গৌর (মালদা) – বাংলার চিত্তাকর্ষক ইতিহাস
বাংলার চিত্তাকর্ষক ইতিহাস সম্পর্কে জানার সময়, গৌরের মতো আর কিছু গন্তব্য হতে পারে না।…..
কুয়াশাঘেরা সকাল। গাড়ি আসবে ৮:৩০ এ। রেডি হয়ে বের হতেই দেখি ডাইনিং হল আমাদের অপেক্ষায়। অতিথি আমরা দশ জন। লাইন দিয়ে ডিস সাজানো। ঢাকনা খুলতেই মজার গন্ধ আর গরম ভাপ চোখে মুখে পরশ বুলিয়ে দিল। লুচি, ডাল, সবজি, রুটি এক এক করে রাখা। ধোয়া ওঠা খাবার প্লেটে তুলে লম্বা টেবিলটায় আমরা। খালাম্মার পরনে নতুন শাড়ি, কারো কারো নতুন ড্রেস। আজ ঈদ। শুভেচ্ছা বিনিময় হলো। যেকোনো উৎসবের অবিচ্ছেদ্য অংশ খাবার, পোশাক, রীতি আর স্মৃতি। তাই হয়তো ঈদ মানেই সেমাই, পোলাও; পূজা বলামাত্র নাড়ু লাবরার গন্ধ, বড়দিন বললেই সান্তা ক্লজ, ক্রিসমাস ট্রি; আষাঢ়ী পূর্ণিমা উচ্চারণে সন্ধ্যার আকাশে আলোকবর্তিকার মতো ফানুস উড়ার স্মৃতি। ঈদের সকালে বাসায় খাই খাচ্ছি করে দেরিতে খাওয়া আমি সেমাই, জর্দা অথবা পোলাও মিস করছিলাম। ভীষণ মজার মিক্সড সবজি বাটি ভরে খেলাম। সবশেষে চা। এ কদিন ইফতার সেহরি সব এলোমেলো হয়ে গিয়েছিল। আজ সবাই বেশ তৃপ্ত।
মনে হচ্ছে কত যুগ আগের স্মৃতি। অথচ মাত্র দু বছর আগের কথা। ২০১৯ সালের ঈদের ছুটিটা আমাদের জীবনে ভীষণ এক আনন্দের উৎস হয়ে এসেছিল। রোজার ঈদের ছুটিতে গিয়েছিলাম স্বপ্নের সিকিম। আবার আসছে ঈদ এবং ছুটিও পাব কিছুদিন। অথচ এখন কেবল নিজেকে আর চারপাশকে বাঁচিয়ে রাখার ইচ্ছাই প্রবল। ছোট বড় যেকোনো ধরনের উৎসবের খুশি ১৩/১৪ মাস যাবত অনেকখানিই অন্তর্হিত জীবন থেকে। তবু প্রাণী মাত্রই সামান্য থেকেও আনন্দ খুঁজতে জানে। বিচ্ছিন্নতা আর মৃত্যুর ভেতর থেকেও খুঁটে খুঁটে নেয় জীবনের রসদ। নানা স্তর বিভাজিত জীবনের পরতে পরতে ভিন্নতা, মেলে না একটার সাথে আরেকটা, তবু বৈচিত্র্যের মধ্যেই ঐক্য। প্রায় এক শতক পর পুরো পৃথিবী একসাথে এক স্তরে নেমে এসেছে। ক্রমাগত চরিত্র পাল্টানো এক অনুজীবের বিরুদ্ধে যুদ্ধরত সবাই। দাদা দাদি, নানা নানি বেঁচে থাকলে শুনতে পেতাম তাঁদের মহামারিকাল অতিক্রমণের অভিজ্ঞতা। এমন এক সময়ের সাক্ষী হওয়া আমাদের বিশেষ অভিজ্ঞতাই বটে। তবু গভীর খাদের কিনারে দাঁড়ানো মানুষই পারে সুখস্মৃতি চারণ করতে, ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা করতে। দু বছরের ব্যবধানে জীবনের ব্যাপক পরিবর্তন ঘটে যাওয়া আমিও তাই স্মৃতির কাছে ফিরি।
