প্রক্সি
তারপর ইলেকট্রিক বিল জমা দিতে যাবো। আমার দেরি হবে আসতে। স্বামী অমর বলে, ঠিক আছে।…..
নয়তলা থেকে দ্রুত পায়ে নামে তাহমিনা। আজ বেলা বয়ে গেছে। এক কেজি পুঁটি, দশটা তেলাপিয়া, একটা চিতল আর একটা ঢাউস রুই মাছ কেটে ধুয়ে আলাদা প্যাকেট করে ডিপে ঢুকিয়ে তবে দম ফেলেছে। সব মিলিয়ে সময় লেগেছে দেড় ঘণ্টা। বটিতে উবু হয়ে বসে কাটো, তারপর সিংকে ফেলে ধোও, লবন ঘষো। এইসব কাজ নিখুঁত করে না করলে ভাল্লাগে না। মাসে তিনদিন এমন মাছ টাছ নিয়ে বসতে হয়। সেদিন এমন যায়।
আজ অবশ্য সাহেব বেগম সাহেব বাসায় ছিল না। লিটন ড্রাইভার মাছ এনে দিয়ে গেছে। দরজা খুলেছিল সাহেবের মা। এরপর লিটনকে বাজার নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে তাহমিনাকে ডাকলো। গায়ের ওড়নাটা জড়িয়ে এসে বাজারের ব্যাগগুলো লিটনের হাত থেকে নিয়েছিল তাহমিনা, লিটনের সাথে কোন কথা কয়নি। লিটন অবশ্যি হাসছিল মুখ টিপে। ভারি বাজে দেখাচ্ছিল ওর মুখটা তখন, বরাবরের মত। কেমন গোলপানা ঢ্যাপসা ধরনের মুখ লিটনের। হাসলে দাঁতের সাথে মাড়িও বেরিয়ে আসে।
তাহমিনা দ্রুত হাতে বাজার নিয়ে রান্নাঘরের দিকে হাঁটা দিলে পিছন থেকে লিটন চাপা গলায় বলে, নতুন বই আইসে বলাকা হলে। তোমার জন্য টিকিট আনসি।
– টিকিট লাগতো না। আপনে অন্য কেউরে নিয়া যান না ক্যান?
– সবার সাথে সব হয় নাকি? যাউগগা, আইলে আইসো। রাতে খাওয়ামুনে
– ওই আমার স্বামীতে খাওয়া দেয় না নিকি?
লিটন এই কথার জবাব না দিয়ে ফ্যাচফ্যাচ করে হাসতে থাকে। যেন সে সব জানে। কি জানি, জানতেও পারে। আর এখানে জানারই বা কী আর না জানারই বা কী। রিকশাওয়ালা তার বউরে ঠিকমত খাইতে দিতে পারবে না- এ তো জানা কথাই। যদি পারতো তবে কি বউ ঝি’র কাজে ভোর থেকে সন্ধ্যা কাটায়ে দিত?
যদি পারতো, তাহমিনা তাইলে আর যাই হোক, এই নয়তলার ঝিয়ের কাজটা ছেড়ে দিত। অন্তত এই বাড়িটা।
মাছ কাটতে কাটতে এইসব ভাবে। লিটনের সাহস ক্যামনে বাড়তেসে সে কথাও ভাবে। কাছে পিঠেই সাহেবের মা ছিল, তাও হারামজাদার কত সাহস- সে কথাও ভাবলো। ভাবতে ভাবতে শরীর জুড়ে একটা ঘিনঘিনে ভাব আসলো। সব শালার নজর এই শরীরে। বই না ছাই। তারে সিনেমা দেখায়া কী লাভ লিটনের?
