জীবন একটা আয়না

তোরিফা নাজমিনা মণি
অনুবাদ, প্রবন্ধ
Bengali
জীবন একটা আয়না

আমার জীবনের একদিনের একটা ঘটনা বলি, কিছু বন্ধুর সাথে পাহাড়ে বেড়াতে গিয়েছিলাম। সেখানে ‘ইকো পয়েন্ট’ নামে খ্যাত একটা জায়গা দেখতে গেলাম আমরা। এটা খুবই সুন্দর জায়গা, খুবই নীরব, চারিদিক পাহাড়ে ঘেরা। বন্ধুদের কেউ একজন কুকুরের মত ডেকে উঠল। সারাপাহাড়ে সেটা প্রতিধ্বনিত হতে লাগল- মনে হল সেখানে হাজার হাজার কুকুরে ভরে গেছে। তারপর কেউ একজন বৌদ্ধদের একটা মন্ত্রপাঠ করতে লাগলঃ

সব্বে সংহার অনিচ্ছা। সব্বে ধর্ম অনিত্য। গাতে, গাতে, পারা গাতে, পারা সঙ্গাতে, বোধিস্বত্তা।

পাহাড় যেন বৌদ্ধধর্মাবলম্বীতে পরিণত হল, পাহাড়ে বারবার মন্ত্রটি প্রতিধ্বনিত হচ্ছিল। মন্ত্রটির অর্থ হল-

সব কিছু অস্থায়ী, কোন কিছু স্থায়ী নয়; সব কিছু পরিবর্তনশীল, কোন কিছু অপরিবর্তনশীল নয়। সব কিছু অনাত্মা। চলে যায়, চলে যায়, অবশেষে সব চলে যায়—কথা, জ্ঞান, এই বোধিত্বও।

আমার সাথে যেসব বন্ধুরা ছিল আমি তাদের বলেছিলাম যে, জীবনও ঠিক এই ‘ইকো পয়েন্ট’ এর মতো, জীবনের সাথে তোমরা যেরকম আচরণ করবে, জীবনও তোমাদের তাই ফেরত দেবে; তুমি একটা সুন্দর মন্ত্রপাঠ করতে থাকলে জীবনও সেই মন্ত্রের ন্যায় সুন্দর হয়ে উঠবে। জীবন হল আয়নার মত। তোমার চারিদিকে অসংখ্য আয়না- প্রতিটা মুখ একটা আয়না; প্রতিটা প্রস্তর একটা আয়না, প্রতিটা মেঘ একটা আয়না। এইসব কিছুর সাথে তোমার সম্পর্ক আয়নার মতো। তুমি যার সাথে যেভাবে সম্পর্কিত হয়ে আছো সেটা সেভাবেই তোমার সামনে প্রতিফলিত হয়। জীবন যদি তোমার সাথে সম্পূর্ণ উন্মাদীয় আচরণ করে, তবে রেগে যাবে না। নিশ্চয় এটা তুমিই শুরু করেছো। এটা শুরু হয়েছে নিশ্চয় তোমারই কোন না কোন কর্মের কারণে। জীবনকে বদলানোর চেষ্টা করবে না; কেবল নিজেকে বদলাও, এবং দেখবে জীবনও বদলে গেছে।

দু’ধরনের দৃষ্টিভঙ্গি আছে- একটাকে আমি বলি কমিউনিস্টিক। তারা বলে, ‘জীবনের পরিবর্তন করুন, কেবল তখনই আপনি সুখি হতে পারবেন’; অন্য আর একটি যাকে আমি ধর্মীয় দৃষ্টিভঙ্গি বলি, তারা বলেন, ‘নিজেকে পরিবর্তন করুন এবং জীবন সহসায় সুন্দর হয়ে যাবে।’ সমাজকে, এই পৃথিবীকে পরিবর্তন করার কোন প্রয়োজন নাই। যদি তুমি সে চিন্তা করো তবে সেটা ভুল যা শেষ পর্যন্ত তোমাকে কোন গন্তব্যে নেবে না। প্রথম কথা, তুমি এটা পরিবর্তন করতে পারবে না- এটা এতোটাই ব্যাপক। এটা একেবারেই অসম্ভব। এটা এতোই দুরুহ এবং কিছু সময়ের জন্য তুমি এই পৃথিবীতে এসেছো; এবং জীবন হল বড়ই সুদুর এবং চিরদিন বহমান। তুমি কেবল অতিথির মতো কিছুকাল থেকে চলে যাবেঃ ‘গাতে গাতে’-চলে যাওয়া, চলে যাওয়া চিরদিন। কীভাবে তুমি এটা পরিবর্তনের কথা চিন্তা করো?

