ফিরে এসো
আমার বাবা ছিলেন অত্যন্ত সাহসী একজন লড়াকু মনের মানুষ।শত অভাব অভিযোগেও তাকে কোনোদিন ভেঙ্গে…..
গতকাল রাতে শোবার পর থেকে অলীক কল্পনায় চটফট করতে করতে আমরা তিনজন ঠিক করে নিদ্রাদেবীর স্নেহ পাইনি। অন্যদিনের তুলনায় একটু তাড়াতাড়ি বিছানা ত্যাগ করেছিলাম।
সকাল থেকেই উত্তেজনায় মনের মধ্যে হাজারটা রঙ মিলেমিশে কোলাজ তৈরি করছিল। ভেতরে ভেতরে একটা কথাই উঁকি দিয়ে যাচ্ছিল, আজ এক অসম্ভব ঘটনার সাক্ষী হতে চলেছি। শুধু আমি না দাদা ও দিদির প্রায় একই অবস্থা। যদিও আমরা এসবে বিশ্বাস করতাম না, তবুও অল্প বয়সের সহজতাতে কিছুটা উৎসাহ জন্মেছিল। তিন ভাইবোন তখনও স্কুলের গন্ডি পেরোইনি। বাড়ির পরিবেশ অনুযায়ী মনের মধ্যে কোনো জটিলতা ছিলনা, আর আমাদের লালঠাম্মা তিন ভাইবোনের সেই সরলতাকে হাতিয়ার করে তার কর্মকাণ্ড দেখানোর প্রস্তুতি নেয়া শুরু করেছিলেন।
লালঠাম্মা আমার বাবার কাকিমা, লালঠাম্মা বলে ডাকলেও আদতে উনি ছিলেন একটু বেশি খয়েরি বা মানুষের রঙ সম্পর্কে যা বলে থাকি খুব কালো, নামের সাথে কোনো মিলই নেই চেহারার। আমার বাবার সেই কাকা অর্থাৎ লালঠাম্মার স্বামী অত্যন্ত ফর্সা ছিলেন বলে বাবারা তাঁকে লাল কাকা বলতেন, সেই জন্য আমাদের কাছে তিনি লাল দাদু ও সেই তালমেলে উনি লালঠাম্মা। দুজন একেবারেই বিপরীত মেরুর, যেন পুরোনো সাদা কালো সিনেমা। যাই হোক আমার ঠাকুরমা যতটা খিটখিটে ছিলেন, লালঠাম্মা ততটাই রসিক ছিলেন। নাতি নাতনি তাদের বন্ধুবান্ধব সবার সাথেই তাঁর দারুণ বন্ধুত্ব। এমনকি হিন্দি সিনেমা দেখা, ক্রিকেট খেলা দেখা, ছেলে বউদের সাথে তর্ক করে নাতি-নাতনিদের আধুনিক পোশাক কিনে দেয়া সবেতেই তার জুড়ি মেলা ভার। তাই আমরাও বদমাশি করার কোন সুযোগ হাতছাড়া করতাম না। কখনো ব্লাড প্রেসার চেক করতে বললে হাতে না লাগিয়ে সেই ভেলকো লাগানো কাফটা (পট্টিটা) গলায় সেট করতে যেতাম, আর ঠাম্মা বৌমা বৌমা করে মায়ের পেছনে গিয়ে আশ্রয় নিতেন। কখনো মোচা বাছতে বসলে মোচার ছড়ার পেছনের অংশ কেটে ঠাম্মার মুখে দাঁতের জায়গায় বসাতাম, কারণ ঠাম্মার উপরেও নিচের মাড়ি মাইলস্টোন বিহীন জাতীয় সড়ক। বিরক্ত যে হতেন সেটা বললে ভূল হবে, আহ্লাদী বাচ্চার মতো ন্যাকা কান্না জুড়তেন। ফাজলামি উপভোগ করতেন সম্পূর্ণভাবে কিন্তু নাটক করতেন ইচ্ছে করে। এই ছিল আমাদের সাথে তাঁর সম্পর্ক।
