প্রক্সি
তারপর ইলেকট্রিক বিল জমা দিতে যাবো। আমার দেরি হবে আসতে। স্বামী অমর বলে, ঠিক আছে।…..
সকাল থেকেই চলছিল তোড়জোড়, গৃহ প্রবেশের পুজো আজ। কত দিন ধরে এই দিনটার জন্য অপেক্ষায় ছিল পর্ণা আর অনিরুদ্ধ।বিয়ের পর এই তিন চারটে বছর দুজনে হিসেব করে করে পা ফেলেছে,যতটা পারে টাকা বাঁচিয়ে, জমিয়েছে। কোনো বাড়তি খরচ করেনি, করতেও দেয়ও নি। এক মাত্র খুব জরুরী ছাড়া কোনো আমোদ প্রমোদ করে নি। এমনকি অনেক কথা সত্ত্বেও ফ্যেমেলি প্ল্যানও করেনি।দাঁতে দাঁত চেপে শুধু হিসেব করে গেছে আর স্বপ্ন বুনেছে। একটা ছাদ চাই মাথার ওপর। কিন্তু কলকাতা শহরে যে মনের মত ফ্ল্যাট পাওয়া এত কঠিন বোঝেনি ওরা। যত গুলো অনলাইন সাইট আছে , এলাকার যত দালাল আছে সবাইকে নিয়ে চেষ্টা করে গেছে। কিন্তু সব বৃথা, কিছুতেই যেন ঠিক মনের মত হচ্ছিল না। যত দিন যাচ্ছিল ততই নিরাশার জালে জড়িয়ে যাচ্ছিল দুটি তরুণ তরুণী।
সেদিন শহরের ওপর প্রান্তে একটা বাড়িতে ছিল একটা ক্লায়েন্ট মিট, বসের বিশেষ পরিচিত। অনিরুদ্ধ ঠিক ঘড়ি ধরে সকাল দশটায় পৌঁছাতেই শুনল তিনি নাকি সেই মাত্র ঘুম থেকে উঠেছেন ,কি বিরক্তিকর ব্যাপার, অথচ ভিজিট করতেই হবে, বসের হুকুম। সুতরাং বিরক্তি চেপে কর্পোরেট কায়দায় মুখে মেকি হাসি টেনে বলল —-” নো প্রবলেম স্যার,একটু অন্য মিট সেরে আসছি।প্লিজ টেক ইয়োর টাইম।কল মি অ্যট ইয়োর কনভিনিয়েন্স। কাজ শেষ হলে আমি আপনাকে কল করে নেব্। ইউ প্লিজ ক্যারি অন।” এই বলে অনিরুদ্ধ বেরিয়ে এলো।
অনিরুদ্ধ বাইক নিয়ে উদ্দেশ্যহীন ভাবে এদিক ওদিক ঘুরতে লাগলো । এই এলাকায় বিশেষ আসা হয়নি ওর। নতুন গজিয়ে উঠেছে আবাসনগুলো, কলকাতা শহর অনুভূমিক রেখা ধরে বেড়ে চলেছে নিরন্তর, তবে এখানে এখনও অনেক সবুজের সমারোহ দেখা যাচ্ছে। হটাৎ একটা নবনির্মিত বাড়ির দিকে চোখ গেল, এটায় বুকিং নিচ্ছে!! হাতে যেন চাঁদ পেল অনিরুদ্ধ। গত কিছু দিন ধরে নির্মান শিল্পে ভাঁটা চলছে সেটা জানত অনিরুদ্ধ। গেটের দারোয়ানের কাছে শুনলো, বাড়ির বেশির ভাগ ফ্ল্যাট বুকেড, এবং সেগুলো অনাবাসী ভারতী়য়রাই কিনেছে। রেডি ফ্ল্যাট নাকি এখন একটাই পরে আছে। প্রোমোটরের নম্বরটা নোট করে চট পট কটা বিভিন্ন দিক থেকে ছবি তুলে নিলো বাড়িটার। ফোন করার আগে একবার একটু পর্নের সঙ্গে আলোচনা করা দরকার। ছবি গুলো দেখে,বাড়ির পজিসন পছন্দ হলে তবেই এগুনো। তবে শুনলো যে এক জগু বাবুর মাধ্যমেই কথা বলতে হবে, তাই ওনার নম্বর টাও নোট করে নিল।
প্রোমোটার দুলাল বাবুর এর সঙ্গে দেখা করে আর ফ্ল্যাট দেখে দুজনেরই পছন্দ হয়ে গেলো। টু বি,এচ,কে, তার ওপর নিজেদের বাজেট এর মধ্যে, তবুও কিছুটা দর কষাকষি করে খুব সহজেই ডিল ফাইনাল হয়ে গেল ফ্ল্যাটের । ব্যাস, আইনগত ভাবে সব ফর্মালিটি মিটে যেতেই শুরু হলো তোড়জোর।তিন চার বছর ধরে করা পরিকল্পনা রূপ দিতে পর্না দশ দিনের ছুটি নিয়ে নিল। সরা কলকাতা ঘুরে ঘুরে পছন্দের সব কিছু দিয়ে সাজিয়ে তুললো নিজেদের ফ্ল্যাট। পছন্দের পর্দা, চাদর, আর্টিফাক্টস, আপহোলস্ত্রি, কার্পেট, বাহারি মোমবাতি, আর একটা ঠাকুরের আসন।মুভার্স এন্ড প্যাকার্ দিয়ে বড় বড় জিনিস সব ঠিক ঠাক জায়গায় রাখানো। আনপ্যাক করে গুছিয়ে তোলা সব পর্ণা একা হাতে সামলালো। শুধু ওদের আদরের পোষ্য কুট্টুস কে নিয়েই একটু ঝামেলায় পড়ল। প্রথম প্রথম ফ্ল্যাটের কাজ দেখতে যাবার সময় ওরা কুট্টুস কে নিয়ে যেত, কিন্তু ওখানে গেলে কি যে হয়, সারাক্ষন কেমন রেগে থেকে, গর্ গর্ করতেই থাকে। তাতে মিস্তিরিরাও ভয় পায়। যদিও তেমন কিছু করতে হবে না। রং আার মেঝে ঘষাটা প্রোমোটর বাবুই আগ বাড়িয়ে করিয়ে দিয়েছেন। সামান্য কিছু ইলেকট্রিকের কাজ আর দুচারটে তাক, ওরা করে নিচ্ছে নিজেদের সুবিধা মত।
ফ্ল্যাটের সব ভালো, খুব হওয়া বাতাস, আলো ঝলমলে। শুধু কেমন একটা আঁশটে গন্ধ লেগে থাকে। হয়ত পাশের ফাঁকা জমির জন্য। বাঙালিরা একটা জায়গা ফাঁকা পেলেই নিজেদের যাবতীয় নোংরা সেখানে ফেলবেই, যাচ্ছেতাই স্বভাব ।তবে এখন জানালা গুলো সব খোলা বলেই হয়তো বেশি লাগছে, দরজা জানালা বন্ধ করে রাখলে নিশ্চয় সেটা থাকবে না। এখন শুধু পুজোটা করে ঢুকে পড়লেই হল। নিমন্ত্রিত বলতে দুই বাড়ির বাবা মা আর ভাই বোন। সাকুল্যে দশ জন মত হবে।
তবুও ওরা বেশ কটা এয়ার ফ্রেশনার কিনে রেখেছে।পুজো করে ঢুকে পড়ে তার পর আস্তে আস্তে দফায় দফায় বন্ধু বান্ধবদের ডেকে খাইয়ে দেবে। আসলে সব কিনে কেটে সাজিয়ে গুছিয়ে উঠতেই হাতটা কিছুটা ফাঁকা। অথচ দুই বাড়ির মত হলো পুজো না করে বাড়িতে ঢোকা চলবে না।অগত্যা ঠাকুর মশাই খুঁজে ওনাকেই বলা হলো সব কিছু গুছিয়ে নিয়ে আসতে। আজ সেই দিন।
দুই
সময় বয়ে যাচ্ছে অথচ ঠাকুর মশাই এর টিকিটিও দেখা যাচ্ছেনা। একে একে সবাই এসে গেছে এমনকি, খাবার অবধি পৌঁছে দিল ক্যাটারার। বার বার করে ঠাকুর মশাই কে ফোন করেও নো রিপ্লাই আসছে।মনটা কু গাইছে অনিরুদ্ধের।
