ঝরা শিমুল

অনসূয়া যূথিকা
ছোটগল্প
Bengali
ঝরা শিমুল

 

আশ্বিনের শুরু, শিউলি ফোঁটা এক শুভ্র সকাল। সকালের আলোটা যেনো দুধে গোলা, সাদা ঝকঝকে। নীল আকাশে থোপা থোপা সাদা ধবধবে মেঘের ভেলা ভেসে চলেছে। মেঘগুলো কি পরদেশী? নজরুলের সেই গানের মতো,”পরদেশী মেঘ যাও রে ফিরে! বলিও আমার পরদেশীরে”!

আজ সকাল থেকে সিংহ রায় বাড়িতে সাজসাজ রব পড়ে গেছে৷ আজ অঙ্কিতার সাধ।কন্যার প্রথম সন্তান জন্মের আনন্দে সারা বাড়িটা যেন হাসছে। অঙ্কিতা আজ কয়েকদিন হলো বাপের বাড়ি এসছে। পণ্ডিত মশাই দিনক্ষণ ঠিক করে আজকের দিনটাকেই সাধের জন্য শুভদিন হিসেবে ঠিক করে দিলেন৷ সেই মতো সব আয়োজনে মেতে আছে পুরো বাড়ি। অঙ্কিতার দুই কাকা আর পিসিরাও আজ খুব ব্যস্ত। সে নিজেও ব্যস্ত বটে! সকাল সকাল স্নান সেরে নতুন পাট ভাঙা শাড়ি পরেছে, মায়ের দেওয়া৷ ভীষণ সুন্দর একটা শাড়ি, বাসন্তি রঙের আর লাল পাড়। লাল আঁচলে কল্কা জরির নকশা তোলা।

আজকের এই শুভ দিনটার জন্য বাড়ির সকলেই অপেক্ষা করে ছিল বহুদিন ধরে। দুপুর গড়াতেই সবাই মিলে একসাথে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। এবার সাধ খেতে বসবে অঙ্কিতা৷ বাড়ির সবাই জড়ো হচ্ছে তাকে ঘিরে৷
হঠাতই ছোটকাকা ছুটে এলেন কোথা থেকে, নিজের স্ত্রীকে টেনে নিয়ে গেলেন নিজের ঘরে। এরপরেই সারা বাড়িতে একটা ফিসফাস শব্দ গড়াতে লাগলো।

গড়াতে গড়াতে শব্দটা একটু একটু করে নিজের মতো করে বড় হতে হতে কয়েকটা বাক্যে পরিণত হলো। শব্দটা যখন অঙ্কিতার কানে এলো বা তাকে জানতে দেয়া হলো ততোক্ষণে তার সাধ ভক্ষণ বা সাধ খেতে বসা সাঙ্গ হয়েছে। সে নিজের নয়মাসের সন্তান সম্ভবা ভারি পেট, ভারি শরীরটাকে কোনমতে নিজের রুমের নিজের বিছানাটায় এনে ফেলতে পেরেছে। মনে মনে ভেবেছে, যা যা খেতে চেয়েছিলাম তারচে বেশি করে খেয়েছি কীনা অতো জানি না বাপু৷ এখন একটু বিছানায় গড়াই, শরীরটা বড় হাঁসফাঁস করছে।

অঙ্কিতার মা সরলা এলেন ঘরে, দেখতে অঙ্কিতা কী করছে৷ একটু কি ঘুমালো মেয়েটা? না এখনো চোখের পাতা এক করতে পারেনি? শুভকামনা জানাতে নয় নয় করে কম তো আত্মীয় আসেনি বাড়িতে৷ কিন্তু তারা এবেলা অঙ্কিতার রুমে জড়ো না হয়ে জুটেছেন অন্যখানে৷ খবরটা জেনে ইস্তক তিনি নিজেও ছটফট করছেন৷ কিন্তু কাজের বাড়ি ছড়ানো কাজ থইথই, এর মধ্যে আর নিজে গিয়ে সেখানে জুটতে পারলেন না৷

