ডাইনি

অজিতেশ নাগ
গল্প
Bengali
ডাইনি

রামেশ্বর ঠিকই বলেছিল। তবে একটা কথা তো নয়। হুড়হুড় করে অনেক কথাই বলে যাচ্ছিল সে। তার মধ্যে থেকে একটা কথা ঠিক ধরে ফেলেছিলাম। গিয়ে দেখি সত্যি বটে।

মেয়েটাকে দেখলে সত্যি লোভ লাগে। বয়স, এই রামেশ্বর যা বলেছিল, তার সামান্য কম বেশী হবে। একটা শিরিষ গাছের মত গাছের নিচে উবু হয়ে বসেছিল মেয়েটা। গাছের মত লিখলাম, কারণ গাছ আমি বিশেষ চিনি না। তাই আমার কাছে সবটাই মতো। গাছ যাক চুলোয়।

ধীরেসুস্থে আমি মেয়েটার সামনে উবু হয়ে বসে পড়লাম। এইভাবে বসার হ্যাবিট অনেকদিন চলে গেছে। কোমর বেড়েছে প্রস্থে। কোমরের চামড়ার বেল্টটা বেশ লাগছে। গায়ের উর্দিটা চেপে ধরল যেন আরও। গলার কাছে বিনবিনে ঘামের উপস্থিতি টের পেলাম। তবু বসলাম। সামান্য অন্ধকার নেমে এসেছে। সেটা কথা নয়। মেয়েটা মাটির দিকে তাকিয়ে বসে আছে। কপাল অবধি একটা গামছা জড়ানো। আর তাই মেয়েটার মুখটা ঠিক পরিষ্কার করে দেখতে পাচ্ছিলাম না। তবে গা গতর যা দেখছি, তাতে আমার পুরো শরীরটা চনমন করে উঠছে। সামান্য চওড়া কাঁধ, বুকের কাছটা বেশ ফোলা, তবে নোয়ানো নয়। কোমরের দিকটা সরু হয়ে এসে ফের উপত্যকার মত চওড়া হয়েছে। হাঁটুর নিচটা উন্মুক্ত। পায়ের ডিম পুরুষ্টু। পাতায় সামান্য কাদামাটি লেগে আছে। পিছন থেকে শবুর বলে উঠল, স্যার, আর কাছে যাবেন নি গ’।

-কেন?

-মেয়েটো ভালো লয় স্যার।

তা এখানকার কিইবা ভালো! মাঙ্গুরিয়া, জয়পুর, আরসা, বলরামপুর হয়ে ঝালদায় ট্রান্সফার হয়ে এসেছি মাসদুয়েকও নয়। যদিও ঝালদা শহরে নয়। খুঁটিয়ে বলতে গেলে ইলুগ্রামের কাছাকাছি। এই থানার অধীনে মোট আটটা গ্রাম। গ্রাম না বলে গণ্ডগ্রাম বললেই ভালো হয়। ঝামেলা লেগেই আছে। তো এইসব এলাকায় এতদিনে তো ভালো কিছু দেখলাম না। ঝালদা থানার আগের ওসি পরিমল হাতি আমাকে কাজ বুঝিয়ে দিয়ে যাবার সময় পেগে পেগ ঠেকিয়ে বাঁ চোখ টিপে বলেছিল, খাবার ইচ্ছে হলে বাইরে থেকে এনে খাবেন। লোকাল খাবার খাবেন না। ভীমকে বলে দেবেন। ও ঠিক জোগাড় করে এনে দেবে।

প্রথমে বুঝি নি। চার পেগের গ্লাসটা নামিয়ে রাখতেই সব পরিষ্কার হয়ে গেল। জানার খুব ইচ্ছে জাগল। পরিমলবাবু শুধু বললেন, এখানকার মেয়েগুলান ভালো না। তাছাড়া খুব রিস্কি। দিনেদুপুরে মার্ডার হয়ে যাবেন।

-সেকি! এতদূর!

-কেন? ইসমাইলের কেসটা শোনেন নি?

