জীবন

অনসূয়া যূথিকা
ছোটগল্প
Bengali
জীবন

পাকশী রেলওয়ে টাউনশিপ, ছোট্ট আর গোছানো। বাংলাদেশের আর দশটা মফস্বলি এলাকা যেমন হয়, ঠিক তেমনি সাদামাটা। বড় শহরের মতো জৌলুশ নাই তার, নাই দেখানেপনাও।  রেলওয়ে এলাকার বাইরে কোন দরকারে যেতে হলে আছে রকেট, ট্রেন। পাকশীর মানুষ ঈশ্বরদীতে যেতে হলেও যায় রকেট চড়েই। পাকশীতে তো তেমন করে কেনাকাটার জায়গাই নাই৷ আছে রেলের বাজার, সস্তায় মেলে সমস্ত সদাই। স্কুল আছে গোটা দুয়েক। আর কলেজ একটা আছে বটে, কিন্তু কো এড হলেও খুব কম মেয়েই স্কুলের গন্ডি পেরিয়ে পড়তে আসে।

স্টেনো টাইপিস্টের মেয়ে সেলিনা, মেট্রিক পরীক্ষার আগেই বিয়ের তারিখ পড়ে তার। ভালো সরকারী চাকুরে, ডাক্তার বর বলে সেলিনার বাপের বাড়ির লোকেরা খুব দ্রুত বিয়ের আয়োজন করে। টেস্ট পরীক্ষার পরেই বিয়ে হয়ে যায় সেলিনার।

সেলিনার স্বামী ডাক্তার আর তার বউ আন্ডারমেট্রিক এ নিয়ে তার কোন জড়তা ছিলোনা, এসব সে ভাবেও নাই।পড়ালেখায় কোনদিনই সে মনোযোগী ছিলোনা। পড়তে হয় বলেই পড়া আর পরীক্ষায় উৎড়ে যাওয়া। যদিও পরীক্ষায় নম্বর তার খারাপ না বরং মোটের উপর ভালোই জুটতো।

বাড়ির লোকেরা তাই খুশি ছিল সেলিনার উপরে। পাড়ার সকলে তাকে মেধাবী আর রূপবতী বলে আলাদা সমীহ করতো।

সে খুব ভালো করেই জানতো লেখাপড়া করতে হয় বটে আর তা এই রকম দামী জামাই পাওয়া যাবে বলেই।আর সেলিনার রূপের কদরও বড় কম নয়। বাংলাদেশের ঘরে ঘরে মেয়েরা জন্মের পর থেকেই একটা কথা জানে, তা হলো ভালো ঘরে বিয়ে হতে হলে চেহারা ভালো রাখতে হয়!   শরীরটাকে লোকের সামনে লোভনীয় রাখতে পারলেই মধ্যবিত্তের ঘরেও চাঁদের মতো নয়া দামান জুটবে মেয়ের জন্য। প্রাইমারি পেরুনোর পর থেকেই তার জন্য বিয়ের সম্বন্ধ আসতে থাকে। বহু চেষ্টায় আটকে রেখে শেষে এইবারে ডাক্তার বরে এসে বরশি ছিঁড়লো তার।

এহেন চৌকস রূপবতী সেলিনা স্বামীর সাথে পাবনা শহরে এলো শ্বশুর বাড়ি। শ্বশুর, শাশুড়ি, দেবর ননদ কামলা পোরেত মুনিস নিয়ে ভরা ভরতি সংসার। মানিয়ে চলতে সেলিনার সমস্যা হবার কথা নয়, ঘরকন্নার কাজ তার মতো মফস্বলি মেয়েরা সেইসময় জেনেই শ্বশুরবাড়ি আসতো। তবুও শাশুড়ির মন যোগাতে সে যখন ঘরকন্নার ঊনকোটি ব্যাখানা শিখতে ব্যস্ত তখন বিনামেঘে বজ্রপাতের মতো বিধান এলো তাকে মেট্রিক পরীক্ষা  দিতে হবে।তার গুণধর ডাক্তার সাহেব স্বামীর সেটাই ইচ্ছা।