লাভ ওই শরীরই। হলের আঁধারে গা ধরা। একটু কাছাকাছি আসা। এরপর কোনদিন বলবে ওর মেসে যাইতে। কি ওর সাথে আর কোথাও।
তেলাপিয়ার শরীরে ছাই মেখে আঁশগুলো ঘষে উঠায়। মাছ কোটে, ধোয়। দু’বেলার রান্না খাওয়া আগেই হয়ে গেছে। এ বাড়ির সবাই এখন ঘুমুচ্ছে। লোক বলতে সাহেবের মা আর ছোট ছেলেটা। বাকিরা বাইরে। সাহেব অফিসে আর দুপুরের খাবার পরই ম্যাডাম গেছে শপিংয়ে বড় মেয়েটাকে নিয়ে।
রান্নাঘর গুছিয়ে ধুয়ে মুছে পরিস্কার করে ফ্ল্যাট থেকে যখন বেরোয় তখন সাড়ে পাঁচটা বেজে গেছে। সূর্য ডুবেছে। সদ্য শীতের বেলার অন্ধকার নেমেছে। মাগরেবের সময় বলে রাস্তায় লোক কম। ওড়নাখানা ভালোমত বুকে পেটে জড়িয়ে টিপটিপ করে হাঁটে তাহমিনা। বিশ মিনিটের টানা হাঁটা পথে ওর বাড়ি। এই রাস্তাটা পেরিয়ে বামে মোড় নিলে একটা মসজিদ। এরপর দুটো গলি পার করে আরেকটু এগিয়ে মেইন রোড। এরপর রাস্তাটা পার হয়ে ওইপাড়ে আরেকটা রাস্তা…। মনে মনে নিজের বহু চেনা পথের দিকগুলো ভাজতে থাকে ও।
ঘরে যাবার আগে একটু ভাজা টাজা কিনে নেবে আজকে? বড্ড খিদে পেয়ে গেছে। মসজিদ পেরিয়ে একটু সামনে ভাজাভুজির দোকান, তার সামন পাতা বেঞ্চিতে তিনটে লোক। তাহমিনাকে ওরা পা থেকে মাথা পর্যন্ত দেখে। দেখার পর চোখ সরিয়ে নেয় না। দেখতেই থাকে।
– দুইটা আলুপুরি
– দশ ট্যাকা
আঁচলের খুঁট থেকে দশ টাকার একটা নোট বের করে।
ওই হিরুইনরে দুইটা গরম পুরি দে। গ-র-ম… গ-র-ম…
গরম শব্দটা দু’বার বেশ রসিয়ে উচ্চারণ করে পুরিওয়ালা। বেঞ্চির লোক তিনটে উচ্চস্বরে হেসে ওঠে।
– কারে কন?
– কী?
– হিরুইন কারে কইলেন?
– ক্যান তরেনি? তুই নিজেরে হিরুইন ভাবস?
– আমি ভাবি না। আপনি কইলেন কারে?
– হিরুইনরে কইসি। ক্যান তুই তো চাইলেই হিরুইন হইতে পারোস। হবি?
– না
দাঁত বের করে দাঁড়িয়ে থাকা লোকটার হাত থেকে আলুপুরির ঠোঙ্গা নিয়ে দ্রুত পায়ে বেরিয়ে আসে তাহমিনা। এই ভর সন্ধ্যেয় আর ইচ্ছে করছে না কাইজা করতে। বড্ড ক্লান্তি শরীরে। বাড়িতে গিয়ে দুটো রেঁধে বেড়ে খেয়ে ঘুমোবে। লোকগুলোর হাসি এখনো মাথার ভিতরে বাজছে। তাকানোর ভঙ্গিও। ওর এই ক্লান্ত ঘর্মাক্ত মুখে ওরা হিরুইন খুঁজে পাইসে। অথচ পেট জ্বলে যাচ্ছে খিদেয়। হাঁটতে হাঁটতেই আলুপরি দুটো গোগ্রাসে গিলতে থাকে ও।
বস্তিতে যখন পৌঁছায় তখন অন্ধকার নেমেছে পুরোটা। বস্তির ঘরের সামনের লনে রইসকে দ্যাখে বিড়ি টানতে। আধ ময়লা সবুজ শালটায় গা পেঁচিয়ে জয়নালদের সিঁড়িটায় যুৎ করে বসেছে।
রইসের দিকে এক নজর তাকিয়ে কোন কথা না বলে ঘরের দিকে এগোয় তাহমিনা।
– এত দেরি করলি ক্যা?
– কাম ছিল
– এত কাম করস, বেতন বাড়ায় না ক্যা? নাকি বাড়াইসে তুই আমারে লুকাছ?
