তুলে রাখা কিছু ছেলেবেলা (পর্ব ১)

সাঈদা মিমি
ধারাবাহিক, নন ফিকশন
Bengali
তুলে রাখা কিছু ছেলেবেলা (পর্ব ১)

১৯৭৭ সাল, স্মৃতি থেকে বলছি। আমার স্মরণ রাখার ক্ষমতা জন্ম নিয়েছে, পাঁচ কিংবা ছয়। আমি জানি ,আমার নিবাস মানিকগঞ্জের শিবালয় থেকে আরও সাত মাইল ভিতরের একটা নিখাঁদ গ্রামে, মাচাইন ঘোনাপাড়া । তখনও বুঝিনি, আমার বোঝার কথাও নয়, জন্মশেকড়ের কাছে আমার জীবন শুরু হলো । একটা পাড়া গাঁ , ছেড়া ছেড়া জনপদ, বল্গাহীন উদোম প্রকৃতি, আগলে রাখার মত অনেক ভালোবাসার মুখ, জীবন শুরু হলো নানীমায়ের কাছে ।

এখানে একটা বিষয় পরিস্কার করা দরকার, কেন আমি আমার পরিবার থেকে দুরে? কারণটা জটিল নয়, বরিশাল শহরে আমাদের যৌথ পরিবার । বাবা-মা, দুই কাকা-কাকিমায়েরা এবং দুই ফুপু-ফুপারা. ভাইবোন অনেক. আছেন দাদি মা । তিনটে ব্যাবসা প্রতিষ্ঠান আমাদের, কর্মচারী, দরিদ্র আত্মীয়স্বজন, কাছের দুরের লোক এবং পরিবারের বড় গিন্নি আমার মা । তার মানে এই নয় মা সব কাজ করতেন! কাজের মানুষ, বাবুর্চি সবই ছিলো এবং বড় বৌ হিসেবে মায়ের দায়িত্ব ছিলো অনেক বেশি । আমাদের যত্নাদি ঠিকমত করতে পারতেন না, তাই বিকল্প ব্যাবস্থাটি বেছে নেন বাবা । একমাত্র বড়’দা পরিবারচ্যুত হন নি কিন্তু আমরা বাকি ছয় ভাইবোন বেড়ে উঠেছি মানিকগঞ্জের নিঝুম গ্রাম ঘোনাপাড়ায় ।

ভূমিকা গেলো ,একলাফ দিয়ে শিক্ষাজীবনে চলে আসি। একলাফেই আসতে হবে কারণ আমাকে একবারে ভর্তি করিয়ে দেয়া হলো ক্লাস থ্রি তে! ঘরে বসেই পড়েছি অন্যান্য ক্লাস । কি মুশকিল! আমার বয়স তখন মাত্র সাত । গ্রামের স্কুলের সরল যে বৈশিষ্ট্য আমাকে আকর্ষণ করতো, তা হলো, আমরা কোন নির্দিষ্ট ইউনিফর্ম পড়তাম না। বেশিরভাগ ছেলেমেয়েদের পায়ে থাকতো মাচাইন অথবা বাল্লা বাজার থেকে কেনা স্পঞ্জের স্যাণ্ডেল, আমরা বই নিতাম বগলদাবা করে, রোদ কিংবা বৃষ্টি থাক আমরা দেড় মাইল হেঁটে স্কুলে যেতাম, আমাদের কারো কারো ছাতা ছিলো, কেউ কেউ কলাপাতায় মাথা ঢেকে চলে আসতো, টিফিন নামক জিনিসটার সাথে আমাদের  পরিচয় ছিলো না । ছেলেমেয়েরা একসাথে ক্লাস করতো, ছেলেদের আর মেয়েদের বেঞ্চি আলাদা ।

আমাদের দুইটা সূর্যঘড়ি ছিলো, একটা আমাদের উঠানে, আরেকটা শিমুদের । ঠিক সকাল নয়টার রোদ  পুতে রাখা কাঠের টুকরায় এসে পড়লেই আমরা বুঝে যেতাম, স্কুলে যাবার সময় হয়েছে । শিমু আমার মামাতো ভাই এবং আমরা একই বয়েসি, আর আমরা দুটোই কপাল পোড়া, একসঙ্গে ক্লাস থ্রী! দুটোই ক্লাসে সবচেয়ে ছোট আর যারা পড়ছে, মিয়াদের বেটাবেটি কিংবা গৃহস্থের, সবাই আমাদের চেয়ে দুই তিন বছরের বড় কিন্তু আমরা সবাই সবার বন্ধু । আমি আর শিমু একসাথে স্কুলে যাই, অর্ধেক পথ এসে আমরা জোড়া জামগাছের নীচে বসি, অদ্ভুতভাবে বেড়ে ওঠা দুইটা গাছ, একটার নাম শিমু, আরেকটা মিমি। নামকরণ আমাদেরই করা, আর আমাদের স্কুলের নাম, মালুচি সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয় ।

