জীবনের ঘূর্ণাবর্ত

রুমা ব্যানার্জি
গল্প
Bengali
জীবনের ঘূর্ণাবর্ত

মুম্বাই এয়ারপোর্টে প্লেন নামার পরে ফোনটা অন করতেই একসঙ্গে বেশকটা মেসেজ ঢুকল টুং টাং করে। ঋদ্ধিমান একটু অবাক হল। হিসেব মত একটা ম্যাসেজই ঢোকার কথা, কলকাতা থেকে তার মায়ের।  মা’রা বোধহয় এমনই হয়, অজানা ধাতুতে গড়া!  এতবার করে বলার আর বোঝানোর পরেও কিছুতেই  শুনবে না। রোজ বাড়ি ফেরার খবর  নেবেই। আর ট্যুর থাকলে তো কথাই  নেই। নামার জন্য বড় লাইন পড়ে যাচ্ছে  দেখে সে ও উঠে পড়ল। এইবার ঋদ্ধিমানের  তিন চার দিনের ট্যুর, তাই লাগেজ বলতে একটা ব্যাকপ্যাক আর একটা হ্যান্ড লাগেজ ছাড়া কিছু নেই বিশেষ। তবে তাড়াহুড়ো না করলে অ্যাপ ক্যেবে বড় লাইন পড়ে যাবে, যদিও তাড়া যে বিশেষ আছে তা নয়। কে’ই বা তার জন্য অপেক্ষায় থাকবে? এক মা, মানে ঝিলমের মা, থাকতে পারেন, কিন্তু তিনিও তো ঘুমের ওষুধ খান, হয়তো ঘুমিয়ে  পড়েছেন।

একটু অপেক্ষা করতেই ঋদ্ধিমান পেয়ে গেল তার গন্তব্যের জন্য নির্ধারিত গাড়ি। উঠে বসতেই গাড়ি ছুটে চলল। এইবার ঋদ্ধিমান নিজের ফোনটা খুলে হোয়াট্সঅ্যাপ চেক করতে বসল। যথারীতি মা কলকাতা থেকে আরো কটা মেসেজ করেছে তাই চট করে একটা কল করে নিল। সে জানে যে তার গলাটা না শোনা অবধি মানুষটা নিশ্চিন্ত হতে পারবে না।

—মা, কি গো? এত গুলো মেসেজ করছো কেন? একটু ফ্রি না হয়ে কি কথা বলতে পারি?তুমিও কি আমায় বুঝবে না?

—‘না রে বাবু, বুঝিতো। কিন্তু  এতটা রাস্তা,চিন্তা হবে না? তার ওপর মেসেজ সিন হল কিন্তু জবাব দিলি না। তাই ভাবনাটা বেড়েই গিয়েছিল  রে।

—- আরে মা, প্রতি মাসেই তো আজকাল যেতে হচ্ছে। তাছাড়া  আমি তো আর নৌকা করে যাই নি ,শুনতেই আবু ধাবি, সময়  লাগে মাত্র ঘন্টা চার, চেক ইন টাইম একটু বেশি এই যা।

—- জানিতো । কিন্তু কি করি বল, মন মানে না যে। মা হওয়ার যে কি জ্বালা…একটা চাপা দীর্ঘশ্বাস পড়ল।

—- আচ্ছা বাবা,আচ্ছা। এখন তো নিশ্চিন্ত নাকি ?  ফোন রাখো। আগে খেয়ে নাও।বাবাকেও দিয়ে  দাও।  আমি বাড়ি  ফিরে, ফ্রেশ  হয়ে ফোন করব।

—-আচ্ছা  রাখ।

ঘড়ি  দেখল তখনো প্রায় চল্লিশ মিনিট লাগবে পৌঁছাতে। তাই  অভ্যাসবশত  ফোনটাই নাড়া চাড়া করতে লাগল।দু চারটে হাই, গুড ইভনিং আর গুড নাইট আর…  ঝিলমের বাবার ম্যাসেজ!! উনি তো কখনো মেসেজ করেন না। কিছুটা অবাক হল ঋদ্ধিমান।  ছোট্ট, টু দি পয়েন্ট  মেসেজ।

–” আমরা কলকাতা যাচ্ছি। কেয়ার টেকারের কাছে ফ্ল্যাটের চাবি আছে। আলমারির  চাবি রয়েছে দরজার বাম দিকের ফুলদানির মধ্যে।  ফ্রিজে খাবার রাখা আছে।”

***

একটা চাপা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এল বুক থেকে। একা ঘরে থাকতে বড় কষ্ট হয়। ওনারা কিন্তু  সেটা জানেন তাও চলে গেলেন? তা যান,একটু চেঞ্জ হলে ওনাদের ও ভাল লাগবে। কিন্তু  ঝিলমের কথা কিছু লেখেন নি। অবশ্য বিগত বেশ ক’মাস ঝিলম এমনিতেই উইকএন্ড গুলো কাটায় বন্ধুদের বা বলা ভাল বন্ধুর সঙ্গে। ঝিলমের মনে তার জন্য জায়গা নেই, এই সরল সত্যিটা ঋদ্ধি জানে, কিন্তু  মানতে পারে না। জীবন কেমন পাল্টে যায়,না? একসময় শুধু সপ্তাহের শেষটা এক সঙ্গে কাটাবার জন্য দুজনে কত উদগ্রীব হয়ে থাকত।  কতটা পথ পাড়ি  দিত শুধু একটু একান্তে থাকবে বলে।  এমনকি বিয়ের পরে এই সাত আট বছর একটা উইকেন্ডও ওরা বাড়ি  থাকতো না। সিনেমা,শপিং,ডিনার, নেমন্তন্ন ,ছোট ট্যুর লেগেই থাকত কিছু না কিছু ।ঝিলমের ভালো লাগাই তার ভালো লাগা, ঝিলমের খারাপ লাগাই তার খারাপ লাগা হয়ে উঠেছিল। একটা ঘোরের মধ্যে কেটেছে। ঝিলমের মুখ একটু ভার দেখলেই টনটন করে উঠেছে ঋদ্ধির বুক।  ঝাঁপিয়ে পড়েছে যতক্ষণ না মুখে হাসি ফুটছে। এমনকি  ঝিলমের বাবা মা কবে যেন তার বাবা মা হয়ে উঠেছে। স্রোতের বিপরীতে ভাসা তাই স্বাভাবিক ভাবেই সমালোচনা কম শুনতে হয় নি। ঋদ্ধি কাউকে বোঝাতে পারেনি যে ভালবাসায়  সে সবকিছু ছাপিয়ে যেতে প্রস্তুত। সে চোখের সামনে দেখেছে তার মা কে গুমরে গুমরে জীবন কাটাতে। কোন প্রতিকার করে উঠতে পারেনি। পারেনি প্রতিবাদ করতে । তাই এই  সমর্পণ তার নিজস্ব ,একান্তই নিজের প্রায়শচিত্ত।

