জুলাইওয়ালার বৃষ্টিবিভ্রম

রুণা বন্দ্যোপাধ্যায়
কবিতা, প্রবন্ধ
Bengali
জুলাইওয়ালার বৃষ্টিবিভ্রম

ইদানীং ঠাণ্ডা শব্দগুলো আঙুল থেকে খুলে রাখি। শব্দের ভেতর কিছুটা টিউন্ড স্পেস। আমি গান ভাবলে তুমি গানান ভাবো। আসলে রংমিলোন্তি খেলারা কবেই ছেড়েছে তাসের দেশ; শালবনী ঘরবারান্দায় গোলগাপ্পা বিতানের গীত। শব্দের কোনো দিগন্তের দায় নেই। অনুরোধের সূচী সারাই হলে আকাশবাণীতে যেমন। বৃষ্টি এলেই নেগেটিভে নেমে যায় পালক আর সেফটিপিনে সারাই হয় বসন্ত। আমি দূরবীনে চোখ লাগিয়ে দেখি কীভাবে বরফের দেশ পেরোচ্ছে ভাষা। হৃদয়ের চাপে গলে যাচ্ছে ফুটপ্রিন্ট। আমি একটা দুটো কল্পলোক জুড়ে দিই শব্দের বারন্দায়। আরামকেদারার হাতলে লেগে যায় চুমু গড়ানো চাঁদের দাগ। সেই দাগ ধরেই জঙ্গলে হুল্লোড় তোলে শেরখান। রাতের জানলা বানভাসি হলে শার্সিতে মুখ রেখে দেখি টারজানের দুরন্ত লাফ।

এক বৃষ্টিভোর সন্ধ্যায় জুলাইওয়ালার আগমন। ক্যালেন্ডারের হিসেবটা যদিও জুলাই নয়। গ্লোবাল ওয়ার্মিং আর ক্লাইমেটিক চেঞ্জের জেরে বৃষ্টিভোর সেপ্টেম্বর। অঝোর বৃষ্টিরেখার কিনারে নিঝুম আমি। বৃষ্টি কুড়োনোর আকাঙ্ক্ষায় মাটিতে ঝুঁকে, কারণ কবির ওসকানি-

তুমি ওঠালে না ব’লে
বৃষ্টি শুধু পড়েই গেল চিরদিন [জুলাইওয়ালা]

আপনি নিশ্চয়ই ধরে ফেলেছেন আমি সেই ‘জুলাইওয়ালা’-তে। কবি ইন্দ্রনীল ঘোষের দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ। কোনো মাপে বা পরিমাপে ধরা না দিয়েই অদ্ভুত শিহরন কবিতার শরীরে কিংবা অবয়ব ছেড়ে অলক্ষ্যে; হয়তো বা কোনো প্রতীক্ষার। কবি দূরত্বের টিউন বাড়ালেন, ফুল ভয়েজে জুলাই। গানে ও প্রাণের এই সন্ধিক্ষণে কতটা জুলাই এল, কতটা বৃষ্টি, সমের ধারে ভিড়বকিভিড়বনা ভাবতে ভাবতেই –

জলে ভিজে, সব পথ
উঠে এলো নোটেশনে
গাইতে গাইতে হঠাৎই এক চৌরাস্তা
এরপর কোন গান
আমি থামলাম
সমের ধারে বাড়ি ঘর, অথবা এই পুকুর
সবই তো জুলাইয়ের
তবে আমার কি
এই থেমে থাকার কি [জুলাইওয়ালা]

“বড় হয়ে তুমি ইন্দ্রনীল হতে চাও!” – কবির গভীর গহন মানসযাত্রা থেকে উঠে আসে এই প্রশ্ন। সমস্ত প্রশ্নগুলোর সম্ভাব্য উত্তরের সম্ভাবনার দ্বারগুলো হাট খোলা। কবি হাঁটতে থাকেন নির্দিষ্ট থেকে অনির্দিষ্টে, নিশ্চিত থেকে অনিশ্চিত ভবিষ্যের দিকে, ওইখানে আছে আমাদের স্বপ্ন, নতুনের সংকেত।

