ডাক্তার তিন ঘণ্টা পর আসতে বলেছিল

শীর্ষেন্দু দত্ত
গল্প
ডাক্তার তিন ঘণ্টা পর আসতে বলেছিল

আমার আজ যা ইচ্ছে করতে ইচ্ছা করছে। যা খুশী,যা মন চায়। কেন? সে অনেক লম্বা গল্প। ছত্রিশ বছরের জীবনে পৌঁছে হটাত আবিষ্কার করলাম জ্ঞান হওয়া ইস্তক আমি আমার ইচ্ছে মতন কিছু করিনি। সবই অন্যের ইচ্ছেয়। কখনো বাবা-মা,কখনো স্কুল-কলেজের স্যর,কখনো অফিসের বস আর ইদানিং বৌয়ের। এটা কি একটা জীবন! কতো কিছু করার ইচ্ছে মনের ভিতর গুমড়ে গেল সারা জীবন। তাই…

প্রথমেই পার্কে ঢুকে একটা থেলাগাড়ির আইসক্রিমওলাকে ডাক দিলাম,

-একঠো অরেঞ্জ দো।

ছোটোবেলায় কি লোভ লাগত এটা দেখলে। কিন্তু আমার যে টনসিলের ধাত। বাবা-মাকে বললেই হাঁ হাঁ করে উঠত। বরজোর কাপের আইসক্রিম, তাও মা চামচ দিয়ে জমাট ভাবটা কাটিয়ে দিত।

আহহ! কি দারুন! বরফের আইসক্রিমটা ঠোঁটে চেপে শোঁ শোঁ টান দিলাম। কি মিস্টি! ঠিক যেন কমলালেবু! আইসক্রিমের রঙ্গিন গলা পরে আমার জামায় লাল দাগ হয়ে গেল।

আমি আইসক্রিম খেতে খেতে এগিয়ে চললাম। পার্কের ঠিক মাঝখানটায় ফুটবল খেলছে কতগুলো ছেলে। ফুটবল আমার খুব প্রিয় খেলা। কিন্তু ক্লাশ ফাইভে চোখে মাইনাস পাওয়ারের চশমা লাগার পর বডি কন্ট্যাক্ট গেম খেলা বন্ধ হয়ে গেল আমার। তবে বন্ধ হবার ফতোয়া বাড়ির লোক আর স্কুল দিলেও,খেলার মাঠের সাথীরাও অসহযোগিতা করেছিল। আমি খুব ভাল স্টাইকার ছিলাম। পায়ে বল পরলে কেউ আটকাতে পারত না। কিন্তু যবে থেকে রুমাল দিয়ে চশমা বেঁধে খেলতে শুরু করলাম তবে থেকে আমার পায়ে বল পরলেই অপোনেন্ট আমার চশমা টার্গেট করতে লাগল।

ব্যাগ রেখে,প্যান্ট গুটিয়ে নেমে পড়লাম মাঠে। আমি ওদের থেকে লম্বা,তাই ছেলেগুলো ফাউল করেও সুবিধে করতে পারছিলনা। দু’তিনটেকে কাটিয়ে নেট কাঁপানো শট নিলাম। আঃ! কি আনন্দ! …

হটাত দৌড়ে একটা রানিং ট্রামে উঠে পড়লাম। ফুটবোর্ডে দাঁড়িয়ে গুনগুন করে গান ধরলাম। ফুটপাথ দিয়ে কতগুলো হেব্বি মেয়ে যাচ্ছে,কলেজের মনে হয়। হটাত কন্ডাক্টর এসে রসভঙ্গ করল,

-ফুটবোর্ডে দাঁড়ানো নিষেধ,জানেন না? উঠে আসুন।

আমি কন্ডাক্টরকে পাত্তা না দিয়ে ট্রামের ঘন্টার দড়িটা ধরে জোরে টান মারলাম। টং টং শব্দে ট্রামটা থমকে গেল। আমি তড়াং করে ট্রাম থেকে নেমে পড়লাম। আমি মনে করতে চাইলাম না আমার বয়েস ছত্রিশ বছর,ছিয়াত্তর কিলো ওজন ভুড়ি সমেত। কন্ডাক্টরটা আমায় হাঁ করে দেখতে দেখতে বলল,

-পাগল নাকি!

