তাঁর একাত্তর

জাকিয়া খান
মুক্তগদ্য, সাক্ষাৎকার
Bengali
তাঁর একাত্তর

‘যুদ্ধের সময় ব্যক্তিগত লোভ, আবেগ বড় শত্রু। অনেকেই যুদ্ধের ময়দান থেকে বা পলাতক অবস্থায় মাকে দেখতে এসে শত্রুর হাতে ধরা পড়ে মারা গেছে। এরকম মৃত্যু যে মূল্যহীন, আট আনার সন্দেশের লোভ সামলাতে না পেরে ধরা পড়ার পরে বুঝেছিলাম। ছেলেবেলায় সব সময় মনে হতো বড় হয়ে টাকা রোজগার করে সন্দেশ খাব। লুঙ্গি আর তিনমাস আগে বানানো খুব শখের সাদা কর্ডের শার্ট পরা ছিলাম। পকেটে হেলেনা বু’র দেওয়া চকচকে কয়েকটা নোটের শেষ এক টাকাটা। শহরের বাইরে দিয়ে ঢুকতেই সন্দেশের কথা মনে হলো। সাইকেল ঘুরিয়ে পশ্চিম দিক দিয়ে মুনসেফ ও ম্যাজিট্রেট কোর্টের বিপরীতে কালীপদ দা’র মিষ্টির দোকানে সন্দেশ খেলাম। এই স্বাদ আর কোথাও নেই। খেয়ে বাড়ির গলির মুখে ঢুকতেই পেছন থেকে বলে উঠল, ‘থাম, নাই গুলি করব।’ ঘাড় ঘুরিয়ে দেখে মুহূর্তেই প্যাডেলে চাপ দিলেও সাইকেল নড়ল না। সামনের চাকা কাদায় আটকে গেছে। ততক্ষণে আমাকে ঘিরে ফিলেছে। রাইফেল তাককারী প্রায় ছয় ফুটের কাছাকাছি লম্বা বলশালী চেহারার। চোখদুটি ভীষণ ক্রুর। মাসুদ রানা সিরিজে পড়া খুনীদের চোখের মতো। নীহাররঞ্জন, বিমল মিত্র এমনকি মানিকের পুতুল নাচের ইতিকথাও পড়েছি। তবে মাসুদ রানা আমার সেরা পছন্দ। সে জন্যই হয়তো পালিয়ে বাঁচতে পেরেছিলাম।’

‘আমাদের জানা বেশ কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা মায়ের সাথে দেখা করতে এসেই ধরা পড়েছিল। মাসুদ রানা কীভাবে বাঁচালো আপনাকে! কাদের কাছে ধরা পড়লেন? চিনতেন?’

‘অধিকাংশই পরিচিত। বেশির ভাগ আমার সহপাঠী, বাকিরা এক দু ক্লাস ওপরে পড়ে। সবার সঙ্গে আমার তুই তুকারির বন্ধুত্ব। রাইফেল তাককারী যুবকটি কেবল অচেনা।

মাসুদ রানা লেখক বিদ্যুৎ মিত্রের লেখা ডিটেকটিভ সিরিজ কুয়াশা তখন আমার ধ্যান-জ্ঞান। সরকারি ইনফরমেশন সেন্টার বা তথ্য কেন্দ্রের লাইব্রেরি ছিল বাড়ির কাছেই। দুপুরে ভাত খেয়েই চুপিচুপি চলে যেতাম। আমি তখন মনে হয় ক্লাস ফাইভে এবং আমার ছোট ভাই থ্রিতে পড়ি। আমরা গভীর মনোযোগে পড়ছি। হঠাৎ পেছন থেকে শার্টের কলার চেপে ধরায় চমকে তাকিয়ে দেখি আব্বা দু হাতে দুই ছেলের কলার ধরে হেসে বলছেন, রোজ দুপুরে খেয়েই এখানে চলে আসিস। আজ ধরেছি। এই মন্টু, এমন ভরদুপুরে এদেরকে আর ঢুকতে দেবে না। মন্টু ভাই সম্মতিসূচক ঘাড় নেড়ে নীরবে হাসছেন। লাইব্রেরিতে আমার মতো একনিষ্ঠ পাঠক আর ছিল না। বড় ভাই সমতুল্য মন্টু ভাইর প্রচ্ছন্ন প্রশ্রয় ছিল আমার প্রতি। খুব সম্মান করতাম। নতুন বই কবে আসবে আনুমানিক সময় জানাতেন। দেরি হলেই খোঁজ নিতাম। কুয়াশার সবগুলি বই কয়েকবার করে পড়া হতো নতুনটা আসার আগে। আব্বা দুজনকে টেনে হেঁচড়ে বের করে আনলেন। আমি খুব একটা ভয় পাইনি। বড়জোর পাখার ডান্ডি দিয়ে এক দু ঘা বাড়ি মারবেন। অনেকেই দেখছে দুই বই পড়ুয়ার ধরা খাওয়ার দৃশ্য। কলেজের গেটের সামনে আসতেই দুই হাত মেলে দৌড়। আব্বার হাতে আমার জামা ঝুলছে। খুব ধীরে বোতামগুলো খুলে ফেলেছিলাম। আব্বা প্রায় ছয় ফুট লম্বা। আমরা তাঁর অনেক নিচে, তাছাড়া এমন কিছু হতে পারে ভাবেনইনি। শূন্য জামা হাতে হো হো করে হেসে উঠেছিলেন। হাসির সেই মুহূর্তে হাত শিথিল হওয়ায় ছোট ভাইও পালিয়ে যায়। আব্বা হাসতে হাসতে বলেছিলেন, ‘ডিটেকটিভ বই পড়ে পড়ে ওরা এত চালাক হয়েছে, কী করে ওদের সঙ্গে পারি?’ কেমন যেন একটা প্রশ্রয় ছিল এরকম কৌশল দর্শনে। ’৭১ এ পালানোর দিনও মাসুদ রানা পড়া বিদ্যা কাজে লেগেছিল।’