শব্দগুলো পরপর না পরস্পর, বুঝি কীভাবে
নীলের সামনে হাত নাড়িয়ে দেখি
ইন্দ্রতে কেউ রোক্কে বলে কি না
আর বললেই
ধানক্ষেত গড়িয়ে পড়ে মোম থেকে
আলো ফাটিয়ে ট্রেন চ’লে যায় [দুগ্‌গা দুগগা]

ওই অপু-আকাশ মোমদানি থেকে দুগ্‌গা দুগ্‌গা, মোম থেকে গড়িয়ে পড়া ধানক্ষেত আর মোমালো ফাটিয়ে চলে যাওয়া ট্রেন… আপনি কি অপু-দুর্গার সেই মুহূর্তটিকে ছুঁয়ে ফেললেন? কিন্তু মুশকিল হল কবি চেনা ছবির আত্মিক স্পর্শটুকুমাত্র গ্রহণ করেন। তারপর আপন জারকরসে জারিত করে সেই চেনা ছবির বিষয়টিকে বিষয়হীন করে তোলেন। কিছু যুক্তি আর যুক্তিহীনতার অবয়বে রেখে যান ভাবনার টুকরো। আর সেই টুকরোগুলোই কবিতার চলনশক্তি, যার গতি ও রতি দুটোই ভাবনার সম্ভাবনায় মুখর। বহুমুখী নির্মাণে এ এক নতুনতর অভিযান।

পঙ্‌ক্তিগুলো নেড়ে চেড়ে দেখি কীভাবে কোনদিকে প্রতিফলন নাকি চেতনাস্তরের ইন্ডেক্সভেদে প্রতিসরণ। ভিন্ন থেকে ভিন্নতর বিস্তীর্ণতায় মনের মধ্যে ঘুরে ঘুরে বাতাস বোনে ঐ প্রশ্ন – “বড় হয়ে তুমি ইন্দ্রিনীল হতে চাও!”

আমি তো কবিতাই লিখবো
আর শ্লোক খুলে, পালিয়ে যাবে কাজলাদি
ভাই কাঁদবে
নেপথ্য মিউজিক, যে মা হল না
সেই না-হওয়া
ভরিয়ে দেবে বাঁশবাগান [পুতুল]

এতক্ষণে আপনার মাথার মধ্যে নিশ্চয়ই ঘুর ঘুর করছে বহু পুরোনো সেই সুর,

বাঁশ বাগানের মাথার ওপর চাঁদ উঠেছে ওই
মা গো আমার শোলোক বলা কাজলাদিদি কই

এ-ও শুধু নেপথ্য মিউজিক, আবহসংগীতে সম্ভাবনার রং, যার অন্তরালে কবি হাঁটা পথের ভুল স্টেপগুলো খুলে খুলে দেখছেন; আত্মসমীক্ষার পাতা উল্টে আজীবনের খেরোখাতায় ক্রিয়া বিক্রিয়াগুলি। পাঠককে একটি সম্ভাব্য চেনা সুরের ইঙ্গিত ছুঁড়ে দিয়েই কবি চ্যালেঞ্জ জানালেন অচেনার; পাঠকের মাথায় তখন গুনগুন করবে শব্দসম্ভাবনার মন্ত্র; যা এক অনন্ত সম্ভাবনার জন্মমুহূর্ত। জীবনকে সঙ্গে নিয়ে চলতে থাকেন কবি; যেখানে হাত রাখলে জীবনের ওম খুঁজে বৃষ্টি নামে; যেখানে ঠোঁট রাখলে অসীম সম্ভাবনাময় চুম্বনের স্মৃতি; জীবনের খেরোখাতার পাতা উল্টে ঝাপসা মনআয়নায় অসম্ভব মেঘেদের জলছাপ।

এই পার্থিব জগতের অপার্থিব ব্রহ্মাণ্ডতলায় কবির বিস্ময়ই কবির দর্শন। কবিমাত্রই চিরন্তন এই বিস্ময়বোধ। এখানে দেখি ক্রিয়াপদের বিস্ময়ে বিস্মিত কবি। প্রতিটি শব্দে একাধিক ভেক্টর সংযোজন করে চেনা শব্দকে ব্যবহার করেছেন নতুন শব্দার্থে। সিন্ট্যাক্সের এই খেলায় পাঠক চমকে ফিরে তাকান পুরোনো ক্রিয়াপদটির দিকে, নতুন ব্যঞ্জনায় বিস্মিত হয়ে ভাবেন, তাই তো! বৃষ্টি যদি পড়ে তবে তাকে ওঠানোই বা যাবে না কেন? ভাষার গঠনতন্ত্র নিয়ে তাঁর নিরীক্ষাগুলো অপূর্ব মুন্সিয়ানায় রোপণ করেছেন “বৃষ্টি পড়া”,  “তারা ফোটা”, “কান পাতা” ইত্যাদি শব্দবিন্যাসে-