এখন আসি মূল পর্বে। বেশ কয়েকদিন ধরেই লাল ঠাম্মা বলে যাচ্ছিলেন, তিনি আমাদের ভূত দেখাবেন। আমরা ভাবলাম, এ আবার কি বলছেন উনি! ঠাম্মা জানালেন যে উনি প্ল্যানচেট করতে পারেন, তাই আমরা যাকে দেখতে চাইবো তাকেই দেখাবেন। আমরা তো প্রথমে হেসে উড়িয়ে দিয়েছিলাম, কিন্তু অসম্ভব আত্মবিশ্বাসের সাথে উনি আমাদের ভাই বোনকে প্রায় বিশ্বাস করাতে বাধ্য করলেন যে উনি সেটা করে দেখাবেন। সেই সময় আসাম থেকে এসে লালঠাম্মা বেশ কিছু মাস আমাদের বাড়িতে ছিলেন, তাই গল্পও বদমায়েশি একটু বেশি চলত। মা ও বাবা তো এসব শুনে হাসতেন আর বলতেন, কাকিমা আপনি পারেনও এদের সাথে ছেলেমানুষী করতে। এসব প্ল্যানচেট ট্যানচেট তাঁরাও বিশ্বাস করতেন না। যাই হোক অবশেষে স্থির হলো, এক শনিবার রাতে উনি প্লানচেট করবেন। শর্ত ছিল ঠাম্মার সাথে আমরা তিনভাইবোন ছাড়া ঘরে আর কেউ থাকবে না, সবাইকে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন হয়ে ধোয়া জামা কাপড় পরে বসতে হবে। আমরা রাজি হলাম অপ্রত্যাশিত এক ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী হিসাবে উপস্থিত থাকতে।
অপেক্ষার অবসান হলো, সেই কাঙ্ক্ষিত শনিবার দরজা জানালা খুলে হাজির হলো রোমাঞ্চিত করবার জন্য। সকাল থেকে প্রায় তিনভাইবোনের ভেতরে উত্তেজনার পারদ চড়চড় করে উঠছে। ঠাম্মা জিজ্ঞেস করলেন আমাদের, কাকে দেখতে চাই আমরা! অনেক ভেবে দিদি বলল – আমাদের ঠাকুরদাকে দেখাবে ঠাম্মা! যেহেতু আমরা আমাদের ঠাকুরদাকে কোনদিন দেখিনি এবং তাঁর কর্মযজ্ঞের কথা শুনে মনের মধ্যে এক উদার ও মহৎ মানুষের ছবি বসিয়েছি, তাই ঠাকুরদাই আমাদের প্রথম পছন্দ। ঠাকুরদার একটা ছবি ছিল, সেটাও বাঁধাই করতে নিয়ে যাবার সময় কাকার কাছ থেকে হারিয়ে যায়। সেই কারণে আমাদের ক্ষোভের শেষ ছিল না। এদিকে আমার দাদা আবার সেই সময় সিনেমাপ্রেমী ছিল, নায়কদের মধ্যে মিঠুন চক্রবর্তীর অনুরাগী ছিল, তাই দাদা বললো- মিঠুন চক্রবর্তী কে দেখব, আনতে পারবে ঠাম্মা? লালঠাম্মা বেশ সপ্রতিভ ভাবে বললেন, “জীবিত মানুষকে আনা কষ্ট তাও চেষ্টা করব”। আমি তো ভেবেই পেলামনা কার নাম বলি! কারণ একগাদা জিনিসের মধ্যে নির্বাচন করা আমার কষ্ট। সে যেকোনো বিষয়ে প্রিয় জিনিস বাছতে দিলে একই সমস্যা হয়, সব কিছুই আমার ভালো লাগে সবাইকেই আমার ভালো লাগে। তাই দাদা দিদির নির্বাচনকেই সম্মতি জানালাম।
রাতের খাওয়া দাওয়া শেষ করে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন হয়ে ঠাম্মার কথামতো ধোয়া জামাকাপড় পড়ে আমরা তিন ভাইবোন নির্দেশিত ঘরের মধ্যে ঢুকে গেলাম, ঠাম্মা আলো নিভিয়ে দিতে বললেন এবং উনি একটু পরে ঘরে ঢুকলেন। ঠাম্মা এসে মেঝের মাঝে বসলেন আর আমরা তিনভাইবোন গোল করে তার পাশে বসলাম। অন্ধকার ঘর, কারো