তুমি এক পলাতকা

পুলক বড়ুয়া
কবিতা
Bengali
তুমি এক পলাতকা

বিস্ময়-বালিকা

পাহাড় ঘুমাইয়া ছিল
পাহাড় ঘুমাইয়া আছে
আমি পাহাড়ের পাশ দিয়া হাঁটিয়া গেলাম।
পাহাড় পাহাড়সমান ঘুম ঘুমাইতেছে
পাহাড় পাহাড়সমান বিশাল ঘুমের বোঝায় স্থবির।
আমি তাহার ঘুমের গা-বেয়ে, ঘুমের অরণ্যে
খুব ঘুরিয়া আসিলাম
বেশ খানিকটা ঘুরিয়া বেড়াইলাম।
নিদ্রিত পাহাড়কে চুমু খাইলাম, সে ঠাহর করিল না
নিদ্রিত পাহাড়কে জড়াইয়া ধরিলাম
তবু তাহার ঘুম ভাঙিল না।
বুঝি, এমন ঘুম ঘুমাইতেছে সে।
তাহার তন্দ্রার
ঠিকানা কী বাহির করিতে পারিলাম না।
তন্দ্রার ঠিকানা খুঁজিয়া খুঁজিয়া মরিলাম,
পথ হারাইয়া ফেলিলাম।
মনে হইতেছে, সে জাগিয়া-জাগিয়া সুখনিদ্রায়।
আমিও একটি দিবাস্বপ্নের মধ্যে ফের
প্রত্যাবর্তন করিলাম, ঘোরাফেরা করিলাম।
তাহার বুকে বুক রাখিলাম, আস্থা চাহিলাম
(তাহাকে জড়াইয়া ধরিয়া আমিও সুখ খুঁজিলাম!)
খুব ডাকিলাম, অতি যত্নে
এটা-ওটার প্রযত্নে

হায়, কপাল আমার

এক বিশালতার কাছে
এক বিপন্নতার কাছে
অসহায় আমি
এতই এতিম নস্যি ছিলাম
( আমার চিরসখা চিরপ্রিয় সেই
ভালোলাগার বিস্ময়-বালিকার কাছে
এক বালক আমি হারাইয়া গেলাম। ) সেই
পর্বতপ্রমাণ বিস্ময়-প্রেমিকার
মাঝে আমি চিরতরেই নিখোঁজ হইয়া গেলাম!
আমি আর ফিরিতে পারি নাই, বোধহয়
তাহার বুকে বুক রাখিয়া ঘুমাইয়া পড়িয়াছিলাম।
হারাইয়া গেলাম।
অবশেষে, তাহার বুকে বুক মিলাইয়া
একদম ঘুমাইয়া পড়িলাম,
একদা গুম হইয়া গেলাম।

ইহা কী তাৎক্ষণিক আমার কোনো স্বপ্ন ছিল,
না,
না,
অকস্মাৎ চাহিলাম, দেখিলাম, পাহাড়ের
বুকে বুক চিরিয়া যে ধারা নামিতেছে
নিসর্গের নিজস্ব নির্ঝর
গহন গহীন গোপন, উহা
আমার বুকের রক্ত, অশ্রুজল
ঈশ্বরের নির্মিত বহুযুগের
ওপার হইতে ঝরিয়া পড়া
আমার বহুদিনের ভালোবাসার প্রতীক

আমার প্রেমের প্রপাত।
আমার প্রেমের নির্ঝর।

 

সম্পন্ন সময়

হে ভবিতব্য তাকাও, তাকিয়ে দেখ
আমার ফেলে আসা দিন-রাত্রি, ধাবমান
রাত্রিদিন, বিগত ও বহমানতা

