জুয়েল মাযহারের কবিতা

জুয়েল মাযহার
কবিতা
Bengali
জুয়েল মাযহারের কবিতা

জন্মাঞ্জলি

আমার বাবার ছবি মুছে দিল রাতের জঙ্গল;
আমার মায়ের মুখ এখনো বেড়াতে আসে
পাতাঝরা গাছের মিনারে!

 

মেগাস্থিনিসের হাসি

নিঃশব্দ কামানে তুমি একা বসে ভরছো বারুদ
শীতকাল গেল;

নিঃশব্দ কামানে তুমি একা কেন ভরছো বারুদ?

আমি ভাবছি: মেগাস্থিনিসের হাসিও কি মেগাস্থিনিস?
শক্তিচালিত এই তামাশার মধ্যে বহু
বাদামি ঘোটক উড়ে যায়;
—এঞ্জিনের শব্দ আর রোবটের কাশি শোনা যায়।
নিঃশব্দ কামানে তুমি এখনো কি ভরছো বারুদ?

 

ক্রমহননের পথ

অপাপবিদ্ধের মতো জোড়া জোড়া চোখ দেখে ভয়;
এই বুঝি রিরংসা নামের কোনো বিস্ফোরণ ঘটে।

তবু নিথরতা;
দূরে ট্রেন চলমান, ঝাউবনে স্রোতকল্প দোলা।

এসো, তোমাকে উদ্ভিন্ন করি রাতপরিদের নামে
ইন্দ্রিয়ের ক্ষমজলে, তরল ক্ষীরের মতো
গলমান নির্বেদের স্রোতে।

সহস্র তিরের শব্দ, শত হুল তোমার পেছনে;
তুমি একা। তাতে ভয়!
ভয় বুঝি সংবেদনের কোনো ডানা?

তাহলে উড্ডীন হও, উড়ে চলো বনের ভেতর।
ক্রমহননের পথ পাড়ি দিয়ে দ্যাখো:
ঘাসে ঘাসে সিঁড়ি চলমান।

পর্বতের ধাপে ধাপে মনুষ্যখুলির ছায়া প্ররোচনা আকারে সাজানো;

আর দ্যাখো, জলের আঙুলে আঁকা চিত্রময়
শুয়ে আছো তুমি।

তোমাকে ঘিরেই জাগে শত শত দেয়াল, প্রাকার;
ক্রমহননের পথ আমাকে বেষ্টন ক’রে
ঝুঁকে আছে তোমার উপর!

 

রাত্রি ও বাঘিনী

বাঘিনী আমারে শুধু ডেকে চলে ভরা পূর্ণিমায়
বারবার কাতর মিনতি করে আমি তারে বলি:
দয়া করো, আমায় খেয়ো না, আমি অসহায় অতি ছোটো জীব

বাঘিনী করুণা করে, আমাকে থাবায় পুরে কি ভেবে
ঘুমিয়ে পড়ে। এ-সুযোগে আমি তার মুঠো গ’লে নামি;
বুকে হেঁটে-হেঁটে তার গর্জনের সীমানা পেরোই
সন্তর্পণে ঢুকি পড়ি বনপ্রান্তে, পরিত্যক্ত ঘুমের গুহায়
ভাবি, বাঁচা গেল! ভাবি, আমাকে পাবে না আর তার
দাঁত-নখ, অত্যধিক প্রেমের আঁচড়।

অবশেষে এ-গর্ভগৃহের ছায়ায় বসে আমি নিরাপদ!
থ্যাঁতলানো অণ্ড-শিশ্ন, কালশিটে ঊরু ও জঘন, আর,
এই দুটি রক্তমাখা ঠোঁটে বিশল্যকরণী ঘষে ফিরে পাবো
অনাঘ্রাত আমাকে আবার।

আমাকে পাবে না আর বাঘিনীর অতিরিক্ত রতি-আক্রমণ!
কিন্তু হায়, প্রতিবারই স্বপ্নে বাঘিনী তবু পিছু নেয়;
তীব্র চোখে ফসফরাস জ্বেলে
এক লাফে সীমান্তের নদীটি পেরিয়ে
অতর্কিতে সামনে আসে; ভয়ানক দু’পায়ে দাঁড়ায়, আর
দু’বাহু বাড়িয়ে তার সে আমাকে কোলে তুলে নেয়;

