ইমন কল্যাণ
পরিচ্ছেদ ৬ অনেক রাতে ফিরেছিল কল্যাণ ওরফে শহীদুল।গাড়িটা শেডে রাখার পর দু’বার হালকা করে মা…..
মেয়েটা যে কি বলে ছিল মেয়েটাই জানে, আমি শুধু তাকিয়েছিলাম তার বৃষ্টি-স্নাত মুখটার দিকে। কী এক পবিত্র আভা ছড়িয়ে পড়ছিল চারপাশে। এমন অপার্থিব মুহূর্তে মূক হতে হয়, বধির হতে হয়, নইলে প্রকৃতি রুষ্ট হোন।
– স্যার কিছু বললেন না যে-
– হুঁ, ও হ্যা আ্য…
আবারো সেই পাহাড়ী ঢলের মতো হাসি। আমি অন্ধপর্যটক যেন- কেবল টের পাই পায়ের তলা থেকে বেলাভূমি সরে যাওয়া।
– স্যার আসেন বৃষ্টিতে ভিজি।
কথাটা এ দেয়ালে ও দেয়ালে বাড়ি খেয়ে ধ্বনিত প্রতিধ্বনিত হয়ে নাড়া দিল আমাকে। এ যেন অমরাবতীর ডাক। এমন অমোঘ আহ্বান কি করে অবজ্ঞা করি। মনের পিঠে যে মনটা সে আবার বাধ সেধে ওঠে। ‘এ কি করছো! তোমার না ঠান্ডার সমস্যা। আর সিনথিয়ার সাথে বৃষ্টিতে ভেজার ফলাফল, সেকি তুমি জানো? টিউশনিটা যাবে। হয়ত কমিশনার সাহেব বেশি দুঃখ পেলে দুদিনের জন্য হাজতও ঘুরিয়ে আনতে পারেন। মোবাইল মানিব্যাগ কিংবা এ জাতীয় কিছু হাতাবার অপরাধে।’
ততক্ষণে সিনথিয়া আমার হাতের কব্জি ধরে ফেলেছে। আমার ধারণা আমি হাইপোথার্মিয়ার রোগী। সবসময় শরীরের তাপ কম থাকে। তার ওপর একটু ঠান্ডা বাতাস কিংবা বৃষ্টি হলে তো কথাই নেই। অথচ সিনথিয়ার ঠান্ডা হাতের স্পর্শে পুরোটা শরীর যেন জ্বলে উঠল। গ্যালারি ভর্তি দর্শক যেন বলে উঠল যাও, যাও। যা হবার হবে, পরে দেখা যাবে।
সামনে মাস্টার্স পরীক্ষা। এসব পাগলামির কোন মানে হয় না। এর মধ্যে বিসিএসের রিটেনও আছে। সিনথিয়াদের জীবনের সঙ্গে ছন্দ মেলানোর মতো ছন্দ যে আমার জানা নেই। তাই বৃষ্টি নিয়ে আদিখ্যেতা আমার মানায় না। ঠান্ডায় শ্বাস কষ্টটা বাড়লে সারা জীবনের সব অর্জন এলোমেলা হয়ে যাবে। এক ঝটকায় হাত ছাড়িয়ে নিলাম। চোখে মুখে একটা কাঠিন্যের ভাব এনে তাকালাম তার দিকে। সিনথিয়া প্রথমে ভড়কে গেলো। তার পর সে নাগিণীর মতো ফুঁসে উঠল।
– আর কক্খন আপনি আমাদের বাসায় আসবেন না। গেট আউট।
ঘটনাটা আজ থেকে ঠিক পাঁচ বছর আগেকার। এমনই কোন জুলাই সেপ্টেম্বর মাসে। আজ হঠাৎ বাংলোর পর্চে দাঁড়িয়ে বৃষ্টি দেখতে দেখতে মনে পড়ে গেলো। গত অক্টোবর মাসে শেষমেশ সিনথিয়ার খবর পেয়েছিলাম। এক কবিকে ভালোবেসে প্রবাসী হয়েছিল। স্ক্যান্ডিনেভিয়ার কোন এক রাস্তায় বৃষ্টি দেখতে দেখেতে তাদের গাড়িটা নাকি ছিটকে পড়েছিল রাস্তা থেকে। সেই রাস্তারই পাশে কোন এক গ্রেভ ইয়ার্ডে সিনথিয়া ঘুমিয়ে আছে। আর চিন্তা নেই বৃষ্টিকুমারী তোমার। আর কারো মণিবন্ধ ধরে অনুরোধ করা লাগবে না, একলা একলা সারা জীবন তুমি বৃষ্টিতে ভিজতে পারবে। শান্তিতে থেকো সিনথিয়া।
