সন্ত জোয়ান অফ আর্ক আর বিচারের বাণী
কবিশেখর কালিদাস রায়ের চাঁদ সদাগর কবিতার একটা পংক্তি ছিল, ‘মানুষই দেবতা গড়ে, তাহারই কৃপার পরে,…..
হাতের লাঠিতে ভর করে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে নিত্যদিনের মতো ঝাঁকড়া হিজল গাছটার নিচে এসে দাঁড়ায় হারাধন পাল। বেলা এখনও তেতে ওঠেনি। কালিন্দীর বুকের উপর দিয়ে আশ্বিনের গা সওয়া তপ্ত হাওয়া বইছে। সুরেশ পাটনির নাও ঘাটের কাছেই বাঁধা। অন্যান্য ঘাটজীবীদের আনাগোনা শুরু হলেও সরব হয়নি নদীপাড়। তাই নদী পারাপারের কোলাহলও অনেকটা কম।
হারাধন পাল হিজল গাছের ধুপছায়ার নিচে বাঁশের পাটাতনের উপর গা এলিয়ে বসে। আধ বুজা চোখে তার আপন জগতে নিমগ্ন হয়। অন্যদিন ঘাট পার হতে আসা পরিচিত জনার সাথে নিচু স্বরে দু’একটা কথা বললেও আজ একেবারে ঝিম মেরে বসে থাকে সে। বেলা বাড়ার সাথে সাথে গাঁয়ের মানুষের সমাগম বেড়ে যায় সেখানে। আজ এখনও সুরেশ পাটনিকে দেখতে না পেয়ে একটু অস্থির হয় সে। বিড় বিড় করে নিজের মনেই প্রশ্ন করে, এত দেরি করছে ক্যান সে? শরীর খারাপ করল নাকি ?
নদীর ক্ষীণমধ্যে বুক সমান জল থৈ থৈ করে। যদিও চৈত্র-বৈশাখে শুকিয়ে একেবারে হাঁটুর নিচে নেমে আসে জল। মাটির রসে তখন ফিরে আসে লুক্কায়িত যৌবন। নদীর উদাম বুক সবুজ ফসলের সমারোহে আদিগন্ত হেসে ওঠে। ধূসর জলের কালিন্দী তখন হয় সবুজের সর্পিল মাঠ।
অধীর অপেক্ষায় হারাধনের গলা শুকিয়ে চৈত্রের সেই রুক্ষ মাটির মতোই চৌচির হয়ে যায়। একসময় সুরেশকে ঘাটের দিকে আসতে দেখেই সে ব্যস্তসমস্ত হয়ে হাত ইশারা করে ডাকে। ঘাটের দিকে না গিয়ে সুরেশ পাটনি হারাধনের কাছেই আসে। উন্মুখ হয়ে হারাধন কিছু একটা জিজ্ঞাসার আগে খানিক ভেবে নেয়। কিন্তু, তার আগেই সুরেশ বলে, তুমি আইজও আবার আসছ?
হোসেনের কোনো খবর আছে? তার খবর কিছু জানো? হারাধন আকুল হয়ে প্রশ্ন করে।
আমি তো কইলাম, কোনো খবর পাইলেই তোমারে জানামু। তুমি আর কত তালাশ করবা? আর কত অপেক্ষা করবা? এইবার তুমি বাড়িত যাও।
তুমি তো অনেকদিন আমাগো বাড়ির পর যাও না। আমাগো বাড়ির পথ একেবারে ভুইলা গেছ।
ঠিক আছে, যামুনে।
কত লোক গাঁও থিকা নিত্য গঞ্জের দিকে সাত সদাই নিয়া যায়। কত কামে এদিক ওদিক যায়। আবার তারা তোমার নাওয়ে পার হইয়া গাঁয়ে ফিরা আসে। কত মানুষের খোঁজখবর লইয়া তুমি আস। তাগোরে হোসেনের কথা একটু জিগাও।
তুমি বাড়ি যাও হারাধন। আমি খবর লইয়া আসমুনে।
দুই আশ্বিন গত হইছে। আইজ দুই বছর ধইরা তুমি একই কথা কও।
হারাধন অবুঝের মতো অবিশ্বাসী দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে থাকে সুরেশের দিকে। তার এই সকরুণ চাহনি সুরেশের বুকে বড়শির মতো বিঁধে থাকে।
তুমি বাড়ি যাও এইবার। কামের আইজ ম্যালা দেরি হইছে। আমার শরীরের হাল ভালা না। সাঁঝের আগেই বাড়িত ফিরা যামু।