এখন মেয়েকে নিজের ঘরে নিজের বিছানায় একটু থিতু দেখে নিজেও এসে বসলেন মেয়ের পাশে।হালকা চালে একটু খোঁজখবর চললো মেয়ের। জামাই কখন আসবেন জানতে চাইলেন মেয়ের কাছে৷ সন্ধ্যা বেলা জামাই আসবে জেনে স্বস্তি পেলেন যেনো। কিন্তু যে খবরটা জেনে ইস্তক তিনি ভিতরে ভিতরে অশান্ত হয়ে আছেন তা মেয়েকে কী করে জানাবেন তা ভাবতে লাগলেন। একথা ওকথা বলতে লাগলেন মেয়ের সাথে কিন্তু মেয়ে বুঝতে পারলো মায়ের কথার তাল সুর বেসুরো।

হঠাৎই রুমে এলো সঞ্চিতা, অঙ্কিতার ছোট বোন। সে এসেই সোজা বলে উঠলো, ‘দিদিয়া তোর শিমুলকে মনে আছে?’ প্রশ্নটা খুব সহজ, সোজা বটে কিন্তু এর উত্তর খুব সোজা না৷ অঙ্কিতা ধীরে আস্তে চাইলো বোনের চোখে। আজ এই দিনে এই মুহূর্তে কেন শিমুল প্রসঙ্গ এলো বুঝতে চাইলো বোনের চোখে তাকিয়ে। সেখানে শঙ্কা দেখতে পেলো যেনো৷ কিন্তু বুঝতে পারলো না শিমুল প্রসঙ্গে এবাড়ির কারো চোখে শঙ্কা কেনোই বা আসবে! তাই বোনের প্রশ্নের উত্তর দেবার তাড়া তার ছিলোনা। কিন্তু সঞ্চিতা অধৈর্য হয়ে যায় যেনো, ফের বলে উঠলো ‘শিমুল সুইসাইড করেছে। ওরা হাসপাতালে নিয়ে গেছে ওকে।’

আমূলে কেঁপে উঠার মতো খবরই ছিল বটে, কিন্তু অঙ্কিতা খুব স্বাভাবিক ভাবেই স্বাভাবিক গলায় বলে উঠলো ‘তাই’! যেন শিমুলের সুইসাইড করা বা মরে যাওয়া বা বেঁচে থাকা কোনটার সাথে তার কোন যোগ নেই। সঞ্চিতা অবাক হলো অঙ্কিতার এহেন স্বাভাবিক আচরণের কারণে, কিন্তু বুঝতে পারলো না কেন! একইভাবে এই দুইবোনের মা নিজেও অবাক হলেন বড় মেয়ের ন নিশ্চল উত্তর জেনে৷ বরং তার ধারণা ছিল মেয়ে খবরটা জেনে অস্থির হয়ে পড়বে, আর তিনি এটা ভেবেই খবরটাকে এতোক্ষণ চেপে গেছিলেন। অঙ্কিতা ধীরে চাইলো তার মায়ের দিকে, বোনের সাথে আর কোন কথা না বলে। মাকেই বলে বসলো, বিকেল তো হয়ে গেছে মা! এখনো চা দিলে না যে? যাই, বলে উঠে পড়লেন অঙ্কিতার মা সরলা।