কিছু মানুষ পৃথিবীতে আসেন বিশাল বিশাল কাজের ভার নিয়ে। কেউ কেউ পৃথিবীতে এসে বড় কোনো কাজের বোঝা কাঁধে তুলে নেন। কিছু মানুষ আসেন নানারকম ইচ্ছে পূরণ করতে। আমি তৃতীয় গোত্রের। প্রায় অর্ধশতকজুড়ে নিজের ইচ্ছাপূরণ ছাড়া তেমন কিছু আমাকে দিয়ে হয়নি। ইচ্ছে-পূরণের তালিকায় বেড়ানো অন্যতম। অদ্ভুত নেশা। দমবন্ধ হয়ে আসে পাহাড়-সমুদ্র আর সবুজের কাছে, খোলা আকাশের নিচে যেতে না পারলে। কলেজ জীবনে বহিঃপ্রকাশ ঘটা নেশাটা ধীরে ধীরে বেড়েছে কেবল। শুরুতে প্রবল যুদ্ধের মুখোমুখি এই আমিকে এখন চারপাশ মেনে নিয়েছে। এটা আমার একরকমের ফুয়েল। ফুয়েল ছাড়া গাড়ি চলে না।
‘আপা, সিকিম যাওয়ার অনুমতি দেওয়া শুরু হয়েছে, যাবেন?’ উদ্যোমী মানুষ শাহনাজের ডাকে সাড়া দিই দ্রুতই। ’১৮ সালের ২০ নভেম্বর সিকিম সীমান্ত খুলে দেওয়া হয় বাংলাদেশিদের জন্য। আহা বরফের রাজ্য সিকিম! চোখে ভাসতে থাকে ফেলুদা তোপসের গ্যাংটকে গণ্ডগোল বইয়ের গল্প। ২০০৭ সালে দার্জিলিং যাবার সময় শিলিগুড়ির যেখান থেকে জিপে উঠি, ওখানে দুটো রাস্তা দু দিকে যাওয়ার। গন্তব্য দার্জিলিং, অথচ উল্টোদিকের গ্যাংটক যাওয়ার রাস্তাটা সমান টানছে। অদ্ভুত মানুষের মন। নেপাল যাওয়ার আগে আমি বার বার বলতাম, হিমালয়ের কাছ থেকে আর ফিরব না। ফিরেছিলাম, ফিরতে হয়। ভেতরের অর্ধেক বৈরাগী মনটা বার বার ছুটে বেরিয়ে গিয়ে আবার ফিরে আসে। ভীষণ ভালোবাসি পাহাড়। প্রায়ই পাহাড়ের ডাক শুনতে পাই, হয়তো একদিন পুরোপুরি চলে যাব। শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় এর মানবজমিন এর দীপনাথ এটা ভেতরে ঢুকিয়েছিল। সিকিম যাওয়ার পরিকল্পনায় তাই নেচে উঠেছিল মন।
বছরে দু বার আমার প্রায় ২২/২৪ দিনের লম্বা ছুটিটা অন্যদের ঈর্ষান্বিত করে। তারা ভুলে যায় ছুটির আগের ১৪/১৫ দিন রাতদিন এক করে নাওয়া খাওয়া ভুলে খাতা দেখা শেষে ফল তৈরির অমানুষিক কষ্টের কথা। চরম বিপর্যয় ছাড়া মাঝের ছয় মাসে ছুটি পাওয়া কঠিন। তিনদিন তিনদিন ছয়দিনের ছুটি থাকলেও পাঠ পরিকল্পনা এলোমলো হওয়া আর সিলেবাস শেষ না হওয়ার ভয়ে ছুটি নেওয়া হয় না পারতপক্ষে। ডেস্ক ওয়ার্ক পরে করা সম্ভব হয়, ক্লাস নয়। অনেকে অর্জিত ছুটির বিনিময়ে টাকা বা পুরস্কার পেলেও আমাদের সেসব নেই। আমার এ ছুটিটায় নজর দিলে তাই খুব কষ্ট লাগে। যাই হোক, ছয়মাসের কর্মপরিকল্পনা টার্মের শুরুতেই হাতে পাওয়ায় সহজ হয় নিজস্ব পরিকল্পনা করা। আফসোস, ভ্রমণ সঙ্গীদের সাথে বেশিরভাগ সময় মেলে না তা। যেকোনো দলের সাথেও চলে যেতে পারি না হুট করে আমি।
