জয়দীপ-এর জীবনগল্প (পর্ব- ৩)

জয়দীপ দে
ধারাবাহিক, নন ফিকশন
জয়দীপ-এর জীবনগল্প (পর্ব- ৩)

বিউটি বক্স

ড্রেসিং টেবিলের ড্রয়ারগুলোতে মা যেন কী লুকিয়ে রাখত। মাটিতে শক্ত করে পা দেয়ার পর থেকে সেই গুপ্তধনের প্রতি আমার অপার আগ্রহ। একবার কোন এক ছুঁতোয় একটা ড্রয়ার খুলে ফেলি। ওমা, এ দেখি আলিবাবা চল্লিশ চোরের গুহা! গুহাভর্তি মজার মজার সব জিনিস। মায়ের স্নোর কৌটো, আলতার শিশি, সিঁদুরের পট ইত্যাদি ইত্যাদি। অল্পদিনের মধ্যে এসবের নানাবিধ ব্যবহার রপ্ত করে ফেলি। আলতার বোতল শোভা পেল শখের ডিসপেন্সারির কেসে। পাউডারের পাভ হলো রোগীর বিছানা। স্নোর কৌটোটাও সুন্দর স্টেথস্কোপ তৈরিতে কাজে লেগে গেল। ডিসপেন্সারির একমাত্র রোগী ছিল আমার দিদি। রোগীর অনিচ্ছা সত্ত্বেও তার গায়ে বিভিন্ন ঔষধ লাগানো হত। রোগী সংক্ষুব্ধ হয়ে নিয়মিত ডাক্তারের ওপর চড়াও হত। এতো লাঞ্ছনার সত্ত্বে জনসেবার মহৎ পেশা চালিয়ে যেতাম।

কিন্তু ক’দিন যেত না যেতেই রসভঙ্গ ঘটল। নতুন রসদের সন্ধানে হামলা হলো মায়ের গুপ্তধনে। আরেকটা দেরাজ মেলল। কল্পনার আরেকটা জগৎ উন্মোচিত হলো। আমার উৎপাতে বাসার সবাই অতিষ্ঠ হয়ে উঠল। প্রথমে বকুনি, তারপর হাত থাকতে মুখে কী পদ্ধতি-। আমাকে সৎ পথে আনার প্রাণান্তকর চেষ্টা চলল। কিন্তু আমার হাতেও ছিল এক অব্যর্থ হাতিয়ার। মা যখন কখনো সাজে না তখন এসব ড্রেসিং টেবিলে রেখে নষ্ট করার মানে কী! দিদি তখন তার মাতৃধন রক্ষায় তৎপর হয়ে উঠল: বাহ, আমি বুঝি সাজব না!

– বড়ো হয়ে আমি যখন চাকরি করব, তখন তোকে অনেক অনেক স্নো পাউডার কিনে দেব। চিন্তা করিস না।

-তোকে কে চাকরি দেবে; তুই তো একটা গাব্বু।

কোটি টাকার প্রশ্ন: গাব্বুকে কে চাকরি দেবে? গাব্বু অংকে ফেল মারে, বাংলায় ফেল মারে, ইংরেজিতে তো…। এর মধ্যে হঠাৎ একদিন গাব্বু বিরাট প্রত্নতাত্ত্বিক হিসেবে আবির্ভূত হলো। কোত্থেক একটা জাদুর বাক্স খুঁজে পেল। এটার চৌক-গোল খোপগুলোতে গূড়ো গূড়ো রং থাকে। সেই রং পানিতে গুলালে দিব্যি ছবি আঁকার রং হয়ে যায়। কাঠির মাথায় তুলো জড়িয়ে সেই রং দিয়ে চমৎকার সব ছবি আঁকা যায়। এই রং দিয়েই আমার ছবি আঁকার হাতেখড়ি। মধ্যবিত্ত টানাপোড়েনের সংসারে সবার অগোচরে রাফ খাতার পৃষ্ঠা নষ্ট করে আমার শিল্প চর্চা চলত। দেখলাম এটা ওটা নকল করে আঁকাতে ভারী মজা। মনে মনে এসবের মধ্যে আমি প্রাণ সঞ্চার করে আমি আমার একটা সাম্রাজ্য গড়ি তুলি।