এটা নিছক বোকামি, যারা বলে- জীবন বদলানো যেতে পারে। কিন্তু এখানেই মানুষের আকর্ষণ বেশি। কমিউনিস্টদের তীব্র সমর্থন এটাতেই। এটা সত্য সে কারণে নয়- এই বোধ অন্য কোথাও থেকে আ। কারণ, এখানে তোমার কোন দায়িত্ব থাকে না; একারণে তারা এই কথা বলে থাকে। সবাই এর জন্য দায়ী কেবল তুমি বাদে; তুমি শিকার। জীবনের সবকিছু দায়ী। জীবনের পরিবর্তন করুন।’ – এটা গতানুগতিক সাধারণ মনের চিন্তা, কারণ কোন মনই দায়িত্বশীল হতে চায় না।

যখন তোমার জীবনে দুঃখ যাতনা আসে তখন তার দায়-দায়িত্ব তুমি অন্যের ঘাড়ে চাপিয়ে দিতে পছন্দ করো। অন্য কেউ সেটা করবে, যে কোন অজুহাত দেখাবে, তাহলেই তুমি ভারমুক্ত হয়ে যাও। এখন তুমি জানো যে, এই লোকটি বা এই স্ত্রীলোকটির জন্য তোমার জীবনের এই দূর্দশা, অথবা এই ধরনের সমাজ ব্যবস্থা, এই ধরনের সরকার, এই সামাজিক গঠন, এই অর্থনৈতিক অবস্থা- অন্য কোন কিছু বা অবশেষে সব দায় ঈশ্বরের বা ভাগ্যের। এইসব কিছুই কমিউনিস্টিক দৃষ্টিভঙ্গি। যে মুহূর্তে সব দায়-দায়িত্ব অন্যের ঘাড়ে চাপিয়ে দাও, তুমি একজন কমিউনিস্ট হয়ে যাও; তুমি আর ধার্মিক থাকো না।

এমনকী, যদি তুমি সব দায়িত্ব ঈশ্বরের ওপর চাপিয়ে দাও তবুও তুমি কমিউনিস্ট হয়ে যাও। আমাকে বোঝার চেষ্টা করো, কারণ কমিউনিস্টরা ঈশ্বরে বিশ্বাস করে না, কিন্তু কমিউনিস্টিক দৃষ্টিভঙ্গি হল, সকল দায়িত্ব অন্যের ঘাড়ে চাপিয়ে দেওয়া- তখন ঈশ্বরকেও পরিবর্তিত হতে হয়।

লোকজন মন্দিরে গিয়ে সে কাজটাই করছে। তারা সেখানে যায় এবং ঈশ্বরকে পরিবর্তনের জন্য প্রার্থনা করে। এইসব লোকজন কমিউনিস্ট। তারা ধর্মীয় লেবাসের আড়ালে নিজেদের লুকিয়ে রেখেছে; তারা আসলে কমিউনিস্ট। তুমি কী প্রার্থনা করছো? তুমি ঈশ্বরকে বলছো, ‘এটা করুন, ওটা করবেন না’, ‘আমার স্ত্রী অসুস্থ, তাকে স্বাস্থ্যবান করে তুলুন।’ তুমিই সবকিছু বলছো, ‘এ দায়িত্ব আপনার।’ তুমি অভিযোগ করছো; তোমার প্রার্থনার গভীরে আসলে অভিযোগ। হয়ত তুমি খুবই নম্র-ভদ্রভাবে বলছো, কিন্তু তোমার এই নম্রতা, এই ভদ্রতা আসলে মিথ্যা। তুমি এভাবে তেলিয়ে তাকে যতই তুষ্ট করার চেষ্টা করো আসলে ভিতরে ভিতরে বলছো, ‘এ সবের দায়িত্ব আপনার- কিছু করুন!’

এই ধরনের আচরণকে আমি কমিনিস্টিক আচরণ বলি; এর মাধ্যমে আমি সেই আচরণকেই বোঝাই যে বলে, ‘এ দায় আমার নয়; আমি শিকার। এই সমস্ত জীবন এর জন্য দায়ী।’ আর জীবনের ধর্মীয় ধারণা বলে, ‘জীবন কেবল প্রতিবিম্বিত হয়’।

জীবন কর্তা নয়; একটা আয়নামাত্র। এটা তোমার কিছু করে না, কারণ একই জীবন বুদ্ধের সাথে অন্যরকম আচরণ করেছে। জীবন একই, এটা তোমার সাথে ভিন্নরকম আচরণ করে। আয়না একই, কিন্তু তুমি যখন আয়নার সামনে আসো তখন আয়না তোমার অভিব্যাক্তিকেই প্রতিবিম্বিত করে। কিন্তু তোমার অভিব্যক্তি যদি বুদ্ধের মত না হয় তবে আয়নার কী দোষ বলো? যখন আয়নার সামনে একজন বুদ্ধ আসেন তখন সেখানে একজন বুদ্ধই প্রতিবিম্বিত হন।