ছোটবেলা থেকেই বিষয়টা লক্ষ্য করে আসছি, যে বিষয় বা ব্যক্তিকে আমি এড়িয়ে যেতে চাই, তা-ই ঘুরে ফিরে এসে আমার ঘাড়ে সওয়ার হয়। ছোটবেলায় বেছে বেছে অংক করতাম। দেখা যেত বাদ দেয়া অংকগুলোই পরীক্ষায়। আমাদের পাড়ার মাঠ জুড়ে ছিল চোরাকাটার রাজ্য। প্যান্টে চোরাকাটা লাগানো থাকলে মা বড়ো চোটপাট করত। তাই হাঁটুর ওপরে প্যান্ট গুটিয়ে চলতাম। ওমা, তার পরও বাসায় ফিরে দেখি প্রতিটি তন্তুর ভাঁজে ভাঁজে যেন চোরাকাটা। আজ এরকম একটা সমস্যায় পড়লাম আবার। থিসিস জমা দেয়ার লাস্ট ডেট ছিল পরশু, গত সাপ্তাহের পুরোটাই রব্বানি স্যার শহরে ছিলেন না, তাই জমা দেয় হয়নি। আজ এসেছেন মাত্র। দুজনকে ফিরিয়ে দিয়েছেন টাইম ওভার বলে। তার অনুপস্থিতির কথা স্মরণ করিয়ে দিতে বললেন, ‘টাইম তো পুরা একমাস ছিল, আগে দিলা না ক্যান।’ কঠিন যুক্তি।
আমার সাথে তার একটা পূর্বশত্রুতার সম্পর্ক আছে। উনি কট্টর ডানপন্থী লোক, আমি বামধারার কর্মী। প্রায় সমাজতন্ত্র নিয়ে উল্টা পাল্টা কথা বললে আমি ক্লাসে বাগড়া দেই। তিনি তার প্রিয়ভাজন ছাত্রদের আমাকে ‘বেয়দাব’ বলে পরিচয় দেন। তাই হুট করে এই সমস্যা নিয়ে তার কাছে যাওয়ার সাহস হলো না। গেলাম চেয়ারম্যান স্যারের কাছে। সব শুনে বললেন, ‘বুঝোই তো বাবা সব, ঝামেলায় না গিয়ে আপোসে সমাধান করো।’ চেয়ারম্যান স্যার কি বুঝাতে চাইলেন তা তিনিই জানেন। রব্বানী স্যারের তালত ভাই মন্ত্রীর কথা, না জাল পিএইচডি’র থিসিসের কথা। তাঁর বোঝা তাঁর ঘাড়ে ফেলে এসে রব্বানী স্যারের পিয়নে সাথে কথা বলি।
– মনসুর ভাই, কি করি বলেন তো। থিসিস না নিলে তো পুরো ইয়ারটা লস।
– আমি কি কমু কন।
– স্যার গত সাপ্তাহে কই গেলেন।
– জাফলঙ।
– এই ঝড় বাদলার দিনে কেউ কি বেড়াইতে যায়।
– আরে বেড়াইতে না, স্যারের পাথরের ব্যবসা আছে। স্যার চালান দেখতে যান।
– পাথরের ব্যবসা! আসলেই স্যারের ব্যবসাটা পাথরের।
(লিডিয়া ডেভিসের অনুপ্রেরণায় লেখা)
আমার পষ্ট মনে আছে, সেদিন রোদটা ছিল খুব চড়া। জানুয়ারিতে এমন রোদ হয় না। কামাল কাকা এই রোদে ভিজিয়ে এনে আমাকে ছেড়ে দিল একটা দোচালা ঘরের সামনে। রেলস্কুলের পেছনের সেই লম্বা দোচালা ঘর, মাঝে মাঝে যেখানে ফাংশন-টাংশন হয়, সেখানেই হত ফোরের ক্লাস।