ঋদ্ধিমান এমনিতেই একটু মুখ চোরা তাই স্বাভাবিক ভাবেই তার বন্ধুর সংখ্যা কম আর এই নতুন শহরে তো নেই বলা যায় । যারা আছে তারা নতুন বা পুরানো সহকর্মী  মাত্র। আর আপনজন বলতে ঝিলম আর ঝিলমের বাবা মা। অবশ্য এক মামাতো দিদি থাকে, তবে যোগাযোগ বলতে দু একটা ফোন  করে কেমন আছো? ভাল আছি। ব্যাস এইটুকুই।  কিছু দিন আগে  যখন ঝিলম একটা ভালো অফার পেয়ে এই শহরে আসবে ঠিক করে তখন সে নিজের চাকরির পরোয়া না  করেই,সব ছেড়ে এখানে চলে আসে।  ঝিলমের কথায় ঝিলমের বাবা মাও আসেন তাদের সঙ্গে। সত্যি তো,ওনাদের বয়স হয়েছে, ছেলেও নেই, মেয়ে ছাড়া কেই বা দেখবে। তখন কিন্তু ঋদ্ধিমান একবার ও ভাবেনি যে সেও তার বাবা মার একমাত্র সন্তান, বাবা মা কি করে থাকবে একা একা। তার বাবার চোখে ছানি পড়েছে, হাই সুগার তাই অপারেশন হচ্ছে  না। মা আর্থারাইটিসে কাবু। তবুও মা হাসি মুখেই বলেছিলেন ” সংসার টা দুজনের, মেয়েরাই তো চিরকাল নিজেদের জায়গা  ছেড়েছে, এবার নাহয় তুই ছাড়লি।এক সঙ্গে থাকতে হলে কাউকে তো  কিছুটা ছাড়তেই হবে। তুই যা। ভালো থাকিস।” বাবা ছিলেন নির্লিপ্ত, ছেলের এই “বৌ কে নিয়ে ন্যাকামি” তে বিরক্ত।

সেলস্ নিয়ে  এম.বি.এ, তাই  নিজের  ক্ষমতার ওপরে বিশ্বাস ছিল ঋদ্ধির, ভেবেছিল ঠিক ভাল কিছু পেয়ে যাবে। কিন্তু  বিধি বাম। যুতসই চাকরি মিলল না। এখনতো আর ঘুরে ঘুরে চাকরি খোঁজার দিন নেই তাই ঘরে বসে নেটেই চেষ্টা চলল। আড়ালে এই চেষ্টার নতুন নামকরণ হল  …কুঁড়েমি।  প্রথম ক’মাস যেতেই সব কেমন পাল্টে যেতে লাগল। একটা বহুজাতিক কোম্পানির মোটা মাইনের চাকরির অভাবে সম্পর্ক গুলো কেমন যেন আলগা হতে শুরু করল।  বিয়ের এতগুলো বছর পর হঠাৎ তার কথা বার্তা, চলা ফেরা, ওঠা বসা এমনকি খাওয়া  শোয়াও যেন দোষের হয়ে পড়ল। সে অলস, সে ঘরের কাজ করে না,বাইরে গিয়ে কাজ করার ক্ষমতা নেই, সে সমাজে মেশার অনুপযুক্ত .. কত শত অভিযোগ ! এতদিনে ঝিলমের মনে হচ্ছে সে নাকি প্রেজেন্টেবল নয় অথচ ওদের প্রেম করেই বিয়ে …। তার যে এত বদগুণ সে নিজেও জানত না।ঝিলমের একটাই কথা সে মুক্তি চায় এই দম বন্ধ করা পরিস্থিতি থেকে।  প্রথমের দিকে নিজেদের মন মালিন্য কে সে  বেশি গুরুত্ব দেয় নি। ক’দিনেই  কথা এসে থেমেছিল শুধুই  একটি শব্দের  মধ্যে, হুম বা না । অনেক চেষ্টা করেও সেই নিঃশব্দতা কাটাতে পারল না ঋদ্ধি  কিছুদিন পর থেকে এইটুকু কথাও হত না। অনেকদিন আগেই তার ঠাঁই হয়েছিল বাইরের ঘরে সোফায়, সঙ্গী  তার ল্যাপটপ। তবুও আঁকড়ে পড়েছিল ঋদ্ধি ঠিক যেমন ঝরে পড়ার আগে বিবর্ণ পাতাটা প্রাণপণে আঁকড়ে থাকে  বাকল খসা ডালটাকে কোন এক চমৎকারের আশায়।

নিজের মন কে বোঝাতো… দিন তার ফিরবেই, তখন  ঝিলমের মন ফিরবে… ঝিলম ফিরে আসবে তার ভালবাসার কাছে । কিন্তু  ঋদ্ধি বুঝতে পারছিল তাদের মধ্যে  যোজন  যোজন দূরত্ব আর সেখানে অনুপ্রবেশ ঘটেছে তৃতীয় ব্যক্তির । বুঝলেও মানতে পারছিল না। এই সম্পর্কের  কটুতা সংক্রামিত হয়েছিল অন্য সম্পর্কেও । নিজের সব খুইয়ে  শুধু সম্পর্কে টা কে বাঁচানোর জন্য  ঋদ্ধি পা’য়ও ধরেছিল। কিন্তু  হিতে বিপরীতে হল। ঝিলম বাড়ি  ফেরাই বন্ধ করে দিল। স্বাভাবিক ভাবেই দোষ পড়ল তার ঘাড়েই।ওনারাই অনেক কাকুতি মিনতি করে ফিরিয়ে আনলেন ঝিলমকে।

বিভিন্ন  কটুবাক্য  শোনা থেকে রেহাই পেতে ঋদ্ধি কাছের একটা মলে বসে থাকত সারাদিন। ওখানকার ওয়াই ফাই ব্যবহার করে কাজ খুঁজত।  কখনো একান্তে জীবনের অঙ্কটা মেলাতে চেষ্টা করত। মা বার বার বলত– ” তোর দোষ একটাই  তুই  তোর সর্বস্ব দিয়ে  ভালবেসেছিস, যে কোন মূল্যে ঝিলমের সঙ্গে থাকতে চেয়েছিস। সম্পর্ক একতরফাভাবে  হয় না রে। এভাবে জোড়া তালি দিয়ে  বেঁধে রাখতে পারবি না।  যেচে সাহাগ পাওয়া যায়  না “