আমার অভিজ্ঞতা থেকেই তোমাদের এসব কথা বলছি। একদিন হয়ত তোমার আদল বদলে যাবে, তখন আয়নাও বদলে যাবে; কারণ আয়নার কোন নির্দিষ্ট অবস্থান নাই। আয়নাতে কেবল প্রতিফলিত হয়, প্রতিবিম্বিত হয়। এটা কিছু বলে না। সে কেবল দেখায়- এটা তোমাকে দেখায়। যদি জীবন যন্ত্রণাময় হয় তবে নিশ্চয় এর সূত্রপাত করেছো তুমি। যদি সবাই তোমার বিপক্ষে অবস্থান নেয় তবে তার শুরুটা দেখবে তোমার থেকেই হয়েছে। কারণ কে বদ্লায়? এবং তুমিই হলে সেই কারণ। ধর্ম তোমাকে দায়িত্বশীল করে- এবং এভাবেই ধর্ম তোমাকে মুক্ত করে। কারণ তখন জীবন বেছে নেওয়াতে তোমার স্বাধীনতা থাকে। দূর্দশাগ্রস্ত হওয়া বা সুখী হওয়া- সে তোমারই ইচ্ছা। এর সাথে অন্যের কোন লেনাদেনা নাই। পৃথিবী একইরকম থাকবে; তুমি নাচ শুরু করতে পারো, এবং সারাপৃথিবী তোমার সাথে নাচবে।

তারা বলে, যখন তুমি কাঁদো, তুমি একাই কাঁদো, যখন তুমি হাসো, তখন সারা পৃথিবী তোমার সাথে হেসে ওঠে। না, এটাও সত্য নয়। যখন তুমি কাঁদো তখন সেটাও সারা পৃথিবীতে প্রতিফলিত হয়; যখন তুমি হাসো তখনও তা সারা পৃথিবীতে প্রতিফলিত হয়। যখন তুমি কাঁদো তখন মনে হয় সারা জগত তোমার সাথে কাঁদছে। যখন তুমি বিষন্ন থাকো চাঁদের দিকে তাকাও- চাঁদকে বিষন্ন মনে হবে; তারাদের দিকে তাকাও- তাদের খুবই দুঃখবাদী মনে হবে; নদীর দিকে তাকাও- মনে হবে না সে বয়ে চলেছে, বিষন্ন, অসুখী মনে হবে। যখন তুমি সুখী থাকো তখন সেই একই চাঁদের দিকে তাকাও- যেন হাসছে; এবং সেই একই তারাগুলি নাচছে; সেই একই নদী- ছন্দময় বয়ে চলেছে, সকল বিষন্নতা কোথায় পালিয়ে গেছে।

কোথাও কোন স্বর্গ বা নরক নাই। যখন তোমার ভিতরের অবস্থা স্বর্গীয় থাকে, এই পৃথিবী… এবং সেখানে যেটা আছে সেটায় একমাত্র পৃথিবী! মনে রাখবে, অন্য কোথাও কিছু নাই। যখন তোমার ভিতরে স্বর্গীয় অনুভবে পূর্ণ থাকে, তখন এই পৃথিবীতে সেটাই প্রতিফলিত হয়। যখন তোমার ভিতর নরক হয়ে থাকে তখন পৃথিবীর কিছুই করার থাকে না, সেটা সে প্রতিফলিত করে।

যদি তুমি নিজেকে দায়িত্বশীল ভাবতে থাকো তবে তুমি ধার্মিক হতে শুরু করেছো। ধর্ম ব্যক্তিগত বিপ্লবে বিশ্বাস করে। আর কোন কিছু নাই—আর সব কিছু প্রতারণাপূর্ণ, অবাস্তব বিপ্লব। দেখে মনে হয় তারা বদলে গেছে; তারা আসলে কিছুই বদলায় না। তারা পরিবর্তন নিয়ে অযথায় ঢের হৈচৈ করে- কিন্তু কিছুই পরিবর্তিত হয় না। নিজেকে পরিবর্তন না করা পর্যন্ত কোন কিছু পরিবর্তন করা সম্ভব নয়।