এক দঙ্গল ছেলে মনের আনন্দে ছোটাছুটি করছে। একজন আরেকজনকে ধরার চেষ্টা। নাগালে পেলেই উড়ে গিয়ে কিক কিংবা বগল দাবা করে নিয়ে পেটানো। ক্লাসের ভেতরে যারা আছে তারাও কম যায় না। বেঞ্চের ওপরে উঠে লাফালাফি করছে। এরমধ্যে একটু সৃজনশীল টাইপের ছেলেরা মনের মাধুরি মিশিয়ে আকিঁবুকি করছে বোর্ডে। এতো বড়ো স্কুল এতো ছাত্র এর আগে কখনো দেখিনি। এর মধ্যে এক ছেলে এসে বলে ‘আরে তুই’।
আমদের আগের পাড়ার নাছরুল। একটু পরেই পেলাম আওরঙ্গজেবকে। হাইস্কুলে ভর্তি হয়ে পাওয়া আমার প্রথম দুই বন্ধু। আমরা তিনে মিলে ছিলাম হরিহর আত্মা । দ্য এ টিম। আমি রোগা পটকা বলে ওরা আমাকে ছায়ার মতো আগলে রাখত
অল্পদিনেই বুঝতে পারলাম আমাদের এই অক্ষশক্তি পুরো ক্লাসের কাছে আতংক হয়ে দাড়িয়েঁছে। আমরা ব্যাপারটা খুব উপভোগ করতাম। আর মনে মনে শপথ নিতাম এই বন্ধুত্ব কোন কালেই নষ্ট হতে দেয়া যাবে না।
কিন্তু সব শপথ তো আর রাখা যায় না। আমাদের আওরঙ্গটা ছিল একটু চাপা কিছিমের। কম কথা বলত। একটু ভাবে থাকত। আসলে এর পেছনে ওর পরিবারের একটা ভূমিকা ছিল। ওর বাবা দ্বিতীয় বিয়ে করার পর ওর মা পাগল হয়ে যায়। সারাদিন সংসারে ঘেঁচাঘেঁচি। ফাইভ থেকে সিক্সে ওঠার সময় ওর মা মারা যান। ওর আর পাস করা হলো না। ও এক ক্লাস পিছিয়ে যায়। তারপর থেকে ও আমাদের এড়িয়ে চলত। কথা বলত কেমন একটা আক্রোশের ভাব নিয়ে।
শেষমেশ আমার নাছরুলের বন্ধুত্বটা রইল। ও আমার পরিবারের মানুষের মতো সকালবেলা এসে নাস্তাপানি করে আমাকে নিয়ে স্কুলে যেত। কিন্তু আস্তে আস্তে সেই বন্ধনটাও হালকা হয়ে আসতে লাগল। আমার মতো মেনিমুখোর সঙ্গ যেন ও আর উপভোগ করছিল না। ওর চোখ ছিল ওপরের দিকে। যেসব বন্ধুর সাথে মিশলে ফ্রিতে সিনেমা দেখা যায়, ঘুরে বেড়ানো যায়, অন্য ছেলেদের আতংকের ওপর রাখা যায় তাদের কাছেই ভিড়তে লাগল সে। ক্লাস এ’টে থাকতে প্রশ্ন ব্যাংক নিয়ে একটা বড়ো আন্দোলন হলো। গাড়ি ভাংতে গিয়ে আমাদের স্কুলের কজন গ্রেফতার হলো। এর মধ্যে নাছরুলের কাছে পাওয়া গেলো আম-ছিলার ছুরি। হাজত থেকে ছাড়া পাওয়ার পর তাকে টিসি দিয়ে দেয়া হলো। তারপর বন্ধু-বিচ্ছেদ। আমি একা হয়ে গেলাম।