কথা আর না বাড়িয়ে সুরেশ ঘাটের দিকে এগিয়ে যায়। হারাধন তারপরও পাটাতনে বিছানো হোগলার চাটাইয়ে বসে গাঁয়ের লোকের আনাগোনা দেখে, নাও পারাপার দেখে। ঝাপসা চোখ কী যেন খুঁজে বেড়ায় শুধু। সবার মধ্যে সে নমিতা আর হোসেনের ছায়া খুঁজে বেড়ায় বারবার। বুকের মাঝের কষ্টের কথাগুলো শুধুই আড়মোড়া ভেঙে তল খোঁজার চেষ্টা করে। কোনোটা আবার কূলের কাছে আছড়ে পড়ে অবহেলায় হারিয়ে যায়। শেষে কোনো কথাই আর ঠাঁই খুঁজে পায় না।
ঘাটলা ঘেঁষে মান্দার, করচ আর হিজলের গাছগুলো নুয়ে থাকে জলের বুক ছুঁয়ে। মান্দারের লাল লাল ফুলগুলো ভেসে যায় নদীর হালকা স্রোতের সাথে। বাতাসে দোল খাওয়া হিজলের সাদা পুষ্পমঞ্জরিতে অব্যক্ত কথার মালা স্তব্ধ হয়ে থাকে। ওদিকে লাল ঠ্যাঙা মাছরাঙাটা টুপ করে জলে ডুব দিয়ে ঠোঁটে মাছ নিয়ে আবার এসে বসে করচের নিচু ডালে। হারাধন দূর থেকে এসব দেখে শৈশবের ভাবনায় হারিয়ে যায়।
ছোটবেলার কথা মনে পড়লে দারুণ পুলকিত হয় হারাধন। তেমন কোলাহল ছিল না কোথাও। ঘাটের দু’পাশে ছিল শুধু বুনো জংলার ঝাড়। ঘাট থেকে জল নিতে এসে মা সুর করে বলতেন;
সুন্দর মান্দার ফুল জলের গায়ে ভাসে
কালো তোকমার ফুল সবাই ভালোবাসে
আজ তোকমার সে ঝাড়গুলো নেই। তবে বুড়ো মান্দার গাছটা এখনও আছে। ফাল্গুন-চৈত্র মাসে কাঁটার ডালে লাল পাপড়ির আড়ালে কেশর দোলানো ফুলগুলো কেমন আরক্ত হয়ে থাকে। ফুলের অমন নয়ন মনোহর কান্তির সাথে কেবল স্বর্গীয় কোনো ফুলের রূপেরই উপমা চলে।
মা বলতেন, অমৃতের সন্ধানে দেবতা ও অসুরকূল যখন সমুদ্র মন্থন করছিলেন তখন দেবী লক্ষ্মীর সাথে উদ্ভাসিত হয়েছিল স্বর্গের এ কল্পতরু। রূপের শোভায় সবার নজর কাড়লেও গন্ধহীন এ ফুলের ভেসে চলাই যেন জীবন। এ যেন তার নমিতার মতো। অন্তহীন স্রোতে তার নমিতাও যে ঐ মান্দার ফুলের মতো কোথায় যেন ভেসে গিয়েছে। গভীর বিস্ময়ে রক্তিম এ ফুলের স্বর্গীয় রূপচ্ছটা দেখে হারাধন। আর মনে মনে এর সাথে তার দেবীর মতো মেয়ে নমিতার গভীর সম্পর্কের একটা নিরর্থক অর্থ খুঁজে বেড়ায়।
হারাধন পাল একলা বসে বেদ-পুরাণের এসব আকাশ পাতাল ভাবনা নিয়ে সুরেশ পাটনির কর্মব্যস্ত দিন দেখে। সে পারানি নিয়ে ধুতির খোঁটে সাবধানে গুঁজে রাখে। তারপর বিরামহীনভাবে নাও নিয়ে নদীর এ ফোঁড় ও ফোঁড় হয়। একসময় খানিক সুযোগ পেয়ে ধুতির কাছা খুলে কপালের ঘাম মুছে নেয় আলগোছে।
কোমরে গোঁজা নেতানো বিড়িটা নিয়ে হাতের তালুতে ঘষে গরম করে নেয়। তারপর দেশলাইর কাঠি মেরে বিড়িতে আগুন ধরিয়ে একটা সুখটান দেয়। দৈত্যের মতো প্রকাণ্ড মান্দার গাছটার দিকে তাকিয়ে গভীর দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে কী যেন ভাবে একবার। ফাল্গুনে গাছের শাখে শাখে আগুনের ফুলকি হয়ে গোছা গোছা মান্দার ফুল ফুটে। আগুনের এই রঙ কল্পনা করে বড়ই ভালো লাগে তার।
দুই.
