি’ কোন প্রকার কর ছিল, বলি’ ছিল স্বেচ্ছাধীন, কিন্তু কালক্রমে রাজকীয় ক্ষমতা বৃদ্ধির ফলে ‘বলি’ বাধ্যতামূলক পরিণত হয়। (৪) এছাড়াও কর্মকার, শিল্পী, বণিক, কারিগর প্রভৃতি পেশার মানুষ এবং একটি পণ্যের উপর কর আরােপ করা হয়। গৃহ, ফেরিঘাট, বন, খনি, পথ, জল, গােচারণ , গণিকা, পানশালা, জুয়ার খানা, কারখানা প্রভৃতির ওপর কর আরোপিত হয়। Wসর আমদানি-রপ্তানি শুল্ক, চুঙ্গিকর প্রভৃতি দিতে হত। বণিক সঙ্ বা গিল্ড-এর উপর | আরোপিত হত। সেনা রােপিত হত। সেনাবাহিনীর জন্য সেনাভক্তমনামে একপ্রকার কর আদায় করা হত। | পতঞ্জলি বলেন যে, । ” বলেন যে, মৌর্য রাজারা সােনা সংগ্রহের জন্য মন্দির প্রতিষ্ঠা করতেন। এই | এগুলো ছাড়াও আপ ভাও আপকালে সরকার অতিরিক্ত কিছু কর আদায় করতেন। তাকে প্রণয় বিভিন্ন দিক গুলোকে একত্রে ‘ব্যয়-শরীর বলা হত। রাজপরিবার, সেনাবাহিনী ও (৫) মৌর্যযুগে আয়ের বিভিন্ন উৎসগুলিকে একসঙ্গে ‘আয়-শরীর এবং ব্যয়ের অল্প কর্মচারীদের বেতন দের বেতন, রাস্তাঘাট, সেতু, বিশ্রামাগার স্থাপন এবং জনকল্যাণমূলক কাজে অর্থ ব্যয় করতেন। সৈকত ছাত্রদের ছোটবেলার ঘটনা শোনায়। সে অতীত নিয়ে নাড়াচাড়া করতে ভালবাসে। সে বলে কিশোরবেলার কথা। সৈকত বলে, আমরা কিশোরবেলায় খুব ক্রিকেট ম্যাচ খেলেছি। একবার ঠিক করলাম আমরা বিল্বেশ্বর গ্রামের সঙ্গে ম্যাচ খেলব। ভাবাও যা তার কিছুদিনের মধ্যেই আমরা বিল্বেশ্বরের সঙ্গে ম্যাচ খেলা ঠিক করে ফেললাম।
ছয় মাইল পায়ে হেঁটে যেতে হবে। আমাদের গ্রাম থেকে ছয় মাইল দূরে বিল্লগ্রাম। সেখানে আমরা হেঁটে চলে গেলাম 11 জন আর একজন এক্সট্রা মোট 12 জন। আর দর্শক আমাদের সঙ্গে ছাত্রদল 12 জন। তারপর দুটোর মধ্যে পৌঁছে গেলাম বিল্বেশ্বর মাঠে।
অজয় নদীর ধারে মাঠ। বেশ বড়। সুন্দর মাঠ তিনটের সময় খেলা শুরু হলো। ওপেন করতাম আমি আর টুলাদা। আমি এক দিকে। আর টুলাদা রানার থেকে কোনরকমে কাটানো হল দু ওভার। বেশ জোরে বল।জোর বলের চেয়ে ভালো বলছে ব্যাটিং।কোনরকমে একদিকে ঠেকােনো হলো আর একদিকে টুলাদা পেটাতে লাগলো।কুড়ি ওভার করে মাত্র খেলা। এর মধ্যে রান তুলতে হবে ভাল রকম। না হলে জেতা যাবে না।টুলা দা ছয় মারতে গিয়ে ক্লিন বোল্ড হয়ে গেল মিডল স্টাম্প উড়ে চলে গেল। তারপরে নামল নীলুদা। নীলুদা নেমে 4,6 মারতে লাগল। কিছুক্ষণ পরে নিলুদা আউট হয়ে গেল। আমি একদিকে কোনরকমে ধরে রেখেছি। টুকটাক করে রান নিয়ে কোনরকমে ধরে রেখেছি। তারপরে এরকম করে পরপর যারা মারতে পারে তারা নামছে। 4,6 মারছে আর আউট হয়ে যাচ্ছে। এরকম করতে করতে আমাদের প্রায় দুশ কুড়ি রান হলো। দু শ কুড়ি রানে অল ডাউন।এবার ওদের পালা। এবার ওরা ব্যাট করবে আমরা ফিল্ডিং করব। আমরা ফিল্ডার হিসেবে এবার মাঠে নেমে পড়লাম। যে যার নিজের জায়গায় দাঁড়িয়ে পড়লাম। আমি উইকেটকিপিং করতাম। উইকেটকিপার হিসেবে আমি দাঁড়িয়ে গেলাম। এবার ওদের দুজন প্লেয়ার নামলো। দুজন প্রথম বলেই ক্লিন বোল্ড। একদম উঠে গিয়ে উইকেটকিপার পিছনে গিয়ে পড়েছে। উইকেট গেল ভেঙে। আবার নতুন আনা হলো বাবু খুব ভালো জোরে বল করতে পারে।বোলারদের কাছে কেউ টিকতে পারেনা। শেষে দেখা গেল ওরা 100 রানের মধ্যে অল ডাউন হয়ে গেল।আমরা জিতে গেলাম। খুব হুল্লোড় হইহই চেঁচামেচি করলাম। মাঠের মধ্যে আমাদের মাস্টারমশাই সুধীনবাবু ছিলেন। তিনি বললেন দাঁড়াও তোমরা জিতেছো। তোমাদের জন্য পুরস্কার আছে। তার সঙ্গে সঙ্গে আমরা স্কুলের গেট পর্যন্ত গেলাম। একটা হাই স্কুল আছে সেটাই আমাদের স্কুল। সেখানে আমরা পড়াশোনা করতাম। সেই স্কুলের মাস্টারমশাই সুধীনবাবু, করলেন কি, একটা বড় হাঁড়ি করে এক হাঁড়ি রসগোল্লা আমাদের হাতে তুলে দিলেন।অজয় নদীর বাঁধ ধরে কিছুটা এসে মাঠে নামতে হবে। তারপর আমরা হেঁটে যাওয়ার রাস্তা ধরে হাটবো। একটা বট গাছের তলায় আমরা সেই এক হাড়ি রসগোল্লা নিয়ে বসে পড়লাম। সবাই খেলাম। পাশে একটা কল ছিল। সেই কল থেকে জল নিলাম। চাষীদের কল। সেইসব কল থেকে তখন জল পড়ছিল। বোতলে জল ভরে আমরা খেলাম। খুব আনন্দ হয়েছিল সেদিন তারপর আস্তে আস্তে স্লোগান দিতে বাড়ি গেলাম।বিল্বেশ্বরকে হারালো কে? পুরুলিয়া ছাড়া আবার কে। বিল্বেশ্বর কে হারালো কে পুরুলিয়া ছাড়া আবার কে?তখন শীতকাল পৌষ মাস। শুধু খেলা আর খেলা। আবার এক মাসের মধ্যেই আমরা ম্যাচ ধরলাম। পাশের গ্রাম বেলুনের সঙ্গে। বেলুনে আমরা ওখানে খেলতে যেত খুব ভালো লাগত। কাঁদরধারে একটা মাঠ। ইশানী নদীকে কাঁদর বলে ওখানে। আবার আমার ছোট পিসির বাড়ি। যাই হোক সবাই মিলে খেলতে গেলাম। একটা ছোট ছেলে ছিল তার নাম তাপস। তাকে প্রথমে ওপেন করতে নামানো হলো। সে ওদের কি ভীষণ রাগ। ছোট ছেলের সঙ্গে আমরা খেলব না আমরা যখন বললাম, ওকে আউট করে দেখাও?
ওরা জোরে বল করলো। তাপস আস্তে করে ঢুকিয়ে দিলো স্লিপারের মাঝে। একদম সম্মানজনক এক্সপার্ট ব্যাটসম্যানের মত। তখন ওরা অবাক হয়ে গেল। আমি বললাম আউট করতে পারবে না। তারপর তো আমরা আছি। এরকম ভাবে খেলতে খেলতে বেলুনকেও আমরা হারিয়ে দিলাম। বেলুন থেকে যখন আসছি তখন আমাদের শ্লোগান হলো বেলুন ফুটো করলো কে? পুরুলিয়া ছাড়া আবার কে।নীলুদা অধুনা ক্যানাডাবাসি। সেই ছোটবেলায় খুব মজা করত। বেলুন থেকে ফেরার সময় এক দাড়িয়ালা কে দেখে বলছে, এ বাবা দাড়ি দেখ। এক দাড়িওয়ালা দাদু খুব রেগে গেছে।বলছে কি অসভ্য তোমরা। কাকে কি বলতে হয় জানো না নীলুদা এইভাবে আমাদের সাথে থাকতেন এবং আমাদের আনন্দ দিতেন। এরপরে আমরা ক্রিকেট দলের সবাই চিন্তা করলাম যে, ভালো কাজ করতে হবে। রাস্তা, তখন মাটির রাস্তা। রাস্তার এক জায়গায় গর্ত ছিল। সবাই মিলে ওই গর্ত ভরাট করলাম। তারপর ঠিক করলাম, এবার গাছ লাগাতে হবে। প্রচুর গাছ বিডিও অফিস থেকে নিয়ে এলাম। নিয়ে এসে রাস্তার ধারে, শিশু গাছ, আমগাছ, দেবদারু গাছ লাগিয়ে ছিলাম। মনে আছে। সেই গাছ গুলো এখন কতো বড় বড় হয়ে গেছে। কিন্তু সেগুলো তো সব পঞ্চায়েতের অন্তর্গত হয়েছে। সেগুলোর উপর আমাদের অধিকার নেই ঠিকই। কিন্তু সকলের সুবিধার জন্য আমরা সেই গাছ লাগিয়ে ছিলাম। এখন সেই গাছ গুলো দেখে আমাদের খুব আনন্দ হয়।
নীলুদা বলতেন, পরের জন্য কাজ করে যে আনন্দ পাওয়া যায়, সেই আনন্দ আর কোথাও পাবি না। সেইজন্য মনে রাখবি সারা জীবন পরের উপকার করার চেষ্টা করবি। কোনদিন স্বার্থপরের মত শুধু নিজের কথা চিন্তা করবি না।গাছ লাগানোর নেশা আমাদের ভূতের মত পেয়ে বসে ছিল। আমরা গাছ লাগাতাম বিডিও অফিসে প্রচুর গাছ পেতাম। এনে লাগাতাম একদম রাস্তার ধারে ধারে। সেনপাড়া তালাড়ি গ্রামে। এখন গাছগুলো বড় বড় হয়ে গিয়ে তারা আমাদের সেই ছোটবেলার স্মৃতি মনে পড়িয়ে দেয় । আমরা সেই ক্রিকেটদল ছোটবেলা থেকেই নাটক, তারপর যে কোন অনুষ্ঠান, 25 শে বৈশাখ পালন করতাম। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্মদিন আমরা একটা ছোট্ট স্টেজ বানিয়ে সুন্দরভাবে পালন করতাম। প্রথমে গান গাইতো আমাদের পাড়ার মৌসুমী। তারপরে আবৃত্তি করত নয়ন। আরো অনেক ছেলে ছিল। তাছাড়া আমাদের ক্রিকেট দলের সবাই আমরা দেখাশোনা করতাম সকলকে। আমরা এইসব কাজ করতাম। তারপর রবীন্দ্র জয়ন্তী পালনের শেষে আমরা সবাইকে একটা করে কেক খেতে দিতাম। আমরা নিজেরাই চাঁদা তুলে কেক কিনে নিয়ে আসতাম।আমাদের দলে আমি মিলু বিশ্বরূপ এই তিনজন একসাথে সব সময় থাকতাম। আমরা তিনজন মোটামুটি দলটাকে পরিচালনা করতাম। তাই আমরা কোন অসুবিধা হলে কারো কাছে চাঁদা চাইলেই সহজেই পেয়ে যেতাম। একবার বন্যায় সব মাটির ঘর বাড়ি ভেঙে গেছিলো। আমাদের হাজরা পাড়ায়। তখন আমরা চাঁদা তুলে সেই পাড়ায় সকলের দেখাশোনা করেছিলাম। বন্যায় দু-চারজন ভেসে যাচ্ছিল। আমরা নৌকা করে তাদের হাত ধরে
ছিলাম। এই সব স্মৃতি এখনো মনে পড়ে। মনে পড়লে খুব আনন্দ হয়। গর্ব হয় আমাদের কিশোরদলের।
😍😍😍😍😍😍
সৈকতের প্রিয় বন্ধু যাত্রাশিল্পী।তার নাম অরিন্দম।শিশিরবাবু, স্বপনবাবু, হেমন্তবাবু, তড়িৎবাবু সকলেই বড় বড় যাত্রাশিগোপালবাবু যাত্রা বিশেষজ্ঞ। তিনি যুবকদের যাত্রাশিল্প পুনরুজ্জীবিত করার কথা বলেন। অরিন্দম বলে, যাত্রা করে এখন পেট ভরবে। কেউ দেখবে না। গোপালবাবু বলেন, সময়ের সঙ্গে তাল রেখে চলতে পারলে এই শিল্প চলবে নিশ্চয়। অরিন্দম গোপালবাবুর কাছে যাত্রাশিল্প সম্বন্ধে জানতে পারে অনেককিছু। অরিন্দম যাত্রার পাঠ নেয় গোপালবাবুর কাছে। গোপালবাবু বলেন, অষ্টাদশ শতকে(১৭০০ সাল) যাত্রা বাংলা ভূখণ্ডের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে। সে সময় শিশুরাম, পরমানন্দ অধিকারী, সুবল দাস ছিলেন যাত্রার জগতে প্রসিদ্ধ। উনবিংশ শতকে পৌরাণিক কাহিনিভিত্তিক যাত্রা খুব জনপ্রিয়তা পায়। মতিলাল রায় ও নীলকণ্ঠ মুখোপাধ্যায়ের যাত্রাদল প্রসিদ্ধি পায়। সে সময় কৃষ্ণলীলা এবং রামায়ণ-মহাভারতের পৌরাণিক কাহিনির পাশাপাশি বিদ্যাসুন্দর, লাইলি মজনু, ইউসুফ জোলেখা, বেহুলা লখিন্দর, মা মনসা, লক্ষ্মীর মহিমা, কমলাবতী রানী, ইত্যাদি প্রেমকাহিনি ও লোকজ কাহিনির অভিনয়ও প্রচলিত ছিল।
অরিন্দম বলে, আমি পড়েছি বিংশ শতকের শেষে এবং বিশশতকের শুরুর দিকে যাত্রায় দেশপ্রেমমূলক কাহিনির অভিনয় শুরু হয়। এক্ষেত্রে সবচেয়ে প্রসিদ্ধ মুকুন্দ দাশ। তার প্রকৃত নাম ছিল যজ্ঞেশ্বর। তিনি বিক্রমপুর থেকে বরিশাল গিয়ে দেশপ্রেমিক বিপ্লবী অশ্বিনী কুমারের শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন। মুকুন্দ দাশ যাত্রার মাধ্যমে দেশপ্রেম ও ব্রিটিশবিরোধী বক্তব্য প্রচার করেন। তিনি সমাজ সংস্কার মূলক বক্তব্য, পণপ্রথা, জাতিভেদে ইত্যাদির বিপক্ষেও বক্তব্য প্রচার কররেন। তিনি ‘স্বদেশী যাত্রা’র সূচনা করেন। সে কারণে তাকে কারাবন্দিও থাকতে হয়। মুকুন্দ দাশের প্রেরণায় আরও অনেক স্বদেশী যাত্রার দল গড়ে ওঠে। তারা গ্রামে গ্রামে যাত্রার প্রদর্শন করে দেশপ্রেমমূলক কাহিনি প্রচার করতে থাকে। সে সময় ঈশা খাঁ, প্রতাপচন্দ্র, বারো ভুঁইয়া, সোনাভান, নবাব সিরাজউদ্দৌলা, ক্ষুদিরাম ও অন্যান্য বিপ্লবীর নামেও কাহিনি অভিনয় হতে থাকে। স্বদেশী যাত্রা একসময় ইংরেজ শাসকদের রোষানলে পড়ে।মুকুন্দ দাসের আগে ঢাকায় কৃষ্ণকমল গোস্বামী নামে একজন পালাকার ‘স্বপ্নবিলাস’, ‘দিব্যোন্মাদ’, ‘বিচিত্রবিলাস’ পালা লিখে আলোড়ন তুলেছিলেন। ১৮৬০-১৮৭৮ এর মধ্যে তার পালা গ্রন্থাকারে প্রকাশ পায় এবং ঢাকাতেই প্রথম মঞ্চায়ন হয়। মনোমহন বসু নামেও আরেকজন পালাকার বেশ বিখ্যাত ছিলেন। নওগাঁজেলার ধামুরহাট থানার শ্রামপুর গ্রামে নফরউদ্দিন নামে আরেকজন পালাকার প্রথমে রাজনীতিকেন্দ্রিক পালা লিখে বেশ খ্যাতি পান। পরে তিনি মধুমালা, সাগরভাসা, কাঞ্চনবতী, বিন্দুমতি, পুষ্পমালা ইত্যাদি রূপকাথাভিত্তিক পালা লেখেন। বিখ্যাত সাহিত্যিক মীরমোশাররফ হোসেনও পালা লিখেছেন। তিনি বেহুলা নিয়ে যাত্রাপালা লেখেন।গোপালবাবু বলেন, ঠিক সে সময় গ্রামে গঞ্জে বিষাদসিন্ধুর কাহিনি নিয়েও যাত্রা অভিনয় হতো। কারবালার কাহিনি নিয়ে যাত্রা পালা লেখা হতো।মানিকগঞ্জের ধানেশ্বরের আব্দুল করিম, নরসিংদির জালাল উদ্দিন, হিরেন্দ্র কৃষ্ণদাস, মুন্সিগঞ্জের আরশাদ আলী , ঢাকার কেরাণীগঞ্জের রফিকুল,পটুয়াখালির দুধল গ্রামের মাস্টার সেকেন্দার আলি, খুলনার ডুমুরিয়ার এম এ মজিদ (অগ্রদূত), ময়মনসিংহ জেলার নান্দাইলের কফিল উদ্দিন ও মানিকগঞ্জ সদরের ডা. আবেদ আলীসহ অনেকেই সেসময় যাত্রা পালা লিখতেন।বিশ শতকে রূপবান-রহিম বাদশাহ, মালকা বানু, সয়ফুল মুলুক বদিউজ্জামাল, গুনাইবিবি, দুর্গামনি, কমলা রানীর বনবাস, কাজল রেখা, মলুয়া, ভেলুয়া সুন্দরী, সোনাভান, বীরাঙ্গনা সখিনা, গাজী কালু চম্পাবতী, বনবিবি ইত্যাদি পালা বেশ জনপ্রিয়তা পায়।১৯৪৭ সালের দেশভাগের পর অনেক পালাকার ও যাত্রাদল পূর্ববঙ্গ ছেড়ে পশ্চিমবঙ্গে চলে যায়। পাকিস্তানি শাসকরা এদেশের লোকজ সংস্কৃতিকে কখনও সুনজরে দেখেনি।যাত্রাপালা ধর্মবিরোধী কাজ এমন ফতোয়াও জারি হয়েছে কখনও কখনও। অনেক গ্রামে ধর্মান্ধ গোষ্ঠি একত্রিত হয়ে অভিনয় বন্ধ করে দিয়েছে।১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের পর দেশ স্বাধীন হলে অনেক যাত্রাদল নতুনভাবে গড়ে ওঠে। মাইকেল মধুসূদন, দেবদাস, রক্তাক্ত বাংলা, স্বাধীন বাংলা, বিজয় এনেছি, মা মাটি মানুষ, সোনার বাংলা, সোজন বাদিয়ার ঘাট, লালন ফকির, ইত্যাদি পালা বেশ জনপ্রিয়তা পায়। অমলেন্দু বিশাস, জ্যোস্না বিশ্বাসসহ অনেক যাত্রাশিল্পী ছিলেন নামকরা। সত্তর দশকের শেষভাগ এবং বিশেষ করে আশির দশকে যাত্রাশিল্পে অবক্ষয় শুরু হয়। তখন যাত্রার নামে অশ্লীল নৃত্য পরিবেশিত হতে থাকে। আবহমান কাল ধরে চলে আসা এই শিল্প ধ্বংসের মুখোমুখি হয় যাত্রার আসরে জুয়া ও অশালীন নাচের কারণে। যাত্রার আসরে সখী নৃত্য একসময় প্রচলিত ছিল যা কিছুটা অসংস্কৃত হলেও তাকে ঠিক অশালীন বলা যেত না। কিন্তু পরবর্তীতে গ্রামগঞ্জে পর্নগ্রাফির প্রভাবে প্রিন্সেসের নাচের নামে যাত্রার আসরে অশালীনতা ছড়িয়ে পড়ে। পরে যাত্রার প্রিন্সেস, সখীনৃত্য ইত্যাদির নামে চলে অশালীন নৃত্য।অরিন্দম বলে, আমি আপনার লেখা” যাত্রা “বইয়ে পড়েছি যাত্রাকে অশালীনতা থেকে মুক্ত করতে এবং যাত্রা শিল্পকে বাঁচাতে নতুন শতকে তৈরি হয় যাত্রা নীতিমালা। ২০১২ সালে যাত্রা নীতিমালা গেজেটভুক্ত হয়। ২০১৩ সাল থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত ৮৮টি যাত্রাদলকে নিবন্ধন করেছে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি। এখনকার নামকরা যাত্রাদলগুলো হলো যশোরের আনন্দ অপেরা, চ্যালেঞ্জার অপেরা, অগ্রগামী নাট্টসংস্থা, মাগুরার চৈতালি অপেরা, নারায়ণগঞ্জের ভোলানাথ যাত্রা সম্প্রদায়, কোহিনূর অপেরা, গাজীপুরের দিশারী অপেরা, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার তিতাস যাত্রা ইউনিট, খুলনার স্বদেশ অপেরা, রাজমহল অপেরা, রঙমহল অপেরা, ফরিদপুরের মধুচ্ছন্দা যাত্রা ইউনিট, নাটোরের পদ্মযাত্রা ইউনিট, বাগেরহাটের সুন্দরবন অপেরা, লক্ষ্মীপুরের কেয়া যাত্রা ইউনিট ইত্যাদি।
গোপালবাবু বলেন, বাঙালির বিনোদনের একটি প্রধান অনুসঙ্গ ছির যাত্রা পালা। এর মধ্য দিয়ে শুধু বিনোদন নয় পুরাণ, ইতিহাস, লোকজ সাহিত্য সম্পর্কে শিক্ষাগ্রহণ চলতো।এখন সিনেমা, টেলিভিশনের কল্যাণে বিনোদনের রূপ পালটেছে। কিন্তু যাত্রার আবেদন গ্রামের মানুষের কাছে এখনও রয়েছে। রাতের পর রাত জেগে যাত্রার কাহিনি, অভিনয়, গানের মাধ্যমে লোকজ নীতিবোধ, শুভ-অশুভের দ্বন্দ্ব সম্পর্কে শিক্ষা নেয় দর্শকরা। যাত্রা আমাদের লোকজ সংস্কৃতির মূল্যবান সম্পদ। যাত্রা শিল্পকে বাঁচাতে প্রয়োজন সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ের অধিকতর পৃষ্ঠপোষকতা।ছায়া সুনিবিড় শান্তির নীড় একটি গ্রামের নাম রূপাডিহি। সবুজ সবুজ গাছের মন কেড়ে নেওয়া শীতলতা মনমাতানো বিশুদ্ধ বাতাস আর শীতল জলের সংস্পর্শে এই রূপাডিহিতে প্রত্যেক লােকই যেন প্রকৃতির রূপ সৌন্দর্য ভুলে থাকতে। এই গ্রামে ছোট্ট একটি পাড়ায় অরিন্দমের বাস। অরিন্দম, অরিন্দম রায়। মদনমােহন রায়ের মেজ পুত্র অরিন্দম। আর দুই ছেলে বড়টির নাম সােহন, ছােট পুত্রের নাম শোভন। দুই কন্যা অনীতা আর দেবিকা। মদনমােহনের স্ত্রী সবিতাদেবী। সাতপাক ঘােরার পর থেকে বিলাসিতার মধ্যে কাটাতে পারেন নি সত্য, কিন্তু স্বামী, পুত্র ও কন্যাদের নিয়ে তিনি শান্তিতেই থাকেন। মধ্যবিত্ত পরিবার বলা চলে। বড় পুত্র সােহন একটি বেসরকারী কারখানায় কর্মী আর মদনমােহন ছােট্ট একটি মুদির দোকানের মালিক। এই সামান্য আয়ের উপর নির্ভর করে সাত সদস্য বিশিষ্ট সংসারটি ‘সংসার সমুদ্রে কোনও রকমে হাল ঠিক রেখে চলছিল। আজ ২০ শে ফাল্গুন। মদনমোহনের বড় ছেলে সােহনের বিবাহ। রূপাডিহির পশ্চিমপাড়ার বাসিন্দা শুভঙ্কর গাঙ্গুলির বড় কন্যা মনীষার সঙ্গে ভালােবাসা ছিল সােহনের। তাছাড়া মদনমােহন ও শুভঙ্কর দুইজনে বরাবর একই সঙ্গে মেলামেশা করায় তাদের মধ্যে বন্ধুত্বটা প্রগাঢ় হয়ে ওঠে। তারই পরিণতি এই বিবাহে, এই বন্ধনে। কিন্তু আশ্চর্য যে এই গােপন পরামর্শ সােহন এবং মনীষা কিন্তু ঘুণাক্ষরে জানতাে না। যখন মনীষা এগারাে বৎসরের তখন শুভঙ্করবাবু একবার কন্যাকে নিয়ে সােহনদের বাড়িতে আসেন মদনমােহনের সঙ্গে দেখা করার জন্যে। ষােল বৎসরের সােহন তখন। পড়াশােনায় ব্যস্ত। হঠাৎ সুন্দরী কিশােরী মনীষার দিকে নজর যাওয়াতে সেই চোখ আর ফিরতে পারেনি। ক্রমে সেই ভালােলাগা ভালােবাসায় পরিণত হয়। তারপর কত রাগ অনুরাগ, কথার পথ পেরিয়ে আজ সেই শুভদিন। উলুধ্বনি, শঙ্খধ্বনির মাঝে সকল চিৎকার চেঁচামেচির মধ্যে থেকেও সােহনের মা, বাবা কিন্তু ঈশ্বরের প্রার্থনায় মগ্ন! তারা চিন্তা করছিলেন কি করে বাধা বিপত্তি অতিক্রম করে তারা আজ কিছুটা সুখের মুখ দেখতে পাচ্ছেন। চিন্তা করছেন এইবার বৌমার হাতে সংসারের ভার অর্পণ করে সুখী হবেন মদনমােহন বলছিলেন সবিতাদেবীকে মনে পড়ে তােমার, একবার সােহন পুকুরে ডুবে গিয়েও বেঁচে গিয়েছিল। সবিতা দেবী বাধা দিয়ে বলে ওঠেন, ওঃ তুমি সেই দুঃখের রাত্রির কথা আর বােলােনা, ওকথা শুনলে আমার কেমন ভয় করে। আজ শুভদিনে শুধু ঈশ্বরের কাছে সােহন আর বৌমার শুভ প্রার্থনা করি। ইত্যবসরে অরিন্দম। আজ কি আনন্দ আকাশে বাতাসে গানটি আবৃত্তি করতে করতে এসে বলল মা শুধু দাদা আর বৌমা ভালাে থাকবে আর আমরা -সবিতা দেবী। কথার মাঝেই বলে উঠলেন, ওরে গাছের গোড়ায় জল দিলে কি আর কেউ গাছের ডগায় জল দেয়। তারা তাে একই বৃক্ষের শাখা প্রশাখা। অরিন্দম মায়ের কথায় প্রীত হয়ে কাজের কথায় ফিরে এসে বাবাকে বললাে, বাবা আমাদের কাজ মােটামুটি শেষ। এখন তােমরা দুজনে কিছু খেয়ে নিলেই ব্যাস ফিনিস।রাত পোহালো। কেকিল ডাকলো। শােভন আজ সকালে রাস্তা দিয়ে যেতে যেতে কার কত বয়স হলাে তারই হিসাব করছিলাে। চিন্তা করে দেখল তার বাবা ষাটে পা দিয়েছেন। মা একান্ন। আর বড়দি অনীতা বত্রিশ, তার বিয়ে হয়েছে আজ বছর দশেক হলাে। বড়দা ত্রিশ, বৌদি বাইশ, অরিন্দমদা চব্বিশ আর ছােটবােন দেবীকা সতের। শােভনের নিজের বয়স কুড়ি বৎসর দুই মাস। ভাবছে বয়স তাে ভালােই হল।এবার সাবধানে চলতে হবে। ল্পী ছিলেন। গোপালবাবু অরিন্দমের গুরুদেব। সৈকত বলে অরিন্দমকে, এখন যাত্রাশিল্পের ভাল সময় নয়। তাই সময় থাকতে নিজে একটা চাকরি বা ব্যবসার ব্যবস্থা কর। অরিন্দম বলে, ঠিক বলেছিস। আজ সে সত্যিকার সংকটে দীর্ণ যাত্রা জগৎ-ব্যবসায়িক অসাফল্যে মুখ থুবড়ে পড়েছে, এটা একটা অচিকিৎসা ব্যাধির প্রকোপ, সে বিষয়ে সন্দেহ নেই। কিন্তু পরিত্রাণের উপায়ই বা কী হতে পারে, সে বিষয়ে কোনো দিশা দেখা গিয়েছে, এমন আশাও আমাদের সামনে নেই। তবু যাত্রাশিল্পের সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান যাত্রাশিল্পের বিকাশে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করবে বলে আশা করা যায়।
😍😍😍😍
সৈকত ঐতিহাসিক স্থান ঘোরার জন্য ঠিক করল। সৈকত ঘোরার কথা বাবাকে জানালো।সে বলল আমরা চারবন্ধু গরমের ছুটিতে ঘুরতে যাব ঠিক করলাম।আমি, রাজু, শ্যামলী আর সোমা। চারজনই আমরা ইতিহাসের ছাত্র। এক কলেজে পড়ি। সোমা বলল, সাঁচি স্তুপ দেখে আসি চল। সৈকতের বাবা মা বললেন, সাবধানে যেও।আজ সকলে সৈকতের বাড়িতে আলোচনা করছে ঘুরতে যাওয়ার আগে।
শ্যামলী বলল, মধ্যপ্রদেশের রাজধানী শহর ভূপাল থেকে ৪৬ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত সাঁচির বিদিশাগিরিতে অবস্থিত বৌদ্ধ স্তূপ। সম্রাট অশোক এই স্তূপ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।