এইসব কথার কোন উত্তর দেয় না তাহমিনা। তবে রইসের সন্দেহ ঠিক। সে তো লুকায়ই। বেতন বাড়ছে আরো তিন মাস আগে। পুরো দুই হাজার টাকা বাড়তি। বেমালুম চেপে গেছে। কেন না? বাকি দু’হাজার তো পুরোটাই রইসের দখলে চলে যায়। একটা টাকা তো থাকতো না তাহমিনার। এই যে আজ দুটো পুরি কিনে খেলো দশ টাকায়, এ টাকাটাও নিয়ে নিত রইস। রইস ওর বাড়তি টাকাটার কথা জানে না বলেই গত তিন মাসে প্রায় আড়াই হাজার হাজার টাকা জমিয়েছে তাহমিনা। ঘরের কোনে রাখা পুরোনো যে কাঠের বাক্সটায় নিজের আয়না চিরুনি ফিতা রাখে, তারই এক কোনে কাগজে মুড়ে টাকাটা রেখে দিয়েছে। রোজ অন্তত একবার পরীক্ষা করে দেখে ঠিকঠাক আছে কিনা। আর বাকি টাকা? সে ওর খরচ হয়ে গেছে। হাত খরচ তো লাগেই, নাকি? রইস তো একটা পাই পয়সা হাতে দেয় না কখনো। শুধু দুবেলা দুটো আলু ভাত দিচ্ছে। আর কী দিচ্ছে?
রইস তারে কী দেয়, কী দিয়েছে, কী দেবে এই প্রশ্ন নিজেকে করা ছেড়ে দিয়েছে তাহমিনা। গত তিন বছরের সংসারের পর এইটুক তার মাথায় ঢুকেছে যে এই লোকটা আসলে ওকে কিছুই দেবে না। এমনকি একটা সন্তানও না।
যদিও রইস বলছে দোষ তার নয়। প্রতি রাতে কি দিনের শুরুতে যে নিত্য ঝগড়া তাদের বাধে তাতে অবশ্যম্ভাবীরূপে বাচ্চা প্রসংগ আসে। তাতে রইস বীরদর্পে জয়লাভ করে এই বলে যে, তাহমিনার রূপ পুরোটাই ফাঁকি। আদতে সে এক বাজা মেয়েমানুষ সেধে ঘরে এনেছে।
এই সব অভিযোগের জবাবে তাহমিনা কিছুই বলে না প্রায়ই। অথচ বস্তিসুদ্ধা লোকে জানে এই দম্পতি বছর খানেক আগে সরকারি হাসপাতালে গিয়েছিল বাচ্চার আশায় এবং যাবতীয় পরীক্ষা নিরীক্ষার পর জানা গেছে, বাবা হবার ক্ষমতা রইসেরই নেই।
সেই দিন মুখ চুন করে বাড়ি ফিরলেও সপ্তাখানেক বাদেই রইস বলতে শুরু করেছে যে পুরুষ কখনো বাজা হয় না এবং ডাক্তার কিছুই জানে না।
এইসব কথা বলার সময় রইসের চোখেমুখে এক তীব্র হিংস্র জিঘাংসা ফুটে ওঠে। পাঁচ ফিট তিন ইঞ্চি উচ্চতার হ্যাংলা পটকা গালভাঙ্গা লোকটাকে তখন চেনাই যায় না।
এইসব পুরান কথা। সন্তান যে হবে না, তাহমিনা এটা মনে মনে মেনে নিয়েছে। যদিও রইস তাকে বারবার হুমকি দেয় আরেকটা বিয়ে সে করবেই- এই বলে। এই কথার জবাবেও চুপ থাকে তাহমিনা। করলে করবে। করলে তো আর ঠেকিয়ে রাখা যাবে না। নাকি?