‘কত তারিখ ছিল সেদিন? সতেরো বছরের যুবককে ধরল কেন?’

‘২০ জুন, ১৯৭১, রবিবার। মিষ্টি খেয়ে বের হবার সময় পাশের কাপড়ের দোকান থেকে হারন চিৎকার করে সতর্ক করেছিল। শুনতে পাইনি। সবে রাজাকার গঠন হয়েছে। আমাকে দেখেই দোকান থেকে রাজাকার কমান্ডার রিজুর চলে যাওয়ায় ওর সন্দেহ হয়েছিল। চার বছরের বড় রিজু রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংঘের সাধারণ স¤পাদক বা ওর কাছাকাছি কোনো পদে ছিল। আমি শহর থেকে চার মাইল দূরে আমাদের বন্ধু এবং ছাত্র ইউনিয়ন কর্মী সাজ্জাদদের বাড়িতে ছিলাম। সাজ্জাদের বড় এক ভাই ছাত্র ইউনিয়নের নেতাও ছিলেন। সবে কোনো এক কলেজে শিক্ষকতা শুরু করেছেন। সপ্তাহখানেক ওদের গ্রামে ওদের বাড়িসহ আরো কয়েকটি বাড়িতে আমরা ৫-৭ জন রাতে ঘুমাই। যে যেখানে থাকে, চলে আসে। দিনের বেলায় যাদের বাড়ি শহরতলিতে, তারা বাড়ির আশেপাশেই সতর্কাবস্থায় কাটায়। ওই দিন কি কারণে ভোরে পাক আর্মি মূল ক্যা¤প থেকে সদলে চলে গিয়েছিল। রাতেই জানতে পেরেছিলাম পরের দিন যাবে। আমি ভোরে সাইকেল চালিয়ে গ্রামের রাস্তা দিয়ে ঝিনাইদহ রোড পার হওয়ার সময় নিশ্চিত হয়ে নিয়েছিলাম আর্মি শহর ত্যাগ করেছে। এটাও আমাকে নির্বোধের সাহস জুগিয়েছিল শহরের মূল সড়কে যেতে। রাজাকারদের আন্ডার এস্টিমেট করেছিলাম। ভুলে গিয়েছিলাম রেজাউল করিম রিজুকে ৬৯-৭০ সালে নবম, দশম শ্রেণিতে পড়ার সময় দু বার পিটিয়েছিলাম। দ্বিতীয়বার যখন মার খেয়েছিল, তখন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। সে অপমান কেউ সহজে ভুলতে পারে?

তাছাড়া আমরা পুরো পরিবার কমিউনিস্ট ভাবাদর্শের সমর্থক কর্মী নেতা। আমার চাচাত ভাই, যিনি আমার ভগ্নিপতিও, তার নেতৃত্বে কমিউনিস্ট পার্টির বাহিনী মাগুরা মহকুমার মহম্মদপুর থানা দখল করেছে। সংঘর্ষে কয়েকজন রাজাকার মারাও গেছে। তার স্ত্রী আমার বড় বোন হেলেনা বু সরকারি উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়ের শিক্ষক, তখনও শহরেই ছিলেন। আমাদের পুরো পরিবারই ওদের টার্গেট। কেবল সময় গুনছিল। আমাকে ধরার মধ্য দিয়ে শুরু হলো এই পরিবার নিকেশ করার কাজ।’

‘ওদের কী জানার ছিল আপনার কাছে?’

‘আমি কোথায় রাতে থাকি, তিন বড় ভাই কোথায়, তাদের বাহিনীতে কতজন আছে, অস্ত্র পেয়েছে কোথা থেকে, মহম্মদপুর থানা আক্রমণের কতটা জানি, আমার বন্ধুরা কোথায়, আমাদের কাছে কি কি অস্ত্র আছেÑ এরকম হরেক ভিত্তিহীন তথ্য জানার জন্য মারছিল। ইন্টারোগেট করার সময় লম্বা চওড়া যুবকটির সুচারু নির্যাতনে বইয়ে পড়া নাৎসিদের কথা মনে হচ্ছিল।’

‘মাসুদ রানার ভক্ত ১৭ বছর বয়সী এসএসসি পরীক্ষার্থী কীভাবে সেই নির্যাতন মোকাবেলা করেছিল?’