রোজ ঋদ্ধি ফিরত রাত করে। সবার চোখ এড়িয়ে ঝিলমের মা দেখে যেতেন সে খেল কিনা… এটাও যে তার অনেক পাওয়া। ঋদ্ধি ফিরত একটু বেশি রাত করে। যাতে ঝিলমের মুখোমুখি না হতে হয় ।

আশ্চর্য লাগে ভাবতে। এই ব্যস্ত জীবনের গতিতে যখন সবাই ছিটকে যাচ্ছে সবার থেকে  তখন তার একমাত্র অবলম্বনটাও সরে গেল। ঋদ্ধি অনেক আগেই  বুঝতে পারছিল যে একটু একটু করে তার জীবনটা আঙুলের ফাঁক গলে পড়ে যাচ্ছে, হারিয়ে  যাচ্ছে… সে অসহায়ের মত শেষ আশ্রয়টাকে আঁকড়ে ধরে থাকতে চেয়েছিল। জীবনের কমা, সেমিকোলেন সামলাতে সামলাতে কখন যে পূর্ণ ছেদ পরে যাবে সেই আশংকায় রোজ একটু একটু করে শেষ হয়ে যাচ্ছিল। ইতিমধ্যে একটা ঠিকঠাক চাকরি সে পেয়ে গেল। সেই সুত্রেই এই বিদেশ যাত্রা।

গাড়ি এসে পৌঁছালো নির্দিষ্ট ঠিকানায়। কেয়ার টেকারের কাছে চাবি নিতে গেল সে বলল..

“ম্যেইডাম উনকে পতি কো চাবি দেনে কো কাহা।  আপ কৌন?”

–” ম্যায় উনকা পতি।”

— আপ পতি হো তো উহ সাহাব কৌন থে?”

বুকটা ধড়াস করে উঠল।কথা না বাড়িয়ে ঋদ্ধি হাঁটা দিল।

চাবি ঘুরিয়ে দরজা খুলে লাইট জ্বলাতেই সেই নরম আলোয় হাহাকার এসে গলা জড়িয়ে ধরল। ফ্ল্যাট ফাঁকা। ঝিলমরা নিজেদের জিনিসপত্র নিয়ে  অন্য কোথাও সিফ্ট করেছে। জীবনের পথে এগিয়ে গেছে ঝিলম। পিছনে পড়ে রইল একা ঋদ্ধি ও তার নিঃসঙ্গতা আর তার আঙুল ছুঁয়ে এক বুক হাহাকার। মাথায়  বাজ ভেঙে পড়ল যেন। কি করবে বুঝতে না পেরে প্রথমেই সে ফোন করল ঝিলম কে…. ফোন বেজে চলল। হেরে যাওয়ার গ্লানিতে  দুচোখ ভিজে গেল।  ফোন কেটে দিয়ে ফোন করল কলকাতায়।

মা ফোনের অপেক্ষায়  ছিল তাই একটা রিং  হতেই ধরল–‘ হ্যাঁ  রে বাবু , বল…খেয়েছিস?

কাঁপা  গলায়  ঋদ্ধি  বলল– মা ওরা আমাকে ছেড়ে  চলে গেল…আমাকে নিঃস্ব করে চলে গেল…

— কি বলছিস? কে চলে গেছে? কোথায়  চলে গেছে?

— জানি না মা। বাড়ি  খালি।ওরা নেই, ওদের জিনিসপত্র নেই, কেউ কোথাও নেই।

অসহায় বাচ্চার মত হাউ হাউ করে কাঁদছে  ঋদ্ধি ।

ঋদ্ধি  মনে মনে বলল—- ত–তুমি সব শেষ করে দিতে পারলে? তোমার কপালের ছোট্ট টিপ, জলছাপ ঠোঁট, মেঘলা আকাশ চুলের কপালে এ খেলে বেড়ানো…এ সব তো আমার ছিল। সব মুছে আম—মাকে এমন কাঙাল করে দিতে পারলে?”

এতদিনের জমানো অপমান বাঁধ ভাঙা  স্রোতে চোখ  বুক ভাসিয়ে  দিচ্ছে । সব হারিয়ে  মাটিতে বসে পড়ল ঋদ্ধি ।  সারা শরীরে তার অপমানের জ্বালা ।

–বাবু, শোন ফোন ধরে থাক । কাটবি না। কথা বল আমার সঙ্গে ।বাবার সঙ্গে  কথা বল।

— না মা।  আমি অপদার্থ। আমি হেরে গেলাম মা। বলে ফোনটা কেটে দিল  ঋদ্ধি ।

দু ‘তিন মিনিট  পরে ফোনটা আবার বাজল। বড়দি কলিং। কথা বলার মত মনের অবস্থা  নেই তাই কল রিজেক্ট করল। আবার কল আসছে। আবার কল রিজেক্ট করল ঋদ্ধি । কিন্তু  দিদিও নাছড়বান্দা বার বার ফোন করেই যাচ্ছে ।এবার বাধ্য  হয়ে  ফোন ধরল। অতি কষ্টে  বলল

— দিদি আমি একটু ব্যস্ত আছি। পরে কথা বলব।

— জানি, পাপাই বাইক নিয়ে  যাচ্ছে।  তোকে পিক আপ করে নেবে।

— আমি যেতে পারবনা। তুই জানিস না…

—- সব জানি। কথা বাড়াস না। মণিমার সঙ্গে  কথা হয়েছে । লজ্জা করছেনা ভ্যাঁভ্যাঁ করে কাঁদতে? শক্ত হ, কাঁদলে দুর্বল হয়ে পড়বি। এবার তোর ঘুরে দাঁড়ানোর সময়। কথা না বাড়িয়ে    দরজায়  তালা দিয়ে, গেটের সামনে এসে দাঁড়া। পাঁচ মিনিটের মধ্যে  পাপাই পোঁছে যাবে। পাপাই এর নাইট সিফ্ট চলছে। তোকে ড্রপ করে আবার ফিরবে।সঙ্গে  জলের বোতল আছে? থাকলে একটু খেয়ে  নে। এখন রাখছি, এলে কথা হবে।”