রাজু বলল, হ্যাঁ ইতিহাসে পাওয়া যায় এইসব কাহিনী। অশোককের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলার পরও কলিঙ্গবাসী পরাজিত হয়। এই যুদ্ধে প্রায় এক লক্ষ নরনারী প্রাণ হারায় এবং প্রায় দেড়লক্ষ নরনারী বন্দী হয়। এই যুদ্ধের এই বীভৎসতা সম্রাট অশোক কে বিষাদগ্রস্ত করে তোলে। পরে তিনি যুদ্ধের পথত্যাগ অহিংসার পথে সাম্রাজ্য পরিচালনার নীতি গ্রহণ করেন। এরপর তিনি ক্রমে ক্রমে বৌদ্ধ ধর্মের প্রতি বিশেষভাবে আসক্ত হয়ে পড়েন এবং উপগুপ্ত নামক এক বৌদ্ধ সন্ন্যাসীর কাছে দীক্ষা নিয়ে বৌদ্ধধর্ম গ্রহণ করেন। তিনি তাঁর গুরু উপগুপ্তকে সাথে নিয়ে কপিলাবস্তু, লুম্বিনী, কুশীনগর, বুদ্ধগয়া-সহ নানা স্থানে ভ্রমণ করেন এবং বৌদ্ধ ধর্মের প্রচার করেন। এই সময় তিনি নানা স্থানে স্তূপ, স্তম্ভ এবং পাহাড়ের গায়ে বুদ্ধের বাণী লিপিবদ্ধ করে রাখার ব্যবস্থা করেন। এই সূত্রে তিনি বর্তমান সাঁচি থেকে দশ কি.মি দুরে বিদিশাগিরি নামক পাহাড়ে একটি বৌদ্ধ স্তূপ তৈরি করেছিলেন।আমি জানি, সম্রাট অশোকের তৈরি মূল স্তূপটির ব্যাস প্রায় ৩৬.৬ মিটার ও উচ্চতা প্রায় ১৬.৫ মিটার। কথিত আছে অশোকের কন্যা সঙ্ঘমিত্রা ও পুত্র মহেন্দ্র শ্রীলঙ্কায় বৌদ্ধধর্ম প্রচারে যাওয়ার আগে, সাঁচিতে এই স্তূপ পরিদর্শন করেছিলেন। বিদিশাগিরির শীর্ষে রয়েছে সম্রাট অশোকের তৈরি মহাস্তূপ। একে এক নম্বর স্তূপ বলা হয়। মনে করা হয় এই এক নম্বর স্তূপের মধ্যে বুদ্ধদেবের ভস্ম আছে। উল্লেখ্য সম্রাট অশোক যে স্তূপ গড়েছিলেন তা এখনকার স্তূপের নিচে চাপা পড়ে গেছে। একশ বছর পরে সেই স্তূপের উপর আরো বড় স্তূপ তৈরি হয়। তা ঘিরে তৈরি হয়েছিল পাথরের অলিন্দ। কালক্রমে সে অলিন্দের পাথর অনেকটা ক্ষয়ে গিয়েছিল। এই কারণে পরে স্তূপের পাশে গোল বারান্দার মতন প্রদক্ষিণ পথ তৈরি হয়। এরও প্রায় একশ বছর পর স্তূপের চারদিকে চারটি তোরণ নির্মাণ হয়। এক নম্বর স্তূপের উত্তরমুখী তোরণ এখনও অক্ষত। এতে আছে কাঠ বা হাতির দাঁতের সূক্ষ্ম কারু কাজ। তোরণের স্তম্ভ ও ফলকে বৌদ্ধ জাতকের গল্প খোদাই করা আছে। বুদ্ধের জীবনের গুরুত্বপূর্ণ বেশ কিছু দৃশ্য এখানে দেখা যায়। তবে তোরণ বা স্তম্ভে বুদ্ধের কোন মূর্তি নেই। কখনও গাছ, কখনও ধর্মচক্র, কখনও পদচিহ্ন-এসব প্রতীক দিয়ে বুদ্ধের উপস্থিতি বোঝান হয়েছে। এর কারণ সম্ভবত এই যে সে সময় বৌদ্ধধর্মাবলম্বীদের ভিতর বুদ্ধমূর্তি পূজোর নিয়ম ছিল না।সৈকত ফিরে অন্যান্য বন্ধুদের ঘোরার গল্প বলল।সে বলল, আমরা হাওড়া এসে ট্রেনে চাপলাম। তারপর যখন ভূপাল এলাম তখন রাত্রি। আগে থেকে হলিডে হোম বুক করা ছিল। এখান থেকেই আমরা সাইড সিন ঘুরে কভার করব। প্রয়োজনে ফিরে আসব এখানেই। রাজু বলল, এখান থেকে মাত্র ছেচল্লিশ কিলোমিটার দূরে বিদিশাগিরি। সেখানে ভগবান বুদ্ধের স্মৃতি বিজড়িত বৌদ্ধ স্তূপ সাঁচিতে অবস্থিত। মালপত্তর রেখে রেডিমেড খাবার খেয়ে আমরা বিশ্রাম নিলাম। আমি আসলে সোমার প্রেমে আবদ্ধ আর রাজু, শ্যামলীর প্রেমে হাবুডুবু খায়। পড়াশুনা শেষ হলে চাকরি পেয়ে বা ব্যবসা করে আমরা বিবাহসূত্রে আবদ্ধ হব একথা আমাদের দুই পরিবারই জানে। আমরা শুয়ে পড়লাম রাত একটার সময়।তারপর সকালে উঠে বাস আসার অপেক্ষা। বাস আমাদের নিয়ে গেল আজ সাঁচী।
আমাদের গাইড বলছেন, বাবু ইতিহাসের কথা একটু মন দিয়ে শুনে লিবেন। তাহলে মজা পাবেন। সোমা বলল, লোকটা তো ভালো বাংলা বলে। আমি বললাম, হ্যাঁ।গাইড বলতে শুরু করলেন, মৌর্য বংশের অবসানের পর, ব্রাহ্মণরা বেশ কয়েকবার সাঁচির স্তূপ আক্রমণ করে ব্যাপক ধ্বংসাত্মক কার্যক্রম চালায়। এই সময় অশোকের স্তূপ ছাড়াও সাঁচির সমস্ত সৌধ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। পরে বৌদ্ধ ভিক্ষু ও স্থানীয় গৃহী বৌদ্ধরা নতুন উদ্যমে কিছুটা মেরামত শুরু করেন। কিন্তু তৎকালীন রাজনৈতিক এবং সাম্প্রদায়িক ধাক্কা সাঁচির উপরেও পরে। ফলে নতুন উদ্যমে মঠ স্তম্ভ নির্মাণের কাজেও ভাঁটা পড়ে। এবং শেষে একেবারে থেমে যায়। গুপ্তযুগে দেশে কিছু শান্তি ও সমৃদ্ধি এলে সাঁচিতে কারুশিল্প ও স্থাপত্যের কাজ নতুন ভাবে শুরু হয়। এ সময়ই মূর্তির দেখা মেলে। এসময়ে সতেরো নম্বর মন্দিরটি নির্মিত হয়। এভাবে দুশো বছর কাজ চলতে থাকে। তারপর হুনেরা ভারত আক্রমণ করে। গুপ্ত সাম্রাজ্যের পতন ঘটে। ফলে এই স্তূপের নিয়মিত সংস্কার বন্ধ হয়ে যায়।৬০৬ খ্রিষ্টাব্দে রাজা হর্ষবর্ধনের শাসনকালে বৌদ্ধধর্ম বিস্তার লাভ করে। এই সময় সাঁচিতে বেশ কিছু মঠ ও মন্দির বানানো হয়। এই ধারা প্রায় ১২০০ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত অব্যাহত ছিল। এরপর হিন্দু আধিপত্যের কারণে সাঁচিতে বৌদ্ধ-ধর্মাবলম্বীরা কোণঠাসা হয়ে পড়ে। ক্রমে স্তূপে হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের ফলক স্থাপিত হতে থাকে। একসময় সাঁচি বৌদ্ধশূন্য এলাকায় পরিণত হয়। উনবিংশ শতাব্দীর দিকে সাঁচির বৌদ্ধ অধ্যুষিত এলাকা একটি পরিত্যাক্ত এলাকায় পরিণত হয়। কালক্রমে স্তূপটি লোকচক্ষুর অন্তরালে চলে যায়।১৮১৮ খ্রিষ্টাব্দে ব্রিটিশ জেনারেল টেলার সাঁচির ধ্বংসস্তূপ আবিষ্কার করেন। এই সময় গুপ্তধনের আশায় লোকজন শেষবারের মতো স্তূপটির ক্ষতি করে। ১৮২২ খ্রিষ্টাব্দে ক্যাপটেন জনসন এক নম্বর স্তূপটি উপর থেকে নিচ পর্যন্ত কেটে ফেলে। ফলে স্তূপের গায়ে প্রকাণ্ড ফাটলের সৃষ্টি হয় এবং পশ্চিমের তোরণ ভেঙ্গে পড়ে। একইভাবে দু নম্বর স্তূপও ধ্বংস হয়। ১৮৫১ খ্রিষ্টাব্দে আবার দুই ও তিন নম্বর স্তূপ খোঁড়া হয়। এক নম্বর স্তূপের মধ্যে রত্নরাজির সন্ধানে লোহার রড ঢুকিয়ে পরীক্ষা করা হয়। এই সময় স্থানীয় এক হিন্দু জমিদার অশোক স্তম্ভটি তিন টুকরো করে বাড়ি নিয়ে যান।১৮৮১ খ্রিষ্টাব্দের পরে স্তূপটি সংরক্ষণের চেষ্টা করেন মেজর কোল। পরের তিন বছর তিনি এই উদ্যম সচল রাখেন। এর বেশ পরে পরে ভারতের আর্কিওলজিকাল সার্ভের ডিরেক্টর এ কাজে এগিয়ে আসেন। মেজর কোল বিদিশাগিরির জঙ্গল কেটে গোটা পাহাড় পরিষ্কার করান। এক নম্বর স্তূপের ফাটল মেরামত করেন। পশ্চিম ও দক্ষিণদিকের তোরণগুলি তুলে যথাস্থানে স্থাপন করেন। এরপর বাকি কাজ করেন স্যার জন মার্শাল। ১৯১২ খ্রিষ্টাব্দ থেকে ১৯১৯ খ্রিষ্টাব্দের ভিতরে এই স্তূপের যে সংস্কার করা হয়, বর্তমানে তাই পুরাকীর্তি হিসেবে গণ্য করা হয়। আমরা বাসের সকলে হোটেলে খাওয়াদাওয়া সেরে নিলাম। এখানে দেওয়ালের কারুকাজ দেখলেই সমগ্র ইতিহাস দেখা যায় চোখে। সোমা বলল মহামতি জীবকের কথা দেওয়ালে খচিত আছে।আমরা পড়েছি, জীবক অত্যন্ত মেধাবী ছিলেন তক্ষশীলা বিশ্ববিদ্যালয় চিকিৎসা শাস্ত্র এবং ভেষজ বিজ্ঞান অধ্যায় পর চিকিৎসক হিসেবে বিম্বিসারের সভায় যোগদান করেন এবং ভগবান বুদ্ধের শিষ্য গ্রহণ করেন। কিন্তু অজাতশত্রু রাজা হওয়ার পরে বৌদ্ধবিদ্বেষী হয়ে ওঠেন। রাজু পুরোনো অট্টালিকায় দাঁড়িয়ে বলল, আমি অজাতশত্রুর অভিনয় করছি আর তুই হয়ে যা মহামতি জীবক। আমি বললাম, তাই হোক। তারপর আমি বললাম, আজ রাজসভায় অজাতশত্রু কথা বলছেন, রাজু শুরু করল অভিনয়। সেনাপতি সোমা আর রাজপুরোহিত শ্যামলী। সবাই এক্সপার্ট। কলেজের সোশালে ওরা নাটকে অভিনয় করে।
– শোন হে পারিষদ বর্গ। আমার রাজ্যে বৌদ্ধগান বন্ধ করতে হবে। সেনাপতি কোথায়?
– আজ্ঞে আমি, হাজির। আদেশ করুন।
– আমার রাজ্যে আমিই এক এবং একক। আর কেউ ধর্ম প্রচার করে বড় হবে এ আমি কিছুতেই সহ্য করব না।
– তাই হবে রাজন। আজ থেকে আমি দেখব। আপনার আদেশ শিরোধার্য।
– না খুব কড়াকড়ি করার প্রয়োজন নেই। রাজার আদেশ তারা যেন পালন করেন এবং কর ঠিকমত দেয় তার ব্যবস্থা করুন। শুধু ধর্ম নিয়ে পেট ভরে না।
রাজা অজাতশত্রু আদেশ দিলেন। তারপরও তিনি ভাবছেন বুদ্ধদেবকে সকলে ভগবান বলে মানে। কেন? তার মধ্যে কি এমন আছে যে রাজার থেকেও সাধু বড় হয়ে যায়।তিনি রাজপুরোহিতের কাছে যান। রাজপুরোহিত বলেন, বুদ্ধদেব বাল্যকালে রাজপাট ছেড়ে কঠোর সাধনায় ব্রতী হয়েছেন। দীর্ঘ সময় সাধনা করে তিনি সিদ্ধিলাভ করেছেন। তিনি সাধারণ মানুষ নন। তিনি তাঁর ভক্তদের কাছে ভগবানস্বরূপ।রাজা বলেন, হ্যাঁ শুনেছি। রাজপুত্র বাইরে বেরিয়েছিলেন চারদিন। চারদিন তিনি মানুষের যৌবন, জ্বরা, ব্যাধি ও মৃত্যু দেখে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন যে মানুষের যদি শেষ পরিণতি মৃত্যু হয়, তাহলে এই যে সংসার জীবন,এর কোন অর্থ হয় না ।রাজপুরোহিত বললেন, হ্যাঁ ঠিক বলেছেন তারপর তিনি এক গভীর রাতে রাজ্যপাট ছেড়ে মাকে ছেড়ে, বাবাকে ছেড়ে, রাজ্যের লোভ ছেড়ে তিনি বাইরে ফিরছিলেন সন্ন্যাসী হবেন বলে। তারপর বটবৃক্ষের তলায় কঠিন সাধনা শুরু করেছিলেন। সেই সাধনায় তিনি সিদ্ধিলাভ করেছিলেন। তারপর সুজাতা নামে এক মহিলার পায়েস খেয়ে তিনি সেই সাধনা ভঙ্গ করেন। তিনি বুঝেছিলেন শরীরকে কষ্ট দিয়ে সাধনা করা যায়না। সাধনা করতে গেলে শরীরকে কষ্ট দিতে নেই।নাটকশেষে, গাইড আবার বললেন, ইতিহাসের কথা, এখন তিনি ভগবান বুদ্ধ নামে পরিচিত। তার কাছে অনেক মানুষ মনের অশান্তি, যন্ত্রণা নিয়ে আসেন এবং মনে সুন্দর এক ভাবনা নিয়ে ফিরে যান। একজন এসে তাকে প্রশ্ন করেছিলেন, কেন আমার ঘরে মৃত্যু বারবার প্রবেশ করছে? আমি মরতে চাই না।
তিনি বলেছিলেন, ঠিক আছে তুমি এমন কোন বাড়ি থেকে আমাকে একমুঠো সরিষা এনে দাও যার ঘরে মৃত্যু প্রবেশ করেনি। সেই সরিষা খেলে তুমি অমর হয়ে যাবে।
সেই ব্যক্তি বক্তব্যের সারাংশ বুঝে চলে গিয়েছিলেন খুশিমনে।
রাজপুরোহিত বলেছিলেন, কিন্তু বুদ্ধদেবের চিকিৎসা করেন এক চিকিৎসাবিজ্ঞানী, সে মস্ত বড় চিকিৎসক তার নাম জীবক।আমাদের রাজপরিবারের চিকিৎসক তিনি রাজা বিম্বিসারের আমল থেকে। তুমি এই জীবককে প্রাসাদে এনে রাখতে পারো। সে তোমার চিকিৎসা করবে। রাজপরিবারের চিকিৎসা করবে।অজাতশত্রুর আগে মহারাজ বিম্বিসার সবরকম খোঁজখবর নিয়ে জীবককে ডেকে পাঠিয়েছিলেন তার রাজসভায় জীবক এসেছিলেন। জীবক রাজি হয়েছিলেন রাজসভায় যোগদান করার জন্য। আবার বুদ্ধদেবের প্রধান শিষ্যদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন জীবক। অজাতশত্রু বৌদ্ধ বিদ্বেষী হয়েও জীবককে মর্যাদার আসনে রেখেছিলেন। মহামতি জীবক রাজপরিবারের চিকিৎসা করতেন। আর যেখানে খবর পেতেন সেখানেই চিকিৎসা করতে চলে যেতেন পায়ে হেঁটে।একবার এক গরীব মানুষ সপ্তপর্ণী গুহাপ্রদেশের এক প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে রাজসভায় মহামতি জীবকের সন্ধান করেছিলেন।
সেই দরিদ্র রাজপ্রাসাদের গেটের বাইরে অধীর আগ্রহে আশাবাদী হয়ে উঠলেন মহামতির দর্শন পাওয়ার জন্য।
তিনি প্রহরীকে বললেন, একবার মহামতি জীবকের কাছে যেতে চাই।
প্রহরী বলল,তোর সাহস দেখে আমি অবাক হচ্ছি। তুই সামন্য এক কৃষক হয়ে রাজার চিকিৎসকের সাহায্য চাইছিস? যা পালা। তার সঙ্গে দেখা হবে না। তিনিমএখন চিকিৎসাশাস্ত্র অধ্যয়ন করছেন।
লোকটি বলল, আমাকে বাঁচান। আমার স্ত্রী মরে যাবে।
প্রহরী বলল, তোর মরে যাওয়াই ভালো।
গরীব কৃষক কান্নাকাটি শুরু করলেন।
গোলমাল শুনে মহামতি জীবক জানালা থেকে গোলমালের কারণ অনুধাবন করলেন। তারপর তার চিকিৎসার থলে নিয়ে হাজির হলেন গেটের সামনে।
মহামতি প্রহরীকে বললেন, দরজা খোলো। আর কোনো লোকের সঙ্গে খারাপ আচরণ করবে না। জীবনে কষ্ট পাবে খারাপ আচরণের ফলে।
প্রহরী লজ্জিত হয়ে গেট খুলে দিল।
জীবক গরীব কৃষকের হাত ধরে চলে গেলেন পায়ে হেঁটে দশ মাইল পথ।
তার চিকিৎসায় সেরে উঠেছিল কৃষকের স্ত্রী।
কোনদিন কোন গরিব মানুষ তার কাছ থেকে মুখ ফিরিয়ে চলে যায়নি। তিনি অর্থের বিনিময় চিকিৎসা করতেন না। তিনি চিকিৎসা করতেন মানুষকে ভালোবেসে। ভগবান বুদ্ধের বাণী তার জীবনকে প্রভাবিত করেছিল অনেকখানি।রাজা অজাতশত্রু জীবকের কাছে ভগবান বুদ্ধের বাণী সম্পর্কে অনেককথা শুনেছিলেন। ধীরে ধীরে তিনি তাঁর প্রতি আগ্রহী হয়ে উঠেছিলেন এবং জীবককে অবসর সময়ে রাজা নিভৃতকক্ষে ডেকে পাঠাতেন। তন্ময় হয়ে শুনতেন জীবকের কথা। জীবক বলতেন, জীবে দয়া, ভালোবাসা আর শান্তি তাঁর জীবনের মূলমন্ত্র। জীবক সময়
কাটাচ্ছেন রাজার কক্ষে এবং বুদ্ধের বাণী শোনাতেন রাজাকে।
জীবন শান্তি ধর্ম আর ভালোবাসার জন্য। বৌদ্ধ ধর্মের মূলকথা, যুদ্ধ নয়, শান্তি চাই।
শান্তিই একমাত্র সমস্ত কিছুর সমাধান করতে পারে। ভালোবাসা আর শান্তি, এই হল বুদ্ধদেবের বাণীর মূলকথা।অজাতশত্রু তার বাবার কাছেও শুনেছিলেন জীবকের কথা। বিম্বিসার জানতেন বৌদ্ধ যুগের ভারতবর্ষে বিজ্ঞানে, চিত্রকলায়, দর্শনে সর্বত্র নিয়োজিত হয়েছিল এক প্রতিবাদ এবং সেগুলি জগতের কাছে একটি বিস্ময়।
মহারাজ বিম্বিসার বলতেন, মহামতি জীবককে পৃথিবীর সর্বকালের অন্যতম সেরা চিকিৎসক ও চিকিৎসাবিজ্ঞানী বলা যেতে পারে কথিত আছে ইনি বারবনিতার সন্তানরূপে জন্ম নিয়েছিলেন আবর্জনার স্তুপে। পরিণত করেছিলেন তক্ষশীলা বিশ্ববিদ্যালয়। চিকিৎসা শাস্ত্র এবং বিজ্ঞান চিকিৎসক মন্ত্রিসভায় যোগদান করেন এবং ভগবান বুদ্ধের শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন।অজাতশত্রু প্রচন্ড বুদ্ধবিরোধী হলেও এবং পিতাকে বন্দি করলেও জীবকেকে চিকিৎসক পদে বহাল রেখেছিলেন। জীবকের অসাধারণ চিকিৎসা নৈপূণ্যের জন্য। সাধারণ জীবন যাপন করছেন জীবক। ধর্মপ্রচারের পরিবর্তে তাদের সেবায় নিজেকে নিয়োজিত করেছিলেন শেষে তার আচরণ অজাতশত্রু কে এতটাই মুগ্ধ করেছিল যে শত্রুতা করেও তিনি বৌদ্ধধর্ম গ্রহন করেছিলেন এবং তাদের পরামর্শে অজাতশত্রু প্রথম বৌদ্ধ সম্মেলন আহ্বান জানিয়েছিলেন। পর্বতের গুহায় সম্মেলন হয়েছিল এবং ভগবান বুদ্ধের বাণী গুলিকে একত্রিত করা হয়েছিল।অজাতশত্রু একদিন জীবককে বললেন, আমি ভগবান বুদ্ধের শরণাপন্ন হতে চাই।
জীবক বললেন, চলুন আমি আপনাকে ভগবানের কাছে নিয়ে যাই।
ভগবান বুদ্ধের কথা শুনে অজাতশত্রুর জীবনে বিরাট এক পরিবর্তন আসে। তিনি বৌদ্ধ মহাসম্মেলনের ব্যবস্থা করেন। তিনি বলেন, ভগবান বুদ্ধের বাণীগুলি সংরক্ষণ করে রাখা হবে ভবিষ্যৎ পৃথিবীর জন্য। বৌদ্ধ গ্রন্থগুলি যুবকের প্রশংসায় পঞ্চমুখ। গ্রন্থগুলি থেকে জানা গেছে তিনি দু-দুবার বুদ্ধকে কঠিন রোগ থেকে মুক্ত করেছিলেন। সংসার থেকে বৌদ্ধভিক্ষু 100 বছর বয়সে পদব্রজে বৌদ্ধবিহার গুলিতে যাওয়া আসা করতেন কেবলমাত্র চিকিৎসার কারণে। বহুদূর থেকে প্রতিদিন শত শত মানুষ ছুটে আসতেন চিকিৎসার জন্য। কাউকে বিমুখ করতেন না। জীবককে বলা হয় বেদোক্ত যুগের ধন্বন্তরি। রোগীকে না দেখেও কিরকম চিকিৎসা করতেন তা শুনলে চমকিত হতে হয়। কথিত আছে ভগবান বুদ্ধ একবার কঠিন রোগে আক্রান্ত হয়েছিলেন। ওষুধগুলো পদ্মফুলে মিশিয়ে রেখেছিলেন। বুদ্ধদেব গ্রহণ না করায় যুবকদের কাছে প্রেরণ করেছিলেন। ঘ্রাণ গ্রহণ করেই তাঁর রোগ ভালো হয়েছিল।
সেবার কাজে নিজেকে শতত নিয়োজিত রাখলেও বিজ্ঞানকে বঞ্চিত করেননি জীবক চিকিৎসা সংক্রান্ত বেশ কয়েকটি মূল্যবান গ্রন্থ রচনা করেছিলেন। সেগুলো পরের দিকে হারিয়ে গেলেও পরবর্তীকালে ভারতীয় চিকিৎসা বিজ্ঞানীদের যথেষ্ট সাহায্য করেছিল তার শেষ বয়সে শ্রেষ্ঠ রচনা শিশু রোগ চিকিৎসা গ্রন্থ পৃথিবীর প্রথম শিশু চিকিৎসা সংক্রান্ত বই অতি মূল্যবান গ্রন্থ যা পরবর্তীকালে ভারতীয় চিকিৎসকদের শিশুরোগ সংক্রান্ত গবেষণায় উদ্বুদ্ধ করেছিল।জীবক বলতেন শুধু ধর্মপ্রচার নয় গরীব রোগীদের সেবা করতে হবে তাদের সেবায় নিয়োজিত হতে চাই।
ধর্ম প্রচার এর পরিবর্তে দীনদরিদ্র, রোগগ্রস্তদের সেবায় তিনি নিজেকে নিয়োজিত করেছিলেন। শেষে তার আচরণ অজাত শত্রুকে এতটাই মুগ্ধ করেছিল যে শত্রুতা ত্যাগ করে বৌদ্ধ ধর্ম গ্রহণ করেও অজাতশত্রু প্রথম বৌদ্ধ সম্মেলন আহ্বান জানিয়েছিলেন।
অজাত শত্রু বললেন আমি এক বড় বৌদ্ধ মহাসম্মেলন করতে চাই।
জীবক বললেন কিন্তু এত বড় মহাসম্মেলন আপনি করবেন কোথায়? ভারতবর্ষের প্রত্যেক প্রদেশ থেকে বহু লোকের সমাগম হবে। অজাতশত্রু বললেন আমি স্থান নির্বাচন করেই রেখেছি গৃধ্রকুট পর্বতে সপ্তপর্ণী গুহায় সম্মেলন করা হবে।রাজপুরোহিত বললেন তার সমস্ত বাণী সংরক্ষণ করতে হবে। তারপর সমস্ত সেনাপতিদের সাহায্যে, সমস্ত নাগরিকদের সাহায্য নিয়ে সেই গৃধ্রকুট পর্বতে বিরাট বড় মহাসম্মেলন অনুষ্ঠিত হলো। সপ্ততপর্ণী পর্বতের গুহায় সম্মেলন হয়েছিল এবং ভগবান বুদ্ধের বাণী গুলো কে একত্রিত করা হয়েছিল রাজার কথামত।একবার ভগবান বুদ্ধের শরীর অসুস্থ হয়ে উঠল চরম।
জীবক বললেন, আপনি ঔষধ সেবন করুন। তাহলেই সুস্থ হয়ে উঠবেন।
ভগবান বললেন, আমি ঔষধ সেবন করব না। এবার তো বয়স হয়েছে। তোমরা বেশি চিন্তা কোরো না।
তাঁকে কেউ রাজী করাতে পারল না।শেষে জীবক এক ফন্দি আঁটলেন। তিনি তার এক বন্ধুকে বললেন তুমি আমার বাড়ি যাবে গোপনে কেউ যেন জানতে না পারে ওখানে আমি ভগবানের ওষুধ দিয়ে দেবো এবং ভগবান সেই ওষুধ ওষুধ ঠিক হয়ে যাবে।যুবকের বন্ধু জীবনের বাড়ি এলেন এবং বললেন আমি এসে গেছি তুমি কি দেবে বলেছিলে দাও। তারপর জীবক করলেন কি ভগবান বুদ্ধের প্রিয় শ্বেত পদ্ম ফুলের ভিতর ওষুধ দিলেন এবং তার মধ্যেই ওষুধের বিভিন্ন রকম পদ্ধতিতে ঔষধ মিশ্রিত করলেন এবং বন্ধুর হাতে তুলে দিলেন।তারপর মহামতি যুবকের বন্ধু ভগবান বুদ্ধের কাছে গেলেন।
তিনি ভগবান বুদ্ধকে বললেন আপনার প্রিয় শ্বেতপদ্ম এনেছি।
ভগবান বুদ্ধ প্রসন্ন চিত্তে তারপর শ্বেতপদ্ম গ্রহণ করলেন । তারপর নাকের কাছে নিয়ে সুগন্ধি পুষ্পের ঘ্রাণ গ্রহণ করলেন।
কিছুদিন পরে ভগবান বুদ্ধ সুস্থ হয়ে উঠলেন।সাধারণে এক ভিক্ষুক মত জীবন যাপন করতেন মহামতি জীবক ধর্মপ্রচারে পরিবর্তে দুঃখিত রোগগ্রস্ত সেবায় নিজেকে নিয়োজিত করেছিলেন শেষে তার আচরন অজাতশত্রু কে খুব মুগ্ধ করেছিল এবং তিনি বৌদ্ধধর্ম গ্রহন করেছিলেন।তুই মহামতি যুবক 100 বছর বয়সেও পায়ে হেঁটে চিকিৎসা করে বেড়াতেন গ্রামে গ্রামে। এবার অজাতশত্রু তাঁকে ডেকে বললেন, আপনি চিকিৎসা শাস্ত্র রচনা করুন ভবিষ্যৎ দুনিয়ার জন্য। জীবনটা শেষ বয়সে শ্রেষ্ঠ রচনা শিশু রোগ চিকিৎসা গ্রন্থ রচনা করেন। পৃথিবীর প্রথম শিশু চিকিৎসা সংক্রান্ত বই, অতি মূল্যবান গ্রন্থ, বৃদ্ধ জীবক তন্ত্র। যা পরবর্তীকালে ভারতীয় চিকিৎসকদের শিশু রোগ সংক্রান্ত গবেষণা যুদ্ধে সাহায্য করেছিল।
রাজা বিম্বিসার বুদ্ধকে ধর্মগুরু হিসেবে মান্য করে প্রাসাদে নিয়ে যান। বুদ্ধ তাঁকে চতুরার্য সত্য সম্বন্ধে উপদেশ প্রদান করেন। এরপর বৌদ্ধ সংঘের সহস্রাধিক ভিক্ষুদের বসবাসের জন্য বেণুবন নামক তার প্রমোদ উদ্যানটি গৌতম বুদ্ধকে প্রদান করেন। পরে রাজা সেখানে একটি বিহার নির্মাণ করেন। এই বিহারটি ‘বেণুবন বিহার’ নামে পরিচিতি পেয়েছিল। বিম্বিসারের অনুরোধে বুদ্ধ অমাবস্যা ও পূর্ণিমা তিথিতে উপোবাস ব্রত পালনের বিধি প্রচলন করেন। কথিত আছে, বিম্বিসারের অনুরোধেই বুদ্ধ বর্ষাকালে পরিব্রাজন না করে একটি নির্দিষ্ট স্থানে অবস্থান করে সাধনার ‘বর্ষাবাস’ নামক রীতি প্রচলন করেন। ভিক্ষুদের বর্ষাবাসের সুবিধার জন্য কুটীর নির্মাণ এবং বুদ্ধ ও ভিক্ষুদের চিকিৎসার জন্য রাজবৈদ্য জীবককে নিযুক্ত করেন। রাজার পত্নী পরবর্তীকালে ভিক্ষুণী সংঘে যোগদান করে অর্হত্ত্ব লাভ করেন।এরপর তিনি তাঁর পিতার অনুরোধে কপিলাবাস্তুতে আসেন। এখানে এসে তিনি তাঁর পিতার শত অনুরোধেও প্রথমে গৃহে প্রবেশ করতে রাজী হলেন না। রাজবাড়ির সামনে দিয়ে হেঁটে যাওয়ার সময় তাঁর স্ত্রী গোপা পুত্র রাহুলকে ডেকে বললেন -ওই তোমার পিতা মতাকে ডেকে আন। রাহুল নিজের পরিচয় দিয়ে ঘরে যেতে বললেন। গৌতম সে আহ্বান অগ্রাহ্য করলেন। এরপর সকলের কাতর অনুরোধে ইনি বাড়িতে প্রবেশ করলেন কিন্তু কোথাও দাঁড়ালেন না। রাজবাড়ি থেকে শেষবারের মতো বের হওয়ার সময় তাঁর স্ত্রী বুদ্ধের সামনে তাঁর দীর্ঘ চুল বিছিয়ে অপেক্ষা করলেন। গৌতম বিন্দু মাত্র বিচলিত না হয়ে সে চুল মাড়িয়ে রাজবাড়ী থেকে বেরিয়ে এলেন। এই সময় ইনি তাঁর বৈমাত্রেয় ভাই নন্দ এবং সাত বৎসরের পুত্র রাহুলকে দীক্ষিত করে রাজধানী ত্যাগ করলেন। এরপর ইনি ১৩ বৎসর ধরে ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে তাঁর ধর্মমত প্রচার করে বেড়ালেন। পিতার অসুস্থাতার কথা শুনে ইনি কপিলাবস্তুতে আসেন এবং পিতার মৃত্যুকালে উপস্থিত হলেন। পিতার মৃত্যুর পর ইনি পুরনারীদের ভিক্ষু বানালেন। এই ভিক্ষুদলের নেত্রী বানালেন তাঁর স্ত্রী গোপাকে। এরপর ইনি তাঁর ধর্মমত প্রচারের জন্য আবার পথে বেড়িয়ে পড়েন। ৮০ বছর বয়সে নেপালের কুশী নগরে ইনি দেহত্যাগ করেন। কথিত আছে তাঁর জন্ম বোধিত্ব লাভ ও মৃত্যু- একই তারিখ ও সময়ে হয়েছিল।বুদ্ধ বেণুবনে দ্বিতীয় ও তৃতীয় বর্ষ উদ্যাপন করেন।শেষ বছরে সারিপুত্র ও মৌদ্গল্যায়ন বুদ্ধের শিষ্য হন।