অঙ্কিতাকে চোখ বুজতে দেখে সরে যেতে হলো সঞ্চিতাকেও। কিন্তু আদতে যতোটা সহজ স্বাভাবিক দেখাচ্ছে বাইরে অঙ্কিতাকে সে কি ততোটাই স্বাভাবিক ভিতরেও? তার কি সত্যি সত্যিই অস্হির হবার কথা? বিগত পনেরো বছরে একবারও কি কথা হয়েছে শিমুলের সাথে? মনেও কি পড়ে তার শিমুলকে, ভুল করেও? অঙ্কিতার চোখে ভেসে আসে বহু দূর থেকে, ঝাপসা হয়ে যাওয়া একটা ছবি। পাহাড়ের গায়ে হেলান দেয়া একটা স্কুল, পাহাড় কেটে বসানো একটা ক্লাসরুম!! সেই স্কুলঘরের জানালার কার্নিশে বসে পা দুলিয়ে টিফিন করছে বছর দশেকের দুটি মেয়ে। একজনার লম্বা চুলে বেণী করা, ফর্সা গায়ের রঙ। নেভিব্লু টিউনিক আর সাদা শার্টে ঝলমলে উজ্জ্বল। আরেকজন বয়কাট চুল, শ্যামলা কিন্তু ভীষণ মিষ্টি চেহারার। এদের মধ্যে লম্বা চুলে চশমা পরা মেয়েটা অঙ্কিতা সিংহরায় আর ছোট চুলের স্মার্ট মেয়েটা শিমুল, শিমুল আহমেদ!

শিমুল আর অঙ্কিতা কখনো ক্লাসমেট ছিল না, এক স্কুলে পড়তো বটে। শিমুল ছিল এক ক্লাস জুনিয়র। কিন্তু বাবাদের চাকরির সুবাদে এক এলাকায় থাকতো। দুজনের মধ্যে কীভাবে কোন কারণে ঘনিষ্ঠতা হলো তা আজো মনে পড়ে না অঙ্কিতার।আগেও কখনো ভাবেনি আজো ভাবলো না। স্রেফ এটুকু মনে আছে কী প্রচন্ড রকম অপমান সে পেয়েছিল এক সময় শিমুলের কাছ থেকে। তাই আজ আর নতুন করে শিমুলকে হারানোর মতো কিছু ছিলো না তার, শিমুল নামের মেয়েটা সেই দশ বছর বয়সেই মরে গেছিলো তার কাছে। যে কারণে বাবার রিটায়ার করার পরে একই এলাকায় পাশাপাশি বাড়ি হওয়া সত্ত্বেও কখনো শিমুলদের বাড়ি অঙ্কিতা আর যায়নি বা সেই ঘটনার পরে শিমুলের সাথে আর কখনো কথাও সে বলেনি৷ আশ্চর্যজনক হলেও সত্যি যে, শিমুলকে আর কখনো কোথাও সে দেখেইনি। এমনকি অঙ্কিতার বিয়েতেও শিমুল এসেছে বলে সে জানে না। আর আজ তো তার জীবনের অনেক বড় একটা দিন। কই শিমুলকে ডাকার মতো ইচ্ছে তো তার হয়নি।

সেই দশ বছর বয়সে, পুতুল খেলার আসরে পুতুলের বিয়ে দিয়েছিল ওরা দুইজন। শিমুলের ছেলে আর অঙ্কিতার মেয়ে পুতুল। অঙ্কিতাদের বাড়িতে তার মা বিশাল আয়োজন করেন এই বিয়েকে কেন্দ্র করে। অঙ্কিতার পাড়ার, স্কুলের সব বন্ধুরাই ছিল সেদিন পুতুল খেলার ছলে এক বনেদি পরিবারের আয়োজনে। সব ঠিকঠাক মতো মিটেও গেলো, সবাই মিলে একসাথে বেশ মজাও করা হলো। কিন্তু বাদ সাধলো পরেরদিন বৌভাতের আয়োজনে। অঙ্কিতার পাড়ার কিছু বন্ধু শিমুলদের বাড়ির আয়োজনের সাথে তুলনা করতে লাগলো মজা করে। যেমন কোন বিয়ের আসরে বড়দের তারা করতে দেখতো সেই সময়। অনেকটা নাটকের সংলাপ বলছিল তারা মজা করেই৷ কিন্তু ছোটদের সেইসব বড়দের নকলে বলা কথা শুনে ফেলেন শিমুলের ডাক্তার বড়বোন মাসুদা। তার অভিজ্ঞ বড়দের বড় মনে কথাগুলো বড়দের মতো করেই লাগলো। মানে তার অহমে লাগলো আরকি। এর পরে অনেক কাণ্ড অনেক কুকথা শোনালেন তিনি অঙ্কিতাকে।