সময়ের নিয়মে আমি কলেজে ভর্তি হই। নাছরুলও। সে অল্পদিনের মাথায় তার কলেজের বড়ো নেতা বনে যায়। আওরঙ্গ এসএসসি পাস না করেই আরেক কলেজের বড়ো নেতা। দুজন দুদলের। আমি দূরে থেকে বিপথে যাওয়া আমার দুই বন্ধুকে দেখি। একদিন সারা পাড়ায় দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়ে একটা খবর। মার্ডার। আমার ওই দুই বন্ধু একজন আরেকজনকে ড্রিল দিয়ে ক্ষত বিক্ষত করে হত্যা করেছে। গল্পটা এখানেই শেষ।
এখন তাদের একজন স্বর্গে। একজন মালয়েশিয়ায়। আরেকজন এই মাটির পৃথিবীতে বসে সেই অনির্বচনীয় দিনগুলোর গল্প শুনিয়ে বেড়ায়। বন্ধু শব্দটা কানে বাজলে এতো বছর পরেও কেন জানি তাদের কথাই মনে পড়ে। বন্ধুরা যে যেখানেই থাকো ভালো থেকো। মঙ্গলময় হোক তোমাদের জীবন।
একটা সময় ছিল শখ করে বৃষ্টিতে ভিজতাম। স্কুল থেকে ফেরার পথে কাঠের ছাতাটা বাতাসে উড়িয়ে দিয়ে পাক খেতে খেতে বৃষ্টিতে ভিজতাম। তখন বৃষ্টি ছিল কল্পনা; বৃষ্টি ছিল বিলাস। হাতের কিনারায় আকাশ ছিল। পাশের বেঞ্চেই মেঘ।
সত্যি, আমাদের সাথে মেঘ পড়ত। মেঘবতী বসু। গাঢ় দুটো চোখ নিয়ে তাকাত। ভয়ে তখন আমার বুকটা কাঁপত। আবার মুখ ফিরিয়ে নিলেই একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতাম ঘন্টার পর ঘন্টা। বাংলা ইংরেজি ভূগোল সমাজ সব বয়ে যেত জলের স্রোতের মতো কলকল করে। আমাকে একটুকু নাড়াতে পারত না কেউ। কিন্তু ও সামনে এলেই ফের খড়কুটোর মতো ভেসে যেতাম। এমন উতাল মেঘের বর্ষা কেবা সইতে পারে।
বুকভরা অভিমান ছিল। চৈত্রের মাঠ কি কখনো বলে বৃষ্টি দাও হে বর্ষা। আমি পুড়ে খাক। বরং মেঘ আপন মহিমায় নেমে আসে যুবক মাঠের বুকে। তারপর আদরে সোহাগে মিশে যায় পাঁজরে পাঁজরে। আমার মেঘ সেটা বুঝে না কেন গো?
বৃষ্টি বিলাসের দিনগুলো শেষ। অন্তিমে হরিপদ জীবন নিয়েছি বেছে। ছাতাটা ফুটো। তাই বৃষ্টি হলে এমনিতেই ভিজি। এভাবে ভিজতে ভিজতে একদিন, কোন এক বর্ষা-দামাল-বিকেলে, আশ্রয় নিয়েছিলাম এক সাহেবী দোকানের আরচলায়।
মধ্যে কুড়িটা বছর। আবার দেখা হয়ে গেলো। কষ্ট হলো। একটা শক্ত ঝাঁকুনি খেলাম। তার চুল-মাথা কালো কাপড়ে ঢাকা। হাতে একটা ৫-৬ বছরের বাচ্চা। মোটাসোটা একটা লোকের পেছনে ও হাঁটছে। এই বেশভূষা এই আয়োজন আমাকে কিছুটা বিভ্রান্ত করল। ভালো করে সাহস নিয়ে তাকালাম। নাহ এই তো আমাদের মেঘ। মেঘবতী বসু। নাকের নিচে তিলের দাগ। সাহস করে দাঁড়ালাম ২০ টা বছরের মুখোমুখি। প্রতিশোধের আগুন পুড়ছি নিজের ওপরে নিজে। আর পালিয়ে যাওয়া যায় না।
এক্সকিউজ মি..