মুখে একটা টুঁ শব্দ নেই, অদ্ভুত এক পরিবেশ। ঠাম্মা মুখ দিয়ে কি বিড়বিড় করতে লাগলেন, আর মনে হল রুদ্রাক্ষের মালা জাতীয় কিছু নাড়াচাড়া করছেন ও সেটা বারবার পিতলের একটা রেকাবিতে লেগে লেগে খর খর শব্দ হচ্ছে। ঘরের এক কোনায় উনি ছোট্ট একটা ডিম লাইট একেবারে নিভু নিভু ভাবে জ্বালিয়ে রেখেছিলেন। খানিক পরে আমাদের চোখ বন্ধ করতে বললেন ও হাতের মধ্যে কিছু দিয়ে বললেন দুই হাতে ডলে ভালো করে মুখে গলায় হাতে মাখতে। আমি বরাবরই একটু দুষ্টু বুদ্ধির অধিকারী, মনের মধ্যে নানা রকম সন্দেহ ডানা মেলে উড়ছিল। তাই আমি হাতে ডলেছি কিন্তু মুখে মাখিনি।
পাঁচ মিনিট পরে উনি আমাদের বললেন এবার চোখ খুলে দেখ তোদের ঠাকুরদাকে দেখতে পাবি। আস্তে আস্তে চোখ খুলে হতভম্ব আমরা। ঘরের সব লাইট জ্বলছে আর বাবা-মাও এসে উপস্থিত, আর তাঁরা মিটমিট করে হাসছেন। বুঝতে পারলাম না কি হয়েছে! যেই দাদা দিদির দিকে তাকিয়েছি আমিও হেসে কুটিপাটি, দিদি সামান্য মুখে হাত বুলালেও দাদা সেই বস্তুটি সম্পূর্ণ মুখে মেখেছিল ঠাম্মার নির্দেশমতো। লালঠাম্মা দাদার দিকে আঙ্গুল তুলে দেখিয়ে বললেন ‘ওই দেখ্ তোদের ঠাকুরদা’। সবার এমন হাসি দেখে দাদা তো রেগে আগুন, সমানে ফুঁসছে, আমি বললাম আয়নায় দেখ্। দাদার আবার আয়না দেখা একটা নেশা, অবসর সময় আয়নার সাথে কাটাতে ভালোবাসে। বাবা মজা করে বলতেন নার্সিসাস। পাশের ঘরে গিয়ে দাদা আয়নাতে নিজেকে দেখে ঠাকুমাকে তো প্রায় মেরেই ফেলে, মা হাসতে হাসতে বললেন, ‘কাকিমা আপনি এইজন্য আমার কাছ থেকে নীলের গুড়ো নিয়েছিলেন’ আর বাবা বললেন ‘তাইতো কাকিমা আমার কাছে রুদ্রাক্ষের মালাটি চেয়েছিলেন’।
দাদার মুখ সম্পূর্ণ রবীন-ব্লু এর বিজ্ঞাপন। সম্মুখে যুদ্ধের আশঙ্কা করে ঠাম্মা এক মুহুর্ত দেরি না করে লাফ দিয়ে সোজা বিছানায় উঠে বাবার পেছনে লুকিয়েছেন। আর বাচ্চাদের মত বাঁকা চোখে মুখের ভঙ্গি করে একটা মহা ফাজিলের হাসি হাসছেন। আর মনে মনে ভাবছেন- “তোমরা যতই নতুন চাল রান্না করো পুরনো চাল ভাতে বাড়ে”।
সুরক্ষিত বলয় থেকে সিনেমার ডায়লগ ছুড়লেন –
” ডোন্ট আন্ডার এস্টিমেট মি”
আমার বাবা ছিলেন অত্যন্ত সাহসী একজন লড়াকু মনের মানুষ।শত অভাব অভিযোগেও তাকে কোনোদিন ভেঙ্গে…..
ভার্সিটির বাস ধরতে হয় আমাকে খুব সকালে। বাড়ি থেকে একটু হেঁটেই রিকসা। তারপর বাস। হাঁটা…..
আজকের সন্ধ্যাটা থমকে যাওয়া মেঘেদের। ঝিরিঝির বৃষ্টি ছিল দিনভর। ঢাকা শহরের পথঘাট জল কাদায় মাখামাখি।…..
জোছনা করেছে আড়ি আসে না আমার বাড়ি গলি দিয়ে চলে যায়, গলি দিয়ে চলে যায়…..