হারাধন পাল সাত পুরুষের মাটির কারিগর। ভগবান মাটিতে জীবন দিয়ে তাকে বানিয়েছেন, সেই মাটিকে আঁকড়ে ধরেই তার জীবন। হাতের কারসাজিতে মাটি নিয়ে খেলা তাই জনমভর। সে এক অচ্ছেদ্য চক্র।
সাত পুরুষের নেশা ও পেশা দুইই ছিল সারা বছর ধরে ঘর-গিরস্থালির মাটির নানাবিধ তৈজসপত্র বানানো। মাটির হাঁড়ি-কলস, পিঠার খোলা, শানকি, সরাই, বাসন আরও কতকিছুই না বানাতো তারা। তার নিপুণ হাতে গড়া মাটির টেপা পুতুল পাইকাররা বাড়ি বয়ে এসে নিয়ে যেত হাটে বিকাবে বলে। বিশেষ করে পূজার সময়ে তার বাবা-ঠাকুরদাদের বানানো দেবী প্রতিমাগুলো শোভা পেত মণ্ডপে মণ্ডপে। চৌধুরিবাড়ির বারোয়ারি দুর্গা মন্দির হতে শুরু করে হরিজন মঙ্গল চৌকিদারের সৌখিন পূজা মণ্ডপেও যেত তার পিতৃপুরুষের গড়া দেবমূর্তিগুলো। আসলে বারো মাসের সব পার্বণ জুড়েই ছিল তাদের সীমাহীন কাজের ব্যস্ততা।
কয়েক বছর আগের কথা মনে পড়ে যায় হারাধনের। কুমারশালায় বিরাম ছিল না কাজের। চাকতি ঘুরতো অবিরাম। নদীর বুক থেকে নিখাদ কালো মাটি ছেনে নিয়ে ঢিবি দিয়ে রাখতো কুমারশালার বাহির বাড়িতে। চাকা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে সেই মাটির দলা থেকে তৈরি হতো এসব তৈজসের আদল। আর অন্যদিকে হাতের পরম ছোঁয়ায় একটু একটু করে প্রাণ পেত প্রতিমার দেহগুলো।
হারাধন তার ঠাকুরদা হরিদাস পালের হাতযশ পেয়েছিল। তাই পূজা পার্বণের সময়ে একাই সে তৈরি করতো পাঁচ গাঁয়ের সকল দেবী প্রতিমা। সে সময় তার নাওয়া খাওয়ার কোনো হিসাব থাকতো না। শুধু নন্দীগ্রামই নয়, আশপাশের চৌগাছি, দেবীনগর আর রাইপুরের বেশিরভাগ প্রতিমা তৈরির বায়না নিত হারাধন নিজেই।
প্রতিমার সত্যিকার আদল হারাধনের হাত দিয়েই সব সময় তৈরি হতো। তবে নমিতা তুলির আঁচড়ে রঙ লাগিয়ে অলংকারের নকশা গড়ে দিত মাঝে মাঝে। সে তার বাবা হারাধনকে দেখে দেখে নিজের মতো করে শিখে নিয়েছিল সব। ঘরকন্নার কাজ সামলে নিয়ে সেও বাবার কাজে অবিরাম সাহায্য করে যেত পূজার আগাম সময়গুলোতে। নমিতার হাত দিয়ে প্রতিমার চোখ আঁকা শেষ হলে মনে হতো, অকালবোধন নয় যেন দেবীর পূর্ণাঙ্গ বোধন ঘটেছে।
