বাংলাদেশের বইমেলায় পশ্চিমবঙ্গের বই-প্রসঙ্গে সাম্প্রতিক বিতর্ক
বাংলা একাডেমি কর্তৃক ফেব্রুয়ারি মাসব্যাপী একাডেমি প্রাঙ্গন ও সোহরাওয়ার্দি উদ্যানে আয়োজিত একুশে বইমেলা ২০২৩ শেষ…..
বঙ্গদেশের দক্ষিণ পশ্চিম প্রান্ত সীমানায় অবস্থিত ছোট ছোট টিলা, অযোধ্যা পাহাড়, শাল-পিয়াল-মহুয়া, জোড়, বাঁধ, রুক্ষভূমি পরিবেষ্টিত আদিম জনজাতির দেশ মানভূম। মানভূমের ইতিহাস বহু প্রাচীন। বৃহৎ পরিসরে আলোচনায় না গিয়ে শুধু এটুকুই বলবো ১৮৩৩ খ্রিস্টাব্দ থেকে মানভূমের সদর দপ্তর ছিলো পুরুলিয়া, তারপর ১৯৫৬ খ্রিস্টাব্দে মানভূম জেলা ভেঙ্গে পূর্বাংশ ‘পুরুলিয়া’ জেলা নামে এই বঙ্গের অন্তর্ভূক্ত হয়। তবু এখনও জেলাবাসী শুধুমাত্র মানভূমবাসী বা ‘মানভূঁইয়া’ নামে পরিচিত হতে ভালোবাসে, আর মানভূমের মৌলিক ও উন্নত লোকসংস্কৃতি নিয়ে তারা চর্চা করতে ভালোবাসে। ‘অংশুমালী’র দেয়ালে মানভূমবাসী হয়ে আমিও তাই চেষ্টা করছি মানভূমের সংস্কৃতিকে বৃহত্তর জগতের কাছে তুলে ধরার, যদিও আজ পৃথিবীবাসীর কাছে পুরুলিয়ার ‘ছৌ’ বহুল পরিচিত।
লোকসংস্কৃতি গবেষক ও লেখক ইজাজ আহমেদ বলেছেন,
“গ্রামাঞ্চলের শ্রমজীবী ও গরীব মানুষের জীবন সংগ্রামের নানা দিক, তাদের জীবন মৃত্যু, দুঃখ -কষ্ট, প্রেম-ভালোবাসা প্রভৃতির উপর ভিত্তি করে সৃষ্ট হয় যে সংস্কৃতি সেটাই লোকসংস্কৃতি”।
মানভূমের পরতে পরতে লোকসংস্কৃতির ইতিহাস। লোকজীবনের হাসি-কান্না, সমস্যা, সমাজ ও শোষণের ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র ছবি মানভূমের সংস্কৃতিতে। এ সংস্কৃতিকে জানতে হলে জানতে হবে এ মাটির সোঁদা গন্ধ, রস, চলমান জনস্রোতের ইতিহাস। আর জানতে হবে ভাদু, টুসু, জাওয়া, অহিরা, ঝুমুর, ছৌ, বাঁধনা, কাঠিনাচ, ঘোড়ানাচ, মাঝিনাচের ইতিহাস। আজ মানভূমের টুসু গান ও টুসু পরবের কথা বলি। একটা টুসু গান দিয়ে শুরু করা যাক-
মকর মকর মকর পরবে
ছোঁড়িদের পা পড়ে নাই গরবে…
মকর উৎসবে ছোঁড়ি (মেয়ে)রা আনন্দ এবং অহংকারের আতিশয্যে ধরাকে সরা জ্ঞান করে এই মানভূমে। টুসু গান গাইতে গাইতে স্বতঃস্ফূর্ত এ আনন্দে না আছে লাগাম, না আছে কাউকে পরোয়া করার মানসিকতা। শুধু উদ্দাম খুশী এবং উদ্ধত ভঙ্গিতে গানে গানে টুসু লক্ষ্মীকে মান্যতা দিয়ে বাকী সারা অর্থাৎ অন্য টুসু ভাসানের দল এবং পথচারীকে সপাটে বাউন্ডারীর ওপাশে ফেলার দুর্জয় আনন্দ প্রচেষ্টা।