বেড়াতে যাওয়ার আগে কিছু হোমওয়ার্ক জরুরি। সেবার ব্যস্ততায় কিচ্ছু করতে পারছিলাম না। ভ্রমণসঙ্গীরা যা বলত, তাতেই রাজি। ইনবক্সে পাঠানো প্যারাগ্লাইডিং এর ভিডিয়ো দেখে প্রচণ্ড রোমাঞ্চিত ছিলাম। জুনের ১ তারিখ, শনিবার, ২৬ রোজার সন্ধ্যায় রওনা করি। আমার স্কুল খোলা না থাকলে বৃহস্পতিবার যাত্রা শুরু করা যেত। কৃতজ্ঞ গ্রুপের সবার প্রতি। ৮ জনের দলে একজন আম্মাও ছিলেন। আরেক বন্ধুর মায়ের সাথে আমাদের বেড়ানোর অনেক মধুর গল্প আছে। আম্মারা ভ্রমণে বাড়তি আনন্দ যোগ করেন। বাইরে গিয়েও বেশ আহ্লাদ পাওয়া যায়।
মাঝে অনেকদিন সিকিম যাওয়ার অনুমতি ছিল না। নিষেধাজ্ঞা তুলে দেবার পর ভিসা অফিসে বেশ চাপ। ১৯৭৫ সালে সিকিম ভারতের ২২তম রাজ্য হিসাবে অন্তর্ভুক্ত হয়। আমাদের দেশের যেমন তিনদিকে ভারতের বিভিন্ন সীমান্ত; সিকিম তেমনি চীন, নেপাল, ভুটান সীমান্ত পরিবেষ্টিত। পাহাড়ঘেরা সিকিমের কিছু রাজ্য সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ১৭ হাজার ফুট উঁচুতে অবস্থিত। পূর্ব হিমালয়ের কোলে অবস্থিত হওয়ায় আবহাওয়া সবসময় ঠাণ্ডা। বেড়ানোর উপযুক্ত সময় ফেব্রুয়ারি থেকে এপ্রিল, সেপ্টেম্বর থেকে নভেম্বর। না মানলে বিপদ। বরফধ্বসে রাস্তাঘাট বন্ধ হয়ে যায়। ফেরার পথে জুনের ৭ তারিখ আমরা যখন শিলিগুড়িতে, একটা দল বরফধ্বসের কারণে গ্যাংটক থেকেই বের হতে পারেনি। আবার অনেকে লাচুং এ আটকা পড়েছিল। ভ্রমণসূচি যেহেতু দু একদিনের জন্য সাজানো হয়, প্রস্তুতি তেমনই থাকে। আটকা পড়লে বেশ সমস্যা।
ঢাকা থেকে সন্ধ্যা ৭টায় বাস ছাড়ার কথা। আমরা বাসা থেকে আনা মজার খাবারযোগে কাউন্টারে ইফতার করি। দলের তিন শিক্ষকের ছুটি অন্যদের থেকে যথারীতি বেশি থাকায় আমরা দুই ভাগে দুই সীমান্ত দিয়ে ঢুকব। ফেরার পথে আমাদের তিনজনের শিলিগুড়ি, জলপাইগুড়ি ঘুরে পঞ্চগড়, দিনাজপুর কাটিয়ে ঢাকা ফেরার পরিকল্পনা। আমাদের গাড়ি বাংলাবান্ধার উদ্দেশ্যে ছাড়ে ৭:৩০ এর দিকে, চ্যাংড়াবান্ধা সীমান্ত প্রত্যাশীদের বাসও একটু পরেই ছাড়ে। ২ জুন সকালে সীমান্তে চেকপোস্টের কাজ শেষে শিলিগুড়ির শ্যামলী বাস কাউন্টার দু দলের মিটিং পয়েন্ট। বাংলাবান্ধা থেকে ফুলবাড়ি সীমান্ত হয়ে শিলিগড়ি পৌঁছাতে সময় লাগে ৩৫/৪০ মিনিট। আমরা আগে পৌঁছে অন্য দলটির অপেক্ষায় থাকি। হাতে সময় আছে, কাজে লাগাই না কেন। অটো নিয়ে আশেপাশে ১ ঘণ্টা ঘুরে নিলাম। সবাই এলে ১০ সিটের জিপ ভাড়া করি। শিলিগুড়ি থেকে গ্যাংটক ১১৪ কিলোমিটার দূরে। পথে ঝঞঘ থেকে সিকিমে ঢোকার অনুমতি নিতে হয়েছিল। বাংলাদেশ থেকে ভিসা ও অন্যান্য কাগজ ১৫টা ফটোকপি করে নিয়েছিলাম। পদে পদে সেটা কাজে লেগেছে। পৌঁছুতে সাড়ে ৫ ঘণ্টা লাগে প্রায় আমাদের।