মেঝে থাকে উঠে দাঁড়াল ঋদ্ধি , মেঝে আঁকড়ে পড়ে থাকা ছায়াটা তখনো হাহাকার করছে।বুকে একটা দম বন্ধ করা কষ্ট হচ্ছে ,এতদিন ধরে টিম টিম করে জ্বলতে থাকা আশার প্রদীপ টা এখন   নিবে গেছে, হৃদয়ের সলতে জুড়ে  পড়ে আছে শুধু কালি আর যন্ত্রণা । বিধ্বস্ত জীবনের একটা অধ্যায়ের ওপর তালা বন্ধ করে নেবে এল ঋদ্ধি ।যাত্রা শুরু হল এক নতুন  পথে ।  একা, একদম একা।

***

বেশ ক’সপ্তাহ ধরেই  তোড়জোড়  চলছিল, কিন্তু একদম গোপনে। আজ সেই সুযোগ এসেছে।  এতদিনের যন্ত্রণার ইতি হবে। ঋদ্ধি  যে কাজে বাইরে যাবে সে খবরটা পেয়ে থেকেই ঝিলম মনে মনে তার পরবর্তি কাজের ছক কষে ফেলেছিল। সেই মত প্যাকার্স কেও বলে রেখেছিল। নতুন  ফ্ল্যাটের রেন্ট  আগাম দিয়ে রেখেছে সেই কবেই।একটু বেশি পড়ে গেল ঠিকই  কিন্তু উপায় ছিল না। আসলে এই শহরে মনের মত ফ্ল্যাট পাওয়া  সহজ কথা নয় ।  তাকে এই ফ্ল্যাটটা খুঁজে পেতে খুব সাহায্য  করেছে রোহন। রোহন ঝিলমের টিমেই কাজ করে। ঝকঝকে চৌখশ একটা ছেলে। ঝিলমের থেকে কিছুটা ছোট।কিন্তু  কি শার্প।সব কিছু একদম নখ দর্পণে। সারাক্ষণ  বিভিন্ন রকম অঙ্গ ভঙ্গি করে কথা বলে। যতক্ষণ থাকে মাতিয়ে রাখে।এ হেন রোহন যখন শুনলো যে ঝিলম বাড়ি সিফ্ট করবে অমনি নিজেই উপযাচক হয়ে ব্রোকার কে বলে টলে  একগাদা  ঠিকানা  নিয়ে  উপস্থিত ।ঋদ্ধি  কে বলে বলেও নড়ানো যায়  না খালি করছি করব করতে থাকে  আর এ তো ধরে আনতে বললে বেঁধে এনে হাজির  করে। তবে মনে মনে ঝিলম স্বীকার করে যে ছেলেটা ভীষণ ভীষণরকম এফিশিয়েন্ট। ইস্ ঋদ্ধিটা যদি এর দশ শতাংশ  হত তাহলেই ঝিলম বর্তে যেত।

রাতটা কেটেছিল কিছুটা উদ্বেগ নিয়েই। সেটাই স্বাভাবিক। জীবনের একটা বড় পদক্ষেপ নিতে চলেছে সে। অবশ্য এটা খুব জরুরী হয়ে পড়েছিল। একটাই তো জীবন,  এইভাবে গুমরে গুমরে জীবন চলে না।এমনিতেই জীবনের অনেকটা সময়  নষ্ট হয়ে গেছে। কিন্তু আর না। যথেষ্ট হয়েছে। এত বড় সাহস  যে ঝিলমের ভাড়া করা ফ্ল্যাট থেকে ঝিলম কেই বলে বেরিয়ে  যেতে। সেইদিন ঠিক করে নেয়,  আর না। হয় ইস পার নাহয় উস পার।

***

ঝিলমের সঙ্গে যখন ঋদ্ধিমানের বিয়েটা হয় তখন বাড়িতে যে একদম অমত ছিল না তা নয় । কিন্তু  ঝিলমের ঐকান্তিক ইচ্ছেকে চিরকাল প্রাধান্য দিয়েছে তার বাবা মা। তাই অসম জেনেও তাঁরা রাজি হয়ে ছিলেন, যাই হোক ছেলেটা যে ভাল তা নিয়ে কোন দ্বিমত ছিল না। প্রথমটা সব নতুন দম্পতির মতই ঠিকই ছিল। প্রেম ভালবাসা কোন কিছুরই খামতি ছিল না। এখন অবশ্য  সেই দিনগুলি কে আদিখ্যেতা ছাড়া কিছু মনে হয় না। যাই হোক সেই আদিখ্যেতার  ঘোর কাটতে সময় লাগেনি। ওরা যেন বিপরীত মেরুর মানুষ। বাড়ির পরিবেশ অস্বাস্থকর,  বাড়িতে যেন সারাক্ষণ যুদ্ধ চলছে, সবাই সবার ওপর চেঁচিয়ে কথা বলে, সবার মেজাজ সব সময় সপ্তমে চড়ে থাকে। এমনকি ঋদ্ধিমান ও সাংঘাতিক মেজাজী। পান থেকে চূন খশলেই হল, অমনি তাণ্ডবনৃত্য শুরু। তাও ভালো যে সারাদিন  কাটে অফিসে, এই পরিবেশ থেকে দূরে। সকালে ঘুম থেকে উঠেই তৈরী হয়ে বেরুনো আর রাত দশটায় ক্লান্ত হয়ে ফেরা। অফিস থেকে পিকআপ আর ড্রপ, শুধু শুক্রবার গাড়ি নিয়ে যায়, তাতে ছুটির দুদিন ঘুরতে ফিরতে সুবিধা হয়। বাড়ি ফিরেও যে দুটো নিজেদের মধ্যে কথা বলবে তার উপায় নেই, ঋদ্ধি সারাক্ষণ হয়  ল্যাপটপে মুখ গুঁজে পড়ে থাকে না হলে মোবাইল নিয়ে। শুধু খেলা হলে ঋদ্ধির আর কিছু চাইনা। যে খেলাই হোক, তা ক্রিকেট ফুটবল হোক বা কুস্তি। লুডো কম্পিটিশন হলেও বোধহয় সেটাও দেখবে। এ ছাড়া  আর একটা জিনিস  ঋদ্ধি ভালবাসে… খেতে।ঝিলম কয়েকবার ছুটির দিনে রান্না করেছে কিন্তু একটুও প্রশংসা পায়নি।তবে হ্যাঁ,  চেটেপুটে খেয়েছে। সবথেকে মুশকিল হত শপিং করতে গেলে।