অনেকবার ফোন করার পর অবশেষে ঠাকুর মশাই ফোন ধরে বললেন তিনি দশ মিনিটের মধ্যে পৌঁছে যাবেন । এলেন ও সেই মত।অটো থেকে পোঁটলা পুঁটলি নামালেন ঠাকুর মশাই, কিন্তু লিফ্ট থেকে নামবার মুহূর্তে হলো বিপত্তি। হয়তো তাড়াহুড়ো করছিলেন বলেই জিনিস পত্র সহ খেলেন একটা বিশাল আছাড়।সে এক লন্ড ভন্ড কান্ড। চতুর্দিকে পুজো-আচ্চার জিনিস পত্র ছড়িয়ে তার মধ্যে কোমর ধরে কোঁকাচ্ছেন ঠাকুর মশাই।ভাগ্যিস সব জিনিস গুলো ভালো করে বাঁধা ছিল নাহলে পুজোটাই পন্ড হয়ে যেত। যন্ত্রণায় কাতরাতে কাতরাতে তিনি কোনো রকমে পুজো করতে বসলেন।পুজো শেষ করেই তিনি ছুটলেন হসপিটালের দিকে।মনটা দুজনেরই একটু কিন্তু কিন্তু করছিল,প্রথমেই এত বাধা বিপত্তি, কি জানি কি হয় ।কিন্তু সবার কোথায় সব কিন্তু ভাব ফুসমন্তর হয়ে উড়ে গেলো। ফ্ল্যাট দেখে সকলে উছ্বসিত।
সবাই এক কথায় পর্ণার রুচিবোধের তারিফ করছিল, সত্যি মেয়েটার চয়েস আছে বলতে হয়। পর্ণা নিজেই নিজের পিঠ চাপড়ে নিল। শুধু একটা ব্যাপার যে কি করে ওর নজর এড়িয়ে গেল সেটা নিজেই বুঝছে না।
সকালে ঘরে আল্পনা দিতে গিয়ে হঠাৎ চোখে পড়ল যে ভিতরের ঘরে এক কোণে, মার্বেলের ওপর একটা বিচ্ছিরি দাগ, পর্ণা একশো ভাগ নিশ্চিত আগে দাগটা ছিল না।থাকলে ঠিক নজরে পড়ত।অনিরুদ্ধ অবশ্য পর্ণার কথায় পাত্তা দিল না। ইয়ার্কি মেরে বলল,” এটার মত আমার কাজ বা অকাজ কিছু ওভারলুক করো ম্যাডাম।”
যত রকম মেঝে পরিষ্কার করার জিনিস পত্র ছিল সব নিয়ে বসে পরলো মেঝে ঘোষতে। “অনির সবেতে ইয়ার্কি, ” মনে মনে বলল পর্ণা। তারপর আবার মেঝে ঘষার কাজে মন দিল। নাহ্ পুরোটাই পণ্ডশ্রম, দাগ একটুও হালকা হলো না, উল্টে তার ঘনত্ব যেন বেড়ে গেল। হতাশ হল পর্ণা,–” দূর বাবা, ভালো লাগে না। ” এই ভাবে বোকা বানিয়েছে ভবে নিজের ওপর প্রচন্ড রাগ হচ্ছিল। তার ওপর এই বিদঘুটে গন্ধ। এদিকে অনিরুদ্ধ বার বার তাড়া দিচ্ছিল । বাধ্য হয়ে দাগ ঘষাঘষি মুলতুবি রেখে উঠে পড়েছিল পর্ণা। মনে মনে বলল—” আগে সব মিটুক। তারপর দুলাল বাবুর একদিন কি আমার একদিন।”
তিন
অবশেষে ঠাকুর ঠাকুর করে পুজো, মিষ্টিমুখ, খাওয়া দাওয়া নির্বিঘ্নে মিটল। দুজনেরই মনটা সবার তারিফ শুনে ফুরফুরে।
সব মিটে যেতে দুজনেই গা এলিয়ে দিল বসার ঘরের ডিভানে,মন থেকে যেন একটা বড় বোঝা নামলো । কিন্তু কুট্টুসটা এখনো কেমন গর গর করেই চলেছে। কি যে হল।ও-বাড়িটায় কিন্তু মুখে রা কাটতো না।সারাক্ষণ লেজ নেড়ে মুখ পা চেটে খেলা করত।
পর্ণা বললো, “এই অনি, শোনো না একটু দেখো না কুট্টুস বোধহয় বাইরে যেতে চাইছে। একটু দেখো না বাবু।”
অনিরুদ্ধ বিরক্ত হয়ে বলল, “এখন যতই বাবু বলো আর সোনাই বলো ম্যাডাম , এখন আমি পারবনা।সারাদিন এত ধকলের পর আর পারছি না , সিরিয়াসলি । এই জন্য বার বার বলেছিলাম একটা পাখি বা মাছ পোষো, কোন চাপ হত না। তা না কুকুর চাই। এখন যত ঝামেলা আমার ঘাড়ে। তাকে হাগু করাও মুতু করাও, হাঁটতে নিয়ে যাও। ধ্যাত আমি যাবো না, ব্যাস। “
পর্ণা আদুরে গলায় বলল,” এই অনি, এইইইই, অ-অ-অ–নি,একটু যাও না লক্ষ্মীটি, আমার পায়ে সত্যি বড় ব্যথা করছে এত অভ্যাস নেই তো, যাও না সোনা, প্লিজ। “
“দুত্তর নিকুচি করেছে ” বলে অনিরুদ্ধ উঠে পড়ল।
কুট্টুস সেই এক ভাবে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে গোঁ গোঁ করে চলেছে, অনি ডাকলো,” আয়ে কুট্টুস, ঘুরে আসি”।অন্য দিন হলে ডাক শুনলেই সে লক্ষ্মী ছেলের মত লেজ নাড়িয়ে বেরিয়ে পড়ত। কিন্তু আজ শুধু মাথা ঘুড়িয়ে দেখল।বেল্টটা আনতে ভিতরের ঘরে ঢুকতেই কুট্টুস অনিরুদ্ধ কে ধরে টানাটানি শুরু করল। কিছুতেই যেতে দেবে না। অনিরুদ্ধ ভাবল ঠিকই তো, কার ভাল লাগে বন্দী হয়ে থাকতে।তাই সে কোলেই তুলে নিল কুট্টুস কে।নিচে নেমে কুট্টুস যেন প্রাণ ফিরে পেল। অনিরুদ্ধ ভাবল, — “একবার ডাক্তার দেখিয়ে নিতে হবে।বেচারার শরীরে কিছু অসুবিধা হচ্ছে নিশ্চয়। নাহলে কুট্টুস তো এমন করত না। আহারে অবলা জীব, কষ্টটা তো বলতে পারে না। “
কুট্টুস যতক্ষণ কমপ্লেক্সের লনে ছুটে বেড়ালো ততক্ষণে অনিরুদ্ধ নিজের মোবাইলে মেলগুলো চেক করে নিল। তারপরে নির্মল হাওয়ায় খোশমেজাজে সিগারেটে সুখটান দিল।আহা এই তো জীবন কালি দা!!!
চার
বাড়ি ফিরে অনিরুদ্ধ দেখলো যে পর্ণা গা ধুয়ে ফ্রেস হয়ে ততক্ষনে সকালের খাবার যা বেঁচে ছিল তা বের করে গরম করে নিয়েছে। জমে থাকা মিষ্টি সব গুছিয়ে তুলে ফেলেছে। অগোছালো ঘরটা আনেকটাই গুছিয়ে ফেলেছে।এলেম আছে বটে মেয়েটার।
–“জানো বাইরে পরিবেশটা বেশ ভালো, সকালে ওয়াকে যাওয়া যাবে।যাবে তো?”
— “সে তো যাবে কিন্তু এই বিকট গন্ধটা সহ্য হচ্ছে না,প্লিজ কিছু একটা ব্যবস্থা কর, “এই বলে পর্ণা ঘরে বেশি করে সুগন্ধী স্প্রে করে দিল।
—“দেখছি দাঁড়াও, নিশ্চই ওই নিচের মাঠে কিছু পচেছে, ইঁদুর বিড়াল হতে পারে। কাল মিউনিসিপ্যাল অফিসে একটা কমপ্লেন করে দেব।”
—“কুট্টুসের যে ওই ঘরটার ওপর কিসের এত রাগ বুঝি না, সারাক্ষণ ঘরের বাইরে দাঁড়িয়ে বকে চলেছে… ঘুরে ফিরে দেখবে আর বকবে “
—” ওওওও কুট্টস, বাবু তোর কি বর আছে নাকি ঐ ঘরে?তাহলে বকাবকির কারণ লাগবে না, ” এই বলে একটা দুষ্ট দুষ্ট হাসি হাসল অনিরুদ্ধ।
—-“এই অনি, মানেটা কি শুনি? খুব খারাপ হয়ে যাবে কিন্তু…।আমি যেন সব সময় তোমাকে বকাবকি করি? ভালবাসি না, আদর করি না, শুধু বুঝি গজ্ গজ্ করি?”