শুনেছিলাম। একটা লোকাল মেয়েকে ভুলিয়ে নিয়ে এসে ফুর্তিফার্তা করার পরদিনই গ্রামের লোক চড়াও হয়েছিল থানায়। এই তো মেরেকেটে স্টাফ। জনা চল্লিশকে আটকাতে পারে? লোকগুলো চেয়েছিল ঐ জিনিসটা কেটে নিয়ে যেতে, নেহাৎ ইসমাইল পায়ে ধরে ক্ষমা চাওয়ায় সে জিনিসটি রক্ষা পেয়েছিল। বিনিময়ে বাঁ হাতের পাঁচটা আঙুলই কেটে নিয়ে যায় টাঙ্গির কোপে। শহরে আসতে আসতে সেপটিক হয়ে গিয়েছিল।

খাবারের ব্যাপারে বেশী বুঝিয়ে বলতে হয় যাদের তারা গাঁড়ল। আমি তা নই। তাছাড়া এইসব জঙ্গল এলাকায় আমার হয়ে গেল তা নয় নয় করে দশ বছর। চোর ছ্যাঁচোর একেবারেই যে নেই তা নয়, তবে তেমন ত্যাঁদড়ামি নেই। ভীম লস্কর, শবুর সরেন, রামেশ্বর মাহাত, গৌরহরি সব মিলিয়ে মিশিয়ে জনা আস্টেক স্টাফ। তার মধ্যে ভীম বেশ কাজের। লোকাল ছেলে। নাম শুনলে যা মনে হয় দেখলে চোখ কপালে ওঠে। ও কী করে চাকরি পেয়েছিল আমি জানি না, তবে এইরকম পাকানো একহারা চেহারা সচরাচর চোখে পড়ে না। উর্দি গায়ে না থাকলে সিঁধেল বলে ওকেই ধরে গারদে পুরতাম। তবে ছেলেটি ভালো। মাঝে মধ্যে ইচ্ছে হলেই ওকে জানাই। ঘনায়মান অন্ধকারে মধ্য থেকে নিয়েও আসে কোত্থেকে না জানি। সব ডবকা ডবকা খাবার। বিনিময়ে একশোটা করে টাকা আর একটা পাইট নয়তো নিপের দাম। একবার একটা লোক লোকাল মদের বোতল নিয়ে আমাকে উপহার দিয়েছিল। খেয়ে দেখেছি। সরেস। অবশ্য এই নিয়ে রামেশ্বর একটু সাবধান করেই দিয়েছিল আমায়। বলা ভালো বকেই দিয়েছিল। আমিও ভুল বুঝতে পেরেছিলাম। আর লোকাল জিনিস খাই নি। রামেশ্বর লোকটা বড্ড ভালো। সব সময় আমার সাথে সাথেই থাকে। খাবার একা খেয়ে শেষ করতে না পারলে ও-ও পায়। প্রসাদ!

বেশ আছি। মাঝে মাঝে ভাবি আমার মত স্টাফই সরকারের চাই এখানে। শ্লা, বউ বাচ্চা কেউ নেই। মরে গেলেও দুঃখ করার কেউ নেই। পেনশন নেবার কেউ নেই। সারা সকাল বড়হুটোলা থেকে হাতিয়া অবধি রাস্তার ধুলোয় পাড়ার পর পাড়া ঢেকে দিয়ে জিপে টহল দিই। সন্ধ্যে হলে একটা পাইট আর শুয়োরের মাংস। শেষ পাতে শবরুর হাতের ঝাল সব্জী দিয়ে ভাত। তারপর প্যান্টটা খুলে একটা লুঙ্গি চড়িয়ে থানার হাতায় দাঁড়িয়ে একটা বিড়ি ধরিয়ে কিছুক্ষন সময় কাটাই। পুরো এলাকাটায় তখন যেন মাঝরাত। সারাদিনমানে শুনতে পাই না, কেবল এইসময়টায় কোথা থেকে একদল পাখি টিরর টিরর করে ডাকতে থাকে। একবার যেন একটা হায়নার হাসিও শুনেছিলাম। কি জানি মদের ঘোরে হয়ত। এরপর কোনদিন ভূতের মত কানের পাশে উদয় হয় ভীম। আমি বুঝতে পারি। তখন ঘরে গিয়ে খাটিয়ায় কিছুক্ষন কচি মাংস দলাই মলাই করি। তারপর এক ঘুমে ভোর। বেশ আছি।