তার চেয়ে নিজের জন্য একটু গুছিয়ে নেবার চিন্তা করেছে তাহমিনা।
এখনো রইস জানে, তাহমিনার কাছে আর কোন টাকা নাই। গলির মুখেই পুরি শেষ করে মুখের তেল আঁচলে মুছে এসেছে তাহমিনা। নাহ, ওর আর কোন টাকা নেই।
বস্তির সারি সারি ঘরের এক কোনে রান্নাঘর। দুইটা চুলা। পাশের কলঘরে যাবার আগে একবার রান্নাঘরে উঁকি দেয় তাহমিনা। শেফালী আর রমিজা রাঁধছে। রমিজার শেষের পথে। এরপর চুলার লাইনে নিজের কথা বলে রেখে কলঘরে স্নানে ঢোকে। শীত গ্রীস্ম যাই হোক কাজ শেষে স্নান ওর লাগবেই, ছোটবেলার অভ্যাস। এই নিয়ে বস্তিসুদ্ধ লোকের কত কথা!
– সুন্দরীর গা না ধুইলে অয় না
– এই শীতেও গা ধোয়! নাইলে রূপ যৌবন শ্যাষ!
স্নান করতে করতে ভাবে কী কী রানবে। বড়ি দিয়ে কুমড়ার ঘ্যাট আর আলু দিয়ে কুচা মাছ। ঘরে বাজার দেখেছে। চটপট করে নেবে।
স্নান সারে। রাঁধে। বাড়ে। খায়। ঘরে যায়। রইসের শরীরের খায়েশ মেটায়। তারপর রাত সাড়ে দশটার ভিতরে ঘুমিয়েও পড়ে।
আজ দিনটা ভাল গেল। ভোরবেলা সামান্য কথা কাটাকাটি ছাড়া দিন শেষ হয়েছে ঝগড়াবিবাদ মারামারি ছাড়াই। ভাবতে ভাবতে ঘুমায় তাহমিনা।
তারপর ফের ভোর ভোর ঘুম ভাঙ্গে। গরম ভাত আর ডাল রাঁধে। সেসব খেয়ে রিকশা নিয়ে বেরোয় রইস। কোনমতে দুটো মুখে গুজে তাহমিনাও বেরিয়ে যায়। গলির মাথায় আটতলা হলুদ বাড়ির চারতলায় দশটা রুটি আলুভাজি সুজির হালুয়া দিয়ে নাস্তা তৈরি, দুপুরের রান্নার কোটাবাছা আর নাস্তা শেষে বাসনকোসন ধুয়ে রাখা। এই কাজ নয়টার ভিতরে শেষ করে প্রায় ছুটতে ছুটতে পনেরো মিনিটের দূরত্বে বড় রাস্তার ওপারে আরেকটু এগিয়ে নয়তলার ফ্ল্যাটে যায়। এ বাসায় তার ম্যালা কাজ। তাই বেতনটাও বেশি।
নয়তলার ফ্ল্যাটে গিয়ে কলিং বেল বাজায় আর দুরু দুরু বুকে অপেক্ষা করে। আজ শুক্রবার। সাহেব ঠিক বাড়িতে আছে। আর যা ভেবেছিল তাই, হাতে খবরের কাগজটা নিয়ে দরজা খোলে সাহেবই। জরোসরো তাহমিনা ঘরে ঢোকে। ঢুকেই সুৎ করে পাকঘরের দিকে চলে যায়।
– তাহমিনা, একটা চা দাও।
পিছু পিছু পাকঘরে এসে চাপা গলায় বলে সাহেব।
– দিতাসি