এমজি মার্গ অর্থাৎ মহাত্মা গান্ধী মার্গ গ্যাংটকের মিডল পয়েন্ট। গান্ধীজীর মূর্তি, নানা রঙের সুন্দর ফুল, বসার বেঞ্চ, দোকানপাট সব মিলিয়ে খুব গোছানো অসাধারণ জায়গা। ইন্ডিয়ার রাস্তায় রাস্তায় বিশাল ভাস্কর্যগুলো খুব নজরকাড়া। একটা দেশের অগ্রগতির পেছনে নানান জনের নানান ভূমিকা। তাঁদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদনের চমৎকার একটি উপায় এটি। আমরা ইফতার করি সময় পার করেই। ২৪ ঘণ্টার ক্লান্তি কেটে যায় অনেকটা। স্ট্রীট ফুড বিখ্যাত জায়গায় দাঁড়িয়ে কিছু খাবো না তা হতে পারে না। ঘুরে ঘুরে গরম মমো, নুডলস, জিলাপি, চা খেলাম মজা করে। ঢাকা থেকে হোটেল বুক করা ছিল। সেহরির খাবার সাথে নিয়ে ট্যাক্সিতে লটবহর নিয়ে রওনা করি।
আর এখন? নিজের বাড়ি থেকে অন্য বাড়ি যেতেও ভয়। আর কী ভয়হীন জীবন ফিরে পাব আমরা? তালিকার কত কিছু বাকি রয়ে গেল। সিকিম ছিল সেই তালিকায়। সিকিমের উত্তর, দক্ষিণ, পূর্ব, পশ্চিম সবদিকই দেখার মতো সুন্দর। দূরত্বের কারণে স্বল্প সময়ে সব দেখা অসম্ভব। আমরা উত্তর সিকিমের লাচুং এ এক রাত থাকব ঠিক ছিল বাংলাদেশ থেকেই। জিরো পয়েন্ট আর ইয়ামথাং ভ্যালি দেখব। গ্যাংটক থেকে প্রায় ১১০ কিলোমিটার দূরে লাচুং। ৪ জুন ছবির মতো সুন্দর পাহাড়ী পথে ৬ ঘণ্টার জার্নিটা ভোলার না এ জীবনে। গ্যাংটক থেকে যেদিকেই যাই না কেন, প্রধান বাহন জিপ। তিনতলা জিপ ডিপোটা শহরের এক পাশে। এই যে এত জিপ বের হচ্ছে একেকদিকে, কোনো গ্যাঞ্জাম নেই। অনেক মানুষ, অনেক জীপ, কিন্তু সুশৃঙ্খল সব। রওনা হতে সময় লাগলেও খুব বিরক্ত লাগেনি। অনেকটা দূর এসে আবার কী কারণে যেন অনেকক্ষণ থেমে ছিলাম আমরা। সেখানে হাঁটাহাঁটি, ছবি তোলা হলো। যেতে যেতে নীল পানির তিস্তা নদী, ব্যারেজ, একটা ঝরনা দেখি। তিস্তা ব্যারেজ ছবির মতো সুন্দর। লাচুং ঢোকার রাস্তার মোড়ে প্লাস্টিকের বোতলের পাহাড়। কী পরিমাণ প্লাস্টিক সামগ্রী ব্যবহার করি আমরা! সাথে থাকলে এখানে ফেলে ঢুকতে হয় শহরে। সিকিমকে ভারতের প্রথম রাজ্য হিসাবে রাসায়নিকমুক্ত বা অর্গানিক রাজ্য হিসাবে ঘোষণা করা হয় ২০১৬ সালে। এখানে জমিতে চাষবাসের ক্ষেত্রে কেউ কিটনাশক ব্যবহার করে না। করলে জেল জরিমানাও হয়। গাড়িতেই ইফতারের সময় হলে বাপ্পির ব্যাগে রাখা খেজুর প্রাণ জুড়িয়েছে বার বার। টুকিটাকি খাবারও ছিল সাথে। এত যে দৌড়ঝাঁপ, ক্লান্তি নাই কারো। শীতের সময় বেড়ানোর মজা আর সুবিধা এটা।