আজ সকাল থেকে মেজাজটা শরিফ ছিল। সারা সকাল দাপিয়ে বেরিয়ে দুপুরে দমভর খেয়ে সামান্য ভাতঘুম এসেছিল, চটকে গেল রামেশ্বরের হাঁকাহাঁকিতে। থানার সামনে একদল লোক দাঁড়িয়ে। বাইরে এসে দেখি কি কান্ড! শুধু একদল লোকই নয় টাঙ্গি, কুড়ুল সমেত জমায়েত বিশেষ। কী কেস ভাইসবেরা? এই অঞ্চলের ভাষা অল্পসল্প শিখেছি কিন্তু এতজন মিলে এমন হইচই লাগিয়ে দিলে যে কিছুই বুঝতে পারলাম না। হাত তুলে সবাইকে থামিয়ে শবুরকে বললাম, কী হয়েছে বুঝাও তো।

-স্যার, ডান ধরা পড়েছে।

ডান! মানে ডাইনি! জগৎ কোথায় চলে এসেছে কিন্তু আজও এইসব অঞ্চলে এইসব কুসংস্কার চলে আসছে। ধমক দিয়ে বললাম, ডান বলে কিছু হয় না। বুঝাও এদের।

-এদ্যের বুঝায়ে লাভ নাই স্যার। এর‍্যা মানবেক লাই। গত ডিসেম্বরের কুতা মন্যা লাই?

মনে নেই আবার! ডিসেম্বরের হাড় কাঁপানো শীতের রাতেও উর্দি চাপিয়ে আমাকে বেরিয়ে পরতে হয়েছিল জিপ হাঁকিয়ে। গিয়ে দেখি আর কিছুই করার নেই। একটা বছর চল্লিশের মেয়েমানুষ। গতরের দিকে তাকিয়ে রাগ হল। এইরকম একটা ফিগারের মেয়েমানুষকে কেউ এইভাবে মারে? আর শুধু মারা? লাঠি দিয়ে পিটিয়ে পিটিয়ে থেতলে দিয়েছে গো। মাথা বলে আর কিছু নেই। এর পরে আজ আবার। মাথা খারাপ হয়ে গেল। এরা সব পাগল আর আমাকেও পাগল বানিয়ে ছাড়বে। রাগত গলায় বললাম, তাহলে আর কী? তাকেও মেরে ফেল। তোদের আর কাজ কী?

শবুর বলল, মেয়েটা গুণ জান্যে স্যার। যে ওকে ছোঁয় তার কুঠ্যা হয়।

কুঠ্যা! মানে কুষ্ঠ! যতসব বুজরুকি। এদের নিজেদের শরীরেও রোগ আর দোষ চাপাচ্ছে কার উপরে। কি আর করা। বললাম, চল দেখি।

অকুস্থল আমার থানার থেকে প্রায় দুমাইল দূরে। গ্রামের নাম কারণবাঁধি। প্রচুর ধুলো খেয়ে যখন পৌঁছলাম, তখন বিকেল ঢলে আসছে। মেয়েটার সামনে উবু হয়ে বসে ওর দেহসুধা পান করতে করতে রামেশ্বরকে বললাম, কী কেস রে? এই মেয়েটার কুষ্ঠ আছে?

-স্যার, ইনফরমেশন যা আছে, এই মেয়েটার বাপ মা কেউ নেই। এক পিসির কাছে মানুষ। সেও পিসিও মারা গেছে। গত হপ্তা অবধি ঠিকই ছিল। তারপরে এরা বলছে এই মেয়েটা যাকে ছুঁয়েছে বা যে ওকে ছুঁয়েছে সবারই একই রোগ হয়েছে। ও ডান হয়ে গেছে স্যার।

-ধ্যাৎ। এরকম হয় নাকি?

-হয়েছে স্যার। এরা বলছে।

আমি মেয়েটার দিকে ঝুঁকে বললাম, কিরে তোর নাম কী?

এইবার মেয়েটা আমার দিকে মাথা তুলে তাকালো। উফফ! মোটা পুষ্ট ঠোঁট দুটো দেখে মনে হল এর জন্য মরেও যাওয়া যায়। তেলতেলে কালো সাপের মত গায়ের রঙে বড় বড় দুটো চোখ। আমার দিকে ঠাঁয় তাকিয়ে আছে। আমি বললাম, তোর নামটা কীরে মাগি?

মেয়েটা ম্লান হাসল। বলল, সুমালি।

-তা সুমালি, তুই ডান বট্যে?