বৃষ্টি যে পড়েছিলো
তা তুমি ওঠাওনি কেন [জুলাইওয়ালা]

এত যে তারা ফোটে
আকাশের লাগে না কখনো! [জল]

রবিঠাকুর তো বলেই খালাস, কান পাতো
পাততেই পারতাম
যদি কানের খুঁটি থাকতো, দড়ি থাকতো
নইলে হাওয়ার দিনে দেখবেটা কে [বুঝে শুনে কথা বলুন]

পাঠকের বুদ্ধিবৃত্তিকে ঘুম পাড়িয়ে কিংবা বুদ্ধির পাহারা এড়িয়ে সোজা হৃদয়ের গোপন কক্ষে হানা দেবে – এমনটা কবি ইন্দ্রিনীলের উদ্দেশ্য নয়। বরং প্রথম পাঠে এক রহস্যময় দরজার সামনে দাঁড় করিয়ে দেন পাঠককে। বন্ধ দরজা অথচ ওপার থেকে রহস্যময় হাতছানি দুর্বার হয়ে উঠছে। পাঠক ফিরে ফিরে আসছে পঙ্‌ক্তিমালার কাছে। কিছু কি রয়ে গেল যা কুড়োনো গেল না? কিছু কি রয়ে গেল যার প্রতিসৃত পথ বিমুখী হল? পাঠক খুঁজতে থাকেন পরবর্তী পাঠগুলিতে, দ্বিতীয় তৃতীয় চতুর্থ…। অনুভবের অলিগলি ঘুরে ক্রমে পাঠক কবির সুরে সুর মেলাতে থাকেন; অভূতপূর্ব রূপদক্ষতায় অভিভূত হতে থাকেন-

শার্টের কলার যদি পাখিরূপ হয়
তবে ওড়ে না কেন
আকাশে ওড়ে না, আগুনে পোড়ে না
এ এক সিদ্ধান্ত
ধান তো!
ক্ষেতি তো হয়!
সেই কবে উলু দিয়েছিলে
পানের কুচোনো দাগ, চাষে লেগে আছে
এখন হবেটা কি
ক্ষেতগুলো উবু হয়ে ট্রেন দেখবে
আর দিগন্তের দায় আমার
পরিষ্কারের দায় আমার

কলারকে কলের বহুবচন ভাবো
ওই জল নামলো
কাঁধের ওপর সেই প্রপাতগুলো নিয়ে
আমি বচন বহিতা দেখি
মর্দানি পা ধা নি … [পুরুষ পুরুষ]

নদী যেখানে বুকের ভেতর মণিমুক্তো লুকিয়ে রাখে সেখানে উপরিতল শান্ত সমাহিত। সংবেদনশীল পাঠকের দরবারে নির্জন ডাক ওঠে, এসো স্পর্শ করো, বুদ্ধি দিয়ে হৃদয় দিয়ে অনুভবের রিখ্‌টারে। আবার কখনও নদী উচ্ছল, জলতরঙ্গের ঝঙ্কার আপনি ওঠে। নিঃসংশয় গান ওঠে রসিক পাঠকের রসবোধে–

এ আমার রসিক বেলার রঙ
এ আমার বেসিক খেলার আলো
উত্তম তো স্টুডিও যাবে
আর অধম থাকবে বঙ্কিমে
রাতের নিচে ধনুক শানাবে, বলবে
চাঁদ রে এত গুল রেখেছো জ্যোৎস্নায়! [চাঁদেল]