জি, স্লামালাইকুম।
আপনি কি মেঘবতী, ভূবনডাঙ্গা হাই স্কুল-
সরি আপনি যেন কে?
কার-বে থেকে তাড়া দিচ্ছে লোকটা। আমার চোখ দুটা জলে ভরে গেলো। এতোদিন পর পোড়া দুটো চোখ জানলো মেঘ ছাড়াও বৃষ্টি হয়। বেনোজলে ভেসে যাচ্ছে সবকিছু।
আমাদের পণ্ডিত স্যার একবুক ভালোবাসা নিয়ে জন্মানো মানুষ। অন্য সাবজেক্টে ফেল করলে স্যাররা পিটিয়ে পাছার চামড়া তুলে ফেলে। কেবল পণ্ডিত স্যারের সাবজেক্টে ফেল মারলে কোন হাউকাউ নেই। বরং পিঠে মাথায় হাত বুলি মন্ত্রের মতো বিড় বিড় করে বলবেন, যা হয়েছে তা ভালই হয়েছে, যা হচ্ছে তা ভালই হচ্ছে…
অবশ্য তার হাত থেকে নাম্বার তোলাটাও বেশ কঠিন। খাতায় কয়টা বানান ভুল হলো তা গুনে গুনে দাগিয়ে দেন। তিনটা বানানের জন্য এক নম্বর কাটা। তাকে কেউ কোন শব্দের বানান জিগগেস করলে হলো; এর ব্যুৎপত্তি থেকে শুরু করে উৎপত্তি কিছুই বাদ যাবে না। একবার হেডস্যার খুব করে ধরে বসলেন, দাদা আপনি নাইনের বাংলাটা নেন।
স্যার করজোড়ে বললেন, ক্ষমা করবেন জনাব। আমি আইএ পিটি- এই গুরুভার গ্রহণের ক্ষমতা আমার নাই।
এমনই বিনীয় নিরহংকারী মানুষ আমাদের পণ্ডিত স্যার। দরিদ্র ব্রাহ্মণকূলের সন্তান বলে সবসময় নিজেকে পরিচয় দেন। যদ্দূর জানা যায় অর্থাভাবে তার বিএ পরীক্ষাটা দেয়া হয়নি। তাই তার চাকরিটাও পুরোপুরি পাকাপোক্ত নয়।
ক্লাসে এসে একপর্যায় ঘুমিয়ে পড়া ছাড়া তার কোন খারাপ কিছু কেউ কখনো দেখেছে বলে শোনা যায় না। এই দরিদ্রব্রাহ্মণকূলের সন্তানটি আমাদের বাংলা পড়ান। তিনি ‘মানবজাতি’ পড়ানো শুরু করলে ক্লাসের মানবজাতির ক্ষুদ্রক্ষুদ্র সন্তানগুলো নানাবিধ জঙ্গি তৎপরতায় ব্যস্ত হয়ে ওঠে। একপর্যায় যখন পেছনের দুয়েকটা ব্রেঞ্চ ধপাধপ ভেঙে পড়ে তখন তিনি সম্বিত ফিরে পান। ভ্রুকুটি করে তাকিয়ে বলেন, এই তুই নরেন্দ্রর পুত্র না। তোর পিতা তো উত্তম চরিত্রের অধিকারী ছিলরে-
ভর্ৎসনা বলেন আর শাস্তি বলেন এই এতোটুকু।
এই নিরীহ লোকটাকে বিরক্ত করতে একসময় আমাদেরই খারাপ লাগে। কিছুক্ষণের জন্য চুপচাপ হয়ে বসি। কেউ হয়ত অত্যুৎসাহী বলে উঠে স্যার একটা গল্প বলেন। তখন তিনি বিভিন্ন পৌরাণিক গল্প শোনান। কখনো হরিশ্চন্দ্র। কখনো বা প্রহ্লাদ। তবে সব গল্পের শেষে একটা সাধারণ নীতি কথা: কা তব কান্তা কস্তে পুত্রঃ। এই জগতে কেউ কারো নয়। না পুত্র না কন্যা। না স্বামী না স্ত্রী। একলা এসেছো একলা যাবে।