সত্বা নগ্ন, পেছনে প্রত্নস্মৃতি
সমুখে অবারিত দ্বার
খোলা বাতায়ন
আসন্ন অনাগত এক

হে আগামী আমার
কেবল কালের ধুলো ওড়াও
শুধু কালের ধুলো সরাও
আমাকে হেঁটে যেতে দাও

আমি হেঁটে যাবো
পূর্বজন্ম, পুনর্জন্ম, পুনর্জীবন থেকে
জন্মজন্মান্তরের দিকে, পূর্বসূরিদের প্রতি
এই চিন্ময় পাকা-পিচঢালা পথ পিছে ফেলে
রেখে মৃন্ময় কাঁচা পথ দিয়ে এক
সুনিবিড় শান্ত-সৌম্য-ছায়ানীড়
বিপুল বিন্যাসে
আমার পূর্বপুরুষের ভিটেমাটির ক্রোড়ে
অফুরান ধান, জলভরা আমিষের কাছে
মননের শ্যামলী কালক্রম ষড়ঋতুর সৃজনকলাপটে
একান্ন পূর্ণপ্রাণ
বাঁশ-খড়-মেঠো কুঞ্জের গীতিময় নিকুঞ্জে
কাকডাকা ভোর পেরিয়ে, দিনান্তে, গোধূলি ও
সাঁঝবেলাশেষে, রাত্তির নামতেই
গহন গহিন নিশীথ
নির্জন নিঝুম শিয়র—হাতছানি দেয়
আমাকেই সুরভিত সুখী-সুর আমোদিত সহজিয়া নিভৃত নিলয়ে

গাঁয়ের প্রাচীনগণ প্রবীণ মহীরুহের মতোন
ছায়ায় কায়ায় শান্ত-দাওয়ায়
বয়েসী মনের স্মৃতির-তাওয়ায় এক
সাধসত্র ধরে আছেন
(আমি অবুঝ শিশুর মতো হামাগুড়ি দিয়ে) তার
কাছে পৌঁছুতে চাই
গঞ্জের পাশ দিয়ে ফিরে ফিরে কুলুকুলু
শব্দে ছুট একূল ওকূল
দুকূল ছাপিয়ে এপার ওপার পাড়ি যেন
নদী ও নারী একটিমাত্রায় বিম্বিত
আদি ও অনন্ত: এঁকেবেঁকে যাওয়া
কলসী কাঁখে এক কন্যে
আমার নয়ননৌকায় নিশিদিন
ওঠানামা করে যায়
শৈশবের কলরবের মতো
ভোর কচিকাঁচার মতো
কিচিরমিচির পাখির শব্দ—দুই
মিলেমিশে ভাঙা ঘুম, আহা
বেলা অবসানে অবসর
পুঁথি-পুরাণ-উপকথা
আরণ্যক-আহ্লাদে আটখানা

মন মজে পড়ে রয়, পাড়াগাঁয়
সম্পন্ন সময়ে সমর্পিত সত্বা আমার।

 

