প্রক্সি
তারপর ইলেকট্রিক বিল জমা দিতে যাবো। আমার দেরি হবে আসতে। স্বামী অমর বলে, ঠিক আছে।…..
দৃশ্যপট এক:
ল্যাবএইড হসপিটালের দাররক্ষকের এক হাত বারংবার ঘাড় চুলকে যাচ্ছে, অতি জরুরি কাজের মধ্যে এই কাজটিই করছে সে ঘুরেফিরে। ব্যস্ত মানুষদের আনাগোনা দিব্যি চলছে রোজকার মতোই। ঠান্ডা দরজায় কাঠ হয়ে বসে থাকার মাঝে ঘাড় চুলকানোই আনন্দদায়ক বিষয় হতে পারে তার কাছে। দামী পোশাক পড়া মানুষের আনাগোনা এখানে বেশ। পাশেই ভূতের গলির সরু চাপা রাস্তা, সিগন্যালে বসে থাকা কয়েকশো লোকের মাঝে এক জোড়া নিঁখুত সুন্দর বাদামী চোখ হসপিটালের বন্ধ এবং খুলে যাওয়ার খেলায় ক্রমাগত ব্যস্ত ঠান্ডা দরজার দিকে নিবদ্ধ। কত লোকের আনাগোনা এই পথে, মৃত এবং জীবিত। জীবন মৃত্যুর খেলায় রোমাঞ্চকর কিছু আছে বলে শাওনের মনে হয়না, প্রতিদিনের একঘেয়েমিপনা সহ্য করে করে দারোয়ানটাও হয়তো বিরক্ত জীবনের প্রতি। এদের প্রতি শাওনের করুনা হয়, মাঝে মাঝে মায়াও জন্মে হয়তো। নিজেকে তার চিল মনে হয়, ভুবন চিল! উড়ে উড়ে রোমাঞ্চের দরজা ঠিক সে খুলে দেয়। ঘাড় চুলকানো দাররক্ষী আর হুইল চেয়ারে আনাগোনা জীবনের অভিশাপ বয়ে বেড়ানো মানুষের পা থেকে মাথা অব্ধি বিরক্তি এবং ক্লান্তির ছায়া সে ঘৃণা করে। শৈশবের বিভিন্ন জিজ্ঞাসায় সে নিজেকে বারবার চিলের রূপে সাজাতে চেয়েছে। চিলের মতো নিখুঁত সুন্দর হতে চেয়েছে, তীর বেগে ঝাঁপিয়ে পড়তে চেয়েছে জীবনের খুঁজে, অসহায়ের দিকে। অসহায়ত্ব নোংরা আবর্জনার মতো,যার প্রতি কোনোদিন ভালোবাসা জন্মায়নি তার ক্ষণকালেও। দামী ফ্ল্যাটে লাল কার্পেটের বুননে বুননে সে প্রতিদিন দক্ষ হওয়ার শিক্ষা নিয়েছে, হয়তো জীবন একটাই, কিংবা জীবন বলতে শুধু কিছু দৌঁড়ঝাপ, কারো কারো ক্ষেত্রে মেঝেতে পড়ে থাকা অলস দেহ।
জীবনকে পরিপূর্ণ করতেই সে তার বাদামী রঙকে চকচকে কালো জ্যাকেটে জড়িয়ে শিকারে বের হয়, কালো ডানা রানার নাইট রাইডার নিয়ে। শৈশব থেকে বেড়ে উঠা চিল শরীর গুছিয়ে চেয়ে থাকে শিকারের দিকে।
শরীর তার – ভুবন চিলের মতোই কালচে-বাদামি দেহে কালো জলছাপ যেন! চিল-মাছের লেজের সৌন্দর্য নিয়ে কি সুন্দর মাথার উপর উড়ে । ডানার নিচের সাদা চোরাদাগ আর মোলায়েম পেটের পশম, এই সৌন্দর্য বোধের জগৎ আর কতজনেরই আছে! বাদামি মেয়ে যেন ভাজে ভাজে শুয়ে আছে চিলের পেটে! চোখে নিচের পৃথিবী, যা মূলত শিকারের মন্ত্রমাঠ। তীক্ষ্ম বাদামী চোখ দৃষ্টির বর্শা নিক্ষেপ করে শিকারের দিকে।
শাওনের তীক্ষ্ম দৃষ্টিও শিকারের দিকে। জীবনানন্দের সোনালি ডানার চিল পড়তে পড়তে ভালোবেসেছে চিলকে, আহা! চিল! সোনালি ডানার চিল! লেজ ছড়ানো লালচে আভায় উপচে পরে আভিজাত্য!