আধা চামচ চিনির সাথে দুধ চা বানিয়ে সাথে দুইটা টোস্ট বিস্কিট পিরিচে সাজিয়ে দিতে গিয়ে বোঝে সাহেব তার প্রিয় কোনের ঘরে ঢুকে গেছে। দরজা ঠেলে ঘরে ঢুকে কাঁপা হাতে চায়ের কাপ আর বিস্কিটের পিরিচ রাখে টেবিলে। সাহেব তাকিয়ে আছে। বুকের ভেতরটা ধক ধক করে তাহমিনার। ও ঘরে বেগম সাহেব এখনো ঘুমে। এ ঘরে সাহেব! যতটা দ্রুত পারা যায় কাপ পিরিচ রেখে বেরিয়ে যাওয়ার মুখেই ওকে জড়িয়ে ধরে লোকটা। কোমরের চারপাশে দুই হাত জড়িয়ে নিয়ে কাছে টানতে চায়। আর তাহমিনা ওর শলশলে ফর্সা শরীরটা বেকেচুড়ে সাপের মত ফেনায়ে ওঠা দুইটা লোমে ঢাকা হাতের ভিতর থেকে নিজেকে মুক্ত করে নেয়। পুরো সংগ্রামটাই ঘটে নিঃশব্দে। এরপর সেরকম শব্দহীনই বেরিয়ে যায় ঘর থেকে। আর সাহেব বিস্কুট খায়, চায়ে ভিজিয়ে, হাসিমুখে। এ প্রায় প্রতি শুক্রবার সকালের ঘটনা। একে এড়ানোর সাধ্য তাহমিনার নাই। মাস শেষে কড়কড়ে চার হাজার টাকার নিচে প্রতি শুক্রবারের কোমর পেচানি, বুক খামচানির ঘটনা চাপা পড়ে আছে।
প্রতি শুক্রবারের সকালে ওই কোনের ঘর থেকে বেরোনোর পর ঘাম দিয়ে জ্বর ছাড়ার মত অনুভুতি হয় ওর। বেগমসাহেব এখুনি উঠবেন। এরপর আর কোন চিন্তা নাই। পরদিন থেকে সাহেব আবার সকাল সকাল অফিস চলে যাবেন। কোমর পেঁচানোর কেউ নাই। কোনমতে শুক্রবারের সকালে ওই দুই তিন মিনিট পার করতে পারলেই শেষ। বাকি দিনগুলোতে ড্রাইভার লিটনের জুলজুলে চোখ, তেলতেলে কথা আর প্রস্তাবগুলো যেহেতু দরজার ওই পার থেকেই আসে, তাই সেগুলো এড়ায়ে যাওয়াও সহজই। তাহমিনা ওর জীবনের আরো হাজারটা ঘটনার মত এগুলোও মেনে নিয়েছে। আর আশা করে আছে, কোমর জড়িয়ে বুক চেপে ধরার চেয়ে বেশি কিছু করার সাহস আর সুযোগ এই সাহেবের কখনো হবে না। বেগম সাহেবকে সে কিছু বলেনি। বললে মহিলা বিশ্বাস করুক আর না করুক, ওকে ঠিক ছাটাই করত। ওর পূর্বঅভিজ্ঞতা এই বলে। এর বাইরে অন্য কিছু অসম্ভব। এর আগে আট নম্বর রোডের পাঁচতলায় রোজ ঘর মুছতে যেত। সেখানে ঘর মুছবার কালে, দুপুর পর্যন্ত ভোস ভোস করে ঘুমুনো বেগম সাহেবের ছোট ভাই খাটের উপর থেকেই হাত বাড়িয়ে ওর বুক চেপে ধরেছিল। ঘটনা ঘটামাত্র চেঁচিয়ে বাড়ি মাথায় করেছিল তাহমিনা। তার জবাবে তখুনি ঘাড় ধাক্কা জুটেছে। আঠারো তারিখ ছিল মাসের, এখনো মনে আছে স্পষ্ট, একটা টাকাও দেয়নি তারা।
জীবনে তো কম দেখলো না। দেখে দেখে আজ বড় ক্লান্তি লাগে!