আমাকেএকটি কথা দাও

ওগো সঞ্চয়িতা ওগো সঞ্চিতা

আমি তো আমাকে ফিরিয়ে নিইনি
আমি তো আমাকে গচ্ছিত রেখে এলাম
তোমার কথার এলবামে থেকে গেলাম
তোমার কথামতো
তোমার অন্তঃস্থ-বহিঃস্থ উচ্চারণগুলো
বরাবরই আমার খুবই প্রিয়
আমি তোমার অমূর্ত অক্ষরের প্রতিবেশী
আমি তোমার মনোনীত শব্দের
অভিধানোত্তর দ্যোতনা
আমি তোমার বাক্যের অনিবার্য উত্থান
আমি তোমার স্বগত কথার স্বরলিপি-শিখন
আমি তোমার একটি কথার ব্যাকরণ
আমি তোমার না-বলা বাণীর অনুরণন
এই যে লেখাপড়াশোনা—এ-তো এক—
অপ্রকাশিত পুঁথি হাতে পাওয়ার
আগেই তোমার কাছে শেখা
যে অব্যক্ত গ্রন্থটি খুলে আমি
একটি কথাই শিখবো
একটি কথাই জানবো
একটি কথাই ভাববো
একটি কথাই বুঝবো
একটি কথাই লিখবো
একটি কথাই পড়বো
একটি কথাই বলবো
তার অনেক আগেই
অনেক অলব্ধ কথার সমাহার সেই
অপ্রস্তুত অথবা প্রকাশিতব্য গ্রন্থ পাঠের পূর্বেই
তুমি আমাকে শুধু তার একটি কথাই দাও
বীজের মতো আমি তাকে হৃদয়ে বুনবো
বীজের মতো আমি তাকে আত্মায় পুষবো
বীজের মতো আমি তাকে বুকে আগলে রাখবো
তুমি আমাকে সেই একটি কথাই দাও
তুমি আমাকে সেই কথাটিই দাও
কলমে নিয়ে আমি তাকে মনে জুড়ে এক
চমৎকার চারাগাছ করে তুলবো
অনুরাগে-সোহাগে
বিকশিত করে তুলবো কুসুমিত করে তুলবো
সুরভিত হবে সে সুশোভিত হবে সে
ধ্বনিত-প্রতিধ্বনিত হবে সে
কথাটি কথামালা হয়ে
মর্মশোভা-মনোমণিমালা হয়ে নিরহঙ্কার অলঙ্কার হয়ে
তোমার অঙ্গ থেকে আমার অঙ্গে বেজায় বেজে যাবে
আমাকে আলিঙ্গন করবে সে
আমাকে জড়িয়ে ধরে শুভেচ্ছায়-ভালোবাসায়
নিবিড় হয়ে সিক্ত হবে আত্মনিবেদনে মশগুল হবে
কথাহীন আমি ভেসে যাব
কথাহীন কথার স্রোতে আমি ভেসে যাব
কথাহীন কথার স্রোতে আমি তোমার কাছে পৌঁছুবো
কথাহীন কথার স্রোতে আমি তোমাকে জাগাবো
কথাহীন কথার স্রোতে আমি তোমাকে দেখব
কথাহীন কথার স্রোতে আমি তোমাকে শুনবো
কথাহীন কথার স্রোতে আমি ছুটে যাবো
কথাহীন কথার স্রোতে ইচ্ছেগুলো থাক ইচ্ছেমতো

রঙ যেমন তুলি ছুঁয়ে, জড়িয়ে
সাধের কথারা, স্বাদের কথারা
ইজেলের মতো তোমার বাহুডোরে
তোমার বুকের ক্যাম্পাসে-ক্যানভাসে
তোমার ওষ্ঠের প্রসাধন-সাধন হয়ে শুয়ে …

কথাগুলোর একটি প্রদর্শনী করো

সবচেয়ে সুন্দর কথাটি সবচেয়ে প্রিয় কথাটি
একান্ত কথাটি
আমি নিতে চাই
আমাকে উপহার দিও
জানি, তোমার কোটরে লুকিয়ে রাখা
চিরকুটের মতো ঐ গভীর গোপন কথাটি ঠিকানা চায়
জানি, দুই পাহাড়ের মতো বুকের খাঁজ থেকে
তুলে আনা সদ্য তোলা অশরীরী আশরীর
ভাঁজ করা আশু কথাটি নিজেকে নিভাঁজ
সটান ধীরে সুস্থে মেলে ধরতে চায়
হাতের মুঠোয় মুষ্টিবদ্ধ উক্তিটি ছোট্ট
একটি পাখির মতো ছটফট করছে
তুমি তাকে প্রমুক্ত করো
তোমার কথাকে আমার বার্তা কক্ষে—বাগযন্ত্রে
ঢেলে দাও, আমি তার মৌলিক আস্বাদ নেব
শব্দের চে’ দ্রুত, আলোর চে’ তড়িৎ
তোমার মনের মৌনাবেগ, সবেগ হৃদয়
আপাদমস্তক সঞ্চালন করো সর্বাঙ্গে পাঠিয়ে দিও
আমার পানপাত্রে ঢেলে দিও

আমার বুকপকেটে তোমার দেয়া সুগন্ধি
রুমালের মতো ম ম
করবে তোমার সত্তার সুধা—তোমার সমগ্র কথারা—
কথামুখ, কথাসমগ্র

আমাকে অথবা আমার মাথামুণ্ডু-করোটি—আমার বেবাক কথার কারখানা
তোমার স্বাগত কথার ফাঁকে ফাঁকে
আমার পায়ের নখ থেকে মাথার চুল পর্যন্ত হারিয়ে যাবে
তোমার অধরের অক্ষরের গান
কোনো কথার কথা নয়
তোমাকে স্বাগতম—আমি
আমার একটি বেপরোয়া কথা
তোমার বোমার মতো কালো খোঁপার কুন্তলে অথবা কালো গোলাপের মতো কৃষ্ণ-খোঁপার পাপড়ি-দলের মাঝখানে ভাঁজে ভাঁজে গুঁজে দেব