ধীরে ধীরে চুমু খায়, ঠোঁটে ও গলায় তার দাঁত-নখ গেঁথে রক্ত চাটে
বেপরোয়া জ্বালামুখে আমাকে পুড়িয়ে শুধু কাবাব বানায়
শেষ রাতে মাতাল চাঁদের নিচে অ্যাম্বুলেন্স এসে
আমাকে উদ্ধার করে দ্রুত কোনো হাসপাতালে ছোটে।

 

রুবিকন

আমার সামনে এক রুবিকন, পুলসিরাত, ভয়ানক ক্রূর অমানিশা
এর সামনে একা আমি;
কিস্তিহীন, নিরশ্ব, রসদহীন
পিগমিদের চেয়ে ছোটো আমি!

আর আমার ভাঙা হাড়, থ্যাঁতলানো খর্বকায় দেহের ভেতরে যতো
রক্ত-পিত্ত-কফ-থুথু-বীর্য-লালা সবই
অসীম বরফে-হিমে গ্রানিটের মতো ক্রমে হতেছে জমাট;

আর ওই থেকে-থেকে ফুঁসন্ত ব্লিজার্ড এক,
আর এক আনক্যানি করাল হিমানী
আমাকে আদ্যন্ত ঘিরে আছে।

সান্নিপাতিক হেতু নাসিকার ছিদ্র বেয়ে
চোখ বেয়ে যে-জল গড়ায় সে তো মাটিতে পড়ে না;
শূন্য থেকে বর্শা হয়ে সিগ্নি ঝুলে রয়—যেন নর্স দেবতার!
সারি সারি শতশত বল্মীকূট পেছনে আমার।

তাদের আড়াল হতে জুল্‌জুল্‌ চেয়ে থাকে লোম-কর্ণ শিবা।
লোলজিভ, অভ্রংলিহ জিভ নাড়ে মেদুসা-মনসা আর কালী।

আমার তরবারি নাই। তাই
দু’হাতে নখর আমার তরবারি!
আমি কি ডরাব?
না, আমি ডরাব না।

অসীম হিম্মত লয়ে এক পায়ে হয়ে আছি খাড়া ।
কিস্তিহীন, শস্ত্রহীন, নিরশ্ব, রসদহীন আমি একা;

আমি ফুঁ দিচ্ছি হাপরে আমার।
আমি আমাকে বলছি: ওঠো, জাগো!
আমার অশ্ব নাই।
এক দুর্বিনীতাশ্ব জন্ম নিচ্ছে ভেতরে আমার।

থ্যাঁতলানো ভাঙা পায়ে আমি লাফ দিচ্ছি। আমি সাঁতরে চলেছি
আমার আয়ুর চেয়ে দীর্ঘ এক গন্ধকের নদী।

আমি ভেদ ক’রে যাবো ক্রূর অমানিশা
আমি জয়ী হব,
আমি পার হব রুবিকন!!

জুয়েল মাজহার। জন্ম ১৯৬২ সালের ২০ জানুয়ারি। নেত্রকোণা জেলার কেন্দুয়া থানার গড়াডোবা ইউনিয়নভুক্ত সাখড়া গ্রামে। পিতা মুকদম আলী, মা বেগম নূরজাহান (সরু)। দুজনই প্রয়াত। বিবাহিত। বন্ধু শিরিন সুলতানা ও পুত্র অর্ক মাজহারের সঙ্গে থাকেন ঢাকায়। বর্তমান পেশা সাংবাদিকতা। কৈশোরে নিরুদ্দেশযাত্রা। দীর্ঘ...

এই বিভাগের অন্যান্য লেখাসমূহ

ঝরা পাতা

ঝরা পাতা

  চারিদিকে কোলাহল শূণ্যতা করেছে গ্রাস, বেদনা বিধুর অতৃপ্ত বাসনায় হাহাকার, অজান্তে নীরবতা তোমার স্পর্শে…..