‘ক্যাম্পে এনে কয়েকজন গোল হয়ে আমাকে নিয়ে ফুটবলের মতো খেলল। এরপর বাথরুমে হাত পা চোখ বেঁধে ফেলে রাখে। কিছুক্ষণ পরে একজন একজন করে জিজ্ঞাসাবাদ, সেই সাথে কিল চড়সহ বাঁশ, লোহার রড দিয়ে বেধড়ক মার। সর্বশেষ নখের নিচে পিন ঢুকানো। তখন যন্ত্রণা যেন শরীর থেকে বিদেয় হয়েছে। ব্যথা টের পেলেও গায়ে লাগছে না, তলিয়ে যাচ্ছিলাম কোন অতলে। সমানে গালি চলছিল। এত মার খেয়েও ‘ওরে মা, ওরে বাবা’ ছাড়া আর কোনো নাম না নেওয়ায় বেশি ক্ষোভ ছিল ওদের। ব্যথাভরা ঘোরের মধ্যে সাইকেলের ছবিটা ভেসে উঠছিল।’

‘আপনার বয়সী অনেকেই আবেগতাড়িত হয়ে মুক্তিযুদ্ধে গিয়েছিলেন, কিন্তু পারিবারিক আবহে আপনার প্রেক্ষাপট ছিল ভিন্ন। ওইটুকু বয়সে এত মার খাওয়ার পর কারো জীবন বাঁচানোর কথা ছাড়া আর কিছু মনে পড়ে!’

‘খুব প্রিয় ছিল ওটা। বড় ভাই’র হারকিউলিস সাইকেলসহ ধরা পড়ি। আগে ভয়ে কখনো ছুতাম না। আমি সাইকেল চালানো শিখি নবম শ্রেণিতে পড়ার সময়। বন্ধুরা সাইকেল চালাতে শিখেছে থ্রি ফোরে পড়ার সময় থেকে। আমার ছিল না। অন্যেরটা ধরাও নিষেধ ছিল। ফলে শেখা হয়নি। কলেজের মাঠে ফুটবল খেলে জিরানোর সময় স্ট্যান্ড করা বন্ধুর চকচকে সাইকেল নজরে এল। স্ট্যান্ড নামিয়ে সিটে বসে দু পা মাটিতে চেপে বসলাম। দু তিনজন আগ্রহ নিয়ে এগিয়ে এল। আমি প্যাডেল মারা শুরু করে ব্যালান্স রেখে কিছুটা এগিয়ে ছেড়ে দিলে দেখি পড়ে যাচ্ছি না। মাঠের আরেক মাথায় গিয়ে ঘুরিয়ে চলে এলাম। ব্রেক চেপে গতি কমাতে হয়। জানতাম না বলে থামাতে পারছিলাম না। শেষে দু পা মাটিতে চেপে ঠেকালেও পতন সামলানো গেল না। দু তিন জায়গা হালকা ছড়ে গেল। পরের কয়েকদিনেই সাইকেল চালানোর বিদ্যা সমাপ্ত হলো। সত্তর সালের শেষের দিকে ভাই সাইকেলযোগে পার্টির গোপন কাগজপত্র পৌঁছাতে আমাকে দূর গ্রামে পাঠাত। এভাবে সেই সাইকেলের ওপর দখল চলে আসে আমার।’

‘কোথায় নিয়ে নির্যাতন করা হয় আপনাকে? পালানোর ভাবনা এল কীভাবে?’

‘জায়গাটা ছিল জেলা বোর্ডের বাংলো। শহরের মধ্যবিন্দুতে। কোর্ট বিল্ডিংয়ের উত্তরে ট্রেজারি পুকুরের উত্তর পাড়ে সিএন্ডবি কোয়ার্টারের সাথে। এর সাথেই নোমানি ময়দান। কোনো এক অবাঙালি এসডিওর নামে মাঠ। তার সময়ে হয়েছিল। মাঠের উত্তরে আনসার ক্যা¤প। জাতীয় সব অনুষ্ঠান; ফুটবল, ক্রিকেট যাবতীয় খেলা এই মাঠে হয়। আমাদের প্রাণ এই মাঠ। বাথরুমের পরেই টয়লেট। এখানে মহকুমার বাইরে থেকে আসা সরকারি কর্মকর্তারা থাকতেন। দুপুরের দিকে ‘তোমাদের বাড়িতে খবর দিয়ে এসেছি, সন্ধ্যার আগে যে ভাবেই হোক পুলিশের হাতে হস্তান্তর ব্যবস্থা করতে। না করাতে পারলে অঘটন হবে। ওরা তোমাকে মেরে ফেলার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।’ মমিন ভাই কানের কাছে মুখ নিয়ে আমাকে কথাগুলি বলেই টয়লেটে ঢুকলেন। উনি খুব ভালো গোল কিপিং করতেন। বাথরুমের সঙ্গে সুইপার ডোর। নিচু হয়ে ঢুকতে হয়। দরজায় ঘুলঘুলিও আছে। সব মুখস্থ। এই শহরের খুঁটিনাটি আমার মতো কেউ জানত না। ওই দরজার বাইরে একজন রাইফেলসহ পাহারায় ছিল। আমাকে একবার ভাত আর গরুর মাংস খেতে দিয়েছিল ওই দরজা দিয়ে। গায়ের চকচকে জামাটা প্রথমেই খুলে নিয়েছিল। আসালত স্কুলে এক ক্লাস নিচে পড়ত। ভাত দেওয়ার সময় হাত, চোখের বাঁধন খুলে দিয়েছিল। চোখ দিয়ে টপটপ করে পানি ঝরছিল। আসালত হাসছিল। ভাবখানা, কেমন লাগে এখন। ইসলামী ছাত্র সংঘ যারা করত, তারা প্রকাশ করত না। ছাত্র ইউনিয়েনের প্রবল প্রতাপে মিইয়ে থাকত। কলেজ নির্বাচনে ছাত্রলীগ, সংঘ, এনএসএফ অনেক সময় ছাত্র ইউনিয়নকে হারাতে গোপন আঁতাত করত। তার পরেও বিপুল ভোটে হারত। সবাই কমিউনিস্ট বিরোধী হওয়ায় এই ঐক্য ছিল। আসালত দরজা খুললেই দেখলাম একটা টুল, পাশে ৩০৩ রাইফেল। দরজায় তালা মারার কড়া নেই। আমার মনে কিছু একটা উঁকি দিল। হাত নাড়াতে পারছিলাম না। বাঁশ, লোহার রডের বাড়িতে ফুলে ঢোল হয়ে আছে। বিশ্বাস হচ্ছিল না এটি নিজের হাত। কে যেন কানে কানে বলল, ‘খেয়ে নে, কাজে লাগবে।’ কষ্ট-ঘেন্না হলেও খেলাম। বিশেষ করে মাংসগুলি। পানি খাওয়ার সময় পাশে লোহার রডটাও চোখে পড়ল। খাওয়া হলে আবার পেছনে হাত মুচড়ে বেঁধে রাখল। চোখ বাঁধল না। ঠিক তখন রেডিওর শব্দ কানে এল। আকাশ বাণী কোলকাতা থেকে রবিবারের দুপুরের অনুরোধের আসর শুরু হলো। আমাদের সময় তিনটা থেকে চারটা পর্যন্ত প্রতি রবিবার অনুরোধের আসর হতো। তখন আমার কেন জানি মনে হলো, ওদের হাতে মরার জন্য আমার জন্ম হয়নি।’