—“আহা আমি কিছু বলেছি তোমাকে??কুট্টুস কে বললাম। সে কিছু বলে নি কিন্তু, তোমার গায়ে লাগল কেন, সোনা?”
—“অ-অ-অনি,মার খাবে কিন্তু…”
দুজনের এমন মিষ্টি খুনসুটি চলতেই থাকে।
পর্ণা সত্যি চিন্তিত হলো, কুট্টুস এমনিতে ভীষণ জলি, খুব মিশুকে। সে কেন এমন করছে? এত মিষ্টি কুকুরটার এই বাড়িতে এসে হটাৎ কি হল?
পাঁচ
কেটে যেতে লাগল দিন। কিন্তু এত করেও দুর্গন্ধের কোন সুরাহা হলো না। একটা জিনিস নিয়ে অনিরুদ্ধ একটু চিন্তিত, কিছুটা উৎকন্ঠায়ও ভুগছে , অথচ কথাটা পর্ণা কে বলতে পারছে না। মেয়েটা এমনিতেই পুরো ঘেঁটে আছে কুট্টুস কে নিয়ে।অনিরুদ্ধ লক্ষ্য করে দেখেছে, গন্ধটা কেবল তাদের ঘরেই আছে, আসে পাশে কোথাও এমন বিকট উগ্র গন্ধ নেই।এমনকি ওদের করিডোরেও না এবং এখানেই খটকা লাগছে। তাহলে কি কনসিল্ড ওয়ারিং এর মধ্যে কিছু পচলো? তেমন হলে এই মুহূর্তে খুব চাপে পড়বে অনিরুদ্ধ, কারণ তাহলে অনেক টাকার ব্যাপার, অথচ হাত খালি।
অফিস থেকে ফিরে শুনল পর্ণা যেন কার সঙ্গে খুব রেগে কথা বলছে।
–“আপনি বললেই হবে? কখনোই এটা আমার কুট্টুস করতে পারে না”
ওপারে কে কি বলল শোনা গেল না।এপারে পর্ণা ডজনখানেক ” হুম, “,”না না”, “হতেই পারেনা”,”আশ্চর্য ” বলে শেষে “নিজেই দেখে যান, তারপর বলুন।” বলে ফোন কেটে দিল রাগত ভাবে।
অনিরুদ্ধ জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। পর্ণ খুব উত্তেজিত ভাবে বললো, “দেখবে এসো”। এই বলে হাত ধরে প্রায় হিড় হিড় করে টানতে টানতে নিয়ে গেলো অন্য ঘরটায়।
—“দেখো দেখো, আজ ঘর মুছতে গিয়ে সোফাটা সরাতেই দেখছি এটা, ওই লোকগুলো এখানেই সোফাটা পেতে রেখে গিয়েছিলো, আজ ভাবলাম একটু জায়গাটা পাল্টাই। সোফাটায় তো চাকা লাগানো তাই এটা সরাতে গিয়ে দেখি এই কান্ড। প্রোমোটার দুলালবাবুকে যত বলছি এটা পাথরের দাগ নয় , আপনি ঠিকমত পরিষ্কার করান নি, সে কিছুতেই শুনবেনা। ওই কোণেই একটা দাগ সেটা গৃহ প্রবেশের সকালেই দেখেছি। এটা আবার নতুন।উনিতো মানছেন না তারপর আবার বলছেন নিশ্চই কুট্টুস অপকর্ম করে রেখেছে সেটা শুকিয়ে দাগ হয়েছে। না, তুমিই বলো এটা কি তাই? এটা কুট্টুসের কাজ হতে পারে?? ওকে তো পটি ট্রেনিং করানো আছে, আমরা তিন বার ওকে বাইরে নিয়ে যাই। আশ্চর্য কথা বললে মেজাজ গরম হয় কি না”
যেটা দেখলো সেটা দেখে অনিরুদ্ধও ভুরু কুঁচকে ফেললো।সত্যি একটা গাঢ় রঙের দাগ দেওয়ালের গা থেকে নেমে ছড়িয়ে পড়েছে পথরের মেঝেতে। অনেকটা দেওয়ালে চা বা নরম পানীয় ছুড়ে দিলে যে ভাবে গোড়ায় সেই রকম। এটা আর যাই হোক কুট্টুসের অপকর্ম হতেই পারে না।
—“দেখো দেখো, ওরা ফাঁকি মেরে কাজ করেছে কেমন।নিশ্চই ঘষার সময় এটা বাদ দিয়েছে, আমার পাঁচ কাজের চাপে এটা নজরে পড়ে নি ।তোমাকে বলছি আমি,মিলিয়ে নিও। ওই যে আমরা একটু টাকা কমিয়েছিলাম সেটি উসুল করলো এইভাবে।এটা তো পুরো ঠকানো হলো তাই না।আর তাকিয়ে দেখ এই খানে । গৃুহ প্রবেশের আগে শুধু না,এতদিন এটা তো আমারা কেউই নজরই করি নি, না তুমি না আমি। ভাগ্যিস মেজদির চোখে পড়েনি এক্ষুনি দশটা কথা শুনিয়ে দিত।”বলে দেওয়ালের দিকে আঙুল তুলে দেখলো।
সদ্য রঙ করা দেওয়ালে বেশ কিছুটা দূরত্বে কেমন দাগ। খুব স্পষ্টভাবে বোঝা যায় না তবে একটু নজর করলেই দেখা যায়। সত্যি তো দেওয়াল জুড়ে নখের দাগ, যেন কেউ প্রাণ পণে আঁচড়েছে। গাঢ় রঙের দেওয়ালে আঁচড় খুব স্পষ্ট ।আপাত দৃষ্টিতে মনে হতেই পারে যে এটা কুত্তুসের কান্ড।কিন্তু যে গত দশ দিনে ঘরের চৌকাঠ ডিঙায়নি সে এটা করেছে বিশ্বাস করা যাচ্ছে না। তাছাড়া স্বাস্থের কারণে কুট্টুসের নখ বাড়তে দেওয়া হয় না আর সেটা অনিরুদ্ধ নিজেই নিয়মিত ভাবে করে । তাহলে এটা কে করলো?? বাড়িতে তো তৃতীয় কেউ নেই।
ছয়
রাতে খাওয়ার পর পর্ণা যতক্ষণ রান্না ঘরের কাজ সারে অনিরুদ্ধ তখন আধশোয়া হয়ে বই এর পাতা ওল্টােয়। শোয়ার আগে বই’ নিয়ে গড়াগড়ি খাওয়া অনিরুদ্ধের অনেকদিনের নেশা। একটা সময় ছিল যখন সে যে বইটা শুরু করতো তা না শেষ করে ছাড়ত না। কিন্তু এখন আর সেটা হয় না ।কাজের চাপে বড় জোর দু চার পাতা পড়েই চোখের পাতা ভারী হয়ে আসে।নতুন বাড়িতে এসে সেই অভ্যাসটাই আবার ঝালিয়ে নিচ্ছিল সে। । পিঠে বালিশ দিয়ে আধ শোয়া হয়ে নতুন কেনা রিডিং লাইট জ্বালিয়ে বই খুলে বসেছিল অনিরুদ্ধ।
হঠাৎ মনে হলো কে যেন সরে গেল।অনিরুদ্ধ ভাবলো পর্ণা নিশ্চই এসেছিল ঘরে কিছু নিতে। সে এক মনে বই পড়ছিল তাই খেয়াল করে নি। আগে হলে এই না নজর দেওয়া নিয়ে পর্ণা কত অভিমান করে বসতো। ভাবতে ভাবতে অনিরুদ্ধ আবার বই এর পাতায় মন দিল। কিন্তু আবার তার মনোযোগ নষ্ট হল। মনে হল কে যেন তার দিকে তাকিয়ে আছে। মুখ তুলে দেখলো, কই কেউ তো নেই। রান্না ঘরের বাসনের শব্দ, তার মানে পর্ণা এখনো কাজ করছে, আর কুট্টুস পায়ের কাছে শুয়ে। তাহলে এমন মনে হলো কেন? নিজেকে বোঝালো অনিরুদ্ধ, এটা এত দিন একটানা ভীষণ স্ট্রেসের ফল। কিন্তু অস্বস্তি একটা রয়েই গেল,অনিরুদ্ধের খালি মনে হচ্ছিল কে যেন তার দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। শরীর জুড়ে একটা শিরশিরে অস্বস্তি । কিন্তু এই বন্ধ ঘরে কে তাকিয়ে থাকবে? অথচ অনিরুদ্ধ স্পষ্ট বুঝতে পারে কেউ তাকে লক্ষ্য করছে । মানুষের শরীরে যে ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় আছে সে এই দেখাটা বুঝতে পরে একে বলে গেজ ডিটেকশন। বাসে ট্রেনে এটা অনেকেই এটা বোধ করেন , কিন্তু তাই বলে বন্ধ ঘরে? তাও যেখানে শুধু দুজন বাস করে!! কুট্টুস কে ধরলে বড় জোর সোয়া দুজন।
কুট্টুস খাটের এক কোণে গুটি শুটি মেরে ঝিমচ্ছিল , হটাৎ ঘাড় ঘুরিয়ে গোঁ গোঁ করে উঠলো। এই এক হয়েছে কাকে যে সারাক্ষণ বকে? এই কথা মনে হতেই গায়ে কাঁটা দিল অনিরুদ্ধের। তার পর নিজেই নিজেকে এক দাবড়ানি দিল, এই একবিংশ শতাব্দীতে এটা হয় নাকি, কি ভুল ভাল ভাবছে সে!!