শিলিগুড়ি থেকে জিপে উঠার সময় আমাদের সাথে সৈকত আর ইসরাত দম্পতি যোগ দেয়, ওখানেই পরিচয়। দশজনের জিপ। আমরা আট জন। ওরা দুজন তাই দলে অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল। লক্ষ্মী দুটো মানুষের সাথে কথা হয় মাঝে মাঝে। গ্রুপে বেড়ানোর মজা এটা, নতুন কিছু বন্ধু পাওয়া যায়। রাত প্রায় ৮টার দিকে লাচুং পৌঁছাই। হোটেলটা খুব নির্জন জায়গায়। আর কোনো বোর্ডার চোখে পড়েনি। বুফে সিস্টেমে রাখা মজাদার গরম খাবার খেয়ে চাঙ্গা হয়ে বাইরে বের হই। আসার সময় পথ কী যে চমৎকার, কিন্তু থামার অবকাশ ছিল না। দীর্ঘ সময় বসে জমে যাওয়া হাত পা গিঁট ছাড়ানোর চেষ্টা। উঁচু নিচু রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে মনে হচ্ছিল যারা এসব এলাকায় থাকে, তাদের প্রতিদিন এই কষ্টকর পথ পারি দিতে হয়। অনেক আগে বান্দরবান এ নিচে থেকে কাঁধে করে পানি বয়ে আনার দৃশ্য দেখে কষ্টে পুড়েছিলাম। রাস্তায় সাদা কুয়াশা, পাশেরজনকেও দেখা যায় না। বেশ ঠাণ্ডাও। ফিরে গেল পাঁচ জন। বাকিরা কাছে বার মতো একটা দোকানে বসে আড্ডা দিলাম কিছুক্ষণ। ওটা ছিল চাঁদরাত, তখন অবশ্য মনে ছিল না। তবে উদ্যাপনটা মন্দ হয়নি।
আসছে ঈদটা কেমন কাটবে? কত জন স্বজনহারা হলো, হারালো নিয়মিত নিশ্চিত জীবন। গতবছর ঈদে এক শহরে থেকেও মায়ের কাছে যেতে পারিনি লকডাউন মেনে। সংক্রমণের হার তখন তুঙ্গে। মায়ের কথা ভেবে রিস্ক নিইনি। আমি বলি ঈদ আলাদা কিছু নয়। যদি তাই হয়, তাহলে আমি কষ্ট পেয়েছিলাম কেন? দুপুর রোদে ছাদে গিয়ে বসেছিলাম। বাতাসের শো শো শব্দ, সচ্ছ নীল আকাশ। আমি বার বার তার প্রেমে ছাদে ছুটে যেতাম। ’১৯ এ মা খুব অভিমান করেছিল ঈদে থাকব না জেনে। কষ্ট দিয়েছিলাম। সারা বছর ব্যস্ততার কারণে যাওয়া হয় কম, থাকার সুযোগ হয় না দুই ঘণ্টার দূরত্বেও। এবার? সবাই বলে স্কুল তো ছুটি। আমরা বলি, স্কুল বিন্ডিং বন্ধ, স্কুল খোলা। পুরো দমে। মাত্র দু বছরে জীবনের কত কী বদলে যায়। দু বছর আগের ৫ জুন, বুধবার সিকিমে সেমাই, পোলাওবিহীন পরিবার ছাড়া অন্যরকম ঈদ ছিল। বন্ধুদের পাশে থেকে পরিবারকে মিস করছিলাম। তবু অন্যরকম আনন্দ ঘিরে রেখেছিল। নাস্তা সেরে জিপের অপেক্ষায় বাইরে রাস্তায় হাঁটাহাঁটির সময় পানির জোরালো শব্দে এগুতে থাকি। ঝরনা! কত বড়! শিশুর আনন্দ আমাদের। ঝরনা দেখলেই আমার উৎসমুখের কাছে