কাপড়ের বালতি সাবান নিয়ে বাথরুমে ঢুকতে ঢুকতেই বেগম সাহেব ওঠেন। ছেলেমেয়েরা ওঠে। সাহেবের মা নিজের ঘর ছেড়ে বেরিয়ে আসেন তসবি হাতে। ড্রইং রুমে তাদের হাসিঠাট্টার আওয়াজ ওঠে। নাস্তার টেবিলে টুংটাং শোনা যায়। ওসব শেষ হলে ধোয়া মোছা করবে তাহমিনা। কাপড় ভিজিয়ে এসে এঁটো বাসন নিয়ে যায়। সাহেব খুব হাসছে। বেগম সাহেবও খুব। হাসাহাসির ফাঁকেই বেগম সাহেব দুপুরের রান্না কী হবে বলে দেন। তাহমিনা মন দিয়ে শোনে। সেইমত সব রাঁধে বাড়ে। চিতলের ঝোল, ফুলকপি আলু সিমের ভাজি, লাউ দিয়ে চিংড়ি, ডাল ভর্তা। এর ফাঁকে সাহেবের জন্য বাথরুমে গরম পানিও দিয়ে আসে। বেগম সাহেব তখন ড্রেসিং টেবিলের টুলে বসে কিছু করছে। লাগোয়া বাথরুমে সাহেব আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে চুলে কলপ মাখছিল। তাহমিনা গরম পানির হাড়িটা থেকে জল ঢালে লাল বড় গামলায়। সাহেব ফিরেও তাকায় না।
– হয়েছে হয়েছে যা এবার
জল ঢালা শেষ হওয়ামাত্র মাছি তাড়াবার ভঙ্গিতে তাহমিনাকে তাড়ায় সাহেব। ফের হাসি পায় ওর। পাকঘরে ফিরে চিতলের পেটি বাড়ে, ভাতের মাড় গালে আর হাসে।
বেকুফ পুরুষ। ভাবে আর হাসে। দুপুর শেষ হয় হয়, তখন সব কাজও শেষ হয়। আজ মাসের চার তারিখ। বেগম সাহেব কড়কড়ে আটটা পাঁচশ টাকার নোট ওর হাতে দেন। বলেন, খাবার বেঁধে নিলি নাকি?
– বাড়িত গিয়া গা ধুয়ে খামু
– ওহ, আচ্ছা যা
ভাত তরকারির বাটি দোলাতে দোলাতে ফুরফুরে পাখির মত উড়ে উড়ে ঘরে ফেরে তাহমিনা। ব্লাউজের নিচে পুটুলিতে রাখা পাঁচ হাজার টাকা। সকালের বাড়ির এক আর নয়তলার চার হাজার। সন্ধ্যে বেলায় বাড়ি ফিরে রইস নেবে তিন। বাকি দুই ওর। রইস জানবে না এই দুইয়ের কথা। বেশ লাগে। যতবার টাকাটার কথা ভাবে, নিজের বুকের কাছে সাবধানে হাত দিয়ে টাকাটা ছোঁয়। এই করে করে বাড়ি ফিরে ফের সেই কুমড়োর ঘেটি রাঁধে, ডাল রাঁধে। কলঘরে স্নানকালে ডলে ডলে তুলে ফেলে সাহেবের লোমশ হাতে ওর গা হাতানোর দুঃস্বপ্নটুকু।
এরপর খেতে বসে ও বাড়ি থেকে আনা ভাগের চিতলের টুকরোটা তুলে দেয় রইসের পাতে। রইস নির্বিকার খায়। কুমড়োর ঘেটি দিয়ে নিজের ভাত মাখে তাহমিনা। রইস ভাত খেতে খেতে ফের টাকা পয়সার টানাটানির কথা তোলে। তাহমিনার আরো টাকা আনা উচিত- এই কথা বলে। তাহমিনা চুপচাপ খায়। এই দিয়ে আরো একটা দিন যাচ্ছে বেশ বিবাদ ছাড়াই। এমনি ভাল, এই চুপ করে থাকা। শুধু ওই গোপন হাজার দুয়েক টাকার কথা ব্যাটা না জানলেই হয়। তাই চুপ করেই থাকে। বহুকাল ও বহু অশ্রুব্যয়ে ও এইটুকু জেনেছে আজ, এভাবে কৌশলেই টিকে থাকতে হয়। যেরকম নয়তলায়, কোমরের খাঁজে সাহেবের হাত, বুকের মাংসে মোটা ডাশা আঙ্গুলের চিরবিড়িয়ে ওঠা- এইসব সন্ধ্যার স্নানের পরেই ধুয়ে মুছে শেষ হয়ে যায়, যে রকম রোজ ভোরে শহরের অলিগলি রাজপথ থেকে আবর্জনা ঝেড়ে মুছে নিয়ে যায় ঝাড়ুদার আর শহরটা কেমন গা ঝাড়া দিয়ে উঠে সারাদিন পায়ে চাক্কা লাগিয়ে ছোটে।