এদিকে কুট্টুস ভীষণ রেগে কাকে তেড়ে তেড়ে বেড়াচ্ছে সেই জানে। তাড়া করে সে শোয়ার ঘর থেকে বেরিয়ে ঢুকলো পাশের ঘরে। হঠাৎ ক’এক মুহুর্ত ডাকাডাকি থেমে গেলো কুট্টুসের। চিন্তিত হয়ে উঠল অনিরুদ্ধ, রান্না ঘর থেকে পর্ণাও গলা তুলে জিজ্ঞাসা করল” কি রে বাবু আবার ক্ষপলি কেন? আনি, একটু দেখো না সোনা, কুট্টুস বাবুর কি হল।”
তারপরেই কুট্টুস এক লাফ দিয়ে বেরিয়ে এলো ওই ঘর থেকে মুখে একটা ভীষণ অসহায় ভাব যেন খুব ভয় পেয়েছে।এতটাই যে লেজ আর কান দুটোই ঝুলছে । কুঁই কুঁই করে খাটের নিচে ঢুকে বসল।অনিরুদ্ধ টিটকিরি কাটলো,” –“যেমন মালিক, আরশোলা টিকটিকি দেখলে আঁতকে ওঠেন তার তেমন হয়েছে বীর পোষ্য!! ইনি সারাক্ষণ টিকটিকি টিকটিকি করে বাড়ি মাথায় করছেন তাল মিলিয়ে ওনার পোষ্যটি খালি ঘরে ভয় পাচ্ছেন, ইনি নাকি চোর ধরবেন!!সত্যি চোর দেখলে যে কি করবে , শেষে চোর বেচারা না লজ্জায় পালায়।”
—-“বাজে বকো না তো, দেখো কেমন ভয়ে কুঁকড়ে আছে।ও বেচারা কথা বলতে পারে না বলে ওকে নিয়ে খিল্লি করছ? সো মীন ওফ ইউ অনি।”
স্নেহের কুট্টুসকে কোলে নিয়ে আদর করে নিজের বিছানায় নিয়ে বসল পর্ণা। কুট্টুসও নিরাপদ কোলে আশ্রয় পেয়ে পর্ণার মুখ চেটে নিজের কৃতজ্ঞতা জানাল।
সাত
নিজের মানসিক সুস্থতা নিয়ে দ্বন্ধে পড়েছে অনিরুদ্ধ, একে তো সব সময় কে যেন তাকে বাড়িময় অনুসরণ করছে মনে হচ্ছে।অথচ এই বোধটা বাইরে বেরুনোর সঙ্গে সঙ্গে উধাও। অথচ সে বিজ্ঞানের ছাত্র। অলৌকিক না নামানুষি কোনো কিছু বিশ্বাস করে না।এত দিন সে জোর গলায় বলে এসেছে সে হল চাণক্যের ছাত্র, প্রমাণ ছাড়া কিছুতে তার বিশ্বাস নেই, এমনকি দেবতা বা অপদেবতা, কিছুতেই নেই।
তার ওপর আবার একটা নতুন উপসর্গ দেখা দিয়েছে। অনিরুদ্ধ থেকে থেকে অনুভব করছে একটা কেউ ঘরে চলা ফেরা করে, একটা ছায়া।প্রথম প্রথম মনে হয়েছে হয়তো পর্ণা কিন্তু না, ভালো করে লক্ষ্য করে দেখেছে সে, তা নয়। একটা ছায়া, স্পষ্ট বোঝা যায় না নারী না পুরুষ। কিন্তু ছায়া যে ঘোরা ফেরা করছে সে ব্যাপারে সে একশো ভাগ নিশ্চিত।
নিজেকে বার বার বুঝিয়েছে যে এটা শুধু মনের ভুল। বেশ কবার সে “কে, কে, কে ওখানে” বলে চিৎকার করে উঠেছে। পর্ণা ছুটে এসেছে কাজ ফেলে। অনিরুদ্ধ বোঝাতে ব্যর্থ হয়েছে যে সে কাউকে সরে যেতে দেখেছে।এটা তার মনের ভুল নয় কেউ একটা আছে ওদের সঙ্গে। এবং ঠিক সেই মুহূর্তে দূর্গন্ধটা তিব্রতা পায়। সম্ভবত সে আর কুট্টুস ছাড়া এই অস্তিত্ব কেউ টের পায়না। পর্ণা তো নয়েই। সেটাই আশ্চর্যের, শুধু সে কেন? জ্ঞানত সে কখনো কারুর অনিষ্ট করেছে বলে মনে পরে না । কিন্তু সে অনুভব করে যে কেউ ভীষণ বিদ্বেষ নিয়ে তার পাশে ঘোরাফেরা করে। এই সব চিন্তায় রাতের ঘুম প্রায় উঠেই গেছে তার।
নিজের মন কে বুঝতে সে গোপনে মনোরোগ বিশেষজ্ঞের পরামর্শ মত কটা কাউসলিং এর সেশন অবধি করেছে। কিন্তু কোন উপশম হয় নি। ডাক্তার তার মনের কোন অসুস্থতা বুঝতে পারেনি,কিছু ওষুধপত্র দিয়েছেন ডাক্তার বাবু কিন্তু সব গুলোই ঘুমের।যদিও সে যা দেখছে আর অনুভব করছে সবটাই জেগে থাকা অবস্থায় । তবে ওষুধগুলো খেয়ে সে অন্তত ঘুমাতে পারছে।ডাক্তার অবশ্য বলেছে এটা তার কোনো পাপ বোধ থেকে হচ্ছে। এমনকিছু যা তার অবচেতন মনে ঘা দিচ্ছে,জাগিয়ে তুলছে গভীর অনুশোচনা। অনিরুদ্ধ কিন্তু কিছুতেই নিজেকে এই তথ্য বোঝাতে পারছি না। অনুশোচনা হলে এই ফিলিং টা সারাক্ষণ হওয়ার কথা। তা তো হচ্ছে না, শুধু বাড়িতে থাকলেই হবে কেন?
আট
ইতি মধ্যে বেশ কদিন ধরে অনিরুদ্ধের শরীরটা ঠিক জুতের নেই। গায়ে, হাতে, পাায়ে খুব ব্যাথা। পর্ণা অনিরুদ্ধের শরীর স্বাস্থ নিয়ে খুব বেশি টেনশন করে বলে অনিরুদ্ধ বাড়িতে কিছু বলল না। ব্যাথা টা ক্রমশ বেড়েই চলেছে।
বিশেষত পিঠে আার ঘাড়ে।অথচ গায়ে জ্বর নেই, টেম্পারেচার নর্মাল। বাঙালির চরিত্র অনু্যায়ী সে নিজেই নিজের ডাক্তারি সেরে ফেলছে। বেশ কটা প্যারাসিটামল ইতিমধ্যেই খেয়ে ফেলেছে, তাতে ব্যথা সহ্যর সীমা ছড়ায় নি ঠিকই , কিন্তু ব্যথা কমার নাম নেই। গুগল ঘেঁটে কি কি হতে পারে সব দেখেছে, একমাত্র আর্থারাইটিস ছাড়া তেমন কিছু পেল না।কিছু ঘরোয়া টোটকার হদিস পেয়ে সেই মত গরম জলে স্নান, ভিটামিন ডি,খাওয়া সব চলছে।
সেদিন অফিস যাওয়ার আগে জমা পড়তে গিয়ে লক্ষ্য করলো তার হাতে কালশিটে!! প্রথমটা অবশ্য নজর করলো পর্ণাই । অনিরুদ্ধের দু হাতে চাপ চাপ রক্ত জমে আছে ।দাগ গুলো দেখে পর্ণা আঁতকে উঠলো। দুহাতে এতটা আঘাত? পর্ণা উঠে এসে জামা সরিয়ে আতঙ্কে চিৎকার করে উঠল।
–” বাবু!!! পিঠে এত লেগেছে!! নো ওয়ান্ডার তুমি মুঠো মুঠো অষুধ খাচ্ছ। কি–কি এগুলো কি করে হল? কবে হল? নিশ্চই মোটর সাইকেলে অ্যাকসিডেন্ট করেছিলে, আমাকে লুকিয়ে গেছ।আশ্চর্য মানুষ বটে তুমি। কি ভেবেছিলে,অ্যাক্সিডেন্টের কথা চেপে গেলে কি আর আমি জানতে পারবো না ? আমি একটা হাঁচি কাশিও লুকাইনা, অথচ তুমি এত বড় ঘটনাটা বেমালুম চেপে গেলে??কি করে পারলে সোনা?”
