প্রক্সি
তারপর ইলেকট্রিক বিল জমা দিতে যাবো। আমার দেরি হবে আসতে। স্বামী অমর বলে, ঠিক আছে।…..
নিজের ভাগ্যকে বিশ্বাস করে উঠতে ‘বে-সম্ভব‘ বেগ পেতে হয় নূর বানুকে। পরিষ্কার শাড়ি-সায়া পড়ে সাফ-সুতরো বিছানা-বালিশে শুয়ে তার ঘুম নিরুদ্দেশ হয় কোথায় কে জানে – সাথে আবার যোগ হয়েছে ভোর রাতে জেগে উঠে সেহরি খাবার উত্তেজনা। আল্লাহর শোকর গুজার করতে করতে ঘুমানোর জোড় চেষ্টা চালায় নূর বানু।
আধ-পাগলা স্বামী কুদ্দুস কামলা মরার সময় নূর বানুর জন্য কী আর এমন রেখে গিয়েছিল- দুই বছরের ছেলে রহমান, পেটের মধ্যে সাত মাসের হুর বানু আর নূর বানুর জঠরে অপার্থিব ক্ষুধা, এই তো! আল্লাহ্র কী বিচার দেখো- নূর বানুর ছেলে- মেয়ে দুটিও হয়েছে মায়েরই মতো। ক্ষুধা সইতে পারে না একদণ্ড, পারলে মাটি-কাঠ-পাথর-নদী- ক্ষেত – খামার কী তামাম দুনিয়াটা খেয়ে হজম করে ফেলতে পারে চোখের নিমেষে। দুই হাভাতে সন্তান আর নিজের পেটের দূর্দমনীয় ক্ষুধা নিবারণে নূর বানুকে কী কী না করতে হয় জীবনভর! এগারো বারো বছরই সে টেনেছে চেয়ারম্যানের বিছানায় পরা বড় বউটাকে। বিছানায় পরে থেকে থেকে বুড়ির পিঠ ভরে গিয়েছিল ঘায়ে- গন্ধে পোকা-মাকড়, শেয়াল কুকুর পালিয়ে কূল পায় না। তার ওপর ছিলো বুড়ির পেটের ব্যারাম- দিনে দুই-তিনবার কাপড়-চোপড়ে হেগে-মুতে একসার করতো। নূর বানুর তবুও সয়ে যেতো। পেটে খেলে পিঠে সইতে দোষ কী! চেয়ারম্যানের বউ এর উচ্ছিষ্ট মাছ-দুধ-কলাটা কতোদিন তাদের তিন হাভাতের জিহ্বা-জঠর সুখে ভরিয়ে দিয়েছে।
শিল্পী: রিয়া দাস
এ’বাড়ির বছর-বান্ধা কামলা ছিলো কুদ্দুস পাগলা। বাড়ির গোয়াল ঘরের পাশ দিয়ে ছিল তার ছাপরা ঘর। নূর-বানুর ভাগ্য ভালো, স্বামী মৃত্যুর পর সেই ছাপরাটা ছাড়তে হয়নি। ওই বছরই যে চেয়ারম্যানের বড় বউ বিছানায় পড়লো। সগীর কামলা কী কম চেষ্টা করেছে তাকে ঘর ছাড়া করতে! আল্লাহর এই ‘ভুতাইরে’ দুনিয়ায় এক বাবা ছিলো তার, মরেছে কবে কোন আদ্যিকালে স্মরণেও আসে না। ভাইয়েরা কুদ্দুস পাগলার কাছে বিয়ে দিয়ে কোন রকম বিড়াল পাড় করেছে। সেই থেকে চেয়ারম্যান বাড়ির চৌহদ্দিই তার ঠিকানা। স্বামী বেঁচে থাকার দিনগুলিতে তার খুব শখ হতো তাকে সাথে নিয়ে বাপের বাড়ি নাইওর যেতে। স্বামীও গেছে সাথে সেই শখও। ওহ! আল্লাহ্! নূর বানুর তো বাপের বাড়িই ছিল না! চেয়ারম্যানের ছোট বউকে দেখে দেখে এইসব বড়লোকি শখ আহ্লাদ জাগতো তার মনের গহীনে, গোপনে।
ছোট বউ ছিল খুব খান্দানি বাড়ির মেয়ে। পর পর দুই স্বামীর ঘরে কোন ছেলে-পুলে না হলে তৃতীয়বারের মতো বউ হয়ে আসে সে ‘আধা বুইড়া’ চেয়ারম্যানের বাড়িতে। এখনও কী চেহারা তার! যেমন উঁচা-লম্বা তেমন শরীর স্বাস্থ্য। তার ফর্শা ভারী শরীর, ধীর স্থির চলাফেরা, মৃদু কণ্ঠের কথাবার্তা খুব টানতো নূর বানুকে। সবচাইতে বেশি টানতো দিন-রাত তার ধর্ম-কর্ম, নামাজ-রোযার হৈ-হাঙ্গামা। আশে-পাশের বাড়ির বৌ-ঝিরা আসতো তার কাছে ধর্মের নানা নিয়ম-কানুন, কেচ্ছা-কাহিনী শুনতে। বাড়ির বান্দিরা, কামলার বউরাও আসা-যাওয়ার পথে, কাজের ফাঁকে ফাঁকে সেইসব ভালো ভালো কথা শুনে নিজেদের জন্য টুকরো-টাকরা সোয়াব জুটিয়ে নেবার সুযোগ ছাড়তো না। নূর বানুরও খুব ইচ্ছা করতো ছোট বৌয়ের মতো সাফ-সুতরা হয়ে ওয়াক্তে ওয়াক্তে নামাজ পড়তে। বছরের বাঁধা রোজা ছাড়াও সপ্তাহে সপ্তাহে মানত করে রোজা রাখতে। স্বামী যতোদিন বেঁচে ছিলো ভুলভাল সুরা-কালাম পড়ে দিনে দুই-এক ওয়াক্ত নামাজ সে পড়েই ফেলতো। রমজানের রোজাও রেখেছে পর পর কয়েক বছর। আল্লাহর ‘লীলা’ ছাড়া কী! রোজা রাখলে তার রাক্ষুসে ক্ষুধা কোথায় যে লাপাত্তা হতো। এটা সেটা বেহেস্তি খানার কথা ভেবে কী অনায়াসে একটা করে অভুক্ত দিন পার করে দিতো নূর বানু। আল্লাহ্র কুদরতে সেহেরীতে খাওয়া সামান্য কাঁঠাল-পান্তা পেটের মধ্যে ফুলে ফেঁপে বেড়ে উঠলে কোথায় পালাতো তার সর্বগ্রাসী ক্ষুধা।
বড় বৌয়ের দেখভাল করতে গিয়ে সে নামাজ-রোযা সব ভুলেই বসেছিলো। নাপাক শরীরে আল্লাহ্ রসুলের নাম নেয় সে কোন মুখে! খালি কী আর বড় বউয়ের গু-মুত ধরেই নাপাক হতো শরীর তার। চেয়ারম্যানের কলেজে পড়া ছেলেটা সুযোগ পেলেই তো তাকে এখানে-সেখানে শুইয়েছে কতো বার। বাড়িতে কামলা-কিষানই কী কম ছিলো!