গাইড আবার বলতে লাগলেন ইতিহাসের কথা, এই সময় রাজবৈদ্য জীবক তাঁর আম্রকাননে বুদ্ধ সংঘের জন্য একটি বিহার নির্মাণ করে দেন। বর্তমানে এই বিহারটি ‘জীবকাম্রবন’ বামে পরিচিত।কাছে হিন্দু দর্শনে সম্যক জ্ঞান লাভ করেন। কিন্তু এই জ্ঞানে পরিতৃপ্ত হতে পারেন নি। তাই এখান থেকে তিনি উদ্দক রামপুত্তের কাছে শিক্ষাগ্রহণের জন্য আসেন। এই গুরুর কাছে তিনি সাংখ্য এবং যোগবিদ্যা শেখেন। এই নতুন জ্ঞানও তাঁকে শান্ত করতে পারলো না। এরপর তিনি মগধের রাজধানী রাজগিরীতে আসেন। লোকমুখে নতুন সন্ন্যাসীর প্রশংসা শুনে বিম্বিসার তাঁর সাথে দেখা করেন এবং রাজপ্রাসাদে আমন্ত্রণ জানান। কিন্তু বুদ্ধ এই আমন্ত্রণ প্রত্যাখ্যান করে জানান যে, যদি কখনও সত্যের সন্ধান পান, তাহলে তিনি রাজার আমন্ত্রণ রক্ষা করবেন। এর কিছুদিন পর, রাজা এক যজ্ঞানুষ্ঠানের জন্য ১০০০ মেষ বলির উদ্যোগ নেন। এই কথা জানতে পেরে বুদ্ধ রাজার সাথে দেখা করেন এবং মেষ বলি থেকে বিরত থাকার জন্য অনুরোধ করেন। রাজা এই অনুরোধে বলি বন্ধ করে দেন। এরপর বুদ্ধ উরুবিল্ব গ্রামের নিকটবর্তী এক উপবনে এসে তপস্যা শুরু করেন। এখানে তিনি কঠোর তপস্যা শুরু করেন। সে সময় পাঁচজন সন্ন্যাসীও তাঁর সাথে ধ্যান শুরু করেন। বুদ্ধের কঠোর তপস্যা দেখে এই পাঁচ সন্ন্যাসী তাঁর ভক্ত হয়ে পড়েন। এরপর তিনি ভারতের বর্তমান বিহার প্রদেশের গয়া জেলার একটি গভীর অরণ্যের ভিতর, নিরাঞ্জনা নদীর তীরস্থ একটি অশ্বত্থ গাছের নিচে কঠোর তপস্যা শুরু করেন। এই সময় অনাহারে অনিদ্রায় তাঁর শরীরের মেদ-মাংস ক্ষয়ে কঙ্কালসার হয়ে গিয়েছিলেন। এই সময় তাঁর শারীরীক অক্ষমতার কারণে ধ্যানে মনোনিবেশ করতে পারছিলেন না। তাই তিনি অল্প কিছু আহার করতে থাকেন। এই সময় সুজাতা নামক এক গৃহবধু প্রথম পুত্র সন্তান লাভের পর বনদেবতার পূজা দিতে আসতেন। তিনি সেখানে বুদ্ধকে দেবতা ভেবে পূজা দিতে গেলে, বুদ্ধ তাঁর ভুল ভেঙে দিয়ে বলেন যে, তিনি দেবতা নন। তিনি সুজাতার নিবেদিত পায়েস গ্রহণ করে বলেন যে, তোমার মনস্কাম যেমন পূর্ণ হয়েছে, এই পায়েস গ্রহণের পর আমার মনস্কামও যেন পূর্ণ হয়। বুদ্ধের এই খাদ্যগ্রহণ দেখে, বুদ্ধের প্রতি শ্রদ্ধা হারিয়ে, তাঁর সাথের সন্ন্যাসীরা তাঁকে ত্যাগ করেন। এরপর তিনি একাই ধ্যান করতে থাকেন। প্রায় ৪৯ দিন ধ্যান করার পর, তিনি বৈশাখী পূর্ণিমায় গৌতম বুদ্ধত্ব লাভ করেন। এই সময় তাঁর বয়স ছিল ৩৫ বৎসর। বোধিপ্রাপ্ত হয়ে তাঁর নাম হল তাঁর বুদ্ধ। কথিত আছে তিনি এই রাতের প্রথম যামে পূর্বজন্মের জ্ঞান লাভ হয়, দ্বিতীয় যামে তাঁর দিব্যচক্ষু বিশুদ্ধ হয়, অন্তিম যামে দ্বাদশ প্রতীত্যসমুৎপাদ এবং অরুণোদয়ে সর্বজ্ঞাতা প্রত্যক্ষ করেন। বর্তমানে নিরঞ্জনা নদীকে স্থানীয়ভাবে বলা হয় ফল্গু। আর উরুবিল্ব গ্রামের নাম বুদ্ধগয়া এবং তিনি যে গাছের নিচে বসে বোধিত্ব লাভ করেছিলেন, সেই অশ্বত্থগাছের নামকরণ করা হয়েছে বোধিবৃক্ষ। বোধিবৃক্ষ এবং মন্দির ছাড়া এখানে একটি দীঘির নাম সুজাতা দিঘি। কথিত আছে। এই দিঘির জলে স্নান করে বুদ্ধদেবকে পায়েস নিবেদন করেছিলেন। শরীরকে কষ্ট দিয়ে সাধনায় সিদ্ধিলাভ করা অসম্ভব একথা তিনি বলতেন।
আমাদের গাইড ঘুরে ঘুরে সমস্ত স্থান দেখালেন এবং ঐতিহাসিক বিবরণ দিলেন। আমরা চুপ করে গোগ্রাসে গিললাম ইতিহাসের কথা।
লজে ফিরে সোমা বলল, স্ত্রী চুল বিছিয়ে দিয়েছিলেন ৃমায়ার শেকল।
আমি বললাম, ভগবান মায়ার শেকল ছিন্ন করে সংসার ছাড়লেন। তাই তো মানুষের জন্য কাজ করতে পারলেন।
শ্যামলী বলল, তাহলে।স্ত্রী র কথাটাও ভাবুন…
আমি আর রাজু নিরুত্তর হয়ে রইলাম।
সৈকত তার পরিবার নিয়ে জাপান চলে গেল। অংশুমান ভাবলো, যাক তার কষ্ট করা,সার্থক হয়েছে। একটা বেসরকারি সংস্থার চাকরি নিয়ে জাপানে সংসার হলো সৈকতের। সৈকতের সঙ্গে বিশুদা বেড়াতে এসেছে জাপানে। বিশু ঘুরতে ভালবাসে আবার সৈকতের হেল্প হলো। বিশু থাকলে সকলের ভরসা হয়। বিশু বলল উদীয়মান সূর্যের দেশে আমরা এলাম। । বিশু বললো, পূর্ব এশিয়ার একটি দ্বীপ রাষ্ট্র হল জাপান । এই দেশটি প্রশান্ত মহাসাগরের বুকে জাপান সাগর, পূর্ব চীন সাগর, চীন, উত্তর কোরিয়া, দক্ষিণ কোরিয়া ও রাশিয়ার পূর্ব দিকে উত্তরে ওখোৎস্ক সাগর থেকে দক্ষিণ পূর্ব চীন সাগর ও তাইওয়ান পর্যন্ত প্রসারিত। যে কাঞ্জি অনুসারে জাপানের নামটি এসেছে, সেটির অর্থ “সূর্য উৎস”। জাপানকে প্রায়শই “উদীয়মান সূর্যের দেশ” বলে অভিহিত করা হয়।জাপান একটি যৌগিক আগ্নেয়গিরীয় দ্বীপমালা। এই দ্বীপমালাটি ৬,৮৫২টি দ্বীপ নিয়ে গঠিত। জাপানের বৃহত্তম চারটি দ্বীপ হল হোনশু, হোক্কাইদো, ক্যুশু ও শিকোকু। এই চারটি দ্বীপ জাপানের মোট ভূখণ্ডের ৯৭% এলাকা নিয়ে গঠিত। জাপানের জনসংখ্যা ১২৬ মিলিয়ন। জনসংখ্যার হিসেবে এটি বিশ্বের ১০ম বৃহত্তম রাষ্ট্র। জাপানের রাজধানী টোকিও শহরের জনসংখ্যা প্রায় ৯.১ মিলিয়ন। এই শহরটি অর্থনৈতিক সহযোগিতা ও উন্নয়ন সংস্থার ২য় বৃহত্তম মূল শহর। টোকিও ও পার্শ্ববর্তী বিভিন্ন রাজ্য নিয়ে গঠিত বৃহত্তর টোকিও অঞ্চলের জনসংখ্যা ৩৫ মিলিয়নেরও বেশি। এটি বিশ্বের বৃহত্তম মহানগরীয় অর্থনীতি।সৈকত বললো, প্রেমেন্দ্র মিত্রের ঘনাদা সাগালিন দ্বীপের কথা বলেছিলেন। মনে আছে তোর বিশু। বিশু বললো, জাপানের সাগালিন এবং ওহোতস্ক সমুদ্র দ্বারা সাখালিনটি ধুয়ে ফেলা হয়, এটি জাপান থেকে লা পেরুজের তলদেশে তাতার তীর দ্বারা মহাদেশ থেকে পৃথক হয়। সাখালিনের মোট এলাকা 76 হাজার বর্গ কিমি। এবং ফর্ম, এটি একটি মাছ অনুরূপ, এশিয়ার তীরে বরাবর প্রসারিত। দ্বীপটির দক্ষিণে, পাহাড়গুলি আয়ত্ত করে, উত্তরের কাছে, তাদের নিম্নভূমি দ্বারা প্রতিস্থাপিত হয়, এবং শুধুমাত্র শ্মিট্ট উপদ্বীপে, সাখালিনের চূড়ান্ত উত্তর দিকটি হ’ল পাহাড়ের শিখরগুলি আবার দৃশ্যমান। যেমন একটি জটিল ত্রাণ, পাশাপাশি সমুদ্র এবং সমুদ্রের নিকটবর্তী, উদ্ভিদ এবং প্রাণী বিশ্বের মৌলিকত্ব নির্ধারিত।সাখালিন বৃহত্তম রাশিয়ান দ্বীপ। জাপানীরা এই দ্বীপটি করাফুতোকে উপভোগ করে, যার অর্থ “ঈশ্বরের ভূমি মুখ।” দ্বীপটি 1643 সালে ডাচম্যান দে ভ্রিসের আবিষ্কৃত হয়েছিল। এবং দীর্ঘদিন ধরে, সাখালিনকে উপদ্বীপ বলে মনে করা হয়েছিল। সম্ভাব্য কারণ দ্বীপটি মূল ভূখন্ড থেকে পৃথক হওয়ার স্রোত শীতে ঠান্ডা হয়।জাপানের সাগালিন এবং ওহোতস্ক সমুদ্র দ্বারা সাখালিনটি ধুয়ে ফেলা হয়, এটি জাপান থেকে লা পেরুজের তলদেশে তাতার তীর দ্বারা মহাদেশ থেকে পৃথক হয়। সাখালিনের মোট এলাকা 76 হাজার বর্গ কিমি। এবং ফর্ম, এটি একটি মাছ অনুরূপ, এশিয়ার তীরে বরাবর প্রসারিত। দ্বীপটির দক্ষিণে, পাহাড়গুলি আয়ত্ত করে, উত্তরের কাছে, তাদের নিম্নভূমি দ্বারা প্রতিস্থাপিত হয়, এবং শুধুমাত্র শ্মিট্ট উপদ্বীপে, সাখালিনের চূড়ান্ত উত্তর দিকটি হ’ল পাহাড়ের শিখরগুলি আবার দৃশ্যমান। যেমন একটি জটিল ত্রাণ, পাশাপাশি সমুদ্র এবং সমুদ্রের নিকটবর্তী, উদ্ভিদ এবং প্রাণী বিশ্বের মৌলিকত্ব নির্ধারিত।কারণ সাখালিন তাহা তার প্রজাতি বৈচিত্র্যের মধ্যে রাশিয়াতে সবচেয়ে ধনী। নিজের জন্য বিচারক – দ্বীপে প্রায় ২00 টি প্রজাতির গাছ ও ঝর্ণা বেড়ে যায়।সখালিনের প্রধান গাছটি জিমেইলিন লার্চ। অন্যান্য ধরনের গাছগুলি খুব কমই প্রতিনিধিত্ব করা হয়: পাতলা লেইড লার্চ, আইয়ানস্কি স্প্রুস, সখালিন ফির। হোয়াইট এবং পাথর birches, aspens, সুগন্ধি poplars, শিশির উইল, জাপানি elms, হলুদ ম্যাপেল, এবং alder hardwoods মধ্যে prevail।সাখালিন ফল এবং বেরিতে সমৃদ্ধ। চেরি, ক্যারাট, ব্লুবেরি, রাস্পবেরি, ব্লুবেরি, রেডবেরি এবং ক্র্যানবেরি এখানে বেড়ে যায়। এবং দ্বীপের দক্ষিণে এক অনন্য প্রাকৃতিক সমন্বয় পালন করতে পারে: সাখাওয়ালীন বাঁশের ঝোপঝাড় দ্বারা বেষ্টিত একটি শঙ্কু বন। এই ধরনের ইউনিয়ন বিশ্বের অন্য কোথাও দেখা যায় না। বাঁশ, অবশ্যই, এখানে উচ্চ নয়, তবে এর ঝড় আসলে সবচেয়ে দুর্বল, যেহেতু ইলাস্টিক টুকরাগুলি সবচেয়ে আশ্চর্যজনক ভাবে আটকে থাকে এবং ছুরিগুলির মত তীক্ষ্ণ পাতাগুলি সহজে ত্বকে কাটাতে পারে।দুর্ভাগ্যবশত, গত কয়েক বছরে সাখালিনের প্রাণীরা উল্লেখযোগ্যভাবে দরিদ্র হয়ে পড়েছে। একবার দ্বীপে, ঘুর্ণিমান হরিণ চারপাশে লাফিয়ে পড়েছিল এবং বন্য ডোরা তাদের কান্না দিয়ে পার্শ্ববর্তী বনগুলিকে পড়েছিল। না যারা অন্য বা বাকি আছে। পরে এল্ক এবং লাল হরিণ বিনষ্ট হয়। শেষ শতাব্দীর মাঝামাঝি বর্ধমান বনজনিত কারণে, সযোগ্য এবং র্যাকুন কুকুর অদৃশ্য হয়ে যায়। পর্বত ভেড়া এবং নদী otters চিরতরে দ্বীপ ছেড়ে। এক স্টাফ নেকড়ে, একবার একবার সাখালিনে ভডিভিশগো, যাদুঘরে একাকী একাকী। সমুদ্রের নিকটবর্তী, উদ্ভিদ এবং প্রাণী বিশ্বের মৌলিকত্ব নির্ধারিত। আমাদের ক্যাপটেন বিশু আরও বললেন, টোকিও বিশ্বের সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ শহরগুলির একটি। এর আয়তন প্রায় ২৪০ বর্গকিলোমিটার। মূল শহরে প্রায় ৯০ লক্ষ লোকের বাস। বৃহত্তর টোকিও মহানগর এলাকাতে প্রায় ১ কোটি ৩০ লক্ষ লোকের বাস, যা জাপানের মোট জনসংখ্যার এক দশমাংশ; এটি বিশ্বের সবচেয়ে জনবহুল বৃহত্তর মহানগর এলাকা।টোকিও থেকে বন্দরনগরী ইয়াকোহমা পর্যন্ত অঞ্চলটি অবিচ্ছিন্নভাবে জন-অধ্যুষিত বলে কিছু বিশেষজ্ঞ টোকিও ইয়োকোহামাকে একটিমাত্র মহানগর এলাকা হিসেবে গণ্য করেন, যার জনসংখ্যা প্রায় ৩ কোটি ৮০ লক্ষ। জাপান হচ্ছে একটি দ্বীপদেশ যা মহাসাগর দ্বারা পরিবেষ্টিত। এখানকার মানুষ সবসময় প্রচুর সীফুড খাওয়ার সুবিধা গ্রহণ করেছে। এটি কিছু খাদ্যবিদদের মতামত যে জাপানি খাদ্য সর্বদা উপর নির্ভর করে প্রধানত শষ্যের উপর সাথে থাকে শাকসব্জি বা সামুদ্রিক আগাছা, দ্বিতীয়ত পাখিজাত মাংস এবং সামান্য পরিমাণ লাল মাংস। বৌদ্ধধর্ম প্রসার লাভের আগ থেকেই জাপানে মাংস গ্রহণের এই অনীহা ভাব ছিলো। ইদো যুগে ইয়োতসুশি বা চারপেয়ে জন্তু খাওয়া নিষিদ্ধ ছিলো। এই সত্ত্বেও জাপানে লাল মাংস ভোজন সম্পূর্ণরূপে অদৃশ্য হয়ে যায়নি। গৃহপালিত পশুদের বিপরীতে বন্য খেলা খাওয়া মেনে নেওয়া হয়েছিলো। বিশেষ করে ফাঁদ পেতে খরগোশ শিকারের জন্য এমন শব্দ (ওয়া) ব্যবহার হতো যা সাধারণত একটি পাখির জন্য সংরক্ষিত শব্দ। সাধারণ খাদ্যদ্রব্যগুলির ক্রমবর্ধমান খরচের কারণে জাপানী পরিবারের প্রক্রিয়াকৃত খাবারগুলি র ব্যবহার আরও সুস্পষ্ট হয়ে উঠেছে। কিয়োটো সবজি বা কিয়াইয়াই জনপ্রিয়তা বাড়ছে এবং বিভিন্ন ধরনের কিয়োটো সবজির ব্যবহার আবারো ফিরে আসছে। বিশুর কাছে জাপানের কথা শুনে আমাদের একটা মোটামুটি ধারণা হলো। টোকিও ঘোরার ব্যাবস্থা করলো বিরাজুল। সে গাড়ি ঠিক করে আসার পরে আমরা সকলে খেয়ে শুয়ে পড়লাম। সকালে আমরা একজন গাইডকে পেয়েছি। তিনি একটু আধটু বাংলা জানেন। তিনি বললেন যা সেটি আমরা ভালো বাংলাতেই বলব।তিনি বললেন, মূল টোকিও শহরটি ২৩টি বিশেষ প্রশাসনিক এলাকা নিয়ে গঠিত। জাপানের রাজকীয় প্রাসাদটি টোকিও শহরের হৃৎকেন্দ্রে অবস্থিত। প্রাসাদটি পাথরের প্রাচীর, পরিখা ও প্রশস্ত বাগান দিয়ে পরিবেষ্টিত। রাজপ্রাসাদের পূর্ব-দিক সংলগ্ন বর্ণিল মারুনোউচি এলাকাটি জাপানি ব্যবসা-বাণিজ্যের একটি প্রধান কেন্দ্র। প্রাসাদের দক্ষিণে আছে কাসমিগাসেকি এলাকাটি, যেখানে বহু জাতীয় পর্যায়ের সরকারী কার্যালয় অবস্থিত। তার পশ্চিমে রয়েছে নাকতোচো উঁচু এলাকা, যেখানে জাপানের জাতীয় দিয়েত বা সংসদ ভবনটি অধিষ্ঠিত। টোকিওতে কোনও কেন্দ্রীয় বাণিজ্যিক এলাকা নেই। শহরটি অনেকগুলি গুচ্ছ গুচ্ছ শহুরে এলাকা নিয়ে গঠিত; এই এলাকাগুলি মূলত রেল স্টেশনগুলিকে ঘিরে গড়ে উঠেছে, যেখানে দোকান, বিপণীবীথি, হোটেল, ব্যবসায়িক কার্যালয় ভবন এবং রেস্তোরাঁগুলি ঘন সন্নিবিষ্ট হয়ে অবস্থান করছে। এই গুচ্ছগুলির মাঝে মাঝে অপেক্ষাকৃত কম ভবনবিশিষ্ট অনাধুনিক এলাকাগুলি অবস্থিত, যদিও এগুলিতেও একই ধরনের ভবনের দেখা মেলে। টোকিওর ভবনগুলি বিভিন্ন ধরনের হয়ে থাকে। এখানে এখনও প্রাচীন জাপানি কাঠের বাড়ির দেখা মেলে, যদিও এদের সংখ্যা ধীরে ধীরে কমে আসছে। এছাড়া এখানে মেইজি পর্বে (১৮৬৮-১৯১২) নির্মিত অনেক পাথর ও ইটের তৈরি ভবন আছে। ২য় বিশ্বযুদ্ধের পরে শহরে কংক্রিট ও ইস্পাত দিয়ে অনেক গগনচুম্বী অট্টালিকা নির্মাণ করা হয়। শহরকেন্দ্রের পূর্বভাগে অবস্থিত আলোয় ঝলমল করা গিনজা নামক কেনাকাটার এলাকাটি বিশ্বখ্যাত। রাজপ্রাসাদের উত্তর-পূর্বে অবস্থিত কান্দা এলাকাটিতে অনেক বিশ্ববিদ্যালয়, বইয়ের দোকান ও প্রকাশনী অবস্থিত। টোকিওর নগর-উদ্যানগুলি ইউরোপ-আমেরিকার মত বড় না হলেও সংখ্যায় প্রচুর এবং এগুলিতে প্রায়ই মনোরম সুদৃশ্য বাগান থাকে।টোকিও জাপানের প্রধানতম সাংস্কৃতিক কেন্দ্র। টোকিও শহরে অত্যাধুনিক জীবনধারার সাথে ঐতিহ্যের সংমিশ্রণ ঘটেছে। এখানে নিয়নের আলোয় উদ্ভাসিত গগনস্পর্শী অট্টালিকা যেমন আছে, তেমনই আছে ঐতিহাসিক সব মন্দির। সমৃদ্ধ মেইজি সিন্ত এর সুউচ্চ প্রবেশদ্বার এবং চারপাশ ঘিরে থাকা বৃক্ষশোভিত এলাকার জন্য পরিচিত। টোকিও জাদুঘর জাপান ও এশিয়ার ধ্রুপদী শিল্পকলা ও ইতিহাস বর্ণনাকারী অনেক প্রদর্শনী আছে। একই এলাকাতে একটি বিজ্ঞান জাদুঘর, একটি চিড়িয়াখানা এবং দুইটি গুরুত্বপূর্ণ শিল্পকলা জাদুঘর অবস্থিত। রাজপ্রাসাদের আশেপাশেও বেশ কিছু বিজ্ঞান ও শিল্পকলা জাদুঘর আছে। এছাড়া শহর জুড়েই অন্যান্য আরও অনেক ধরনের জাদুঘর ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। পুনর্নির্মিত নাট্যমঞ্চ পরিদর্শন করা সম্ভব। টোকিওর নাট্যশালাগুলিতে নিয়মিতভাবে ঐতিহ্যবাহী কাবুকি নাটকের পাশাপাশি আধুনিক নাটক পরিবেশন করা হয়। এছাড়া ঐকতান, গীতিনাট্য, ইত্যাদি পাশ্চাত্য ধ্রুপদী সঙ্গীত ও নৃত্যকলা সর্বদাই পরিবেশিত হয়। এদের মধ্যে বিশ্বববিদ্যালয় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। গাইড বললেন, এলাকার পুরাতন, সরু রাস্তাগুলি দিয়ে হাঁটলে দোকানপাট, -পরিহিতা নারী ও ৭ম শতকে নির্মিত চোখে পড়বে। এর বিপরীতে এলাকাতে গেলে উদ্দাম উচ্ছ্বল নৈশক্লাব ও গান গাওয়ার বার দেখা যাবে। এলাকায় পাওয়া যাবে অত্যাধুনিক ইলেকট্রনিক প্রযুক্তির দোকানের সমাহার। মদ্যপান করার জন্য ইজিকায়া নামের ঘরোয়া জাপানি ধাঁচের পাবগুলি টোকিওর সর্বত্র ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। শহরের কেন্দ্রের কাছে আছে যেটি টুনা মাছের নিলামের জন্য বিখ্যাত। সুউচ্চ নামক স্থাপনার শীর্ষে জনসাধারণের জন্য উন্মুক্ত পর্যবেক্ষণ মঞ্চ থেকে গোটা টোকিও শহরের বিস্তৃত পরিদৃশ্য অবলোকন করা সম্ভব। টোকিওর খাবারের দোকানগুলি সবসময়ই জমজমাট থাকে। ও এলাকাতে গেলে হালের কিশোর-কিশোরীদের পোশাকশৈলী সম্বন্ধে ভাল ধারণা পাওয়া যায়।টোকিও জাপানের পরিবহনের প্রধান কেন্দ্র। এছাড়া এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ আন্তর্জাতিক পরিবহন কেন্দ্র। বৈদ্যুতিক রেল, পাতালরেল, বাস ও মহাসড়কের এক ঘনসন্নিবিষ্ট জালিকা টোকিওর সেবায় নিয়োজিত। রেল সমগ্র জাপানের জন্য কেন্দ্রীয় রেল স্টেশন।আমরা হিকারি এক্সপ্রেস নামে উচ্চগতিসম্পন্ন রেলগাড়িতে চাপলাম। এখান দিয়ে যাওয়া যায় টোকিও থেকে উত্তর জাপান অভিমুখী সমস্ত রেললাইনগুলি,’ উয়েনো’ এসে মিলেছে। অন্যদিকে হনশু এবং টোকিওর পশ্চিমের শহরতলী থেকে আগত রেলগাড়িগুলির শেষ গন্তব্যস্থল পর্যন্ত। আমরা ঘুরছি আর গাইডের গল্প শুনছি, কিছু বেসরকারী মালিকানাধীন বৈদ্যুতিক রেলপথ নগরে পরিবহন সেবা দান করে। টোকিওর, চিবা বন্দর শহরে অবস্থিত। অন্যদিকে টোকিও উপসাগরের কাছে অবস্থান আভ্যন্তরীণ বিমান পরিবহন সেবা প্রদান করে।টোকিও সারা বছরই ব্যস্ত থাকে। জানুয়ারির ১ তারিখে গ্রেগরিয়ান মতে নববর্ষ উদযাপন করা হয়; এসময় সমাধিমন্দিরগুলিতে অনেক তীর্থযাত্রীর ভিড় হয়। এপ্রিলে সারা টোকিও শহর জুড়ে চেরি পালিত হয়। মে মাসে উৎসব পালিত হয়, যেখানে বহনযোগ্য সমাধির শোভাযাত্রা হয়। জুলাই মাসে সুমিদা নদীর আতশবাজি উৎসব হয়। আগস্ট মাসে ওবোন নামে একটি বৌদ্ধ ছুটির দিবসে পূর্বপুরুষদের স্মরণ করা হয়। একই মাসে উৎসবে কোয়েঞ্জি রেলস্টেশনের আশেপাশে শোভাযাত্রা-মিছিলের আয়োজন করা হয়।২০১৪ সালে নামক পর্যটকদের সহায়তাকারী ওয়েবসাইটে “স্থানীয়দের সাহায্যদানকারী মনোভাব”, “নৈশজীবন”, “কেনাকাটা”, “স্থানীয় গণপরিবহন” এবং “রাস্তাঘাটের পরিচ্ছন্নতা”-র ক্ষেত্রে “শ্রেষ্ঠ সামগ্রিক অনুভূতি। গাইড বয় আমাদের সাখালিনের বনভূমির কথাও শোনালেন। সাখালিনের বনভূমিগুলির বৈশিষ্টসূচক প্রতিনিধিরা প্রধান ভূখণ্ডের প্রাণী, চরিত্রগত ও দুধ চাষের দুধঃ এইগুলি অনেকগুলি ভেজাল এবং তরমুজ। দ্বীপের দক্ষিণে কলাম পাওয়া যায়। এই প্রাণী জাপান থেকে আনা হয়েছিল, কিন্তু তাদের সংখ্যা এত ছোট।সাখালিনের সবচেয়ে জনপ্রিয় এবং প্রবল শত্রু বাদামী ভালুক। এই দৈত্যগুলির বৃদ্ধি দুই মিটার এবং ওজন – 500 কেজি পর্যন্ত পৌঁছায়। লাল, ধূসর এবং রৌপ্য-কালো বনের মধ্যে অনেক লাল শিয়াল আছে। নদী প্লাবনভূমিতে সর্বত্র হরেস এবং গহ্বর পাওয়া যায়, আপনি নদী otters দেখতে পারেন। আমাদের গাইড আমাদের কৌতূহল দেখে হিমবাহ ও সাগালিন সম্পর্কে অনেক অজানা কথা বললেন। জাপান এসেছি বলে কি আর অন্য অজানা খবর শুনব না। হতেও তো পারে কোনদিন হিমবাহের সামনাসামনি হলাম। অতএব, “জানার কোন শেষ নাই “….কিন্তু সাখালিনের হরিণটি বেশিরভাগ পেঁচা দ্বারা পালিত হয়। বন্য দ্বীপ শুধুমাত্র উত্তর অংশে পাওয়া যায়। Srenely দ্বীপ এবং musk হরিণ প্রায় migrates। এটি রেড বুক তালিকাভুক্ত করা হয়।হিমবাহ হল বরফের বিরাট চলমান স্তুপ বা নদী। সাধারণত পার্বত্য অঞ্চলে শীতকালে তুষার পড়ার হার গ্রীষ্মে গলনের হারের চেয়ে বেশি হলে পাহাড়ের উপরে তুষার জমতে শুরু করে এবং জমে শক্ত বরফে পরিণত হয়। এই বরফজমা এলাকাটিকে বরফক্ষেত্র (Ice field) বলে। যখন এই জমা বরফ নিজের ওজনের ভারে এবং মাধ্যাকর্ষণের টানে ধীরগতিতে পাহাড়ের ঢাল বেয়ে নিচে নামতে শুরু করে, তখন তাকে হিমবাহ বলে। তবে জমা বরফ এত পুরু হয় এবং এর নিম্নগতি এতই ধীর যে তাকে স্থিরই মনে হয়।বিশু হিমবাহ সম্পর্কে কিছুকথা বললো, ভারতের উত্তরে পাকিস্তানের কারাকোরাম পর্বতমালাতে অবস্থিত গ্রেট বালটোরা পৃথিবীর দীর্ঘতম হিমবাহ। এর দৈর্ঘ্য প্রায় আটান্ন কিলোমিটার। হিমালয়ের এভারেস্ট শৃঙ্গের কাছে রংবুক ও কাশৃঙ্গ হিমবাহ অবস্থিত। অস্ট্রিয়া-ইতালি সীমান্তে আল্পস পর্বতমালার সিমিলাউন হিমবাহে উনিশশো একানব্বই সালে একজন মানুষের অবিকৃত দেহের সন্ধান পাওয়া যায়। ধারণা করা হয় দেহটি প্রায় পাঁচহাজার বছর সেখানে সমাহিত হয়ে ছিল।হিমবাহ ও সাকালিনের বর্ণনা শুনে আমাদের আশ্চর্য অনুভূতি হল। পৃথিবী একটা ছোট গ্রহ। তার সব খবর জানা কঠিন। আর মহাকাশ বা ব্রম্ভান্ডের কথা বাদই দিলাম। অসীম এই মহাকাশ। কত বিচিত্র। তার কিছুই কি আমরা জানি? নিজেকে খুব বোকা লাগে যখন জ্ঞানের অহংকারে মত্ত হয়ে আস্ফালন করি ডাঁহা আহাম্মকের মত,বিশু বলল।বিশু সৈকতের কাছে বিদায় নিয়ে ভারতবর্ষে ফিরে এল।
😍😍😍😍😍😍😍😍
বিশু ও সৈকতের বন্ধু, অরিন্দম গোপালবাবুর স্ত্রী সবিতাদেবীর কথা বলছে । এখন গোপালবাবু নেই। অরিন্দম আর যাত্রা করেনা। সে এখন লেখে নিজের জীবনের কথা, গোপালবাবুর কথা তার পরিবারের কথা। সে বলল,বিশুকেকে একটা জীবনের গল্প। তারা এখন অজয় নদের ধারে বসে জীবনের প্রবাহ দেখে।বিশু সবিতাদেবীর পাশেই থাকে। একই গ্রামে ন্বাড়ি।
সবিতা দেবীর বয়স নব্বই ছুঁই ছুঁই। শরীরের নানারকমের অসুখ বাসা বেঁধেছে ডাক্তারবাবু বলেছেন কিডনি,হার্টের যা অবস্থা, বড়জোর আর কয়েকদিন বাঁচবেন। ছেলে একটা প্লাসটিকের গামলা কিনে দিয়েছে। বাথরুম শোবার ঘরের থেকে অনেক দূরে। ওই গামলায় পেচ্ছাপ করা যাবে। কিন্তু পায়খানা যেতেই হবে দূরে। ফলে রাতে দরজার তালা খুলে উঠোন পেরিয়ে বাথরুম যেতে হয়। তখন স্বামী বারবার বলেছিলেন,তোমার ঠাকুর ঘরের পাশেই বাথরুমটা হলে বুড়ো,বুড়ি আমাদের দুজনেরই সুবিধা হবে। কিন্তু সবিতারাণী রাজী হন নি। তিনি বলেছেন,ম্লেচ্ছ,নোংরা লোকের মতো কথা বলো না। ঠাকুর ঘরের পাশে আবার বাথরুম হয় নাকি? স্বামী বলেছিলেন,তাহলে মানুষের শরীরটাতো বাথরুমের থেকেও নোংরা। সবিতাদেবী তর্ক করেন নি আর। শুধু বলেছিলেন, দূরেই করো। সব মনে পরছে তার। স্বামী বারো বছরের বড় ছিলেন। আগেই চলে গেলেন মহাসিন্ধুর ওপাড়ে।
তাঁর স্বামী বড়ো অভিনেতা ছিলেন।সবিতাদেবীকে বলতেন, তিরস্কারের থেকে জীবনে পুরস্কারই বেশি পেয়েছি। অসংখ্য মানুষের ভালোবাসা। এর থেকে বড় পুরস্কার আমার অভিধানে নেই। আমার যোগ্যতার বেশি, তার পরিমাণ। ঈশ্বর সময় হলেই প্রত্যেকের যোগ্য পাওনাটুকু দিতে ভোলেন না। শুধু প্রয়োজন ধৈর্য আর সহনশীলতা। সময় কিন্তু কারও কথায় এগিয়ে আসবে না বা পিছিয়ে যাবে না। অভিজ্ঞ লোকেরা প্রথমে ধৈর্যের পরীক্ষা নিয়ে থাকেন। অন্য মানুষকে সহ্য করা, সম্মান করা ধর্মেরই নামান্তর। মানুষের জন্যই মানুষ। শুধু শুকনো লোক দেখানো ধর্ম যা মানুষকে ছোটো করে সেটা কখনই ধর্ম হতে পারে না। ধর্ম হচ্ছে অণুবিক্ষণের মতো। ছোটো জিনিসকে বড়ো করে দেখে।
সবিতাদেবীর মা ছিলেন গ্রামের লক্ষীদেবী। তার দান,ধ্যানের জন্য সকলেই খুব ভালোবাসতো। মনে পরে সবিতাদেবীর মায়ের কথা। তিনি বলতেন,কথিত আছে কোজাগরি লক্ষীপুজোয় পুজো করার পরে যে গৃহস্থ রাত্রি জাগরণ করে রাত কাটাবে তার ঘরে লক্ষী স্বয়ং বিরাজ করেন। কোনো অভাব, অনটন তাকে স্পর্শ করতে পারবে না। স্বার্থ নিয়েই মানুষ পুজো করে। কারণ সে সংসারী। ছেলে, মেয়ে, বাবা,মা, ঠাকুমা, দাদু সকলকে নিয়ে এই সংসার। তাদের মঙ্গল কামনা করেই মানুষের এই পুজো পার্বণ।
মায়ের মূল লক্ষ্য থাকতো মানুষের সেবা করা
হয়তো তিনি আশ্রম করে যেতে পারেন নি। কিন্তু প্রত্যেক পুজোতে গরীব মানুষকে পেট ভরে প্রসাদ খাওয়াতেন।