হারাধনের কুমারশালা ধীরে ধীরে তখন দেবলোক হয়ে ওঠে। আগাম টাকা দিয়ে বায়না করা দেবী প্রতিমাগুলো পূজার আগেই বুঝে নিয়ে চলে যায় সবাই। মর্ত্যলোকের ঘরগুলোতে আশ্রয় নিতে থাকে তারা। হারাধন আর নমিতার হাতে প্রাণ পাওয়া ভক্তির প্রতিমা পুনরায় অধিষ্ঠিত হয় মানুষগুলোর মনে, মনের মন্দিরে, মন্দিরের বেদীতে। দশ চক্রে ভগবানও নাকি ভূত হয়। কিন্তু, কুমারশালার এই চক্র চৌদ্দ পুরুষ ধরে হারাধন পালদের যে ভূত বানিয়ে রেখেছে তা থেকে মুক্তির উপায় কেবল ভগবানই জানেন।
হারাধনের শক্তি ফুরিয়ে আসে। এদিকে নমিতা তার মর্ত্যলোকের দেবীর মতো বেড়ে উঠছিল দিন দিন। সেই ভাবনায় মনের জোর ফিকে হয়ে আসে একটু একটু করে। তাই দেবমূর্তি তৈরিতে তেমন ভক্তি ও মন কোনোটাই আসে না তার। চোখের জ্যোতি কমে যাওয়ায় মায়াবী মুখের প্রতিমাগুলোতে এখন আর আগের মতো নিখুঁত আদলও দিতে পারে না সে।
পূজা পার্বণের ধুম লাগলে উৎফুল্ল উচ্ছ্বসিত হয় হারাধন। সে সময় মূর্তি গড়ার পাশাপাশি বাড়তি কাজের চাপ বলতে হাঁড়ি-কলস বানানো আর হাটে বিক্রি করে সংসারের চাকাটুকু সচল রাখা। জীবনের অনিবার্য অনুষঙ্গকে তো উপেক্ষা করা যায় না। তাই আটপৌরে জীবনকে আঁকড়ে ধরে অতিক্রমের সংগ্রামী চেষ্টাই চলে নিরন্তর। সেই ভাবনাও ভাবতে হয় হারাধন পালের।
তফজেল মুন্সির ছেলে হোসেন আজকাল কাজে লেগেছে তার সাথে। সুঠাম দেহ আর চওড়া বুকের ছাতিতে বেজায় দম। হারাধনের হাঁপিয়ে ওঠা মন ও দৈহিক কষ্ট দেখে কুমারশালার বড় চাকতিটা সেই ঘুরায় অনবরত।
শনি মঙ্গলে দুইদিন হাট বসে। পোড়ামাটির হাঁড়ি-কলসগুলো সুরেশ পাটনির নাওয়ে করে হাটে নিয়ে বিক্রি করার প্রাণান্ত চেষ্টাও চলে। নমিতা মাঝে মাঝে সঙ্গ দেয় হোসেনের। তফজেল মুন্সির বড় মুদীখানায় বিক্রি হয় এইসব। নমিতা আর হোসেনের ঠুনকো কিছু রঙিন স্বপ্নের এলোমেলো বিস্তারও ঘটে নন্দীগ্রামের হাটে। দেবী লক্ষ্মীর নারায়ণ ভেবে হারাধন সব বুঝেও নিশ্চুপ থাকার ব্রত নেয়।
হোসেন বড় বিশ্বাসী আর কর্মঠ ছেলে। হারাধনের দারুণ পছন্দ তাকে। নমিতার সাথে আজকাল বেশ ভাব দেখা যায় হোসেনের। ক্রমাগত এই সখ্য বাড়তে থাকে যা মাঝে মাঝে হারাধনকেও বিচলিত ও উৎকণ্ঠিত করে তোলে।
অবারিত ও অবুঝ প্রণয়ের অঙ্কুরিত বীজ তার কাছে পবিত্রই মনে হয়। তবুও অনেক অজানা শঙ্কা বুকে ভর করে নীরবে ছোবল দিয়ে যায়। তারপরও যাপিত জীবনের মগ্নতায় দিন রাত্রির যূথবদ্ধ মিলন ঘটে। মাটির চক্রের মতোই কোনো রকমে আবর্তিত হয় হোসেন, নমিতা আর হারাধন পালের নিস্তরঙ্গ দিনগুলো।
তিন.