রূপমুগ্ধ জামাই কিকরে যেন জেনে গেছে যে সেলিনার সামনে অপার সম্ভাবনা সে মেধাবী। অগত্যা… সেলিনাকে ফের হাতাখুন্তির সঙ্গে সঙ্গে কলমও ধরতে হলো। বাপের বাড়ি থেকে পরীক্ষা দিয়ে এলো, সঙ্গে নাইওরও হলো।

বছর ঘুরতে থাকে! একেক করে পাড়ার সব ননদদের বিয়ে হয়ে চলেছে, সেলিনার পড়ার বহরও বেড়েছে।

সেলিনার এলাকার আর সব বান্ধবী যখন ছেলে সামলাতে ব্যস্ত তখন সে উচ্চ মাধ্যমিকের পড়া তৈরীতে ব্যস্ত।

বন্ধুদের কোল জোড়া ছেলে, আর সেলিনার কোল তখনও শূন্য!  সেলিনা পড়া নিয়ে ব্যস্ত, ভীষণ রকম ব্যস্ত। শূন্য বুক জুড়াতে, মা বলে ডাকতে কেউ আসেনা। লক্ষ্মীমন্ত বউ সেলিনার পাড়াজোড়া বড় সুনাম! সংসার সামলে সে পড়ে, কলেজ করে।

ডাক্তারী পড়তে রাজশাহী চলে যেতে হয় সেলিনাকে! বাড়ি ছেড়ে কঠিন আর রহস্যময় হোস্টেল জীবন! ডাক্তারি পড়ার চাপের সাথে যোগ হয় হোস্টেলে থাকার নানান রকম চাপ। তা থেকে মুক্তি পেতে হাতের নাগালেই ছিল বন্ধুদের নানান রকম স্বস্তির উপকরণ। রাজশাহীর বড় বড় রাস্তাঘাট, মোড়ে মোড়ে ঢোপকলে পানির সুব্যবস্হা, সিনেমা ঘরে অপেক্ষা করতো ডাক্তারি পড়ায় ক্লান্ত কিছু তরুণের আনন্দ। সমাজ তখনো এতো উদার ছিল না, মেয়েদের বাইরে বেরুনোর গণ্ডি সীমাবদ্ধ ছিল। কিন্তু উচ্চ শিক্ষার আলোতে আলোকিত বিস্তর মানুষের বসবাস ছিল রাজশাহী শহরে। মেডিকেলে পড়ুয়া তরুণ তরুণীদের শহর জুড়েই ছিল অবাধ বিচরণ। শহরের উপরেই রাজশাহী মহিলা কলেজ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য আশপাশের বিভিন্ন জেলা শহরের মানুষজনের যাতায়াত ও বসবাস ছিল রাজশাহী শহরে।

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের এক তরুণের সঙ্গে সখ্য গড়ে উঠে সেলিনার! ভেসে চলে প্রেমের স্রোতে, চলে স্বপ্নের জাল বোনা। মেডিকেল কলেজের পাঠ্যবই, এনাটমি ক্লাসের সাথে সাথে চলতে থাকে দুই প্রেমির এনাটমি ক্লাসের মহরাও! বিবাহিত সেলিনার চোখে ধরা পড়ে আরেক স্বপ্ন, মুহিবের সাথে সংসার করবার। তবেই তাদের প্রেম পূর্ণতা পাবে। মুহিবও তাতে সায় দিয়ে যায় বরাবরই। সেলিনার ব্যস্ত স্বামী তখন এফআরসিএস পড়তে বিলেতে বসবাস করছে। রাজশাহী শহরে সেলিনাও মেডিকেল কলেজের হোস্টেলে ভালো আছে, ভালো থাকবে এই ছিল তার বিশ্বাস।

সেলিনা হোস্টেল ছেড়ে মুহিবের সাথে বাসা নেয়, বাড়িতে জানায় হোস্টেলে বড় অসুবিধা হয় পড়ার। খাবারের কষ্টের কথা জেনে মমতাময়ী শাশুড়ি মা মাস খরচের টাকার অঙ্ক বাড়িয়ে দেন। গুছিয়ে মেডিকেল আর বিশ্বিবদ্যালয়ের পড়া চলে দুইজনার, সঙ্গে চলে প্রেম! স্বামী সংসার নিয়ে ব্যস্ত সেলিনা, পড়ায় ক্লান্ত হয়! পরীক্ষায় আর আশানুরূপ ফল আসেনা, নম্বরে পড়ে টান। ধীরে আস্তে টান পড়ে মুহিবের প্রেমের দরিয়াতেও।