এইগুলি দায়িত্ববান হওয়া সম্পর্কিত সূত্র, ব্যক্তিগত দায়িত্ব। শুরুতে কিছুটা গুরুভার মনে হতে পারে তোমাদের কাছে- যে, ‘দায়িত্ব আমার’, এবং অন্য কারো ঘাড়ে তুমি তা চাপিয়ে দিতেও পারবে না। কিন্তু ভাল করে জেনে রাখো, যদি তুমি নিজে দায়িত্বশীল হও, তবেই আশা থাকে; তুমি তাহলে কিছু একটা করতে পারো। যদি এ দায়িত্ব অন্য কারো হয়, তবে কোন আশা থাকে না, কারণ সেখানে কি তোমার করার কিছু আছে? তুমি হয়ত ধ্যানস্থ হয়েছো, কিন্তু অন্যরা ঝামেলার সৃষ্টি করছে; তুমি ভুগবে। তুমি বুদ্ধ হতে পারো, কিন্তু সারাপৃথিবী সেই নরকই থেকে যাবে। তুমি ভুগবে। শুরুতে সকল স্বাধীনতা গুরুভার মনে হয়- সে কারণে লোকজন স্বাধীন হতে ভয় পায়।

এরিক ফম একটা চমৎকার বই লিখেছেন, ‘দি ফিয়ার অফ ফ্রীডম’। শিরোনামটা আমার খুব ভাল লেগেছে। মানুষ কেন স্বাধীনতাকে এতো ভয় পায়? প্রত্যকের চিন্তা অন্যরকম হওয়া উচিত, তাদের স্বাধীনতাকে ভয় পাওয়া উচিত নয়। অথচ আমরা ভাবি সবাই স্বাধীনতা চাই, কিন্তু আমার পর্যবেক্ষণ বলে- মনের গভীরে কেউই স্বাধীনতা চায় না। কারণ, স্বাধীনতা হল বিশাল দায়িত্ব। তখন কেবল তুমিই দায়িত্বপরায়ণ। তখন তুমি কোন দায়িত্ব অন্যের ঘাড়ে চাপিয়ে দিতে পারবে না। তখন তোমার নিজেকে সান্তনা দেওবার সুযোগ নাই- যদি তুমি ভোগো তবে সেটা তোমারই কোন না কোন কারণের জন্য ভোগো, তোমার নিজের জন্যই; এই কারণে, এর সূত্রপাত করেছো তুমি।

কিন্তু এই গুরুভারের মাধ্যমে তোমার জন্য এক নতুন দুয়ার খুলে যায়। তুমি সেটাকে ছুড়ে ফেলতে পারো। যদি আমার দূর্ভোগের কারণ আমারই সৃষ্টি হয়, তবে সেটাকে আমি থামিয়ে দিতে পারি। আমি একটা সাইকেলের প্যাডেল চালিয়ে যাচ্ছি এবং সাইকেলের ওপর বসে কষ্ট পাচ্ছি এবং ক্লান্ত হয়ে যাচ্ছি, এবং আমি বলেই যাচ্ছি ‘এটাকে থামাও’, এবং প্যাডেল চালিয়েই যাচ্ছি… তারচেয়ে প্যাডেল চালানো থামিয়ে দেওয়াই আমার জন্য ভাল, এবং তাহলেই সাইকেল থেমে যাবে। অন্য কেউ তো আর প্যাডেল চালাচ্ছে না।

এই হল কর্মের গুঢ় তত্ত্ব। দায় তোমারই। একবারের জন্য বিষয়টা প্রগাঢ়ভাবে বুঝে গেলে যে, ‘দায়িত্ব আমার’, তাহলেই অর্ধেক কাজ হয়ে যায়। সত্যি বলতে কি, যে মুহূর্তে তুমি উপলব্ধি করো, ‘আমি যা কিছু দুঃখ ভোগ করেছি, যা কিছু আনন্দভোগ করেছি তা আমারই জন্য, তার দায় আমার’, তখনই তুমি মুক্ত হয়ে যাও, তুমি এই সমাজ থেকে মুক্ত হয়ে যাও, এই পৃথিবী থেকে মুক্ত হয়ে যাও। এখন তুমি জীবন যাপনের জন্য পছন্দের পৃথিবী বেছে নিতে পারো। এটাই হল একমাত্র পৃথিবী! মনে রাখবে। কিন্তু এখন তুমি সেটা বেছে নিতে পারো। তুমি নাচতে পারো, এবং তখন সবকিছুই তোমার সাথে নাচবে।

 

নোট: নিবন্ধটি ‘The Essence of Yoga’ by Osho এর ভাষান্তর।

তোরিফা নাজমিনা মণি। লেখক, অনুবাদক ও শিক্ষক। জন্ম ও বেড়ে ওঠা মেহেরপুর জেলার গাংনী উপজেলার সীমান্তবর্তী তেঁতুলবাড়িয়া গ্রামে। প্রিয় বিষয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীত, ভ্রমণ, কবিতা। পেশা শিক্ষকতা।

এই বিভাগের অন্যান্য লেখাসমূহ