মানভূমের ছোঁড়িরা শুধু নয়, সমস্ত মানভূম এবং সংলগ্ন এলাকায় মকর উৎসব জাতীয় উৎসব। বাঙালির কাছে দুর্গাপূজা জাতীয় উৎসব হিসেবে মান্যতা পেলেও মানভূমে দুর্গাপূজাকে ব্যাকফুটে ফেলে দিয়েছে টুসু পরব বহুকাল আগে থেকেই। মানভূমের শহরাঞ্চলে দুর্গাপূজার বাড়বাড়ন্ত হলেও এখানকার এমন কোন গ্রাম নেই, গ্রামের মাঝে অথবা পাশে এমন কোন জলাশয় নেই বা গ্রামের এমন কোন পরিবার নেই যারা মকর বা টুসু পরবের সাথে যুক্ত নয়। শুধু গ্রামই বা বলি কেন, পুরুলিয়া শহর ও জেলার বাকী শহর ও আধা শহরগুলিও আজকাল সরাসরি টুসু পরবের আনন্দযজ্ঞে নিজেদের সমর্পণ করেছে।
উৎসব মানেই আনন্দ, উৎসব মানেই অনুষ্ঠান, উৎসব মানেই আচার। মকর উৎসব মানভূমের রুখা-সুখা জমির একমাত্র ফসল আমন ধান ঘরে তোলার উৎসব। আঘনে (অগ্রহায়ণ মাসে) মাঠ থেকে ধান তুলে আঘন সাঁকরাতে (অঘ্রাণ সংক্রান্তিতে) যে ভূমি বা বা ভূমি লক্ষ্মীর দান এই শস্য, সেই ভূমি লক্ষ্মীকে টুসু দেবী রূপে প্রতিষ্ঠা করা হয় ঘরে ঘরে। ধানের তুষ থেকে নাম এসেছে টুসু। এই টুসু দেবী বন্দনায় কোন পুরোহিতের কোন মন্ত্র নেই, জ্ঞানগর্ভ বক্তব্যসমেত কোন অঞ্জলি নেই, কোন পাঁচালি কথা নেই- এ দেবীর একমাত্র তুষ্টি হৃদয় থেকে উৎসারিত টুসু গান। টুসু গানের কোন ব্যাকরণও নেই, নাড়া বেঁধে গুরুর কাছে শিক্ষা নেই, লিপিবদ্ধ কোন স্বরলিপি নেই – হৃদয় হতে আপনা-আপনি উঠে আসা এক সরল, অনাড়ম্বর আনন্দের গান, যে গানে ফুটে ওঠে দৈনন্দিন যাপিত জীবনের ভগ্নাংশ। মাঠে যে রাখাল গরু চরাচ্ছে সেও যেমন টুসু গাইছে, তেমনই রান্নাঘরে ব্যস্ত মেয়ে গাইছে টুসুগান, বাচ্চা ছেলেমেয়ে খেলতে খেলতে গাইছে টুসু, ধান সেদ্ধ করতে করতে ঘরের পুরুষ-মহিলা গাইছে টুসুগান, এমন কি অফিসের বাবু যিনি গ্রাম থেকে শহরে যান দশটা পাঁচটা করতে তিনিও যাওয়া-আসার পথে টুসু গেয়ে নিজেকে সতেজ রাখছেন। এখানেই টুসুগানের বিশেষত্ব। টুসুগানের কোন ক্লাসিফিকেশন নেই। টুসুগান মানভূমের সরল সোজা, অকপট সমস্ত মানুষের গান। এভাবেই টুসুগান মানভূমের লোকসংস্কৃতির বিশেষ অঙ্গ হয়ে উঠেছে। সমস্ত পৌষ মাস মানভূমের আকাশ-বাতাস-গাঁ-ডিহি-ডহর-নদী-বাঁধ-ডোবা মুখরিত হতে থাকে টুসু গানে। টুসু গানে সাহিত্যধর্মিতা নেই, আছে বক্তব্যধর্মিতা। তাই গানের বিষয় যা কিছু হতে পারে। জীবনের কথা সাবলীলভাবে, অকপটভাবে গানের মাধ্যমে প্রকাশ পায়। সমাজব্যবস্থার যে কোন রূপ এ গানের বিষয়বস্তু। যেমন হতে পারে মানভূমের দিন আনি দিন খাই মানুষদের অনটন, তেমনই তাদের আশা আকাঙ্খা। এমনকী ভোট, রাজনীতি, আন্দোলন, নারী নির্যাতনও এ গানের সহজ সরল সুরে ফুটে ওঠে। এমনই একটি টুসুগানের উদাহরণ-
আমার মনের মাধুরী
সেই বাংলা ভাষা করবি কে চুরি?