পরে জেনেছি, এই জাদুর বাক্সটা আমার মায়ের বিয়েতে দেয়া বিউটি বক্স। যে রং দিয়ে আমার মা সাজার কথা ছিল, কিন্তু কোন দিন সাজা হলো না, সেই রং দিয়ে আজ আমার জীবন সেজেছে। এখনো আমি রাফ খাতায় রং বুলিয়ে সময় কাটাই। এই রঙের কৃপাতেই খেয়ে-পরে আছি। ভালোই আছি।

ভালোবাসার শার্টপিস

জীবনের আরেকটা পাতা উল্টে গেলো। রুদ্ধশ্বাসের মতো একটার পর একটা সিন যেন আসছে জীবনে। পত্রিকার রিপোর্টারের চাকরি দিয়ে শুরু। তারপর  জীবন… `ও মোর পাগলা ঘোড়ারে’….  হ’য়ে কই থেকে কই নিয়ে যাচ্ছে…

কর্পোরেট চাকরি থেকে স্কুল মাস্টারি। এসি রুম থেকে টিনশেড ক্লাসরুম। সাদামাটা জীবনে শেষমেশ একটা মজা পেয়ে গেলাম। বল্লাম-বেশ তো! কিন্তু তাতেও থিতু হয়া হলো না! এরাও আজ দুয়ার ভিঁজিয়ে দিল। ফেয়ারওয়েল দিয়ে দিল আমাকে।

সকাল থেকে ভাবছিলাম- সরকারি চাকরি ছাড়ছি, এতো আবেগ-টাবেগ কি, কাটা কাটা কটা কথা বলে চলে আসব। কিন্তু বাস্তবে হলো উল্টো। এই উড়নচণ্ডিপণার মাঝে কখন ভালোবাসা এসে জমা হলো টের পাইনি। আজ আমার দরিদ্র স্কুলটির সবাই মিলে একাট্টা হয়ে আমাকে কাঁদালো। হাঁপুস নয়নে কাঁদলাম… আর ভাবলাম: ভালোবাসা জিনিসটা কী ভয়ংকর!

কমন রুম ফান্ডে মাসে মাত্র ৪০০ টাকা করে জমে। এই টাকা দিয়ে টিচারদের বিদায়-বরণ হয়। মাঝে মাঝে এর ওর বিয়েতে গিফট। তাই বিদায়ের সময় ইচ্ছে থাকলেও কাউকে তেমন কিছু দেয়া যায় না। হাহুতাশ আর অশ্রুজলই হয় আমাদের উপহার।

কিন্তু অনুষ্ঠানের একবারে শেষপ্রান্ত এসে ওরা একটা শার্টপিস ধরিয়ে দিল আমাকে (জানি না কোত্থেকে এ ফান্ড ম্যানেজ হলো)।  সিনথেটিকের কাপড়। সাধারণত সিনথেটিকের কাপড় আমি পড়ি না। গা চুলকায়। কিন্তু আমি খুব ভালো একজন দর্জি দিয়ে শার্টটা বানাব। আমার খুব দু:খের দিনে শার্টটা পড়ে জৈন্তার সেই আলো-ঝলমলে দিনগুলোর কথা স্মরণ করব। আলোর স্নানে প্রাণ সজীব হবে, সব গ্লানি মুছে যাবে, আমি নিশ্চত।

মেঘমিতা

একটু বৃষ্টি হলেই ধনচের গাছগুলো লকলকিয়ে বেড়ে উঠে সান্ত্রীর মতো দাঁড়িয়ে পড়ে রাস্তার দু’ধারে। হাওয়া দিলে ঝিলমিল করে শুরু হয় সবুজের কুজকাওয়াজ। বাতাসের তালে তালে পা পড়ে হাত নড়ে। আকাশে তখন জল-কালির খেলা। কার্টিজের ভেজা বুকে চাইনিজ ইংকে একটার পর একটা ওয়াশ। এর মধ্যে মেঘের কোল পিছলে বেরিয়ে পড়ে দুষ্টু আলোর ছেলেরা। আলোক স্তম্ভগুলো ড্রাইব্রাশের ক্ষিপ্র আঁচড়ের মতো নেমে পড়ে সবুজের বুকে। এর মধ্যে দূর্গ শীর্ষে বেজ উঠে দুন্দুভির ধ্বনি। সঙ্গে সঙ্গে ভোজবাজিতে মাতোয়ারা নীল নবঘন।