সুমালি সেই একপেশে হেসে মাথা নামিয়ে নিলো। ততক্ষণে যা বোঝার বুঝে গেছি। এদেরই কেউ নিশ্চয় একে ভোগ করতে চেয়েছে। না পেরে ডাইনি অপবাদ দিয়ে মারতে চায়। এরকম বহু কেস আমি হ্যান্ডেল করেছি। বেশীর ভাগ হয় একাকী বৃদ্ধামানুষ। হয়ত জমিজিরেত আছে। বুড়ির তিনকুলে কেউ নেই। ব্যস। ডাইনি বলে রটিয়ে মারো। তারপর তার সম্পত্তি নিশ্চিন্তে ভোগদখল কর। ভোগের লালসা নিবৃত্তি না হলেই ‘ডান’। পুলিশ আর কি করবে? এরকম একটা কেসে চারজনকে ধরে এনে বেধড়ক কেলিয়েছিলাম। তাতে কী হয়? কী হল? কিছুই না।

আমি উঠে দাঁড়ালাম। কোমরের রিভলভারটা হাতে তুলে নিয়ে ঘোষণা করলাম, এই মেয়েটাকে আমি নিয়ে যাচ্ছি। সরকারি হোমে দিয়ে দেব। কেউ গণ্ডগোল করতে এলে মরবে।

একটা গণ্ডগোল পাকিয়ে উঠতে যাচ্ছিল, হাতে রিভলভার দেখে সেটা জমে উঠতে পারলনা। আমি শবুরকে বললাম, মেয়েটাকে জিপে তোল।

শবুর দাঁড়িয়ে রইল। সাধারণত আমার কথায় কোন দ্বিরুক্তি করে না। বুঝলাম। যত্ত সুপারস্টিশন। আমি মেয়েটাকেই উদ্দেশ্য করে বললাম, অ্যাই, ওঠ জিপে।

মেয়েটা উঠে দাঁড়ালো কিন্তু ঠায় দাঁড়িয়ে থাকল।

-কিরে আমার সাথে যাবি? না এখানে পরে পরে মরবি?

এতেও মেয়েটি ঘাড় গোজ করে দাঁড়িয়ে রইলে। ‘মরগে যা’ বলে আমি এগিয়ে গেলাম জিপের দিকে। এদিকে আমার পাঁইটের নেশা চাগিয়ে উঠছে। ফের দুমাইল পথ উজিয়ে তবে গ্লাস সাজিয়ে বসতে পারব। দৃশ্যটা ভাবতেই গলার কাছে তেষ্টা পেল। ওমা! আমি বাকি দুজনকে নিয়ে জিপে উঠতেই দেখি সে সুড়সুড় করে এসে পাশে বসে পড়েছে। বাঃ। খাসা তো। আমি জিপ চালিয়ে দিলাম। শবুর আর রামেশ্বর তখন থেকেই গুম মেরে আছে। আমার এই কাজটাকে মোটেই সমর্থন করতে পারছে না, সেটা বিলক্ষণ বুঝতে পারছি।

থানার সামনে জিপ থামিয়ে মেয়েটাকে নামিয়ে ভেতরের ঘরে এনে বসালাম। ভীমকে বললাম কিছু খাবার আনতে। আসা ইস্তক ভীমের চোখ লেপটে ছিল মেয়েটার দিকে। আমার দাবড়ানি খেয়ে পালালো। কিছুক্ষণ পরে পাউরুটি আর ঘুগনি এনে হাজির। কোত্থেকে যে এইসব পায় ভীমের বাচ্চা কে জানে। মেয়েটা খাবার পেয়েই উর্ধশ্বাসে খেতে লাগল। বেশ খিদে পেয়েছে মনে হয়। একসময় বুকের পাশ থেকে কাপড় সামান্য সরে যাওয়ায় চোখ চুম্বক। এ জিনিস ঈশ্বরপ্রদত্ত। ভগবান-স্যার অনেকটা সময় ধরে গুছিয়ে না বানালে এ জিনিস উদ্ভূত হওয়া মুশকিল। কষ্টি পাথরের একটা কেষ্টঠাকুর দেখেছিলাম ঠাকুরদার বাড়িতে। ফের যেন দেখলাম। বাল্বের অল্প আলোয় কেমন একটা নেশা ধরে যাচ্ছিল। অথচ সকাল থেকে এক ফোঁটা মুখে পড়েনি। মেয়েটার এক জোড়া ঠোঁটের আন্দোলন দেখতে দেখতে আচমকা তৃষ্ণা জেগে উঠল।

রামেশ্বরকে কিছুই বলিনি। তবু সে বোতল সাজিয়ে দিয়ে গেল। পাশে মিনারেল ওয়াটারের বোতলে জল। নিকুচি করে জলের। বোতল খুলেই নিট গলায় ঢাললাম। এই মুহুর্তে নার্ভ চঞ্চল হয়ে উঠেছে। শান্ত করবার দরকার। মেয়েটা আমাকে পাগল করে তুলছে। গলাটা ঝাঁঝাঁ করে উঠল। বোতল নামিয়েই দেখি মেয়েটা খাওয়া থামিয়ে জুলজুল করে তাকিয়ে আছে।

-খাবি?