বাজারে দরদাম করে ঠাকুর কেনার পরে পুজোর ফলমূল, দশকর্মার জিনিসপত্র কিনে বাড়িতে আলপনা এঁকে ঠাকুরের প্রতিষ্ঠা হয়। তারপর পুরোহিতের পৌরোহিত্যে গৃহস্থের মঙ্গলসাধন। লৌকিক আচার, আচরণে বিশ্বাস জড়িয়ে থাকে। আর বিশ্বাসে মিলায় বস্তু। পুজোর প্রতিটি পর্যায়ে শিল্প ভাবনা বিরাজ করে। তারফলে পুজো আরো আকর্ষণীয় হয়ে ওঠে। দুর্গাপুজোয় ঢাক বাজে। প্যান্ডেলে কোটি কোটি টাকা খরচ করে কোনো কিছুর আদলে মন্দির বানানো হয়। যেমন, তাজমহল, খাজুরাহো, কোনারক প্রভৃতি। নানারকম বাদ্যযন্ত্র পুজেকে আরও আকর্ষণীয় করে তোলে। প্রত্যেক প্যান্ডেলে যদি নর নারায়ণ সেবা হতো তাহলে আরও ভালো লাগতো। সবিতাদেবী কথা বলার সঙ্গী পান না। তাই বসে বসে নিরালায় পুরোনো দিনের কথা ভাবেন।
কাটোয়ার কার্তিক লড়াই, চন্দননগরে জগদ্ধাত্রি পুজো, কাগ্রামের জগদ্ধাত্রি পুজো বাংলার পুজোর জগতে বিশেষ স্থান অধিকার করে আছে। মা সব পুজোতেই মানুষকে খাইয়ে আনন্দ পেতেন। সঙ্গে সবিতা থাকতেন। মায়ের এই গুণ তার মধ্যেও প্রভাব বিস্তার করেছিলো।
সবিতা দেবী এক লক্ষীপুজোর কথা মনে করছেন বসে বসে। অখন্ড অবসর তার। পুজো এলেই মায়ের লক্ষ্মীর ঝাঁপি উন্মুক্ত হয়ে যেতো। কোজাগরীর রাতে মা কম করে তিনশো লোকের খাওয়ার ব্যবস্থা করতেন। মাজা নীচু করে আসনে বসা মানুষদের প্রসাদ বিতরণ করতাম আমরা ভাই বোনেরা। পরের দিনও খিচুড়ির ব্যবস্থা থাকতো। ডোমপাড়ার সকলে এসে নিয়ে যেতো আনন্দে। সর্দার বুড়ি বেসকা দি, মঙ্গলীদি সবাই আসতো। ছোটো পিসি, মানা, বড়পিসী, সন্ধ্যা,রুনু, শংকরী সকলে আসতো। মায়ের ঘর পূর্ণ হয়ে উঠতো অতিথি সমাগমে। গম্,গম্ করতো বাড়ি। মানুষই যে লক্ষ্মী তা আবার প্রমাণ হয়ে যেতো চিরকালের সত্য সুরে।পুজোর বেশ কিছুদিন পরে মেয়েরা সকলে এক হয়ে মাংস, ভাতের ফিষ্টি করতো। মনেআছে আমার, খেতে এসে বিশাখাদি বলেছিলো, আমি বিধবা মাংস খবো কি করে? আমার মাসতুতো দিদি বলেছিলো, বিধবা আবার কি কথা? তোর স্বামী মরে গেছে। দুঃখের কথা। তার সঙ্গে মাংসের কি সম্পর্ক। আচ্ছা কেউ মনে কর মাংস খেলো না। আর মনে মনে স্বামীকে দোষ দিলো। সমাজপতিরা, সমাজের সেনাপতিরা মনের নাগাল কি করে পাবে? ওদের হাত ওই মাংস অবধি। অতএব, নো চিন্তা, ডু ফুর্তি।বিশাখাদি আনন্দে মাংস খেয়েছিলো। সমস্ত কিছুতেই চিরকাল কিছু মহিলার সংস্কারমুক্ত মনের জন্য পৃথিবী এত সুন্দর। উন্মুক্ত সমাজ আমাদের সর্দার পাড়ার। সেখানে সমাজের কোনো সেনাপতি বিধি আরোপ করে না। যে যারইচ্ছেমতো খেটে খায়। কেউ মুনিষ খাটে, কেউ মাছ ধরে, কেউ কেরালা সোনার দেকানে কাজ করে। বুড়ো বয়সে তারা ছেলে মেয়েদের রোজগারে খায়। ওদের কাউকে বৃদ্ধাশ্রমে যেতে হয় না। কার কৃপায় ওরা বুড়ো বুড়ি হয় না? শক্ত সমর্থ থাকতেই পরকালের ডাকে ওপাড়ে চলে যায়। কাজই হলো আসল লক্ষ্মী।
স্বামী বলতেন তার মায়ের কথা। তিনি বলতেন,আমার মা সাধনায় ছিলেন রামপ্রসাদ। মা রক্ষাকালীর পুজো দিতে দিতে গেয়ে উঠতেন রামপ্রসাদি। নিরামিষ মা কালীর আশীর্বাদ মাথায় নিয়ে ছেলেদের নিয়ে সংসার চালাতেন জীবনানন্দ ছন্দে। অভাব থাকলেও কোনোদিন তার ছাপ পরেনি মায়ের চোখেমুখে। আসল মূল্যবান রত্নের সন্ধান তিনি পেয়ে গেছিলেন পুজোর আসনে বসে। কোনোদিন তার কথায় প্রকাশ পেতো না সেসব কথা। তার চলনে, বলনে ফুটে উঠতো মাতৃরূপের জলছবি। মাকে দেখেই মাথা নত হয়ে যেতো সকলের। দাদু মাকে মা বলেই ডাকতেন। তিনি সময়ে অসময়ে মাকে রামপ্রসাদী শোনাতে বলতেন। মায়ের গান শুনতে শুনতে একদিন চলে গেলেন পরপারে তৃপ্ত মুখে। একবার বৈশাখি ঝড়ে আম গাছের ডাল ভেঙ্গে পড়লো। মা বললেন,তোদের দাদুর আত্মা মুক্তি পেলো। অই ডালে বাঁধা ছিলো দাদুর মুক্ত হবার লাল চেলি। অবশ্য এটা ছিলো এক সাধুবাবার তুকতাক। বুড়ি ঠাকুমা সেদিন কেঁদে উঠেছিলো জোরে। ঠাকুমা বলে উঠলেন,চলে গেলো,ও চলে গেলো। কোনো কিছুই আমরা নিশ্চিতভাবে জানি না। তবু কিছু ঘটনা বার বার তার অস্ত্বিত্বের কথা স্বীকার করে নেয়। একটা দেশি কুকুর আমাদের বাড়িতে থাকতো ছোটে থেকে। তোমরা বিশ্বাস করবে কি না জানি না? সে অমাবস্যা,পূর্ণিমায় কিছু খেতো না। রক্ষাকালী পুজোয় উপবাস করতো। তার সামনে খাবার দিয়ে দেখা গেছে সে খাবারের ধারের কাছে যেতো না। শুধু কথা বলতে পারতো না। কিন্তু ভাবে, ভঙ্গিমায় সব বেঝাতে পারতো মানুষের মতো। মা বলতেন,পূর্বজন্মে তোর সঙ্গে কোনো আত্মীয়তা নিশ্চয় ছিলো। তাই তোর আমাদের বাড়িতে আগমণ। যেদিন জিম দেহ রেখেছিলো সেদিন ওকে মাটি চাপা দিয়ে ধূপ আর ফুলে শেষ বিদায় জানিয়েছিলো সারা পাড়ার বাসীন্দা। তাহলে কি বলবে তুমি এই ঘটনাকে। কোন যুক্তিতে অস্বীকার করবে তার সারা জীবন ধরে পালন করা ব্রত,উপবাস। বলবে,কাকতালীয়। সেসব তো এক আধবার হয়। সারাজীবন ধরে নিয়মিত হয় না।বিজয়ার সময় আমার মা জিমকে প্রথম মিষ্টিমুখ করাতেন। ধান রাখার গোলার তলায় একবার গোখরো সাপ দেখে, ঘেউ ঘেউ শব্দ করে আমাদের দেখিয়ে দিয়েছিলো সাপটা। তারপর সাপুড়ে ডেকে সাপটি বনে ছেড়ে দেওয়া হয়। বড়দার বিছানার মাথার কাছে সে শুয়ে থাকতো। কোনো বিপদ বুঝলে ঝাঁপিয়ে পরতো নিঃস্বার্থ ভাবে। প্রত্যেক প্রাণীর কাছে আমাদের শেখার আছে অনেক কিছু।স্বামী চলে যাওয়ার পরে একদম একা হয়ে পরেছিলেন তিনি। মনে পরতো তার আদর। প্রথম ফুলশয্যার রাত। কি করে যে একটা একটা করে রাত, দিন পার হয়ে যায়, বোঝাই যায় না। তবু বুঝতে হয়, মেনে নিতে হয়। একটা ঘুঘু পাখি তার স্বামী মরে যাওয়ার পর থেকেই এবাড়িতে আসে। আম গাছের ডালে বসে আপন মনে কত কথা বলে। ঘুঘুর ঘু,ঘুঘুর ঘু। সবিতাদেবীর সঙ্গে পাখিটার খুব ভাব। মনে হয় স্বামী ঘুঘুর রূপ ধরে আসেন। তিনি আম গাছের তলায় খুদকুড়ো ছিটিয়ে দেন। ঘুঘু পাখিটা খায় আর গলা তুলু সবিতাদেবীকে দেখে। কিছু বলতে চায়। তিনি বোঝেন। আর আপনমনেই পাখিটার সঙ্গে বকবক করেন। পুরোনো দিনের কথা বলেন। ছেলের বৌ বল,বুড়িটা পাগলী হয়ে গেছে। প্রতিবেশীরা অতশত বোঝে না। হাসাহাসি করে। শুধু তার ছেলে বোঝে মায়ের অন্তরের কথা, ব্যথা। ঘুঘু পাখিটা সারাদিন ডেকে চলে। এবার আয়, এবার আয়। বুড়ি বলে,ও ঘুঘুর ঘু,বলে না। বলে,এবার আয়,এবার আয়। নাতি এসে মাঝে মাঝে ঠাকুমার কাছে বসে। আর ঘুঘু পাখিটার সঙ্গে সুর মিলিয়ে বলে,এবার আয়।নাতিকে গল্প বলে ঠাকুমা। নিজের জীবনের কথা বলেন,জানিস,ছোটোবেলায় আমার বন্ধুদল ছিলো। বক্রেশ্বর নদী ছিলো। গাছ ছিলো। তারাও আমার বন্ধুর দলে ভিড়ে গেয়েচিলো। নদীর ধারে বনকুলের গাছ ছিলো। তারা সাজিয়ে রাখতে আমাদের জন্য মিষ্টি কুল। আমরা আঁচলে করে, বা গামছায় বেঁধে মুড়ি নিয়ে যেতাম। ছোলাভাজা,কুসুম ফুলের বীজ ভাজা চালভাজা নিয়ে যেতাম। নদীর ধারে বসে জলে পা ডুবিয়ে খেতাম। নদীর জল হেঁট হয়ে বসে চুমুক দিয়ে পান করতাম। পায়ে বিভিন্নরকমের রঙীন মাছ চুমু খেয়ে যেতো। আমরা মুড়ি খাওয়ার পরে গামছা করে রঙীন মাছ ধরতাম। আবার ছেড়েও দিতাম। তারা সাঁতার কেটে খেলা দেখাতো।একবার সন্ধ্যা হল,আমরা আমড়া গাছে ভূত দেখেছিলাম। ভূতের কথা শুনে নাতি বললো,কি ভূত গো ঠাকুমা। ভালো না খারাপ।
তখন ভূত গুলোও ভালো ছিলো। আমাদের শুধু বলেছিলো, তিনি সন্ধে বেলা বাড়িতে পড়তে বসবি। এখন আমরা আসর জমাবো। তোরা বিকেলে খেলবি। জানিস না,তিনি সন্ধে বেলা, ভূতে মারে ঢেলা। ভূতের গল্প শুনে নাতি ঠাকুমার কোল ঘেঁষে বসতো। ঠাকুমা বলতেন,ভয় কি আমি তো আছি। ঠাকুমা সবিতা দেবী ঠাকুরকে বলেন,আর একবার সময়ের চাকাটা উল্টোদিকে ঘোরানো যায় না। তাহলে আবার ছোটো বয়সটা পাওয়া যাবে। নদীর জল খাওয়া যাবে। স্কুল ফাঁকি দিয়ে মাঠে, মাঠে ঘোরা যাবে। ঘু ঘু পাখিটা বিজ্ঞের সুরে বলে,না না না, ঘুঘু, ঘুঘু।আজ সকাল থেকে সবিতাদেবী উঠোনের রোদে বসল আছেন। ছেলে অফিস যাওয়ার আগে আজকে প্রণাম করলো। কোনোদিন করে না তো। তিনি আশীর্বাদ করলেন ছেলেকে প্রাণভরে। ছেলে বললো,সাবধানে থেকো। আজ ওরা পিকনিক করতে যাবে পুকুরের ধারে। ছেলে চলে গেলো।এখন শীতকাল। পিকনিকের সময়। যাবে বৈকি। নিশ্চয় যাবে। তারও যেতেন। যুগে যুগে পরম্পরা এইভাবেই তো ঐতিহ্য ধরে রেখেছে। ভাবেন সবিতাদেবী। বৌমা নাতিকে দিয়ে একবাটি মুড়ি,তরকারী নামিয়ে দিয়ে গেলো। ঠাকুমা খিদে পেলে খাবে। ঠাকুমা বললেন,বেশ বাবা। তোমরা যাও। আমি ঠিক খেয়ে নেবো। মনে পরে গেলো একবার ফাঁকা বাড়ি পেয়ে রান্না করে খেয়েছিলেন। পুড়ে গেছিলো তরকারীটা। সেই প্রথম রান্নার অভিজ্ঞতা। তারপর দুপুরবেলা তালবোনা পুকুরে সাঁতার কেটে তাল কুড়িয়ে এনেছিলেন। সব মনে আছে। আরও মনে পরছে পাড়ার ধীরেন ফাঁকা বাড়ি পেয়ে তার কাছে এসলছিলো। খুব ভালে ছেলে। অনেক গল্প হয়েছিলো। একটা চুমু খেয়েছিলো। আর কিছু নয়। বলেছিলো, সারা জীবন এই স্মৃতি মনে থাকবে তার। ধীরেন এক বছর পরে ক্যান্সারে মারা গেছিলো। কিন্তু কিশোরী সবিতার কাছে সে অমর হয়ে আছে।স্বামীকে সব কতা খুলে বলেছিলো। বড় সরল তার মন। বলার ফলে অশান্তি হয়েছিলো অনেক
একজন মৃত মানুষ জীবন্ত হয়ে উঠেছিলো সংসারের টানা পোড়েনে। তারপর বয়স বাড়লে তার স্বামী বুঝেছিলেন পাগলামীর কথা। তখন তার গোপন বাল্যপ্রেমের কথা তিনি বলেছিলেন সবিতা দেবীকে,যখন তখন নয়নার ছবি ভেসে উঠতো নয়ন জুড়ে। তবু সেকথা বলা হয়নি আজীবন। দূর থেকে শুধু দেখা আর দেখা। সে দেখা মৃত্যুর আগে অবধি ছিলো অন্তরজুড়ে।সবিতা দেবী এক মেয়ে ও এক ছেলে নিয়ে যৌবনে বিকেলে যখন বেড়াতে যেতেন তখন সবাই তাকিয়ে দেখতো। ছেলে বড়ো। মেয়ে ছোটো। মেয়েকে অনেকে ভালোবেসে চকলেট দিতেন। মেয়ে আর একটা হাত পেতে বলতো,আর একটা দাও। দাদা খাবে। ছোটো থেকে আমরা সবাই ভাগ করে খাবো, এই আদর্শে মানুষ তার ছেলে মেয়ে। ভারতীয় দর্শন তো সেই কথাই বলে। স্বামী অসীম চাকরী করতেন বেসরকারি একটা কারখানায়। ম্যানেজার ছিলেন তিনি। ছোটো থেকে নিজে অনেক কষ্ট করেছিলেন। মুদিখানা দোকান ছিলো তার বাবার। বৃদ্ধবাবা, বাজার যেতে পারতেন না। তখন রাস্তায় ছিলো মাটির ধুলো। বৃষ্টি পরলে কাদায় পিছল হয়ে যেতো পথ। তবু মাথায় করে বয়ে আনতেন নুনের বস্তা, যার ওজন ছিলো ষাট কেজির মতো। অমানুষিক পরিশ্রম করে বড় হয়েছিলেন তিনি। পেট ভরে দুবেলা খাবার জুটতো না। সবিতাদেবীর খুব খারাপ লাগতো। তাই তিনি তার দাদা, দুকড়ি কে সব কথা খুলে বলেন। দুকড়ি দাদা কলকাতায় কাজ করতেন। অনেক মাড়োয়ারি, কারখানার মালিকের সঙ্গে তার জানাশোনা ছিলো। তিনি অসীমকে একটা কারখানার ম্যানেজার পদের চাকরী জোগাড় করে দিলেন। অসীম নিজের দুঃখের কথা ছেলেমেয়েদের কোনোদিন বলেন নি। তিনি ছেলে ওমেয়েকে জমিদারের সন্তানের মতো মানুষ করেছিলেন। ঝুলনের দিনে পুতুলে ভর্তি হয়ে যেতো ঘর। ছেলেমেয়েরা ঝুলন সাজাতো। আর অসীমবাবুর খুব ভালো লাগতো। ছোটোবেলার নিজের না পাওয়ার দুঃখ তিনি ভুলে যেতেন। দোলের সময় ছেলে মেয়েকে কিনে দিতেন নতুন জামা। সেই জামা পরে তারা দোল খেলতো। মিষ্টি,মাংস, ফল কিছু বাকি থাকতো না। কত লোক আসতো তার বাড়িতে রং মাখাতে। তারপর মিষ্টিমুখ করে ফিরে যেতো রাম রাম বলে। আমরা শ্রদ্ধেয় লোককে দেখে যেমন নমস্কার করি। যারা হিন্দীভাষী তারা শ্রদ্ধেয় গণ্যমান্য লোককে দেখলে বলে,রাম রাম রায় বাবু। লিলুয়া শহরে পটুয়াপাড়ায় বাসা ভাড়া করে থাকতেন অসীমবাবু। তারপর একদিন তার গ্রামের ভাই মরে গেলো কম বয়সে। জীবন ওলট পালট হয়ে গেলো। চাকরী ছেড়ে আবার চলে গেলেন গ্রামে। জমানো পয়সা,সোনাদানা সব খরচ হয়ে গেলো। ধার, দেনা করে কোনোরকমে একটা দোকান করলেন। মুদিখানা। আবার শুরু হলে জীবন সংগ্রাম। মেয়ের বিয়ে হলো কোনোরকমে। ছেলের তখনও চাকরী হয় নি। শরীরের ওপর চাপ খুব বেশি হয়ে পরলো। তার ফলে অল্প বয়সে মারা গেলেন তিনি। এবার দোকান চালায় ছেলে। দোকান বেশিদিন চালাতে হলো না। ছেলে চাকরী পেলো। সেদিন খুব আনন্দ হয়েছিলো সবিতাদেবীর।মনে পরে তার, একবার সুতিকা হয়েছিলো তার। পেট ফেঁপে যেতো। বারবার পায়খানা যেতে হতো। তখন মাঠে,ঘাটে সারতো সবাই। শ্বশুরমশাই খাল কেটে দিয়েছিলেন। তারপর শুয়োগাছি গিয়ে সাধুবাবার কাছে শেকড়,বাকড় খেয়ে বাবা ভূতনাথের দয়ায় অসুখ ভালো হয়েছিলো। শুয়োগাছি থেকে আসার সময় মেয়েটাকে সারা রাস্তা কাঁধে করে এনেছিলো ছেলে। বাড়িতে এসে দেখলেন,শ্বাশুড়ি মরে গেছেন। শ্বাশুড়ির ছোটো মেয়েটা ভুগছিলো খুব। কাঠির মতো শরীর হয়ে গেছিলো। শ্বশুর বললেন সবাইকে,ওর মরদেহের সঙ্গে মেয়েটাকেও বেঁধে দাও। ও তো আর কদিন পরেই মরবে। কিন্তু সেই মেয়ে বড়ো হয়ে গ্রামের শ্রেষ্ঠ সুন্দরী হয়েছিলো। রাখে হরি মারে কে? সবিতাদেবী ভাবেন ঈশ্বরের করুণার কথা। যাইহোক,চাকরী পাওয়ার পরে ছেলের বিয়ে দিলেন সবিতাদেবী। এখন ছেলে,ছেলের বৌ আর নাতি এই নিয়ে তার সংসার। কোনো কিছুর অভাব নেই। তবু সবিতাদেবীর মনে হয়,আগের দিনগুলোই ভালো ছিলো। অভাব থাকলেও শান্তি ছিলো হৃদয় জোড়া। যাইহোক এখন বয়স হয়েছে। ভালোমন্দ সব সমান মনে হয়।
বাথরুম যেতে গিয়ে কলতলায় পা পিছলে পরে গেলেন সবিতাদেবী। বুকটায় খুব ব্যাথা করছে। ঘুঘু পাখিটা নিচে নেমে এসেছে গলা কাঁপিয়ে কি দেখছে পাখিটা। তিনি ভাবছেন,আমাকেই দেখছে। একি হলো। আর কিছু দেখতে পাচ্ছি না কেন?। চিৎকার করার ইচ্ছে হলেও গলা দিয়ে আওয়াজ বেরোলো না। তার বাবা,মা,স্বামীকে এবার দেখতে পাচ্ছেন। আর দেখছেন,তিনি ঘুঘু পাখি হয়ে গেছেন। একটা শীর্ণ শরীর পরে আছে কলতলা জুড়ে। তার শরীর বেশ হাল্কা লাগছে। ঘুঘু পাখিটার সঙ্গে উড়ে চলে গেলেন খোলা আকাশের নীচে।
সন্ধেবেলা ছেলে,বৌমা,নাতি এসে দেখে,মা পরে আছে কলতলায়। শরীর কাঠ হয়ে গেছে। সবাই ধরাধরি করে নিয়ে এলো বারান্দায় দড়ির খাটে। আর চাদর,বিছানা নষ্ট করে লাভ নেই। বৌমা ভাবছে। নাতি বললো,একটা চাদর ঢাকা দাও ঠাকুমাকে। ঠান্ডা লাগবে। ছেলে একটা সাদা শাড়ী এনে ঢাকা দিলো। তারপর পাড়ার লোকজন এসে নিয়ে গেলো শ্মশানে। সব মিটে গেলো পনেরো দিনের মধ্যেই।এখন ছেলে একা। তার ছেলেও বড়ো হচ্ছে। সমানে অনন্তকাল ধরে চলেছে এই প্রবাহ। ছেলে ভাবছে,মা নেই,বাবা নেই।মন খারাপ। এবার তার মনের খবর কে নেবে?মায়ের কাছে সময় দিতে পারেনি। শুধু কাজ, কাজ আর কাজ। আর এই কাজ শেষ হলে সেও একা হয়ে পরবে। আজ কবি বন্ধু বাড়িতে এসেছে। বেশ ভালো লাগছে। বন্ধু বলছে,জন্ম, মৃত্যু তো থাকবেই। সত্যকে মেনে নিতে হয়। তাহলেই আনন্দ। সে বলছে,তবু সব কিছুর মাঝেই ঋতুজুড়ে আনন্দের পসরা সাজাতে ভোলে না প্রকৃতি। সংসারের মাঝেও সাধু লোকের অভাব নেই। তারা মানুষকে ভালোবাসেন বলেই জগৎ সুন্দর আকাশ মোহময়ী, বলেন আমার মা। সব কিছুর মাঝেও সকলের আনন্দে সকলের মন মেতে ওঠে। সকলকে নিয়ে একসাথে জীবন কাটানোর মহান আদর্শে, আমার দেশই আদর্শ।
সত্য শিব সুন্দরের আলো আমার দেশ থেকেই সমগ্র পৃথিবীকে আলোকিত করুক। আমি বললাম, এক নাগাড়ে বকে গেলি অনেকক্ষণ। বন্ধু বললো, তুমি আরও কিছু বলো। সেই জন্যই তোমার কাছে আসা। আমি আবার বলতে শুরু করলাম,আমার কথা আমার গোপন কথা। আমার অনুভবের কথা। কবি বন্ধু আমার কথা শুনতে ভালোবাসে। সে সংসারী। তবু সব কিছু সামলে তার কবিতা তো লিখে চলে।
আমি বন্ধুকে বলতে শুরু করলাম শরত জীবনের কথা। এবার আমার জীবনের পরবর্তী অঙ্ক শুরু।তারপর শুরু হলো আমার জীবনের রোজ নামচা। আমি ট্রেনে এখন রবির সঙ্গেই যাওয়া আসা করি। রবির সঙ্গে আমার খুব ভাব। অন্তরঙ্গ বন্ধু আমার। তাছাড়া ধীরে ধীরে আরও বন্ধু হলো। রবি বললো,শোন আমার একটা কবি সম্মেলনের আলোচনার কথা। এই ট্রেন জার্নির অভিজ্ঞ তার কথা।রবি বলছে, যে সব মানুষ অন্ধ, খোঁড়া কিংবা বার্ধক্যের কারণে মানুষের সাহায্য চেয়ে বাঁচতে চান তারা ভিখারি নন।একটা সাহিত্য সম্মেলনে রবি বক্তব্য রাখছিলো। বিষয় হলো, ভিখারি- আপনার চোখে। স্টেজে উঠে গল্পটা বলছিলো।রবি আবার শুরু করলো তার বক্তব্য, দাঁড়িয়ে। সামনে অনেক কবি, সাহিত্যিক, ও আরও অনেক গণ্যমান্য মানুষ বসে আছেন, তাদের আমি সকলকে শ্রদ্ধা জানাই। আমি বলছি অভাবের কারণে, রোগের কারণে যারা ভিক্ষা করেন তারা ভিখারি নয়। কারণ বাঁচার অধিকার জ্ঞাপন করার জন্য তারা মানুষের দ্বারস্থ হন। বাঁচতে চাওয়া, একমুঠো খেতে চাওয়া তো অন্যায় নয়। মানুষকে ঠকিয়ে যারা টাকার পাহাড় গড়ে তোলে সত্যিকারের
ভিখারি তারাই।সে বলে চলেছে, আমি ভিখারি দেখেছি অনেক। সেই গল্প আমি আপনাদের শোনাবো।সবাই একবাক্যে বলে উঠলেন, বলুন, আমরা শুনতে চাই। রবি বলছে, যাদের প্রচুর আছে অথচ সামান্য পেনশেন ভোগীর কাছে ঘুষ নেয়, বিধবা মহিলাকে মৃত স্বামীর জমানো হক্কের টাকা পাইয়ে দেবার আগে তাকে শোষন করে ছারপোকার মতো তারাই প্রকৃত ভিখারি। এবার আমি আমার লেখা গল্প পাঠ করছি।আমার বন্ধু আমার সঙ্গেই আসা যাওয়া করতেন। তিনি থাকলে আমার একাকিত্ব দূর হতো। দুজনে গল্প করতে করতে সময় কখন যে পার হয়ে যেতো বুঝতেই পারতাম না।আর এক বন্ধুর নাম সুকুমার। সুকুমার বললেন, দেখুন ট্রেন চলাকালীন বাইরের দৃশ্য মনোরম। দুর্গাপূজা হয়ে গেছে। কাশফুলগুলো মন খারাপ করে মাথা দোলানো বন্ধ করেছে। বৃষ্টি হয়ে গেলো। একটা ভ্যাপসা গরম মন আরও বিষন্ন করে তুলেছে।আমি বললাম,আপনি তো বেশ কবির মতো কথা বলছেন। ঠিক বলেছেন।ট্রেনের ভিতরটা একবার দেখুন। কেউ বাদাম খেতে ব্যস্ত। কমবয়সীএকটা ছেলে একদৃষ্টে কলেজ ছুটির পরে বান্ধবীর দিকে তাকিয়ে আছে। তার তাকানো দেখে পাশের মেয়েটি মাথা ঘুরিয়ে দাঁড়ালো। একটা সমগ্র দোকান বয়ে বেড়াচ্ছে বুকে হরেক মাল সাঁটানো ফেরিওয়ালা। ফ্রি তে হজমি গুলি খেতে ব্যস্ত যাত্রী পাঁচজন। কিন্তু কেনার লোকের অভাব। একজন যাত্রী ভাবুক মনে সব কেনা কাটা দেখছেএক মনে। কেউ হিন্দীভাষী, কেউ ওড়িয়াভাষী, কেউ সাঁওতাল। সকলের সমান অধিকার। ট্রেনের একটা কামরা যেনো দেশ। আত্মীয় পরিজন নিয়ে উঠে খাওয়া দাওয়ায় ব্যস্ত। সোমড়াবাজারের মোহন ভোগ
মানুষের রসনা মোহিত করে রেখেছে।
বন্ধু আর আমি কথা বলতেই ব্যস্ত। বড়ো ভালো লাগে ট্রেনের এগিয়ে যাওয়ার গতি। তারপর স্বস্থানে ফিরতে হবে সবাইকে।আমার চোখে ট্রেনরর কামরাটা গোটা পৃথিবী হয়ে উঠেছে। লন্ডন থেকে আসা লাল রঙের লোকটা নবদ্বীপে নেমে গেলো হরে রাম, হরে রাম ধ্বনি দিতে দিতে। তারপরই বিষ্ঞুপ্রিয়া হল্ট। আর সেখান থেকেই আধঝুড়ি আপেল নিয়ে এক বিক্রেতা উঠলেন।তিনি হেঁকে চলেছেন, আপেল, কাশ্মীরী আপেল। এক কেজি সত্তর,পাঁচশো চল্লিশ টাকা। দেবো নাকি? ডিলিশাস, খেয়ে দেখুন।এদিকে শসাওয়ালা বলছেন, দেবো নাকি ছাল ছাড়িয়ে,নুন মাখিয়ে…আপেল দেখলাম। খুব ভালো। দুজনেই নিলাম। আর ফুল ফ্যামিলি নিয়ে যে ধনী লোকটি এতক্ষণ সব কিছু দরদাম করে কানের পোকা মারছেন,তিনি এবার ডাকলেন,এই আপেল, এদিকে আয়।
-যাই বাবু, আপেল…-
-কই রে, কত করে
-দিলাম সত্তর করে।
– না না ষাট টাকার বেশি দেবো না।
তারপর অনেক কথা ক্ষয় করে বাবুটি পাঁচশো আপেল নিলেন। তারপর আমরা দুজনেই দেখলাম পঞ্চাশ টাকা তার হাতে দিলেন।স্টেশনে এবার নামতে হবে। তাড়াতাড়ির মাথায় আপেলওয়ালা একশো টাকা মনে করে পঁয়ষট্টি টাকা ফেরত দিলেন বাবুটিকে।বাবু অম্লান বদনে নিয়ে নিলেন টাকা। আমরা দুজনেই প্রতিবাদ করলাম। আমি বললাম, আপনি তো পঞ্চাশ টাকা দিলেন। তাহলে কোন আক্কেলে আবার এতগুলো টাকা নিলেন।বাবু বললেন, আমি একশো টাকা দিয়েছি।মুখ সামলে কথা বলবেন।আপেলওয়ালা বললেন, আমার ভুল হয়েছে। দেখুন আপনি ভালো করে। আপনি পঞ্চাশ টাকা দিয়েছেন।
বাবুটি সমানে তর্ক করে চলেছেন।আপেলওয়ালা বললেন, বেশ আপনাকে আমি
ভিক্ষা দিলাম। এই বলে তিনি নেমে গেলেন।তারপর দেখলাম বাবু বিজয় গর্বে বলছেন, এই সুযোগ কেউ ছাড়ে মশাই। একদম ফ্রিতে আপেল। তারপর আপেলে কামড় দিয়ে বললেন, আপনাদের দেখে নেবো।পরের স্টেশনে আমি নামবো। তারপর দেখছি।আমার বন্ধুটি বললেন, পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ ভিখারি আপনি। আপনার ক্ষমতা কই?আপনি তো নিঃস্ব রিক্ত। আপনাকে দেখে আমাদের দয়া হচ্ছে।বাবুটি ফাটা বেলুনের মতো চুপসে গেলেন। ওনার স্ত্রী চোখের ঈশারায় চুপ করতে বললেন স্বামীকে। পরের স্টেশনে ওনারা নেমে গেলেন।
বন্ধু বললেন, ভিখারি এরেই বলে…আমার গল্প এখানেই শেষ। এই বলে রবি সকলকে নমস্কার জানিয়ে বসে পরলো।করতালি দিতে ভুলে গেলো অনেকেই…
ট্রেন থেকে নেমে আমরা চলে গেলাম বাড়ি।ছোটোবেলার মজার কথা বলতে, ভাবতে খুব ভালো লাগে।সারা রাত পুজো দেখতে গিয়ে বন্ধুদের দলের একজনের খুব টয়লেট যাবার প্রয়োজন হলো। বন্ধু পড়লে লজ্জা পাবে। নামটা নকল বলি। হেগো, হাগুর জন্য ছটফট করছে। সামনে কোনো ব্যবস্থা নেই। হেগো কাপড়ে চোপড়ে হবার আগে প্যান্টের বোতাম খুলে ফেলেছে। একটা ড্রেনে বসতে যাবে এমন সময়ে বাড়ির মালিক বলছেন, একি আমার বাড়ির সামনে,খোলা স্থানে,আরে ছি, ছি,…
হেগো বলছে, মেসোমশাই একটুখানি, এক সেকেন্ড…
— আরে, আরে,বেয়ারা..