এই ডায়লগটা বলার সঙ্গে সঙ্গে আমাদের হাসি পায়। গাঁয়ের লোকজন বলাবলি করে সারা জীবন নাকি একটা পুত্র সন্তানের আশায় তিনি মন্দিরে মন্দিরে ঘুরে বেরিয়েছেন। কি এক বংশের অভিশাপে নাকি তার সন্তান বাঁচত না। আতুড় ঘর থেকে সরাসরি শ্মশান। শেষ বয়সে এসে তার একটা পুত্র সন্তান হয়। এখন ছেলেটা আমাদের দু ক্লাস নিচে পড়ে। পণ্ডিত স্যারের প্রাণভ্রমরা যেন ওর ভেতরেই লুকিয়ে। সারাক্ষণ ছেলেটাকে চোখে চোখে রাখেন।
আর ছেলেটাও হয়েছে বাপের কার্বন কপি। সাদা ট্যাঙট্যাঙা ধাচেঁর নিরীহ একটা ছেলে। গায়ে মাংসের কোন চিহ্ণ নেই। আমরা আড়ালে ওকে লইট্যা মাছ বলি। এ এলাকায় এক ধরণের সামূদ্রিক মাছ পাওয়া যায়: সাদা থকথকে, ধরলে যেন গলে গলে পড়ে; লটিয়া নাম। সেটা মুখে মুখে ফিরে লইট্যা।
এই লইট্যা মাছ সাত সকালে বাপের সঙ্গে কাপড়ের ব্যাগ কাধেঁ নিয়ে হাজির হতো স্কুলে। স্কুলের কোণায় এক খণ্ড জমি দেয়া হয়েছে পণ্ডিত স্যারকে ক্ষেতকৃষি করার জন্য। এসেম্বলির ঘন্টা বাজার আগ পর্যন্ত সেখানে মাটি কুপিয়ে আগাছা তুলে; পুকুরে একটা ডুব দিয়ে হাজির হতো ক্লাসে। এভাবে প্রতিদিন নিরীহ দুটো মানুষের জীবন চলত হাজারও উত্তেজনাকে পাশ কেটে। আমরা মজা পাই; বিদ্রুপ করি। আবার ভাবি কাজটা কি ঠিক হচ্ছে। কিন্তু তাদের কোন বিকার নেই।
একদিন এসেম্বিলর বাশিঁ বাজলো না। আমরা সময়মতো খেলা শেষ করে এদিক ওদিক তাকাই। শোনা গেলো পণ্ডিত স্যারের ছেলের পায়ে নাকি কোদালের কোপ পড়েছে। ড্রিল স্যার আর আব্দুর রহিম স্যার তাকে নিয়ে হাসপাতালে গেছেন। শুনে খারাপ লাগল। আহারে ছেলেটা এই শরীরে সাতসকালে মাটি কোপানোর কাজে লেগে যায়। আজ একটা দুর্ঘটনা ঘটে গেলো।
সেকেণ্ড পিরিয়ডে বাংলা ক্লাসে দেখি পণ্ডিত স্যার হাজির। আমরা সবাই হৈ চৈ শুরু করে দিলাম ‘অর্জুনের কি হয়েছে স্যার, অর্জুনের-‘। তিনি খুব শান্ত গলায় বললেন, ‘আঘাত তেমন গুরুতর নয়, জগন্নাথের কৃপা হলে ভালো হয়ে যাবে’।
কিছুদিন পর জানা গেলো অর্জুনের পায়ে গ্যাংরিন হয়ে গেছে। পা কেটে ফেলতে হবে। শহরের হাসাপাতালে নেয়া ছাড়া কোন গতি নেই। কিন্তু পণ্ডিত স্যার বেঁকে বসলেন। ক্লাস কামাই দিয়ে তার পক্ষে এখন শহরে যাওয়া সম্ভব না। সামনেই তো গ্রীষ্মের বন্ধ। তখন না হয় যাওয়া যায়। আর তো মাত্র ১৬ দিন।