‘বাঁচার অদম্য ইচ্ছাই বাঁচিয়েছিল। ছোটবেলা থেকে দুরন্ত আপনার প্রবল ইচ্ছাশক্তি ছিল।’

‘মাঝে মাঝে মনে হয় কত কিছু করার ছিল, পারিনি স্বভাবজাত প্রতিবাদী হওয়ায়… সব ভাইবোনের মধ্যে দুষ্টু ছিলাম। কুয়াশা বই পড়তে গিয়ে আব্বার হাত থেকে পালানোর গল্প তো বলেছি। আমি প্রতিদিন কোনো না কোনো ঝামেলা পাকাতাম। বাড়িতে রোজ নালিশ আসত। কারো গাছের ফল পড়া, কাউকে মারধর করা, ঘুড়ির সুতো ছিঁড়ে দৌড়ে পালানো। স্কুলের নামে বাড়ি থেকে বেরিয়ে মার্বেল খেলা, ঘুড়ি উড়ানো এগুলি প্রাত্যহিক কাজ ছিল। ঘুড়ি লাটাই মার্বেল এসব বাড়িতে রাখতাম না। ঘুড়ি লাটাই চুলার আগুনে ঢুকত। মার্বেল বাড়ির মধ্যে কুয়ো বা সামনের পুকুরে ফেলে দেওয়া হতো। কুয়ো সংস্কারে একবার ছোটখাটো এক বস্তা মার্বেল উঠেছিল। পানিতে থেকে স্থানে স্থানে ক্ষয়ে গেছে। বড়ো কষ্ট পেয়েছিলাম। কি খাটুনি আর বুদ্ধি দিয়ে এতগুলো মার্বেল জিতেছিলাম। এরকম ফেলে দেওয়ায় আবার মার্বেল জোগাড়ের সংগ্রাম শুরু হতো। তাকে থাকতাম মায়ের আঁচল খুলে পয়সা নেওয়ার। রান্না করার সময় সন্তর্পণে আঁচল খুলে এক আনা পয়সা নিয়ে আরো সাবধানে আটকে দিতাম। পরে বুঝেছিলাম মা সব টের পেত।’

‘বলেছিলেন মাসুদ রানা পড়া বিদ্যা পালানোর সময় কাজে লেগেছিল। কীভাবে পালিয়েছিলেন?’