স্ত্রী শপিং করলে কোন স্বামী আবার সঙ্গে  যায় না? হ্যাঁ,  এটা ঠিক যে ঝিলম একটু খুঁতখুঁতে তাই চট করে কিছু তার পছন্দ হয় না। একটু দোকান ঘুরে ফিরেই কেনা কাটা করে।কিন্তু  সে কি বিরক্তি!!!একটু ট্রলি ঠেলে গাড়ি অবধি আনতেও সে বিরক্ত, কি অসহ্য মুখের ভাব দেখলেই গা পিত্তি জ্বলে যায়  ।সেই বিরক্তি মুখ ছাপিয়ে  ছড়িয়ে পড়ত মনে। বিরক্তি প্রকাশ পেতো ঋদ্ধির কথায়, ব্যবহারে। মন খারাপ হয়ে যেত ঝিলমের।কিছু কিনতে গেলেই শুনতে হত… আরো কিনবে? কি হবে এত বাজে খরচ করে। ঝিলম ভাবত নিজের পয়সায়  কিনলেও এত কৈফিয়ত  কেন দিতে হবে? রোজগার করাই তো ভালো থাকা,  ভাল পরার জন্য … ঝিলম কোনদিন কথা কাটাকাটি পছন্দ করত না তাই স্বাভাবিক ভাবেই অভিমানে  চুপ করে যেত।এই চুপ করে যাওয়ার ভাষা ঋদ্ধি কখনো বুঝতে চেষ্টাই করেনি।তবে যখন চোখে জল আসত তখন ছটফটিয়ে উঠত সে। তখন চাইলে চাঁদ এনে দেয় এমন অবস্থা ।সব মিলিয়ে মনে ঊষ্মা জমা হচ্ছিল। তার মধ্যে চলছিল “বাচ্চা ” চাই গোছের কল্পবিলাস। চাইলেই তো আর হল না,  একটা বচ্চা  মানুষ করতে কত খরচ কোন ধারণাই নেই  ঋদ্ধির। ঝিলম ও সাফ জানিয়ে  দিয়েছিল যে এখন সে বাচ্চা নেওয়ার কথা দুঃস্বপ্নেও ভাবতে পারছে না।সবার আগে প্রয়োজন একটা ছিম ছাম , সাজিয়ে গুছিয়ে, হাত পা ছড়িয়ে থাকার মত পছন্দসই  ফ্ল্যাট । কিন্তু  তা হল কই?সব তো ওই গুষ্টির পেছনেই বেরিয়ে যায় ।তাতেও আপত্তি ছিল না ঝিলমের।

ঝিলম ভাবে–“যা চাই সব এনে দিচ্ছি, কিন্তু তাই বলে নিজের সবটা দিতে হবে এটা কেমন কথা?সারাজীবন কি চাওয়া পাওয়ার  নাগর দোলায়  দুলব?  সেই কবে থেকে চাইলেই শুনতে হয়েছে ওটার দিকে নজর দিতে নেই । ওটা দামী । নিজের দমে, এতদিনে নিজের সামর্থ হল তাও  শুধু একদল লোকের সুবিধা  দেখে শখ আহ্লাদ  বিসর্জন দিতে হবে। সেটাও মেনে নেবার চেষ্টা করেছিল ঝিলম । ভেবেছিল দুজনে রোজগার করে সব সামলে নেবে। কিন্তু  ঋদ্ধি তা হতে দিল না। কিছুটা নিজের দোষে , কিছুটা উচ্চাকাঙ্খার অভাবে একের পর এক চাকরি ধরতে ও ছাড়তে লাগল ঋদ্ধি । ফলে সব দায়িত্ব এসে পড়ল ঝিলমের ওপর।প্রয়োজনের তাগিদে সাধের ভালবাসা জানলা গলে পালাল।ভালবাসা তখন শুধুই  স্মৃতি।  সেই স্মৃতির জমা নোনা জলের  উজান স্রোতে কচুরিপানার মত ভেসে গেল দুটি  ছিন্ন বিচ্ছিন্ন হৃদয় ।

একদিন  যে সম্পর্কের শিকল কে নূপুর ভেবে গ্রহণ করেছিল সেই ভালবাসার  বন্ধনে শ্বাস আটকে আসছিল ঝিলমের।এই বোঝা বইবার ইচ্ছে আর ক্ষমতা  দুটোই  তলানিতে ঠেকেছিল। সম্পর্ক ক্ষয়ে ক্ষয়ে অবশিষ্ট ছিল শুধু জং ধরা লোক দেখানো  ছায়া।যাপিত জীবন হয়ে উঠেছিল অসহ্য । অথচ ঋদ্ধি তার এই ক্ষয়ে যাওয়াটা বুঝতেই  পারছিল না ।এক সঙ্গে  এক ছাদের তলায়  থাকাটাই তার কাছে  শেষ কথা।  ওর মতে ম্যেরেজেস আর মেড ইন হেভেন !!!মাই ফুট!! এর নাম নাকি সংসার!!এমন একজন বেকার পুরুষ, যাকে নিয়ে পাঁচ জায়গায় পরিচয় দেওয়া  যায় না, সুখ দুঃখ ভাগ করা যায়  না তার সঙ্গে কি সংসার করা যায়? এমন নিস্পৃহ অলস দুটি হয় না। এই সম্পর্ক থেকে ঝিলমের প্রাপ্তি  শুধুই হতাশা। নেট ফল শূন্য!!জীবনের এত গুলো বছর আঙুলের ফাঁক দিয়ে  গলে বেরিয়ে  গেল, এ আফসোস  কোথায়  রাখবে সে?

ঝিলম বোঝাতে কম চেষ্টা করে নি। ঠান্ডা মাথায় বুঝিয়ে বলেছে — “দেখো একটাই জীবন আর সেটা আমি ফুরিয়ে যাওয়া  প্রেমের নামে কম্প্রোমাইজ করে কাটাতে পারব না। যদিও অনেক গুলো বছর নষ্ট হল, তাও বেটার লেট দ্যেন নেভার। তুমি আমাকে মুক্তি দাও। লিভ এন্ড লেট লিভ। তুমি তোমার মত থাকো, আমাকে আমার মত করে বাঁচতে দাও”। যেই শোনা ,ব্যাস  শুরু হয়ে যেত ন্যাকামো,সে নাকি একা একা বাঁচবেনা। তাকে যা বলা হবে তাই করবে, যেভাবে চলতে বলবে ঝিলম তাই চলবে। ঝিলমের অবাক লাগে । ঋদ্ধি তো একজন স্বনির্ভর  পুরুষ, তার একটা ডিগনিটি থাকবে না? আত্মশ্লাঘা না থাক আত্মসম্মান  বোধ  থাকবে না?মানুষ হয়ে যদি মান টাই না রইল তাহলে তো সে কীটপতঙ্গের সামিল। মনে মনে বলে” তুমি আমাকে ছাড়া বাঁচবে না?যেচে সোহাগ নেবে? এটা কি হয়?  যে যার মনের ধ্বংসস্তুপে বাঁচে। আমি আমার মত, তুমি তোমার মত। কিন্তু  আমি সেই  ছাই এর স্তুপ থেকে ফিনিক্স পাখির মত ঠিক জেগে উঠব। খাঁচায় বদ্ধ থাকার জীবন আমি অস্বীকার করবই। বেদনার ঋণ আমার শোধ হয়ে গেছে। এবার আমি নিজের শর্তে  খোলা আকাশে বাঁচব।”