আমি ‘জংলি’ সিনেমার সেই গানটা শাম্মী কাপুরের স্টাইলে গেয়ে উঠলাম, ইয়াহুউউ,চাহে কোই মুঝে জংলি কাহে…

কন্ডাক্টর থতমত খেয়ে টিংটিং করে ট্রাম ছেড়ে দিল।

মেট্রোয় উঠেই জায়গা পেয়ে গেলাম। পরের স্টেশন গিরিশ পার্ক থেকে পিলপিল করে লোক উঠতে লাগল। একটা মেয়ে উঠেই আমার সামনে দাঁড়ালো। উফফ! ফাটাফাটি দেখতে। ওর নাভিটা আমার মুখের কাছে। নীল সিফন শরীর থেকে স্লিপ খাচ্ছে শুধু। উঠে দাঁড়িয়ে বললুম,

-আপনি বসুন।

মেয়েটা এমন আদিখ্যেতার জন্য তৈরি ছিলনা। সে চোখেমুখে বিস্ময় ফুটিয়ে বলে উঠল,

-ওমমা! কেন! নানা,ছি ছি! আপনি বসুন।

আহা! কতোদিনের শখ এমন একটা অচেনা ঝিনকু মিঙ্কুর সাথে কথা বলব। আমি বললাম,

-আরে না। আপনি বসুন।আমি সারাদিন বসেই থাকি। কোমর ধরে আছে।

মেয়েটা সারা শরীরে ভাইব্রেট করে বলে উঠল,

-থ্যাঙ্কু।

যেন অ্যাপেল ফোনের রিংটোন! আহা!

কিছুক্ষণ পর মেয়েটা বলল,

-আপনার ব্যাগটা দিন। ধরছি।

আমি ন্যাকা চৈতন্য,

-না না,ঠিক আছে।

মেয়েটা চৈতন্যের মাসি,

-দিন নাআআ।

বলে একরকম আমার হাত থেকে কেড়ে নিল ব্যাগটা। আজ আমি বিন্দাস। যা ইচ্ছে করব।

আমার সরোবরে নামার থাকলেও আমি মেয়েটার সাথে পার্ক স্ট্রিটে নেমে পড়লাম। ওর পিছু পিছু স্টেশন থেকে বেরিয়ে এলাম। মেয়েটা কিছুটা অবাক হয়ে তাকিয়ে হাসল। বলল,

-ওকে,বাই।

আমি বললাম,

-আজ খুব গরম। চলুন একটা করে ঠান্ডা হয়ে যাক।

মেয়েটার নাম বল্লরী। ওর মোবাইল নম্বরটা নিয়ে টা টা করে আলাদা হয়ে গেলাম আবার।

আমার হাতে একঘন্টা সময় আরো আছে। ডাক্তার তিন ঘন্টা পর আসতে বলেছিল।

হোটেলটার সামনে লম্বা লাইন দেখে সেখানে দাঁড়িয়ে গেলাম। ‘হিরো নাম্বার ওয়ান’- এ এন্ট্রি পাবার জন্য অডিশন চলছে। এন্ট্রি ফর্ম ভরে আমিও লাইনে দাঁড়িয়ে পড়লাম। সব কুড়ি-বাইশ বছরের ছেলে মেয়ে। ওদের কেউ কেউ আমায় একটু অবাক হয়ে দেখল। না,শুধু বয়সের জন্য নয়। আমি পরে টিপিক্যাল প্যান্ট শার্ট আর কালো বুট। হাতে অ্যাটাচি। ওদের সব কেয়ারলেশ। ছেঁড়া জিন্স,টি শার্ট,টুপি,পিঠে ব্যাগ,কানে হেডফোন। মেয়েগুলো হয় বেটে খয়রা নয় হস্তিনী। ঠোঁটে সিগারেট।

নাহ,লম্বা লাইন দেখছি। আমি লাইন রেখে ‘একটু পরে আসছি’ বলে বেরিয়ে গেলাম।

সময় ফুরিয়ে আসছে। সায়নী বলেছিল ফুল মালাটা যেন আমি কিনে আনি।

সামনে পার্ক স্ট্রিট ক্রসিং-এ একটা বাচ্চা ছেলে ফুল বিক্রি করছে। নানা রঙের গোলাপ আর কতগুলো অজানা রঙ্গিন ফুল। ওর থেকে অনেকগুলো ফুল কিনে ফেললাম। বাচ্চাটার মুখে একটা তৃপ্ত ভাব। আমি ওকে দাম ছাড়া আরো দশ টাকা দিয়ে বললাম,