ওগো সঞ্চয়িতা ওগো সঞ্চিতা
দুজনের মাঝখানে জমে আছে অনেক কথা
খোঁড়লে জমে আছে অনেক কথা
আমাকে একটি কথা দাও।

 

তুমি এক পলাতকা

কোমায় চলে গিয়েছিলে ? হাজার-লক্ষ-কোটি বর্ষ!
কে তোমাকে ফেরালো, কে তোমাকে ঘোরালো, কে তোমাকে জাগালো—
কে সেই মহান হেকিম ? প্রেমিক ?
আমার তো দারুন জিগীষা; বোমা মেরে জাগাব। কেন
তুমি আমার কাছ থেকে নিজেকে এমন প্রত্যাহার করে নিলে ?

এত বেশি ঘুম গিয়েছিলে ? এত বেশি ঘুম পেয়েছিল ? এত বেশি ঘুম কেন এসেছিল ? ঘুমের সবগুলো ওষুধ
একসঙ্গে একেবারে খেয়ে ফেলেছিলে নাকি ? কেউ কেউ একবারে খেয়ে নেয়, অসহ্য ঘুম পায় তার, তাকে টানে চুম্বক ঘুম, ঝুঁকিপূর্ণ ঘুম, এতে খুব বিপজ্জনক ঘুম হয় তার, ঘুমের বিশদ বীজ সুবিশাল সুবিপুল মহীরুহ মহাঘুম তাকে হাতছানি দেয়, কাছে ডাকে, একটানা বেড়ে ওঠে ঐ ঘুম, সুউচ্চ সুদীর্ঘ ঘুম, কারো কারো ঘুমোবার কি যে সাধ হয়, এত ঘুম পায়, ঘুমুতে চায়, ঘুমুতে যায়, কেউ কেউ শুয়ে পড়ে দূরপাল্লার দূরযাত্রায়, আবার চুলের ভেতরে সুলক্ষণা আঙুলের ডুব সাঁতার কাউকে কাউকে সুনিবিড় ঘুমের নিজবাসভূমে নিয়ে যায়— ঘুমুতে শেখায়, গভীর আলিঙ্গনে ভরে নিয়ে দুবাহু পাঁজাকোলা করে ঘুমের পালঙ্কে তুলে দেয়, কোনো এক দরদী ঘুম বুঝি তোমাকে উজাড় করে নিজেকে সঁপে দিয়েছিল নির্ঘুম ? এতটা নির্দয় ঘুমুলে তুমি ? এমন আত্মকেন্দ্রিক ঘুমে আহ্লাদিত হলে, স্বার্থপরের মতো আচ্ছন্ন-আচ্ছাদিত হলে ? এ কেমন ঘুম ঘুমুলে তুমি ? সে কেমন ঘুমের দেশ?

তো সেই নিদ এসেছিল দেবদূতের মতো, তো সেই নিদ এসেছিল দেবতার মতো, তো সেই নিদ এসেছিল ভারী নেশার মতোই, শর্বরী কি ঘুমের পেয়ালা উজাড় করে দিয়েছিল ? ঘুমে ঢুলু ঢুলু টইটম্বুর দুচোখের পাতা টলে উঠে ঘুমের অতল দীঘিতে সম্বিত হারালো, ডুবে গেল ? চুর চুর বুঁধ হয়ে গেলে, দুর্বলতায় অবসাদে হুঁশ হারিয়ে ফেলেছিল ? বেহুঁশ তোমাকে নিয়ে পালিয়ে গিয়েছিল, তোমাকে নিয়ে লুকিয়ে পড়েছিল?
তুমি সেই এক হারিয়ে যাওয়া ? প্রিয় পলাতকা ? আমার পরম হাওয়া?

পুলক বড়ুয়া। কবি। জন্ম বাংলাদেশের চট্টগ্রামে। লেখাপড়া করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। প্রকাশিত গ্রন্থ: ‘ওই পূর্বে রাঙা সূর্যে’, এবং ‘পাঠেরা খেলছে মাঠে’।

এই বিভাগের অন্যান্য লেখাসমূহ