ল্যাবএইডের দরজা, ঘাড় চুলকানো বুড়ো দাররক্ষী, ব্যস্ত মানুষের ফাঁকে সে চিল চোখে ব্যাগটি দেখে, কফি কালার হ্যান্ডব্যাগ মেয়েটার কাঁধে আলতো করে পড়ে আছে। শাওন তার রোদ চশমায় মেয়েকে পরখ করে, শিকার ঠিকঠাক কিনা দেখে নেয়, যদিও এই রাত আটটায় রোদ চশমার কোনো প্রয়োজন নেই, কিন্তু শাওন প্রয়োজনের জন্য কিছু করেনা, ছোট থেকেই সে প্রয়োজনকে উপেক্ষা করে অপ্রোয়জনীয় সবকিছুকেই প্রিয় বলে জানতে শিখেছে।
সে পুনরায় মেয়েটিকে দেখে, কালো টিশার্ট আর জিন্স পরা তরুনী, পনিটেইল করে বাধা চুল, বড় কালো টিপ এবং কালো ফ্রেমের চশমা। মেয়েটি নিঃসন্দেহে সুন্দরী, শাওন ভাবে – শিকার ঠিক ই আছে! তার চোখে নেশা জাগে একমুহূর্তের জন্য, অন্যের গাছ জুড়ে যে তারাফুল ফুটিয়েছে তা মিলিয়ে গেছে অনেক আগেই কুয়াশার সাথে। সেই মুখের আদলে মেয়েটি কারো জন্য অপেক্ষা করে কিন্তু একবারো মোবাইল বের করেনা, তাহলে মোবাইল আছে সেই স্টাইলিশ কফি কালারের ব্যাগে, যদিও ব্যাগ দেখে তার তেমন দামী মনে হয়না!
সে নিজেই নিজেকে শোনায় যেন!
একেকদিন একেক ঢংয়ের ব্যাগ নিয়ে বের হয় সুন্দরীরা, এটা শাওনের জানা আছে, তাই সে বিচলিত হয়না।
বাইকের পিছনে তার বন্ধু বসে আছে, অভি।
সে অভিকে শিকার চিনিয়ে দিয়ে বাইক স্টার্ট দেয়! বড় করে নিঃশ্বাস নেয়, লক্ষ্য সামনের ওভারব্রিজের নিচে অল্প আলোয় দাঁড়ানো অন্যমনস্ক তরুণী, তার শিকার চোখ দেখে বুঝার উপায় নেই আসলে কি ঘটতে চলেছে পরবর্তীতে।
দৃশ্যপট দুই:
তরুনীর ব্যাগ নিতে অভিকে কোনো প্রকার বেগ পেতে হয়নি, ব্যাগ টান দিতেই উড়ালপঙখী উড়িয়ে শাওন চলে এসেছে সুন্দরীর থেকে অনেক দূর। চিল ডানা ছড়িয়ে শিকার ঠোঁটে চলে এসেছে ভূতের গলির অলিগলি টপকে কলাবাগান।
সুন্দর ফ্ল্যাটবাড়ির ৭ তলায় লিফট চেপে দুইবন্ধু যেন হাসার ফুসরত পায়। তারা মেয়েটির চিৎকার কল্পনা করে আরো জোরে জোরে হাসে।
বন্ধ দরজার নব ঘুরিয়ে দরজা খুলে তারা ঘরে প্রবেশ করে। ছিমছাম পরিপাটি গুছানো ড্রয়িংরুম, দেয়াল জুড়ে অদ্ভুত অদ্ভুত সব পেইন্টিং, প্রায় সবই উড়ন্ত কিছুর,কিছু ঝড়ের আবার কিছু উত্তাল সমুদ্রে । পাশেই বড় বড় দুইটা বেডরুম, সেগুলোতেও সুদক্ষ হাতের যত্নের ছাপ স্পষ্ট। সে সবকিছু গুছিয়ে রাখতে এবং সব কাজ গুছিয়ে করতে পছন্দ করে।