বড় বৌ মরেছে চারমাস। নূর বানুর কোন নির্ধারিত কাজ ছিলো না চেয়ারম্যান বাড়িতে। যখন যেখানে দরকার হয়েছে হাত লাগাতে ছুটে গেছে সে। প্রয়োজনের অতিরিক্ত কর্মদক্ষতা দেখিয়ে এ’বাড়িতে তার অবস্থান নিশ্চিত করাই ছিলো তার লক্ষ্য। কয়েকমাস হলো ‘বিহানে’ উঠে রহমান আর হুর বানু পাড়ার ছেলে-মেয়েদের সাথে দল বেঁধে যায় মসজিদের বড় হুজুরের কাছে আমপারা শিখতে। পরের বেলায় প্রাইমারি স্কুলে যায় বাংলা পড়তে। অকস্মাৎ চেয়ারম্যান বাড়ি ছাড়তে হলে এই নিয়মিত ব্যবস্থাপনা ভেঙ্গে পড়বে। নূর বানুকে আবার কোথায় কোথায় ঘুরতে হবে ছেলে-মেয়েকে নিয়ে।
এবারে ছোট বউ অসুস্থ হতেই দুর্ভাবনা বিদায় হলো নূর বানুর। আল্লাহ্র লীলা ছাড়া আর কী! ছোট বউয়ের পেটের নাড়িতে কী এক মরণ রোগ বাসা বেঁধেছে। ডাক্তারের কঠোর নিষেধ, পেট খালি রাখা যাবে না এক বেলাও। কী সর্বনাশ! রোজা শুরু হতে সপ্তাহ বাকি নেই, বুদ্ধি হবার পর যে মেয়ে মানুষটা কোনদিন একটাও রোজা বাদ দেয় নাই, তার সাথে আল্লাহ্র এ’কেমন বিচার! মসজিদের বড়-মেঝ-ছোট হুজুরেরা শলা-পরামর্শ করে শেষে গিয়ে এই পথ বাতলালেন। আল্লাহ-রসুলের প্রতি নূর বানুর বিশেষ ভক্তিভাব বড় হুজুরের জানা ছিলো। তার উছিলাতেই এই দফা নূর বানুর জীবন ও জীবিকা নিশ্চিত হলো। নাহ, নূর বানুকে চেয়ারম্যান বাড়ি ছাড়তে হবে না। বরং ছোট বউয়ের ঘরের পাশে ছোট ঘরটাতেই সে এখন থেকে তার ছেলে-মেয়েদের নিয়ে ঘুমাবে। ছোট বৌয়ের ফরয রোজা, বছরব্যাপী মানতের রোজা সবই নিয়ম করে নূর বানুই রাখবে, ছোট বৌয়ের সাথে ওয়াক্তে ওয়াক্তে নামাজ পড়বে, জিকির-আশকার করবে। এখন থেকে চেয়ারম্যান বাড়িতে এই হবে নূর বানুর কাজ।
ছোট বৌয়ের নামে রোজা রাখলেও কিছু সোয়াব কী তার বরাতেও জুটবে না? এই প্রশ্নের সম্ভাব্য উত্তর নিয়ে ভাবতে ভাবতে উত্তেজিত, উচ্ছ্বসিত দুটি চোখে এক সময় ঘুম নেমে আসে নূর বানুর।
তারপর ইলেকট্রিক বিল জমা দিতে যাবো। আমার দেরি হবে আসতে। স্বামী অমর বলে, ঠিক আছে।…..
নভেম্বর চলছে। অনির সাথে আজ দেখা হবে তা জানাই ছিল। এই তো ক’দিন আগেই দেখা…..
বুড়িমাসি বলেন,জীবনটা বালির ঘর গো।ঢেউ এলে ধুয়ে যায় জীবনের মায়া।তবু বড় ভালবাসা ওদের দাম্পত্যে।রোদের চাদরের…..
এক ড্রইং রুমে বসে রয়েছে সদ্য কিশোর উত্তীর্ণ তরুণ গোয়েন্দা সজীব। সামনের টেবিলে ছড়িয়ে…..