‘খুব মনোযোগী পাঠক ছিলাম, রানার বুদ্ধির খেলাগুলোয় মজা পেতাম। যখনই মনে হলো রাজাকারদের হাতে মরা যাবে না, আশ্চর্য শক্তি ভর করল। খুব ধীরে একটুও শব্দ না করে সুইপার দরজা খুলে দেখি টুল খালি, আসালত নেই। হয়তো কোনো কাজে সাময়িক পাহারা সরিয়েছিল। আর এরকম নির্যাতনের পরে হাতের বাঁধন খুলে দিনের আলোয় কেউ পালাতে পারে, তা ভাবনার বাইরে থাকাই স্বাভাবিক। বাম দিকে বাংলোর মাঝখানের কামরার পেছনের দরজা পুরো খোলা। ওখানে শহরের পরিচিত রাজাকারদের তিন ছোট ভাই দেওয়ালে হেলান দিয়ে রেডিও শুনছে। আমি ডানের বারান্দা থেকে গড়িয়ে নিচে নেমে হামাগুড়ি দিয়ে দক্ষিণে ট্রেজারি পুকুর পাড়ের সরু রাস্তা দিয়ে কিছুটা ক্রলিং করে পার হলাম। বাংলোর পাঁচিল মাত্র তিনফুট উঁচু। ওটুকু পার হয়েই উঠে দৌড়। একটু পরেই এসডিওর বাড়ির উঁচু পাঁচিল। দু বার টপকালাম। দু পাশের গেটই খোলা। কীভাবে ওই হাত নিয়ে পাঁচিল টপকেছিলাম ভাবলে শিহরিত হই। মাসুদ রানায় পড়েছিলাম মৃত্যুভয়ে ভীত মানুষ যে গতিতে দৌড়াতে পারে, অলিম্পিকের দৌড়বিদও তার কাছে হার মানবে। লুঙ্গি কাছা মেরে খালি গায়ে দৌড়াচ্ছি আমি। মনে হচ্ছে পেছনে অসংখ্য মানুষ তাড়া করেছে। পরিচিত লোকজন বিস্মিত দৃষ্টিতে দেখছে। কিছু জিজ্ঞেস করার আগেই তাদের পেরিয়ে যাচ্ছি। মারের চোটে আমি যা, তার দুটির সমান হয়ে গেছি। নিজের হাত-পাকে বিশ্বাস করতে পারছি না। একটা চোখে কিছু দেখছি না। ঘুসিতে ফুলে বন্ধ হয় আছে। সরকারি হাসপাতালের পরে হাটুরে রাস্তা একটু গিয়েই বাঁক নিয়েছে পাড়ার মধ্যে। আমাদের পাড়ার লাগোয়া বা একই পাড়ার অন্যপ্রান্ত। কয়েকটি বাড়ি পেরুলেই বড় আম বাগান। ক্ষুধিরাম সাহার বিখ্যাত মালদহ, ফজলি আমের বাগিচা। ছায়াছন্ন বাগিচার অন্ধকারে ভুতের ভয়ে ছেলেবেলায় দলে বলে ছাড়া ঢুকতাম না।’

‘বাড়ির এত কাছে গিয়ে যেতে ইচ্ছা করেছিল নিশ্চয়?’

‘ওখান থেকে বাড়ির দূরত্ব পায়ে হেঁটে তিন মিনিট। যেতে খুব ইচ্ছা হলেও নিজেকে নিবৃত করেছিলাম। আমার জন্য পরিবারের সবাই মহা ঝামেলায় পড়বে। পরে জেনেছিলাম পালানোর পরপরই একটা দল আমাকে খুঁজতে গিয়ে পুরো ঘরবাড়ি তছনছ করে। হেলেনা বু কেঁদে ওদের চার্জ করে বলেছিল, ‘তোমরা ওকে মেরে ফেলে এখন এসব ভান করছ।’ পরে আমাকে পালাতে দেখা কেউ একজন বাড়িতে গিয়ে বেঁচে থাকা সম্পর্কে নিশ্চিত করেছিল।’

‘কতক্ষণ থাকলেন আম বাগানে? কী অনুভূতি হচ্ছিল তখন?’

‘আন্দাজে মনে হলো পাঁচটার মতো বাজে। আরো দু ঘণ্টার ওপর দিন। জুনের ২১ সবচেয়ে দীর্ঘতম দিন। সেদিন ২০ তারিখ। একটা ছোট জলাশয়। তার ওপারে কোমর সমান ঘন ফার্ন গাছ। আমি এখানে ঢুকেছি কেউ দেখেছে কিনা জানি না। ফার্নের মধ্যে শুয়ে হাত দিয়ে গাছগুলি নেড়ে দিলাম, যাতে দেখে মনে না হয় সদ্য কেউ ঢুকেছে। দুনিয়ার তাবৎ মশা আমার খোলা গায়ে ছেপে গেল। নিঃসাড়ে পড়ে থাকলাম। শারীরিক অনুভূতি পুরো টের পাচ্ছিলাম না। মিনিট পনেরো পরেই দেখলাম সাত আটজনের স্বশস্ত্র একটি দল আম গাছের দিকে তাকাতে তাকাতে হাঁটছে। কয়েক সেকেন্ডকে যুগ মনে হচ্ছিল। ওদের পায়ের শব্দ মিলিয়ে যেতেই মশার কামড় টের পাওয়া শুরু হলো। মানুষের কি বিচিত্র অনুভব, অনুভূতি। নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে পালিয়ে বেঁচে থাকাটা নিশ্চিত না হতেই মশার কামড় অসহনীয় হয়ে উঠেছে! দিনের আলো শেষে অন্ধকার হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। তারপর কোথায় যাব, কিভাবে যাব, যেতে পারব কিনাÑ কিছুই জানি না। আমার পলায়নের ঘটনায় ওরা ক্রুদ্ধ হয়ে আমাদের বাড়িতে কি ঘটায়, সে দুঃচিন্তাও কাজ করছিল। সময় চলমান, যত কষ্টেরই হোক। অপেক্ষা করা ছাড়া আর কোনো পথ নেই।’

‘শুনেছি সে বছর প্রচুর বৃষ্টি হয়েছিল। পানি পার হয়ে আগের রাতের ঢেরায় পৌঁছেছিলেন?’