আমার একজনই মাত্র প্রাণের বন্ধু, মমতা সাহা। মমতা আমার দেড়গুন লম্বা, ক্লাসের সবচেয়ে জ্যাঠা বালিকা । ও পাইনা বাড়ির মেয়ে,  অনেকগুলো পানের বরজ আছে ওদের । আমার এবং মমতার বন্ধুত্ব একটা স্বর্গীয় সমন্বয়, আজ পর্যন্ত মমতার মত সরল মেয়ে আমি একটাও দেখিনি । একবার মমতাদের বাড়ি গেছি, রোজই তো যাই, ওর মা নাড়ু… মোয়া… কত কি খাওয়ায়! কিন্তু সেই একবার আমাকে ওদের রান্নাঘরে ঢুকিয়েছিলো মমতা। বেঁধে গেলো লংকাকাণ্ড! মমতার ঠাকুমা এলেন তেড়ে, পবিত্র জলটল ছিটানো হলো । সেবার আমি খুব ভয় পেয়েছিলাম, জাত ধর্মের রেষারেষি দেখে । মাসি মা আমায় বুকে জড়িয়ে বারবার বলছিলেন, কষ্ট নিস না মা, পুরান দিনের মানুষ, আমাগের নগেও কেম্বা সব কীর্তি করে । না, আমি কিছু মনে করিনি, পরে শুনেছি মমতা নাকি ভীষণ ক্ষেপে গিয়েছিলো ওর দাদির ওপর। একটা জপমালা তার সামনে ঝুলিয়ে বলেছিলো হিদু মোছলমান কি জিনিস দাদি? এই দ্যাহো আমরা জপমালা জপি, অরা তসবি জপে ।

মমতা তোর কথা আমি কোনদিনই ভুলতে পারবো না । আমরা একসাথে বৈশাখি উৎসব করেছি, ঈদ পূজায় আনন্দ করেছি, মালুচি স্কুল মাঠে বৌ চি খেলেছি, পুতুলের বিয়ে দিয়েছি, ছেঁচুনি দিয়ে ছেঁচে পান খেয়েছি, কীর্তনের আসরে বসে মাথা দুলিয়েছি, নৌকা বাইচের সঙে পাল্লা দিয়ে ছুটেছি, বৃষ্টিতে পিছল ঢালের উপর থেকে গড়িয়ে নেমেছি ইছামতির জলে, প্রতিমা বিসর্জন দেয়ার পর তোর দেখাদেখি আমিও কেঁদেছি । সেই প্রতিমারও তো বিসর্জন হলো, আমার প্রতিমা ছিলি তুই, জানতিস কি? বাচ্চা জন্ম দিতে গিয়ে টুপ করে মরে গেলি এই আমারই হাতের ওপর। সেই আতুরঘরে তোর সেই অন্তিম চাহনি আমি কোনদিন ভুলবো না । তোর চিতার পাশে বসেছিলাম। সেই প্রথম, সেটাই শেষ। আর কোন চিতার সামনে আমি দাঁড়াইনি, এমনকি কবর খোঁড়ার দৃশ্য দেখতেও না। আমার প্রথম সন্তান জন্মেছিলো মৃত, আমি তার ছোট্ট শরীরটাকে ছুঁয়ে দেখতে পেরেছি কেবল, তাকে কোলে নিতে দেয়া হয়নি আমাকে । সেই অনাঘ্রাত হেমন্তের দিকে তাকিয়ে নীরব জল গড়িয়েছিলো প্রতিমা হারানোর কষ্টের মতন। আমার যা প্রিয়, তা এভাবেই কেন হারায়?

শিমু আমার বন্ধু? কিন্তু ওতো আমার ভাই! কেবলই খবরদারি, মালুচি স্কুলের উত্তরদিকে ওর দাদাবাড়ি, আমারও তো নানাবাড়ি! দুপুরে আমার খিদে পেতো, স্কুলে তখন আধাঘন্টা বিরতি আমরা ওখানে দুপুরে খেতাম । শিমুর সাথে এই ভাব তো ঐ ঝগড়া। আমাকে খোঁটা দিতো, আমার দাদাবাড়িতে খাইবার আইছাস ক্যা? আমিও সমান তেজে উত্তর দিতাম, তুই আমার নানাবাড়িতে খাইতাছাস কোন সাহসে? শুরু হয়ে গেলো ঝগড়াপর্ব।  নানি অর্থাত মায়ের মামি অনেক কষ্টে মিটমাট করে দিতেন। যদিও দুদিন পরেই সেই কাহিনীর পুনরাবৃত্তি । দিন দ্রুত অতীত হচ্ছে, নিকট থেকে দুর অতীত । একরাতে প্রবল ঝড় হলো, কয়েকদিন রইলো তার রেশ, মানিকগঞ্জ ঘূর্ণিঝড় প্রবণ এলাকা । কেমন ভুতুড়ে এক ছন্নছাড়া অবস্থা, আমরা স্কুলে গেলাম ঝড় কমার কিছুদিন পর, শিমু এবং মিমি দু’টো গাছই উপড়ে আছে পথের ওপর।  আমরা দুইজন দুখি ভাইবোন পরস্পরকে ধরে দীর্ঘসময় কাঁদলাম, আমাদের শেকড় উড়ে গেছে ।