এদিকে অর্থাভাবে অর্জুনের চিকিৎসা বন্ধ হয় হয় অবস্থা। পণ্ডিত স্যারের বউ নাকি হেডস্যারের বাসায় গিয়ে কান্না কাটি করেছেন। আমরা দল বেধে অর্জুনকে দেখতে যাই। বিছানার সাথে মিশে গেছে ছেলেটা। কেবল পায়ে একটা বড়ো ব্যান্ডেজ। নাইনের ভাইয়ারা ঠিক করে চাঁদা তুলবে। হেডস্যার স্কুলের গাছ বেচার কিছু টাকা এক করে একদিন পণ্ডিত স্যারকে ডাকলেন। তিনি যথারীতি করজোড়ে বললেন, বিনা পরিশ্রমে অর্থ রোজগার অন্যায় জনাব।
আমরা মনে মনে পণ্ডিত স্যারের ওপর ক্ষ্যাপে উঠি। হাসপাতালে গেলে দেখতে পাই স্যারের স্ত্রী স্যারকে নিয়ে ইচ্ছেমতো গালিগালাজ করছেন। কী বিশ্রি অবস্থা।
কাদের স্যার তো না পারতে জিগগেস করে বসলেন, দাদা ছেলেটা কি বিনা চিকিৎসায় মারা যাবে?
কী বলো কাদের, আমি তো অর্থ সংস্থাপনের চেষ্টা আছি। ভিটাটার খতিয়ান থেকে ভিপি শব্দটা মুছে দিতে পারলে তো আর চিন্তা নাই, কার কত টাকা লাগে। তফশিলদার তো মজুমদারের ছেলে। ও বলছে আর কয়টা দিন ধৈর্য্য ধরেন।
আর ধৈর্য্য ধরলো না অজুর্ন। রাতের অন্ধকারে সে মিলিয়ে গেলো।
এসেম্বিলির মাঠে খবরটা এলো। আমরা স্তব্ধ হয়ে গেলাম। অর্জুনের হাতে লাগানো লাউ গাছের কচি ডগাটা বাতাসে দুলছে। তারও যেন কি বলার আছে। আমরা ভারী ভারী পা ফেলে ক্লাসে যাই। জব্বর স্যার রোল কল না করে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকেন। আমাদের খুব কান্না আসে। কাঁদতে পারি না। এভাবে নিস্তব্ধতার মধ্যে দিয়ে ঘন্টা বাজে। জব্বার স্যারের ক্লাস শেষ হয়ে যায়। জব্বার স্যার দরজার দিকে মুখ ফেরাতেই চমকে যান। পণ্ডিত স্যার হাজির। সেকেন্ড পিরিয়ড বাংলা সেকেন্ড পেপার। আজকের বিষয় তৎপুরুষ সমাস।
পরিচ্ছেদ ৬ অনেক রাতে ফিরেছিল কল্যাণ ওরফে শহীদুল।গাড়িটা শেডে রাখার পর দু’বার হালকা করে মা…..
পরিচ্ছেদ ৫ আকাশে এখন আর মেঘ নেই। হাওয়া হচ্ছে।কদিন পরেই বর্ষা নামবে।একদিন হাসপাতাল থেকে ফিরতে…..
পরিচ্ছেদ ৪ ভোর হয়ে আসছে।রাতে ভালো ঘুম হয়নি।ঘুমের ঘোরে মনে হচ্ছিল দম বন্ধ হয়ে আসছে।এরকম…..
বাংলার চিত্তাকর্ষক ইতিহাস সম্পর্কে জানার সময়, গৌরের মতো আর কিছু গন্তব্য হতে পারে না।…..