-দে কেন্যে।

একটা এনামেলের বাটিতে খানিকটা ঢেলে দিলাম। চোঁচোঁ করে মেরে দিলো মাইরি।

-এবার কেসটা কী বল তো?

-কী বট্যে?

-বলছি তুই ডান হলি কী কর‍্যা?

-দূর। আমি ডান হব কেন্যে?

-তায়লে?

-সব ব্যাটার নজর আমার গতরের দিকে। অ্যাদ্দিন বাঁচাইছি। আর পারলম না। লাখিয়া আমারে খেইল্য।

-আর কুঠ্যা?

-অ আমি কি জান্যি। উসব জানিক না। লাখিয়ার কুঠ্যা হইল, শমরির পুল্যার হইল, গেরামের সব রট্যাইল আমি ডান।

-শমরির পুল্যার হল্য ক্যান?

-অরে আমি নিজের ছেইল্যার লাখান ভালবাসতম। কী জানি কী হইল বাবু।

-হুম। বুঝলাম। তা এখন কি করবি তুই?

-কি করব আজ্ঞে?

-গেরামে ফিরলে তুই গেছিস। চল তোকে অন্য গেরামে দিয়ে আসি। ওঠ।

-কাজটা ভালো হইচ্ছে না স্যার। সুমালি আমাদের গেরামের মেইয়্যা। ওকে কিছু কর‍্যান না স্যার।

আরে দূর! শবুরের অনর্থক চিন্তাকে নিবৃত্ত করে মেয়েটাকে নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। এই মেয়েকে বেশীক্ষন কাছে রাখলেই আমার নেশার ছুটে যাবে। অনেককিছু ইচ্ছা জাগবে। তার চেয়ে দূর করে দেওয়া ভালো। রামেশ্বর আসতে চেয়েছিল, আমি না করলাম।

কতক্ষণ জিপ ছুটিয়েছি মনে নেই। একসময় থামলাম। এদিকে জঙ্গল পাতলা হয়ে এসেছে। একটা অনুচ্চ টিলা। আমি জানি ওটা পার করলেই নৈহারটোলা। মুখে মুখে নেয়ারটোলা। মোটামুটি ভদ্রস্থ গ্রাম। নিশ্চয় কিছু একটা জীবিকা খুঁজে নিতে পারবে মেয়েটা। আর পারুক না পারুক আমার কি। চারদিকে জ্যোৎস্নার পাতলা আস্তরণ। কোথা থেকে মহুয়ার গন্ধ আসছে নাকি? মহুয়া নাকি জারুল? নাকি কোন বুনো ফুল? আগেই বলেছি আমি গাছ চিনি না। নেহাৎ এইসব অঞ্চল আমার চষা। নয়ত অন্য কেউ সাহস করত না, এতরাতে এদিকে আসার।

-নাম। যা, ঐ টিলাটা পের‍্যোয়ে যা। উদিকে নেয়ারটোলা।

-জানি গো বাবু, জানি। কিন্তুক তুই কি জানিস আমি ডান?

-ফের মাজাকি? মরতে মরতে বেঁচেছিস, ভালো লাগছে না?

মেয়েটা তার পাথুরে শিল্পশরীর নিয়ে আমার দিকে এগিয়ে এলো। আমি নড়তে পারছিলাম না। মহুয়ার গন্ধটা খানিকটা বাড়ল। খুব ধীরে মেয়েটার স্তন ছুঁল আমায় বুক।

খুব ফিসফিসে গলায় শুনলাম মেয়েটা বলছে, আমি ডান বাবু। সত্যি সত্যি ডান আছি। মারাংবরু স্বপনে আস্যে আমারে ডান কর‍্যাচ্ছে। মারাংবরুর আদেশ মানলম। আমি ডান হলম। গেরামের লোকদের খেত্যে শুরু কর‍্যেছিলম, তুই লিয়ে এলি ক্যান্যে বাবু? মারাংবরু পাপ দিবেক লাই?