হারাধন কল্পনার জগৎ থেকে আবার তার বাস্তবতার দিনগুলোতে ফিরে আসে। নমিতা নেই এটা সে বিশ্বাস করতে চায় না। তার অবুঝ মন মোটেই মেনে নিতে চায় না সত্যটা। সারাক্ষণ এক আচ্ছন্নতার মধ্যে বসত করে সে। যে জগতে তার ইন্দ্রপুরীর সকল দেবতার অধিষ্ঠান সেই জগতের খোঁজে ব্যাকুল হয় সে।
আশ্বিনের এই অবেলায় তার স্পষ্ট মনে পড়ে যায় সেই পুরানো দিনের কথাগুলো। উথলে ওঠা শোকের মতো পুরানো ঘটনার দৃশ্যপট এক এক করে মুহূর্তেই চোখের সামনে ভেসে ওঠে। জীবনে সুরের বিনাশ ঘটে অসুরের এ হঠাৎ আবির্ভাবে ভীষণ বিচলিত বোধ করে হারাধন।
উদ্দাম হাওয়ার তোড়জোড় ছিল সেদিন চারদিকে। শরতের আকাশে সাদা অলক মেঘের ছড়াছড়ি। আশ্বিন মাস হলেও কালিন্দীর বুক ছিল জলে টইটম্বুর। শারদীয় পূজা আসন্ন হওয়ায় কী ভীষণ কর্মযজ্ঞ ছিল তার। দিনভর অন্তহীন ব্যস্ততার মধ্যে নিঃশ্বাস নেওয়ার সময়টুকু পর্যন্ত ছিল না।
চৌগাছির চৌধুরিবাবুদের নায়েব জোর করেই বায়নার টাকা গুঁজে দিয়েছিল তার হাতে একটা দুর্গা প্রতিমা গড়ে দেবার জন্যে। সাথে নিয়মমতো অমরলোকের অন্যান্য দেবতাসহ অসুরের প্রতিমূর্তি তো ছিলই। সময় কম হওয়ায় সেই কর্মব্যস্ততার সীমা পরিসীমা ছিল না মোটে। আগের রাতে ঠাকুর ঘরের সামনের উঠানে খড়, মাটি আর তারের বুননে ছাঁচ বানিয়ে রেখেছিল সাধ্যমতো। মধ্যরাত পর্যন্ত জেগে থাকায় ক্লান্তি আর অবসন্নতায় চোখ দুটা বুজে এসেছিল ভোরের কিছুক্ষণ আগে। অনেক বেলা করে তাই ঘুম থেকে ওঠে সে।
আগের রাতে নমিতাকে বলে রেখেছিল যেন হোসেনকে নিয়ে হাটের দিকে যায়। রোদে তাতা মাটির হাঁড়িগুলো উঠানে গাদি করা আছে। ওগুলো বেচে ঘরখরচ মেটাতে হবে সংসারের। আকাশের হালও মাঝে মাঝে বেগতিক হয়ে ওঠে। কেমন থেকে থেকে আশ্বিনের দমকা বাতাস বয়। যে কোনো সময় আঁধি নেমে লণ্ডভণ্ড করে দিতে পারে সব। আর বৃষ্টিতে একবার ভিজলে সব কষ্টই পণ্ড।
ঘুম থেকে উঠে নমিতাকে খোঁজে হারাধন। কোনো সাড়া শব্দ না পেয়ে উচ্চকণ্ঠেই ডাকে, নমিতা, কই গেলিরে মা? আকাশটা কেমুন থম ধইরা আছে। আইজ তাড়াতাড়ি যাইতে হইব। সুরেশ মাঝিরে কইয়া রাখছি। আঁধি নামার আগেই ফিরা আসতে হইব রে মা।
নমিতার জবাব শুনতে না পেয়ে তার ঘরের দিকে এগিয়ে যায় হারাধন। দরজা ঠেলে ভেতরেও তাকে খুঁজে পায় না সে। পরক্ষণেই বুঝতে পেরে খুশি মনে বের হয়ে দাওয়ায় গিয়ে বসে। কিন্তু, সহসা ঈশাণ কোণের জমাট মেঘের কালো পাহাড় দেখে বুকের ভেতর ধক করে ওঠে। টালমাটাল হাওয়া বইছে। বাতাসের আচমকা ধাক্কায় ঘরের চালে চড়চড় করে শব্দ হতে থাকে। মুহূর্তেই ঘোর আঁধি নেমে যায় চারদিকে।
ঘরের কোল থেকে লাফ দিয়ে নামে হারাধন। শরীরের ক্লান্তিবোধ এক ঝটকায় উবে যায় হঠাৎ। উত্তেজনায় হাত-পা কাঁপতে থাকে। মাটির দাওয়ার ওপর বাঁশের খুঁটি ধরে মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়ে সে। আর্তনাদের শক্তি নেই, মুখ থেকে মৃদু গোঙানির মতো শব্দ হতে থাকে শুধু।
সব কিছু শূন্য হয়ে গলা শুকিয়ে আসে তার। হঠাৎ সম্বিৎ ফিরে পেতেই ভূতের মতোন চমকে ওঠে। তফজেল মুন্সি, সফদার ইমাম গঞ্জের তারা মিয়াসহ তার দিকে এগিয়ে আসছে। হারাধনকে উদ্দেশ করে তফজেল মুন্সির দরাজ গলাই সবার আগে শোনা যায়।
হারাধন, তোমার মাইয়া কই? হোসেনের লগে মনে হয় তারে দেখলাম। আমার ছেলেরে ফুসলাইয়া কই নিয়া গেছে? আকাশের এই হালে তারা সুরেশ মাঝির নাওয়ে কইরা কই যায়?