ডায়েরি বললেই চোখের সামনে চুপচাপ হেঁটে যাওয়া কিছুটা সময়। নির্জনে মুখ ডুবিয়ে তোমাকেই ফিরে দেখা। তোমাকে মানে কি নিজেকে দেখা? নিঃসঙ্গ যাপনের স্পন্দনটুকু যা বহমান চেতনার সঙ্গে লেপটে আছে চিরকাল। অথচ প্রতিমুহূর্তে হৃদয়ঘটিত বখাটেপনা সুর থেকে বেসুরে রং থেকে বেরঙে একটা গল্প চাইছে। গ-ল-প কোনটাকে কার নীচে বসাবো তারই হিসেব কষে বখে যাওয়া কার্শিয়াং-বোতাম। ঘুমোলে কী হয়, ঘুমকে ভাঙলেই বা কী হয় – এ সব প্রশ্ন নয়; আবোলতাবলের গড়ানো প্রেক্ষাপটে কিছু প্রশ্নোত্তর খেলা –

বর্ষা শেষ। রঙের স্টপেজে আজ গোটাটাই ব্রেইল। আমি সেই স্কুলের কাছাকাছি। কতগুলো দাগ ছুঁয়ে ছুঁয়ে একটা ভাষা কেটে যাচ্ছে – সেই খেলাটার কাছাকাছি। ওরা আমায় রেফারি করেছে।  টুপটাপ ফাউল কুড়োচ্ছি মাঠ জুড়ে। নামানো টুপির পাশে বিকেলও নামানো। দেখছি, শেষ যেদিন শ্রাবন্তী ভিজছে – ধীরে ধীরে, চোখ হারাচ্ছে জুলাই… [ডায়েরি / অগস্ট – ২০০৭]

যাঁর কাব্যগ্রন্থে আমার বৃষ্টিবিভ্রম সেই জুলাইওয়ালার সংক্ষিপ্ত পরিচয়:

শূন্য দশকে লিখতে আসা অপর-ধারার লেখকদের মধ্যে ইন্দ্রনীল ঘোষ এক উল্লেখযোগ্য নাম। ‘বৈখরী-ভাষ্য’, ‘ইন্ডিয়ারি’ ও ‘অপরজন’ পত্রিকার সাথে যুক্ত। কবিতা এবং গদ্য দুই-ই তাঁর মাধ্যম। এবাদেও সিনেমা নিয়ে উৎসাহিত। কবিতায় বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন পরীক্ষা চালিয়েছেন ইন্দ্রনীল। কখনও তা যেমন, ভাষার গন্ডীর মধ্যে দাঁড়িয়েই সিম্যান্টিক ও সিন্ট্যাক্সের তারতম্যে বিবিধ ব্যঞ্জনার খেলা (‘রাত্রে ডেকো না, প্লিজ’, ‘জুলাইওয়ালা’); তেমনই কখনও তা সেই গন্ডী পেরিয়ে চ’লে গেছে ধ্বনি কবিতা বা Sound Poetry-র দিকে (‘জুলাইওয়ালা’-র শেষভাগ, ‘লোকটা পাখি ওড়া নিয়ে বলছে’); আবার ‘সার্চ করছেন দেবাঞ্জন’-এ তিনি তুলে আনেন গ্রাফ-কবিতার প্রস্তাবনা, প্রশ্ন তোলেন কবিতার একটি নির্মিত-কাঠামোর মধ্যে লুকিয়ে থাকা অসংখ্য খামখেয়ালী (Arbitrary) কণাদের নিয়ে। খুব বিশেষ প্রয়োজন বাদে ইচ্ছাকৃত জটিলতার পরিপন্থী ইন্দ্রনীল মনে করেন, সমস্ত পরীক্ষা নিরীক্ষার মধ্যে দিয়েই লেখকের গন্তব্য আসলে সহজের দিকে। ইন্দ্রনীলের এযাবৎ প্রকাশিত বইগুলি কালানুক্রমে, কবিতা – রাত্রে ডেকো না, প্লিজ (প্রথম প্রকাশ ২০০৫), জুলাইওয়ালা (২০০৯), লোকটা পাখি ওড়া নিয়ে বলছে (২০১২), গদ্য – সার্চ করছেন দেবাঞ্জন (২০১৫), নুলোর পৃথিবী ও অন্যান্য গল্প (২০১৬)।

এই বিভাগের অন্যান্য লেখাসমূহ