মেসো ততক্ষণে নাক চেপে ধরেছেন।
হেগো তখন মরিয়া। কাজ সাবাড়। মার ছুট। মেসো আমাদের বললেন, তোমরা চেনো।
আমরা বললাম, না না। ব্যাটাকে ধরতে পারলেন না।
– কি করে ধরবো। জল নেই। তবু, শালার ঘেন্না নেই।
বন্ধু বিপদমুক্ত হলে আমাদের আনন্দ হয়েছিলো।
😍😍😍😍😍😍😍
আবার সাঁতার শিখতে গিয়ে,ছোটোবেলার রায়পুকুরের রাধা চূড়ার ডালটা আজও আমায় আহ্বান করে হাত বাড়িয়ে । এই ডাল ধরেই এলোপাথারি হাত পা ছুড়তে ছুড়তে সাঁতার শিখেছি আদরের পরশে । ডুবন্ত জলে যখন জল খেয়ে ফেলতাম আনাড়ি চুমুকে, দম শেষ হয়ে আসতো তখন এই ডাল তার শক্তি দিয়ে ভালোবাসা দিয়ে জড়িয়ে ধরতো অক্লেশে । হয়তো পূর্ব জন্মে আমার দিদি হয়ে যত্ন আদর করতো এই ডালটা । কোনোদিন তাকে গাছ মনে করিনি আমি ।এখনও জল ছুঁয়ে আদরের ডাক শুনতে পাই পুকুরের ধারে গেলে । রাধা নামের মায়াচাদর জড়ানো তার সবুজ অঙ্গে ।ভালো থেকো বাল্য অনুভব । চিরন্তন প্রকৃতির শিক্ষা অঙ্গনে নাম লিখে যাক নব নবীন শিক্ষার্থী প্রবাহ ।আমি এইসব ভাবছি। এমন সময় পিছন দিক থেকে একটা বড় পাঁঠা আমাকে গুঁতিয়ে জলে ফেলে দিলো। খুব রাগ হলো কিন্তু পাঁঠার সঙ্গে লড়াই করতে লজ্জা হলো। যদি কেউ দেখে ফেলে। তারপর গাজনের রাতে স্বাধীন আমরা। সারা রাত বোলান গান শুনতাম। সারা রাত নাচতাম বাজনার তালে তালে। সবাই মনে করতো, ব্যাটারা গাঁজার ভক্ত নাকি। গাজনে একজন হনুমান সেজেছিলো। আমরা তার লেজে আগুন লাগিয়ে দিয়েছিলাম। পরে দেখলাম লোকটা রাগ করে নি। বলছে,লঙ্কা পুড়িয়ে ছারখার করে দেবো।
আর হনুমান লাফিয়ে শেষে জলে ঝাঁপ দিলো।
চারদিকে প্রচুর লোকজন ভিড় করে দাঁড়িয়ে আছে।বন্ধু রবি বলছ,ঠিক বলেছিস। তোর কথা শুনলাম। রবি আর আমি বসে গল্প করছি। এবার শোন আমার দাদুর কথা। আমার হৃদয়ের কথা। তোকে শোনাতে পারলে ভালো লাগবে।।রাগ,হিংসা,ক্রোধের সংমিশ্রণে সংসার স্রোতে ভাসতে ভাসতে জীবন প্রবাহ এগিয়ে চলে। হয়তো এর ফলেই দাদুর শেষজীবনে সেবার সুযোগ পেয়েছিলাম আমরা। আমি নিয়ম করে দাদুকে গীতাপাঠ করে শোনাতাম। দাদু কত গল্প বলতেন। কোনোদিন হা পিত্যেশ করতে দেখিনি। আমার সময় কাটতো দাদুর কাছেই বেশি। পড়াশোনার ফাঁকে চলতো গীতাপাঠ। আমি জিজ্ঞেস করতাম,দাদু মরণের পরে আমরা কোথায় যাই? দাদু বলতেন,জানি না ভাই। তবে।।মরণের পরে যদি যোগাযোগ করা যায়,তাহলে আমি তোকে নিশ্চয় জানাবো। দাদু বলতেন, আমি যখন শেষ বিছানায় শোবো,তখন আমি ঈশারা করবো হাত নেড়ে। তখন তুই গীতার কর্মযোগ অধ্যায় পড়ে শোনাবি। তোর মঙ্গল হবে। আমিও শান্তিতে যেতে পারবো। হয়েছিলো তাই। কর্মযোগ পাঠ করা শেষ হতেই দাদুর হাত মাটিতে ধপাস করে পরে গেলো। দাদু ওপাড়ে চলে গেলেন হেলতে দুলতে চারজনের কাঁধে চেপে। মাথাটা দুই বাঁশের ফাঁক গলে বেরিয়ে ঝুলছিলো। আমি বলে উঠলাম, ওগো দাঁড়াও দাদুর লাগবে। মাথাটা ঠিক কর বালিশে দি। কেঁধো বললেন,মরে গেয়েচে। ছেড়ে দে। আমি বললাম, না ঠিক করো। তারপর ঠিক করলো দাদাভাই,দাদুর মাথাটা বালিশে দিয়ে। অনেক বছর অপেক্ষা করেছি,দাদুর কথা শুনবো ওপাড় থেকে। যোগাযোগের উপায় থাকলে নিশ্চয় করতেন। কিন্তু কোনোদিন স্বপ্ন পর্যন্ত দেখিনি। কথা শোনা তো দূর অস্ত। ট্রেন কাটোয়া ঢুকে পরেছে। যে যার নিজের রাস্তা ধরে হাঁটতে লাগলো। আমি বাড়ি এসেই খাওয়া দাওয়া করে বেরিয়ে পরলাম ফাঁকা মাঠে হাওয়া খেতে। বন্ধুরা সবাই বেড়াতে আসে মাঠে। গল্প গুজব করতে করতেই সবাই বাড়ি ফিরলাম। তারপর কিছু ছেলেমেয়ে পড়তে আসে। তারা চলে গেলে সপরিবারে রাতের আহার সারি।
সকাল হলেই বন্ধু আশীষের খোঁজ নিতে গেলাম। ও ফিরে এসেছে ভেলোর থেকে।
খবর ভালো নয়।আশীষ নামের সীমাহীন আনন্দমাখা ছেলেটা ভেলোরে গিয়ে জানতে পারলো,তার হার্ট বড়জোর আর দুবছর চলবে। এত কথা জেনেও কোনোদিন মুষড়ে পরেনি তার মন। ফুটবল খেলতে ভালোবাসতো ছেলেটা। সারা বিকেল ছুটে ছুটে সে আনন্দ মাখতো সারা গায়ে। আলো নামের আলো মনের মেয়েটা জেনেশুনে তার সমস্তকিছু দিয়েছিলো দুদিনের আনন্দের দেবদূতকে। পৃথিবীর রঙ,রূপ, রস সে একশো বছরের পরমায়ুর মতো পেয়ে গিয়েছিলো মনের প্রসারতায়। কেউ তাকে সান্ত্বনা দিতে এলেই কথা ঘুরিয়ে তার চোখে এঁকে দিতো স্বপ্ন।তার সঙ্গে ঘুরতে গেছিলাম মুর্শিদাবাদের রামপাড়া। গঙ্গার ধারে গ্রামটি। ছোটো হলেও আমরা বন্ধুরা প্রত্যেকটি বাড়ি বাড়ি ঘুরেছি। কারো বাড়ি স্নান করা, কারও বাড়িতে খাওয়া দাওয়া।কারওবাড়িতে গান বাজনা করেই দিন চলে যেতো। দুর্গাপুজোর বিসর্জনের দিনে নৌকা করে ঠাকুর বিসর্জন দেখলাম। গঙ্গার ধারের সব গ্রামের ঠাকুর নৌকো করে মাঝ গঙ্গায়এনে বিসর্জন করা হচ্ছে ঢাক,ঢোল বাজিয়ে। দেখতে দেখতে সন্ধ্যা নেমেএলো। সন্ধ্যা নেমে এলো আশীষের জীবনে। রাত হওয়ার আগেই পাড়ি দিলো ভবসাগরের ওপাড়ে। তার সংসারে বাবা,মা, তিন বোন। আশীষের বাবাকে আমি জামাইবাবু বলতাম। তিনি কেলকাতা লালবাজারের কমিশনারের দপ্তরে কাজ করতেন। তার দাপ ছিলো ভীষণ। তার নামে বাঘে গরুতে এক ঘাটে জল খেতো। তিনি ছেলের শোকে মারা গেলেন। দিদি কয়েক মাসের মধ্যেই চলে গেলেন। বড্ড প্রাণপ্রিয় ছিলো তার আশীষ। মেয়েদের বিয়ে হয়ে গেছে। রামপাড়ার বাড়িতে আর কেউ নেই। কতকগুলো ঘুঘু মনখারাপের ডাক ডেকে চলে নিশিদিন। ওই নিরীহ পাখি মানুষকে সত্য, সুন্দরের বাণী শোনায় আজীবন। বড্ড প্রিয় আমার এই ঘুঘু পাখি। ভিটেতে ঘুঘু চড়ে না,সে মনে রাখে এই ভিটের মালিক একদিন আমাকে আশ্রয় দিয়েছিলো,আজও দিয়েছে। তাই কৃতজ্ঞ সুরে তার শোকপ্রকাশ মালিকের অবর্তমানে। আমার তাই মনে হয়। সত্য ঘটনা থেকে শিক্ষা নেওয়ার নাম ধর্ম। জীবন একটা ছোটো নাটক। জলে একমুঠো দেহছাই ছড়িয়ে গেলেই সব শেষ। রবি বলে চলেছে তার আবেগ,তার ভাবনার কথা।কি করে একটা সাজানো বাগান তছনছ হয়ে যায়। বন্ধু রবি বললো,তবু কিছু মানুষের এত অহংকার। তারা মনে করে মৃত্যু বোধহয় তাদের ভুলে গেছে। সে ভোলে না। হঠাৎ চলে আসে। সময় থাকতে বাড়ির কাছের মানুষের সেবা করাই ভালো। পৃথিবী সুন্দর হয়ে উঠবে,পরস্পরের সেবা, ভালোবাসার মাধ্যমে। অন্তর্জলির আগে একবার মানুষকে ভালোবেসে তাদের সুখে দুখে আমাদের হৃদয়কে ভরিয়ে তুলি ভালোবাসায়। আয় আমরা মানুষ হবার শপথ নিই…অংশুমান বুড়ো হয়েছে। সৈকত বিয়ে করে সংসারী হয়েছে। অনুপমও বিয়ে করেছে। আর বিশু ও সৈকতের অনান্য সঙ্গিরা সকলে জীবনের ছবি এঁকে চলেছে নবরূপে নতুন তুলিতে।
রূপাডিহির পশ্চিমপাড়ার বাসিন্দা শুভঙ্কর গাঙ্গুলির বড় কন্যা মনীষার সঙ্গে ভালােবাসা ছিল সােহনের। তাছাড়া মদনমােহন ও শুভঙ্কর দুইজনে বরাবর একই সঙ্গে মেলামেশা করায় তাদের মধ্যে বন্ধুত্বটা প্রগাঢ় হয়ে ওঠে। তারই পরিণতি এই বিবাহে, এই বন্ধনে। কিন্তু আশ্চর্য যে এই গােপন পরামর্শ সােহন এবং মনীষা কিন্তু ঘুণাক্ষরে জানতাে না। যখন মনীষা এগারাে বৎসরের তখন শুভঙ্করবাবু একবার কন্যাকে নিয়ে সােহনদের বাড়িতে আসেন মদনমােহনের সঙ্গে দেখা করার জন্যে। ষােল বৎসরের সােহন তখন। পড়াশােনায় ব্যস্ত। হঠাৎ সুন্দরী কিশােরী মনীষার দিকে নজর যাওয়াতে সেই চোখ আর ফিরতে পারেনি। ক্রমে সেই ভালােলাগা ভালােবাসায় পরিণত হয়। তারপর কত রাগ অনুরাগ, কথার পথ পেরিয়ে আজ সেই শুভদিন। উলুধ্বনি, শঙ্খধ্বনির মাঝে সকল চিৎকার চেঁচামেচির মধ্যে থেকেও সােহনের মা, বাবা কিন্তু ঈশ্বরের প্রার্থনায় মগ্ন! তারা চিন্তা করছিলেন কি করে বাধা বিপত্তি অতিক্রম করে তারা আজ কিছুটা সুখের মুখ দেখতে পাচ্ছেন। চিন্তা করছেন এইবার বৌমার হাতে সংসারের ভার অর্পণ করে সুখী হবেন মদনমােহন বলছিলেন সবিতাদেবীকে মনে পড়ে তােমার, একবার সােহন পুকুরে ডুবে গিয়েও বেঁচে গিয়েছিল। সবিতা দেবী বাধা দিয়ে বলে ওঠেন, ওঃ তুমি সেই দুঃখের রাত্রির কথা আর বােলােনা, ওকথা শুনলে আমার কেমন ভয় করে। আজ শুভদিনে শুধু ঈশ্বরের কাছে সােহন আর বৌমার শুভ প্রার্থনা করি। ইত্যবসরে অরিন্দম। আজ কি আনন্দ আকাশে বাতাসে গানটি আবৃত্তি করতে করতে এসে বলল মা শুধু দাদা আর বৌমা ভালাে থাকবে আর আমরা -সবিতা দেবী। কথার মাঝেই বলে উঠলেন, ওরে গাছের গোড়ায় জল দিলে কি আর কেউ গাছের ডগায় জল দেয়। তারা তাে একই বৃক্ষের শাখা প্রশাখা। অরিন্দম মায়ের কথায় প্রীত হয়ে কাজের কথায় ফিরে এসে বাবাকে বললাে, বাবা আমাদের কাজ মােটামুটি শেষ। এখন তােমরা দুজনে কিছু খেয়ে নিলেই ব্যাস ফিনিস।রাত পোহালো। কেকিল ডাকলো। শােভন আজ সকালে রাস্তা দিয়ে যেতে যেতে কার কত বয়স হলাে তারই হিসাব করছিলাে। চিন্তা করে দেখল তার বাবা ষাটে পা দিয়েছেন। মা একান্ন। আর বড়দি অনীতা বত্রিশ, তার বিয়ে হয়েছে আজ বছর দশেক হলাে। বড়দা ত্রিশ, বৌদি বাইশ, অরিন্দমদা চব্বিশ আর ছােটবােন দেবীকা সতের। শােভনের নিজের বয়স কুড়ি বৎসর দুই মাস। ভাবছে বয়স তাে ভালােই হল।এবার সাবধানে চলতে হবে।
সুন্দর চরিত্রের দাদা বৌদি আর দেব-দেবী পিতা মাতাকে ছেড়ে কোথাও পালিয়ে যেতে ইচ্ছাও করে না শােভনের। শােভন যাচ্ছিল সােনা-দিঘি গ্রাম, তাদের গ্রামের পাশেই গ্রাম। এক মাইল দূরত্ব। সেখানে থাকে তার এক অন্তরঙ্গ কাকু অশােক। অশােকের মা বাবা সবাই আছে আর আছে এক বােন নাম অপর্ণা। সুন্দরী, তন্বী মেয়ে। অতি ভদ্র, লেখাপড়ার দিক থেকে খুবই ভালাে। অশােক বেশিরভাগ সময়ে শােভনের কাছে আসে, কিন্তু মাঝে মধ্যে তাে বন্ধুর বাড়ী যেতে হয় এই বলে শােভন তাদের বাড়ী যায়। শােভনের যাবার আরও একটি কারণ ছিল। তার হল অশােকের বাবার আন্তরিকতার আকর্ষণ। পদ্মপুকুরের পাড় ঘুরতেই একটা মিষ্টি কণ্ঠের আওয়াজ শােভনের এলাে। এই শােভনদা, যাচ্ছেন কোথায় আরে আরে এইদিকে তাকান, শােভন ঘুরে দেখে অপর্ণা সঙ্গে আর একটি মেয়ে। শােভন তাকে চেনে না। শােভনের অত পর্যবেক্ষণ করারও কোন প্রয়ােজন ছিল না বলে অপর্ণাকে বলল, “তােমাদের বাড়িতেই যাচ্ছিলাম, অশােক ধরে আনল। “হ্যাঁ” ছােট্ট একটি উত্তর দিয়েই অপর্ণা বান্ধবীর সাথে কথা বলতে শুরু করল। শােভনও আপন পথে পা বাড়ালাে। দেবীকার সঙ্গে অপর্ণার হয়তাে কোন পরিচয় নেই। একদিন পরিচয় করিয়ে দিতে হবে চিন্তা করে শােভন একটি গান ধরলাে। অশােকের নাম ধরে ডাকতেই সে বেরিয়ে এলাে একটি কলম হাতে। দীর্ঘকায়, সুঠাম সবল একুশ বৎসরের এক যুবক অশােক। মুখে চাপ দাড়ি আর সুন্দর তার মুখের গড়ন। সম্পাদক হয়ে ঝামেলার অন্ত নেই মাইরি। এইমাত্র একটা রবীন্দ্রনাথের ছবি আঁকা শুরু করেছি, আর কে কি আবৃত্তি করবে, কে গান করবে এইসব ঠিক করে নিই।প্রোগ্রাম তৈরী করছিলাম আর কি। অশোকের বাবা মৃন্ময় মুখোপাধ্যায় মহাশয়কে ধারে ধীরে তাদের দিকে আসতে দেখে দুই বন্ধু চুপ করে গেল। মৃন্ময় বাবু বলে উঠলেন, কি শোভন কেমন আছে? পড়াশুনা কেমন চলছে?শােভন তাড়াতাড়ি উঠে মৃণ্ময়বাবুকে প্রণাম করে বললাে, চলে যাচ্ছে কাকাবাবু একরকম। আর এবার তাে আমার সেকেণ্ড ইয়ার হল।
-হ্যাঁ তুমি আর অশােক তবে দুজনেই বি.এ. সেকেণ্ড ইয়ারে পড়াে। তবে কি জানাে পাশ কোর্সে পড়ে। এখন আর কোন কাজ হচ্ছে না শোভন। শােভন মৃম্ময়বাবুর কথায় সম্মতি জানিয়ে অন্য প্রসঙ্গ টানলাে। বললাে, কাকাবাবু এখন অপর্ণার শরীর কেমন? মৃন্ময় বাবু বললেন, তােমার বাবার থেকে আমি আট বছরের ছােট। তাও দেখ আমার শরীরের অবস্থা। এজমা রোগী। এখনই ভালাে, তখনই মন্দ। যাহােক তােমর তাহলে গল্প করাে আমি একটু ঘুরে আসি। আর, তুমি এখন আমাদের এখানে বড় একটা আসাে না তাে? আসবে, আসবে তােমার সাথে কথা বলে শান্তি হয়। এইকটু কথা বলতে বলতে তিনি বেরিয়ে গেলেন।
– তারপর তুই কি করছিস বল? বলে অশােক ভালাে করে বসলো। অশােক ভালাে করে বসলাে। কিন্তু শােভন বলে, চল রাস্তায় খেতে খেতে বলা যাবে, পাঁচটা বাজে। অগত্যা শোভনের কথায় রাজি হল। শোভন বলল, যাবার সময় কাকীমার সাথে পরিচয় করিয়ে দেবো। আর আপনাকে বললাম তোমাকে একদিন আমার বোনের সাথে পরিচয় করিয়ে দেব। অনিল আজ অপর্ণাকে বললাে, আরে মশাই দেবীকা হচ্ছে আমার প্রিয় বান্ধবী। অরিন্দম দুপুরটা অভিনয় আর আবৃত্তির চর্চা করে কাটিয়ে দিলাে। চারটি ঘরের মধ্যে, একটি ঘর নিজের মতাে করে সাজিয়ে নিয়েছে এবং তা ব্যবহার করে। শুধুমাত্র কিছু সময় দিয়ে সে শুধু নিজের সাধনা চালিয়ে যায়। যতরকম অভিনয় সংক্রান্ত উপদেশমূলক বই আছে তার কোনটাই তার বাদ যায়নি। আবার মাঝে মধ্যে সে গােপালবাবুর কাছে.যায়। গােপালবাবু একজন সুদক্ষ অভিনেতা ও বিশেষজ্ঞ । তার কাছে গিয়েও অনেক উপকার হয় অরিন্দমের। কিন্তু মন তার বােঝে না। শুধুমাত্র অভিনয় শিখে একটা মানুষ তার সব আশা পূর্ণ করতে পারে। গােপালবাবু বলেন, অভিনয় সর্বপ্রথমে জ্ঞান দেয়, সম্মান দেয় আর তার সঙ্গে দেয় অর্থ। সেই অর্থই এখন প্রয়ােজন অরিন্দমের। দ্বাদশ শ্রেণি অবধি পড়ে আর পড়াশুনা হয়নি অরিন্দমের। কিন্তু অরিন্দম বুদ্ধিমান, বিচক্ষণ এবং শান্ত প্রকৃতির। গোপালবাবু বলেন, অরিন্দম অভিনয় কখনও অভিনয় বলে নিও না। চরিত্রের মধ্যে প্রবেশ করার চেষ্টা করাে, তারপর তােমার ভাব প্রকাশ করাে। | এইসব চিন্তা করতে করতে অরিন্দম প্রায় তন্দ্রাচ্ছন্ন হয়ে পড়েছিলাে আর ঠিক সেই মুহুর্তে বৌদি মনীষা এসে বললাে, ঠাকুরপাে এখনও তােমার অভিনয় সাঙ্গ হলাে না। এবার ওঠো জাগাে চেয়ে দেখাে, সম্মুখে রয়েছে এক পেয়ালা চা আর — ‘মাের মাতৃসমা স্নেহশীলা বৌদি।। বাব্বা! তুমি এতও পারাে বলে বৌদি কাজে চলে গেলেন। বিকালে এক কাপ চা। পেলে যেন অরিন্দম হাতে স্বর্গ পায়। কিন্তু আবার ভাবে এক কাপ চায়েরও দাম চল্লিশ পয়সা। অরিন্দম ভাবলাে চাকরী তাকে একটা জোগাড় করতেই হবে। আরে কি চিন্তা করছিস। চল। চল একটু ঘুরে আসা যাক, সুব্রত বললাে।
গোপালবাবু বলেন, রাতের পর রাত জেগে বাংলার সাধারণ মানুষ কৃষক, তাঁতী, কামার ,কুমার, জেলে দেখেছে যাত্রায় কাহিনি আর মেতেছে পালা গানের সুরে। কখনো ভক্তি, কখনো ভালোবাসা, কখনো দেশপ্রেম তাকে কাঁদিয়েছে, হাসিয়েছে। আবার সামন্ত রাজা, জমিদার ও অভিজাত শ্রেণির মানুষও যাত্রা দেখেছে। জমিদারবাবু তো আর সাধারণ প্রজার সঙ্গে যাত্রার আসরে গিয়ে বসবেন না। বরং তার প্রাসাদের নাটমণ্ডপেই বসবে যাত্রার আসর। জমিদারবাড়িতে থাকতো বিশাল নাটমণ্ডপ। সেখানেই যাত্রা, পালাগান, কীর্তনের আসর বসতো। চিক বা পর্দাঘেরা বারান্দায় বসতেন জমিদার গৃহিনী, রানীমা, পরিবারের নারী সদস্যরা। তারা চিকের আড়াল থেকেই দেখতেন যাত্রা পালা।যাত্রাপালার ঐতিহ্য অত্যন্ত প্রাচীন। অষ্টম ও নবম শতকেও এদেশে পালাগান ও পালার অভিনয় প্রচলিত ছিল। শ্রী চৈতন্যদেবের আবির্ভাবের আগেও রাঢ়, বঙ্গ, সমতট, গৌড়, পুণ্ড্র, চন্দ্রদ্বীপ, হরিকেল, শ্রীহট্টসহ সমগ্র ভূখণ্ডে পালাগান ও কাহিনিকাব্যের অভিনয় প্রচলিত ছিল। ধর্মীয় বা কোনো উৎসবে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় যাওয়ার যে রীতি সেখান থেকেই যাত্রা শব্দটি এসেছে। এদেশে শিবের গাজন, রামযাত্রা,কেষ্টযাত্রা, সীতার বারোমাসী, রাধার বারোমাসী প্রচলিত ছিল। সেসময় বিভিন্ন পৌরাণিক কাহিনি অভিনয় করে দেখানো হতো। সেখান থেকেই যাত্রার উৎপত্তি। নবদ্বীপে শ্রীচৈতন্যের আবির্ভাবের পর কৃষ্ণযাত্রা ব্যাপক জনপ্রিয়তা পায়। কৃষ্ণযাত্রায় মূলত রাধাকৃষ্ণের প্রেমলীলা, কৃষ্ণের বাল্যকাল, মা যশোদার সঙ্গে কৃষ্ণর বাল্যক্রীড়া, কৃষ্ণের কংসবধ, মথুরা জয় ইত্যাদি কাহিনি অভিনয় ও গানের মাধ্যমে দর্শকদের পরিবেশন করা হতো। দর্শকরা তা দেখে ভক্তিরসে সিক্ত হতেন। রুক্মিণী হরণ নামে একটি কৃষ্ণযাত্রায় চৈতন্যদেব নিজেই অভিনয় করতেন। তিনি রুক্মিণী সাজতেন।জামাটা গায়ে দিয়ে জুতাে পরে বেরিয়ে পড়লাে বন্ধু সুব্রতর সঙ্গে। সুব্রত অরিন্দমের বন্ধু। সুব্রত ব্যানার্জী। সেও অভিনয় করে অরিন্দমের সঙ্গে। অভিনয়কে ভালােবাসে। কিন্তু তার ঘরের অবস্থা অরিন্দমের থেকে ভালাে। ফলে সে অভিনয়টাকে পেশা হিসেবে নিতে চায় না। নদীর ধারে বসে বসে দুই বন্ধুতে অনেক গল্পই করলাে। তারা আবৃত্তি নিয়ে আলােচনা করল। অরিন্দম আবৃত্তি করে শােনাল সুকান্তের ঐতিহাসিক। “আজ এসাে তােমাদের ঘরে ঘরে পৃথিবীর আদালতের পারায়ানা নিয়ে।” তার সাথে পরিচয় করিয়ে দেবো। আর আপনাকে বললাম তোমাকে একদিন আমার বোনের সাথে পরিচয় কলি, সী। অনিন আজ গাল অপ্ণা বললাে, আরে মশাই দেবীকা হচ্ছে আমার প্রিয় বান্ধবী। অরিন্দন দুপুরটা অভিনয় আর আবৃত্তির চর্চা করে কাটিয়ে দিলাে। চারটি ঘরের মলো। একটি ঘর নিজের মতাে করে সাজিয়ে নি@েই তা ব্যবহার করে। শুধুমাত্র কিছe দিয়ে সে শুধু নিজের সাধনা চালিয়ে যায় যতরকম অভিনয় সংক্রান্ত উপদেশমূলক আছে তার কোনটাই তার বাদ যায়নি। আবার মাঝে মধ্যে সে গােপালবাবুর কাছে যায়। গােপালবাবু একজন সুদক্ষ অভিনেতা। তার কাছে গিয়েও অনেক উপকার অরিন্দমের। কিন্তু মন তার বােঝে না শুধুমাত্র অভিনয় শিখে একটা মানুষ তার সব আশা পূর্ণ করতে পারে। গােপালবাবু বলেন, অভিনয় সর্বপ্রথমে জ্ঞান দেয়, সম্মান দেয় আর তার সঙ্গে দেয় অর্থ। সেই অর্থই এখন প্রয়ােজন অরিন্দমের। দ্বাদশ শ্রেণি অবধি পড়ে আর পড়াশুনা হয়নি অরিন্দমের কিন্তু অরিন্দম বুদ্ধিমান, বিচক্ষণ এবং শান্ত প্রকৃতির। গোপালবাবু বলেন, অরিন্দম অভিনয় কখনও অভিনয় বলে নিও না। চরিত্রের মধ্যে প্রবেশ করার চেষ্টা করাে, তারপর তােমার ভাব প্রকাশ করাে। | এইসব চিন্তা করতে করতে অরিন্দম প্রায় তন্দ্রাচ্ছন্ন হয়ে পড়েছিলাে আর ঠিক সেই মুহুর্তে বৌদি মনীষা এসে বললাে, ঠাকুরপাে এখনও তােমার অভিনয় সাঙ্গ হলাে না। এবার ওঠো জাগাে চেয়ে দেখাে, সম্মুখে রয়েছে এক পেয়ালা চা আর — ‘মাের মাতৃসমা স্নেহশীলা বৌদি।। বাব্বা! তুমি এতও পারাে বলে বৌদি কাজে চলে গেলেন। বিকালে এক কাপ চা। পেলে যেন অরিন্দম হাতে স্বর্গ পায়। কিন্তু আবার ভাবে এক কাপ চায়েরও দাম চল্লিশ। পয়সা। অরিন্দম ভাবলাে চাকরী তাকে একটা জোগাড় করতেই হবে। আরে কি চিন্তা করছিস। চল একটু ঘুরে আসা যাক্। বন্ধু সুব্রত বললাে।