‘হ্যাঁ। ’৭১ সালে জৈষ্ঠ্য মাস থেকেই প্রচুর বৃষ্টি হওয়ায় বর্ষাকালের আগেই মাঠে পানি জমে গিয়েছিল। পুরো অন্ধকার হলে আম বাগিচা থেকে বেরিয়ে ধানী মাঠ ধরে দক্ষিণে আগাতে লাগলাম আমি। সবে আষাঢ়ের শুরু। ধানী মাঠের পানিভরা ক্ষেতে কাদার মধ্যে পা ডেবে যাচ্ছে। শরীরে বল কম, খুব ধীরে হাঁটছি। মাঠের পরেই হাইওয়ে। কালভার্টের নিচ দিয়ে ওপাশের ধান ক্ষেতে যাওয়ার পর আস্তে আস্তে পানি বাড়তে লাগল। বিলের ভেতরে চলে এসেছি। খুব ধীরে পানি সরিয়ে চলতে চলতে এক সময় ডুব জল। তাও পেরিয়ে গতরাতে যে বাড়িতে ছিলাম তা খুঁজে বের করে সাজ্জাদকে ডেকে উঠানে বসে পড়লাম। ওরাও খবর পেয়েছিল আমার ধরা পড়ার। ধরাধরি করে ঘরের বারান্দায় নিয়ে বসাল।’

‘আপনি খুব শক্ত নার্ভের ছিলেন। তখন কী কোনো জায়গায় সামনাসামনি লড়াই শুরু হয়েছিল?’

‘নাহলে কী আজ তোমার সাথে কথা বলতে পারতাম? মুক্তিযুদ্ধের নয় মাসের মধ্যে প্রথম তিন মাস পাকিস্তানিদের এক তরফা হত্যাকাণ্ড আর নির্যাতনের ইতিহাস। কিছু প্রতিরোধের চেষ্টা হয়েছে, সন্দেহ নেই। তবে মুক্তিযুদ্ধ মূলত জুলাই থেকে দানা বাঁধতে শুরু করে। জুলাই থেকে ডিসেম্বর, এই পাঁচ মাস প্রকৃত লড়াই এবং প্রস্তুতির কাল। তখন দেশের কোনো একটি মহকুমা শহরও, এখনকার জেলা, মুক্তিবাহিনীর দখলে ছিল না। থানাগুলির যাতায়াত সহজ না হওয়ায় এবং বর্ষার পানিতে ভরা থাকায় মুক্তিবাহিনীর করায়ত্ব ছিল। তবে পাক আর্মি কোনো অভিযান চালালে সম্মুখ সমরে যেত না মুক্তিযোদ্ধারা। সম্মুখ সমরের ট্রেনিং এবং অস্ত্র বাঙালি সেনা, ইপিআর বাদে সাধারণ মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে ছিল না। ভারত বা স্থানীয় বাহিনী কর্তৃক প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত মুক্তিবাহিনীর হাতে সর্বোচ্চ এলএমজি ছিল। সে কারণে গেরিলা যুদ্ধই প্রধান কৌশল গণ্য হয়েছিল। সেনাবাহিনী, ইপিআর এর জোয়ান মুক্তিযোদ্ধারা কোথাও কোথাও সম্মুখ সমরে অবতীর্ণ হয়েছে।’

‘যুদ্ধের ট্রেনিং তখনও না থাকায় এমন সিদ্ধান্ত ছাড়া উপায়ও তো ছিল না।’

‘২৫ মার্চে পাকিস্তানি বাহিনীর ক্রাক ডাউনের পরে এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহে মাগুরায় কয়েকজন স্বশস্ত্র ইপিআর সদস্য এসেছিলেন। তখন তোড়জোর চলছে যুদ্ধ প্রস্তুতির। ইতিমধ্যে ট্রেজারি, থানার অস্ত্র সব দখলে চলে এসেছে। সবকিছু আওয়ামী লীগ ছাত্রলীগের নেতাদের নিয়ন্ত্রণে। আমরা যারা ছাত্র ইউনিয়নের কর্মী-সমর্থক-নেতা সকলেই তাদের সঙ্গে। ইপিআর এবং আর্মির স্থানীয় যারা অবসরে যাওয়া জোয়ান, তাঁরাও একত্র হয়ে ট্রেনিং এর ব্যবস্থা করেছিলেন। ট্রেনিংয়ের প্রথম ট্রুপের দ্বিতীয় নম্বরে আমার নাম ছিল। কাঠের রাইফেল হাতে নদীর ওপারে বিরাট আম বাগিচায় শুরু হলো প্রশিক্ষণ। আম বাগানের পাশে বিরাট অঞ্চল নিয়ে বাঁশবন। কাঠের রাইফেলের পর্ব শেষে দু দিন সত্যিকারের রাইফেল ট্রেনিংয়ের সৌভাগ্য হয়েছিল। তারপরেই যশোর ক্যান্টমেন্ট থেকে আর্মি মাগুরার উদ্দেশ্যে রওনা হচ্ছে বা হয়েছে এরকম সংবাদের ভিত্তিতে সব স্থগিত হয়ে যায়। একদিন সকালে দেখা গেল আনসার ক্যা¤প ফাঁকা, সবাই শহর ত্যাগ করেছে। যাওয়ার আগে কোনো নির্দেশনা দিয়ে যায়নি। ব্যাংক থেকে সকল টাকা, অস্ত্র নিয়ে ভারতের সীমান্তের দিকে ধাবিত হয়েছে। পড়ে থাকা মানুষ কি করবে কেউ জানে না। সে এক বেদনাদায়ক অনুভূতি। আমাকে ধরে নেওয়ার পর হাতের কনুই পরীক্ষা করে অশ্রাব্য গালাগালি আর মার দিচ্ছিল। ওরা সব জানত। এদেরও কেউ কেউ ট্রেনিংয়ের গ্রুপে ছিল। গণ প্রশিক্ষণ। ১৫-১৬ বছর থেকে ২৩-২৪ পর্যন্ত যারা, তাদের অনেকেই নিজ উদ্যোগে প্রশিক্ষণ নিতে শুরু করেছিল। প্রতিরোধের সে এক অভূতপূর্ব জাগরণ। কিছুই টিকল না। রাতের আঁধারে কোনো বার্তা না দিয়ে দলীয় লোক লষ্কর নিয়ে ভারতের উদ্দেশ্যে চলে গেল।’