তারা শাওনের ঘরে ঢুকে, লাল গালিচায় পদক্ষেপ ফেলে দ্রুত বিছানায় শুয়ে যায় শাওন। সিগারেটে টানতে টানতে ভাবে অজস্র মুখচ্ছবি। দৃশ্যের ছন্দপতনে ভেসে উঠে সকালে কাজের বুয়ার কচুপাতার শাড়ি, ভার্সিটির ঝালমুড়ি মামার ফুলের মতো ছড়িয়ে থাকা মুড়িগুলো আর তরুণীর সুন্দর মুখ, চোখে অপেক্ষার মোহ, ভেসে উঠে দাররক্ষীর চুলকানো হাত।
অভি প্রতিদিনের অভ্যাসগত কাজ সারে, ডেটল দিয়ে ঘষে ঘষে হাত ধোঁয়, এতে হয়তো ছিনিয়ে আনায় যে পাপ হাতে লাগে তা পানির স্রোতের সাথে গড়িয়ে গড়িয়ে কানা গহবরে হারিয়ে যায়। প্রিয় সাদা তোয়ালে পিঠে জড়িয়ে ফ্যানের দিকে তাকিয়ে জোরে জোরে নিঃশ্বাস নেয় কয়েকবার, এতে শ্বাসপ্রশ্বাস ধীর হয়ে আসে, শান্ত বালকের মতো কাজ করে হৃদপিণ্ডটা।
প্রাত্যহিক কাজ সেরে তারা দুজন ব্যাগ নিয়ে বসে। আনমনে কথা বলে, ব্যাগের এক ফিতে তো ছেড়া! শালীর ব্যাগে কি আছে কে জানে।
বিসমিল্লাহ বলে অভি চেইন খুলে, শাওন বসে বসে দেখে। এখন চোখে সানগ্লাস নেই, সুন্দর চোখেমুখে পবিত্র আলো খেলছে যেন।
অভি সব উলোটপালোট করে ফেলে খুঁজতে খুঁজতে, যে জন্য ব্যাগ শিকার করলো সেরকম কিছুই নেই ব্যাগে, কোনো টাকাপয়সা, অলংকার, দামী কিছুই নেই। রাজ্যের আজাইরা জিনিসে ব্যাগ ভর্তি।
চোখভর্তি অস্থিরতা নিয়ে সে শাওনের দিকে তাকায়!
শাওন গম্ভীরমুখে বলে ব্যাটা মোবাইল খোঁজ! মিনিমাম একটা মোবাইল তো নিশ্চয় আছে! তখন তার মনেও সন্দেহ! মেয়েটা একবারো মোবাইল বের করেনি! পাক্কা ১০ মিনিট মেয়েটাকে সে অবসার্ভ করেছে!
তার মেজাজ খারাপ হয়!
অভি মোবাইল খুঁজে পায়! নোকিয়া ১৬০০ মডেলের বিক্রি অযোগ্য একটা জিনিস। স্কিনে ফাটল ধরা, বাটনের চাপে বিশ্রী শব্দ হয়। এইটা দিয়ে কি করবে! বড়জোর ২০০ টাকা বেঁচতে পারবে!
শাওন রাগে ব্যাগ টেনে নেয় অভির কাছ থেকে! কিছুতো নিশ্চয় আছে! আছেই!
সে ব্যাগের সব জিনিস ফ্লোরে ফেলে! তারপর সব চেইন উল্টেপাল্টে দেখে, শুধু ৫০ টাকার একটা নোট ছাড়া আর কোনো টাকা নেই। দুইটা কলম, একটা পেন্সিল, একটা লিপস্টিক আর কিছু লেখাভর্তি কাগজ! এছাড়া একটা সবুজ রঙের লাইটার, সেটাও গ্যাস ফুরিয়ে শেষের দিকে! দুইটা রয়েলনেক্সটের প্যাকেট! একটার ভেতর পাঁচটা গোল্ডলিফ, অন্যটায় একটা সাদা কাগজে কিছু গাঁজার গুড়ো, আর বাদামী রেজলা!