এমবিবিএস দুইবারে পাশ করে সেলিনা, স্বামীর প্রবল আগ্রহ আর চেষ্টায়। সেলিনার আর আর বান্ধবীরা যখন বয়ঃস্বন্ধির ছেলে মেয়ের সমস্যা নিয়ে ব্যাতিব্যস্ত তখনও সেলিনা পড়া তৈরী করে,সামনেই বিসিএস এক্সাম।ফাঁকি দেবার উপায় নেই, জামাই তো জামাই শ্বাশুড়ি মাও বউকে বিদুষী বানাতে বদ্ধপরিকর। সেলিনা ভুলতে চায় রাজশাহীর সেই উদ্দাম বেগে বয়ে চলা দিনগুলোতে মুহিবের দস্যিপনা। ভুলে যেতে চায় মুহিবের প্রেমের নামে প্রতারনা৷ কোরান শরীফ সাক্ষী করে বিয়ের নাটক। নিজের ফেরেশতার মতো স্বামীকে ঠকিয়ে হাজার না লাখ টাকার শ্রাদ্ধ করে পড়াশোনার নামে ফেরেব্বাজি করার জীবন। যেই জীবনে এক স্বামী বর্তমান থাকতে মুসলিম নারী হয়েও শরিয়তের মুখে লাথি মেরে সে আরেক পুরুষের অঙ্কশায়িনী হয়েছিল! কিসের আশায়, কিসের লোভে একজন শিক্ষিত নারী হয়েও সে মুহিবের মতো প্রতারকের জালে জড়ালো!

চল্লিশ ছুঁই ছুঁই ডাক্তার সেলিনার বাপমায়ের দেয়া নাম উজ্বলতর হয় ডিগ্রির ভারে,কোল তখনো শূন্য। স্বামী সাজ্জাদ তাকে আরো আরো ডিগ্রি নিতে উৎসাহ যোগায়। পঁয়ত্রিশ বছরের পর বাচ্চা নেয়ার ঝুঁকির কথা তুড়িতে উড়িয়ে দিয়ে পড়তে বসায়। পরিবারের চাপ অগ্রাহ্য করে বউকে বিদুষী বানাতে যারপরনাই আগ্রহী হয়। বাচ্চা তো যে কোন সময় নেয়া সম্ভব, তারা দুইজনাই ডাক্তার যখন। টাকার অভাব নাই, পরিচর্যার জন্য ভাবতে হবেনা। আরো বছর খানেক পরে বাচ্চা নিলেই হবে, সমস্যা নাই। এই রকম ভেবে নেয় সাজ্জাদ, সেলিনাকেও বোঝাতে সক্ষম হয়।

পঞ্চাশ পেরুনো আলহাজ্বি ডাক্তার সেলিনা! কেবল হিজাব না, বোরকা ধরেছেন বেশ কিছুদিন হলো।

পঞ্চাশ পেরিয়ে পোস্ট মেনপোজাল সিন্ড্রোম আর হরমোনাল ইমব্যালেন্সে জেরবার ডাক্তার সেলিনা! মাসিক বন্ধের দাপটে ঘামতে ঘামতে রাতদিন ছুটতে থাকেন। সঙ্গে

আট বছরের পুত্র অর্কর দৌড়াত্ম সামলাতে নাজেহাল।হাইপো থারয়েডের রোগী ডাঃ সেলিনা ততোদিনে। মোটাসোটা শরীরের ভীষণ ব্যস্ত ডাক্তার সেলিনা ছেলের রোজকার আব্দার মেটাতে আরো ব্যস্ত হতে হতে ক্লান্ত স্বরে শ্বাস চেপে বলেন, আহা জীবন মধুরই বটে!

অনসূয়া যূথিকা। লেখক ও সংস্কৃতিকর্মী। জন্ম ও নিবাস বাংলাদেশের ঢাকায়।

এই বিভাগের অন্যান্য লেখাসমূহ