অনিরুদ্ধ সমান অবাক হল।
—“কিছুই তো বুঝতে পারছি না। অ্যাক্সিডেন্ট তো প্রশ্নই ওঠেনা, কোথাও ধাক্কা খেয়েছি বলেও মনে পড়ছে না। অ্যাকসিডেন্ট হলে বলব নাই বা কেন? এত বছর বাইক চালাচ্ছি, ক’বার দুর্ঘটনায় পড়েছি?আমি যে সাবধানে গাড়ি চালাই সেটা তুমি ভালোই জানো।”
দুই চোখে জল নিয়ে পর্ণা কোন রকমে বলল–“” নাহ্ উনি অ্যাক্সিডেন্ট করেন নি, কোথাও ধাক্কাও খান নি,তাহলে এই দাগ গুলো কি ভূতে করল?”
এই প্রশ্নটা শুনে ভিতর ভিতর কেঁপে উঠলো অনিরুদ্ধ। কিছুদিন ধরেই যা অনুভব করছে তা সব খুলে বললো সে পর্ণা কে।
পর্ণা সব শুনে ভীষণ ঘাবড়ে গেল।মেয়েরা ভয় পেলে বিয়ের আগে বাবাকে আর বিয়ের পরে মা কে আঁকরে স্বস্তি পায়। হলো ও তাই , পর্ণা সজা ফোন লাগালো বাপের বাড়িতে
—“মা, একট বিপদে পড়েছি, কি করব বুঝতে পারছিনা কিছুতেই। তোমার সাহায্য লাগবে”
—-কি হয়েছে, রান্না করতে গিয়ে হাত পুড়িয়েছিস নাকি, উফফ তোকে নিয় আর পারি না।”
—“ওহহ মা, প্লিজ একটু চুপ করে আমার কথাটা শুনবে?”
—“বল আমি তো শুনবো বলেই জিজ্ঞেস করছিরে।”
—“মা,ওর সঙ্গে কিছু একটা খুব সাংঘাতিক কিছু হচ্ছে ।”
নয়
সাধারণ মানুষের জীবনে যে কোন ধরনের আতি জগতিক ঘটনা ঘটলেই সে ছুটে যায় দুটো জায়গায়, হয় ঈশ্বরের কাছে মনে কোনো গুরুদেব, তান্ত্রিক ইত্যাদি নাহলে জ্যোতিষীর স্মরণ নেয়।
পর্ণার সব কথা শুনে সবাই বেশ চিন্তিত হয়ে পড়ল সুতরাং সমস্যার সমাধান করতে তাঁরাও হাজির হলেন এক জ্যোতিষীর কাছে।জ্যোতিষশাস্ত্রের প্রতি সাধারণ মানুষের দুর্বলতা রয়েছে। জ্যোতিষীরা ভবিষ্যৎ গণনা করতে পারেন বলে লোকের বধ্যমূল ধারণা। আবার তাঁরা দুর্দিন এড়াতে কী কী ধারণ করতে হবে, সে কথাও বলে দেন।
ফোনে বুকিং করেও সময়ের থেকে দুঘন্টা পরে দর্শন পাওয়া গেলো ওনার। তিনি কুষ্টি বিচার করে, হাতের রেখা দেখে নানা ধরনের হিসেব নিকেশ করে বললেন
—“এটা বিশেষ বিপদের পূর্বাভাস। জীবনের সব কিছুই রাশি গ্রহের ফের। আপনাদের জীবনের পৈশাচিক ছায়া পড়েছে। এক্ষুনি এর প্রতিকার করা প্রয়োজন।”
—“আপনি বলুন কি করলে এর থেকে মুক্তি হবে” পর্ণের মা ভেঙে পড়লেন
জ্যোতিষী মহাশয় আবার গভীর গবেষণায় মনোনিবেশ করলেন , অনেকক্ষন অনেক আঁকি বুঁকি কেটে অবশেষে বললেন,
—-“এক্ষুণি প্রতিকার করতে একটা পিশাচনাশিনী যজ্ঞের ব্যবস্থা সম্পন্ন করতে হবে আর তিনদিন ধরে ক্রমাগত মহা মৃত্যুঞ্জয় মন্ত্রের জপ করতে হবে এক লক্ষ বার করে। আপনারা নিজেরা করলেই ভালো “
—-“সেটা হলে খুব ভালো হয়।কিন্তু মেয়ের তো একার সংসার, কি করে পারবে? জামাইও তো পুরো সুস্থ নয়।”
—-“অসুবিধা থাকলে আপনার হয়ে অন্য কেউ তারা মায়ের মন্দিরে বসে জপ করতে পারে।”
—“এটা হয়?”
—-” অবশ্যই হতে পারে। আমি তাহলে আমার পরিচিত যে পাঁচজন সেবায়েত আছে ওনাদের বলে দেব, যৎকিঞ্চিৎ মূল্যের বিনিময়ে ওনারা জপ করবেন।”
—-“কেমন খরচ লাগবে? “
—“হাজার দশ পরবে আর যজ্ঞের খরচ। সেটা কতটা কি লাগবে আমি কথা বলে জানাচ্ছি।আমি নিজে তো করিনা, আমার পরিচিত এক তান্ত্রিক আছেন আমি জিজ্ঞেস করে দেখতে পারি”
শুনেই পর্ণের চক্ষু চড়কগাছ। বলে কী লোকটা? পর্ণা ইতস্তত করছে দেখে ওর মা বললেন—“দাদা, আপনি নিশ্চিত এতে কাজ হবে?”
—-“আমার বিচার বুদ্ধির ওপর নির্ভর করে বলতে পারি হবে , বাকিটা ঈশ্বরের হাতে”
—-“কবে করতে হবে, “
পরশুই অমাবস্যা, ওই দিন করলেই ভালো
পর্ণা একটু ইতস্তত করছিল, কিন্তু ওর মা বলে দিল, —” আপনি ব্যবস্থা করুন দাদা, আমরা রাজি।”
—–“বেশ তাহলে কথা বলছি এক্ষুনি, আপনারা আসুন একটু। বাইরে দু’জন অপেক্ষা করছে,ওদের ছেড়ে আমি কথা বলছি। তারপর জানিয়ে দিচ্ছি। তাড়া থাকলে বাড়ি চলে যান আমি ফোনে জানিয়ে দিতে পারি”
“না না দাদা , আমরা বসছি, শুনেই যাবো।”
পর্ণা প্রায় টানতে টানতে নিজের মাকে বাড়ি নিয়ে এলো। পরে জ্যোতিষী বাবুর ফোন এলো। নির্দিষ্ট একাউন্টে ওদের পাঁচ হাজার দুশো টাকা জমা করতে হবে। পুজোর জিনিস পত্র সব কিছু ওনারাই মানে তান্ত্রিকরাই নিয়ে আসবেন,। বাড়ি ঘরে ধুয়ে মুছে রাখতে হবে। শুধু একটা লাল শাড়ী, কিছু লাল জবা ফুল আর একটা সিধের ব্যবস্থা করে রাখলেই চলবে।পর্না ফোন করে শুনে নিল সবটাই ।
অনিরুদ্ধ কে সেই মত সব জানিয়েও দিল। অনিরুদ্ধ এতদিন মনে মনে বিশ্বাস করত যে আসলে সাধু-সন্তদের আসন অনেক উঁচুতে, তাঁদের চরিত্র অত্যন্ত পবিত্র এবং তাঁরা ত্যাগের প্রতিমূর্তি। তাঁরা নির্জনে ঈশ্বরের সাধনা করেন । মানুষের দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে এখন অনেক লোক সাধকের ভেক ধরে ব্যবসা করছে, অন্যায়-অপকর্ম করছে। লোকে বিজ্ঞাপন দেখে ভাগ্য ফেরাতে এঁদের কাছে চলে যান, তারপরে সর্বস্বান্ত হন।যার ফলে সাধকদের সম্বন্ধেই একটা ভুল বার্তা যাচ্ছে মানুষের কাছে। বিজ্ঞানের ছাত্র হলেও কেমন যেন দুর্বল হয়ে পড়ছিল।তাই সেও রাজি হয়ে গেল।জপ তপের কথাটা ইচ্ছে করেই চেপে গেল পর্ণা। ওটা বাড়িতে হবেনা, তাই পরে জানালেও চলবে।মানুষটা এমনিতেই নিজের বিশ্বাসে চিড় ধরায় বিভ্রান্ত। সেই নড়বড়ে জায়গায় আঘাত এড়িয়ে যাওয়াই ভালো
দশ
—“দেখলে তো সোনা ,এবার আমার কথায় বিশ্বাস হলো? বলেছিলাম না এরা বেশির ভাগই ভন্ড। সামান্য কিছু অনুভব করতে পারেন কারন এদের ষষ্ঠ ইন্দ্রিয়টা সজাগ, মানুষকে পর্যবেক্ষণ করেন আর বাকিটা ইনফো নিয়ে কাজ করেন।”
রাগে দুঃখে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছিল পর্ণা। কাঁদতে কাঁদতেই বলল,–“কেউ এই ভাবে বোকা বানালে খুব কষ্ট হয় গো… ছি ছি এরা কি মানুষ? লোকের আবেগে নিয়ে এই ভাবে ব্যবসা করে… আমি কি করে এতটা বোকার মত কাজ করলাম?”