৫০ টাকা ব্যাগ নিয়া মাগী বিড়ি আর গাঞ্জা টানে! শাওনের রাগ হয়! প্রচন্ড রাগে সে ব্যাগটা ছুঁড়ে মারে দরজার বাইরের বারান্দায়। বারান্দা অর্কিডে ছেঁয়ে আছে, প্রায় একুশ জাতের অর্কিড সেই আড্ডায় গল্প করে রোজ।
তখনি মেয়েটির মোবাইলে কল আসে, শাওন বিরক্ত হয়, অভি চুপ করে বসে আছে, তার মুখভঙ্গিতে কিছুই মনে হচ্ছেনা,নিরুত্তাপ – নিরুত্তেজ। শাওন মোবাইল তুলে নেয় হাতে, বাথরুমের ঢুকে সে তৎক্ষণাৎ মোবাইল খুলে সিম বের করে।
তারপর কমোডের ফ্লাসে মিলিয়ে যায় সেই সিম! সেই সিমে আসা যত কল, যত এসএমএস! শাওন যদি কলটা ধরতো তাহলে ওপাশের উদ্বিগ্ন কোনো কন্ঠস্বর শুনতে পেতো, যে তার প্রাণের মানুষকে খুঁজে পাওয়ার জন্য অনবরত ফোন দিয়ে যাচ্ছে, জানতে চাচ্ছে সে কোথায় আছে, উপবন এক্সপ্রেসে তাদের শ্রীমঙ্গল যাওয়ার কথা প্রথম হানিমুনে!
সে নিজেকে গালমন্দ করে, শালা শুয়োর এতোদিনেও শিকার চিনোনাই! জীবনে এই প্রথম তার এতো বড় ভুল হলো। সে ব্যাগের সব জিনিসপত্রে লাথি দেয়, যেন মেয়েটির উপর রাগ ঢালছে সবকিছুর উপর। লাথিতে কাগজ উল্টে যায়, শাওন বিস্ময় চোখে দেখে মুক্তোর মতো লেখা কাগজ জুড়ে! কি সুন্দরই না লাগে!
সে কাগজ গুলো তুলে নেয় হাতে, উল্টেপাল্টে দেখে লেখাগুলো! সব কবিতা লিখে ভরা!
আহ্লাদী তারাফুল! ফুটে কেবলই মিলায়ে যায়!
আহা তারাফুল ফুটেই কেন মিলাতে হবে, শাওনের বোধে আসেনা। সে মরিয়া হয়ে মেয়েটির সব কাগজ ঘাঁটে, জিনিসপত্র ঘাঁটে, সেই সুশ্রী মুখ তার চোখে ভাসে, যে একজন কবি! যে হয়ত রেজলায় গাঁজা পুড়ে ফুঁকতে ফুঁকতে দুঃখকে কবিতা বানিয়ে আকাশে উড়ায়, আহা তার কবিতা, তার কাছে কত দামী!
শাওনের মেয়েটির জন্য তারাফুল ফুটে। ২য় বার সে তা মিলিয়ে দিতে চায় না! অস্থির হয়ে ঠিকানা খুঁজতেই থাকে… খুঁজতেই থাকে তার শিকারি চোখ!
তারপর ইলেকট্রিক বিল জমা দিতে যাবো। আমার দেরি হবে আসতে। স্বামী অমর বলে, ঠিক আছে।…..
নভেম্বর চলছে। অনির সাথে আজ দেখা হবে তা জানাই ছিল। এই তো ক’দিন আগেই দেখা…..
বুড়িমাসি বলেন,জীবনটা বালির ঘর গো।ঢেউ এলে ধুয়ে যায় জীবনের মায়া।তবু বড় ভালবাসা ওদের দাম্পত্যে।রোদের চাদরের…..
এক ড্রইং রুমে বসে রয়েছে সদ্য কিশোর উত্তীর্ণ তরুণ গোয়েন্দা সজীব। সামনের টেবিলে ছড়িয়ে…..