-চকোলেট খাস বাবা।

ছেলেটা মনে হয় অয়নেরই বয়েসি। অয়ন আমার একমাত্র সন্তান। ক্লাশ টু তে পড়ে। এখন আমার যা ইচ্ছে পর্ব চলছে। অতএব কাল ভোরে অয়নকে স্কুলে যাবার জন্য তুলবোনা। নো স্কুল,এনজয়। যত পারো ঘুমাও। সায়নীর কোনো হুইপ মানা নেই।

আমি বারোতলার ফ্ল্যাটটায় ঢুকে পড়লাম। আমার হাতে অনেক ফুল। সব কটা লেটারবক্সের ফুটোয় একটা করে ফুল গুঁজে দিলাম। লিফটে উঠে একদম টপে গিয়ে নামলাম। ছাদের দরজাটা খোলা। আমি জানি,এটা খোলাই থাকে। ছাদে হু হু হাওয়া বইছে। কত উঁচু! ময়দানের সবুজ দেখা যাচ্ছে। ফ্লাইওভার,বাস,ট্যাক্সি সব কেমন ছোট ছোট! বেটে বক্কেশ্বর।

আমার হাতে আর মাত্র পাঁচ মিনিট সময় আছে। ডাক্তারবাবু আমায় তিন ঘন্টা পর বলেছিল। প্রায় শেষ করে এনেছি সেই তিন ঘন্টা। আমি বলেছিলাম তিন ঘন্টা পরই আসব অয়নের বডি নিতে। সায়নী বলেছিল ফুলমালা,ধুপ সব নিয়ে ঢুকো।

এতক্ষণে নার্সিংহোমের সামনে সবাই নিশ্চয় এসে গেছে। আমার জন্য অপেক্ষা করছে। ঘন ঘন ঘড়ি দেখছে। আমার মোবাইল ফোনটা বেজে চলেছে সমানে। এতো তাড়া কেন সবার? থাকনা অয়ন আরো খানিকটা।

আজ আমি আমার যা মন চায় তাই করব। অয়নের ডেঙ্গু হলেও বলব ডেঙ্গু নয়। অজানা রোগ। আর প্লেটলেট কাউন্ট করবনা।

অয়ন খুব ভাল আঁকত। গতবার ফার্ষ্ট হবার পর বলেছিল,

-বাপি,অরেংজ আইসক্রিম খাব।

সায়নী খেতে দেয়নি। ওর টনসিলের প্রবলেম। অয়ন খুব উড়তে ভালবাসত। এরোপ্লেন,পাখি…

আমি ছাদের পাঁচিলে উঠে দাঁড়ালাম।

একমিনিট আরো বাকি। অয়ন এরোপ্লেনে ওঠার সুযোগ আর পেলনা। পাখি হওয়াও ওর হলনা। আমি কিন্তু সব শখ মেটাবো।

কুড়ি সেকেন্ড বাকি আরো,তিন ঘন্টা শেষ হতে। এর মধ্যেই আমি উড়তে উড়তে নিচে ল্যান্ড করব। আমার ইচ্ছে আজ আকাশের পাখি হবার…

শীর্ষেন্দু দত্ত। লেখক ও ঔপন্যাসিক। জন্ম ১৯৬৯ সালের ১২ সেপ্টেম্বর ভারতের ইস্পাত নগরী জামসেদপুরে। পেশায় মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার বাবাকে চার বছর বয়সে হারান পথ দুর্ঘটনায়। মায়ের সাথে কলকাতায় চলে আসেন। মেজমামা অরুন আইন একজন পরিচিত লেখক ছিলেন। তার কাজে প্রাণিত হয়ে লেখা...

এই বিভাগের অন্যান্য লেখাসমূহ

বালির বেহালা

বালির বেহালা

বুড়িমাসি বলেন,জীবনটা বালির ঘর গো।ঢেউ এলে ধুয়ে যায় জীবনের মায়া।তবু বড় ভালবাসা ওদের দাম্পত্যে।রোদের চাদরের…..

তদন্ত

তদন্ত

  এক ড্রইং রুমে বসে রয়েছে সদ্য কিশোর উত্তীর্ণ তরুণ গোয়েন্দা সজীব। সামনের টেবিলে ছড়িয়ে…..