হারাধন জবাব দেয় না অথবা আগপাছ ভেবে কোনোই উত্তর খুঁজে পায় না। তবে তার বিড়বিড়ানিও তফজেল মুন্সি শুনতে পায় না। সফদার ইমাম অকস্মাৎ খেঁকিয়ে ওঠে।
কথা বল না ক্যানে? তোমার বড় সাহস বাড়ছে। তোমারে একঘরে করা দরকার। তোমার মাইয়ার হোসেনের লগে কীসের এত ভাব? তোমার জাত কী? আর আমাগো কী জাত? আমাগো ধর্ম মিলে? তুমি কুমার হইয়া তফজেল মুন্সির ছেলেরে কোন মন্ত্র দিয়া হাত করলা?
আহ, তুমি থামো। বড়ই অবান্তর কথা কইতাছ। সফদার ইমামের কথা শুনে তফজেল মুন্সি বিরক্ত হয়।
হারাধনরে কথা কইবার দাও। সেই নিজ মুখে বলুক ঘটনা কী?
একসাথে এত প্রশ্নের চাপে হারাধন কেমন ভ্যাবাচেকা খেয়ে যায়। উত্তর হাতড়ে না পেয়ে ঘামে নেয়ে ওঠে শরীর। ক্ষণে ক্ষণে বিদ্যুৎ চমক ও বাজের আওয়াজের মধ্যে হারাধনের উঠানের এ বাকবিতণ্ডা চাপা পড়ে যায়।
একটা শোরগোল আসে ঘাটের কাছ থেকে। তারা মিয়া সেই শোরগোলের আওয়াজ পেয়ে তৎক্ষণাৎ অনুগামী হয় সেদিকে। হারাধনের মনে কুডাক আসে। খানিক বাদে বিরাট হৈ চৈ বাঁধিয়ে তারা মিয়া আবার এক ছুটেই চলে আসে হারাধনের উঠানে।
আমাগো সব শ্যাষ চাচা। বিরাট সর্বনাশ হইছে। মাঝ নদীতে সুরেশ পাটনির নাও ডুবছে।
জাত-ধর্মের হিসাব নিকাশ নিয়ে ব্যস্ত হওয়া মানুষগুলো হন্তদন্ত হয়ে ছুটে যায় ঘাটের দিকে। দমকা ঝড়ো হাওয়া ও ফুঁসে ওঠা ঢেউয়ের আঘাতে খণ্ড-বিখণ্ড হয় সুরেশ পাটনির নাও। রাক্ষুসে কালিন্দীর টলমল বুকে খড়কুটার মতো ভেসে যায় নগণ্য মানুষগুলো। প্রবল ঢেউয়ের আছড়ানিতে ডুবে যায় হাঁড়ি কুঁড়ির ভাঙা চিহ্ন।
নদীর তীরে কান্নার রোল ওঠে। সেই সাথে ক্ষতবিক্ষত হয় নদীতীরে উপস্থিত হওয়া মানুষগুলোর পাঁজরভাঙা বুকের দুর্নিবার আকুতি। সুরেশ মাঝি সাঁতরে নদী পার হয়ে কোনোরকম বেঁচে যায়। কিন্তু, কোনো অজানার পারে ভেসে যায় হোসেন ও নমিতা। তাদের সাথে ভেসে যায় হারাধনের সকল স্বপ্ন-সাধ ও বেঁচে থাকার ক্ষীণ এক রত্তি আশা।
চার.