***

ঝিলম্ কম্প্রোমাইজ করে নি। হাজার কাকুতি মিনতিতেও মুখ ফেরায় নি। ঋদ্ধি  কে লুকিয়ে  চলে এসেছিল।বলা ভাল পালিয়ে  এসেছিল।মুখোমুখি দাঁড়িয়ে , সজোরে বুকে আঘাত করতে বোধহয়  বেঁধেছিল।খবর পেত মাঝে মধ্যে। কোন রকম ভনিতা না করে তার পাঠানো কাগজে সই করে দিয়েছিল ঋদ্ধি। কোর্টে শেষ দেখা, বিয়ের হীরের আংটিটা ঋদ্ধির হাতে ধরিয়ে  দিয়ে সে জীবনের দিকে হেঁটছিল।আর ফিরে তাকায় নি।

মাঝে মাঝে কাছের বা দূরের লোকেদের কাছ থেকে খবর পেত ঋদ্ধির । সে পথ বন্ধ করতে সবার থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলেছিল নিজেকে। স্বচ্ছা নির্বাসন নিয়েছিল। একটা দ্বীপে  থাকার মত করে  গড়ে তুলেছিল নিজের একটা একলা জগৎ। ঠিক একলা বললে ভুল বলা হয় । নানা সময় নানা মানুষ  এসেছিল। কেউ বাড়িয়ে ছিল বন্ধুত্বের  হাত , দিয়েছিল   সাহচর্য।    কখনো মানসিক  কখনো বা জীবনের নিয়ম মেনে শারীরিক ।কাউকে আবার দরকার হয়েছিল   এই বহু জাতিক কোম্পানির শীর্ষে  উঠতে।  তখন চেপে বসেছিল জেতার লিপ্সা, যেন তেন প্রকারেণ সাফল্যের হাত ধরতেই হবে।  অনেকেই  এসেছে আবার খড়কুটোর মত ভেসে গেছে। যতদিন গেছে মানুষের থেকে নেকড়ের দেখাই মিলেছে  বেশি।তবে টুকটাক দু চারজন ব্যতিক্রমী ছিলনা তা নয়। কিন্তু  কেউ সেভাবে মনে দাগ কাটেনি ।  সামনে শুধুই  উজ্বল ভবিষ্যতের হাতছানি । একদিন যারা তার এই শিকল কাটা কে মেনে নিতে পারে নি তারাও তখন ঝিলম কেই তুলে ধরেছে উদাহরণস্বরূপ ।ঝিলম জয়ী । যা তার প্রাপ্য তা সে অর্জন করেছে নিজের একে প্রচেষ্টায়। জীবন কে     উচ্চ স্বরে বলে — জীবন এই বেলা জড়িয়ে ধরো। পরে যদি সুযোগ না পাও, যদি ফাঁকি পরে যাও…. সময়  থাকতে বেঁচে নাও।   তবুও…হ্যাঁ একটা ‘তবুও’ কুরে কুরে খায় বইকি….

***

এই ভাবে দিন গড়িয়ে মাস, বছর কেটে গেছে।সময়-নদীর বুক দিয়ে  ভেসে গেছে কত ঘটনার শ্রোত। আজকাল বড্ড ক্লান্ত লাগে ঝিলমের। তার একমাত্র আশ্রয় এখন এই মেঘ ছোঁয়া বহুতল বাড়ির বারান্দাটা। কফির কাপ হাতে দাঁড়িয়ে থাকে এখানে ঝিলম। নীচে হাঁটতে থাকা মানুষ গুলো এখন তার অচেনা। ওদের হাতে হাত জড়িয়ে হাঁটা, বা দুরন্ত বাচ্চার পিছনে বাবা মার দৌড়  বুকটা কেমন যেন ভারি করে তোলে।  একটা ভরসার কাঁধ বড় প্রয়োজন  মনে হয় ।হঠাৎ  করেই,থেকে থেকেই পা টিপে টিপে মনটা পেছু হাঁটে… ফিরে যেতে চায় মুছে ফেলা দিনে। অথচ সে জানে নালিশ করার কিছু নেই। কেউ ঘরের কোণে একলা কেউ বা ভিড়ে একলা, যেমন এত পাখি থেকেও  আকাশ কিন্তু  একলা, নদীর উথাল পাথাল ঢেউ এ ভাসতে থাকা  নৌকা টাও একলা আবার দাঁড় হাতে মাঝিও একলা।ঝিলম এখন উপলব্ধি করে যে সুখের খোঁজে বেরিয়ে পড়ছিল, যে অলীক সুখের  খোঁজে একা পাড়ি দিয়েছিল জীবন দরিয়ায়  আজ তার সবটাই ধরা ছোঁয়ার বাইরে  চলে যাচ্ছে।না  বলা কথাগুলোয় মরচের দাগ ধরেছে। একটা কথাও শোনার সময়  বা ইচ্ছে নেই কারুর। এখন মনে হয় মুক্তি নয় একটু বন্ধন হলেই বোধহয় ভাল হত।

যখন পড়বে না মোর পায়ের চিহ্ন এই বাটে,
আমি বাইব না মোর খেয়াতরী এই ঘাটে,
চুকিয়ে দেব বেচা কেনা,
মিটিয়ে দেব গো, মিটিয়ে দেব লেনা দেনা,
বন্ধ হবে আনাগোনা এই হাটে–
তখন আমায় নাইবা মনে রাখলে,
তারার পানে চেয়ে চেয়ে নাইবা আমায় ডাকলে।