থেমে গেলে সব তর্জন গর্জন সেই মেঘমেদুর সকাল। জলভেজা হাওয়া বিলি কাটে চুলে। তিরতির করে শরীর। একটা সুখের আবেশ যেন আচ্ছন্ন  করে রাখে। তার সঙ্গে যোগ হয় ট্রেনের দুলুনি। চোখর পাতা দুটো ভারী হয়ে আসে। হঠাৎ একটা গমগমে আওয়াজে নিদ্রার জালগুলো ছিঁড়ে-ফুঁড়ে যায়।   স্কুল খুইল্যাছে রে মওলা স্কুল খুইল্যাছে …। গান আর শ্লোগানের মাঝামাঝি একটা সুর। তাল লয়ের চেয়ে স্বরশক্তির প্রকাশ প্রকট। গানের দমকে আরো সন্নিবিষ্ট হয়ে ওঠে অন্ধকার। বগিভর্তি ছায়ামূর্তিগুলো নেচে উঠে মরমী আবেগে। গানে গানে কেটে যায় ঘন্টা খানেক। মোষের গাড়ির মতো দুলে দুলে শাটল ট্রেনটা এসে স্টেশনে থামে। ওমনি সবাই লাফিয়ে পড়ে মল্লভূমিতে। তারপর জল-কাদা ভেঙে কাটাপাহাড়ের বুক চিড়ে ছোটা। দৌড়াতে দৌড়াতে হালকা চুটকি। সস্তা শ্ল্যাং। অবণী; ও’হেনরি। তারপর আলতামিরার গুহায় প্রবেশ। আর্টস ফ্যাকাল্টির ঘুপচি অন্ধকার। স্যাঁতস্যাঁত চারিপাশ। গ্রাফিক্স রুমে কোন এক মেয়ে হয়ত আপনমনে জিংক প্ল্যাটে ড্রইং তুলছে। পেছন থেকে কম্বুকণ্ঠের   `মেংকু’  শুনে ভয়ে লাফিয়ে উঠে। পরে কপট রাগ দেখিয়ে বলে ওঠে,  `দ্যুৎ ছামছাদ বাই’  (ধ্যুৎ শামশাদ ভাই)। বড়ো ছোট ভুলে ফের সেই দুষ্টামি।…হেডমাস্টারো তোঁয়ারে তোঁয়া ও মায়ুরে…। ডিপার্টমেন্টের স্টাফরাও এসে যোগ দেয়। মজা যে কত ধরনের হতে পারে এখনো ভাবলে হাসি পায়। আমাদের এই মেঘমিতালীর দিনগুলোয়, আমাদের এই বসন্তের দিনগুলোয়- যে মাতাল কোকিলটি, যে স্বপ্নবাজ তরুণটি সারাদিন আমাদের মাতিয়ে রাখত, সে-ই শামশাদ কামাল।