‘আমরা মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে পূর্ণাঙ্গ কোনো উপন্যাস বা চলচ্চিত্র পাইনি এখনো। এটার কারণ কী বলে আপনার মনে হয়?’

‘পাঁচ মাসে কি একটা জাতির পরিচয় তৈরি হয়? তা যে কোনো ঘটনায় হোক না কেন। হত্যা, মৃত্যু, নির্যাতন, দুর্দশার কাহিনি সম্বলিত ইতিহাসে যুদ্ধের ঘটনা অনেক কম। এই পাঁচ মাসের মধ্যে যা যা সংঘটিত হয়েছে, তা দিয়ে কোনো ভালো উপন্যাস বা চলচ্চিত্র নির্মাণ সে জন্যই হয়ে ওঠেনি। যা হয়েছে তার বেশিটা কেবল পাক হানাদার বাহিনীর নৃশংসতার বিবরণ। তা ছাপিয়ে আর কিছু এগিয়ে যেতে পারেনি। সে জন্য মুক্তিযুদ্ধ মানেই খুন, ধর্ষণ, অগ্নিসংযোগ, নির্যাতন।’

‘আমার জন্ম অন্য গ্রামের এক বাড়িতে, যেখানে আমার পরিবার পালিয়ে গিয়েছিল। আমার খালাত বোনের শ্বশুর বাড়ি, যারা ওই এলাকার প্রভাবশালী এবং বিত্তবানও বটে। এখন ভাবাই যায় না এই হৃদ্যতা।’

‘মুক্তিযুদ্ধের সময় গ্রাম শহরের মানুষের মধ্যে অন্যরকম এক হৃদ্যতা গড়ে উঠেছিল। গ্রামের মানুষ শহর থেকে যাওয়া আত্মীয়, অপরিচিতদের সাহায্যে মুক্ত চিত্তে এগিয়ে এসেছিল। প্রত্যাখ্যানের ঘটনাও আছে, কম হলেও। সবচেয়ে নির্মম হলো প্রায় এক কোটি মানুষের দেশ-ত্যাগে শরণার্থী হয়ে যাওয়া। এর মধ্যে নব্বই শতাংশ হিন্দু ধর্মাবলম্বী। তারা সর্বস্ব হারিয়ে বা ত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছিল। দলে দলে মানুষ লুটে অংশ নিয়েছিল। গ্রামের বাড়িঘরের কিছুই অবশিষ্ট ছিল না। শহরের বাড়িগুলির দখল নিয়েছিল শান্তি বাহিনী বা রাজাকাররা। এই লুটপাটে অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে কোনো দলীয় পরিচয় ছিল না। দলমত নির্বিশেষে সবাই অংশগ্রহণ করেছিল। পরবর্তীতে রাজাকার বাহিনী, শান্তিবাহিনী গঠিত হলে তারা আবার অন্য দলীয়দের বাড়িঘর থেকে যা পেরেছিল লুটে আনে। যারা মুক্তিযুদ্ধ, প্রতিরোধ যুদ্ধে অংশ নিয়েছিল, তাদের অনেকের বাড়িঘরে অগ্নিসংযোগ লুটপাটের ঘটনা আছে। কিন্তু হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপরে যে নৃশংসতা হয়েছে তা অবর্ণনীয়। এর অধিকাংশটাই হয়েছে পাকিস্তানিরা দখল নেওয়ার আগেই। পরেও হয়েছে। তবে এপ্রিল থেকে জুন মাসের মধ্যেই ব্যাপক ছিল।’

‘পঞ্চাশ বছর পূর্ণ হচ্ছে। এখনো আমরা মুক্তিযোদ্ধা তালিকা সম্পূর্ণ করতে পারিনি। আপনার কি মনে হয়?’

‘প্রতিবাদ, প্রতিরোধহীন মৃত্যুকে আত্মত্যাগ বলা যায় কি? অন্যায় হত্যা আখ্যায়িত করা যায়। এ দেশে অধিকাংশ হত্যাকাণ্ড তাই-ই ছিল। কতজন মানুষ যুদ্ধ, প্রতিরোধ, প্রতিবাদে নিহত হয়েছেন, তার হিসাব নেই। মোট নিহতের সংখ্যা বলা হলেও তাঁদের নামের কোনো তালিকা করা হয়নি। এর থেকে মর্মান্তিক আর কি হতে পারে!’