আমি হিসহিসে গলায় বলতে চাইলাম, ‘সব মিথ্যে’। পারলাম না। এক ঢোক জলের খুব দরকার এখন। মেয়েটার নিঃশ্বাস আমার দেহে জলের জোগান কমিয়ে দিচ্ছে। এমনিতে জলের বোতল সবসময়েই আমার জিপে থাকে। নড়তে ইচ্ছা করছে না। চারদিকের সময় থমকে গেছে। গাছের পাতা নড়ছে না। শুকনো পাতাপুতির সড়সড় শব্দ চুপচাপ। শুধু মহুয়ার গন্ধটা বেড়ে চলেছে। গন্ধটা মেয়েটার পা বেয়ে উঠছে। কোমর ছাপিয়ে এবার বুক ছুঁয়ে ঠোঁটের কাছাকাছি উঠে এল। পাতলা জ্যোৎস্নায় যেন জ্ঞান হারাবার আগেই বুঝতে পারছি মোটা ঠোঁটদুটো ফাঁক হচ্ছে ক্রমশঃ। ঠোঁট নাকি পায়ের নিচের বুনো জমিটাই? সাবধানে পা রেখে দাঁড়ালাম। হাত চলে যাচ্ছে কোমরের বেল্টের দিকে। পরক্ষনেই জিপারে হাত। খুলে ফেলতে হবে সব অর্গল। শীতের শেষে জেগে ওঠা শঙ্খলাগা সাপের মন্ত্রোচ্চারণ শুনতে পেলাম। গন্ধটা আরো বেড়েছে। আলতো করে মেয়েটার গালদুটো ছুঁলাম। তারপর সেই কতদিনের জমা গাছের পাতার বিছানায় আমি শুলাম, মেয়েটাকে নিয়েই।

যেন পরিতৃপ্ততার শিখরে উঠে আমার ঘুম ভাঙল। চোখ খুলে প্রথম দেখলাম শবুরের মুখটা। আমাকে দেখছে। খেয়াল করে দেখলাম ঠিক আমাকে নয়, আমার মাথার উপর আড়াআড়ি ভাবে রাখা আমার ডানহাতটাকে। কী যেন খুব মনোযোগ সহকারে নিরীক্ষণ করছে। আমি নিজেও হাতটাকে চোখের সামনে এসে দেখলাম। হাত ঠিক আছে। তবে আঙুলগুলোর মাথার দিকে কী যেন হয়েছে। সামান্য আঠালো রসের মত বেরোচ্ছে। শবুর চমকে সরে গেল। তারপর চিৎকার করে থানা মাথায় তুলে বলল, কুঠ্যা! স্যার আপনার কুঠ্যা হইছেক বটে।

মাথায় রক্ত চড়ে গেল। সেই হাতেই ঠাটিয়ে এক চড় কষালাম শবুরের গালে।

যত্তসব কুসংস্কারচ্ছন্ন মন!

অজিতেশ নাগ। কবি ও ঔপন্যাসিক। জন্ম ভারতের উত্তরবঙ্গের জলপাইগুড়িতে। সাহিত্যের অন্দরমহলে ঘোরাঘুরি আজ প্রায় তিন দশক। সিগনেট, প্রতিভাসসহ মোট দশটি প্রকাশনী থেকে কবিতার বই আর তিনটি প্রকাশিত উপন্যাস। নিয়মিত লেখা দেশ, কৃত্তিবাস, রেওয়া, কবিতাআশ্রম, ভাষানগর ইত্যাদি বহু পত্রপত্রিকায়। সোপান সাহিত্য সম্মানসহ...

এই বিভাগের অন্যান্য লেখাসমূহ

বালির বেহালা

বালির বেহালা

বুড়িমাসি বলেন,জীবনটা বালির ঘর গো।ঢেউ এলে ধুয়ে যায় জীবনের মায়া।তবু বড় ভালবাসা ওদের দাম্পত্যে।রোদের চাদরের…..

তদন্ত

তদন্ত

  এক ড্রইং রুমে বসে রয়েছে সদ্য কিশোর উত্তীর্ণ তরুণ গোয়েন্দা সজীব। সামনের টেবিলে ছড়িয়ে…..