উপরি-দর্শণে সাদামাটা একটা মানুষ। অনেকটা গ্রাম্য মোড়লদের মতো বিশাল বাপুটা ফুলিয়ে দু’হাত দুলিয়ে হাঁটত। কথাবার্তায় কিছুটা অসংস্কৃতভাব। কিন্তু মনে প্রাণে ছিলেন একজন আধুনিক সাহসী মানুষ।মুক্তিযুদ্ধ কিংবা বঙ্গবন্ধু নিয়ে কোন বিরূপ মন্তব্য শুনলে ক্ষিপ্র চিতার মতো লাফিয়ে পড়তেন। সেই জোট সরকারের আমলে যখন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় রক্তমাখা শরীরে গড়াগড়ি খাচ্ছে তখনো তিনি ছিলেন তার বিশ্বাসে অটল।   বেনসন  বাদে আরেকটা জিনিসে ছিল তার দুর্মর নেশা। পাগলের মতো ফিগার ড্রইং করতেন। শেষবার ইয়ার্লি এক্সিবিশনে ড্রাই পয়েন্টের একটা পোর্ট্রট করে তাক লাগিয়ে দিয়েছিলেন সবাইকে। তাক লাগানোর ব্যাপারটা ছিল তার অভ্যাসগত।  প্রতিভার অভাব ছিল না। কিন্তু কিঞ্চিত পাগলাটে কিঞ্চিত আত্মভোলা স্বভাবের কারণে একটা শংকা ছিল তাকে নিয়ে। দুষ্পাপ‌্য এই চাকরির বাজারে যোগ্যতা মতোন একটা চাকরি জুটিয়ে নিতে পারবেন তো। কিন্তু সবাইকে আবাক করে মাস্টার্সের পরপর সরকারের প্রথম শ্রেণির কর্মকর্তার একটা চাকরি জুটিয়ে নেন অনায়াসে। আমার বিসিএস পরীক্ষার সময় কত ঢঙে কত প্রকারে উৎসাহ পরামর্শ দিয়ে সাহায্য করেছেন।

গত সাত জুলাই বিকেলে ফেইসবুকে রাফির স্ট্যাটাসে দেখলাম `শামশাদ ভাই নেই’। একটা ধাক্কা খেলাম। আবার ভাবলাম কোন না কোন শামশাদ ভাই। তার চেয়ে বরং তাকেই ফোন করে জেনে নেই। ফোন করলাম। সুন্দর ফোন বাজল। পেয়ে যাই পরিচিত সেই কণ্ঠস্বর। কিন্তু চিনতে পারে না ওপর প্রান্ত। ভাবলাম নাম্বারটা বোধহয় ডিলিট হয়ে গেছে।  ভারী গলায় বল্লাম `পুলিশের লোক বলছি-‘। ও প্রান্তের লোকটা ভয় পায় না। কারণ যাকে ভয় পাওয়ানোর জন্য এই চেষ্টা, তিনি ভয়-ভীতির ঊর্ধ্বে চলে গেছেন সেদিন দুপুরে। তার কর্মস্থল পিটিআই থেকে ফেরার পথে মোটরবাইক দুর্ঘটনায় মৃত্যু। বুকের ভেতরে একটা শূন্যতার ঝড় ওঠে। বাইরে ঝমঝম বৃষ্টি। এমন দিনেতো সাক্ষাৎ রবীন্দ্রনাথ বারণ করেছেন চলে যেতে-

ঝরঝর ধারে ভিজিবে নিচোল,
ঘাটে যেতে পথ হয়েছে পিছল,
ঐ বেণুবন দুলে ঘনঘন
পথপাশে দেখ্‌ চাহি রে।
ওগো, আজ তোরা যাস নে ঘরের
বাহিরে।
হে মেঘমিতা, এমন দিনে ঘরের বাহিরে চলে গেলে!

জয়দীপ দে। জন্ম ১৯৮০ সালে। চট্টগ্রামে। রেলওয়ে হাসপাতালে। বাবা ছিলেন রেলওয়ের ইঞ্জিনিয়ার। সে সূত্রে রেল পাড়ায় বড়ো হওয়া। আদিভিটে সিলেটের গোলপগঞ্জ উপজেলায়। অবশ্য পঞ্চাশের দশকের কোন একসময় তা হাতছাড়া হয়ে যায়। পড়াশোনা চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে। বিষয় ছিল চারুকলা। সে সময় সাংস্কৃতিক...

এই বিভাগের অন্যান্য লেখাসমূহ

প্যাটাক্যুয়রিক্যাল নাইটশোয়ে আপনাকে স্বাগতম (পঞ্চম পর্ব )

প্যাটাক্যুয়রিক্যাল নাইটশোয়ে আপনাকে স্বাগতম (পঞ্চম পর্ব )

ইংরেজি ভার্সান এখানে >>> Welcome to the Pataquerical Night Show (Episode-5) পূর্ববর্তী পর্ব এখানে>>> শেষ…..