—“এটাই ওদের অস্ত্র। মানুষের দুর্বলতাকে এরা কাজে লাগায়।”
সে দিন সকালের ঘটনা…অনিরুদ্ধ দেখলো ঘড়িতে তখন সকাল ছটা । দুজন, জটাধারী জোর গলায় “জয় তারা, জয় জয় তারা “ধ্বনি দিয়ে জানান দিল যে তারা উপস্থিত । এমনিতেই পাড়াটা নির্জন তার ওপরে এতটা সকাল বলে রাস্তার যানবাহনের চলাচলও তেমন নেই। নেহাত লোকজনও কম, নাহলে এই চিৎকার শুনে কিছু লোক জড়ো হত নিশ্চয়ই। সকাল থেকে পর্ণা ঘর ধুয়ে মুছে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করে তুলেছে। আগন্তুক দুজনেই মোটামুটি একই সাজে সজ্জিত। তফাৎ শুধু আয়তনে।দুজনেরই পরণে রক্ত বস্ত্র,কপালে হলুদ কুমকুম দিয়ে ত্রিপুণ্ড্র আঁকা।গায়ে ভস্ম। গলায় হাতে রুদ্রাক্ষের গোটা দশেক মালা। পায়ে খড়ম।হাতে বড় ব্যাগ আর কাঁধে লাল কাপড়ের ঝোলা। দেখলে ভক্তির থেকে ভয়ের উদ্রেক হয় বেশি। অনিরুদ্ধ কিছুটা কৌতূহলী হল ওরা কি করে জানতে।
ঘরে ঢুকে, চারিদিকে গঙ্গা জল ছিটিয়ে, দরজায় দরজায় ভাস্মের তিলক কেটে শুদ্ধিকরণ হলো।তারপর সব জিনিস পত্র ছড়িয়ে চলল পুজোর জোগাড়।তবে সবার আগে থালা ভর্তি কুঁচনো ফল, মিষ্টি আর শরবৎ উদরস্থ করে নিলেন দুজনে। খেয়ে বিশাল ঢেঁকুর তুলে বেশ প্রত্যয়ের সঙ্গে জানালেন—- ” চিন্তা কি রে বেটি, আমাদের যজ্ঞের শুরু হওয়া অবধি অপেক্ষা কর, তিন মিনিটে এই ভূতকে আমরা কমন্ডুলে বন্দী করে নিয়ে যাবো। তারপর শ্মশানে এই ভূতের ওপর বসে করবো মহা পিশাচনাশিনী যজ্ঞের পূর্ণ আহুতি দান।
ঘণ্টা খানেক ধরে গুছিয়ে পুব মুখ হয়ে বসে, চাল, তেল সিঁদুর দিয়ে দেওয়ালে লেপে শুরু হলো মন্ত্র পাঠ।তিন মিনিটের জায়গায় প্রায় কয়েক ঘন্টা ধরে যা করলেন তা নিছক ভাওতাবাজীর চেষ্টা ছাড়া আর কিছুই নয়। তাতে যে মন্ত্রগুলো তিনি উচ্চারণ করলেন – তার কয়েকটি হিন্দুদের ধর্মগ্রন্থ “শ্রী শ্রী চন্ডী” থেকে নেয়া। “যা দেবী সর্বভূতেষু শক্তি রূপেন সংস্থিতা, নমস্তস্যৈ নমস্তস্যৈ নমস্তস্যৈ নমো নমঃ” এ মন্ত্রটি উচ্চারিত হল অনেকবার। বেশ গড় গড় করে আদ্যা স্তব পাঠও চললো কিছুক্ষণ। তার সঙ্গে যজ্ঞের আগুনে আহুতি।বাকি যেগুলো তার বেশির ভাগই অর্থহীন কিছু সংস্কৃত শব্দাংশ।
এতক্ষণ অবধি তবুও ঠিক ছিল কিন্তু ভূতের অস্তিত্ব বোঝাতে যেই আহুতি দেওয়ার পরে আগুনের রং সবুজ আর উজ্জ্বল সবুজ হতে লাগলো অনিরুদ্ধ ওঁদের সব বুজরুকি ধরে ফেললো।কি কি রাসায়নিক এর প্রভাবে এমন হয় টা অনিরুদ্ধ খুব ভালই জানত।
আগুনে আহুতি দিয়ে এক বাবা বললেন,—-“দেখ রে বেটি, ভূত কেমন আগুনে নিজেই ধরা দিচ্ছে। কুট্টুস এতক্ষণ ঘরের বাইরে বসে লেজ নাড়াচ্ছিল আর জুল জুল করে সব দেখছিল, যেন খুব মজা পাচ্ছে। হটাৎ দূর্গন্ধ টা যেন বহুগুণ বেড়ে গেল। কুট্টুস হঠাৎ সন্ত্রস্ত হয়ে ছুটে খাটের তলায় ঢুকে পড়ল। ঘি, কর্পূর, ধূপ,ধুনোর গন্ধ ছাপিয়ে দূর্গন্ধ ভরে গেল পুরো জায়গা।
অনিরুদ্ধ কিছু করার আগেই হটাৎ দুই বাবাই স্তব্ধ হয়ে গেলো। যেন কেউ ভীষণ জোরে ওদের গলা চেপে ধরেছে। ছাড়া পাওয়ার জন্য ছট্ফট্ করছিল দুই তথাকথিত তান্ত্রিক। গলা দিয়ে শুধু অস্ফুট গোঙানীর শব্দে ঘরে ভরে উঠলো। তারপর সব নিঃশব্দ। আগুনের শিখা দাউ দাউ করে জ্বলছে।
—-“আমাদের মাফ করে দে ,আমাদের মাফ করে দে, ” বলে দুজনেই উর্ধশ্বাসে ঘর থেকে বেরিয়ে এলো। ছুটে ফ্ল্যাট থেকে বেরিয়েই যেত কিন্তু অনিরুদ্ধের মুখ মুখি হতে বললো, —-“মাফ করবেন। আমরা একে তাড়াতে পারবো না , আত্মাটি খুব শক্তিশালী।দেখুন কেমন চেপে ধরে রক্ত জমিয়ে দিয়েছে। “
চিহ্ন গুলো পরিচিত, শুধু তফাত একটাই অনিরুদ্ধ আঘাত পাওয়ার সময়টা অনুভব করতেই পারেনা।
অনিরুদ্ধ একজনের হাত চেপে ধরল,—” বললেই হলো? অত গুলো টাকা নিলেন…তার বেলা?
কোনরকমে হাত ছাড়িয়ে, সিঁড়ি দিয়ে দুরদারিয়ে ছুটে নামতে নামতে বললো—“আমাদের ছেড়ে দিন আপনার সব টাকা ফেরত দিয়ে দেব।এই আত্মা কিন্তু আপনাকে শেষ করেই ছাড়বে “
ঘরময় তখন শুধু নৈঃশব্দ আর পর্ণার ফোঁপানির শব্দ।
এগারো
কাছের দেবুদার চা’র দোকানে একটা স্পেশাল চা বলে পাশের বেঞ্চিতে বসল অনিরুদ্ধ। এটাই একটু সময় নিয়ে ভাবার আবকাশ।
দম বন্ধ লাগছিল বলে অনিরুদ্ধ —-“একটু ঘুরে আসছি” বলে নেমে এসেছিল। ভন্ড জেনেও তাদের বলা সতর্কবাণীতে সে বেশ বিচলিত বোধ করছিল। এই সময় দরকার এক কাপ গরম চা, সঙ্গে একটা সিগারেট। তবে যদি মাথাটা খোলে।সব কেমন তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে
চায়ের গ্লাসটা এগিয়ে দিয়ে দেবুদা বলল—+” দাদা, কিছু মনে কৈরেন না, একখান কতা কই?