‘আপনার পরিবারের সাথে মুক্তিযুদ্ধ যেভাবে জড়িয়ে আছে, তা যেমন গর্বের, তেমন বেদনার…’

‘মা, আব্বা, ছোট এক ভাই, চার বোন ছাড়া আমরা বড় চার ভাই বাড়ি ছেড়েছিলাম। চারজনের মধ্যে আমি ছোট। বাড়ি থেকে তিন চার মাইল দূরে গ্রামের পরিচিত, বন্ধুদের বাড়িতে রাত কাটাই। দিনের বেলা কখনও কখনও সময় বুঝে পেছনের বিভিন্ন বাড়ির ভেতর দিয়ে বা রাস্তা এড়িয়ে আম কাঁঠালের গাছ গাছালির ভেতর দিয়ে পেছনের পাটখড়ির বেড়া ফাঁক করে এক নজর সবার সঙ্গে দেখা করেই চলে যেতাম। কিছু খেতে দিলে বাড়ির ভেতরে খেতাম না। ঘর এড়িয়ে পশ্চিমের বাড়ির পেছনে দাঁড়িয়ে যত দ্রুত গেলা যায়, খেয়ে বেড়া গলে বের হয়ে আসতাম। ওই সময়টুকুও বাড়ির বাইরে ছোট কাউকে মজুদ রাখা হতো পাহারায়। এর আগে একবার মিলিটারি চড়াও হয়েছিল বাড়িতে। তছনছ করে ফেলেছিল সবকিছু। বাড়িঘর খোলা রেখেই পরিবারের সবাই বাড়ি ছেড়েছিল। যে কোনোদিন মিলিটারি আসতে পারে এরূপ আশঙ্কায় কেউ না কেউ সদর রাস্তায় নজর রাখত। সকাল দশটার সময় মিলিটারির গাড়ি বাড়ির অনতিদূরে দেখামাত্রই মা বাবা ভাই বোন সকলেই পেছনের পাটখড়ির বেড়া ভেঙে সরে যেতে পেরেছিলাম। মা বাবাসহ সকলেই শহরের অনেক বাইরে গ্রামের মধ্যে চলে এসে মোটামুটি ধরা পড়ার হাত থেকে বেঁচেছিলাম। ওখান থেকে ৫-৬ মাইল দূরে নানি বাড়িতে চলে এসেছিলাম। দু তিনদিন পরে মা আব্বা ছোট ভাই চার বোন বাড়ি ফেরে।

মুক্তিযুদ্ধের গবেষণা গ্রন্থ রচনায় অন্যের জন্যে বেগার দিয়েছি, অথচ নিজের বোনকে নিয়ে কিছু লিখিনি। অনেকবার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়েছি। আবেগ দমন করতে পারিনি। টেলিভিশন প্রতিবেদনের জন্য এলে একটু বলার পরে শেষ করতে পারিনি। অন্য কেউ এগিয়ে আসেনি তাঁকে নিয়ে লিখতে। আমি পালাতে না পারলে হয়তো আমার বোন বেঁচেও যেতে পারতেন। এই পরিবারের কারো একজনের প্রাণ হরণ ছাড়া জামায়াতে ইসলামী বা ইসলামী ছাত্র সংঘের সকলের চোখের ঘুম হারাম হয়ে গিয়েছিল। ৫ অক্টোবর ভোররাতে পাকিস্তানি মিলিটারি এবং তাদের সহযোগী রাজাকাররা লুৎফুন নাহার হেলেন বু’কে নৃশংসভাবে হত্যা করে। তাঁর মরদেহ পাওয়া যায়নি। নিজেকে মাঝে মাঝে অপরাধী লাগে। এমন শক্তিমান একজন মানুষের শক্তির কথা অজানাই রয়ে গেল। তবু আশায় বাঁচি, হয়তো কেউ না কেউ একদিন কাজ করবে হেলেন বু’কে নিয়ে।’

যাকে নিয়ে এই লেখা: জাহাঙ্গীর কবীর। প্রাক্তন বাম রাজনৈতিক কর্মী। যিনি ছাত্রজীবন, কর্মজীবনের পাশাপাশি লিটল ম্যাগাজিন, দৈনিক পত্রিকার সাহিত্য পাতায় লিখতেন। ২০১৫ থেকে ২০২০ পর্যন্ত চারটি বই প্রকাশ করেছেন। মাগুরা জেলায় বাস করছেন এখন।

জাকিয়া খান। গদ্যকার। জন্ম ১৯৭১ এর নভেম্বর, বাংলাদেশের ঢাকায়। পড়াশুনো করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে 'বাংলা সাহিত্য' বিষয়ে। পেশাগত জীবনে তিনি শিক্ষকতার সঙ্গে যুক্ত। প্রকাশিত বই: ‘বিশ্বের আলোচিত ১০ ক্ষমতাধর নারী শাসক’ (প্রবন্ধগ্রন্থ, ২০১৪), এবং ‘আমাদের পাখিরা’ (শিশুতোষগ্রন্থ, ২০২০)।

এই বিভাগের অন্যান্য লেখাসমূহ