আশেপাশে কোথাও এই গানটা বাজছে….এই গানের সঙ্গে জড়িয়ে আছে অনেক স্মৃতি । ঝিলমের মনটা কেমন হু হু করে উঠল।এটা ঋদ্ধির খুব প্রিয় গান।সারাক্ষণ এটাই গুণ গুণ করত। হঠাৎ মনটা কেমন যেন মুচড়ে উঠল। নিজেরই অবাক লাগল ঝিলমের , নিজের ওপর বিরক্ত হল, মনে মনে বলে উঠল — “এখনো এই গানটা কানে গেলে  আমার মনটা আছন্ন হয় !!! কিছুতেই কি পিছু ছাড়রে না ওর স্মৃতি?? কি জানি কেমন আছে? একবার ফোন করে দেখব? একবার শুধু গলাটা শুনেই ছেড়ে  দেব।ফোন নাম্বার তো বদলে ফেলেছি কিন্তু  যদি ট্রু কলার লাগানো থাকে? থাকবেই যা গেজেট ফ্রীক । তার থেকে একবার ফেস বুকে চেক করি”। ব্লক লিস্ট থেকে ঋদ্ধির নাম খুঁজে আনব্লক করল ঝিলম। কি ব্যাপার? বেশ ক’বছর ঋদ্ধির কোন পোস্ট নেই কেন?দুত্তোর বলে  ফোনটা রেখে দিল ঝিলম।তারপর আবার গতানুগতিক জীবনের ধাক্কায় এই ঘটনাটা কিছুটা ভুলেই গিয়েছিল ঝিলম।কর্মব্যস্ততায় কেটে গেল বেশ ক’মাস ।

***

ঝিলমের উর্ধতন বস জর্জ ,আর তার ছোট্ট  টিম কাজের শেষে কলকাতার  মাদার্স হাউস দেখতে যাবে সেটা আগেই  জানিয়েছিল। একে ঝিলমের বস তার ওপর ঝিলমের শহর তাই নিয়ে যাবার  দায়িত্ব ঝিলমের ওপর বর্তাবে এটাই স্বাভাবিক । যদিও  এই নংরা ঘিঞ্জি গরমে পচা শহরের প্রতি বিন্দুমাত্র টান নেই ঝিলমের তবুও মুখে মেকি হাসি ফুটিয়ে  “মাই প্লেজার” বলতেই হল ঝিলমকে।

অবশেষে  আবার সেই কলকাতা,তবে এখন শহরটা  অনেক সাফ সুতরো। যদিও অন্যান্য মেট্রো শহরের তুলনায় কিছুইনা।তবুও মন্দ না এটা মনে মনে মানল ঝিলম। ফ্লাইট থেকে নেমে, সকালেই নির্দিষ্ট সময়ে মাদার্স হাউজে মিটিং  সেরে এই গরমে বিপর্যস্ত সাহেবরা গেলেন হোটেলে বিশ্রাম করতে, বিলেত যাওয়ার ফ্লাইট মাঝ রাতে।   সন্ধ্যা অবধি ফ্রি। ততক্ষণ ওদের জন্য  একটা সিটি ট্যুর ছকে ফেলল ঝিলম। কি অদম্য উৎসাহ ওদের। কিছুক্ষণ বিশ্রাম করেই বেরিয়ে পড়ল।  দেখা গেল যে কোথায় কি আছে  সে বিষয়ে ওঁনারা বেশ হোমওয়ার্ক করেই এসেছেন। ফলে স্বামীজীর বাড়ি ,জোড়াসাঁকোর ঠাকুর বাড়ি আর বই পাড়া  নিয়ে  যেতে হল। খাওয়াতে হল দই মিষ্টি আর কলকাতা স্পেশাল মিষ্টি পান । ঝিলম ভেবেছিল গাড়ি চড়েই টুক করে  যতটা সম্ভব দেখিয়ে দেব। কিন্তু  সাহেবদের উদ্দিপনার কাছে হার মানল এই বঙ্গ ললনা। সময়  মত ওদের খাইয়ে এয়ারপোর্ট  পৌঁছানোর দায়িত্ব  খুবই  পেশাদারি কায়দায়  সেরে ফেলল ঝিলম।

ঝিলম ফিরবে কাল। এই রাতটা কজন বন্ধু দের সঙ্গে  মিট টা আগেই ঠিক করা ছিল। পরের দিন সকালে ঝিলমের অন্য প্ল্যান ছিল। ঠেসে ব্রেকফাস্ট সেরে তখন সে গাড়ি টা নিয়ে  বেরিয়ে  পড়ল।কাজটা সেরে সেখান থেকেই সোজাসুজি  এয়ারপোর্ট চলে যাবে   ।

মনে যে কিছু টা ইতস্তত ভাব ছিল না তা নয় ।  যদি কিছু ভাবে?তবে ঝিলম কোন দিনই কে কি ভাবল তাকে বেশি গুরুত্ব দেয় নি? আজও দিল না।

শুধু একটা কিন্তু বোধ, যদি অন্য জায়গায় চলে গিয়ে থাকে?

পরিচিত বাড়ির নিচে এসে তাই ইতস্তত করেও ল্যান্ড লাইনে ফোন করল ঝিলম। একটা যান্ত্রিক কন্ঠ জানিয়ে দিল যে ওই নম্বরের কোন অস্তিত্ব নেই ।এটা অবশ্য আশাই করেছিল ঝিলম।হয়তো বাড়ি টাই বদলে ফেলেছে। তাও গেটের সামনে নামল ঝিলম। তাকিয়ে  দেখতে পেল লেটার বক্সে লেখা ঋদ্ধিদের নাম। কিছুটা আস্বস্ত হল । লিফ্টে করে উঠে এল চার তলায় । পরিচিত তলাটা আজ অচেনা। লিফ্টের সামনে করিডোরে থাকত বেশ ক’টা পাতা বাহারি গাছ। অযত্নে পড়ে আছে শুধু টবগুলো।সামনের দরজাটা খোলা।

ঝিলম দরজার বাইরে থেকে ডাকল–মা, মা!!

— দরজা তো খোলা। ভিতরে এস।

চটি খুলে ভিতরে ঢুকতেই  দেখল পুরো হলটা খাঁ খাঁ করছে ।এক কোণে  দুটো ভাঙা  বেতের মোড়া,আর একটা হাত পাখা।মেঝেতে ছড়িয়ে আছে কটা মোমবাতি।একটা শস্তা প্লাস্টিকের বোতল। বুকটা কেন জানি ধড়াস করে উঠল।

— কই এসো…

বারান্দা  থেকে সেই চেনা গলা শোনা গেল।একজন নারী সাদা থান কাপড়  পরে বারান্দায়,  মেঝেতে বসে আছে।বসার ভঙ্গি টা চেনা কিন্তু  এ কি চেহারার হয়েছে? যেন এক কঙ্কাল সার দেহে চামরা জড়ানো। পরণে একটা মলিন সাদা থান

অতি কষ্টে ঝিলম বলল—” ত- তু–তুমি ??? কি করে? কবে?