আকাশ জুড়ে বৃষ্টি নামে মেঠো সুরের কোন চুয়া।।
বাংলা গানের ছড়া কেটে আষাঢ় মাসে ধানরুয়া
বাংলা গানে টুসু আমার মকর দিলে সাঁকরাতে
টুসু ভাসান পরব টাঁড়ে টুসুর গানে মন মাতে।
বিহার প্রদেশে থাকাকালীন মানভূমের বাংলা ভাষার সংকটকালীন অবস্থায় এমনই কিছু টুসুগান রচিত হয়েছিলো। এইভাবে পরম্পরা ও তাৎক্ষণিকতা টুসু গানে মিলেমিশে একাকার হয়ে তার লোকপ্রিয়তা বজায় রেখেছে। কলি (চরণ) ছোট, চপল ও চটুলতা এ গানের বৈশিষ্ট্য। রচয়িতা গ্রামের নিরক্ষর, স্বল্পসাক্ষর লোকজনেরা। যে ভূমিলক্ষ্মী টুসু দেবীকে গোটা পৌষ মাস সন্ধ্যা বেলায় গান শুনিয়ে মেয়েরা বন্দনা করে, সে টুসুদেবী কিন্তু কোন মূর্তিমতী দেবতা নন। মাটির সরা একটির উপর আরেকটি উপুড় করে তার ভেতর গুড়ের লাড়ু (নাড়ু), ফুল দিয়ে সরাদুটিকে গোবর দিয়ে লেপন করা হয়, তারপর সেটিকে লাল টুকটুকে কাঁচফল দিয়ে সাজানো হয়। একত্রে সাজানো সরা দুটিই দেবী। একেই আঘন সাঁকরাতে (অঘ্রাণ সংক্রান্তিতে) গ্রামের মা-বোনেরা স্থাপন করেন ঘরের কুলুঙ্গিতে। পৌষমাসের প্রতি সন্ধ্যায় তাকে গান শুনিয়ে বন্দনা করে পৌষ সংক্রান্তির আগের রাত্রিতে রঙিন কাগজ, চাঁদমালা দিয়ে সাজানো টুসুর ঘর অর্থাৎ চৌডোল- এ বসিয়ে টুসুদেবীকে সারারাত টুসুগান শুনিয়ে জাগরণ করা হয়। টুসুর ভোগ সেদিন তিলের নাড়ু, গড়গড়্যা পিঠে, খই, জনার (ভুট্টা), মুড়কি প্রভৃতি। মকর সংক্রান্তির দিন ভোর বেলা দলবদ্ধ হয়ে মেয়েরা টুসুগান গাইতে গাইতে টুসুদেবীকে চৌডোলে বসিয়েই ভারাক্রান্ত হৃদয়ে নদীতে নিয়ে গিয়ে বিসর্জন করেন।
অঘ্রাণ সংক্রান্তি থেকে পৌষ সংক্রান্তি পর্যন্ত টুসু বন্দনা হলো মকর পরবের একটি দিক, সামগ্রিকভাবে মকর পরব আরও ব্যাপক ও বিস্তৃত। সে কথা অন্য কোনদিন।
বাংলা একাডেমি কর্তৃক ফেব্রুয়ারি মাসব্যাপী একাডেমি প্রাঙ্গন ও সোহরাওয়ার্দি উদ্যানে আয়োজিত একুশে বইমেলা ২০২৩ শেষ…..
চিত্তরঞ্জনের গৃহপরিবেশ এত সুখ ও শান্তির ছিল তবুও তার মন যেন মাঝে মাঝে কেঁদে উঠতাে…..
পারসিক সংস্কৃতির দেশ ইরানের মেয়েরা সমানে তাঁদের হিজাব পুড়িয়ে ফেলছেন, চুল কাটছেন। যেন তারা পুরুষতন্ত্রের…..
“ভালোবাসা তোমাকে যেমন রাজমুকুট পরিয়ে দেবে, তেমনি তোমাকে ক্রুশবিদ্ধ করবে। … প্রেম তোমাকে শস্যের আঁটি…..