যেতে মন চায়। গাড়ি এলে ইয়ামথাং ভ্যালি আর জিরো পয়েন্টের উদ্দেশ্যে যাত্রা। মোটেই স্মুথ নয়, অথচ পথটা কী যে সুন্দর! কোথাও পাহাড়ের পাশ দিয়ে, কোথাও সমতল। সমতল অংশটুকুতে নানা ধরনের গাছ। কেউ পত্রহীন, কেউবা সবুজ জামা গায়ে। পথে অন্য একটা দলের গাড়ি নষ্ট হয়ে গেল। আশেপাশে কিচ্ছু নেই। ড্রাইভার জানালো আরেকটা গাড়ি না আসা পর্যন্ত অপেক্ষা করবে। তাদের ফেলে আসতে খারাপ লাগলেও কিছু করার ছিল না। অবশেষে ইয়ামথাং ভ্যালির কাছে সমান একটা জায়গায় গাড়ি থামল। এখান থেকে ওভারকোট আর গামবুট ভাড়া নিতে হবে ঠাণ্ডা থেকে বাঁচতে। পাশাপাশি কয়েকটা দোকান। পর্যটকদের সেবায় অপেক্ষমান। তেমনই একটাতে ধোয়া ওঠা কফি, গরম নুডলস, পাউরুটি উইথ চিজ ছাকনিতে করে পানির উপর ভাপিয়ে দিচ্ছে, আমরা খাচ্ছি হুমহাম। অনেক মজা। পাহাড়ি যত জায়গায় খেয়েছি, সাথে পুরুষ থাকলেও দোকান চালায় মহিলারাই। সব দোকানেই বাথরুমের ব্যবস্থা আছে। মাফলার, শালসহ নানা সামগ্রী রাখা। বেশ ভালো ব্যবসা। হাঁটু পর্যন্ত বুট আর ওভারকোটের জন্য জামানত হিসাবে কিছু টাকা রাখে, যাবার সময় জিনিসগুলো ফেরত দিয়ে যেতে হয়। জিপের ড্রাইভাররাই গাইড হয়ে লিয়াজোর কাজটা করে থাকে। একটা মজা হয়েছিল। আমার বোতলটা দিয়েছিলাম পানি ভরতে। গরম পানি ভরে বলে ‘বোটল টুট গিয়া’। উন্নত মানের প্লাস্টিক সেই গরম সহ্য করতে পারেনি। বোতলের চেহারা দেখে এক চোট হেসে নিলাম সবাই।
প্রায় ১৩০০০ ফুট উপরে বরফে ঢাকা ইয়ামথাং ভ্যালি ছবির মতো সুন্দর। কেমন শান্ত, সমাহিত করে দেয়। যেন স্বপ্ন, ঘুম ভাঙলে শেষ হয়ে যাবে। এত কাপড় পরেও টেকা দায় ঠাণ্ডায়। তারপর স্বপ্নের জিরো পয়েন্ট। নর্থ সিকিমের একেবারে উপরে এটা, ১৫ হাজার ৫০৩ ফুট উপরে। সাদা বরফ চোখের সামনে। এত বরফ জীবনে দেখিনি। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে যত উপরে ওঠা যায়, অক্সিজেন লেভেল কমতে থাকে বলে অনেকের শ্বাসকষ্ট, বমি হয়। লাদাখ যাবার সময় টের পেয়েছিলাম। তীব্র মাথা ব্যথায় এক পর্যায়ে সৌন্দর্য উপভোগের সামর্থ্য হারিয়ে ফেলেছিলাম প্রায়। এবার আমাদের দলের কারো অসুবিধা হয়নি, খালাম্মাও সুস্থ ছিলেন। এত বরফ, উত্তেজনায় মাথা খারাপ অবস্থা সবার। বাচ্চাদের মতো বরফে শুয়ে একটা চক্কর দিতে মন চাইছিল। সবাই বরফ লোফালুফি, বল বানিয়ে ছোড়াছুড়ি খেলায় মত্ত। ঠাণ্ডা টের পাচ্ছিলাম না তেমন, অথচ মাইনাস তাপমাত্রা। এখানেও গরম কফি, নুডলস, ছোলা বিক্রি হচ্ছে। মাত্রই ভরপেট