বাবা-মা এসেছেন বরিশাল থেকে, বছরে দুইবার আসেন তারা। আমাদের অনেক ফসল ওঠে যেই সময়গুলোতে তখন । প্রসঙ্গত বলতেই হবে, আমাদের মামার বাড়ির সাথেই আমার মায়ের লাগোয়া ভিটা, বাবাই এটা কিনে দিয়েছিলেন মাকে।  আমার মায়ের ভিটা আমাদের মামাদের জায়গার দ্বিগুণেরও বেশি, আমরা কোনদিন মামাদের ওপর নির্ভরশীল ছিলাম না। আমাদের জমির ফসল তো ছিলোই, বাবা সারা বছরের রসদ পাঠাতেন বরিশাল থেকে । এবারও অনেক কিছু নিয়ে বাবা মা এসেছেন কিন্তু বাবা বেশ চিন্তিত, আমার আজীবন শুদ্ধভাষী বাবা আবিষ্কার করেছেন আমি মানিকগঞ্জের আঞ্চলিক টানে কথা বলি। ততদিনে পঞ্চম শ্রেণির বার্ষিক পরীক্ষা শেষ ।

১৯৭৯ সাল, ইছামতি নদীতে তখন ছোট লঞ্চ চলতো। পঁয়ত্রিশ বছর আগের কথা, আমার সামনে কোন নোটবুক নেই, স্মৃতি থেকে লিখছি । পঁয়ত্রিশটা বছর গড়িয়েছে! এইতো আমার চোখে ভাসছে, আমি একটা বাসন্তি রঙের ফ্রক পড়া, কাঁদছি আমাদের পূবের বাঁশঝোপের নিচে। বরিশালে যাবো না আমি, বাবা আমাকে একেবারেই নিয়ে যাবেন এবার । ততদিনে আমাদের যৌথ দেয়াল আলাদা হয়েছে, কাকা কাকিমায়েরা আলাদা, ফুপুরা, দাদি থাকছেন ছোটকার সঙ্গে । অসম্ভব আদব নিয়ে বলছি, দাদি আমাদের অসম্ভব ভালোবাসতেন । আমি তাঁকে অসম্ভব অনুভব করি । দাদি মারা যান লালাগ্রন্থির ক্যান্সারে । অনেককাল পর সোলঝেনিৎসিনের ‘দ্যা ক্যান্সার ওয়ার্ল্ড’ পড়তে পড়তে আমার মনে পড়ে গিয়েছিলো, সেই সময় যখন ক্যান্সারের চিকিৎসা আধুনিক হয়নি, আমার দাদি তিনটে বছর লড়েছিলেন সেই অসুখের বিরুদ্ধে ।

বেলা ফুরিয়ে এলো, ছোট্ট লঞ্চে চেপে যাত্রা শুরু করেছি।  লঞ্চ ভিড়বে উথলিতে, সেখান থেকে আমরা লোকাল বাসে চেপে শিবালয় যাবো, তারপর পায়ে হেঁটে পাটুরিয়া। সেখান থেকে পদ্মা পাড়ি দিয়ে আসবো দৌলতদিয়া। একটু এগোলেই বি আর টি সি বাস, সেই বাসেই সরাসরি বরিশাল । শিমু দাঁড়িয়ে আছে নদীর পাড়ে, হতভাগা কাঁদছে! আমিও কাঁদছি। হ্যাঁ, আমি কাঁদছি, বানের জলের মত নামছে বুক মুচড়ানো তপ্ত জলধারা । ওরে, আমরা কেউ প্রকৃতির ঈঙ্গিত বুঝতে পারিনি! আমাদের জামশেকড় তো উপড়ে দিয়েছে ঘুর্ণিঝড়! মমতাকে কিছু বলিনি, আমার সাহসে কুলায়নি । আমি শেকড় উপরে চলে যাচ্ছি, ক্রমশ ঝাঁপসা হয়ে আসছে ঘোনাপাড়া-মাচাইনের সীমানা ।

সাঈদা মিমি। জন্ম ২৯ ফেব্রুয়ারী ১৯৬৮। ছাত্রজীবন থেকে লেখালেখি শুরু। প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ সব নিয়ে গ্যাছে এক সময়ের লুটেরা বাতাস ফারাও কুমারী একজন মৃতের ডায়েরী শুশুনিয়া পাহাড় ঔরঙ্গজেবের নীল ঘোড়া (গল্পগ্রন্থ) কীর্তনখোলা (প্রকাশিতব্য কাব্যগ্রন্থ) পেশাগত জীবনে একজন ফ্রি ল্যান্সার সাংবাদিক।

এই বিভাগের অন্যান্য লেখাসমূহ