কালিন্দীর শান্ত বুকে এখন আর ঢেউ দুলে ওঠে না। জায়গায় জায়গায় ধুলির চাঁদোয়া জমে রাক্ষুসে নদীটার গভীর উচ্ছ্বাসও নেই আগের মতো। নিশিদিনের নব নব রাগের সেই ঢেউয়ের খেলা হারিয়ে কেমন যেন ধীর, নিথর। কোলাহল কমে শান্ত হয়েছে নদীর তীর।
নদীর মতোই যৌবনের বল হারিয়েছে হারাধন পাল। আসলে নমিতা যে নেই এটা বিশ্বাসই হয় না তার। নমিতা মিশে গিয়েছিল কালিন্দীর কালো জলের অতল গহ্বরে আর হোসেনের যে কোনো খোঁজই মেলেনি।
গাঁয়ের লোকে বলাবলি করে, নমিতার জলে ডুবা লাশটায় পচন ধরলেও মুখটা নাকি লক্ষ্মীর মুখের মতোই মায়াবী ছিল অনেক। উদভ্রান্ত মনে হারাধন শুনে আর হাসে। সকলের অগোচরে তাই নমিতার গলিত নিথর দেহটিকে শ্মশানে না নিয়ে জলেই ভাসিয়ে দিয়েছিল সে। নমিতার প্রাণভোমরা লুকিয়ে রয়েছে সেখানে। হারাধন নিত্যদিন সেই প্রাণের খোঁজ করে চলে।
দুই আশ্বিন গত হলেও প্রবল এ শোক ভুলতে কষ্ট হয় হারাধনের। সামনে শারদীয় দুর্গোৎসব। আবারও কদর বেড়ে গেছে তার। অনেকদিন পর আবারও সে প্রতিমা গড়তে বসবে। মূর্তি গড়ার ছলে নমিতা ও হোসেনকে খুঁজে বেড়াবে প্রাণহীন প্রাণে এক অপার ভক্তিতে। দেবতার অবয়বে এক পবিত্র প্রেমের আরাধনায়। তার এ আনন্দ নিছক সুখ নয়। এটা যুগ যুগ ধরে তার পূর্বপুরুষের হাতে গড়ে ওঠা প্রতিটা দেবতার মতোই নিষ্পাপ ও পবিত্র। প্রেম ও ভালোবাসাময় পরম আরাধ্য এক কৃত্য।
বাহির বাড়ির চওড়া উঠানটায় প্রতিমা গড়ার উপযুক্ত মাটি নেই। মাটি আনবে বলে সে একাই চলে যায় খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে কালিন্দীর তীরে। সে আজ তার সকল মেধা, পরিশ্রম আর কল্পনা দিয়ে গড়ে তুলবে মনের মতো প্রতিমা। যেখানে মিশে থাকবে মমতা ও প্রেমের এক ভক্তিময় আশীর্বাদ। যে প্রাণের মায়া সে খুঁজে বেড়াচ্ছে বহুদিন ধরে সে মায়ায় সে থাকে বিহ্বল ও অবিচল।
মর্ত্যলোকের কোনো দেবতা নয় হারাধন; নদীমন্থনের কোনো শক্তিও নেই তার। তারপরও অমৃত-সুধার খোঁজে ব্রতী হয় সে। জীবনের গরল বুকে নিয়ে দেবী লক্ষ্মীর মতো মনের বেদীতে যদি একবার নমিতাকে আবাহন করা যায় এ আশায় নতুন করে বুক বাঁধে সে।
কত কাল ধরে হারাধন দেবমূর্তি তৈরি করে না। আজকাল ঠিকমতো দেবীর আদল দিতে পারে না, সেই ধৈর্য্যও তার হয় না। শরীর যেন হঠাৎ করে আগের চেয়ে অনেক ভেঙে গেছে। যে মাটি আজ নিয়ে এসেছে নদীর বুক থেকে সেখানেই তো প্রাণটা গেছে নমিতার। আজ তার অন্তিম সে বাসনা নিশ্চয়ই পূর্ণ হবে।
হোগলার চাটাইঘেরা খেজুরপাতার দরমার ছোট্ট কুঁড়ের ছিমছাম গৃহকোণটাই প্রতিমা তৈরির ঘর। এটাই কুমারপাড়ায় হারাধনের দেবালয় যেখানে দেবতাগণের অধিষ্ঠান হয়। বাঁশের ঝাঁপি ঠেলে ভালো করে দেখে নেয় হারাধন। তার বাবা ঠাকুরদারা এখানে বসেই ক্লান্তিহীন দেবী প্রতিমা তৈরি করতেন।
উঠানের মাটির তাল থেকে পরম মমতায় মাটি ছেনে নিয়ে তার সাথে খড়ের বজ্র আঁটুনি দেয় হারাধন। খড়ের অবয়বের ওপর ভালো করে আঠালো মাটি লেপে দিয়ে গভীর মনোযোগে তৈরি করতে শুরু করে দেবতাদের গড়ন। কুমারপাড়ার কয়েক ঘর বসতির মধ্যে একমাত্র হারাধন পালই দেবী প্রতিমা তৈরির জাত কারিগর। তাই অন্য কুমাররাও আসে তার এই কর্মযজ্ঞ দেখতে। নলেন, দেবেশ, পরিতোষসহ অনেকেই এসেছে সেই খবর শুনে। অনেকদিন পর হারাধন পালের এই প্রতিকৃতি তৈরির কাজ তাদেরকে দারুণভাবে উৎসুক করে।