শিমুলের ভাই এসে পরে বিষয়টি মিটমাট করার চেষ্টা করলেন এই বলে যে, অঙ্কিতা তার মেয়ে পুতুল আর তার বন্ধুদের নিয়ে ফিরে যাবে এখনই৷ আর কখনো সে যেনো শিমুলের সাথে না মেশে। এমনিতেও হিন্দু বাড়ির মেয়ে কখনো মুসলমান মেয়ের বান্ধবী হতে পারে না। ওরা দুইজন দুই ধর্মের যখন, পুতুলের বিয়েও সম্ভব না। প্রচন্ড অপমানিত হয়েই সেদিন অঙ্কিতা তার পুতুল নিয়ে কাঁদতে কাঁদতে বাড়ি এসছে। এরপরে আর কখনো কোনভাবেই শিমুলের সাথে তার যোগাযোগ ছিল না। এক এলাকায় পাশাপাশি বাড়ি, শিমুলের বড় ভাইবোন নানা কারণে প্রায় আসেন অঙ্কিতাদের বাড়িতে। এরাও যান বটে কেবল অঙ্কিতা এসবে নেই একেবারে৷

একটু পরেই মা চা দিয়ে গেলেন অঙ্কিতাকে। সঙ্গে জানালেন, তিনি শিমুলদের বাড়ি যাবেন এখন৷ না গেলেই নয়। অঙ্কিতার এই শরীরে তার এখন আর ওবাড়ি গিয়ে দরকার নেই বটে কিন্তু বাড়ির আর সকলে নিশ্চয়ই যাবে।
শিমুলের সাথে ওরই এক ক্লাসমেটের প্রেম আছে জানতে পারে বাড়ির লোক। বড়রা এই ঘটনা জেনে বড়দের মতোই শাসন করতে চাইলে শিমুল প্রতিবাদ করে ঘরে থাকা হারপিক খেয়ে। হাসপাতালে যখন নেয়া যায় তাকে, ততোক্ষণে অনেক দেরী হয়ে গেছে। ওয়াশ করা হয় বটে তবে তাকে বাঁচানো গেলো না। এড়ানো গেলো না পোস্টমর্টেম এমনকি অপঘাতের মামলাও। শিমুলের নিজের বড়বোন ডাক্তার, একভাই ম্যাজিস্ট্রেট। আছেন বাবা মাও, তারা সকলে মিলেও শিমুলকে বাঁচাতে পারেন নাই। অকালেই শিমুল ঝরলো বৃন্ত খসে।

গভীর রাতে সবাই যখন ঘুমে তখন হঠাৎই ঘুমের মধ্যে ছটফট করে উঠে অঙ্কিতা আর তখনই সে টের পায় পেটে প্রচন্ড রকম ব্যথা। অঙ্কিতার চীৎকার শুনে একে একে তন্দ্রা ভেঙে উঠে আসে বাড়ির সকলে। তড়িঘড়ি করে গাড়ি বের করে তাকে নেয়া হলো হাসপাতালে। কিন্তু অঙ্কিতার পেটের সন্তানকে বাঁচানো গেলো না কোনরকমে। অঙ্কিতার সন্তান জন্মালো বটে, তবে মৃত।ভীষণ সুন্দর, তুলতুলে নরম আর লাল গায়ের রঙ। যেনো বৃন্ত থেকে খসে পড়লো আরো একটা শিমুল, অকালেই!

ছবি : এক্রিলিক অন ক্যানভাস
শিল্পী : মঞ্জুর রশিদ

অনসূয়া যূথিকা। লেখক ও সংস্কৃতিকর্মী। জন্ম ও নিবাস বাংলাদেশের ঢাকায়।

এই বিভাগের অন্যান্য লেখাসমূহ