কাছে গেছে ভোরে উঠে।অরিন্দম ভাবে চাকরি না হলে যাত্রাদল সে করবেই।আজ অরিন্দম বাড়িতে মা বাবাকে বলে গোপাল বাবুর গােপালবাবুকে আজ আশেপাশের পাঁচ ছয়টি গ্রাম থেকে একজন করে বা দুজন করে। নিয়ে আর নিজের গ্রাম থেকে আটজন অভিনেতাকে নিয়ে একটি বই মঞ্চস্থ করার। মনস্থ করলেন। তার জন্য তো মহড়ার প্রয়োজন। সেই মহড়ার শুরু আজ থেকে। গোপালবাবুর সেই পুরানো দিনের বাড়ি। বাড়ি বললে ভুল হবে। যেন এক বিরাট প্রাসাদ। সেই প্রাসাদের সম্মুখে প্রাচীর দিয়ে ঘেরা। হয়ত এটা পূর্বের জমিদার বাড়ির সভাকক্ষ ছিল । গােপালবাবু একজন শিল্পী।তিনি সেই স্থানটিতেই মহড়ার বন্দোবস্ত করলেন। অেক জমায়েত ধনী ব্যক্তির। মহড়া দেবার স্থান নির্বাচিত হল সেই স্থানটিতেই হয়েছিল। যাদের ডাকা হয়েছিল তারা সকলের সম্মতিক্রমে ঠিক হলাে মহড়া দেবার কথাটি। প্রথমে নির্বাচন হল কোন বইটা মঞ্চস্থ করা যাবে। সর্বসম্মতিক্রমে ভবেশ ভট্টাচার্যের ‘দিন দিন প্রতিদিন’ সামাজিক পালাটি ঠিক হলো । মোটামুটি সকলেই জানে, অভয়পুরের সুদর্শন সান্যালের নাম অভিনয় জগতে মােটামুটি সকলে অভিনয় দেখে। তারা গােপালবাবু আর সুদর্শনকেই চেনে বেশি। তাছাড়া মহড়ায় সুদর্শনের সন্তোষজনক অভিনয় দেখে, গােপাল বাবু নায়কের ভূমিকায় অভিনয় করতে বলেছিলেন। গােপালবাবু নিজেও একটি চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন। বাইরের শহর থেকে এসেছিলেন চারজন অভিনেত্রী। অরিন্দম একজন বেকার ছেলের চরিত্রে ছিল। যাত্রাগান অনুষ্ঠিত হওয়ার রাত্রিতে একটু তাড়াতাড়ি বেরিয়ে ছিল অরিন্দম। তার সকল রকম দরকারী জিনিসপত্র নিয়ে। উপস্থিত হলাে একদম গ্রীণ রুমে। গিয়ে দেখে গােপালবাবু ও শহরের অভিনেত্রীরা এবং সাজঘরের লােকেরা প্রত্যেকেই সময়মতাে উপস্থিত হয়েছেন। ধীরে ধীরে সকলেই এলাে। তারপর শুরু হলাে ‘মেক আপ। এদিকে দেবীকা বায়না ধরেছে শােভনের সঙ্গে সেও যাত্রা দেখতে যাবে। শােভন আমি এসে গেছি বলে প্রবেশ করলাে অশােক। শােভন জিজ্ঞাসা করলাে কি রেঅপর্ণাকে নিয়ে এলি না কেন?ওরা তিনজনে দেবীকা, শােভন আর অপর্ণা বেেিরয় পড়লাে যাত্রা দেখার জন্য। যাত্রাটি হচ্ছে গােপালবাবুর বাড়ির একটু দূরে যে জায়গাটি পড়ে আছে সেখানেই।
😍😍😍😍😍
অভিনয় সকলেরই ভালাে হয়েছে। প্রত্যেক গ্রামের অভিজ্ঞ লােকেরা সকলের। অভিনয়ের প্রশংসায় মুখর। কিন্তু সকলের উর্ধ্বে যেন অরিন্দম। অরিন্দম একা,ছেলের চরিত্রে যা অভিনয় করে গেল তা সত্যি সকলের মনে দাগ রেখে গেল। পরের দিন সকালে অরিন্দম দেখে তরুণ যুবকেরা তাকে গুরু বলছে। তপন বলল, গুরু পায়ের ধুলো দাও। অরিন্দম বাড়িতে মা বাবাকে বলে গোপাল বাবুর বাড়ি গেল। গােপালবাবু আজ আশেপাশের পাঁচ ছয়টি গ্রাম থেকে একজন করে বা দুজন করে নিয়ে, আর নিজের গ্রাম থেকে আটজন অভিনেতাকে নিয়ে একটি বই মঞ্চস্থ করার মনস্থ করলেন। তার জন্য তো মহড়ার প্রয়োজন। সেই মহড়ার কাজ শুরু আজ থেকে। গোপালবাবুর সেই পুরানো দিনের বাড়ি। বাড়ি বললে ভুল হবে। যেন এক বিরাট প্রাসাদ। সেই প্রাসাদের সম্মুখে প্রাচীর দিয়ে ঘেরা। হয়ত এটা পূর্বের জমিদার বাড়ির সভাকক্ষ ছিল । গােপালবাবু একজন সেই স্থানটিতেই। সেখানে জমায়েত ধনী ব্যক্তি। মহড়া দেবার স্থান নির্বাচিত হল। সেই স্থানটিতেই ডাকা হয়েছিল। যাদের ডাকা হয়েছিল তারা এলেন। অরিন্দদমের মনে কিন্তু একটা কথাই ঘুরপাক খাচ্ছে। গতকল রাত্রিতে অভিনয় করার সময় সে শুধু একটি দিকেই মনপ্রাণ রেখেছিল। সেখানে বসেছিলাে এক সুন্দরী তরুণী। অরিন্দম লক্ষ্য করেছিল তার সেই দুটি চোখ যেন কি অপরিসীম ব্যথায় জর্জরিত। যাত্রার শেষে অরিন্দম লক্ষ্য করেছিল সেই তরুণী শেষে গোপালবাবুর সঙ্গেই ঘরে ফিরেছিল। অরিন্দম আজ যেন তার সন্ধানে ব্যাকুল। সেইজনা সে চা খেয়েই বৌদিকে বলে ঘর থেকে বেরিয়েছে। বৌদি বলেছেন, দেখ ঠাকুরপাে, তোমাকে প্রকৃতিস্থ মনে হচ্ছে না। অরিন্দম ভাবে মেয়েদের চরিত্র কি বিচিত্র। পুরুষদের মনের কথা। তারা যেন দেশের চিত্রের মতো দেখতে পায়। | লেবু বাইরে দাড়িয়ে কিছু লােকের সাথে কথা বলছিলেন। প্রসঙ্গ সেই যাত্রাগান। গোপালবাবু অরিন্দমকে দেখে বললেন, আমার, তোমার সঙ্গে একটা দরকারী কথা আছে। তুমি একটু ঘরে বসো। অরিন্দম ঘরে বসে আর ভাবে কোথায় সেই তরুণীটি। এখানে তাে থাকে না। তাহলে থাকে কোথায়? অরিন্দমের হঠাৎ চোখে পড়ল ঘরটি বেশ সুন্দর ভাবে গােছানাে। সামনেই একটি রাধাকৃষ্ণের ফটো। তার পাশে মা কালি। দু চারটি মহাপুরুষদের বড় বড় বাঁধানাে চিত্র। মনে হল এটা গােপালবাবুর শােবার ঘর। খাটের পাশে টেবিলের উপর কতকগুলি মােটা আর একটি বাঁধানাে ফটো। ফটোটা হাতে নিয়ে অরিন্দম দেখলাে এই তো সেই তরুণীটি। শোভনের কলেজে আজ বাৎসরিক অনুষ্ঠানের প্রথম দিন। আজ মমতা শংকরের নাচের প্রোগ্রাম। বাড়তি একটা কার্ড শােভন সংগ্রহ করেছিলাে, বন্ধু বান্ধবদের বলে। বলা যায় না কেউ তাে বায়না ধরতে পারে এই ভেবে। এই কলেজে পড়ে শােভন, অশোক আর অপর্ণা।আগেই বলেছি শােভন অশােক সেকেন্ড ইয়ার বি.এ. আর অপর্ণা ক্লাস টুয়েলভ এ | অপর্ণাও দুটি কার্ড জোগাড় করেছে। সে মনস্থ করেছে তার বান্ধবী বীথিকাকে সঙ্গে নেবে।। বীথিকরা সােনাদিঘিতে থাকতাে না। যদিও তার জন্মস্থান এই গ্রাম | তারা থাকতাে লিলুয়ায়। আর গ্রামে থাকতেন তার কাকা। কাকা মারা যাওয়ার পর বীথিকার বাবা চাকরী ছেড়ে দিয়ে এই গ্রামেই এসেছেন। বর্তমানে বীথিকা তার বাবা আর আর মা এখানে থাকেন আর বড় দাদা ব্যাঙ্কে চাকরী করেন। বীথিকার বাবা অরুণ মুখার্জী আর মা রেবা দেবী। কলেজে গেছে শােভন, অশােক আর দেবীকা। অন্যদিকে অপর্ণা আর বীথিকা। অপর্ণা দেবীকাকে দেখেই বলে উঠলাে, আরে দেবী তােমার সাথে অনেকদিন দেখা হয়নি, এসাে এসাে এইদিকে বসি। শােভন আর অশােকের সুবিধাই হল।
😍😍😍😍😍😍😍😍
শােভন অশােককে নিরালায় পেয়ে বীথিকার কথা জিজ্ঞাসা করলাে। শােভন একদিন সােনাদিঘী আসবার সময় অপর্ণার সঙ্গে একটি মেয়েকে দেখেছিল। সেই মেয়েটির সাথে এই মেয়েটির অনেক সাদৃশ্য আছে। তাই কৌতুহল বশে শােভন বললাে, অশােক অপর্ণার সাথে এই মেয়েটি কে? অশােক বীথিকার সমস্ত পরিচয় শােভনকে বললাে। অনুষ্ঠান শুরু হয়ে গিয়েছে। সকলেই নৃত্যানুষ্ঠান দেখতে ব্যস্ত। কিন্তু শােভন বীথিকাকে প্রায় সর্বক্ষণই নিরীক্ষণ করল। অনুষ্ঠান শেষে বাসের সীটে একদিকে বীথিকা ও শােভন বসল । অন্যদিকে অশােক, দেবীকা ও অপর্ণা বসেছিলাে। শােভন বীথিকার সাথে কথা বলার অনেক চেষ্টা করেও বলতে পারলাে না। বীথিকা অপর্ণার সঙ্গ হারাবার ফলে খুবই বিব্রত বােধ করল। কিন্তু শােভনের মতাে এতাে লাজুক ছেলে সে আর কখনও দেখেনি। কি সুন্দর তার চোখ, উন্নত ললাট। বীথিকা শােভনের দিকে তাকিয়ে চোখ ফেরাতে পারলাে না। শােভনের সাথে চোখাচোখি হতেই লজ্জায় সে মুখ নীচু করল। কিছুক্ষণ পরেই রূপাডিহি এল। শােভন, দেবীকা নেমে পড়ল। দেবীকা, অপর্ণা ও অশােককে বিদায় জানালাে কিন্তু শােভন যেন সব ভদ্রতাই ভুলে গেল।শােভনদের বাড়ী দীর্ঘদিন আসা যাওয়ার ফলে অশােক ও শােভনের বােন দেবীকার সঙ্গে একটা প্রেমের সম্পর্ক গড়ে উঠেছিলাে যে সংবাদটি উভয়পক্ষের পিতামাতারা তথা গ্রামের লােক সকলেই উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন।গতকাল রাত্রিতে বাড়িতে ফিরে এসে বীথিকার মন অজানা এক আনন্দে ভরে উঠলাে।সেই রাত্রিতে সে রবীন্দ্র সংগীতের সুর গাইতে লাগলাে। “তোমার হল শুরু, আমার হল সারা “। বড় দাদা ঠাট্টা করে বললেন, কি রে আজ তাের কলেজ ফাংশান দেখে শিল্পী হবার সখ হল নাকি।
– হ্যাঁ বড়দা। সেইরকমই মনে হচ্ছে।
সকালে শয্যাত্যাগ করে কাজকর্ম কিছু করে প্রথমেই বীথিকা দেবীকার বাড়িতে গেল। এত সকালে বীথিকাকে দেখে দেবীকা অবাক। বললাে, কি এত সকালে কি ব্যাপার? বীথিকা গতকাল রাত্রির সকল কথা বলে এবং শােভনের প্রতি তার আসক্তির কথা দেবীকাকে জানাল।। দেবীকা প্রত্যুত্তরে বললাে, ধীরে বন্ধু ধীরে। বীথিকা বাড়ীতে ফিরে এসে বিছানায় দুপুরে শুয়ে এক সুন্দর স্বপ্ন দেখলাে। দেখলাে শােভন তার সামনে দাঁড়িয়ে। শােভনের লাজুক লাজুক চোখ আর সুন্দর অবয়ব সে সামনে দেখতে পেল। কল্পনা করলাে মনে মনে সুন্দর এক জীবনের। সে একদিন তাকে নিজের করে নিয়ে, তার ঘরে, তার মনে আশ্রয় দেবে। তার সবরকম সুখ স্বপ্ন সত্যি হয়। বীথিকা সেনকে নিয়ে যে স্বপ্ন সে রচনা করছে তাও হয়ত শত হবে। যদি তা পবিত্র হয় যদি সেটা খাঁটি হয়। অনেকে কি পেতে চায়। চাইলেই হয়ত পায় না। কিন্তু কিছু মানুষ তাে পায়। শােভনের প্রতি যে এখন, যে ভালোবাসা বীথিকার মনে জমে উঠেছে তা যদি একটু একটু করে শােভনের মনে জাগে তারপর কি তার স্বপ্ন সফল হবে না। একটু আশা, একটু বাঁচার ইচ্ছা এই আশাতে সংসার। সেই আশা বুকে রেখে বীথিকা শােভন সিদ্ধান্ত গ্রহণ করল জীবনজয়ের। গােপালবাবু যাত্রাদল গঠন করে গ্রামে এমনকি অনেক শহরে পর্যন্ত অভিনয় করে বেড়ান। তার দলের নাম এই অঞ্চলে সকলেরই পরিচিত। অভিনয় গােপালবাবুর পেশা ছিল না, নেশা ছিল। কিন্তু দলে অনেক বেকার ছেলে তথা দরিদ্র ঘরের ছেলে ছিল। তাই গােপালবাবু যাত্রাদলটিকে সুসংবদ্ধভাবে গড়ে তােলার জন্য একটি পেশাদার দল গঠন করতে চাইলেন। দলের প্রত্যেক সদস্য গােপালবাবুর এই সিদ্ধান্তে খুশী না হয়ে পারলেন না। বিশেষ করে অরিন্দমের মতাে বেকার ছেলেদের তাে কথাই নেই। গ্রামের নামের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে যাত্রাদলের নাম রাখা হলাে, রূপা অপেরা। গােপালবাবু নিজের গ্রামে তার অর্থ দিয়ে একটি যাত্রাদল গঠন করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলেন। দলের প্রত্যেককে অর্থ নেবার জন্য আপত্তি করলেন। কিন্তু গােপালবাবু বললেন, এটা পেশাদারী দল, তাই অর্থ নেবার মানসিকতা প্রথম থেকেই শুরু হওয়া উচিত। যাত্রার দিন প্রথম থেকেই পরিচ্ছন্নভাবে পেশাদারী দলের মতাে সবকিছুর ব্যবস্থা করা হলাে। সকলেই ব্যস্ত, যেন এক মহাযজ্ঞ এক্ষণি শুরু হবে। গােপালবাবুর প্রধান শিষ্য অরিন্দম রায়, তাই অরিন্দম অভিনয় শুরু করার পূর্বে গােপালবাবুর চরণধূলি গ্রহণ করে। গােপালবাবু সবকিছু জ্ঞান অরিন্দমকে উজাড় করে ঢেলে দিতে চান। তিনি অরিন্দকে গড়তে চান মনের মতাে এক অভিনেতা হিসাবে। ভালাে অভিনয় করার মানসিকতা, যােগ্যতা অরিন্দমের সত্যিই আছে।। | গােপালবাবুর মতাে একজন দূরদর্শী মানুষের অনুমান কখনাে ভুল হতে পারে না। তাই পরের দিন সকলের মুখে মুখে এক নাম, এক ভাষা। অরিন্দমের সত্যি এমন মন ভােলানাে পাঠ জীবনে ভুলতে পারবাে না। অরিন্দম আপন মনে চলেছিলাে একটা কথা চিন্তা করতে করতে, যে ফটোটি অরিন্দম সেদিন দেখেছিলো তার কথা।
অরিন্দমের কাছে এল। চিন্তা করলো কে তাকে অভিনীত চরিত্রের নাম ধরে ডাকলো। পিছন ফিরে দেখ সেই মেয়েটি যাকে সে একবার যাত্রা করতে করতে দেখেছিলাে, আরে স্যার আপনার ছবি দেখেছিলাম । আপনার ব্যথা’ কথাটি বলেই চুপ করে গেল মেয়েটি।অরিন্দম বলল – কিসের ব্যথা ছিল।কেন কাল রাত্রির কথা ভুলে গেলেন নাকি?
– আরে ওটা অভিনয় ছাড়া আর কিছু নয়। মেয়েটি ধন্যবাদ বলে চলে যাচ্ছিলাে। অরিন্দম ডাকল।
-শুনুন একটা কথা বলুন মেয়েটি বলল। আপনাকে তাে চিনতে পারলাম না।
-আমি আপনার গুরুদেবের একমাত্র কন্যা। বাইরে ছিলাম। সাত দিন হল এসেছি। কথা বলেই মেয়েটি একপ্রকার দৌড়েই চলে গেল।গােপালবাবুর মেয়ে আছে অরিন্দম জানতাে না তাই কৌতুহলবশত অতি গােপালবাবুর বাড়ি গেল। গােপালবাবুর বাড়িতে এতদিন অরিন্দম যাওয়া আসা করছে কিন্তু গােপালবাবুর সাংসারিক খবর সে কিছুই রাখতাে না। উচিতও নয় ভেতরে যাওয়ার। গােপালবাবুও তাকে কিছু বলার প্রয়ােজনবােধ করেন নি। অরিন্দম তার কাছে খুবই ঋণী কিন্তু তার সবরকম খবর না জানাতে সে লজ্জিত হল।
😍😍😍😍😍
গােপালবাবু অরিকে দেখে তাকে আশীর্বাদ করলেন। বড় স্নেহের পাত্র অরিন্দম গােপালবাবুর কাছে। তিনি আদর করে অরি বলেন। একসময় সুযােগ বুঝে অরিন্দম অন্য প্রসঙ্গ টানলাে। বললাে, মাস্টারমশাই আপনার পরিবারে সদস্য কতজন?
-ওহাে তােমাকে বলাই হয়নি। আমার একটি মাত্র কন্যা আছে তার নাম…
– অপরূপা সেনগুপ্ত, বলে ঘরে প্রবেশ করলাে গােপালবাবুর কন্যা। ‘
-তুই কখন এলি মা?’ এত সকালে কোথায় গেছিলি?
-বাবা আমি আর মাসীমা যাত্রা দেখতে এসেছিলাম মাসীমা চলে গেলেন, কিছুতেই এলেন না, বললেন কাজ আছে।
-আমি চা করে আনছি বাবা বলে অপরূপা ভিতরে চলে গেল।
অরিন্দম কথাবার্তার মাথামুণ্ডু বুঝতে না পেরে চুপ করে রইল। গােপালাবু বললেন, জানাে অরি অপরূপা খুব ছােট থাকতে, ওর মা মারা যায়, তারপর থেকে মাসীর কাছেই মানুষ। যা কিছু খরচ লাগে সবই আমি পাঠিয়ে দিই। যাতে আমার মেয়ে সুখে থাকে।।চা পান করতে করতে গােপালবাবু কন্যাকে অরিন্দমের পরিচয় দিন। তার পর সে অরিন্দমের সঙ্গে অপরূপার পরিচয় হয়েছে তা ঘুণাক্ষরেও জানতে পারলেন না গােপলাবাবু।অপরূপাকে সত্যিই অপরূপ লেগেছে অরিন্দমের। এত ফ্রাঙ্ক, মেয়ে খুব কমই দেখা যায়। তার আন্তরিকতা অরিন্দমের হৃদয় প্রেমে সিক্ত করে তুলল। গােপালবাবুর বাড়ি থেকে বিদায় নিয়ে অরিন্দম গতরাত্রের উপার্জন করা টাকায় কিছু জিনিসপত্র কিনলো।ছেলের আয় করা টাকায় জুতাে জোড়া পেয়ে খুবই খুশী বাবা। বড় পুত্রের বিবাহ বছর খানেক হলাে হয়েছে, এবার মেজপুত্রের পালা। কিন্তু একটা চাকরী না হওয়া পর্যন্ত তারা এ বিষয়ে নিশ্চিন্ত হতে পারছেন না। তাই তারা চাকরীর খোঁজের জন্যে অরিন্দমকে বলল। | অরিন্দমের কিন্তু চাকরী সম্বন্ধে আর কোন চিন্তা হয় না। সে ভাবে যদি তাদের দলটি পাকাপােক্ত ভাবে গড়ে ওঠে তাহলে তার অর্থ উপার্জন করার কোন চিস্তাই নেই। সে অভিনয় কে পেশা হিসাবে গ্রহণ করতে চায়। আর চিন্তায়, শয়নে স্বপনে শুধু একটা মুখই অরিন্দমের চোখের সামনে ভেসে ওঠে। তাকে নিয়ে কতরকম রং বেরঙের স্বপ্নে আশার মন্দির রচনা করে মনের মধ্যে। তাকে হৃদয়ে স্থান দেবার জন্য যেন তার মন আকুলি বিকুলি করে। সে হল অপরূপা।সামনের জুন মাসে শােভনের ও অশােকের বি.এ. ফাইনাল পরীক্ষা। পরীক্ষার প্রস্তুতি নেওয়ার জন্যে অশােক শােভনের বাড়ী সকালবেলা এসে দুপুরে খেতে যায় এবং পুনরায় দুটো নাগাদ এসে একেবারে রাত্রিবেলা ফিরে যায়। দুজনে একই সাথে শােভনের পড়ার ঘরে পড়াশুনা করে। একসাথে পড়াশুনা করার ফল সত্যি ভালাে। কারণ এতে আলােচনার ফলে একে অন্যকে বােঝাতে পারে। যাইহােক একরকম ভালোভাবেই দুজনের পড়াশুনা অগ্রসর হচ্ছিল। অশােক শােভনের কাছে পড়ার জন্যে আসত এটাই মুখ্য। কিন্তু সে আশা করতাে নিশ্চয় দেবীকার সঙ্গে তার দু একবার দেখা হবে, কথা হবে। কিন্তু বিগত একমাসে এক মিনিটের জন্যেও দেবীকার সঙ্গে অশোকের দুটি বাক্য বিনিময় কিংবা একটিও বাক্য বিনিময় হয়নি।অশোক যে ঘরে পড়াশুনা করত সেই ঘরে ভুলে একবারও প্রবেশ করত না। কারণ দেবীকার ভালোবাসার মর্ম, মর্মে মর্মে উপলব্ধি করত। সে জানত পড়াশুনার জন্যে একাগ্রতা বিশেষ প্রয়োজন। যদি সে অশোকের সামনে যায় হয়ত বা তার পড়াশোনায় ব্যাঘাত ঘটবে। তার ফলেই অশোকের জীবনে উন্নতির বাধা হবে। অশােকের অনিষ্ট হওয়ার কথা চিন্তা করতে দেবীকার অন্তর ব্যথায় মুচড়ে উঠতাে। কিন্তু হায়রে ‘ভালােবাসার অন্য প্রান্ত, সে বুঝতাে না। অশােক ভাবতাে বারাে থেকে চোদ্দ ঘণ্টা পর্যন্ত তাদের বাড়িতে থাকার ফলে দেবীকা হয়তাে নির্লজ্জ মনে করতাে। তাই অশােক একদিন শােভনকে বললাে এবার থেকে আমাদের বাড়ীতে যাওয়া তাের পালা। কারণ বাড়ীতে কয়েকদিন বাবা থাকছেন না। শােভনের কথাটির গুরুত্ব অশােকের কথায় সায় দিল। দেবীকা যদিও শােভনদের পড়ার ঘরে আসতাে না, কিন্তু অশােকের যাওয়া আসা সকলই লক্ষ্য করতাে আড়াল থেকে। আজ চার পাঁচদিন হলাে অশােক তাদের বাড়ি আসছে না। দেবীকা দাদাকে জিজ্ঞাসা করলাে, দাদা,অশােক আজকাল তাে আসছে না তাের কাছে পড়তে। দেবীকা জানতে পারল। শােভনই তাদের বাড়ী যায় কারণটাও জানলাে। কিন্তু দেবীকা বুঝল কারণ একটাই। তা হলাে অশােকের অভিমান। বৌদি জিজ্ঞাসা করল কি হলাে দেবী, দেবাদিদেব মহাদেবের হলাে কি?