—- এইতো এখানে বসেই দেখলাম তুমি এলে। ফোন করলে, তারপর এগিয়ে এলে। বুঝলাম এখানেই আসছ।

— কি– কিন্তু  …. অন্যরা….

—- আর তো কোন অন্য  নেই।

—–‘ঋদ্ধি….ঋদ্ধি  কোথায়?

—-‘ বাবু নেই।আজ তিন মাস হল সে আমাকে মুক্তি  দিয়েছে।

—–মা মমা– মানে কি বলছ? কি দিয়েছে?

এতক্ষণে  ঘুরে বসল ঋদ্ধির মা।– “কেন তুমি  জানো না?”

চিৎকার করে ওঠে ঝিলম — কি জানি না??

আপন মনে বলে চলেন ঋদ্ধির মা—“তুমি সেই কোর্টে সই করে যে হীরের আংটি টা ফেরত দিয়েছিলে। এ –এ –এই   দেখ সেটা। সারাক্ষণ হাতে ধরে রাখত।

—কি বলছ?

—- তুমি জানতে চাওনি ,তাই জানতে পারোনি।  সেদিন কোর্ট থেকে ফেরার পর বাবুর বাইকটা নিয়ে দিল্লি রোড ধরে কোথাও যাচ্ছিল। পথে একটা ধাবা থেকে জানিয়েছিল যে সে দু দিন একটু একা থাকতে চায়…তাকে যেন বিরক্ত না করি । ফেরার  সেই পথে বাইকের সঙ্গে একটি  লরির মুখোমুখি  ধাক্কা লাগে। টিভিতে  দেখলামও  একটা দুর্ঘটনা ঘটেছে। তখন কি বুঝেছি  যে আমার বাবুকেই দেখাচ্ছে? সে দিন ফেরার কথা অথচ ফোন বন্ধ,  খবর না পেয়ে  খোঁজ  শুরু হল। খোঁজ  করতে করতে  পেলাম এক সরকারী হাসপাতালে  অচৈতন্য বাবুকে।তখন সে কোমায়। আর জ্ঞান  ফেরে নি।পুলিশ  হাতের মধ্যে  পেয়েছিল এই আংটি টা।

ডাক্তাররা হাল ছেড়ে  দিল। বাড়ি  পাঠিয়ে  দিল ।চতুর্দিকে নল লাগানো বাবুকে নিয়ে  এলাম এখানে।যে টুকু যা ছিল এক এক করে চলে যেতে লাগল ।এর মধ্যে উনি বাজার করতে গিয়ে  মাথা ঘুরে রাস্তায় পড়ে যান। সঙ্গে  সঙ্গেই মুক্তি পান। ওনার জন্য আর খরচ করতে হয় নি। পাড়ার ছেলেরাই সব করল। ভালই হল। আমার চিন্তা কমল।

 একজনের চেষ্টাতে আমাদের সব ভার নিল একটি চার্চ ।ওদের দয়ায় আর প্রভু যিশুর আশীর্বাদে এত বছর চিকিৎসা চলল বাবুর। কিছু হবে না জানা ছিল।কিন্তু আমি তো মা। আমি কি বাবুকে একা ছেড়ে  দিতে পারি?

তবে ঈশ্বর কে রোজ ডেকেছি, বাবুর যেন আগে মুক্তি  হয়। আমার আগে। নাহলে ওকে কে দেখবে? এখন আমি মুক্ত । কাল চলে যাব আশ্রমে। শুধু এই আংটিটার জন্য ভাবছিলাম । নেবে তুমি? কি অদ্ভুত না? যার ভালবাসা  সে পেলই না তার স্মৃতিটুকুকেও   হারাতেও  চাইত না বোকা ছেলেটা …”

ঝিলমের দিকে বাড়িয়ে দিলেন আংটিটা।গলার কাছে কুণ্ডলী পাকানো একটা যন্ত্রণা।  ঝিলম মুখ ঘুরিয়ে  নিল। চোখের জল আড়াল করতে রোদ চশমা মাথা থেকে নামিয়ে চোখে পড়ে নিল।

ঝিলমের বুকের মধ্যে  যে সেই ভালবাসার পাখিটা আজ ও বেঁচে আছে তা বুঝতেই পারেনি এতদিন। আকাশ ছাড়া, ডানা ভাঙা পাখিটা আজও  ভালবাসার ভাঙা খাঁচা ছেড়ে  উড়তে পারল না। নীরবে হাত বাড়িয়ে  আংটি টা নিল ঝিলম। এক পা এক পা করে সরে, ঘর ছেড়ে  বেরিয়ে  এল ঝিলম। সে কখনো ভাবেনি যে একদিন ঋদ্ধির জন্য  চোখ ভেঙে কান্না আসবে এবং তা লুকাতে হবে।ঝিলম শরীর টা টেনে গাড়িতে চড়ে বসল। নিজের মনে ঋদ্ধিকে  প্রশ্ন করল…” তুমি  আমার কেউ  না, কিছু না, কখনো হয়ে উঠতেও পারনি, তবে কেন তোমাকে ছাড়া এত নিঃসঙ্গ লাগছে, কেন জীবন  এতটা নির্জন, এতটা নীরব?” উত্তর মেলে না…

রুমা ব্যানার্জি। কবি ও গল্পকার। জন্ম ভারতের পশ্চিমবঙ্গরাজ্যের কলকাতায়, ১৯৬৪ খ্রিস্টাব্দে। রুমা মূলত প্রকৃতি প্রেমিক ও সাহিত্য অনুরাগী। পড়াশুনা করেছেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে উদ্ভিদ বিদ্যায় স্নাতক, এরপর আইন ও ইংরেজিতে স্নাতকোত্তর। ছেলের উৎসাহেই লেখালিখির জগতে আসা।

এই বিভাগের অন্যান্য লেখাসমূহ

বালির বেহালা

বালির বেহালা

বুড়িমাসি বলেন,জীবনটা বালির ঘর গো।ঢেউ এলে ধুয়ে যায় জীবনের মায়া।তবু বড় ভালবাসা ওদের দাম্পত্যে।রোদের চাদরের…..

তদন্ত

তদন্ত

  এক ড্রইং রুমে বসে রয়েছে সদ্য কিশোর উত্তীর্ণ তরুণ গোয়েন্দা সজীব। সামনের টেবিলে ছড়িয়ে…..