দেবীধামের ঝাঁপি ঠেলে ভেতরে প্রবেশ করে তারা দেখে হারাধন নিমগ্ন তার কাজে। কী নিখুঁতভাবে মানুষের গড়নে তৈরি হচ্ছে সব। খড়ের দেহের ওপর মাটির প্রলেপ বসছে। আদল নিচ্ছে একে একে পা, হাত, গলা আর সবশেষে দেবীর মুখখানা।
এই বেলা কাজ শেষ হলে মধ্যাহ্নের পর শুকাবে তপ্ত রোদের আগুনে। হারাধন এক বসায় তাই দেবীর গড়ন ঠিক করে উঠানের এক কোণে শুকাতে দেয়। প্রতিমার দেহ ঠিকমতো না শুকালে রঙের আঁচড়ও যে ঠিকমতো পড়বে না। আজ বাদে তিনদিন পর ভালোমতো শুকিয়ে গেলে তবেই তুলির আঁচড় পড়বে প্রতিমার গায়ে। হারাধন অধীর হয়ে সেই দিনটার জন্য অপেক্ষা করে।
মঙ্গলবার দিনটা শুরু হয় অন্যভাবে হারাধনের। কোথা থেকে যেন শরীরে বলও ফিরে আসে। আসলে মনের জোরটাই ফিরে এসেছে তার। নিজে নিজেই ঠাকুরের ঘর ঝাঁট দিয়ে দেবতা বিষ্ণুর পূজা দেয় সে। উঠানকোণের জবা গাছটা থেকে রক্তজবা, টগর আর সিঁদুরে কলমি সাজিয়ে নেয় কাঁসার বাসনে। মাটির পিলসুজে প্রদীপ জ্বালিয়ে ধূপদানিটার পাশে রাখে। ঘরময় পবিত্র একটা গন্ধ ছড়িয়ে যায়। কয়েকটা সবরি কলা, ধান, দূর্বা আর মুড়ির মোয়া দিয়ে সাজিয়ে নেয় ভোগ, পূজার নৈবেদ্য।
মহালয়ার পর অন্তহীন কাজের চাপে বিশ্রামের একটুও ফুরসত পায়নি সে। তাই আজ সন্ধ্যায় দেবীর বোধন হয়ে গেলে এগুলো দিয়ে পূজা সেরে কিছুটা বিরাম নেবে সে। একটুকরা রোদ এসে হামাগুড়ি দেয় ভাঙা দরমার ফাঁক দিয়ে। সকালবেলা পূজার সময় নয় তারপরও কেমন যেন আরতি শুরুর মোহনীয় পরিবেশ তৈরি হয় দেবীঘরে। পাটভাঙা নূতন ধুতি গায়ে চাপিয়ে হারাধন রঙের আখর নিয়ে বসে। ক্লান্তিহীন তার উৎসাহ। বাহারি অলংকারে সাজিয়ে তোলে দেবীর পা, হাত, গলা আর মায়াবী মুখাবয়ব। সবকিছুই রঙের তুলির আঁচড়ে। দেবীর পটলচেরা চোখ এঁকে ক্ষান্ত হয় হারাধন।
হারাধনের ধ্যান ভাঙে হঠাৎ। এ কী? তার সামনে দাঁড়িয়ে এ প্রতিমা কার? বিস্ময়ে বিমূঢ় হয়ে ওঠে তার মন। এ যে দেবীর রূপ নিয়ে দাঁড়িয়ে তার লক্ষ্মী মেয়ে নমিতা। যাকে সে এতকাল ধরে খুঁজে বেড়িয়েছে পরাণের গহীন কোণে। মাথাটা কেমন যেন চক্কর দেয় তার। টাল সামলে উঠতেই ধুতি কোর্তায় রঙ এসে আছড়ে পড়ে। ভোগ দেয়ার থালা হাতে নেয়ার আগেই মাটিতে লুটিয়ে পড়ে হারাধন। অন্তরে লালিত তার আরাধনার দেবী আজ হঠাৎ করেই আবির্ভূত হয়। যাকে সে তালাশ করে মরছে কুমারপাড়ার এই দেবলোকের মধ্যাহ্নে।
কবিশেখর কালিদাস রায়ের চাঁদ সদাগর কবিতার একটা পংক্তি ছিল, ‘মানুষই দেবতা গড়ে, তাহারই কৃপার পরে,…..
গুলশান এক থেকে দুইয়ের দিকে যাওয়ার পথে চৌরাস্তার পঞ্চাশ গজ দক্ষিণে পঁচিশতলা আর্কেডিয়া টাওয়ারের তেরতলায়…..
রবি স্কুলে এসে প্রথমে সই করতে যায় হেডমাস্টারমশাই এর ঘরে।হেডমাস্টারমশাই বললেন,রবি আমি আজ একটু কাজে…..
কাঁটায় কাঁটায় বিকেল চারটা পঞ্চান্নতে ডাইনিং রুমের উত্তরের দেয়ালে কাঠের ফ্রেমে বাঁধাই করা ফুলদানিতে বর্ণিল…..