খেয়ে আসা আমাদের গ্রুপ লিডার শাহনাজের অনুমতি প্রার্থনা। আমাদের ব্যাংক তো ওই। আমি ইদানীং অ্যাসিডিটির ভয়ে নুডলস কম খাই, আগে পর্যন্ত ভীষণ প্রিয় ছিল। যে ফরম্যাটে হোক না কেন, অল টাইম ফেবারিট। বরফে লোফালুফি করতে করতে আমরা ক্লান্ত হয়েছিলাম। আর অনেকদিন পর দিনে খাওয়ার সুযোগ পেয়ে হারাতে মন চাইছিল না। খাওয়ার পর পাত্রটা সরাসরি বরফের চাইয়ের ভেতর ঢুকিয়ে পরিষ্কার করার বুদ্ধিটা খুবই আকর্ষণীয়। এখানেই জীবনে প্রথম রডেনড্রোন ফুল দেখি। ফিরতে মন চাইছিল না, তবু স্বপ্ন থেকে জাগতে হয়, ফিরে চলো মন। আবার প্রায় ৬ ঘণ্টা জার্নি, গন্তব্য গ্যাংটক। একপাশে পাহাড়, অন্যপাশে গভীর খাদ। বিপজ্জনক অথচ ভয়াবহ সুন্দর। প্রতি বাঁেক নতুন রূপ। আকাশ, পাহাড়, সবুজ বনানী, খাড়া খাদÑ এত সৌন্দর্য প্রকাশ করার ক্ষমতা আমার নাই। অনেক নিচে পাহাড় কেটে তৈরি খুব সুন্দর গোছানো কিছু ঘরবাড়ি। ড্রাইভার জানায় সেটা জেলখানা। সারল্যমাখা হাসিতে জানায় সেও ৩ মাস ছিল ওখানে। হিন্দি ভাষাটা একেবারেই রপ্ত করতে না পারায় তার সাথে মজা করে গল্প করতে কিঞ্চিত অসুবিধা হচ্ছিল। পণ করেছিলাম ফিরে শেখার চেষ্টা করব। শেখা হয়নি আজও। সেদিন রাতে ফিরে এমজি মার্গে আমরা থুকপা খেয়েছিলাম তার পরামর্শমতো। খাইনি জেনে অভিনয় করে সু করে টেনে নিয়ে কীভাবে সুরুত করে মুখে পুরব, সেই দেখিয়েছিল।
প্রতিটা দিন শুরু করি পরিচিত কারো না কারো পৃথিবী ছাড়ার খবর দিয়ে। মৃত্যু অবধারিত সত্য, কেউ এড়াতে পারবে না। তবু এমন টুপটাপ চলে যাওয়া প্রাণে বাজে। মৃত্যু মিছিলে দাঁড়িয়েও তাই আমরা জীবনের গান গাই। নতুন করে জীবনের পরিকল্পনা করি। কত শত ইচ্ছা অপূরিত রয়ে গেল! কত কাজ বাকি আছে করার। কত অনুশোচনা রয়ে গেছে, কত ভুল শুদ্ধ করা হয়নি আজও, রয়ে গেছে না বলা কথা। তখন আমি ৬/৭ হবো। ঈদে বেড়াতে গিয়েছিলাম সিলেট চাচা চাচির বাড়িতে বড় ভাই, ছোট ভাইয়ের সাথে। কিছু মানুষ রক্তের বন্ধনের বাইরেও কাছের হয়ে উঠে, তারা ছিলেন তাই। যাওয়াটা খুব মজার ছিল। ট্রেনের দুলুনির একটা অদ্ভুত মজা আছে, তালটুকু ঘুম পাড়ানিয়া গানের মতো। ঘুম ঘুম আমাকে নিশ্চিন্তে ঘুমাতে বাংকারের উপরে তুলে দিয়ে বেচারারা আমার রোষে পড়েছিল। প্রায় পুরো রাস্তাটুকু উপরে ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে পৌঁছেছিলাম। ঘুম ভেঙে কী রাগ আমার, কেন ডাকা হয়নি, কিচ্ছু দেখা হলো না।