—” বলুন”
— “ছোট মুখে বড় কতা বৈলতেছি। আসলে আজ দৈখলাম দুই বাবাজীরে বেরুতে , শুনলাম আবনার ফেলাটে পুজার জন্যি । তা সেখান হলোনি বাঝি?”
অনাবশ্যক উৎসুক্যে বিরক্ত হলেও অনিরুদ্ধ উত্তর দিল—” না ওরা ভন্ড। লোক ঠকায়। “
—” বেশির ভাগ তাই গো দাদা। যদি তেনাদের ব্যাপার হয় থাসকে তাইলে কইবেন। আম্মাদের গেরামে তারস তান্ত্রিকের কাছথেকে ঘুইরে আাসুন কেনে। দ্যেকবেন কি ত্যেজ।”
–“আচ্ছা বলব, এখন আসি দেবুদা” বলে গ্লাসটা রেখে চায়ের দাম মিটিয়ে উঠে পড়ল অনিরুদ্ধ।
একবার প্রমোটর দুলাল বাবুর সঙ্গে সামনাসামনি কথা বলা দরকার।
বারো
অনিরুদ্ধ বাড়ি ফিরলো বেশ চিন্তিত মুখে। দুলাল বাবুর কাছ থেকে যা শুনলো তাতে তার আক্কেল গুড়ুম হয়ে গেছে। এখন পর্ণা কে বললে যে কি ভাবে রিএক্ট করবে সেটা ভাবাচ্ছে। অথচ না বললেই নয়।ঘটনাটা চেপে রাখা ঠিক হবে না।
আজ সকালে একটা হেস্ত-নেস্ত করতে অনিরুদ্ধ সোজা উপস্থিত হয়েছিল দুলালবাবুর অফিসে।উনি তখন নিজের ল্যাপটপে কিসব যেন করছিলেন। অনিরুদ্ধ কে দেখে মুখে মেকি হাসি টেনে বললেন,—” আরে কি সৌভাগ্য, অনিরুদ্ধ বাবু নিজে এই গরীব খানায়! আসুন আসুন। বসুন, একটু চা আনাই নাকি ঠান্ডা ? “
এমনিতেই সকালের ভন্ড তান্ত্রিকের ব্যাপারে মাথায় আগুন জ্বলছিল, এবার এই ন্যাকা কথায় তেলে বেগুনে জ্বলে উঠলো অনিরুদ্ধ,” —“ছাড়ুন তো মশাই আপনার এই চিঁড়ে ভেজানো কথা।খুব বোকা বানিয়ে আমাকে একটা ভূতুড়ে ফ্ল্যাট গছিয়ে এখন দাঁত ক্যালানো হচ্ছে। ইচ্ছে করছে…..”
—“আহা, আহা, চটছেন কেন? ঠান্ডা হয়ে একটু পাখার হওয়ায় বসুন, ওরে কেলো, একটা ঠান্ডা নিয়ে আয়ে বাবা স্যারের জন্য। ছুট্টে যাবি, দৌড়ে আসবি।”
–” নিকুচি করেছে ঠান্ডার। কিছু লাগবে না, যা ঠাণ্ডা আমাকে করেছেন তার ঠেলায় জীবন ওষ্টাগত। কেন করলেন এমন?জেনে শুনে আমার এমন সর্বনাশ কেন করলেন?’
—“আমি তো মশাই আপনাকে বলেছিলাম ফ্ল্যাটটা বউদির নামে কিনুন। আমার কথা শুনলে এমনটা হত না।
—“বলেছিলেন , কিন্তু কেন তো কি বলেছিলেন? বোকাবোকা কথা বললেই হবে? ওর নামে ফ্ল্যাট হলে লোন পাওয়া যেত কি? কি মনে করেন? সবটাই আপনার তেজারতি?”
—“ইয়ে , না মানে তা বলি নি, মাইরি বলছি স্যার। আর কখনো এমন ভুল করবো না।”
—“এটা কি ফাজলামো করার সময় ?? তখন কি বলেছিলেন যে ম্যাডামের নেমে ফ্ল্যাট নাহলে আপনাকে ভূতে ধরবে।”
—-“সেটা আমার অন্যায় হয়েছে আমি মানছি, তবে বিশ্বাস করুন, মাইরি বলছি, এই দেষে এটা যে ভৌতিক কান্ড হলে দাঁড়াবে বুঝি নি স্যার , মায়ের দিব্বি বলছি। মেয়েটার আত্মা যে এই ভাবে জ্বালাবে বুঝতে পারি নি।বিশ্বাস করুন।
—” মেয়েটা? কোন মেয়েটা?”
—“ওই যে স্যার যাকে ওই ফ্ল্যাটে মেরে ফেললো ওর বর।”
—” ভ্যেনতারা না করে খুলে বলুন তো।”
—“আর বলবেন না মশাই, যাদের জমি ছিল তারা আমার পার্টনারের পরিচিত। তিনি জমিটার জন্যে ডেভেলপার খুঁজছিলেন,আমাদের ও কাজ দরকার ছিল।ওনার ইচ্ছে ছিল টাকাটা আর ফ্ল্যাটটা যাতে বিয়ের সময় মেয়েকে গিফ্ট করতে পারেন। করলেনও তাই। তা জামাইটা এমন বজ্জাত যে ফ্ল্যাটটা নিজের নেমে করার জন্য মেয়েটিকে মেরে মেরে মেরেই ফেললো,ভাবুন। এমন চামার যে কি বলব। ঘরের দেওয়ালে মাথা ঠুকে ঠুকে মেরে ওখানেই ফেলে পালিয়ে গেল দেশ ছেড়ে। শেষে লাশ পচে দূর্গন্ধ বেরোতে তখন বোঝা গেল। মেয়েটা কিন্তু কিছুতেই হার মানে নি, মরে গেল কিন্তু সম্পত্তি ছেড়ে দেয় নি। মেয়েটির বাবা ওটা বিক্রি করে দিতে বললেন। আমরাও তাই করলাম। তবে বলেছিলেন যেন কোন কম বয়সি দম্পতি কে বিক্রি করা হয়, তাহলে মেয়েটির আত্মা শান্তি পাবে। আগে কত খদ্দের এসেছে। কিন্তু আমাদের হলো মার্দ কা জবান । কাউকে দি নিই। নাহলে ওই দামে আপনি ফ্ল্যাট পেতেন?তারপর আপনারা নিজেই এলেন , তখন আপনাদের সঙ্গে ডিল হল। বলুন এতে আমাদের দোষ কোথায়? আমি তো ভূত কে লেলিয়ে দেই নি,তাই না?
সেই জন্য দূর্গন্ধ, মেঝে তে আর দেওয়ালে দাগ।এতক্ষণে ব্যাপারটা বোঝা গেল।শেষ অবধি ডিস্পোডোফোবিয়া!!! তাও ভূতের। এমনটাও হয়?