দেবীকা উত্তর করে না। অশােক পরীক্ষার দুদিন পূর্বে কোথায় পরীক্ষার সেন্টার হবে আর সবরকম সংবাদ নিতে কলেজে যাচ্ছিল। বাসে উঠেই অশােক কলেজের এক বান্ধবীর দেখা পেল। বান্ধবীটি জিজ্ঞাসা করল আরে কেমন প্রিপারেশন হলাে? উত্তর দিতে গিয়ে অশােক হঠাৎ দেখলাে দেবীকা ও তার বৌদি লেডিজ সীটের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। দেবীকাকে দেখতে পেয়ে অশােক একটু উচ্চস্বরে বলল ‘মােটামুটি হচ্ছে। তােমার কেমন হচ্ছে বলাে। অশােক বান্ধবীটির সঙ্গে তুই তুকারি করেই কথা বলতাে। সেইজন্য বান্ধবীটি অবাক হলাে। কিন্তু পরক্ষণেই অশােকের ইশারা পেয়ে সব বুঝতে পেরে বললাে, আর বলাে না, খুব পরিশ্রম হচ্ছে। শরীর ভালাে যাচ্ছেনা। তােমার শরীর ভালাে তাে?হাঁ বহাল তবিয়তেই আছি, তুমি ডাক্তার দেখাচ্ছাে তাে, শরীরের যত্ন নিও। তােমার যদি শরীর খারাপ হয় তাহলে – দেবীকা আর শুনতে পারছে না। বৌদির হাত ধরে টেনে নামিয়ে পরের বাসে সে বাড়ী ফিরলাে। বাড়ী ফিরে শুয়ে শুয়ে দেবীকা শুধু কেঁদেই সারাটাদিন কাটিয়ে দিল। শােকে , অপমানে তার সেদিন আত্মহত্যার ইচ্ছা হলো। কিন্তু বৌদির পরামর্শে সে নিজের
মনকে স্থির করল।অশােকের কাছে মাসখানেক পড়তে গিয়েছিলাে। আর তার মধ্যেই বীথিকার সঙ্গে তার দেখা হয়েছিল পরের দিন। | কথা বলেছিল বীথিকাই, বলেছিল শােভনদা আপনার পরীক্ষা শুরু হচ্ছে। কোন মাস থেকে। শোভন বীথিকাকে আমার প্রাণের থেকেও যেন বেশী ভালাোবাসে। একটা কথা ভালােভাবেই জানে বীথিকা, তাকে কি পরিমাণ ভালােবাসে। তাই তাদের মধুর মিলনে কোন বাধা নেই। তারা পরস্পর পরস্পরের সাথে মিলিত হয় সােনাদিঘির সেই বট গাছতলায়। তারা কথা বলে, গান গায় আর পূর্বের স্মৃতিচারণ আধুনিক সমাজ ব্যবস্থা থেকে আরম্ভ করে রাজনীতি পর্যন্তও তাদের আলােচনা। খেলাধূলারও খবর রাখে বীথিকা। শুধুমাত্র কতকগুলি ভালােবাসার ছেঁদো কথা, তারা কেউই ভালােবাসে না। প্রেম যে কি তা তাদের ভালােভাবেই জানা আছে। প্রেম ছেলেখেলা নয় প্রেম তপস্যা। প্রেমের মাধ্যমেই ঈশ্বরের নিকটবর্তী হওয়া যায়। সেটা হল মানবপ্রেম। প্রেম যখন সকল কামনা বাসনায় উর্ধে উঠে যায় তখন সেই প্রেম হয় সুন্দর শাশ্বত। অবিনশ্বর। তবে বাথিকা শােভনের প্রেম তাে কামনা বাসনায় শূন্য নয়। আবার শুধু কামনা বাসনাও নয়। সব থেকেও যেন কিছু নেই এই ভাব। তারা দুজনেই শিক্ষিত, মার্জিত, রুচিবান। তারা জানে এই পৃথিবীর এমন কোন শক্তি নেই তাদের বিচ্ছিন্ন করে। তাই তাদের মধ্যে ভালােবাসার কোন দ্বন্ধ নেই। তারা সবার সামনেই যেন বলে বেড়াতে চায় দেখ আমরা দুজনে কত সুখী, তােমরাও সুখী হও। বীথিকা। শােভন প্রেম দেখে প্রত্যেক তরুণ তরুণীর মনে ঈর্ষার উদ্রেক হয়। সেটা শুধু ঈর্ষা নয়। শ্রদ্ধা, ভালােবাসার প্রেমের সঠিক সংজ্ঞা। এতদিন যারা অন্ধকারে শুধু ঘুরে বেড়িয়েছে। আর প্রেম করেছে কিন্তু তার অর্থ বােঝেনি তারা আজ দুচোখ মেলে তাকিয়ে দেখে যেন এক নবজাগরণ। আজকাল যদি শোভন বীথিকাকে দুইদিন দেখতে না পায় শােভনের মতাে শক্ত যুবকের যেমন বুকটা ফেটে যায়। সে বােঝে তাদের এই বন্ধন ভালােবাসার বন্ধন।। বাধিকার কাছে যে প্রেরণা শােভন পায় তার তুলনা মেলা ভার, শােভন আজ যেন।কোন মহাপুরুষের পর্যায়ে। কলা অপেরা’ আজ বর্ধমানে এক ক্লাবের বাৎসরিক অনুষ্ঠান উপলক্ষে যাত্রা। বে। আরও একটি দল যাবে এবং সেই দলের যাত্রাটিই প্রথমে হবে।। করতে যাবে। সেখানে আরও এক আজ তাদের সঙ্গে যাবার জন্যে বায়না ধরেছে। তাছাড়া সে চাইছিল।যদি একবার অরিন্দম তাকে যাত্রা দেখতে যেতে বলে তাে খুব ভাল বাড়ী থেকে বাবা, মা, দাদা ও বৌদিকে প্রণাম করে তাড়াতাড়ি গােপালবাপুর বই। এসেছে। যাত্রা করতে যাওয়ার পূবে অরিন্দম গোপাল বাবুর কাছে আর একম দিয়ে নেয়।অরিন্দম এসেই দেখে অপরূপা সামনের বারান্দায় একটা চেয়ারে সে কি মনে করে অপরূপাকে জিজ্ঞাসা করল আপনি আমাদের যাত্রা দেখাতে যাকেন। অপরূপা জানতাে অরিন্দম ও তার মধ্যে যেন কোথায় একটা বলেন সে ধীরে গড়ে উঠেছে। অরিন্দমকে তার শুধু ভালাে লাগে তাই নয় ভালাে। কিন্তু অপরূপা একজন গম্ভীর প্রকৃতির মহিলা ছিল। সেদিন সে অরিনের অভিনয় দেখে সেইদিন থেকেই সে তার প্রেমে পড়ে যায়। সুদর্শন সান্যালের পরিচয় আপনারা জানেন। একজন ভালাে অভিনেতা বলে তার মনে গর্বের অন্ত ছিল না। সে দেখতে ভালো হলেও অন্তরটা তার ভালো ছিল। যেদিন থেকেঅরিন্দমের যাত্রা গানের নাম প্রতিষ্ঠিত হতে থাকে সেইদিন থেকেই কেন অরিন্দম তার প্রধান শত্রু হয়ে দাঁড়িয়েছে। যেনে তেন প্রকারেণ অরিন্দমের ক্ষতিই যেনতার প্রধান কাজ। সবসময় সে তার বদনাম করে বেড়ায়। অপরূপা অরিন্দমকে পরীক্ষা করার জন্যে প্রঘমে বললাে, না আজ শীরটা। ভালাে নেই। আজ বােধহয় যাওয়া হবে না। অরিন্দম এই প্রথম অপরূপার হাতে হাত দিয়ে দেখলাে তার উত্তাপ স্বাভাবিক। অপরূপার দুষ্টুমি বুঝতে পেরে সে চলে যাচ্ছিল। অপরূপা ডাকলাে, শােন অরিদা আমি যাব, তােমার সঙ্গে যাবাে। অরিন্দম এতটা প্রস্তুত ছিল না। আপরূপার মুখে ‘তুমি আমি শুনে যেন অপূর্ব অনুভূতিতে তার মন শিউরে উঠলাে। অরিন্দম বললাে, তাহলে আমরা প্রথম দলের যাত্রাই দেখতে যাবাে। অপরূপা এতে খুব খুশী হলাে। কারণ সে যাত্রা প্রেমিকা। বর্ধমানে ক্লাবের ছেলেদের কাছে পরের যাত্রাদলে প্রধান অভিনেতা হিসাবে পরিচি দেওয়াতে তারা অরিন্দমের ও অপরূপার সকল রকম সুব্যবস্থা করে দিল। তবে ব্যবহার খুবই ভালাে লাগলাে অরিন্দমের। তাদের সঙ্গে এসেছে আর একশ ) হলাে অরিন্দমের বন্ধু সুব্রত ব্যানার্জী। অরিন্দম যেন এক অন্য জগতে চলে গিয়েছে। বামদিকে অপরূপা আর এ বন্ধুবর। অপরূপাকে একটা নিজের করে পাওয়ার জন্য সে কতকাল নিজেই জানে না অরিন্দম। প্রথম দলের যাত্রা শেষ। এবার ‘রূপা অপেরার যাত্রা। তাই অরিন্দম বলে অামি “তা হলে। আর অপরূপা পাশে আর একজন ভদ্রমহিলা যিনি ক্লাবের সম্পাদকের কন। অপম সেই ভ্র মহিলাকে অপরূপাকে একটু সঙ্গদান করার কথা বলে।এ দলে তাহলে এসেছে। সুদর্শন সান্যাল গোপালবাবু বললাে, দাদা অপককে দেখছি না তো গেল কোথায়? গােপালবাবু বললেন, অপরূপা অরিন্দমের খেআগে এসেছে। দাদা মেয়েকে একা একা ছেড়ে দেন। সুদর্শন বললাে গােপালবাবু প্রেমের সুরে বললেন, নিজের চরকায় তেল দাও তাে। ইতিমধ্যে অরিন্দম ঘরের মধ্যে প্রবেশ করেছে। সুব্রতও সঙ্গে আছে। সুব্রত সুশনকে মােটেই দেখতে পারে না। সে বরাবর বলতাে ঐ লােকটি একটি ধুরস্কর। খােপালবাবু অরিন্দমকে দেখতে পেয়ে জিজ্ঞাসা করলেন যে অপরূপা কোথায় আছে? অরিন্দমের কাছে সব কথা শুনে গোপালবাবু কাজে লেগে গেলেন কারণ তিনি অরিন্দমের কথায় নিশ্চিন্ত হন। যাত্রা শুরু হলাে একের পর এক দৃশ্য এগােতে লাগলাে। কিন্তু আশ্চর্য্য যতবারই অরিন্দম যায় দর্শকরা হাততালিতে ভরিয়ে রাখে মঞ্চের আশপাশ। কিন্তু শেষ দৃশ্যে অরিন্দম মৃত্যু শখ্যায় যে অভিনয় দক্ষতা দেখানাে তা দেখে প্রতােক দর্শক বিহলচিত্তে রুখে মুহ্যমান হয়ে পড়লাে। ক্লাব কর্তৃপক্ষ অরিন্দমকে পুরস্কার স্বরূপ দিলেন একটি ছোট্ট শিশু। আর একবার দর্শকদের হাততালি বেজে উঠলাে। যাত্রা শেষ হওয়ার পরক্ষণেই অরিন্দম ফিরে এলাে অপরূপার কাছে। অপরূপা অরিন্দমকে দেখে লজ্জাসরম ভূলে গিয়ে তাকে দুই বাহুতে জড়িয়ে ধরলাে আর বললাে, তুমি এরকম আর কোনদিন করবে না। অরিন্দমের আনন্দে চোখে জল এলাে, সত্যিই পৃথিবীতে তার মূল্য আজ অনেক। সে তাকিয়ে দেখলাে চারপাশের দর্শকমণ্ডলী তখনও তাকে দেখবার ভীড় করে দাঁড়িয়ে আছে। সে ভাবলাে আজ যাত্রা করে সে যে সুনাম পেল যে অভিনয় দক্ষতা দেখাতে পারলাে তা শুধু অপরূপার প্রেরণা আর গোপাল বাবুর নির্দেশনার পরিপক্ক মিষ্ট ফল।গোপালবাবু আজ আবার অরিন্দমকে যাত্রাশিল্পের কথা বলেন, বিশ্ব শতাব্দীর মাঝামাঝি ব্রজেন্দ্র কুমার দে’র (১৯০৭-৭৬) হাতে যাত্রা বিকশিত হয়ে পৌরাণিক পালার পাশাপাশি ঐতিহাসিক, লোককাহিনীভিত্তিক ও সামাজিক পালায়।পেশাদার যাত্রাদলের আবির্ভাবে যাত্রা হয়ে ওঠে গ্রাহ্য শিল্পমাধ্যম। আধুনিক নগর জীবণে যেমন থিয়েটার, গ্রামীণ জনপদে তেমনি ‘যাত্রা’ এখনো অন্যতম বিনোদন-মাধ্যম হিসেবে প্রভাব বিস্তার করে আছে। স্থূলতা, গ্রাম্যতা ও অশ্লীলতার অভিযোগ এবং নানা নেতিবাচক ধারণা সত্ত্বেও যাত্রার প্রভাব ও বৈভবকে অস্বীকার করা যায় না।’ বাংলা শিল্প-সাহিত্যের প্রায় সব শাখাতেই যাত্রার প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ প্রভাব রয়েছে। বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস পর্যালোচনা করে দেখা যায়, বাংলা ভাষার বিখ্যাত কবি-সাহিত্যিকদের অনেকেই দারুণভাবে প্রভাবিত ছিলেন যাত্রায়।মহাকবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত, গিরীশ চন্দ্র ঘোষ, বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম কেবল ব্যক্তি জীবনেই যাত্রা দ্বারা প্রভাবিত ছিলেন না, তাদের সাহিত্যকর্মেও ছিল যাত্রার উজ্জল উপস্থিতি।যাত্রাশিল্পী ও গবেষকরা মনে করেন, যাত্রা কেবল বিনোদন মাধ্যম নয়, লোকশিক্ষার বাহনও। নিরক্ষতার অনগ্রসর সমাজে যাত্রা পালন করছে ভ্রাম্যমাণ বিদ্যালয়ের ভূমিকাও।রাজাবাড়ী জেলার বালিয়াকান্দির বাসিন্দা যাত্রাশিল্পী কল্পনা ঘোষ (৫২)। শৈশব থেকেই যাত্রার সঙ্গে যুক্ত রয়েছেন। পুরো জীবনের অভিজ্ঞতা-স্মৃতি বলতে যা কিছু, তার সবই যাত্রাকে ঘিরেই।সম্প্রতি শিল্পকলা একাডেমী চত্বরে অনুষ্ঠিত একটি যাত্রা উৎসবে অংশ নিতে এসে এ প্রতিবেদককে জানালেন এ শিল্পের নানা সমস্যার কথা। যাত্রাশিল্পী কল্পনা ঘোষ বাংলানিউজকে জানান, শিশুকাল থেকে যাত্রাপালায় অভিনয় করছি। এর মাধ্যমে জীবিকা নির্বাহ করে ৩ ছেলে মেয়ে মানুষ করেছি। ভালবেসে এখনো ধরে রেখেছি যাত্রাভিনয়। বর্তমানে তরুণরা আর যাত্রাভিনয়ে আসতে চায় না। তরুণরা এগিয়ে আসলে এ শিল্পের উত্তরণ ঘটতো। এটি একটি ভাল মাধ্যম। এখানে শেখার অনেক কিছু রয়েছে। প্রাচীন শিল্পমাধ্যম যাত্রার ওপর বিধিনিষেধ আরোপিত হয় ব্রিটিশ শাসনামলেই। ভারতবর্ষের স্বাধীনতার দাবি উচ্চারিত হওয়ায় ব্রিটিশ শাসকরা বন্ধ করে দেয় মুকুন্দ দাশের স্বদেশী যাত্রা।পাকিস্তান আমলেও যাত্রাশিল্পটি রক্ষনশীল ও মৌলবাদীদের রোষানলে পড়ে। ১৯৬২ সালে পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর মোনায়েম খাঁ’র নির্দেশে বন্ধ করা হয় রূপবান যাত্রা। যাত্রাশিল্পীদের অভিযোগ, ১৯৭৫’র পর স্বাধীন দেশেই বাঙালি সংস্কৃতির শেকড় যাত্রাকে নিয়ে শুরু হয় নানা ষড়যন্ত্র। ১৯৯২ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি যাত্রা বন্ধে সরকারি আদেশ জারি করা হয়। বাংলাদেশ যাত্রাশিল্প উন্নয়ন পরিষদের সাধারণ সম্পাদক ও বিশিষ্ট যাত্রাশিল্পী মিলন কান্তি দে এই শিল্পের চলমান সংকট প্রসঙ্গে বাংলানিউজকে জানান, যাত্রানুষ্ঠানের বিরুদ্ধে যে অশ্লীলতার অভিযোগ আনা হয়, তার জন্য যাত্রাশিল্পীরা দায়ী নন।একশ্রেণীর ভূঁইফোড় ও বিকৃত মানসিকতার প্রদর্শকরা এর জন্য দায়ী। এরা কেউ পেশাদার যাত্রা প্রদর্শক না। আমরা একাধিকবার বলেছি, অশ্লীলতা যাত্রাশিল্পীরা করে না, কেউ করলে আমরা প্রশাসনকে তাৎক্ষণিক অবগত করি তা বন্ধ করার জন্য। তারপরও পুরো দায়ভার এ শিল্পকেই বহন করতে হচ্ছে।তিনি জানান, ‘একটি বিশাল জনগোষ্ঠীর জীবন-জীবিকা এ শিল্পের ওপর নির্ভর করে। নানা সময়ে এ শিল্পকে বন্ধ করে দেয়ার যে অপচেষ্টা হয়েছে তা মূলত: বাংলা সংস্কৃতিকেই ক্ষতিগ্রস্ত করার অপপ্রয়াস।সরকারের কাছে আমরা এ শিল্প রক্ষায় নানা সময়ে আবেদন জানিয়েছি। কিন্তু কোনো ফল হয়নি। বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকার আমলে একটি স্থায়ী সমাধানের জন্য আমরা আবেদন জানাই। বর্তমান সরকার আমলে যাত্রাশিল্পের জন্য একটি নীতিমালা প্রণয়নের কাজ হাতে নেওয়া হয়েছে। এটি প্রণীত হলে এ শিল্প ঘুরে দাঁড়াবে বলে আমরা মনে করি।’মিলন কান্তি দে মনে করেন- যাত্রাশিল্পকে আরো বিকশিত রূপ দিতে আমাদের দেশের প্রতিষ্ঠিত নাট্যকাররা তেমন ভূমিকা রাখছেন না। পশ্চিমবঙ্গের প্রতিষ্ঠিত নাট্যকাররা যাত্রাপালা লেখেন, আমাদের নাট্যকাররা যাত্রাপালা লেখেন না।এখানে তাই ভালমানের পালা রচিত হচ্ছে না। এ শিল্পের সামগ্রিক বিকাশের পথে এটিও একটি বড় বাধা হিসেবে দেখেন মিলন দে।
😍😍😍😍😍
শোভন ভাবে, দেশে ওষুধ কোম্পানিগুলোর প্রসার হচ্ছে দিন দিন। কোম্পানিগুলো নিয়মিত নতুন নতুন ওষুধ বাজারে নিয়ে আসছে। আর আগের ওষুধ তো আছেই। সেই ওষুধগুলোর পরিচিত চিকিৎসকদের কাছে তুলে ধরার দায়িত্ব মেডিকেল রিপ্রেজেন্টেটিভদের।এটি একটি চ্যালেঞ্জিং পেশা। যাঁরা এ পেশায় যেতে আগ্রহী, তাঁদের জন্য উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হতে পারেন এ দুই ব্যক্তি। দুজনই নিজ নিজ পেশায় সফল। একেবারে নিচুতলা থেকে শুরু করে সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছেছেন।এই দীর্ঘ সময়ের মধ্যে গ্লাক্সো, ওয়েথ ইন্টারন্যাশনাল, একমি ও আরএকের মতো ফার্মাসিউটিক্যালস কোম্পানিগুলোয় কাজ করেছেন রফিকুল ইসলাম। অভিজ্ঞতা থেকে তিনি বললেন, ‘এ পেশায় ভালো করতে হলে অবশ্যই দক্ষতা প্রয়োজন। তবে সেই সঙ্গে কাজের প্রতি নিষ্ঠা, প্রতিশ্রুতি ও সততা থাকতে হবে।’দেবীকা যেদিন তার বৌদিকে নিয়ে মাঝপথে বাস থেকে নেমে পড়েছিল সেদিন থেকে অশােক নিজেকে অপরাধীর মতাে সবসময় নিজেকে দূরে দূরে সরিয়ে রাখতাে। একটু ভুলের জনাে পরস্পরের মধ্যে যে বিভেদ সৃষ্টি হয়তার জন্যে অনেক তো মাশুল গুনতে হয়। সে কথা বলার আগে মনে করি দুই বন্ধুকে। আজ শােভন এসেছে, অশােকের কাছে। তারা দুজনেই পরীক্ষা দিয়েছে। বর্তমানে যা অবস্থা মনে হয় বছর খানেকের মধ্যে না হলে বি.এ., বি.এস.সি,পরীক্ষার রেজাল্ট বের হয় না। এই খবরটুকু তাদের জানা বলেই তারা দুজনে যুক্তি করে কিছু করতে চায়। কিন্তু কি করবে তারা। বর্তমান বেকার যুগে কিই বা করার আছে। অনেক আলােচনার পর তারা ঠিক করলাে তারা দুজনে মিলে টিউটোরিয়াল হােম খুলে স্বল্প বেতনে শিক্ষাদান করবে। কিছুদিনের মধ্যে প্রস্তুতি শুরু হয়ে গেল। তারা রূপাডিহির ও সােনাদিঘির সপ্তম শ্রেণী থেকে দশম শ্রেণী পর্যন্ত ছাত্র-ছাত্রীদের ডেকে তাদের মনের কথা বললাে। কুড়িজন ছাত্র ছাত্রী নিয়ে তারা শুরু করলো তাদের শিক্ষাদান। প্রত্যেকের কাছে পঁচিশ টাকা করে নিয়ে তাদের হিসেবে পাঁচশাে টাকার মতাে হবে। তারপর দুজনের ফিফটি ফিফটি। অশোক শােভনের টিউটোরিয়াল হােম ভালােভাবেই চলছে। এতে স্টুডেন্ট কল্যাণের ফলে তাদের দুই বন্ধুর সম্মান দুই গ্রামেই বেড়ে গেছে। দুজনের নম্রতা প্রত্যেক গ্রামবাসীর কাছে প্রশংসার বিষয়বস্তু ছিল। আর দুই বন্ধু অশোক ও শােভন তাদের নতুন ভাব দর্শনের স্রোতে ভেসে চললাে। ছােট ঘটনাটি ঘটলে হয়তাে অশােক দেবীকার মধ্যেকার সম্পর্কে কতখানি দৃঢ় তাহা বুঝা যেত না। অতি প্রত্যুষে উঠে অশোক শােভনের বাড়ি গেল আজ সুদীর্ঘ তিন মাস পরে। শােভনের বাড়িতে প্রবেশ করার আগেই অশােক, দেবীকা কে ফুল বাগানে দেখতে পেল। আড়ালে দাঁড়িয়ে অশোক তাকে নিরীক্ষণ করতে থাকলাে। হঠাৎ একটা শব্দ শুনে দেবীকা ঘুরে দাঁড়াতেই অশােকের সঙ্গে চোখাচোখি হল। এক পলক তাকিয়েই দেবিকা ঘাড় নীচু করে ঘরের ভিতর প্রবেশ করলো, অশােক তাকে ডেকেও উত্তর পেল না। অশোক চলে যাচ্ছিল। হঠাৎ মাসীমার অর্থাৎ সবিতা দেবীর ডাকে সচকিত হয়ে সে ঘুরে দাঁড়ালাে। সীতা দেবী তাকে এতদিন না আসার কারণ জিজ্ঞাসা করলেন। অশোক আমতা আমতা করে কোনরকম শােভনের ঘরে প্রবেশ করল। প্রায় দু তিন ঘণ্টা পরে অশােক যখন শােভনের ঘর থেকে বাইরে এল তখন দেবীকা লাল পাড়ের শাড়ি পরে কলেজের পথে পা বাড়িয়েছে। বর্তমানে গলসি কলেজের দ্বাদশ শ্রেণীর ছাত্রী। অশােক দেবীকার পিছু নিল। দেবীকা কিন্তু অনড়, অচল। সে ভুল করে একবারও অশােকের ডাকে সাড়া দিল না বা তাকাল না। অশােক কাতর স্বরে বারংবার বলতে শুরু করলাে। দেবীকা তুমি আমায় ভুল বুঝাে না। আমি তােমায় আমি তােমায় ভালােবাসি। পথের মাঝে তার ফলে সে সিনক্রিয়েট হলাে। তার প্রতি বিন্দুমাত্র লক্ষ্য ছিল না অশোকের। পথযাত্রীরা প্রত্যেকে ভুল বুঝে অশোকের পথ রুদ্ধ করলো। অশোক পাঁচ ছয় ব্যক্তির বেড়া ভেঙ্গে দেবীকার কাছে যেতে চেষ্টা করলাে কিন্তু দেবীকা তার প্রতি ভ্রক্ষেপ মাত্র না করে বাসে উঠে আপন পথে এগিয়ে গেল। অপরিচিত কয়েকজন ব্যক্তির হাতে প্রহৃত হয়ে অশোকের হৃদয়ে যে ক্ষতের সৃষ্টি হলাে সেই ক্ষতের দাগ নিশ্চিহ্ন হতে যুগ যুগ হয়তাে কেটে যাবে। তবু সে দেবীকার সামনে এ মুখ দেখাবে না। তার প্রতি বিন্দুমাত্র আসক্তি ও নেই।ও ভুলবে না,এই প্রতিজ্ঞা করলাে। অশােক ও শােভনের বি.এ. পরীক্ষার ফল ঠিক এক বৎসর দেড় মাস পর প্রকাশিত হল। অশােক ডিস্টিংশন নিয়ে পাশ করেছে আর শােভন ফরটি ফাইভ’ পারসেন্ট পেয়ে পাশ করেছে। শােভন গ্র্যাজুয়েট হওয়ার প্রথম খবর মা, বাবাকে দেওয়ার পর,বীথিকার বাড়ি গেলাে। কিন্তু বীথিকার পাশে বসে কে ওই তরুণী পিছন দিকে থেকে দেখার ফলে তাকে চেনা যাচ্ছে না। শােভন এগিয়ে না গিয়ে দুর থেকে ইশারা করে বীথিকার দৃষ্টি আকর্ষণ করলাে। বীথিকা উঠেআসতে পাশের তরুণী ঘুরে বসে দেখলাে শােভনকে, আর দেখল শােভন ও বীথিকা ঘনিষ্ট অবস্থায় দাঁড়িয়ে। খুশির প্রথম চুম্বন আঁকলাে বীথিকার চিবুকে শােভন। তারপর…. আর দেখতে পারলাে না তরুণীটি। দৌড়ে বেড়িয়ে গেল সে। বীথিকা বান্ধবীকে ডেকে উঠলাে। এই অপর্ণা কোথায় যাচ্ছিস?স্তম্ভিত শােভন। এমনভাবে আঘাত দিতে চায়নি অপর্ণাকে। সে জানতাে অপর্ণা তাকে ভালােবাসে। কিন্তু শােভন যাকে একবার তার বােনের আসনে বসিয়েছে তাকে প্রেমিকার আসন দিতে পারেনি। এটা শােভনের নীতি বিরুদ্ধ। শােভনকে ধাক্কা দিয়ে বীথিকা সহজভাবে বলে উঠলাে, পূৰ্ব্ব প্রেমিকা বুঝি ?আজ রবিবার। ১২ই জানুয়ারী। অশােক ও শােভন যৌথভাবে আজ একটি পার্টি দিয়েছে তাদের পাশ করার আনন্দ স্বরূপ। সেখানে নিমন্ত্রিত আছেন অনেকে। প্রথমত দুই পরিবারের সকল সদস্য এবং এ ছাড়া উভয় পরিবারের সঙ্গে সম্পর্কিত কিছু ব্যক্তি। যেমন গােপালবাবু ও মেয়ে অপরূপা আর বীথিকা ও তার পিতা অরুণ মুখার্জী ও মাতা রিয়া দেবী, অপর্ণা বীথিকার বন্ধুত্বের সূত্র ধরে।।অশােক ও শােভন তাদের উভয়ের মিলিত টিউটোরিয়াল হােমের অর্থ খরচ করে,ব্যবস্থা করেছিলাে অতিথিদের জন্য, সবরকম ব্যবস্থা। সবসময় ভেসে আসছিল সংগীতের মিষ্টি সুর। সুদৃশ্য অলােকসজ্জা আর সুরুচিকর খাদ্য পরিবেশনের মাধ্যমে আসর জমে উঠেছিলাে। অরিন্দম ও অপরূপা একটি পপ সংগীত গাইতে তালে তাল নাচতে থাকে। তার সঙ্গে নাচতে থাকে উপস্থিত সকলে। শােভন ও অশােক একই সুরে সুর মিলিয়ে গাইতে থাকে। – “যদি তাের ডাক শুনে ..”.এরই মধ্যে চলতে থাকে আর একটি নাটক। দেবীকা অশোকের হৃদয়ের গভীর ক্ষতের কথা জানতে পেরেছে। সেই ক্ষতস্থানে প্রলেপ দেওয়ার জন্যে সে বারবার অশােকর দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাইছে। কিন্তু পারছে না। অশােক আজ সেই অশোক নেই সে আজ দিশেহারা আজ সে একটু ড্রিংকসও করছে। ব্যথা হঠাৎ বুকে এসে অশোকের সঙ্গ দিতে শুরু করেছে। সে কোমর দোলাতে দোলাতে অশোকের কন্ঠে কণ্ঠ মিলিয়েছে। আর ঘন ঘন ক্যামেরার ফ্লাশ গর্জন করে চলেছে শােভনের হাত থেকে।শােভন, অপর্ণাকে পাশে ডেকে নিয়ে গিয়ে সােফায় বসল। অপর্ণা ঘরে বসে তার দাদা অশােকের সঙ্গে নাচছে, দেখছে কি সুন্দর ভঙ্গিমায় তার বান্ধবী বীথিকা তার দাদার সঙ্গে কতক্ষণ গান গাইছে। সে কেন পারছেনা। তাদের মানসিকতার, শিক্ষাদীক্ষার ফারাক মর্মে মর্মে উপলব্ধি করলাে। সে আরও বুঝতে পারলাে ভালােবাসা কোনদিন মরে না। সে তার আপন গতিপথে স্বতঃস্ফূর্তি ভাবে এগিয়ে চলে। সে কি করল, তার দাদা অশােকের চোখ তারই দিকে চেয়ে আছে। সে দাদার অন্তরের কথা যেন বুঝতে পারল। সে দ্রুত উঠে পড়ে দেবীকার পাশে দাঁড়াল। শােভন এ দৃশ্য উপভােগ করতে লাগল। দেবীকার পাশে দাঁড়ানাে মাত্র অপর্ণা এক অজানা আশঙ্কায় কেঁপে উঠলাে। সে দেবীকাকে ডেকে বাইরে পূর্ণিমার আলাের মধ্যে বসল। দেবীকার মুখের এবং অশ্রুসজল চোখের ভাষায় অপর্ণা ব্যাপারটির গুরুত্ব উপলব্ধি করলাে।রূপা অপেরার চাহিদা বেড়েই চলেছে। অপেরা পার্টির প্রতিষ্ঠাতা এবং পরিচালক হিসাবে গােপালবাবুর সুনাম চতুর্দিকে বিস্তৃত হয়ে চলেছে। আজ পর্যন্ত অনেক নামীদামী অপেরার পার্টির থেকে রূপা অপেরাটির বৈশিষ্ট্য আলাদা। সুদর্শন সান্যাল বিশেষ লোক, যে কোনাে বইয়ের প্রধান চরিত্রে অভিনয় করতেন। কিন্তু অরিন্দম সে বিষয়ে কোনাে গুরুত্ব দিত না। গােপালবাবুর নির্বাচন মতাে সে অভিনয় করে যেত। অপেরার স্বার্থে গােপালবাবু কিছু পরিবর্তন করতে চাইলেন। কিন্তু সর্বপ্রথম তিনি বাধা পেলেন সুদর্শন সান্যালের কাছে। নিজেকে তিনি একজন বড়াে অভিনেতা বলে অহংকারে মত্ত ছিলেন। গােপালবাবুর মতে সুদর্শনবাবুর অভিনয়ের শিক্ষার অনেক অভাব ছিল। তিনি অরিন্দমকে প্রধান চরিত্রে মনােনীত করতে চাইলেন। কিন্তু সুদর্শন সান্যাল এই সুযােগ হাতছাড়া করতে চাইলেন না।। গােপালবাবুকে কথা দিলেন যে এবার তিনি সাধ্যমত অভিনয় করে তার আসন পাকা করে নেবেন। সান্যাল ধনী দুলালের পুত্র কিন্তু তার অর্থের প্রলােভন ছিল বেশী। সে। চেয়েছিল প্রধান চরিত্রে অভিনয় করে বেশী উপার্জন করতে। গােপালবাবু সহৃদয় লোক। তিনি সুদর্শন সান্যালকে আর একটি সুযােগ দিলেন। অরিন্দমের কিন্তু কোনো বিকার নেই। গোপালবাবুই তার গুরুদেব।তার নির্দেশমতাে চলতে তার বিন্দুমাত্র দ্বিধা নেই।।