আয়না চিরুনি ফিতার কাঠের বাক্সটায় আগের আড়াইয়ের সাথে আরো দুই মিলে সাড়ে চার হয়। চুলে তেল মেখে ফিতা দিয়ে কষে বেনি বাঁধে। টাকাগুলো কাগজে মুড়িয়ে ফিতা টিতার আড়ালে একখানা টিপের পাতার নিচে রেখে বাক্স আটকে দেয়। মনটা ফুরফুর করে। শুতে এসেও বারবার চোখটা বাক্সর দিকে যায়। এমনকি রইস যখন শরীরের উপরে চড়ে বসে, তখনো মনে মনে হিসাবই করে তাহমিনা। পরের মাসে আরো দুই, এই করে করে আরো ছ’মাস পরেই ভালো একটা টাকা জমলে বড় রাস্তার মোড়ে সোনালী ব্যাংকে একখানা হিসাব খুলবে সে। প্রতি মাসে অবশ্য পুরো দুই জমবে না। অন্তত পাঁচ ছশো খরচ হয়ে যাবে।
রইস যখন একসময় শরীর থেকে নেমে গায়ে কম্বল জড়িয়ে ওপাশ ফিরে তীব্রশব্দে নাক ডাকাতে শুরু করে, তখনো মনটায় ফুরফুরে ভাবটা রয়ে গেছে ওর। আলগোছে শাড়িটা বুকের ওপরে ফেলে তাহমিনা ওর কাঁথাটা জড়িয়ে নেয় গায়ে। শীত বাড়ছে। প্রতি শীতে পা জমে ফেটে টেটে একাকার হয়, ব্যাথায় হাঁটতে পারে না। একজোড়া মোজা চাই ওর। আর একটা লাল শাল। সম্ভব হলে হাতের দু’গাছি সোনালী চুড়িও, পাশের ঘরের সাজেদার মত। রাজমিস্ত্রী ফারুক মিয়ার বউ মরিয়মের কাছে জেনেছে, একটা মেলা বসেছে মেইন রোডের ওপারের ক্লাবের মাঠে। কাল সোজা চলে যাবে মেলায়, নয়তলার কাজের পর।
এইসব ভাবতে ভাবতে দু’চোখ মুদে আসে ঘুমে। আধো ঘুমের ভেতরে হিসেব করে নেয়, অন্তত দুশো টাকা কাল ঠিক খরচ করতে পারবে। আর যদি খুব ইচ্ছে হয়, তবে এক প্লেট ফুচকা কি চটপটিও নেবে। মরিয়ম বলেছে, শহরের মেলার চটপটির ম্যালা স্বাদ। অথবা খুব যদি খিদে পায় তাহলে নাহয় হাফপ্লেট তেহারিই কিনে নেবে। মরিয়ম জানিয়েছে, মেলার মাঠে হাফ প্লেট গরুর তেহারি পাওয়া যাবে মাত্র পঁয়তাল্লিশ টাকায়। ঘুমিয়ে পড়ার আগে তেহারির মৃদু সুবাসটা পর্যন্ত টের পায় নাকের ভিতরে। আর বাকি রাত স্বপ্ন দেখে টুকটুকে লাল গরম শালটার, যেটা গায়ে জড়িয়ে ও হেঁটে যাচ্ছে একা ওই বড় রাস্তাটা ধরে।
তারপর ইলেকট্রিক বিল জমা দিতে যাবো। আমার দেরি হবে আসতে। স্বামী অমর বলে, ঠিক আছে।…..
নভেম্বর চলছে। অনির সাথে আজ দেখা হবে তা জানাই ছিল। এই তো ক’দিন আগেই দেখা…..
বুড়িমাসি বলেন,জীবনটা বালির ঘর গো।ঢেউ এলে ধুয়ে যায় জীবনের মায়া।তবু বড় ভালবাসা ওদের দাম্পত্যে।রোদের চাদরের…..
এক ড্রইং রুমে বসে রয়েছে সদ্য কিশোর উত্তীর্ণ তরুণ গোয়েন্দা সজীব। সামনের টেবিলে ছড়িয়ে…..