তেরো
চায়ের দোকানের দেবুদার কাছ থেকে ঠিকানা নিয়ে পরের দিনই অনিরুদ্ধ পৌঁছে গেল নির্দিষ্ট গ্রামে। ডেরা খুঁজে পেতে মটেই বেগ পেতে হল না। চার পাঁচ কিলোমিটার দূর থেকেই তারা-তান্ত্রিকের নাম বলতেই একডাকে জায়গাটার হদিস বলে দিল সবাই।
ছোট একটা প্রদীপ জ্বলছে বটগাছটার নিচে।এক সাধুবাবা বসে আছেন একটা বড় পাথরের উপরে। সারা গায়ে ছাইয়ের প্রলেপ মেখে প্রায় উলঙ্গ জটাধারী তারা-তান্ত্রিককে দেখলে যে কেউ ভয় পাবে। উনি বয়সে বৃদ্ধ হলেও দেহে সাধনা সুলভ উজ্জ্বলতা আছে। গলায় ছোট রুদ্রাক্ষের একটা মালা। আার একটা স্ফটিকের মালা। রূপসজ্জার আড়ম্বর বলতে এইটুকু। কপালে তিলক বা ফোঁটা টোটা কিছু নেই। গায়ের রঙ ময়লা। ময়লা পরনের গেরুয়া বসনটাও । পাশে একটা পানপাত্র নারকেলের খোলা দিয়ে তৈরি। প্রয়োজনে হয়তো ভিক্ষের চালও রাখা যায়। দেখলাম শিঙেও আছে একটা ঝুলির উপরে।
সামনে ছোট্ট একটা হোমকুন্ড। পাশে নরকরোটি, একটা পশুর ছালের আসন পাতা। একবার টকটকে লাল চোখ খুলে অনিরুদ্ধের দিকে তাকিয়ে আবার চোখ বুঝেছিল তান্ত্রিক। বেশ কিছুক্ষণ পর চোখ খুলে ইশারায় ওকে বসতে বলল আসনে। অনিরুদ্ধ লক্ষ্য করল যে তান্ত্রিকের মাথায় জটা তবে সারা মাথাভর্তি নয়। মাত্র কয়েকটা জটা নেমে এসেছে কাঁধ আর পিঠ বেয়ে। হাত দেড়েকের উপর হবে না। মুখখানা বেশ। গালে দাড়ি আছে লম্বা। কাঁচায় পাকায় বেশ মানিয়েছে।
তারপর অগ্নিকুন্ডে কিছু ছুঁড়ে দিতেই দাউদাউ করে জ্বলে উঠেছিল আগুন। সেদিকে তাকিয়ে মন্ত্রচ্চারণ করতে করতে তারা-তান্ত্রিক উঠে দাঁড়াল। তারপর চিৎকার করে বললেন— -”এলি, কিন্তু বড্ড দেরিতে এলি। ওর শক্তি বৃদ্ধি পেয়েছে। তোকে শেষ করবে ওই অভাগীর বেটি। ”
—”কিন্তু বাবা কিছু তো উপায় হবে ? এই ভূতের হাত থেকে আমাকে বাঁচান।” করুণ স্বরে বলে অনিরুদ্ধ । কিছু না বলতেই তান্ত্রিক সব জেনে গেছে । লোকটা তার মানে ভণ্ড নয়। মনের সব সংশয় দূর হতেই পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করল অনিরুদ্ধ।
সাধুবাবা বললেন,—“মৃত্যুর পর কোনও আত্মাই পৃথিবীর বুকে আটকে থাকতে চায় না রে শালা। আত্মা সব সময় মুক্তির পথ খোঁজে। যে আত্মা তা পায় না, সেই প্রেতাত্মায় পরিণত হয়। জীবনের অপূর্ণতা মৃত্যুর পরে দূর করার চেষ্টায় এই ধরনের অতৃপ্ত আত্মা জীবিত মানুষের শরীরে প্রবেশ করার পথ খোঁজে। কিন্তু এ বেটি দেহ চায় না।প্রতিশোধ চায়। আার চায় নিজের সম্পত্তি আগলে রাখতে।মরেও শুধু সম্পত্তির মায়ায় পৃথিবী ছেড়ে যেতে পারছে না “
—-“কিন্তু বাবা, আমি তো কোন ক্ষতি করিনি,আমি তো জানতামই না ওনার অস্তিত্বের কথা…”
—“দুর শালা , সে কথা কি আর ওই আভাগার বেটি বোঝে, ওর কাছে পুরুষ মাত্রই শত্রু, যারা ওর অধিকার কেড়ে নিতে চায়।তাই শুধু তোকে আক্রমণ করে। তোর বউ কি ওর অস্তিত্ব টেড় পায়? পায় না তো…”
—” হ্যাঁ বাবা, পর্ণার কোনো সমস্যাই হয় না। তবে বাবা আমাদের কুট্টুসও কি তার মানে..
—“ওরা হলো ধর্মের বাহন,মা’য়ের সন্তান, মনে পাপ নেই তাই দেখতে পায়।ও বোঝে যে ওই বেটি তোর ক্ষতি চায় তাই সারাক্ষন বকাবকি করে, বকুনিও খায়। তোর কুত্তাটা তোরে বড্ড ভালোবাসে। যা যা বলছি মন দিয়ে শোন। বেটি কে বোঝাতে হবে যে তুই ওর অধিকার কেড়ে নিতে আসিসনি।বাড়িটা বউকে দিয়ে দে। আর ওই বেটির নামে একটা পিন্ডি দেয়ে দে। খবরদার এ মুখো হবি না।তাহলে তোর একদিন কি আমার একদিন।”
—-“কেন বাবা, কি অপরাধে এমন বলছেন।”
—-“দুর হ হারামজাদা, দুর হ। সারাক্ষণ ভ্যান ভ্যান করে মাথাটা গরম করে দিলি। বেরো এক্ষুণি । আমি কি সারাদিন তোর সমস্যা নিয়ে বসে থাকবো,? মা কে ডাকতে দিবি না, শিগগির বেরিয়ে যা। দূর দূর।”
অনিরুদ্ধ প্রণাম করে প্রণামী দিতেই এক লাথি মারলেন, বললেন—-” হারামজাদা, ট্যাকাটা ওই বাইরের বুড়োটা কে দে, ওর ঘরে চাল বাড়ন্ত। উনি বড়লোকি দেখাচ্ছেন রে মা। মা, মা, রে তুই রাগ করিস নে, ও ব্যাটা একদম বুদ্ধু মথামোটা।”
অনিরুদ্ধ বাক্য হারা হয়ে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল। দেখল বাবা চোখ বুজে ধ্যানে নিবিষ্ট। টাকাটা কুড়িয়ে নিয়ে আবার একটা প্রণাম করে বেরিয়ে এলো।
চৌদ্দ
বাড়ি পৌঁছিয়ে অনিরুদ্ধ সব কথা সবিস্তারে বলল।ব্যাংকে কথাবার্তা বলে, তারা-তান্ত্রিকের কথা মত পর্ণার নামে দান পত্র করে দিল। আার বাড়িতে একটা শ্রাদ্ধ করল। সেই বিকট দূর্গন্ধটা আর নেই। গায়ে নতুন করে আর দাগও হয় না। অনিরুদ্ধ এখন আনেকটাই নিশ্চিন্ত যে সব বিপদ কেটে গিয়েছে। আত্মাটি নিশ্চয় শান্তি পেয়ে সাধনোচিত ধামে চলে গেছে।
দেখতে দেখতে বছর ঘুরে গেল।নিরোপদ্রুপ জীবনে এখন ব্যস্ততা নতুন সদস্য কে ঘিরে।ওদের মেয়ে, ছোট্ট পিপাই। পিপাই দেখতে একদম যেন একটা জ্যান্ত পুতুল।ভারি সোনা মেয়ে।কান্নাকাটির ব্যাপার নেই, বাড়িতে যে অতটুকু একটা ছোট বাচ্ছা আছে সেটা বোঝাই যায় না। পিপাই আজকাল টুক টুক করে হামাগুড়ি দিয়ে সারা বাড়িতে ঘোরে।তবে কথা এখনো ভালো বলতে শেখে নি। কিন্তু বাবা মা কে চিনতে শিখেছে।জিজ্ঞেস করলে আঙুলে তুলে দেখাতে শিখেছে। পাখা,আলো, হাত, পা বাপী, মামনি, এমনকি কুট্টুসকেও চিনতে শিখেছে। তবে মুখে সারাদিন একটাই শব্দ শুধু বুবু আার বুবু।
অনিরুদ্ধ অফিস থেকে ফিরেই মেতে ওঠে সারাদিন মেয়ে কি কি শিখল সেই নিয়ে। আজকাল অনিরুদ্ধ কে দেখেই বাপি বলে হাত বাড়ায় কোলে ওঠার জন্য। মনটা ভরে ওঠে তৃপ্তিতে..শান্তিতে।
সেদিন মেয়েকে নিয়ে ঘরে খেলছিল অনিরুদ্ধ, হঠাৎ পিপাই “বুবু, বুবু” বলে হাত বাড়িয়ে দিল দেওয়ালের দিকে…ওখানে তো কেউ নেই,একটা টিকটিকিও নেই । বুকটা ধরাস করে উঠল অনিরুদ্ধের। তাহলে কি সে আজও…
তারপর ইলেকট্রিক বিল জমা দিতে যাবো। আমার দেরি হবে আসতে। স্বামী অমর বলে, ঠিক আছে।…..
নভেম্বর চলছে। অনির সাথে আজ দেখা হবে তা জানাই ছিল। এই তো ক’দিন আগেই দেখা…..
বুড়িমাসি বলেন,জীবনটা বালির ঘর গো।ঢেউ এলে ধুয়ে যায় জীবনের মায়া।তবু বড় ভালবাসা ওদের দাম্পত্যে।রোদের চাদরের…..
এক ড্রইং রুমে বসে রয়েছে সদ্য কিশোর উত্তীর্ণ তরুণ গোয়েন্দা সজীব। সামনের টেবিলে ছড়িয়ে…..