যাইহােক ‘রূপা অপেরা’ দেড় বৎসর ব্যাপী রামকৃষ্ণ মিত্রের ‘সােনার সানাই।’ বইয়ের মহড়া দিল। অরিন্দম ছিল এক ছদ্মবেশী ভিক্ষুর অভিনয়ের। এবার রূপা অপেরা-র ডাক পড়েছে নদীয়ার একটি শহরে। রূপা অপেরার এখন দশ হাজার টাকা, পার নাইট রেট। বাসভর্তি অপেরা পার্টি হাজির ছিল সন্ধ্যা সাত ঘটিকায়। বই শুরু হবে নয় ঘটিকায়। অরিন্দম ও অপরূপা প্রথমত শহরটি একটু দেখার জন্যে বেরিয়েছে। পথমধ্যে এক মারাত্মক দুর্ঘটনার কবলে পড়লাে তারা। একটি মােটর সাইকেল এসে তাদের রিক্সার সঙ্গে সংঘর্ষ বাধায়। এর ফলে অরিন্দম লাফিয়ে নেমে পড়লেও অপরূপা পায়ে ভীষণভাবে আঘাত লাগে। অরিন্দম কথা না বাড়িয়ে মােটর সাইকেল আরােহীর সাহায্যে রূপাকে নার্সিংহােমে নিয়ে যায়। ডাক্তারবাবু প্রাথমিক চিকিৎসার পর তাদের ছেড়ে দেন। | এদিকে গােপালবাবু অরিন্দমকে খোঁজাখুঁজি শুরু করে দিয়েছেন। বই শুরু হতে আর আধ ঘণ্টা বাকী। কনসার্ট পড়ে গিয়েছে। কিন্তু অরিন্দমের পাত্তা নেই। অরিন্দমের দ্বিতীয় দৃশ্যে প্রবেশ। সুদর্শন সান্যাল এ সুযােগ হাত ছাড়া করলাে না। বারবার গােপালবাবুর কানে কুমন্ত্রণা দিতে থাকলাে গােপালবাবুর উপর দোষ চাপিয়ে বললাে আপনিই ওকে বাড়িয়ে মাথায় তুলেছেন নিজেকে অরিন্দম বড্ড বেশী বড় মনে করে। গােপালবাবু একে প্রেসারের রােগী ক্রমে তার ক্রোধ বেড়ে যাওয়াতে তার প্রেসার বাড়তে থাকলাে। অরিন্দম যখন এলাে তখন গ্রীন রুম সাইলেন্ট। অপরূপা এক পাশে বসে পড়লাে। অরিন্দম দ্রুত মেকআপ সেরে নিয়ে মঞ্চে প্রবেশ করেলা। মানসিকভাবে প্রস্তুত না থাকায় অরিন্দম খুবই বিব্রত বােধ করতে থাকলাে, ফলে ডায়ালগ মিশ করল। সঙ্গে সঙ্গে দর্শকদের মধ্যে গুঞ্জন শােনা গেল। কোনওরকমে অরিন্দম মঞ্চ থেকে বেরিয়ে এলাে। অপরূপার কাছে এসে দাঁড়ালাে। অপরূপা অভয় দিলাে। উভয়ে তাকিয়ে দেখলাে সুদর্শন সান্যালের মৃদু হাসির ঝিলিক আর তার পার্শ্বে দন্ডায়মান হিরু এবং ব্যথিত গােপালবাবুকে। পরবর্তী দৃশ্যগুলিতে অরিন্দম মােটামুটি ভালাে অভিনয় করলাে কিন্তু অপরূপার অভিনয় ভালাে হল না। এদিকে সুদর্শন সান্যাল ফাঁকা মাঠে গােল দেওয়ার মতাে সেই রাত্রির শ্রেষ্ঠ অভিনেতার সম্মান পেল। অপরূপা ও অরিন্দম বিষন্ন চিত্তে বাসে উঠে পিছনের সীটে বসলাে। সুদর্শন সান্যাল ও গােপালবাবু বসলেন পিছনের সীটে। সুদর্শন সান্যালের ভালাে অভিনয়ের জন্যে অরিন্দম এবং অপরূপা কিন্তু তাকে শাবাসি দিতে ভুল করলাে না। কিন্তু সুদর্শন সান্যাল প্রত্যুত্তরে কিছুই বললাে না। এমন মনের বাসনা চরিতার্থ করার জন্য সাধনা লাগলাে। সাত দিন পরে সে গােপালবাবুর বাড়ি গিয়ে দেখে তিনি আলােচনায় ব্যস্ত। অপরুপা পাশের ঘরে। অরিন্দম ঘরে প্রবেশের অনুমতি নিয়ে গোপালবাবু পাশের চেয়ারে বসলাে। সান্যাল উঠে তখন পাশের ঘরে গেল। গোপালবাবু তিরস্কারের সুরে বলে উঠলেন, তোমার আর অভিনয় শেখা হলনা।” গােপালবাবুর এই কথাটি অরিন্দমের বুকে তীব্র তিরের মত বিদ্ধ হল। অরিন্দমের চোখ জল ছলছল করে উঠলাে। গােপালবাবু বলে যেতে লাগলেন অভিনয় করতে গেলে দায়িত্ববান হতে হয় এবং অনুশীলন করতে হয়। তােমার মধ্যে এই দুটোর কোনটাই দেখছি না। গােপালবাবুকে বিছানায় দেখে বলে উঠলাে, কাকাবাবু আপাতত এখন কেমন আছেন তার দেহে হাত দিয়ে দেখলাে অরিন্দম ‘হার্টবিট’ অনেক বেশি এবং উত্তাপ অস্বাভাবিক। কোন কথা না বলে অরিন্দম ডাক্তার ডাকতে চলে গেল। এসেই দেখে সুদর্শন সান্যাল ডাক্তার নিয়ে এসেছে। একা অপরূপা বিছানার পাশে বসে আছে। অরিন্দম ডাক্তারকে ফি দিয়ে বিদায় দিল। অপরূপা অরিন্দমকে দেখে উঠে এসে তার বুকে মাথা রেখে কান্নায় ভেঙ্গে পড়লাে। তার কথা শুনে অরিন্দম জানতে পারল গােপালবাবু ক্যান্সারে আক্রান্ত এবং তিনি চার মাসের বেশী বাঁচবেন না। | ‘রূপা অপাের পুনরায় চার রাত্রি যাত্রা করার ডাক পেলাে। অরিন্দম কিন্তু গােপালবাবুর শরীরের জন্যে যেতে চাইলেন না। সুদর্শন সান্যাল এখন পার্টির সকল দায়িত্ব নিয়েছে এবং সকলের দেখাশােনা করছে। গােপালবাবুর পরামর্শে এবং তার আদেশে শেষ পর্যন্ত অরিন্দম যেতে রাজী হলাে। কিন্তু সঙ্গে অপরূপা এবং গােপালবাবু যাবেন না, ফলে অরিন্দম ব্যথায় জর্জরিত।
😍😍😍😍😍
অশােক ও শােভন গ্র্যাজুয়েট হওয়ার পর থেকে দুই বৎসর অতিক্রান্ত হয়েছে। কিন্তু দুজনের কারাের কোনাে চাকরী হয়নি। শুধুমাত্র তাদের টিউটোরিয়াল হােমের উন্নতি হয়েছে। তাদের এই হােম থেকে অনেক ছাত্র ফাস্ট ডিভিশনে মাধ্যমিক পাশ করেছে এমন কি দুই একজন ছাত্রছাত্রী স্টারও পেয়েছে। ফলে তাদের হােমের’ ছাত্রছাত্রী সংখ্যা এখন অনেক। দুইবেলা তারা হােম খােলে। সকাল সাত ঘটিকা থেকে দশ ঘটিকা এবং সন্ধ্যা সাড়ে ছয় থেকে নয় ঘটিকা পর্যন্ত। প্রত্যেক গ্রুপে তিরিশ জন করে ছাত্রছাত্রী থাকে দুইজনে পনেরজন করে প্রতি সপ্তাহে চারদিন শিক্ষাদান করে। শুধুমাত্র নব এবং দশম শ্রেণীর ছাত্রছাত্রীই এখন পড়াশুনা করে। দুইবেলায় মােট ৬০জন ছাত্রছাত্রী পঁচিশ টাকা করে দেয়। মােট দেড় হাজার টাকার মতাে মাইনে দেয়। এতে দুজনের মােটামুটি অপেশাদারি খুশী মন। দিন যায় এবং তাদের পড়াশুনার অভ্যাসও বজায় থাকে। এটাই ছিল তাদের প্রধান উদ্দেশ্য।তা হােক দেবিকা এবং অপর্ণা দুইজনেই এখন বারাে ক্লাসের গন্ডী পেরিয়ে কলেজে ভর্তি হয়েছে। অপর্ণা তার দাদা অশােককে দেবীকার কথা এই প্রথম অশোক অপর্ণার মুখে দেবীকার কথা শুনে বুঝতে পারলাে দেবীকার অনুতাপের কথা। কিন্তু শুধু মনে পড়ে যায় সেদিনের অপমানের কথা। সেদিন রাস্তায় অশােক যেখানে ছােটো হয়েছিল জীবনে আর কোনদিন সেরূপ অপমানিত সে হয়নি। অতএব মনােবাসনা পূর্ণ হল না।অপর্ণা দেবীকাকে একদিন তার বাড়ী নিয়ে এলাে। দেবীকা বাড়িতে প্রবেশ করেই দুচোখ দিয়ে শুধুমাত্র অশােককে খুঁজে বেড়ায়। কিন্তু কোথাও অশােকের দেখা নেই। শেষে অধৈর্য হয়ে দেবীকা অপর্ণাকে তার দাদার কথা জিজ্ঞাসা করে। অপর্ণা দাদার ঘরের দিকে আঙুল দেখিয়ে দেয়। দেবীকা ধীর পদক্ষেপে দৃঢ় চিত্তে জয়ের বাসনা নিয়ে দরজার দিকে এগােতে থাকে। প্রবেশের মুখেই স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে। দেখে বিছানায় অশােক ছটফট করছে আর বীথিকা তার পাশে বসে তার মাথায় হাত দিচ্ছে। দেবীকা আড়ালে সরে গিয়ে সব দেখতে লাগলাে। শুনতে পেল অশােক বলছে। ‘বীথিকা শােভন কেন এল না? ওকে এইসময় আমার বিশেষ দরকার। শােভন আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ বন্ধু, আর তুমি তার ভাবী বধু, আমার বােন বীথিকা তুমি কত স্নেহশীলা, তুমি কত সুন্দর। বীথিকা অশােককে চুপ করিয়ে ডাক্তারের দেওয়া ঔষধ খেতে দেয়। ইতিমধ্যে শােভন এসে দেখে দেবীকা দরজার পাশে দাঁড়িয়ে। সে তাকে হাত ধরে নিয়ে ধরে প্রবেশ করে। অশােক দেবীকাকে দেখে চমকে ওঠে। কিন্তু পরক্ষণেই মুখ ঘুরিয়ে নেয়। বীথিকা ও শোভন তাদের ঘরে বসিয়ে অপর্ণার ঘরে যায়। সঙ্গে সঙ্গে দেবীকা ডুকরে কেঁদে ওঠে। আর হাত জোড় করে ক্ষমা প্রার্থনায় ভঙ্গিতে অশােককে ডাকতে থাকে। অশােক দেবীকার দিকে আজ অনেকদিন পর তাকিয়ে দেখলাে, দেবীকা আগের থেকে অনেক সুন্দরী হয়েছে। দেবীকা একসাথে অনেক কথা বলতে চায় কিন্তু কিছুই। বলতে পারে না। শুধুমাত্র তাদের দুজনের হাত পরস্পরের হাতের মুঠোর মধ্যে থাকে। ইতিমধ্যে শােভন ও বীথিকা অশােকের কাছে এসেছে। কিন্তু অপর্ণা শােভনের বােন দেবীকাকে কোনমতে এবেলা বাড়ী যেতে দিল না। দেবীকার এই প্রথম অশােকদের বাড়ী থাকা।অশােক যখন নিদ্রাচ্ছন্ন হল তখন অপর্ণা ও দেবীকা গৃহকর্মে যুক্ত হল। মাসীমা, মেসােমশায় অর্থাৎ অশােকের বাবা মা দুজনেই দেবীকাকে খুব ভালােবাসেন। দেবীকাকে কাছে পেয়ে তাদের আর আনন্দের সীমা নেই। দেবীকাকে কাছে বসিয়ে তারা গল্প করলেন। খাওয়া দাওয়া সারা হওয়ার পর দেবিকা আর একবার অশােকের সঙ্গে দেখা করতে গেলে অশােক তাকে চুম্বনে সিক্ত করল। তাদের ভুল বােঝাবুঝির অবসান হল।অশােকের বিছানায় বসে দেবীকা তার মনের গভীরে আশঙ্কার জল ঢুকতে লাগল। হঠাৎ সে দেখলাে অশােক পৃথিবীতে নেই। সে নিঃসঙ্গ একাকী। পৃথিবীতে তবে থাকার আর কোন আশা আকাঙ্খা নেই। শুধুমাত্র মরুপ্রান্তর। দেখলাে অশােক ভেসে চলেছে অজানা পৃথিবীর উদ্দেশ্যে। তাকে ফেলে একা রেখে। হায়রে অবুঝ প্রেম। প্রেমের রূপ এরূপই হয়ে থাকে। যাকে তুমি আপন হৃদয়ের অন্তঃস্থলে ঠাঁই দিয়েছ তার অমঙ্গল চিন্তা আগে আসবে মনে, তবেই তােমার সার্থক ভালােবাসা। প্রিয় যখন কাছে থাকে তখন তাকে অবজ্ঞা কর না, প্রিয় দূরে গেলে প্রিয় আরও প্রিয় হয়ে ওঠে এই হল অবুঝ প্রেম।দেবীকার হঠাৎ মনে হল সে মৃত অশােকের পাশে বসে। সে ভয়ে আর্তনাদ করে ঘুমন্ত অশােককে জড়িয়ে ধরলাে নিজের শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে। ঘুমন্ত অসু্থ অশােক তখন স্বপ্ন দেখে গোলাপ ফুলের মত দেবীকার সুন্দর মনের। সে অনেক কিছুই দিল দেবীকাকে। দেবীকা নিশ্চিন্ত হল অশােক মরেনি।অরিন্দম তার গতবারের অভিনয়ের বদনাম ঘুচিয়ে চার রাত্রিতেই সর্বশ্রেষ্ঠ অভিনেতার সম্মান নিয়ে ফিরলেন। আর সঙ্গে নিয়ে ফিরলাে দশ হাজার টাকা। ফিরে এসে প্রথমেই অরিন্দম অপরূপার সঙ্গে দেখা করতে গেল। অপরূপা অরিন্দমকে দেখেই আনন্দে আত্মহারা হয়ে অরিন্দমকে জড়িয়ে ধরলাে। অরিন্দম তার জয়ের কথা অপরূপাকে বলল তারপরে গােপালবাবুর কাছে গিয়ে শরীরের উত্তাপ এবং হার্টবিট দেখে অপরূপাকে অন্য ডাক্তার দেখাবার জন্য বললাে। অপরূপা অর্থের অভাবে অন্য ডাক্তার আনার ভরসা পাচ্ছিল না। অরিন্দম একথা বুঝতে পেরে নিজে গিয়ে কলকাতা থেকে বড় ডাক্তার নিয়ে এলাে।। যেদিন অরিন্দম কলকাতা থেকে ডাক্তার নিয়ে এলাে সেইদিন এসেই দেখতে পেল সুদর্শন সান্যালের ডাক্তার গোপালবাবুকে দেখছেন। অরিন্দম ডাক্তারবাবুকে অপরূপার ঘরে বসিয়ে রেখে তাকে আপ্যায়ণ করার জন্য অপরূপাকে বলল। সুদর্শন সান্যাল ডাক্তার নিয়ে চলে যাবার আগে ফি বাবদ টাকা অপরূপার কাছে নিতে আসে। সেদিন টাকা নিতে এসে অন্য আর একজনকে দেখে সুদর্শন সান্যাল অপরূপাকে বাইরে ডাকলাে। আর ঠিক সেইসময় সুদর্শন সান্যাল তার মনের বাসনা চরিতার্থ করার জন্য অপরূপাকে জড়িয়ে ধরে বলল “অপরূপা আমি তােমায়” কথা আর শেষ হতে হল না। অপরূপার চিৎকার অরিন্দম এসে সুদর্শন সান্যালের কেশ আকর্ষণ করে অপরূপার কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করতে বলল। প্রত্যুত্তরে সুদর্শন সান্যাল কে থেকে ভোজালি বের করে অরিন্দমের প্রতি অগ্রসর হতে থাকল। আগত বাবু একটি লাঠি ছুড়ে অরিন্দমকে সূদর্শন সান্যালের থেকে রক্ষা করলেন। সুদর্শন সান্যাল সুযােগ বুঝে পালালো। কলকাতা থেকে আগত ডাক্তারবাবু তারপর রোগীর কাছে গিয়ে প্রায় এক ঘণ্টা ব্যাপী গোপালের শরীর পর্যবেক্ষণ করে বললেন একে ড্রাগ এডিকেটেড করা হয়েছে । এর প্রেসার একটু বেশি হলেও অন্য কোন কঠিন ব্যাধি নেই এবং পরিকল্পপনা মাফিক একে রোগী বানিয়ে রাখা হয়েছে। এর প্রেসার বাড়িয়ে,ওষুুুুধ না দিয়ে প্রতিদিন তাকে মেরে দেবার চক্রান্ত চলছিল। ভাক্তারবাবুকে ট্রেনে তুলে দেবার পর অরিন্দম সােজা নিজের বাড়ী গিয়ে কথামত ঔষধপত্র কেনার জন্য শহরে গেল। প্রায় আড়াই মাস ব্যাপী চিকিৎসার ফলে গােপালবাবু প্রায় স্বাভাবিক ও সুস্থ হয়ে উঠলেন এবং হাত ভরে অরিকে আশীর্বাদ করলেন। ঈশ্বরকে প্রণাম জানালেন এক বিরাট দুর্ঘটনা থেকে বাঁচার জন্য। গোপালবাবু আজ অরিন্দমকে বলছেন আগে তো যাত্রাদলের নারী পাওয়া যেত না তখন পুরুষ মানুষই নারী সেজে যাত্রাদল অভিনয় করত। পুরুষরা কিন্তু নারীর অভিনয় কম যেত না তারা বেশ সুন্দর অভিনয় করত। এমন অনেক পুরুষের নারীর ভূমিকায় অভিনয় করেই নাম হয়েছে যাত্রা জগতে। তিনি আরও বলেন, নারীদের মঞ্চে আগমনের আগে যে সকল পুরুষ-অভিনেত্রী এদেশে ছিলেন তাদেরকে ‘রানী’ বলা হত। সেই রানীদের মধ্যে রেবতীরানী, হরিপদ বায়েন, নিতাইরানী, সুদর্শনরানী, সুধীররানী, ছবিরানী প্রমুখের অভিনয় দর্শকদের প্রশংসা কুড়িয়েছে।যাত্রা-গবেষক গৌরাঙ্গপ্রসাদ ঘোষের ধারণা যাত্রার জন্ম তৃতীয় শতকে। ডক্টর হংসনারায়ণ ভট্টাচার্য মনে করেন যে দ্বাদশ শতকের আগেই যাত্রার জন্ম হয়েছে। দ্বাদশ শতকেই যাত্রার জন্ম এমন মতের সমর্থক প্রবোধবন্ধু অধিকারী, ডক্টর আশ্রাফ সিদ্দিকী, নাট্যকার মমতাজদদীন আহমেদ প্রমুখ। পালাসম্রাট ব্রজেন্দ্রকুমার দে এবং সাহিত্যিক সঞ্জীবচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় মনে করেন পঞ্চদশ শতকের আগেই যাত্রার জন্ম। নাট্যব্যক্তিত্ব অহীন্দ্র চৌধুরী অবশ্য পঞ্চদশ শতককেই যাত্রার জন্ম বলে চিহ্নিত করেছেন। ডক্টর সুরেশচন্দ্র মৈত্র, গবেষক কপিলা বাৎসায়ন, ডক্টর সুশীলকুমার দে, নাট্যকার মন্মথ রায়, নটসম্রাট অমলেন্দু বিশ্বাস, ডক্টর প্রভাতকুমার দাস, ডক্টর প্রভাতকুমার গোস্বামী, ডক্টর মণীন্দ্রলাল কুণডু, ডক্টর সৈয়দ জামিল আহমেদ প্রমুখের ধারণা বিশ্লেষণ করলে যাত্রার জন্ম ষোড়শ শতক বলে প্রতীয়মান হয়।নাট্যকার জিয়া হায়দার বলেছেন,- ‘অষ্টাদশ শতক থেকে, সম্ভবত তার আগে থেকেই ভ্রাম্যমাণ যাত্রাদল গড়ে ওঠে’। ডক্টর সেলিম আল দীন বলেছেন,-‘অষ্টাদশ শতকের মধ্যভাগ থেকে যাত্রা কথাটার অর্থ সঙ্কুচিত হতে থাকে এবং ঊনবিংশ শতাব্দীর শুরু থেকেই মূলত যাত্রা নাট্যাদি অর্থে পরিচিতি লাভ করে’। সেলিম আল দীনের এই মত মানলে যাত্রা এই আাধুনিককালের শিল্পআঙ্গিক বলে ভাবতে হয়। কিন্তু সেটি সম্ভবপর নয়। নিশিকান্ত চট্টোপাধ্যায় তো বলেছিলেন,- ‘…এসব থেকে নিঃসংশয় হয়ে বোঝা যায় যে, খ্রিস্টপূর্ব দ্বিতীয় শতক থেকেই নিয়মিত কৃষ্ণযাত্রার অভিনয় হতো এবং ভারতের সর্বস্তরের জনসাধারণের কাছেই তা জনপ্রিয় ছিল’। এখানে আর সংশয় থাকে না। দ্বাদশ শতকের কবি জয়দেবের ‘গীতগোবিন্দ’কে যাত্রা-নাট কিংবা নাটগীত হিসেবে আখ্যা দেয়া হয়। ষোড়শ শতকের প্রথম দশকে গৌরাঙ্গ মহাপ্রভুর কৃষ্ণলীলার অভিনয়কে যাত্রাগান মনে করার যুক্তিসঙ্গত কারণ রয়েছে। যাত্রার জন্ম নিয়ে সকল অভিমতকে আমলে নিয়ে আমরা এই সিদ্ধান্তে আসতে পারি যে, উৎসব-অর্থে যাত্রা-র উন্মেষ প্রাচীনকালে কিন্তু অভিনয়কলা-অর্থে যাত্রা-র উন্মেষ ষোড়শ শতকে, গ্রামীণ আসরে বা চাঁতালে। অষ্টাদশ শতকে যাত্রা চাঁতাল বা আসর থেকে উঠে আসে বাঁধামঞ্চে। অষ্টাদশ শতকের পর থেকে যাত্রা উৎসব কিংবা গীতাভিনয়ের আবরণ ঝেড়ে পরিণত হয় স্বতন্ত্র এক অভিনয়কলায়।ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, আসাম, উড়িষ্যা, ত্রিপুরা এবং বাংলাদেশেই যাত্রা-র চলন, বিকাশ এবং প্রবাহ। আমরা জানি, যাত্রা-র জন্ম এই সমতটে। অর্থাৎ আমাদের বর্তমান বাংলাদেশ ভূখণ্ডেই যাত্রা-র জন্ম। যাত্রা বাঙালির নিজস্ব সংস্কৃতি। যাত্রা শুরুতে ছিল দেববন্দনার অংশ, কালে তা পৌরাণিক উপাখ্যান বয়ানের মাধ্যমে লোকশিক্ষার মাধ্যম হয়ে উঠেছে। চারণকবি মুকুন্দ দাসের হাতে যাত্রা তার বিষয় ও উপস্থাপনার গুণে রূপান্তরিত হলো ব্রিটিশ-বিরোধী আন্দোলনের হাতিয়ার হিসেবে। পালাসম্রাট ব্রজেন্দ্রকুমার দে যাত্রাপালায় নিয়ে এলেন কাল্পনিক ইতিহাস, লোককাহিনী, জীবনী এবং সাম্প্রতিক সমাজিক উপাদান। যাত্রা হয়ে উঠলো সামাজিক বিনোদনের বিশাল মাধ্যম। এসব এখন জানা যায় ইন্টারনেট, গুগুলের মাধ্যমে। অনেক গ্রন্থ পাঠ করতে হয়। অরিন্দম বলে আপনার সাধনাকে কুর্ণিশ জানাই। পরিশেষে আজ গােপালাবাবু তার একমাত্র কন্যা অপরূপার জন্মদিনের আয়ােজন করেছেন বিপুল আয়োজনে । আজ তিনি সকলের সম্মুখে অরিন্দম ও অপরূপার বিবাহের ঘােষণা করবেন অরিন্দমের বন্ধু সুব্রত সকল ব্যবস্থার দায়িত্বে। | অপরূপার জীবনের শ্রেষ্ঠ দিন আজকে। আজ অরিন্দম তার একেবারে নিজস্ব হবে। সারাদিন সে কল্পনার জাল বুনে চলেছে। আজ সে বাধাহীন উচ্ছাসে আনন্দিত। কখনও গাইছে কখনও নাচছে। বনের ময়ূরী বর্ষার জলে সিক্ত হয়ে যেরূপ পেখম তুলে নৃত্য করে সেই আনন্দের নৃত্যে। সন্ধ্যা সাতটার সময় অরিন্দম তার পিতামাতাকে সঙ্গে করে নিয়ে এসে গােপালবাবুর গৃহে উপিস্থত হলো। গোপালবাবুর ব্যবহারে এবং বিনম্র আচরণে তারা খুব আনন্দিত হলে আরও খুশী হলেন অপরূপাকে দর্শন করে। | সানাই বাজিয়ে উদ্বােধন করা হল আসরের। গান গাইলেন গােপালবাবু এবং তার আজ মিলনের পথে নেই কোন বাধা। জীবনের দিন আজ এসে গেছে রাজা। অরিন্দম গানের মধ্যে ডুবে যায় কল্পনার সমুদ্রে। গােপালবাবু তার ফ্রেন্ড, অফার এ গাইড। সেই গােপালবাবব কন্যাকে সে আজ বিবাহ করতে চলেছে। একটা কথা অনুষ্ঠানের শেষে গোপালবাব অরিন্দমকে এবং অপরূপাকে ্পূর্ব পাশে নিয়ে তাদের আসন্ন বিবাহের পাকা কথা ঘােষণা করলেন। হাততালি বেজে উঠলাে। আজ অপর্ণার বিবাহ বিবাহ সিউড়ি শহরের বিখ্যাত পরিবারের প্রভাত ঘােষালের ছােটো পুত্র বাবুর সঙ্গে।সব সাজানো এবং শরণার্থীদের আপ্যায়ন কগ্রান্ত ব্যয় খরচ অশোক এবং শােভন দুই বন্ধুতে দায়িত্ব নিয়েছে। বরপক্ষ থেকে কোনাে দাবা নেই। তবু অশােকের পিতামাতা কন্যাকে সাজিয়ে দিয়েছেন। শোভনের ‘আজকে অন্য রূপ। সারাদিন সে আজ ব্যস্ত। এমনকি বাথিকার সঙ্গে দেখা করতে যেতে পারেনি। অশোক আহ্বান করছে। অশােকের নিজে। মাসী, পিসী ব্যতীত আছেন শােভনের বাড়ীর সকলে। অপর্ণার বাবা হিসাবে বীথিকা এবং তার পিতামাতা আর অরিন্দমের ভাবী শশুর এবং বধু হিসাবে গােপালবাবু এবং অপরূপা। অরিন্দম আজ চুড়িদার পাজামা পাঞ্জাবী আর অপরূপা লাল বেনারসী পড়ে এসেছে। যেন বিবাহের পূর্বে একবার মহড়া দিয়ে নিচ্ছে। অপর্ণার বান্ধবী বীথিকা আর দেবীকা দুজনেই কনে সাজাতে ব্যস্ত। এদিকে সুরেন্দ্র ক্যাটারার লাভপুর থেকে এসেছে। তাদের কাজকর্ম প্রায় শেষ। করে ফেলেছে। তাদের খাবার দাবারের আয়ােজন প্রায় শেষ। এখন বাকি শুধু বরের আগমন। বর এসে গেছে, বর এসে গেছে বলে চেঁচাতে লাগলাে বাচ্চা ছেলেমেয়েরা। বরকে কোলে করে তুলে বরাসনে বসালাে শােভন। বাবু ও শােভনের পরিচয় হতে বেশী সময় লাগলাে না। অপর্ণার আর একটি দাদা হিসাবে অশােক তাকে পরিচয় করিয়ে দিল। সুন্দর ব্যবহারে শােভন অভিভূত। অপর্ণার যােগ্য বর বাবু ঘােষাল। শােভনের মনটা প্রশান্তিতে ভরে উঠলাে। আজ অনেকদিন পর সে বিশ্বজয়ের মানসিকতা অর্জন করেছে। এমনিতে শােভন খুবই প্র্যাকটিক্যাল কিন্তু আজকের দিনে সে ভাবের আবেশে নিমজ্জিত। | দেবীকা ও বীথিকা মিলিতভাবে অপর্ণাকে প্রেজেন্ট করলাে একটি সুন্দর হারমােনিয়াম। অরিন্দম প্রেজেন্ট করলাে একজোড়া সােনার চুড়ি। গােপালবাবু দিলেন একটি দেওয়াল ঘড়ি। কিন্তু শােভনের প্রেজেন্ট সর্বাপেক্ষা আকর্ষণীয়। এক গােছা সাদা ফুলের তােড়া। অশােক আজ খুব কম কথা বলছে। শােভন এর কারণ বুঝতে পারছে না। কিন্তু অশােক আজ বেশী কথা বলতে চাইছে না। ভাবাবেগের ফলে হয়ত মনের বাসনা ভাষা হয়ে বেরিয়ে যেতে পারে। সে আজকে শােভনকে সারপ্রাইজ দিতে চায়। তাই সে শােভনকে এড়িয়ে চলছে। অশােক যখন দেবীকাকে আজকের সারপ্রাইজের কথা বললাে তখন থেকে দেবীকার মন ঠিক নেই। এ ব্যাপারটি বীথিকাও লক্ষ্য করেছে। সে বারবার দেবীকাকে খোঁচা দিতে ছাড়েনি। কিন্তু সঠিক কারণ বুঝতে পারেনি।যাইহােক বিবাহ কার্য সমাপ্ত হওয়ার পর বর কন্যা ঘরে প্রবেশ করার পূর্বে সকলের সম্মুখে অশােকের পিতা অশােক এবং দেবীকার বিবাহের কথা ঘােষণা করলেন। সঙ্গে সঙ্গে আসরে আনন্দের জোয়ার বয়ে গেলাে। শােভন ও বীথিকা হতভম্ব, বিহ্বল হয়ে পড়েছে। তাদের মুখে কোনাে ভাষা নেই, শুধু পরস্পরের প্রতি দুজনের মৃদু হাসির ঝিলিক। | ঘােষণা পূর্বের পরেই শােভন অশােকের পিঠে সজোরে আঘাত করে তাকে আদরে সিক্ত করে তুলল। শােভনের চোখে অশ্রু অশােকের চোখে পড়ল শােভনকে অভয় দিয়ে অশাের আর একবার তার সঙ্গে কোলাকুলি করল। আজ তাদের বন্ধুত্বের দৃঢ় বন্ধন হল। এ বন্ধন জন্ম-জন্মান্তরেও অটুট থাকবে। রাত্রিতে যখন সবাই নিদ্রাচ্ছন্ন কেউ ঘরােয়া আসরের গল্পে মত্ততখন কিন্তু শােভন এবং বীথিকা অশােকদের দোতলা ছাদের উপর ঘনিষ্ঠ ভাবে বলে তাদের সুন্দর অবকাশ যাপন করছে। ছাতে পূর্ণিমার আলাে উদ্ভাসিত। বীথিকা তাজমহলের রাগী সেজে বসে আছে। আর সম্মুখে শােভন কল্পনা প্রবণ শিল্পীর মতাে যেন তুলি হাতে দাঁড়িয়ে আছে। আজ অপর্ণার বিবাহ হয়ে গেল। অশােক ও দেবীকা বন্ধনে আবদ্ধ হল। কিন্তু শােভন বীথিকার পরিণতি কি হবে? তাদের মিলনের পথে যেতে আর কত পথ অতিক্রান্ত করতে হবে। বীথিকা তার বান্ধবী অপর্ণার কাছে জেনেছে কি পরিমাণ ভালাে সে শােভনকে বেসেছে। শােভন কিন্তু অন্য মানসিকতা নিয়ে তাকে দেখেছে তাও জানে। কিন্তু বীথিকা তার ভালােবাসায় শ্রেষ্ঠ পাত্র শােভনকে কিন্তু তিরস্কার করতে ছাড়ে না। সে শােভনকে জানায় ভালােবাসা কোনদিন কোনাে বাধা মানে না। জলের স্রোতের মত এগিয়ে চলে। কিন্তু শােভন কি করে বােঝাবে বীথিকাকে কোন চোখে সে দেখে? সে যে তার মনের গহন বনের অধিবাসী। তার প্রত্যেকটি অণু পরমাণু শােভনের জন্ম জন্মান্তরের চেনা। বীথিকা বিহীন শােভন জল ছাড়া মাছের মত এক মুহূর্তও বাঁচতে পারবে না। তবে তার কি ব্যবস্থা হবে? বীথিকা এই প্রশ্নের কোন উত্তর খুঁজে পায় না। কেবল শােভনের বুকে মাথা গুঁজে দিয়ে আনন্দে বিহ্বল হয়ে পড়ে। শােভন বীথিকার মিলনের পথে আর কোনাে বাধা নেই। শােভন বীথিকার জীবনে শান্তি আসুক আর সারা পৃথিবী শান্তির পরিবেশ গড়ে তুলক।।যাত্রাদলের শিল্পী অরিন্দম ভেবেছিল বড় যাত্রাশিল্পী হবে কিন্তু সে হতে পারে নি। রিপ্রেজেন্টেটিভ নাম করেছিল তার চিরকাল একলা সুরে হেঁটে গেছে সারা জীবন এক অজানা তুলিতে কে গেছে তা রঙিন জীবন।জীবনে সকলের স্বপ্ন পূরণ হয়না। কিন্তু হেঁটে চলে আমৃত্যু। তাকে হেঁটে যেতে হবে। হেঁটে যাওয়াই পথের নিয়ম। অংশুমান তার জীবনে কত জীবন দেখেছে কত চরিত্র দেখেছে তাদের ওঠানামা উন্নতি-অবনতি সবকিছু দেখে এসে আজ অভিজ্ঞ।তার বয়স হয়েছে তার ছেলে এখন সংসার চালায় কিন্তু তবু সে কর্ম করে নিজের উঠোনে গাছ লাগায় এবং বাগান পরিচর্যা করে সংসারের বাজার করে দেয় কিন্তু সে আজীবন সন্নাসীর মতো জীবন কাটায় । সৈকত জাপানে থেকে গেছে। সে জাপানে চলে গেছে এটা বেসরকারি সংস্থার কাজ নিয়ে সেখানেই তার পরিবার সেটল্ হয়েছে আর এখানে আসে না। বিশুর অনেক কথা মনে পড়ে তারা এখন কাটোয়া স্টেশনে বসে থাকে ছোটবেলার বন্ধুদের নিয়ে। তারা সকলেই বুড়ো হয়েছে। বয়স হয়েছে। এখন তারা কাটোয়া স্টেশনের প্লাটফর্মে আড্ডা মারে সেখানে বসে থাকে, সময় কাটায়।
সম্পাদকের নোট: এই উপন্যাসে শব্দসংখ্যা ৩৪,৬৭৫
পরিচ্ছেদ ৫ আকাশে এখন আর মেঘ নেই। হাওয়া হচ্ছে।কদিন পরেই বর্ষা নামবে।একদিন হাসপাতাল থেকে ফিরতে…..
পরিচ্ছেদ ৪ ভোর হয়ে আসছে।রাতে ভালো ঘুম হয়নি।ঘুমের ঘোরে মনে হচ্ছিল দম বন্ধ হয়ে আসছে।এরকম…..
পরিচ্ছেদ ৩ শীত শেষ হয়ে আসছে।রাঙ্গালীবাজনা ঢোকার মুখের রাস্তাগুলো পলাশ ফুলে ভরে গেছে।অথচ ঠান্ডাই।…..
দ্বিতীয় পর্ব মইদুল সারারাত এপাশ ওপাশ করেছে।রাতে মনে হয়েছিল প্রেসার বেড়েছে। হাইপ্রেসার আছে ওর বাবারও।বাড়ি…..