সেই সময়ের বাড়িগুলো যেমন হয়, উঠান মাঝে রেখে চারপাশে শরীকদের ঘর। আমরা তিন পিঠাপিঠি ভাইবোন খুব আদরে ছিলাম। খেড়ের পালা বেয়ে উপরে উঠা, শসা ক্ষেতে মাচার নিচে দৌড়ে দৌড়ে ঝুলন্ত শসা খাওয়া, ভীষণ আনন্দের। আজও অপরাধবোধে ভুগি। কত শসা নষ্ট করেছিলাম ছেলেমানুষী করে। কিন্তু ঈদের দিন সকালে আমার পৃথিবী এলোমেলো। বাসায় ফজরের আজানের পর পর ঘুম থেকে ওঠে গোসল। তার আগে বিছানায় নতুন চাদর পাড়া, সোফার কাভার টেবিল ক্লথ পাল্টানো। আগের রাতেই করা যেত, তবু সকালে করার নিয়ম। নতুন লাক্স সাবান দিয়ে গোসল করে মাথার কাছে রাখা জুতো জোড়া মাটিতে নামানো। রাতে ইস্ত্রিরি করে রাখা পাঞ্জাবি পরে বাবা দাদাভাই নামাজ পড়ে ফিরলে একসাথে সেমাই খাওয়া। সালামি পকেটে ভরা। সিলেটে ঘুম ভেঙে আমি এইসব ভীষণ মিস করতে লাগলাম। কান্না কান্না মুখের আমি সবার আদরে উঠে পুকুরে গোসল করে নতুন জামা পরলাম। সবাইকে সালাম করে রান্নাঘরে। নতুন ধরনের খাওয়া দেখে আবার মেজাজ খারাপ। তিন/চারটা চাউলের রুটি পানিতে ভিজিয়ে তাওয়ায় ভাজা হচ্ছে, মাংস দিয়ে খাওয়া হবে। ‘খাব না।’ উনারা বিব্রত। পাঁচ বছরের বড় দাদাভাই এর দিকে চোখ পড়তেই দেখি কড়া দৃষ্টি। বুঝলাম ভুল করেছি। ওটা ছিল স্পেশাল খাবার, খেতে খুব মজার। অভ্যস্ত না হওয়ায় প্রতিবাদের ঝড়। তারপর সারাদিন টো টো ঘুরাঘুরি। অন্যরকম এক ঈদ কেটেছিল। এ বছর তো যোগের চাইতে বিয়োগই বেশি জীবনে। অনেক বাসার নির্দিষ্ট একটা চেয়ার এবার ইফতারে খালি থাকবে। ঈদের দিন বাসায় হয়তো অনেককিছু রান্না হবে, খেতে পারবে না কেউ ঠিকমতো। তবু আশা, ছোটদের নতুন কাপড় জুতো আর ঈদির আনন্দ, খোলা হাওয়ায় বেড়াবার আনন্দ, বড়দের একে অন্যের সাথে মিলিত হবার আনন্দ, কিংবা বাড়িতে বয়স্ক মা বাবার সন্তানদের জন্য অপেক্ষার পালা কবে শেষ হবে, অথবা সন্তান মা বাবাকে বুকে জড়িয়ে নিতে পারবে নির্ভয়ে। ধ্বংসের চূড়ায় দাঁড়িয়েও আবার নতুন করে মানুষই গড়ে। আমরাও পারব নিশ্চয়ই।
বাংলার চিত্তাকর্ষক ইতিহাস সম্পর্কে জানার সময়, গৌরের মতো আর কিছু গন্তব্য হতে পারে না।…..
এপিসোড-১ (প্রথমাংশে রেল-জংশন) সে তিন যুগ আগের কথা।ঢাকা থেকে এসে বিল্টু মামা নেমেছেন কুলাউড়া জংশন…..
কবি কাশীরামদাসের জন্মস্থান পূর্ববর্ধমান জেলার সিঙ্গিগ্রামে বেড়াতে গেলাম।তাঁর জন্মভিটের ভগ্নাবশেষ দেখলাম।আমি,মিহির,রিমি,সোমা,রজত সকলে গ্রাম ঘুুুুরলাম। চারদিকে…..
ভ্রমণবিলাসী চারজন বেরিয়ে পরলাম ভ্রমণে। আমিও গেলাম।প্রথমে ওরা গেল মুকুটমণিপুর। সপ্তাহান্তে পিকনিক বা একদিনে ছুটিতে…..